প্রিয় বিকালফুল পর্ব-৩৬

0
672

#প্রিয়_বিকালফুল(৩৬)
#তানিয়া_মাহি(নীরু)

নিতু, রিশা আর রাস্তায় উত্য*ক্ত করা ছেলেটা তিনজনকেই থানায় আনা হয়েছে। তবে তিনজনকে আসা*মী করে আনা হয়নি। আসা*মী করে আনা হয়েছে নিতুকে। রাস্তায় যখন নিতুর সাথে ছেলেটার কথা কাটাকাটি হচ্ছিল তখন পাশে দিয়েই পুলিশের গাড়ি যাচ্ছিল। অন্য সময় মেয়েদের থেকে আগে সব শোনা হলেও এবার হয়েছে তার ভিন্নতা। ছেলেটা এলাকার এক রাজনীতিবিদের ছেলে। নাম আশরাফ। বাবার পরিচয়ে পরিচিত হওয়ায় আশেপাশের এলাকা এবং থানায় সে পরিচিত। রাস্তায় গন্ডগোল কেন সেটা জানতে চেয়ে আশরাফকে প্রশ্ন করায় সে জানায়, তারা ওখানেই দাঁড়িয়ে ছিল। এই মেয়ে দুইটা না-কি খারাপ মেয়ে। টাকার বিনিময়ে খারাপ কাজ করে৷ তাদের এই বিষয়ে উস্কানি দিচ্ছিল। বিভিন্ন ধরণের খারাপ মন্তব্য করায় পুলিশ নিতু আর রিশাকে একটা কথাও বলার সুযোগ দেয়নি।

নিতুকে একপ্রকার চোখে চোখে রাখা হয়েছে দুজন মহিলা কনস্টেবল দিয়ে।

নিতু এবং রিশা দুজনই বারবার বোঝানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে তারা ভালো পরিবার থেকে এসেছে, ছেলেটা মিথ্যে বলেছে, সে নিজেই উত্য*ক্ত করছিল ইত্যাদি ইত্যাদি সব বলার পরও একজন মহিলা কনস্টেবল বলে উঠল,

“ধরা পড়ার পর সবাই এমন বলে। নিজেদের ছাড়িয়ে নিতে কাকে ডাকবেন ডাকেন৷ নাহলে এই কেসে সহজে ছাড়া পাবেন না।”

রিশা নিতুর পাশেই বসে আছে। সুযোগ বুঝে উৎসকে কল করল সে। দুইবার রিং বেজে যাওয়ায়ও রিসিভ হলো না। চেষ্টা করতেই থাকলো রিশা। অতঃপর কল রিসিভ হলো। ওপাশে থেকে হাসাহাসির শব্দ ভেসে আসছে। এদিকে রিশা কাঁপাকাঁপা গলায় বলল,

“ভাইয়া, কোথায় আছ তুমি?”

রিশার কথা হয়তো ভালোভাবে বুঝতে পারল না উৎস। চারদিকে প্রচন্ড আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। উৎস বলে উঠল,

“রিশা, ওয়েট কর একটু। কথা শোনা যাচ্ছে না। আমি একটু দূরে গিয়ে কল করছি।”

কলটা কেটে গেল। রিশা দুশ্চিন্তা যেন বাড়তেই থাকলো। মিনিটের মাথায় কল ব্যাক করল উৎস। সাথে সাথে রিশার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে কল রিসিভ করল নিতু। বলে উঠল,

“আপনার বউ এখন থানায় আছে, উৎস সাহেব।”

উৎস হয়তো প্রথমে নিতুর কথাটা মজা হিসেবেই নিল। মজার স্বরেই বলে উঠল,“আমার কি তবে হিরো হয়ে বউকে বাঁচাতে আসতে হবে?”

নিতু বেশ স্বাভাবিকভাবে বলল,“মজা করছি না। আমি আর রিশা এখন থানায় বসে আছি।”

উৎস কিছুক্ষণ চুপ রইল। নিতু মজা করলে কণ্ঠস্বরেই বুঝতে পারত সে কিন্তু এখন নিতু বেশ স্বাভাবিক আর তাতেই উৎসের কেমন সন্দেহ হলো। সে বলল,

“কোন থানা? ডিটেইলস বলো।”

নিতু রিশার থেকে শুনে শুনে উৎসকে জানালো। আশেপাশে কোন অফিসার আছে কি- না জানতে চাইলো উৎস। অতঃপর নিতু উঠে সামনের দিকটায় চেয়ারে বসা অফিসারের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। অফিসার আশরাফের সাথে কথা বলছিল। অফিসারের সাথে সাথে সে নিজেও তীক্ষ্ণ নজরে নিতুকে একবার দেখল। নিতু দাঁতে দাঁত চেপে অফিসারের দিকে ফোন বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

“আপনার কল।”

অফিসার নিতুর দিকে চেয়েই ফোনটা হাতে নিল। কানে নিয়ে বলে উঠল, “কে?”

উৎস ওপাশ থেকে কড়া গলায় বলে উঠল,“আমার বউয়ের গায়ে হাত তোলা তো দূর, ওর সাথে খারাপ ব্যবহারের কারণে, কটু কথার কারণেও থানায় এসে তার চোখ যদি ছলছল করতে দেখি তাহলে আমি আপনার পুরো থানা কবরস্থান বানিয়ে ছাড়ব বলে দিলাম, অফিসার।”

নিতু, রিশা দুজন থানার এক কোণায় চুপ মেরে বসে ছিল। হন্তদন্ত হয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই থানার ভেতরে প্রবেশ করল উৎস। ঠিক সোজাসুজি নিতু আর রিশাকে দেখতেও পেল সে। উৎসকে দেখে দুজনে উঠে দাঁড়ালো। উৎস সেদিকে যেতে গিয়েও থেমে গেল। বামদিকেই অফিসার তখনো বসে আছে। উৎস ধীরপায়ে সেদিকে এগিয়ে গেল। অফিসারকে মৃদু গলায় বলল,

“হ্যালো স্যার। আমি মুবতাসিম ফুয়াদ উৎস। নামেই চিনে যাওয়ার কথা। সামনাসামনি যেহেতু দেখছেন সেহেতু ভুল হওয়ার কোন প্রশ্নই ওঠে না।”

অফিসার উৎসকে কিছু মুহূর্ত অবজার্ভ করল তারপরই চকিতে স্যালুট দিয়ে দাঁড়ালো। উৎস ইশারায় বসতে বলে শুধালো,

“পুরো ঘটনা বলুন। আমার স্ত্রী যেটা জানিয়েছে সেটা বলবেন।”

অফিসার দেরি না করে সবটা জানালো। উৎসও ভালো শ্রোতার মতো শুনল সব কথা। কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে ঠোঁটের কোণায় ফুঁটে উঠল হাসি। অফিসারের কথা শেষ হতেই উৎস নিতুর দিকে ফিরে উড়ন্ত চুমু ইশারা করে বলে উঠল,

“এই না হলে আমার বউ!”

উৎসের এমন আচরণে কিঞ্চিৎ লজ্জা পেয়ে বসলো নিতু। তার এমন আচরণ মোটেও আশা করেনি সে। লজ্জা পেল সামনে বসা অফিসারও। উৎস সময় না নিয়ে বলে উঠল,

“যার দৃষ্টিতে আমার স্ত্রী আর বোন টাকার বিনিময়ে মানুষের সাথে রুমে যায় সেই রাজনীতিবিদের বাচ্চারে ডাকেন। তারে তো মানুষ ছাড়া অন্যকিছুর সাথে রুমে না পাঠানো অবধি আমার শান্তি হবে না।”

আশরাফ নামের ছেলেটা বাহিরেই দাঁড়িয়ে ছিল। সম্ভবত বিপদ আঁচ করতে পেরে বাবাকে বারবার কল করছিল সে। অফিসের ভেতর থেকে ডাক পড়ায় ভেতরে এলো সে। উৎসের সামনে এসেই দাঁড়ালো। ভেতরে কিংবা মুখে কোন অনুশোচনার ছাপ নেই। সে উলটো ব্যাঙ্গাত্মক হাসি হেসে বলল,

“আপনার ভয়ে তো কাঁপছি আমি।”

উৎস ফিচেল হেসে বলল,“শুধু কাঁপা-কাঁপি কেন? তুমি চাইলে তোমার প্যান্ট ভেজারও ব্যবস্থা করে দিতে পারি, সোনা।”

আশরাফ দাঁতে দাঁত চেপে উৎসের দিকে তাকালো। উৎস পরক্ষণের ধমকের সুরে বলল,“চোখ রাঙানো একদম সহ্য করব না। চোখ নিচে৷ একদম নিচে। মেয়েদের রাস্তায় উত্য*ক্ত করবি আবার মিথ্যা অপবাদে থানায় কেইসে ফাঁসিয়ে দিবি? ক্ষমতার বলে সবকিছু এতই সস্তা না-কি? বাপের ক্ষমতা আছে, বাপ সব সামলে নেয় বলে ছেলে এমন হতচ্ছাড়া বাইঞ্চো** হবে? দুনিয়াকে মামার বাড়ির মোয়া ভাববি? শালার ঘরের শালা।”

“বাড়াবাড়ি করছেন কিন্তু! আমি কে সেটা এখনো বুঝতে পারেননি।”

উৎস ঠোঁট কামড়ে তাচ্ছিল্য করে বলল,“তুই আমার বা**ল।”

রিশাকে ডাকলো উৎস। রিশার সাথে সাথে নিতুও এগিয়ে এলো৷ দুজনই চুপচাপ। তবে রিশার মুখে ভয়ের ছাপ থাকলেও নিতুর মুখে তা বিন্দুমাত্র নেই৷ উৎস রিশার হাত ধরে সামনের দিকে টেনে নিয়ে এলো। আশরাফের সামনে দাঁড় করিয়ে বলল,

“কী কী করেছে ও?”

রিশা আমতা আমতা করে জবাবে বলল,“আজেবাজে কথা বলেছে, একদম শরীর ঘেষে দাঁড়িয়েছিল, একটা মেয়েকে বিরক্ত করতে যা যা করতে হয় সবই করেছে।”
“জুতা খোল। ”
“হ্যাঁ? ” উৎসের কথায় অবাকচোখে তাকালো সবাই। উৎস পুনরায় বলল,

“জুতা খুলে ওর গালে তিনটা সম্মান দিবি।”

অফিসার এবার একটু ইতস্তত করতে করতে বলল,“স্যার, থানার মধ্যে এসব না করলে হয় না?”

উৎস তেজি গলায় বলল, “আপনারা যে থানার বাহিরে ক্ষমতাবানদের কথায় সত্য-মিথ্যা যাচাই না করে যা ইচ্ছে করেন সে বেলায়? আমার কি এখন অন্যা*য় রুখে দিতে ইউনিফর্মে আসতে হবে?”

অফিসার আর কিছু বলল না। উৎস রিশাকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ফের বলল,“রিশা, থাপ্প*ড় লাগা ওরে।”

আশরাফ কটমট চোখে অফিসারের দিকে তাকাচ্ছে বারবার। অফিসার সমানে চোখ নামিয়ে নিচ্ছে। রিশার মনে পড়ল বিকেলের সেই দৃশ্য। গা ঘিনঘিন করে উঠল যেন। শরীরে একটা ঝাঁকুনিও হলো। দেরি না করে উৎসের কথামতো সাহস করে বসিয়ে দিল একটা থাপ্প*ড়। আশরাফ গালে হাত দিয়ে অবাক চোখে রিশার দিকে চাইলো। তার দিকে তেড়ে যেতেই রিশাকে আড়াল করে মাঝে গিয়ে দাঁড়ালো উৎস।

আশরাফ উৎসকে উদ্দেশ্য করে বলল,“আ*গু*ন নিয়ে খেলা শুরু করেছিস, এর দাম তোকে দিতেই হবে। সব শেষ করে দেব আমি। আমার বাবাকে চিনিস না তুই।”

“হুমকি ধামকিতে কোন কাজ হবে না। অনেকদিন কোন খেলোয়াড়ের সাথে খেলি না। জোশ হারিয়ে গেছে। পারলে কিছু করে দেখা। নিজের বলে বা বাপের বা*লের জোরে।”

মুহূর্তের মধ্যে থানার ভেতরে প্রবেশ করল তিনজন লোক। একজনের পাশেই দুইজন্য পিছু পিছু এলো। দরজার দিকে আশরাফকে দাঁড়িয়ে কারও সাথে কথা বলতে দেখে মাঝের জন বলে উঠল,

“কী হইছে, আব্বা?”

#চলবে…….