প্রিয় বিকালফুল পর্ব-৪৩

0
602

#প্রিয়_বিকালফুল(৪৩)
#তানিয়া_মাহি(নীরু)

ছেঁড়া পোশাক পরে দৌঁড়াচ্ছে এক অল্পবয়সী নারী। দুই বাহুতে বেশ খানিকটা অংশ ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। মেয়েটার চোখেমুখে আতঙ্ক। প্রাণপণে দৌঁড়াচ্ছে সে। বারবার পিছনে ফিরে দেখছে আর সামনের দিকে যত দ্রুত সম্ভব দৌঁড়াচ্ছে। চারদিকে অন্ধকার নেমেছে। মৃদু আলো জ্ব*লছে কিছুদূর পরপর। অসময়ে বৃষ্টি নেমেছে। বৃষ্টিতে ভিজে একাকার অবস্থা। চুল, মুখ বেয়ে পানি ঝরছে।

বিল্ডিংয়ে কাজ হচ্ছে এমন একটা জায়গা দেখে সামনের দিকটায় লুকিয়ে পড়ল মেয়েটা। পিছন দিকে কয়েক জনের পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। বুকটা দ্রুমদ্রুম করে কাঁপছে যেন। ছেলেগুলো কাছাকাছি আসতেই ভয় যেন কয়েকগুণ বাড়ছিল। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল সে ওখানে। ভয়ে সমস্ত শরীর কাঁপছে তার। বৃষ্টির পানি বেশ কিছুক্ষণ মাথা, সমস্ত শরীরে পড়ায় ক্ষণিকেই ঠান্ডা লেগে গিয়েছে। আচমকা হাঁচি হওয়ায় ছেলেগুলো মেয়েটার উপস্থিতি টের পেতেই মেয়েটা আগের অবস্থান ত্যাগ করে দৌঁড়ে রাস্তার দিকে বেরিয়ে এলো। দৌঁড়ে মেয়েটার পিছু নিল ছেলেগুলো। হঠাৎই গলির মুখে উবার এসে পড়ায় অকস্মাৎ ধাক্কায় মেয়েটি রাস্তায় লুটিয়ে পড়ল। ছেলেগুলো ওখানেই দাঁড়িয়ে গেল। একজন দুইহাতে অন্যদের সেখানেই দাঁড়িয়ে যেতে বলল। দূরত্ব কিছুটা বাকি তাদের মধ্যে। কেউ একজন পিছন থেকে বলে উঠল,

“ভাই, আমাদের এখানে থেকে চলে যাওয়া উচিত। ম*রলে তো ম*রলই আর বেঁচে গেলে আবার পরে দেখা যাবে।”

একে অপরের সম্মতিতে বিদায় নিল সবাই মিলে।
রাস্তায় পড়ে আছে মেয়েটি। হয়তো ওঠার চেষ্টা করছে একটু করে। গাড়ি থেকে ড্রাইভারসহ তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে এলো নিতু আর বন্যা। দৌঁড়ে এসে মেয়েটির দুই বাহু ধরে দাঁড় করানোর চেষ্টা করল। নিতু বন্যাকে বলে উঠল,

“গাড়িতে নতুন যে ওড়নাটা আছে ওটা নিয়ে আয়। শরীরটা ঢেকে দেই।”

বন্যা ছুটে গেল গাড়ির দিকে। নিতু ড্রাইভারের দিকে তাকালো। ড্রাইভার একটু ভয় পেয়ে আছে। কী করবে বুঝতে না পেরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। যেন এখনই তাকে কোন কাজের হুমুক দেওয়া হবে এবং এরপর সে সেটা করবে। নিতু মেয়েটাকে নিজের সাথে এক প্রকার জড়িয়ে নিয়ে বলল,

“ভাই, আপনি যদি একটু সাহায্য করতেন!”

লোকটা আমতা আমতা করে বলল,“ কী করতে হবে বলেন? আপা, আমি ইচ্ছে করে এটা করিনি। উনি হঠাৎ করে গাড়ির সামনে চলে এসেছিলেন। আপা, আমি মাত্র মাস খানেক ধরে গাড়ি চালাই৷ আমাকে পুলিশে দিয়েন না। আমার সামান্য টাকায় সংসার চলে, আপা।”

নিতু আশ্বস্ত করে বলল,“আপনার ভয় নেই। আপনি একটু উনাকে ধরে গাড়িতে ধরে তুলতে সাহায্য করবেন। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া জরুরি।”

বন্যা এসে ওড়নায় পেঁচিয়ে দিল শরীর। তিনজনে মিলে মেয়েটাকে গাড়িতে তুলল। সময় নষ্ট না করে গাড়ি ছুটলো হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। পুরো রাস্তা নিতু এবং বন্যা মেয়েটাকে জাগ্রত রাখার চেষ্টা করল। মেয়েটা ছোট ছোট চোখে তাকিয়ে থাকছে আবার কিছুক্ষণ পরপর চোখ বন্ধ করে নিচ্ছে। আধো আধো গলায় কিছু বলার চেষ্টা করছে কিন্তু নিতু বা বন্যা কেউই কিছু বুঝতে পারছে না। আ*ঘাত খুব একটা লাগেনি। নিতু আন্দাজ করল, মেয়েটা কঠিন বিপদ থেকে নিজেকে বাঁচাতে পালিয়েছিল।

কিছুক্ষণের মধ্যে হাসপাতালে পৌঁছলো সবাই। ইমার্জেন্সিতে ভর্তি করা হলো মেয়েটাকে। চিকিৎসা চলল বেশ কিছু সময় ধরে। সাধারণ দূর্ঘটনা না হওয়ায় পুলিশে খবর দিতে হলো কারণ পুলিশের অনুমতি ছাড়া চিকিৎসা শুরু হচ্ছিল না। নিতু এবং বন্যাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলো। ড্রাইভারও বাদ গেল না। যতটুকু জানানো সম্ভব সবটা জানালো তারা। ভিক্টিমের জবানবন্দির অপেক্ষায় হাসপাতালেই রয়ে গেল দুইজন অফিসার। নিতু এবং বন্যাও বাড়ি পৌঁছতে পারল না। এভাবে একটা মেয়েকে বাড়ির মানুষের হাতে তুলে না দিয়ে যাওয়াটা সমীচীন দেখাল না।

নিতু এবং উৎস সাজেক থেকে ভ্রমণ শেষ করে বাড়ি ফিরেছে কয়েকদিন হলো। উৎসের ছুটির মধ্যেই জরুরি মিশনের জন্য ডাক পড়ায় তাকে কাজে ফিরতে হয়েছে। নিতু আজকাল আবার কাজে মন দিয়েছে। নুরজাহান বেগম বাড়ি ফিরেছেন গত পরশু। এক জায়গা থেকে ঘুরে আসার পর বন্যার সাথে একটু বেরিয়ে, কথাবার্তা না শেয়ার করা অবধি ভালো লাগছিল না নিতুর। বন্ধুর সাথে দেখা করতে আর কথা বলতে মনটা ছটফট করছিল যেন। তাই মনকে কষ্ট না দিয়ে বন্যার সাথে কথা বলে দুজনে মিলে সময় বের করে একটু ঘুরতে বেরিয়েছিল। প্রয়োজনীয়, শখের কিছু কেনাকাটা করে দুজনে রেস্টুরেন্টে খেয়ে সন্ধ্যাপর বেরিয়েছিল বাসায় ফেরার উদ্দেশ্যে। বাসায় পৌঁছানোর পূর্বেই দূর্ঘটনার সম্মুখীন হলো দুজনে।

নিতু বাসায় শাশুড়িকে জানিয়ে দিয়েছে সম্পূর্ণ ঘটনা। ফরিনা বেগম শক্ত ধাঁচের এবং বুদ্ধিমতী মহিলা। তিনি নিতুকে জানিয়েছেন- মেয়েটাকে একা ফেলে যেন নিতু কিছুতেই বাড়ি না ফেরে৷ রাত তাতে যত হয় হোক৷ পৃথিবী থেকে মনুষ্যত্ব উঠে যাচ্ছে, নিতু যেন সেটা আরও একধাপ এগিয়ে না দেয়। বাসা থেকে গাড়ি ঠিকানায় সময়মত পৌঁছে যাবে। রাতে গাড়ির চিন্তা করতে হবে না নিতুর। প্রয়োজনে বান্ধবীকে নিয়েই যেন রাতে বাড়ি ফিরে৷

মেয়েটার সুস্থ হতেই তার পরিচয় জানতে, বাড়ির লোকদের খবর দিতে এবং পুরো ঘটনার কিছুটা অন্তত জানা যায় কি-না তার জন্য অফিসার কেবিনে প্রবেশ করেছেন কিছুক্ষণ আগে। নিতু এবং বন্যা বাহিরে বসে আছে। একজন নার্স বের হতেই নিতু মেয়েটার ব্যাপারে জানতে চাইলে নার্স জানালো মেয়েটার নাম আশা। সে রাজনীতিবীজ মহসিন সাহেবের মেয়ে। নার্স এটাও জানালো, মেয়েটার ওপর আক্র*মণ করা হয়েছিল। হয়তো রাজনৈতিক ব্যাপার জড়িত৷ তার বাড়িতে খবর দেওয়া হয়েছে। এখনই হয়তো চলে আসবে।

‘মহসিন সাহেব’ নামটা চেনা চেনা লাগলো নিতুর। মুখ গুরুগম্ভীর করে ভাবতে বসলো সে। নামটা কোথায় যেন শুনেছে। নিতুকে ভাবুক দেখে বন্যা বলে উঠল,

“তোর আবার কী হলো? কী ভাবছিস?”

নিতু নখ কামড়ে বলল,“নামটা কোথায় যেন শুনেছি।”
“ব্রেইনকে এত প্রেশার দিতে হবে। এলেই দেখতে পাবি। আমাদের সাথেও কথা বলতে আসবে নিশ্চয়ই। আফটার অল, তাদের মেয়েকে আমরা হাসপাতালে নিয়ে এসেছি।”

নিতুও সায় দিয়ে চুপ করে বসে অপেক্ষা করল। প্রায় বিশ মিনিট যেতে না যেতেই এক দল লোককে হুড়মুড়িয়ে হাসপাতালের করিডরে আসতে দেখা গেল। সামনের সারিতে সাদা পাঞ্জাবি, পাজামা পরিহিত পুরুষকে এক নজর দেখেই দাঁড়িয়ে গেল নিতু। চিনতে পারল বোধ হয়৷ বিড়বিড় করে বলে উঠল,

“এরাই তাহলে আশার বাড়ির মানুষ? ”

বন্যা সামনের দিকে তাকিয়ে বলল,“হবে হয়তো। কেন?”
“আশরাফ, আশা এরা ভাইবোন সম্ভবত। ”

বন্যা প্রশ্ন ছুড়ল,“আশরাফ কে?”
নিতু ইশারায় দেখিয়ে বলল,“সামনে সাদা পাঞ্জাবি পরা ছেলেটা।”
“তুই চিনলি কীভাবে?”
“তোকে বলেছিলাম না, একটা ছেলে আমাকে আর রিশাকে বিরক্ত করেছিল? থানা-পুলিশ হয়েছিল। এটাই সেই ছেলে। আল্লাহ বিচার করে জানি, তবে এত জলদি! মেয়েটার জন্য খারাপ লাগছে আমার। মেয়েটা এই ছেলের বোন!”

মহসিন সাহেব এবং আশরাফ কেবিনে প্রবেশ করল। বাকি সবাই বাহিরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষারত৷ ডাক্তার এই অল্প সময়ে বেশ কয়েকবার চেকআপ করে গিয়েছেন। আশার অবস্থা এখন অনেকটা ভালো। পুলিশ কথা বলে ড্রাইভারকে যেতে দিয়েছে। নিতু আর বন্যা বাহিরেই ছিল। নার্স এসে জানালো, পেশেন্ট তাদের দুজনের সাথে দেখা করতে চাইছে। এতক্ষণে সুযোগ মিললো তাদের দুজনের৷ বন্যা ভেতরে যেতে ইতস্তত করলেও নিতু হাত ধরে টেনে ভেতরে নিয়ে গেল তাকে৷ কেবিন থেকে অফিসার দুজন বেরিয়ে গেলেন। সম্ভবত কথাবার্তা সব শেষ হয়েছে। মহসিন সাহেব বেডের পাশে মেয়ের হাত ধরে দুঃখীমুখে কথা বলছেন মেয়ের সাথে। আশরাফ পাশেই দাঁড়িয়ে আছে।

নিতু আর বন্যা ভেতরে প্রবেশ করতে তিন জোড়া চোখ তাদের দিকে গেল। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল আশরাফ। নিতুকে চিনতে তার ভুল হয়নি৷ মহসিন সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। আন্তরিকতার সাথে বললেন,

“আপনারা আমার মেয়ের জন্য অনেকটা করেছেন। আমি চিরকাল কৃতজ্ঞ থাকব। আপনারা ঠিক সময়ে আমার মেয়ের কাছে না এলে তার কী যে হতো কে জানে!”

নিতু মৃদু হাসলো৷ আল্লাহর প্রতি শুকরিয়া আদায় করে বলল,“হয়তো আল্লাহই পাঠিয়েছিলেন আমাদের৷ নারী তো আজকাল কোথাও সেফ না৷ কোন ছেলে রাস্তায় ইভটিজিং করে আর তার বোনকে আবার অন্যকেউ। আশার জন্য সত্যিই খারাপ লাগছে৷ যত শক্তি, খ্যাতিই থাকুক না কেন কিছু শু*য়ো*** বাচ্চার কাছে কোনভাবেই সেফ না।”

শেষ কথাটা আশরাফের দিকে তাকিয়ে বলল নিতু। আশরাফ লজ্জায়, কষ্টে, অনুশোচনায় মাথা নিচু করে রইল।

বন্যা এবং নিতু দুজনেই আশার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে বিদায় নিতে চাইলো। মহসিন সাহেব জানালেন, এত রাতে একা না গিয়ে তাদের মধ্যে কেউ পৌঁছে দিলে ভালো হবে৷ নিতু নিজেদের গাড়ির কথা জানালো। মহসিন সাহেব আপত্তি করলেন না। নিতু বলল,

“আশা খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবে ইন শা আল্লাহ। আজকের রাতটা এখানেই থাকতে হবে। সকালে এসে দেখা করে যাব আরেকবার।”

বেরিয়ে এলো দুজনে। কয়েক কদম হাঁটতেই পেছন থেকে পুরুষ কণ্ঠস্বর ভেসে এলো,

“এই যে, শুনছেন?”

পিছন থেকে ডাক শুনে ঘুরে তাকালো দুজন। আশরাফকে দেখে দাঁড়িয়ে গেল তারা। আশরাফ এগিয়ে এসে তাদের সামনে দাঁড়ালো। মাথা নিচু করে কণ্ঠ খাঁদে নামিয়ে বলল,

“সেদিনের জন্য স্যরি। আমি আজকে বুঝতে পেরেছি ক্ষমতা, শক্তির গৌরবে আমি অমানুষ হয়ে গিয়েছি। বিশ্বাস করুন এরকম আমি আর কখনও করব না।”

নিতু ফিচেল হেসে বলল,“কোন অঘটন নিজের সাথে ঘটলেই মানুষ বুঝতে পারে। আপনার ক্ষেত্রেও তাই হলো। তাও তো বুঝতে পারলেন! এটাই অনেক।”

আশরাফ কথা না বাড়িয়ে বলল,“আশা আপনাদের কারও একজনের নম্বর চাইলো। পরে যোগাযোগ করতে চায়। এখন তো ভালোভাবে কথা বলতে পারল না।”

বন্যা নিজের নম্বরটা আশরাফকে দিয়ে বলল,“এটা রাখুন। বোনের যত্ন নেবেন৷ পরবর্তীতে বাহিরের মেয়েদেরও একটু নিজের বোনের নজরেই দেখবেন।”

#চলবে…..