প্রিয় বিকালফুল পর্ব-৪৫

0
638

#প্রিয়_বিকালফুল(৪৫)
#তানিয়া_মাহি(নীরু)

উৎস দেশে ফিরেছে। নিজের কোয়ার্টারে কিছু কাজ থাকায় সেখানে আগে যেতে হয়েছিল তাকে। প্রতিবারই মিশন থেকে ফিরে কিছু বৈঠকে বসতে হয় নিজেদের যেমনটা বসতে হয় কোথাও যাওয়ার পূর্বে। সবরকম কাজ মিটিয়ে বাসায় পুনরায় ফিরে আসতে সময় লেগেছে চারদিনের মতো। আপাতত কিছুদিন এখন পরিবারের সাথে থাকা যাবে।

রিশার বিয়ের কেনাকাটা চলছে। রিশার পরিবার মাস দুয়েক দেরি করতে চাইলেও জুবায়েরের পরিবার সেটা মেনে নেয়নি। তারা নিজেদের ছেলেকে তাড়াতাড়ি বিয়ে করাতে চান। বিশেষ করে জুবায়েরের আম্মা। তিনি রিশাকে দেখে এত পছন্দ করেছেন যার দরুন প্রায় প্রতিদিন একবার হলেও ছেলের হবু বউয়ের সাথে কথা বলেন।

রিশার নিজের পরিবারের সাথে সাথে উৎস এবং নিতুরও অনেককিছুর দায়িত্ব পড়েছে। রিশার মা স্বয়ং উৎস এবং নিতুকে দায়িত্ব দিয়েছেন রিশার বিয়ের জন্য গহনা কেনার। উৎস প্রথমে এই দায়িত্ব নিতে না চাইলে তাকে এক প্রকার জোর করা হয়। শেষমেশ রাজি না হয়ে কোন উপায় মিলেনি।

উৎস এবং নিতু বিকেলের দিকে বেরিয়েছে নিজেদের জন্য কিছু কেনাকাটা করতে এবং রিশার গহনা কেনার জন্য। সবকিছু যখন কেনা প্রায় শেষ, নিজেদের জন্য কেনাকাটাও শেষ করে শপিংমল থেকে বের হচ্ছিল তখন হঠাৎই মাথাটা ঘুরে ওঠে নিতুর। হাঁটা থামিয়ে শার্ট খামচে ধরে দাঁড়িয়ে যায় উৎসের। নিতুকে এই অবস্থায় দেখে দাঁড়িয়ে যায় উৎস নিজেও৷

“খারাপ লাগছে তোমার?”

নিতু কপালে হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল৷ তারপর নিজেকে ধাতস্থ করে উৎসকে আশ্বস্ত করে বলল,“আমি ঠিক আছি।”

“হঠাৎ এভাবে দাঁড়িয়ে গেলে যে?”
“মাথাটা একট চক্কর দিয়ে উঠেছিল।”
“আসার পর থেকে দেখছি ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করছো না৷ মাথার আর দোষ কী? সে তো এখানে ওখানে চক্কর দেবেই।”

নিতু মৃদু হেসে বলল,“এখানে কি এখন তুমি আমাকে শাসন করতে শুরু করবে নাকি? চারদিকে কিন্তু মানুষ দেখছে।”

উৎস চকিতে বলে উঠল,“বউ আমার। বউকে আমি শাসন করব নাকি আদর করব সেটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার।”

নিতুর হাতে যেই দুইটা শপিংব্যাগ ছিল উৎস সেগুলোও নিজের হাতে নিয়ে অন্য হাতে নিতুর হাত ধরে বলল,

“চলো কিছু খেয়ে নিই।”

নিতু বাঁধা দিয়ে বলল,“ক্ষুধা লাগেনি তো। শরীরটা কয়েকদিন হলো একটু খারাপ যাচ্ছে এই আর কি…”
“তাহলে এখন খাওয়া দাওয়া করে, একবার চেকআপ করে তারপর বাড়ি ফিরব। সামনে রিশার বিয়ে, তুমি এমন অসুস্থ থাকলে চলবে? তাদের তো সব ভরসা তোমার ওপর। তুমি অসুস্থ থাকলে সবকিছু কে দেখবে?”
“কিন্তু…”

নিতুকে কোন কথা বলতে না দিয়ে হাত ধরে টেনে হাঁটা শুরু করল উৎস। গাড়ির পেছনের সিটে সব জিনিসপত্র রেখে সামনে পাশের সিটে নিতুকে বসিয়ে দিল সে। নিজে গিয়েও ড্রাইভিং সিটে বসল। গাড়ি চলতে শুরু করল মুহূর্তেই।

গাড়ি এসে থামলো নিতুর পছন্দের রেস্টুরেন্টের সামনে। নিতু যে কয়েকবার উৎসের সাথে বাহিরে খেতে এসেছে তার বেশিরভাগ সময়ই এটায় এসেছে। এখানকার খাবার নিতুর বড্ড পছন্দের। তাছাড়া এখানে এত বেশি সে এসেছে যে এখানকার কাজে যারা নিয়োজিত তারা প্রায় প্রত্যেকেই তাকে চিনে।

উৎস বেছে বেছে নিতুর পছন্দের খাবার গুলো অর্ডার করল। নিতু চুপচাপ বসে বসে উৎসের কাজ দেখছে আর ভাবছে এমনিতেই কয়েকদিন খাওয়া দাওয়ার ইচ্ছে হচ্ছে না তার। খেতেই পারছে না বলতে গেলে। উৎস এতগুলো খাবার অর্ডার করল সেটা দুজনে মিলে কীভাবে শেষ করবে সেটাই ভাবছে।

ওয়েটার চলে যেতেই নিতু বলল,“এত খাবার কে খাবে?”

উৎস হেসে বলল,“আমি খাব আর তুমি চেয়ে চেয়ে দেখবে।”

নিতু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,“সেটাই করতে হবে। আমি খেতে পারব না এতকিছু।”
”সেসব পরে দেখছি। তুমি ফ্রেশ হবে একটু? আমার যেতে হবে ফ্রেশ হতে।”
“না, আমি এখানেই বসছি।”
“ঠিক আছে। তুমি বোসো, আমি আসছি।”

উৎস অল্প কিছু সময়ের মধ্যেই ফ্রেশ হয়ে ফিরে এলো। খাবার আসতে সময় নিল প্রায় আধাঘণ্টা। টেবিলভরতি খাবার। উৎস নিজেই অল্প অল্প করে পরিবেশন করল নিজের এবং নিতুর জন্য। বাকি খাবারগুলো নষ্ট না হয় তাই আগে থেকেই ওয়েটারকে জানিয়ে রাখল খাবারগুলো প্যাক করার কথা।

নিতু খেতে খেতে শুধালো,“খাবার বাসায় নিয়ে যাওয়ার কথা ভেবেই এত অর্ডার করলে?”

উৎস দুপাশে মাথা নেড়ে বলল,“না।”
“তাহলে?”
“যাওয়ার পথে কাউকে এই খাবারগুলো দেওয়ার মতো পেলে দিয়ে যাব।”

নিতু আর কিছু বলল না শুধু মৃদু হেসে পুনরায় খাওয়া শুরু করল। উৎসের কিছু কিছু কাজ তার অসম্ভব ভালো লাগে। মাঝেমাঝে সে এই মানুষটাকে দেখে আর ভাবে, এই মানুষটা তার ভাগ্যে লেখা ছিল! অধিক সময় নিয়ে হলেও তারই তো হলো! ভালোবাসার কাঙাল এই মেয়েটার ভাগ্যে এই মানুষটা আজীবন থেকে যাবে!

বাসায় ফেরার পথেই একটা জায়গায় এসে গাড়ি থামলো। জায়গাটা কখনো কখনো যাওয়া আসার পথে দেখতে দেখতে নিতুর কাছে পরিচিত হয়ে গিয়েছে। গাড়ি থামতেই নিতু শুধালো,

“এখানে থামালে কেন গাড়ি?”

উৎস গাড়ি থেকে নেমে খাবারের প্যাকেটগুলো হাতে নিয়ে নিতুর কাছে এসে বলল,“নেমে এসো বলছি।”

উৎসের কথানুযায়ী নিতু গাড়ি থেকে নেমে এলো। এদিক ওদিক দেখল কিছুক্ষণ। চারদিকে মানুষের কমতি নেই। রাস্তার দুইপাশে সারি সারি দোকানপাট। নিতু সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে বলল,

“এখানে কী?”

উৎস নিতুর হাত ধরে একদিকে হাঁটতে শুরু করল। হাঁটতে হাঁটতে বলল,“এখানে এক বয়স্ক আঙ্কেল থাকেন। ছেলেরা জায়গা জমি লিখে নিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। দিনে কারও কোন কাজ করে খাবার পেলে খেতে পারত। একদিন আমার সাথে দেখা। সেদিনই উনার সম্পর্কে জানতে পারলাম। ভেবেছিলাম ছেলেদের সাথে কথা বলব কিন্তু উনি রাজি হননি৷ আমি আর উনার অমতে কীই বা করতে পারি? তবে সেদিন থেকে আমার বেতনের একাংশ উনার কাছে যায়। ওটা দিয়েই উনি এখন দিনাতিপাত করেন। আজ মনে হলো উনার সাথে একবার দেখা করে যাই৷ তোমাকে দেখলে খুশি হবে।”

নিতু মৃদু হেসে বলল,“তোমার সম্পর্কে আর কী কী জানা বাকি কে জানে!”

উৎস নিতুর হাতটা নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে তার দিকে তাকিয়ে বলল,“এসব আসলে কিছুই না। দোয়া করো, তোমার বর যেন হাতেগোনা কয়েকজনকে অন্তত ভালো রাখতে পারে।”

নিতু হেসে জিজ্ঞেস করল,“তাদের ভালো রাখো আমার কোন আপত্তি নেই কিন্তু আমাকে ভালো রাখা এবং ভালোবাসার দায়িত্ব কিন্তু তোমার।”

“বউয়ের সাথে আর দশজনের তুলনা করলে চলে? বউ তো জীবনসঙ্গী। তাকে ভালো রাখা, ভালোবাসা থেকে শুরু করে অনেককিছুর দায়িত্বই আমার।”

নিতু বেশ আগ্রহ নিয়ে শুধালো,“কী কী করতে পারবে আমার জন্য?”
“কখনো যদি এমন পরিস্থিতি আসে যে সবরকম চেষ্টা করার পরও বিপদ না কেটে আমার পরিবর্তে তোমাকে বাঁচানো যাবে এমন কথা আসে তবে আমি হাসতে হাসতে বিদায় নেব। আর যদি তোমার দিকে কেউ ক্ষতির উদ্দেশ্যে হাত বাড়ায় তবে তাকে পৃথিবী থেকে বিদায় করতেও ভাববো না।”

নিতু মুচকি হেসে উৎসের হাতটা শক্ত করে ধরল। চাপাস্বরে বলল,“তুমি ছাড়া আমার একটা দিনও না আসুক। তুমি নেই মানে আমিও থাকব না।”

পথ শেষ করে একটা ছোট ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল দুজন। সেখানে প্রায় ৭৫/৮০ বছর বয়স্ক একটা লোকের সাথে পরিচয় হলো নিতুর। উৎস উনার কথাও বলেছিল। খাবার এবং কিছু টাকা উৎস নিতুর হাত দিয়েই দেওয়ালো এবার৷ লোকটা এতটা ভালোবাসা, সম্মান পেয়ে এক পর্যায়ে বারবার চোখ মুছতে থাকলেন। উৎস বেশ কিছুক্ষণ কথা বলল তার সাথে। রাত হয়ে যাওয়ায় এক সময় বাসায় ফেরার সিদ্ধান্ত নিতে হলো নিতু, উৎস দুজনের। বয়স্ক লোকটার থেকে বিদায় নিয়ে বেরও হলো দুজনে।

দুজন বের হয়ে গাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো। অন্ধকার বেশ ঘনিয়ে এসেছে। আকাশে চাঁদ, তারা একসাথে দেখা যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পরপর মৃদু হাওয়া বইছে। দুজনে মিনিট পাঁচেক সেখানে চুপচাপ দাঁড়িয়ে প্রকৃতির অনাবিল সুখ উপভোগ করল। যখন বাসায় ফেরার কথা হলো হঠাৎই নিতু বলে উঠল,

“তুমি গাড়িতে বোসো। আমি একটু এই যে ফার্মেসি থেকে আসছি। মাথাটা ব্যথা করছে। ওষুধ নিয়ে আসি।”

উৎস গাড়িতে বসার জন্য গাড়ির দরজা খুলেছিল। নিতুর কথা শুনে দাঁড়িয়ে গেল সে। বলল,“তুমি বোসো আমি নিয়ে আসছি।”

নিতু বাঁধা দিয়ে বলল,”তুমি বোসো আমি নিয়ে আসছি। তাছাড়া ন্যাপকিনও কিনতে হবে। তোমাকে পাঠাতে ইচ্ছে করছে না। দুইটা মিনিট বোসো। আমি এখনই আসছি।”
“শিওর?”
“ইয়েস।”

নিতু ফার্মেসির দিকে এগিয়ে গেল। কাছাকাছি যেতেই পিছন থেকে একটা মেয়েকে দেখে চেনা চেনা লাগলো তার। ভালো করে খেয়াল করতেই বুঝলো মেয়েটাকে বন্যার মতো দেখতে৷ পাশে থেকে অবিকল বন্যা মনে হচ্ছে। তাড়াতাড়ি করে এগিয়ে গেল সে। কাছে যেতেই নিশ্চিত হলো তার ধারণাই সঠিক। পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে বন্যার পিঠ চাপড়ে সে বলে উঠল,

“কী রে তুই এখানে!?”

চমকে উঠল বন্যা। একবার নিতুকে দেখে পাশেই কিছুটা দূরে দাঁড়ানো পুরুষটির দিকে ভয়ার্ত চোখে তাকালো সে। নিতুর চোখও বন্যার চোখকে অনুসরণ করল। অস্ফুটস্বরে বলে উঠল,

“তোরা দুজন একসাথে এখানে কী করছিস?”

#চলবে…..

গঠনমূলক মন্তব্য আশা করছি।🌸