প্রিয় বিকালফুল পর্ব-৩৯

0
696

#প্রিয়_বিকালফুল(৩৯)
#তানিয়া_মাহি(নীরু)

উৎস একটা খাম এগিয়ে দিল নিতুর দিকে। বলল,
“এই নাও।”

নিতু ভ্রু কুঁচকে শুধালো,“কী এতে?”
“খুলেই দেখো।” সংক্ষেপে উত্তর উৎসের।

“বলো।”
“দেখো তুমি৷”

নিতু খামটা হাতে নিতেই বুঝল ভেতরে কোন কাগজ আছে কিন্তু কাগজটা কীসের? উৎসের দিকে তাকিয়ে দেখে খামের দিকে তাকালো সে। জিজ্ঞেস করল,

“ছিঁড়ে দেখব? আমার ভয় লাগছে। কী আছে এতে?”
“সবসময় বলেকয়ে কিছু না দিলে সেটা ভয়েরই হবে এমন ভাবতে হবে কেন? ভালোকিছুও তো থাকতে পারে। উৎস কি সবসময় ভয়ংকর না-কি?”

নিতু মৃদু হাসলো। খামটা হাতে রেখেই চোখ বড় বড় করে উৎসের দিকে তাকিয়ে বলল,“হ্যাঁ, ভয়ংকর।”
“খুলে দেখো। হতে পারে ভয়ংকর কিছুই আছে।”

নিতু খামে মনোযোগ দিল। ভেতর থেকে দুটো টিকেট বের হলো৷ এপাশ ওপাশ উল্টে দেখে বলল,“কী সের টিকেট এটা?”
“আমাদের ঘুরতে যাওয়ার।”

বিস্ময়ে যেন হতবিহ্বল অবস্থা নিতুর৷ এই সময়ে ঘুরতে যাওয়ার কথা তার মাথায় কিছুতেই আসেনি। উৎস ছুটিতে বাড়ি ফেরার পর থেকে নিতু ভাবছিল উৎসকে একটু বলবে কোথাও ঘুরতে যাওয়ার কথা। মাঝে অনেকটা সময় একঘেয়েমিতে কেটেছে। শরীর ও মন ভালো রাখতে মাঝেমাঝে ভ্রমণটাও জরুরি। জায়গার পরিবর্তন হলে মস্তিষ্ক পূর্বের চেয়ে বেশি সচল হয়। বাসায় তার প্রায় বন্দি জীবন কাটছিল। যদিও প্রতি মাসে তিন, চারটা কাজ তার করা হয়েছে। কাজের সূত্রেই শুধু বাহিরে বের হওয়া হয়েছে। নিজেকে আলাদাভাবে সময় দিতে বাহিরে বের হওয়া হয়নি তার।

নিতু টিকেট দুটো ভালো করে দেখল৷ উৎসের দিকে চেয়ে বলল,“মেঘের দেশে যাব? সত্যি বলতে বিদেশ ঘুরলেও সাজেক যাওয়া হয়নি এখনো।”

উৎস প্রলম্বিত শ্বাস ফেলল। কপাল ঘষে বলল,“ভ্যাগ্যিস যাওনি৷ আমি টিকেটের ব্যবস্থা করার সময় ভাবছিলাম, তুমি গিয়ে থাকলে তো বিষয়টা অন্যরকম হয়ে যাবে৷ যাই হোক দুজনেরই প্রথমবার।”

নিতু উৎসের দিকে এগিয়ে এসে বসলো। মনটা একটু খারাপ করে বলল, “কিন্তু আম্মা তো আজ এলো। তাকে রেখে কীভাবে যাব?”

উৎস বলল,“আমাদের যাওয়া দুইদিন পর। এই দুইদিন মায়ের সাথে থেকে নাও। আমরা ঘুরতে গেলে আমার আম্মা বাসায় একা হয়ে যাবে তাই তোমার আম্মাকে নিয়ে এলাম। দুজনে বাড়িতে থাকলে কোন অসুবিধা হবে না। তাছাড়া আমি হেল্পিং হ্যান্ডের ব্যবস্থা করেছি। খাওয়া দাওয়ার কোন অসুবিধাও হবে না৷ শুধু যখন যেটে খেতে ইচ্ছে করবে সেটা বললেই হাজির হয়ে যাবে। আমি আর তুমি একদম নিশ্চিন্তে তিনদিন ঘুরে আসতে পারব। কোন চিন্তা থাকবে না। আমি রতন চাচাকে বলব তিনদিন এখানে থেকে যেতে। সব সমস্যার সমাধান হলো তো?”

নিতু একপাশে মাথা নাড়ল। মৃদু হেসে বলল,“ সব ঠিক আছে৷”
“এবার একটা চুমু দাও।”

নিতু হেসে বলল,“অবশ্যই। এত ভালো একটা নিউজ আর সারপ্রাইজের জন্য একটা কেন চুমুর পরিমাণ আরও বাড়িয়েও দিতে পারি৷ আমার একমাত্র বর বলে কথা!”

উৎস মুখ এগিয়ে দিল৷ নিতু চিবুক ধরে দুই গালে এবং কপালে চুমু দিয়ে বলল,“এখনকার জন্য এটুকুই। ”

উৎস উৎসুক হয়ে জানতে চাইলো,“আর বাকিটা?”
“আমাকে নিয়ে শপিংয়ে বের হলে বাড়ি ফিরে বাকিটা পুষিয়ে দেব।”
”অনলাইনে নিয়ে নাও যা যা ইচ্ছে।”
”দূরে ঘুরতে যাওয়ার আগে কাছাকাছি একটু বের হয়ে মনটাকে প্রিপেয়ার্ড করে নিতে হয় বুঝেছ? এই যেমন তুমি আমাকে নিয়ে শপিংয়ে গেলে ফুরফুরে মন নিয়ে ঘুরতে যেতে পারব।”
“আপনার মন বলে যেহেতু কথা সুতরাং আমার তাহলে যেতেই হচ্ছে৷”

নিতু উৎসের দুই গাল টেনে দিয়ে বলল,“এই না হলে আমার বর!”
____

দুইদিনে অনলাইন, অফলাইন থেকে মোটামুটি কেনাকাটা শেষ নিতুর। তিন দিন থাকা হবে ঘুরতে গিয়ে। কখন, কোন বেলা কোন ড্রেস বা শাড়ি পরা হবে সেটা অনুযায়ী পছন্দমতো কেনাকাটা করেছে সে। একবার উৎসকে সাথে নিয়ে বাহিরেও গিয়েছিল সে। নিজের কেনাকাটার সাথে সাথে উৎসের জন্যও কিনেছে।

সন্ধ্যা পর দুইটা শাড়ি নিয়ে শাশুড়ির রুমে গেল নিতু। ফরিনা বেগম এবং নুরজাহান বেগম বসে বসে গল্প করছিলেন। হঠাৎ নিতু প্রবেশ করায় দুজনে চুপ হয়ে গেলেন। ফরিনা বেগম নিতুকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

“হাতে কী রে, মা? ”

নিতু দ্রুত পায়ে বিছানার ওপর এসে বসলো। শপিং ব্যাগের ভেতর থেকে দুটো একই শাড়ি বের করে বিছানার ওপর রাখল। শাড়ি দুটো একই শুধু রঙ ভিন্ন। দুজনের দিকে তাকিয়ে বলল,

“দুজনের জন্য নিয়ে এলাম। পছন্দ হয়?”

নুরজাহান বেগম ইতস্তত করে বললেন,“আমার জন্য কেন আনতে হবে? আমার তো শাড়ি আছে। আপার জন্য শুধু আনলেই হবে।”

নিতু বলল,“আমার দুই মা এখানে তাহলে আমি একজনের জন্য কেন আনব? দিলে দুজনকেই দেব আর না দিলে কাউকে দেব না। হিসেব সোজা। এই হিসেব কখনো আঁকাবাঁকা পথে যাবে না। ”

ফরিনা বেগম মৃদু আওয়াজে বললেন,“ মেয়ে এ যুগের মানুষ বুঝলেন, আপা? তার জ্ঞানবুদ্ধির ঘাটতি নেই। তারা এক হাতেই সব সামলে নিতে জানে। দেখুন একইসাথে কীভাবে মা এবং শাশুড়ির মন রাখল!”

নুরজাহান বেগম কিছু বললেন না। মেয়ের দিকে চেয়ে শুধু মৃদু হাসলেন। নিতু দুটো শাড়ি প্রথমে শাশুড়ির দিকে বাড়িয়ে দিল।

“আম্মা, আপনি আগে নিন।”

ফরিনা বেগম শাড়ি দুটো নুরজাহান বেগমের দিকে ঠেলে এগিয়ে দিয়ে বললেন,“তোমার মা আগে নিক। আমি তো নেওয়ার ওপরই আছি।”

নুরজাহান বেগম নিজেও বেছে না নিয়ে ফরিনা বেগমের দিকে ঠেলে দিলেন৷ দুজনের এমন কান্ড দেখে নিতু নিজেই শাড়ি দুটো নিজের কাছে নিয়ে নিল। মেকি রাগ দেখিয়ে বলল,

“তোমাদের বেছে নিতে হবে না। আমি দিচ্ছি। ”

নিতু শাড়ি দুইটা দুজনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে ফের বলল,“নিজেদের পছন্দে শাড়ি তোমাদের পরতে হবে না। এবার আমার পছন্দেই নাও।”

নুরজাহান বেগম ফরিনা বেগমের দিকে চেয়ে বললেন,“ এটাই ভালো হলো তাই না, আপা?”

ফরিনা বেগম হেসে বললেন,“একদম।”

নিতু উঠে দাঁড়ালো। তাড়া দিয়ে বলল,“প্রত্যেকে শাড়ি পরে ফেলো। আমি কিন্তু রাতে এই শাড়িতে দেখতে চাই৷ আগামীকাল ভোরবেলা তো বের হচ্ছি আমরা। ব্যাগপত্র গুছাতে হবে।”

নুরজাহান বেগম বলে উঠলেন,“শুধু জামাকাপড় না নিয়ে কিছু শুকনো খাবার আর কিছু প্রয়োজনীয় ওষুধ নিও। কাজে দেবে। বাহিরের পরিবেশে যাচ্ছো, বলা তো যায় না।”

নিতু সম্মতি জানিয়ে বলল,“ঠিক আছে নেব। তোমরা দুজনে সাবধানে থাকবে। আমরা কালকে বের হওয়ার পরপরই একজন হয়তো আসবে। রান্নাবান্না থেকে শুরু করে সব কাজ করবে। আমরা না ফিরে আসা অবধি এ বাড়িতেই থাকবে। তোমাদের কোন অসুবিধা হবে না।”

ফরিনা বেগম হাতের শাড়িটা পাশে রেখে বললেন,“আমাদের নিয়ে এত চিন্তা করতে হবে না। একদম ফ্রেশম্যুডে দুজনে গিয়ে ঘুরে এসো। আমাদের জন্য এত চিন্তা করলে তোমরা এনজয় করবে কীভাবে? যাও, যাও।”
_____

রাত এগারোটার দিকে ঢাকা থেকে খাগড়াছড়ির উদ্দেশ্যে কোচ-বাস রওয়ানা দিয়েছে। প্রায় সারা রাতের জার্নি শেষ করে সকাল পরপর গিয়ে পৌঁছবে তারা। চার রাত, তিনদিন সেখানে থাকবে এবং পরদিন আবার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিতে হবে।

বিরাটা একটা কোচ-বাস ভরতি মানুষ। কেউ বা যাচ্ছে পরিবার নিয়ে আবার কেউ বা যাচ্ছে শুধু স্বামী-স্ত্রী মিলে আবার যাচ্ছে বন্ধুরা মিলে। বাসে ওঠার প্রথম থেকেই সবার মধ্যে উচ্ছ্বাস দেখা দিল। কারও কারও প্রথম যাত্রা বা কারও কয়েকবারের। তবুও কারও আনন্দ যেন কম প্রকাশ পাচ্ছে না।

নিতু আর উৎস পাশাপাশি সিটে বসেছে। গাড়ি চলতে শুরু করেছে কিছুক্ষণ যাবৎ। গাড়ি চলতে শুরু করার আগেই ড্রাইভারের সাথে বসে থাকা একজন বলে উঠলেন,

“দূরের রাস্তা। সবাই আল্লাহর কাছে মাফ চেয়ে নেন। ভ্রমণ যেন ভালো হয়, কোন বিপদ -আপদ যেন না ঘটে সেটার জন্য দোয়া করে নিন।”

উনার কথামতো কেউ মোনাজাত করল আবার কেউ বা পাত্তা দিল না সেভাবে। গাড়ি চলতে শুরু করল নিজ গতিতে। প্রায় দুই- তিনঘণ্টা পরপর নির্দিষ্ট জায়গায় মিনিট দশ-পনেরোর ব্রেকও নেওয়া হলো। তারপরই আবার নতুন উদ্যোমে চলল সবাই।

সকাল হতে হতেই গাড়িও এসে পৌঁছলো খাগড়াছড়ি শহরে। সবাই সেখানেই বাস থেকে নেমে পড়ল। সাথে করে যে যা এনেছিল দেখেশুনে সবকিছু সঙ্গে নিল। নিতু আর উৎসও তাই করল। বাস থেকে নামার সাথে সাথে সকালের শীতল হাওয়া স্পর্শ করল তাদের। নিতু রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে প্রলম্বিত শ্বাস ফেলল। দুজনে ধীরগতিতে কয়েক কদম এগিয়ে গেল। নিতু বাসায় ফোন করে জানিয়ে দিল তারা বাস থেকে নেমে পড়েছে। নিতু ফোন রাখতেই উৎস নিতুর দিকে হাত বাড়িয়ে বলল,

“চলো যাওয়া যাক, মেঘের বাড়িতে। সেখানে মেঘেদের সঙ্গ দেব আমি আর তুমি।”

#চলবে…..