#প্রিয়_বিকালফুল(৩৪)
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
নিতু ত্রস্তপায়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। ড্রয়িংরুমের আলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। নিতু বাহিরে এসে ফোনের ফ্ল্যাশলাইটটা অন করতেই দূর থেকে কারও ফিসফিস আওয়াজ শুনতে পেল। কণ্ঠস্বর মেয়েলি। সামনের দিকে আলো ধরে বলে উঠল,
“কে ওখানে?”
পরিবেশ নিস্তব্ধ হলো। কেউ আর কোথাও কথা বলছে না। সামনে দিক থেকে কোন আওয়াজ শোনা যাচ্ছে না। নিতু ওভাবেই দেখার চেষ্টা করল অতঃপর কাউকে দেখতে না পেয়ে ড্রয়িংরুমে লাইট অন করল। এদিক ওদিক একবার চোখ বুলিয়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে রান্নাঘরের দিকে যাবে তখনই হঠাৎ ”ভাবি, কোন দরকার?” বলে বেরিয়ে এলো রিশা।
নিতু দাঁড়িয়ে গেল।
“তুমি ছিলে ওপাশে?”
রিশা নিতুর কাছাকাছি এসে বলল,“হ্যাঁ।”
“কারও সাথে কথা বলছিলে?”
রিশা মুচকি হেসে মাথা চুলকে বলল,“ওই আর কী….”
নিতু বেশ উৎসাহ নিয়ে শুধালো,“বয়ফ্রেন্ড?”
“হুম। সমানে কল করছিল, বসে থাকতে পারছিলাম না তাই একটু কথা বলছিলাম। ওপাশ থেকে আম্মা বেরিয়েছে তাই কথা বন্ধ করে চলে আসতে হলো।”
“লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম করার মজাটাই আলাদা।”
“সেই মজা তুমি পেলে না৷ বিয়ের পরের প্রেমটা কেমন লাগছে? আমার ভাইয়া বর হিসেবে কেমন?”
নিতু হেসে দুচোখ খিঁচে বন্ধ করে বলে উঠল,“দারুণ! বলতে পারো সেরা একজন মানুষ।”
“আমার ভাইয়া বলে কথা!”
নিতু রান্নাঘরের দিকে এগুতে এগুতে বলল,“তোমার ব্যাপারে তো কিছু বললে না?”
দুজনে রান্নাঘরে প্রবেশ করল। নিতু চুলায় পানি গরম বসিয়ে চায়ের বন্দোবস্ত করতে করতে ফের শুধালো,
“রিশা, কিছু বললে না এখনো।”
রিশা র্যাক থেকে কিসমিসের কৌটা নিয়ে একের পর এক খেতে থাকলো। ফোনটা পাশে রেখে বলল,
“ও জুবায়ের। পড়াশোনার জন্য বাহিরে ছিল। আর্কিটেক্ট। গতকালই দেশে এসেছে। ফোন করে, মেসেজ করে বারবার দেখা করতে বলছে। এদিকে বিয়ের বাড়ির আমেজ, বাড়ি থেকে সবাই এখনো যায়নি। কত ব্যস্ততা! এসবের মাঝে আমি তার সাথে দেখা করব কীভাবে বলো, ভাবি?”
“সে এতদিন পর বাহিরে থেকে দেশে ফিরল আর প্রেমিকাকে দেখবে না? এটা কোন কথা?”
রিশা মুখ গোমড়া করে জানতে চাইলো,“কিন্তু কীভাবে? সম্ভব হচ্ছে না তো।”
“তোমার দেখা করতে ইচ্ছে করছে না?”
“খুব! মনে হচ্ছে এখনই সম্ভব হলে এখনই দেখা করতাম। কতগুলো বছর সামনাসামনি দেখা হয় না আমাদের!”
“সম্পর্ক কতদিন তোমাদের?”
”গুনে গুনে সাত বছর।”
“মানে একদম স্কুল লাইফ থেকে!?”
“জি।”
“এত বছর টিকে আছে! বাহ। তবে এবার বিয়ে করে নেওয়া প্রয়োজন। ভালো ছেলেকে হাতছাড়া কোরো না। একটা সুন্দর সম্পর্ক তৈরি হয় বিয়ে থেকে। বিয়ে ছাড়া এসব সম্পর্ক যত বছরই টিকুক না কেন, এসব ঠুনকো। যখন তখন ভেঙে যেতে পারে। বিয়ে করো, দেখবে কবুল বলার পর থেকেই কেমন অদ্ভুত ভালোবাসা আর মায়া তৈরি হবে।”
রিশা কিসমিসের কৌটা পাশে রাখল। মুখ মলিন করে ফেলল। তারও মনে হয় বিয়ে করে নেওয়া উচিত। জুবায়ের নিজেও অনেক আগে থেকেই বিয়ের কথা বলে। গত বছর যখন পাড়ার একটা ছেলে রিশার বাড়িতে বিয়ের প্রোপোজাল দিয়েছিল আর বাড়ির মানুষগুলো রাজিও হয়ে গিয়েছিল সেই কথা জুবায়েরকে জানানোর পর সে দেশে আসার চেষ্টা করেছিল। চেয়েছিল রিশাকে বিয়ে করে রেখে যেতে কিন্তু রিশা নিজেই জুবায়েরকে বুঝিয়ে সব সামলে নিয়েছিল। জুবায়েরের কোন খারাপ গুণ রিশার চোখে পড়েনি কিন্তু তবুও মাঝেমধ্যে রিশার ভয় হয়৷ জুবায়ের বিয়ের পরও এমন থাকবে তো? কোনভাবে যদি পরিবর্তন হয়ে যায় তাহলে যে রিশার দুঃখের সীমা থাকবে না।
রিশা কিছুক্ষণ নিরব থেকে বলল,“ভাবি, তুমি ওকে দেখবে?”
নিতুর চা প্রায় শেষের দিকে। চায়ের কাপে চা ঢালতে ঢালতে শুধালো,“কীভাবে? ছবি দেখাবে?”
“না, তুমি যদি আম্মাকে একটু ম্যানেজ করতে পারো তাহলে তুমি আর আমি আগামীকাল জুবায়েরের সাথে দেখা করতাম।”
নিতু চায়ের কাপসহ ট্রে হাতে নিয়ে বলল,“বিয়ের প্রথম কার্ডটা যদি আমি পাই তাহলে তোমাদের কাল দেখা হচ্ছে।”
রিশা নিতুর কাছে থেকে একটা চায়ের কাপ নিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল,”চলো, প্রমিস।”
__
পরদিন দুপুর দুটো। নিতু, উৎস দুজনেই ফরিনা বেগমের বোনের বাড়িতেই অবস্থান করছে। আজ সন্ধ্যায় তাদের বাড়ি ফেরার কথা। উৎস সকাল থেকে বাহিরে ছিল ভাই এবং বন্ধুদের সাথে। দুপুরে বাসায় ফিরেছে সবাই। কথা হয়েছে ফ্রেশ হয়ে, খাওয়া দাওয়া শেষ করে বিকেলের দিকে আবার বের হবে সবাই। সেখান থেকে ফিরে সন্ধ্যায় নিজেদের বাসায় ফিরবে।
উৎস গোসলে গিয়েছে৷ নিতু রুমেই শুয়ে শুয়ে ফোন ঘাটাঘাটি করছিল। রিশার রুমটা আপাতত তারা ব্যবহার করছে৷ বাসায় অতিথি এলেই বেচারির রুম ছেড়ে দিতে হয়। উৎস আসার পর থেকে দুই বার সে বিভিন্ন প্রয়োজনে রুমে এসেছে৷ এই সময়েও সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় নিতুকে একা দেখে দরজার সামনে এসে উঁকি দিয়ে বলল,
“আমরা কখন বের হচ্ছি, ভাবি?”
নিতু ফোনস্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে রিশার দিকে তাকালো।
“তোমার ভাইয়ারা বের হলেই আমি আর তুমি বের হব। প্রেমিকের সাথে দেখাই করতে চাইছিলে না আর এখন এত ছটফটানি!”
“সময় কাটছেই না৷ ওকে আমি বলে দিয়েছি। আমাদের আগেই চলে আসবে। তুমি ভাইয়াকে বলেছ? ”
“তাকে তো এখনো বলিনি। গোসল দিয়ে খেয়ে নিক তারপর বলি৷ নিষেধ করবে না আই থিংক।”
“তোমার বর তুমি বুঝে নাও তবে আমরা কিন্তু যাচ্ছি।”
“হ্যাঁ, যাচ্ছি। চিন্তার কোন কারণ নেই।”
“ঠিক আছে।”
রিশা চলে যেতেই ফোনে চোখ বুলাতে থাকলো নিতু। সাইডবক্সে ফোনের রিংটন শুনতে পেল নিতু। উৎস গোসলে যাওয়ার পূর্বে ফোন চার্জে বসিয়েছিল। নিতু উঠে ফোনের কাছে যেতেই ফোনস্ক্রিনে সেদিনের সেই নম্বর দেখতে পেল। নিতু ভাবলো, উৎস সম্ভবত নম্বরটা ব্লক করতে ভুলে গিয়েছে। ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার। কল কেটে যাওয়ার আগ মুহূর্তে রিসিভ করল নিতু। ওপাশে থেকে মেয়েলি কণ্ঠস্বর ভেসে এলো,
“আমি তো ভেবেছিলাম আগের মতো এই নম্বরটাও ব্লক করেছ। আজ হঠাৎ কল করে দেখছি এখনো ব্লক করোনি৷ কেমন আছ তুমি?”
নিতু উচ্ছ্বসিত হয়েই বলল,“ব্লক না করে উপায় আছে? পরোকিয়া করে চলে যাওয়ার পর বেশিরভাগ মহিলারই ফেলে যাওয়া স্বামীর ওপর দরদ উথলে ওঠে অথচ সেই দরদ যে বি*ষের মতো গলায় জ্ব*লে সেটা চরিত্রহীন মহিলাগুলো বোঝে না। ছ্যাচড়ার মতো পিছে পড়েই থাকে।”
ওপাশের ব্যক্তিটি চুপ রইল কিছুক্ষণ তারপর নরম গলায় শুধালো,“কে আপনি? এটা তো উৎসের নম্বর।”
“উৎস কাজের সূত্রে নম্বর পরিবর্তন করে না বলেই আপনার মতো মহিলা এখনো সুযোগে আছেন। থেকে থেকে ভালোবাসা ফাল দিয়ে ওঠে নাকি? ফেলে যাওয়ার সময় মনে ছিল না? টাকা দেখে, প্রতিপত্তি দেখে তো ঠিকই চলে গেছিলেন মাথায় ছিল না জবের প্রমোশন হয়? লোভী মহিলা হয়েও ভুলে গেলেন কীভাবে, জুই?”
“আ আপনি ক কে? বুঝলেন কীভাবে আমি জ জুই?”
“আমাকে রহস্যময়ী লাগছে? এত ইন্টারেস্ট কেন আমার প্রতি?”
“উৎসের কল আজ অবধি কেউ রিসিভ করেনি দুই একবার সে ছাড়া। আপনি কে? ওর ফোন আপনার কাছে কী করছে?”
“যার সাথে উৎসের ভাগ্য জুড়ে যাওয়ার কথা ছিল সে আমি। মাঝখানে আপনার মতো থার্ড ক্লাস মেয়ে এসে জীবন থেকে কয়েকটা বছর নষ্ট করে চলে গেছেন। মাটিতে ফেলে থুথু আবার চেটে জিহ্বায় তুলে নিতে মন চাইছে? নাকি যার সাথে গেছেন সে ঠিকঠাক সুখী করতে পারছে না? নাকি একটায় চলছে না কোনটা?”
“মাইন্ড ইয়্যুর ল্যাংগুয়েজ। ”
“জাস্ট কিপ ইয়্যুর মাউথ শাট। আর একবার এই নম্বরে কল এলে নোংরা মানুষকে নোংরা পানিতে চুবিয়ে মা**রতে সময় নিব না। কান খুলে শুনে রাখ, উৎস বিবাহিত একজন পুরুষ। সে তার স্ত্রীর সাথে ভালো আছে। মাঝখানে পুনরায় আসার চেষ্টা করলে জাস্ট শিকড়সমেত উপড়ে ফেলব তোকে।”
জুই আমতা আমতা করে বলে উঠল,“উ উৎস ব বিবাহিত! বিশ্বাস করি না আমি।”
নিতু তেজি গলায় বলে উঠল,“তুই কে বে? কোথাকার কোন প্রধানমন্ত্রী? তুই বিশ্বাস না করলেই বা কার কী ছেঁড়া যাচ্ছে? আমি জাস্ট তোকে ওয়ার্ন করছি, নেক্সট টাইম এই নম্বরে কল এলে পরবর্তীতে কল দেওয়ার মতো হাত খুঁজে পাবি না।”
নিতু কল কে*টে সাথে সাথে নম্বরখানা ব্লক করে ফেলে রাখল। ফোন রেখে বসে হাঁপাচ্ছে সে। জুইয়ের সাথে খুব উত্তেজিত হয়ে কথা বলে ফেলেছে সে। নিতু পুনরায় কী ভেবে উৎসের ফোনটা হাতে নিতেই ওয়াশরুম থেকে উৎস বেরিয়ে শুধালো,
“কেউ ফোন করেছে?”
#চলবে…….