প্রিয় বিকালফুল পর্ব-৪১

0
685

#প্রিয়_বিকালফুল(৪১)
#তানিয়া_মাহি(নীরু)

ভ্রমণ শেষ করে বাড়ি ফেরার সময় ঘনিয়ে আসছে। গত কয়েকটা দিন অচেনা জায়গায় সবচেয়ে চেনা মানু্ষটার সাথে সময় খুব একটা খারাপ কাটেনি নিতুর। এখানে ওখানে ঘুরাঘুরি থেকে শুরু করে বিভিন্ন নতুন নতুন খাবার খাওয়া হয়েছে তার। যে খাবারগুলো নিজের শহরে বা বাহিরের দেশগুলোতে কখনো ট্রাই করা হয়নি সেগুলো টেস্ট করা হয়েছে। সব মিলিয়ে দিনগুলো ভীষণই ভালো কেটেছে সবার।

নিতু সন্ধ্যাবেলা ফ্রেশ হয়ে রুমে এসে দেখে উৎস বিছানায় হেলান দিয়ে বসে আছে। নিতু এসে বসতেই দরজায় কেউ শব্দ করল। নিতু চকিতে সেদিকে তাকাতেই উৎস বলল,

“দুজনের জন্য কফির অর্ডার দিয়েছিলাম। চলে এসেছে বোধ হয়। তুমি বোসো, আমি নিয়ে আসছি।”

নিতু মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। উৎস দরজা খুলতেই বাহিরে কফি হাতে এক লোককে দেখতে পেল। লোকটা উৎসের হাতে কফি দিয়ে আন্তরিকতার সাথেই প্রস্থান করল। উৎস বাহু দিয়ে দরজা ভেজিয়ে দিয়ে মগ দুটো রেখে দরজাটা ভালোভাবে আটকে দিল। নিতুর দিকে এগিয়ে এসে বলল,

“চলো বাহিরের ওই বারান্দাটায় যাই। প্রকৃতি, প্রিয়তমা আর এক কাপ চায়ের বদলে কফি খুব একটা মন্দ হবে না হয়তো।”

নিতু মুচকি হেসে কফির মগটা হাতে নিয়ে বলল,“চলো যাওয়া যাক।”

উৎস নিজেও নিতুর সাথে সাথে রওয়ানা দিল৷ দুজনে গিয়ে পৌঁছলো বারান্দায়। পুরোটা বাঁশ এবং কাঠের কাজ করা। অসম্ভব সুন্দর দেখতে। সামনেই সবুজ অরণ্যে ঠাসা পর্বতমালা। সামনেই গভীর খাদ। সব মিলিয়ে সামনের সৌন্দর্যটা যেন কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।

নিতু কফির মগে চুমুক দিল। আকাশের দিকে মুখ করে চোখ বন্ধ রেখে প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে বলল,“তোমার প্রত্যেক ছুটিতেই আমাদের এমন একটু বের হওয়া উচিত। সবসময় কাজ, বাসা এসবে মনে তিক্ততা আসতেই পারে। মাঝেমধ্যে নিজেদের এমন সময় দিলে…”

নিতুকে কথা শেষ করতে না দিয়ে উৎস বলে উঠল,“সম্পর্ক গাঢ় হবে, তাই তো?”

নিতু উৎসের নাক টেনে বলল,“জি, মিস্টার।”

কিঞ্চিৎ ফাঁকা ছিল দুজনের মধ্যে। উৎস এগিয়ে এসে সেটাও পূরণ করে একহাতে নিতুর কোমর পেঁচিয়ে ধরে বলল,
“সম্পর্ক গাঢ় করতে একটা ছোট কিউট বাচ্চারও প্রয়োজন হয়। তোমার মনে হয় না, আমাদের এখন দুজন থেকে তিনজন হওয়ার সময় এসেছে?”

লজ্জা পেল নিতু। মাথানিচু করে নিল সে। উৎস মুচকি হেসে বলল,“আমার বউয়ের লজ্জাও আছে? অথচ বিয়ের প্রথমদিকে কি ফ্লার্টটাই না করত!”

নিতু মুখ তুলে চাইলো৷ হাতের মগটা পাশে রেখে দুইহাতে উৎসের শার্টের কলার চেপে ধরে এক ঝটকায় নিজের সন্নিকটে এনে শয়তানি হাসি হেসে বলল,

“তুমি কি কোনভাবে চাইছো, আমি তোমার কাজ সহজ করে দেই?”

উৎস নিজেও মগটা রেখে দিল। এক হাত কোমরে এবং অন্যহাতের তর্জনী আঙুলের সাহায্যে নিতুর কপাল বেয়ে ঠোঁট স্পর্শ করে সেদিকেই নজর নিবদ্ধ রেখে বলল,“সবে মিলে করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ। একা একা কোন কাজ কষ্টসাধ্য হতেই পারে, তুমি এক পা এগোলে আর আমি এক পা এগোলাম এটাই ভালো হলো না? দুই পা এগোনোর আগেই তোমায় পেলাম।”

উৎসের দিকে নেশালো চোখে তাকিয়ে প্রলম্বিত শ্বাস ফেলল নিতু। তার ঠোঁটজোড়াকে তাক করে এগোতে থাকলো উৎস। দূরত্ব মিটিয়ে দুই জোড়া ঠোঁট যখন এক হবে তখনই নিতু চকিতে উৎসের মুখে হাত রেখে থামিয়ে দিল। স্বর খাদে নামিয়ে বলল,

“আশেপাশে রুমের বারান্দ আছে। কেউ চলে আসবে।”

আশেপাশে অন্ধকার নেমে এসেছে। চারদিকে নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। আশেপাশে তাকিয়ে দেখল উৎস। কোথাও সেরকম কাউকে দেখতে পেল না সে। নিজের মুখের ওপর থেকে নিতুর হাত সরিয়ে তাকে কোলে তুলে নিল। মৃদু আওয়াজে বলল,

“চলো, রুমে যাওয়া যাক। এমনিতেও প্রাইভেট টাইমে আমি কারও উপস্থিতি নিতে পারব না। এসময় কারও উপস্থিতির শব্দমাত্র বরদাস্ত করতে পারব না আমি৷ এ সময় শুধু তোমার আর আমার। শুধুই আমাদের।”

নিতু মাথানিচু করে শক্ত হাতে উৎসকে ধরে নিশ্চুপ রইল। উৎস পা বাড়ালো নিজেদের রুমের দিকে।
____

ভোর বেলা পেরিয়ে হালকা সকাল হতে শুরু করেছে। আজই নাশতা বেলা পার করে সবার রওয়ানা দেওয়ার কথা। শেষবারের মতো সকাল সকাল টিমের কয়েকজন হাঁটতে বের হয়েছে। নিতু আর উৎসও বাদ যায়নি। তারাও বেরিয়েছে সবার সাথে। রিসোর্ট এবং রিসোর্টের সামনের দিকটা হেঁটে হেঁটে পুনরায় দেখছে তারা। কবে আবার কার আসার সুযোগ হবে কি-না কে জানে!

এদিক ওদিক ঘুরাঘুরি করে, সকালের সূর্যোদয় দেখে সাদা তুলোর মতো ছুঁয়ে, সবাই মিলে আনন্দ করে রুমে পৌঁছতে পৌঁছতে আটটা বেজে গেল। টিম লিডার জানালেন, দশটার মধ্যে সবার একসাথে বেরিয়ে রিসোর্টের সামনে একসাথে দাঁড়াতে হবে।

নিতু-উৎস দুজনে নিজেদের রুমের দিকে এগোলো। তাদের এখন সেরকম কোন কাজ নেই। রাতেই দুজনে মিলে বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে সবটা গুছিয়ে নিয়েছে। যা যা বের করা হয়েছিল প্রয়োজন বলে সবই আবার ব্যাগে রাখা হয়েছে। শেষ মুহূর্তে এসে যেন কোন ঝামেলা না হয় সেটা তারা মাথায় রেখেছে।

রুমের দিকে এগিয়ে আসতেই দরজার সামনে কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল দুজন। কেউ ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে। কাছাকাছি এসে দুজনে দুজনের মুখের দিকে চাইলো।

পায়ের শব্দে পেছনে ঘুরে তাকালো দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি। সে ঘুরে তাকাতেই হাস্যোজ্জ্বল মুখটা মলিন হলো দুজনের। উৎসের সটান বিস্তৃত ভ্রুযুগোল মুহূর্তেই কুঁচকে গেল। বলে উঠল,

“আপনি এখানে?”

এতগুলো বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও নিজের সবচেয়ে কাছের বান্ধবীকে চিনতে ভুল হলো না নিতুর। সামনে যে একসময়ের সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুটি দাঁড়িয়ে আছি। জুই!
এখানে আসার পর থেকে তার সন্দেহ হচ্ছিল, কেউ তাদের অনুসরণ করছে বলে তার মানে সে ঠিক ছিল? জুই তাদের অনুসরণ করছিল? কিন্তু এখন সে এখানেই বা কেন? তার উদ্দেশ্যই বা কী? এক পলকে সন্দিহান দৃষ্টিতে চেয়ে রইল নিতু।

জুই হঠাৎই পা বাড়ালো উৎসের দিকে। নিতু তড়িৎ হাত বাড়িয়ে মাঝে ব্যারিকেড দিয়ে দাঁড়ালো। দাঁড়িয়ে গেল জুইও। বিরক্তি নিয়ে তাকালো নিতুর দিকে। পরক্ষণেই মুখভঙ্গির পরিবর্তন করে উৎসের দিকে তাকালো।

“তুমি আমার সঙ্গে আপনি করে কেন বলছো, উৎস?”

উৎস তীক্ষ্ণ গলায় বলে উঠল,“আপনি করে কেন? আমার তো কথা বলাই উচিত হয়নি আপনার মতো মানুষের সাথে।”
“উৎস!”
“কী উৎস? এখানে কেন আপনি? আমাদের ফলো করছিলেন? আমাদের ফলো করে এখানে চলে এসেছেন!?”

জুই মাথানিচু করে বলল,“আমার তোমার সাথে কথা বলা জরুরি।”
“জরুরি! কী এমন কথা?”

জুই কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,“তুমি এই মেয়েটাকে ডিভোর্স দিয়ে দাও। আমি আবার তোমার জীবনে ফিরতে চাই। আমি মাঝখানে একটা বড় ভুল করে ফেলেছিলাম। ওরকম আর কোনদিন হবে না। আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি। বিশ্বাস করো, এতদিনে আমি খুব করে বুঝেছি, আমি তোমাকে ঠিক কতটা ভালোবাসি। ”

শব্দ করে হেসে উঠল নিতু। উৎস, জুই দুজনেই অবাক চোখে চাইলো তার দিকে। নিতু হাসতে হাসতে বলল,“উৎস এখন আমাকে ডিভোর্স দিয়ে আপনাকে ফিরিয়ে আনবে? সব কু*ত্তারই কেন বাড়ি ছাড়ার পর মনিবের প্রতি ভালোবাসা উথলে ওঠে? জামাই থাকতে যখন পরপুরুষের সাথে থাকতে ভাল্লাগতো তখন জামাইয়ের প্রতি ভালোবাসা কই গেছিল? যে মহিলার দশ ঘাটের পানি খাওয়ার অভ্যাস সে আবার বলছে ভালোবাসার কথা!”

জুই চিৎকার দিয়ে বলে উঠল,“শাটআপ। আমি এখানে উৎসের সাথে কথা বলছি। কোন থার্ড পারসন নাক গলাবে এটা আমার পছন্দ না।”

নিতু কিছু বলবে তার আগেই উৎস ধারালো গলায় বলে উঠল,“থার্ড পারসন এখানে কে? আয়না দেখা বন্ধ করে দিয়েছেন না-কি? ও আমার বউ হয়। ওর সাথে পুনরায় গলা উঁচিয়ে কথা বলার আগে একবার অন্তত ভেবে নেবেন। নিজের জঘন্য চেহারা, মানসিকতা নিজের কাছে রাখবেন, যারা সহ্য করতে পারে তাদের দেখাবেন৷ আমার সামনে একদম নয়। আমার স্ত্রীর সাথে উঁচু গলায় কথা বললে, গলা দিয়ে যেন আওয়াজ না আসে সেই কাজ করব।”

#চলবে……