#প্রিয়_বিকালফুল(৪২)
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
“থার্ড পারসন এখানে কে? আয়না দেখা বন্ধ করে দিয়েছেন না-কি? ও আমার বউ হয়। ওর সাথে পুনরায় গলা উঁচিয়ে কথা বলার আগে একবার অন্তত ভেবে নেবেন। নিজের জঘন্য চেহারা, মানসিকতা নিজের কাছে রাখবেন, যারা সহ্য করতে পারে তাদের দেখাবেন৷ আমার সামনে একদম নয়। আমার স্ত্রীর সাথে উঁচু গলায় কথা বললে, গলা দিয়ে যেন আওয়াজ না আসে সেই কাজ করব।”
উৎসের এমন কড়া কথায় বোধ হয় কিছুটা দমে গেল জুই। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,“মানুষকে ক্ষমা করা তো মহৎ গুণ তাই না বলো? প্লিজ আমাকে এবারের মতো ক্ষমা করে দাও। আমি সত্যিই তোমাকে ছাড়া থাকতে পারছি না। আমার ভীষণ কষ্ট হয়। নিজের করা ভুলের দিকে তাকালে ম*রে যেতে ইচ্ছে করে আমার।”
“তো ম*রে যান। বেঁচে থেকে কার কী উপকার করছেন আপনি?” বলেই উৎস তাচ্ছিল্যের নজরে চাইলো। শক্ত করে ধরল নিতুর হাত। নিতু কিছুক্ষণ উৎস আর শক্ত করে ধরে রাখা হাতের দিকে চেয়ে রইল।
জুই বলে উঠল, “তুমি আমার প্রতি এত বিমুখ কবে থেকে হলে? আমি এই মানুষকে চিনতে পারছি না। কিছুতেই চিনতে পারছি না। তুমি আমার সাথে এমন হতে পারছো? কীভাবে পারছো? তুমি তো আমায় ভালোবাসতে।”
উৎস মাড়ি শক্ত করে বলল,“ভালোবাসতাম। ভুল মানুষকে, ভুল করে। এই যে, আজ আপনার চেহারা দেখছি এতে আমার ভীষণ করে বমি পাচ্ছে। একটা মানুষ এত নোংরা আর অসহ্যকর কীভাবে হতে পারে?”
উৎস থেমে পুনরায় বলল,“একটা উপকার করতে পারবেন?”
জুই উচ্ছ্বসিত হয়ে জানতে চাইলো, “কী বলো? তোমার জন্য আমি সব করতে পারব। আমি শুধু তোমাকে ফিরে পেতে চাই। আমি নিজের করা ভুল বুঝতে পেরেছি। আমি অনুতপ্ত। আমি তোমার কাছে ফিরতে চাই। প্লিজ তুমি ওকে ছেড়ে দাও। আমি আর তুমি মিলে আবার নতুন করে সংসার করব।”
উৎস প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে বলল,“আজকে যে ভুল করেছেন, করেছেন। পরবর্তীতে আমার বা আমার স্ত্রীর সামনে আসবেন না। আমি চাই না, কোন একসময় যাকে ভালো রাখার সবটুকু দায়িত্ব আমি নিয়েছিলাম তার সাথে খারাপ ব্যবহার করতে। বিশ্বাস করুন, আমার রুচিতে বাঁধছে৷ সব ভুলের ক্ষমা হয় না জানেন তো? আর ক্ষমা করা গেলেও সেই মানুষটাকে ফিরিয়ে নেওয়া যায় না৷ পুরুষের ভালোবাসা যেমন কঠিন সেরকম খুবই প্রবল। আপনাকে ভালোবেসে কষ্ট আর ধোঁকা খাওয়ার পর প্রায় সাত বছর আমি অন্যকাউকে ভালোবাসা তো দূর কাউকে নিয়ে ভাবার সাহসটুকুও পাইনি। তারপর নিতু আমার জীবনে এলো৷ নিয়ে এলো এক মুঠো ভালোবাসা আর বিশ্বাস সাথে কিছু অবিশ্বাস্য অতীত। ওকে নিশ্চয়ই চিনতে পারছেন?”
জুই আমতা আমতা করে বলল,“আ আ আমি তা তাকে কীভাবে চিনব?”
নিতু কুটিল হেসে জবাব দিল,“সেই তো! ছলনা করে বান্ধবীর পছন্দের মানুষকে নিজের মানুষ বানিয়ে নেওয়ার পর আমাকে কীভাবে চিনবেন? বেশরম মহিলা একটা! একটা মহিলা এত লাজলজ্জাহীন, কুকুরের মতো কীভাবে হয় সেটা আপনাকে না দেখলে বুঝতেই পারতাম না। প্রথমে আমি সেজে আমার মানুষকে কেড়ে নিয়ে সুযোগ বুঝে চরিত্রে সুরসুরানিতে অন্য লোকের বিছানায় যেতে বাঁধলো না পরে যখন আমি ফিরে এলাম তখন আবার ভালোবাসা উথলে উঠছে। ওয়াও!”
চেতে উঠল জুই৷ কড়া মেজাজে বলে উঠল, “মুখ সামলে কথা বল, ক্যামেলিয়া! তোর মতো নোংরা মেয়ের মুখে নোংরা কথা আমি সহ্য করব না। আর একটা বাজে কথা বললে এখান থেকে তুলে ঠেলে ফেলে দেব খাদে।”
সজোরে একটা থা*প্পড় পড়লো জুইয়ের গালে৷ উৎস রাগে কটমট করে চেয়ে আছে জুইয়ের দিকে।
“বলেছিলাম, ওর সাথে খারাপ ভাষায় খারাপভাবে কথা না বলতে। কথা কানে যায়নি?”
জুই গালে হাত দিয়ে অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল উৎসের দিকে। কিছুক্ষণ মৌন থেকে বলল,“তুমি আমাকে থা*প্পড় দিলে?”
“আমার স্ত্রীকে কষ্ট দেওয়া মানুষকে আমি পৃথিবীতে টিকতে দেব না।”
জুই হেসে বলল,“ক্যামেলিয়া, নিজের বাপের কথা বলিসনি? সে এখনো বেঁচে আছে কীভাবে?”
নিতু শুকনো ঢোক গিললো৷ বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল বোধ হয়। সে কিছু বলবে তার আগেই উৎস বলে উঠল, “অন্যের চিন্তা না করে নিজের চিন্তা করুন। সবটা আমার ভাবনার বিষয়, আপনার না৷ ভালোয় ভালোয় এখান থেকে কেটে পড়ুন। মিনিমাম লজ্জাবোধ থাকলে আর কোনদিন আমাদের সামনে আসার চেষ্টা করবেন না। আসলেও ফলাফল আপনার জন্য সুখকর হবে না।”
নিতু সাহস পেল৷ পাশে এমন একজন পুরুষ থাকলে কোন নারীই বা ভয়ে ভীত থাকবে? যার পাশে উৎসেদ মতো একজন পুরুষ আছে তার আর কিছুই প্রয়োজন নেই।
নিতু বুকে হাত গুজে বলল,“আপনার কি মনে হয়, টানা এগারো বছর ভেতরে ভেতরে কষ্ট পেয়ে যাকে ভালোবেসেছি তার কাছে থেকে কিছু লুকোবো। কিছুই লুকোয়নি৷ না বাপের কথা আর না আপনার কথা৷ আপনি কে, কী ছিলেন আমার, তাকে কীভাবে ছলনা করে কেড়ে নিয়েছিলেন সবই তিনি জানেন। সত্যি কথা কি জানেন, একটা মানুষ চিরকাল আরেকটা মানুষের বাস্তবে না থাকলেও কল্পনায় ঠিক বেঁচে থাকে। আপনিও তার কল্পনায় বেঁচে আছেন। ভালোবাসায় নয় ঘৃণায়। আপনার মতো বন্ধু বা আপনার স্ত্রী কখনো কারও না হোক৷ একজন পুরুষ সারাজীবন একা থাকুক তবুও আপনার মতো নারী না জুটুক।”
জুই ভাঙা ভাঙা শব্দে বলে উঠল, “ক কী বলেছিস তাকে?”
নিতু উৎসকে দেখলো। চোখে মুখে ঘৃণা যেন উপচে পড়ছে। সে বলল,“নিতু, এখান থেকে চলো৷ আমাদের সময়ের মূল্য আছে৷ থার্ড ক্লাস কোন মানুষের সাথে কথা বলে সেই সময় ব্যয় করতে হবে না।”
নিতু জুইয়ের দিকে তাকালো। বলল,”তার বিকালফুল জুই না ক্যামেলিয়া ছিল। দুজনের নামই ফুলের নাম হওয়ায় আর আমি পুরোপুরি খোলাসাভাবে সামনে না আসার সুযোগটা আপনি নিয়েছিলেন। আমার মুঠোফোন চুরি করে আমার অসুস্থতায় অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে আমার পছন্দের মানুষের সাথে আমি সেজে রিলেশনে গিয়েছিলেন এসব অনেককিছুই এখন সে জানে। সুতরাং বুঝতে পারছেন? উৎস সারাজীবন কাকে ভালোবেসেছে? আমাকে। মানুষটা আপনাকে আমি ভেবে ভালোবেসেছে, তার সব ভালোবাসা তাৎক্ষণিক আপনি পেলেও সেটা আমার জন্যই ছিল। এখানে আর কোন লুকোচুরি নেই।”
জুই উৎসের দিকে এগিয়ে এলো। আঙুলের ইশারায় নিতুকে দেখিয়ে বলল,“ও মিথ্যা বলছে। বিশ্বাস করো ওই মেয়ে মিথ্যা কথা বলছে। এরকম কিছুই হয়নি। আমি কোনভাবেই ওসব করিনি।”
উৎস বেশ স্বাভাবিকভাবেই বলল,”আচ্ছা করেননি তাতে কী হয়েছে? অতীত সেটা ছাড়া অনেককিছুই করেছেন।”
উৎস নিতুর হাত ছেড়ে আঙুল উঁচিয়ে জুইকে উদ্দেশ্য করে বলল,“এই মুখের কথার কোন দাম নেই আমার কাছে। যে শরীরকে আমি ছাড়া অন্যকেউ ছুঁয়েছে সেই শরীরের প্রতি আমার কোন আকর্ষণ নেই। যেই মন আমি ছাড়া অন্যকিছু, অন্যকাউকে ভেবেছে সে মন আমার প্রয়োজন নেই। সর্বপরি যে মানুষটা আপনি, সেই মানুষকে আমার কস্মিনকালেও চাই না। আমার ব্যক্তিগত নারী আছে। তাকে আমি অসম্ভব ভালোবাসি। সে আমার কাছে চাঁদ। যেখানে আমার ব্যক্তিগত চাঁদ আছে সেখানে আমি শরীর বিলিয়ে দেওয়া রাস্তার মেয়েদের দিকে ফিরেও তাকাই না। চার্জ প্রয়োজন হওয়া টর্চ লাইট আপনি। আপনার ক্ষণে ক্ষণে চার্জার পাল্টানোর স্বভাব নিয়ে এগিয়ে যান। এদিকে ফিরেও তাকাবেন না।”
জুই ধরে যাওয়া গলায় বলে উঠল,“উৎস!”
নিতু বলে উঠল, ”আপনার মান সম্মান প্রবল। এখনো লজ্জা লাগছে না এসব শুনে? ম*রে যেতে ইচ্ছে করছে না নিজের চারিত্রিক সনদ পেয়ে? এক সময় যে পুরুষ আপনাকে চোখে হারাতো সে-ই এখন চোখ তুলে চাইতে চায় না, লজ্জাবোধ হয় না এতেও? এসেছেন ভালোবাসার কথা বলতে? আজ থেকে এগারো বছর আগে আপনি যেমন লোভী ছিলেন এখনো ঠিক তেমনটাই আছেন। লোভের বশবর্তী হয়ে বান্ধবীর প্রিয় মানুষকে কায়দা করে নিজের করে নিলেন৷ যখন দেখলেন তার আয় সামান্য, যতটা আশা করেছিলেন ততটা না তখনই আরও একটা ধনী লোক দেখে তার হাত ধরলেন। এখন যখন জেনেছেন ক্যামেলিয়া পুনরায় উৎসের জীবনে ফিরে এসেছে, উৎস ভালো একটা অবস্থানে আছে তখন আর লোভ সামলাতে পারেননি। ছুটে চলে এসেছেন। এত নিকৃষ্ট মানুষ হয়! আপনি আদতে মানুষ কি-না তাতে সন্দেহ হয় আমার।”
জুই টলমল চোখে মাথানিচু করে নিতুর কথা শুনে গেল। পরক্ষণেই উৎসের দিকে তাকিয়ে বলল,“ভালোই আছো তাহলে!? আমি ভেবেছিলাম…”
উৎস চকিতে শুধালো,“কী ভেবেছিলেন? আপনার মতো মেয়ের জন্য ম*রে যাচ্ছি? হাহ! ভালো আছি আমি, আমার জীবনের সেরা সময়টা পার করছি এখন অবশ্যই সেরা মানুষের সাথে।”
“আমাকে ক্ষমা করা যায় না?”
জুইয়ের প্রশ্নে হাসলো উৎস। নিতুর দিকে তাকিয়ে বলল,“ক্ষমা করা যায়।”
হঠাৎই চোখমুখ চকচক করে উঠল জুইয়ের। হাতের উলটোদিক দিয়ে গাল মুছে বলল,“সব ভুলে ফিরিয়ে নেওয়া যায় না একটাবারের জন্য?”
নিতু একমনে তাকিয়ে রইল উৎসের দিকে। চোখেমুখে প্রশ্ন, কী জবাব দেবে উৎস!
উৎস তখনও নিতুর দিকেই তাকিয়ে। উৎস ওভাবেই জবাবে বলল,“মানুষ হিসেবে ক্ষমা করতেই পারি, কোন একজনের ব্যক্তিগত পুরুষ হিসেবে অতীতকে বর্তমানে নিয়ে আসতে পারি না। একা থাকলেও সেটা কখনোই করতাম না আর এখন! এখন সেটা করার প্রশ্নই ওঠে না।”
উৎস ডান হাতে নিতুর গাল স্পর্শ করে বলল,“আমি আমার বিকালফুল পেয়ে গেছি। আমি এখন কারও ব্যক্তিগত পুরুষ।”
নিতুর চোখজোড়া আনন্দে ছলছল করে উঠল ওদিকে আরেকজনের হৃদয় হয়তো ভেঙে মাঝ সাগরে প্রাণ হারালো।
নিতু উৎসের হাতের ওপর হাত রেখে জুইয়ের দিকে তাকালো। বলল,“এবার অন্তত আমাকে ভালো থাকতে দে, জুই। আমি তো আমার পছন্দের মানুষটাকে তোর হতে দেখে এগারোটা বছর একা থেকেছি। একটাবারের জন্য বলতে আসিনি এই মানুষটা আগাগোড়া আমার, শুধুমাত্র আমার। ভেবেছিলাম পছন্দের মানুষ, ভালোবাসার মানুষ ভালো থাকলেই আমিও ভালো থাকব। কিন্তু যখন সবটা জানলাম, ভাগ্য আমাদের আমাদের একসাথে লিখে নিয়েছে বুঝলাম তখন আমি তাকে ছাড়া কিছুই ভাবতে পারি না। এই মানুষটা আমার প্রথম প্রেম এবং শেষ ভালোবাসা। তার দিকে তুই দ্বিতীয়বার হাত বাড়াস না। এবার সহ্য করে নিলেও পরবর্তীতে আমি সহ্য করব না। হাত ভেঙে গুড়িয়ে দেব। আশা করি, তার মনের কথাগুলো জানার পর, তোর সম্পর্কে সে এখন কী ধারণা পোষণ করে সেটা জানার পর তুই এদিকে আর ফিরেও তাকাবি না। মেয়েদের আত্মসম্মান থাকা জরুরি। টাকার দিকে না তাকিয়ে সম্মানের দিকে একটু চেয়ে দেখ। একবার তো দিয়েই দিয়েছিলাম এই মানুষটাকে। ভালো রাখতে পারিসনি। এবার আর চোখ তুলেও চেয়ে দেখিস না। নিজেও ভালো থাক আর আমাদেরও ভালো থাকতে দে। ”
#চলবে…..