#প্রিয়_বিকালফুল(৩১)
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
বিয়ে বাড়ি শাশুড়ির সাথে দুদিন আগেই এসেছে নিতু। খালাশাশুড়ির ছেলের বিয়ে আগামীকাল। আজ ছোটখাটো আয়োজনে হলুদের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাড়ি এবং বাড়ির মানুষগুলো নতুন হলেও সেটা কিছুতেই মনে করতে দেয়নি তারা। বিশেষ করে নিতুর খালাশাশুড়ির বড় ছেলের বউ আর মেয়েটা এত মিশুক যে দুদিনেই নিতুর সাথে গভীর ভাব জমিয়ে ফেলেছে। নিতু এ বাড়িতে আসার পর থেকে খালাশাশুড়ির মেয়ে অর্থাৎ রিশা সবসময় সাথে সাথে আছে। রাতে অন্যকাউকে নিজের সাথে না রেখে নিতুকে রাখছে। রাতে দুজনের কত গল্পগুজব!
রাতে হলুদের অনুষ্ঠান হবে। বাসার সবাই মিলে ছাদে স্টেজ সাজিয়েছে। সন্ধ্যা পরপর সাজানো মোটামুটি শেষ হলে নিতু, রিশা আর তার ভাবি মালিহা তিনজনে একসাথে নিচে এলো। তিনজন একসাথে ফ্রেশ হয়ে রেডি হবে বলে ঠিক করল। তিনজন একসাথে ওয়াশরুম খালি পাবে না তাই রিশা নিতুকে ফ্রেশ হতে বলে আগে আগে নিজের মায়ের রুমে চলে গেল। নিতু ফাঁকা রুম পেয়ে এতক্ষণে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। ড্রয়ার থেকে নিজের ফোনটা বের করে দেখল উৎস বেশ কয়েকবার কল করেছিল। ফ্রেশ হতে যাওয়ার আগে একবার কথা বলবে ভেবেই কলব্যাক করল সে। একে একে কয়েকবার রিং হলো কিন্তু রিসিভ হলো না।
কেটে গেছে বেশ কয়েক মাস। উৎস একটাবারও বাড়িতে আসার সুযোগ পেয়ে ওঠেনি। খালাতো ভাইয়ের বিয়েতে অন্তত আসার কথা ছিল তার কিন্তু সেখানেও শেষ মুহূর্তে এসে নাকচ করে দিয়েছে। উৎসের ছুটির কথা মাথায় রেখেই এ বাড়িতে বিয়ের তারিখ ঠিক করা হয়েছিল কিন্তু উৎস গতকাল রাতেই জানালো সে কিছুতেই আসতে পারবে না। উৎস আসতে পারবে ভেবেই নিতু আগেই এখানে এসেছে শাশুড়ির সাথে।
নিতু বারবার চেষ্টা করা সত্ত্বেও কল রিসিভ হচ্ছে না দেখে ফোনটা ওভাবেই রেখে নিজের জন্য বরাদ্দ করা পোশাকটি নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। হাতে ততটা সময় নেই৷ ফ্রেশ হওয়ার পর সাজগোজেও অনেকটা সময় লাগবে।
প্রায় পুরো বাড়ির মানুষ ছাদে চলে গিয়েছে অনেক আগেই৷ বাড়ির সদর দরজা পেরিয়ে কেউ বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করল। বাড়ির বাহিরে থেকে শুরু করে ভেতরে অনেকটা অংশে মরিচবাতি দিয়ে সাজানো। এক পা, দুই পা করে এগিয়ে এলো আগন্তুক। একপাশে দাঁড়িয়ে কল করল রিশার নম্বরে। রিসিভ হলো সাথে সাথে। মিনিট খানেক কথাও হলো। এরপর ফোনটা পকেটে রেখে পা বাড়ালো রিশার রুমের দিকে।
নিতু ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুমের দরজা খুলতেই দেখল রুমের লাইট বন্ধ। হাতের ভেজা কাপড়গুলো নিয়ে কোনমতো বেলকনির দড়িতে মেলে দিয়ে পুনরায় রুমে ফিরে এলো। অন্ধকারে ধীরে ধীরে পা ফেলে এগিয়ে চলল স্যুইচবোর্ডের দেয়ালের দিকে। পায়ের সাথে কিছু একটা বাঁধতেই হোঁচট খেলো নিতু। পড়তে পড়তে নিজেকে বাঁচিয়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল সে। অন্ধকারে দেয়াল হাতড়ে স্যুইচবোর্ডও খুঁজে পেল। বাল্ব জ্বা*লানোর পূর্বেই রুমে কারও উপস্থিতি টের পেল নিতু। সেদিকে ধ্যান দিয়ে অন্ধকারে এক জোড়া হাত এসে স্পর্শ করল নিতুর কোমর।
নিজের শরীরে কারও স্পর্শ বুঝতে পেরে ইন্দ্রিয়গুলো সজাগ হলো নিতুর। এক মুহূর্ত দেরি না করে তড়িৎ গতিতে দুই হাতের ওপরে হাত এবং সামনে পেট বরাবর আঘা*ত করল। “আহঃ” শব্দ করে কেউ পিছিয়ে গেল। নিতু রুমের লাইট অন করেই পিছনে ঘুরে তাকালো। উৎস পেটে হাত দিয়ে এক হাতে হাঁটুতে ভর দিয়ে নিতুর দিকে তাকিয়ে হাসছে। উৎসকে এই অবস্থায় দেখে বেশ অবাক হলো নিতু৷ সে ভেবেছিল বিয়ে বাড়ির কেউ হয়তো তার ওপর খারাপ নজর থেকে এগুলো করার সাহস করেছে তাই আঘা*ত করেছিল সে। ঘটনা সম্পূর্ণ বিপরীত দেখে তাড়াতাড়ি করে উৎসের দিকে এগিয়ে গেল। ততক্ষণে উৎস সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিতু দৌঁড়ে উৎসের কাছে এসে ডান হাতে পেটে আঘা*ত করা স্থানে হাত রেখে বলল,
“এরকম কেউ করে? কখন আসলে তুমি? তুমি তো বলেছিলে আসতে পারবে না।”
উৎস বুকপকেট থেকে গোলাপ তিনটে নিতুর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ”এতগুলো মাস পর ফিরলাম বউয়ের যত্ন পেতে, আদর পেতে আর বউ কি-না ছক্কা হাঁকালো আমার পেটে!”
নিতু ফুলগুলো হাতে নিয়ে উৎসকে টেনে বিছানায় বসালো। মুখ গোমড়া করে বলল,”একদম নাটক করবে না। এত শক্ত বডিতে কীভাবে আমার আঘা*ত জোড়ালো হবে? এসেছ কখন সেটা বলো। আমার কত মন খারাপ হয়েছিল তুমি জানো? তুমি আসবে বলে আম্মার সাথে আগে আগে চলে এলাম এখানে আর তুমি পরে জানালে যে, তুমি আসবে না। তারপর আবার এখন এখানে। আমি কীভাবে বুঝব, অন্ধকারে আমাকে স্পর্শ করা হাতটা আমার বরের ছিল!”
উৎস নিতুকে নিজের দিকে টেনে কাছে বসালো। মৃদু গলায় বলল,“আগেই সব বলে দিলে, এই মানুষটার মুখে এমন খুশি দেখতে পেতাম?”
“কিছুক্ষণ আগে অবধিও মন খারাপ রেখে এখন এসেছেন খুশির ক্রেডিট নিতে?”
“খুশি হওনি?”
“আগেই এলে এই খুশিটা কতগুণ বেড়ে যেত আইডিয়া আছে? তবে সত্যিই আমি ভাবতে পারিনি তুমি আসবে। আমি তো ভেবেছিলাম গত কয়েক মাসের মতো আমাকে এখনো অপেক্ষায় থাকতে হবে। সবাই কত আনন্দ করছিল! বাহিরে বাহিরে আমি ভালো থাকলেও তোমাকে ছাড়া এত মানুষের ভিড়েও নিজেকে একা একা লাগছিল আমার।”
উৎস শার্টের ওপরের তিনটা বোতাম খুলতে খুলতে বলল,“আরও অভিযোগ আছে?”
নিতু উৎসের চোখে চোখ রেখে নির্দ্বিধায় বলল,“আছে তো। জমিয়ে রাখি পরে বলব। এখন সময় নেই।”
“আমার জন্য?”
“কথায় ফাঁসিয়ে দিচ্ছো কেন? এখনই রিশা আর ভাবি চলে আসবে৷ আমরা তিনজনই তৈরি হওয়া বাকি। আমার সবটুকু সময় তো তোমার জন্যই। শুধু মাঝেমাঝে একটু সময় অন্যদের দিতে হয়। তাছাড়া আমি তোমার জন্য এতগুলো মাস অপেক্ষা করেছি আর তুমি করবে না?”
উৎস দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল,“ভাবছি এবারে তোমাদের আমার সাথে নিয়ে যাব৷ আম্মাকে রাজি করাও।”
“আম্মা কিছুতেই যাবে না। ওসব ভুলে যাও। আমিও ওখানে গিয়ে থাকতে পারব না।”
“এটা কোন কথা! অন্যদের বউরা তাদের বরদের সাথে যাওয়ার জন্য বায়না ধরে আর তুমি! বউ ছাড়া থাকতে হবে আমার?”
“জি মশাই৷ আপাতত ওসব বাদ দিন৷ এখন আপনি ফ্রেশ হয়ে সোজা ছাদে চলে যান। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।” বলেই উঠে দাঁড়ালো নিতু।
উৎস নিজেও উঠে দাঁড়ালো। মুখ গোমড়া করে বলল,“এতদিন পর এলাম। বউ একবার বুকে আসবে না?”
নিতু মৃদু হাসলো৷ এত অপেক্ষার পর প্রিয় মানুষকে কাছে পেয়ে এমনি এমনি ছেড়ে দেবে সেটাও কি নিতুর পক্ষে সম্ভব নাকি? এতগুলো দিন এই বুকটার জন্য নিজের বুকে ব্যথা পুষেছে সে। মাথা না রাখতে পারার কষ্টে ভেতরটা ক্ষ*তবি*ক্ষ*ত হয়েছে সেটা কি সামনে দাঁড়ানো মানুষটা জানে না?
নিতু আলতো করে উৎসের বুকে মাথা রেখে, জড়িয়ে ধরল উৎসকে৷ হৃদয় যেন শীতল হলো উভয়ের। প্রিয় মানুষকে কাছে পাওয়া ঠিক কতটুকু আনন্দের সেটা হয়তো শুধু দূরত্বে অবস্থান করা মানুষগুলোই টের পায়।
হলুদের আনন্দ শেষ হলো প্রায় রাত দুইটার দিকে। অনেকদিন পর আত্মীয়স্বজন একসাথে হয়েছে। গল্পগুজব, আড্ডা, নাচ-গান, হাসি-ঠাট্টা সব মিলিয়ে সময়টা জমজমাট ছিল। অনুষ্ঠান শেষ ঠিক করা হলো, ছেলেরা সবাই ছাদে থাকবে আর ছোট বাচ্চা বা মহিলা যারা আছে সবাই নিচে বিভিন্ন রুমে যেখানে যে জায়গা পাবে সেখানেই থাকবে। বাড়ির গিন্নির এমন ঘোষণা শুনে নিজের রুমের মায়া রিশা কিছুতেই ছাড়তে পারল না। অনুষ্ঠান শেষ হতে হতেই নিতুসহ নিজের বড় ভাবিকে নিয়ে নিজের রুমের দিকে রওয়ানা দিল সে। বড় ভাবি মালিহার রুম এবং আরও কয়েকটা রুমে অন্য আত্মীয়দের থাকার ব্যবস্থা করা হলো।
আগামীকাল সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠতে হবে এই চিন্তা মাথায় নিয়ে সবাই তাড়াতাড়িই শুয়ে পড়ল। তাড়াতাড়ি ঘুমোবে বলেও পাশের দুজনের গল্প চলছে। দুজন যেন তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে তাই নিতু কোন কথাও বলছে না। নিচে রুমে আসার সময় উৎস বলে দিয়েছে সবাই ঘুমিয়ে গেলে যেন সে একটু বাহিরে আসে। নিতু চুপচাপ শুয়ে শুয়ে রিশা এবং মালিহার ঘুমোনোর অপেক্ষা করছিল। দুজনের ঘুমোনোর কোন নামই নেই৷ বিয়েতে কী কী করবে, পরবে সেসবের গল্প এত রাতে হচ্ছে৷ ওদিকে উৎসের ফোন, মেসেজ আসছে একের পর এক। নিতু না পেরে ফোনটা অনেক আগেই সাইলেন্ট করে রেখেছে। দুজনের চোখ এড়িয়ে শুধু ছোট করে একটা মেসেজে জানিয়েছে পাশের দুজন ঘুমিয়ে গেলেই সে বের হবে।
দশ মিনিট, বিশ মিনিট, আধাঘণ্টা পেরিয়ে প্রায় ঘণ্টা পার হতে চলল। দুজনে কিছুক্ষণ আগেই কথাবার্তা বন্ধ করে চুপ হয়েছে। নিতুর চোখ ঘুমে ভারি হয়ে আসছিল। বারবার চোখ মুছে নিজেকে জাগিয়ে রেখেছে। পাশের দুজনের চুপচাপ হয়ে যাওয়ায় একটু যেন স্বস্তি মিললো। তবুও অপেক্ষা করল আরও দশ মিনিট। তারা ঘুমিয়ে পড়েছে নিশ্চিত হয়ে উৎসকে মেসেজে বলল বাহিরে এসে দাঁড়াতে। নিজেও আলগোছে শোয়া থেকে উঠে বসলো। কোন রকম শব্দ না করে উঠে খাটের সাইডে এসে দুইপা মেঝের দিকে ঝুলিয়ে দিতেই রিশা হেসে উঠল। পাশে থেকে মালিহা বলে উঠল,
“বরের কাছে যাওয়া হচ্ছে? আজ তো সেটা হবে না। বরকে আজকের রাতের মতো ভুলে যাও।”
নিতু জিহ্বায় কামড় দিয়ে খিঁচে দুই চোখ বন্ধ করে নিল। পরক্ষণেই আমতা আমতা করে বলল,
“না মানে, ভাবি….”
নিতুর হাতের ফোনে আলো জ্বেলে উঠতেই রিশা হাত থেকে ফোনটা কেড়ে মালিহার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,“দেখো দেখো, ভাইয়া কল দিয়েছে।”
মালিহা কলটা রিসিভ করল। ওপাশে থেকে উৎস বলে উঠল,“কোথায় তুমি? আমি লনের দিকে অপেক্ষা করছি। এদিকেই এসো।”
মালিহা হেসে বলে উঠল, ”বউ আজ যাবে না, দেবর সাহেব। আজকের রাতটা বউকে আমাদের কাছে রেখে নিশ্চিন্তে ছাদে গিয়ে ঘুমান।”
#চলবে……