প্রিয় বিকালফুল পর্ব-৪৬

0
704

#প্রিয়_বিকালফুল(৪৬)
#তানিয়া_মাহি(নীরু)

“একটা প্রেগন্যান্সি কিট দিয়েন তো, ভাই।”

ফার্মাসিস্ট কী লাগবে জিজ্ঞেস করলে নিতু কথাটা বলেই বন্যার দিকে পুনরায় তাকালো। বন্যা শুকনো ঢোক গিলে পরিস্থিতি সামলে নিতে শুধালো,

“প্রেগন্যান্সি কিট? তুই প্রেগন্যান্ট!? আমাকে জানাসনি তো!”

নিতু কড়াস্বরে বলে উঠল,“প্রেগন্যান্ট কি না সেটা জানার জন্যই নিচ্ছি। তাছাড়া তুই আমাকে সবকিছু জানাস? কার কার সাথে কথা বলিস, ঘুরতে বের হোস আমাকে জানাস তুই?”

আড়চোখে আশরাফের দিলে তাকালো বন্যা। আশরাফ এগিয়ে এলো খানিকটা। বন্যা সরে দাঁড়াতেই আশরাফ বলল,

“আপনি আমাকে অপছন্দ করেন সেটা জানি। পছন্দ করার মতো সেরকম কোন কারণও আসলে নেই। উনি আমার সাথে ঘুরতে বের হননি।”

আশরাফকে থামিয়ে দিয়ে বন্যা নিজেই বলে উঠল,“অফিস থেকে এক কলিগের বাসায় নিমন্ত্রণ ছিল। সেখানে থেকে বাসায় ফেরার পথে মনে হলো আমার ওষুধ নেওয়া হয়নি। ওই যে, একটা ফার্মেসি দেখছিস ওখানে নেমেছিলাম ওষুধ নিতে কিন্তু কেউ ছিল না তাই ওখানে অপেক্ষা না করে এদিকে আসছিলাম তখনই উনার সাথে দেখা। আমি প্রথমে চিনতেই পারিনি। উনি পরিচয় দেওয়ার পর চিনেছি। ওখান থেকেই অল্পস্বল্প কথা বলতে বলতে এখানে এসে দাঁড়িয়েছি আর তুই এলি।”

নিতু ভ্রু কুঁচকে দুজনের দিকেই একবার করে দেখল। সন্দেহ-মিশ্রিত নজর নিবদ্ধ রেখেই বলে উঠল,“আসলেই? তোরা আমাকে লুকিয়ে প্রেম করছিস না তো? সত্যি করে বল আমাকে। আমার কিন্তু তোদের দুজনকে একসাথে দেখে সন্দেহ হচ্ছে।”

বন্যা অসহায়ের মতো ঠোঁট উল্টে ডানে-বামে মাথা নাড়ল। বলল,“তুই যে আমাদের দুজনকে একসাথে সন্দেহ করছিস সেটা তোর তাকানোতেই বোঝা যাচ্ছে। বিশ্বাস কর, আমার এখন বিয়ের বয়স, প্রেমের বয়স না। উনার সাথে এই তো মিনিট পাঁচ-সাত আগেই আমার দেখা হয়েছে। উনার সাথে আমার আর কখনো কথা হয়নি।”

নিতু ফের শুধালো,“তোর নম্বর উনার কাছে তাও কল করেনি? আসলেই? ”

আশরাফ মাথা চুলকে বলে উঠল,“উনার সাথে আশার কথা হয়েছে। আমি নম্বর দিয়েছিলাম ও বাসায় ফিরলেই। আমার কাছে উনার নম্বর আছে সেটা ভুলেই গিয়েছিলাম। সেদিনের পর থেকে ভালো হয়ে গেছি বিশ্বাস করুন। আমি আর কোন মেয়েকে বিরক্ত করি না। তবে আপনার বান্ধবী সুন্দরী। বিয়ের বয়স তার হয়েছে, আমারও কম হলো না। আপনি রাজি থাকলে আমি উনাকে বিয়ের জন্য বিরক্ত করতেই পারি।”

এক ঝটকায় সামনে দাঁড়ানো দুই নারী আশরাফের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকালো৷ আশরাফ মিটিমিটি হাসছে। বন্যা মুহূর্তের মধ্যে জায়গা পরিবর্তন করে আশরাফের কাছে থেকে সরে নিতুর পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। বেচারিকে বড্ড অসহায় দেখাচ্ছে এবার। সে আশরাফের দিকে তাকিয়েই নিতুকে উদ্দেশ্য করে বলল,

“দোস্ত, আমি এই লোকটাকে চিনি না৷ প্লিজ তুই এখান থেকে চল। কী হচ্ছে এসব আমার সাথে! ধুর।”

নিতু একধাপ এগিয়ে এলো৷ শাসানো গলায় বলল,“অ্যাই! সাত মিনিটে দুনিয়ার বাইরে পাঠিয়ে দেব বললাম।”

আশরাফ হো হো করে হেসে উঠল। বন্যা নিতুর হাত শক্ত করে চেপে ধরে আশরাফকে বলল,“আপনি উন্মাদের মতো হাসবেন না। আপনাকে ভালো ভেবেছিলাম। এখন দেখছি আমার বান্ধবীই ঠিক। ”

আশরাফ বলল,“আপনার তো বিয়ের বয়স হয়েই গেছে। সমস্যা কোথায়? আপনার বান্ধবী আমাকে যতটা খারাপ ভাবে ততটা খারাপ আমি না।”

নিতু আঙুল উঁচিয়ে তীক্ষ্ণ ও ধারালো গলায় বলল,“একদম আমার বান্ধবীর দিকে নজর দেবেন না।”

আশরাফ কিছু বলবে তার পূর্বেই ভেতর থেকে কেউ বলে উঠল,“এই নিন প্রেগ্ন্যাসির কিট আর আপনার ওষুধ।”

নিতু আশরাফের দিকেই রাগি দৃষ্টিতে চেয়ে থেকেই এক হাতেই জিনিসগুলো নিয়ে নিল। বন্যাকে বলল,
“আমি টাকা পরিশোধ করে দিচ্ছি, তুমি আমাদের সাথে চল। উৎস আমার জন্য অপেক্ষা করছে।”

বন্যা সংক্ষেপে বলল,“ঠিক আছে।”
____

সারা রাত নিতুর চিন্তায় কাটলো। বলতে গেলে এক ফোঁটাও ঘুম তার হয়নি। রাতের কয়েকটা ঘণ্টা একদম নির্ঘুম কেটেছে। মাথায় একটাই চিন্তা- যে উপসর্গ দেখা দিয়েছে সেটা কি প্রেগ্ন্যাসির? নাকি সে বেশি বেশি ভাবছে? কিন্তু তারও তো বয়স অনেক আগেই হয়েছে। সে একজন মা হওয়ার জন্য একদম প্রস্তুত।

নিতুর মাঝেমধ্যেই পিরিয়ড অনিয়মিত চলে তাই খুব একটা মাথা ঘামায়নি সে কিন্তু এবারের ব্যাপারটা ভিন্ন। খাওয়া দাওয়ার এমন সমস্যা আগে কখনো হয়নি তার ওপর মাঝেমধ্যে মাথা চক্কর দেওয়া, দূর্বল লাগা এগুলো নিয়ে সে ঘাটাঘাটি করেছে। বিভিন্ন চিকিৎসকের ভিডিয়ো সে রাতে বাসায় ফিরে দেখে নিয়েছে। তাতেই মনের আশা জোরালো হয়েছে তার।

রাতে বাসায় ফেরার পর থেকে কত চিন্তা তার মাথায় ঘুরছে! একটা ছোট প্রাণ তার পেটে বেড়ে উঠবে। প্রথমদিকে তার জন্য শুধুমাত্র তার জন্য খাওয়া দাওয়া বন্ধ হবে, শরীর দূর্বল হবে তবুও প্রাণটার প্রতি কোন ক্ষোভ আসবে না। রাতের পর রাত অস্বস্তিতে এপাশ ওপাশ করে নির্ঘুম কাটবে। পেটে মাঝেমধ্যেই কারও উপস্থিতি বোঝা যাবে। মনে হবে এই তো সে নিজের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে! নয়টা মাস পর সে এই পৃথিবীতে আসবে। ছোট ছোট হাত, পা, আঙুল, চিকন গোলাপি ঠোট, নরম গাল ইশ! আর ভাবতে পারে না নিতু। তার লোভ লেগে যায় একটা বাচ্চার। ইচ্ছে করে মা হতে।

সারা রাত সে খুব করে চেয়েছে তার চিন্তাভাবনাটা যেন সত্য হয়। এত এত আশায় বুক বেঁধে ফেলেছে সে। ভেঙে গেলে বড্ড খারাপ লাগবে তার। কান্না পাবে।

বালিশের নিচেই প্রেগন্যান্সি কিট৷ কিছুক্ষণ পরপরই সেটা হাতে নেড়ে দেখছে সে। রুমে ড্রিম লাইট জ্বলছে। দেয়ালঘড়িতে বারবার সময় দেখছে আর কিছুক্ষণ পরপর উৎসের দিকে এক নজরে তাকিয়ে থাকছে। উৎসকে কিছুই জানায়নি সে। ফলাফল নিয়ে সে বেশ চিন্তিত। একসাথে দুজনের কষ্ট পাওয়া নিশ্চয়ই সুখকর হবে না। নেগেটিভ কথা মাথায় আসতেই বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস আসে তার।

ঘড়িতে চারটা বাজে। আর শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে না নিতুর। উঠে বসল সে। বালিশের নিচে থেকে প্রেগ্ন্যাসি কিটটা হাতে নিয়ে খাটে হেলান দিয়ে চোখ জোড়া বন্ধ করে নিল। ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়ছে তার। এত ভয় তার কখনো হয়নি এমনকি স্কুলের আলতাফ স্যারের ক্লাসেও না। পড়া না পারলে চিকন বেতের বারি খেতে হতো। কই তখনো তো এত ভয় লাগেনি তার! এত ভয় কেন হচ্ছে তার! সারা রাত একটু ঘুম অবধি হলো না!

বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো নিতু। পুরো রুমে পায়চারি শুরু হলো তার। কী মনে করে নামাজের প্রস্তুতি নিল। ওযু করে জায়নামাজ নিয়ে বসলো। মনে হলো এই সময় একজনের রহমত তার খুব করে প্রয়োজন। তিনিই সর্বোচ্চ সহায়তাটুকু করতে পারবেন। তিনি চাইলেই নিতুর মনের ইচ্ছেটা পূরণ হবে নচেৎ না।

অনেকটা সময় জায়নামাজে ব্যয় করে উঠল নিতু। জায়নামাজ ভাজ করে জায়গায়মতো রেখেও দিল। উৎস তখনও ঘুমে আচ্ছন্ন। একপাশে ফিরে অঘোরে ঘুমোচ্ছে সে। পাশে গিয়ে বসলো নিতু। উৎসের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে কপালে একটু চুমু খেয়ে পুনরায় উঠে দাঁড়ালো।

নিতু ধীরপায়ে রওয়ানা দিল ওয়াশরুমের দিকে৷ হাতে প্রেগ্ন্যাসি কিট আর মনে ভয়মিশ্রিত প্রবল আকাঙ্ক্ষা। মা হওয়ার যে ভীষণ ইচ্ছে হয়েছে তার। কয়েকদিন আগেও ইচ্ছেটা এত প্রবল ছিল না। হঠাৎ করেই যেন এই চিন্তাটা তার মন-মস্তিস্ক দখল করে নিয়েছে। দিনে দিনে যখন কিছু বুঝতে পারছিল তখন থেকেই ইচ্ছেটা জোরালো হতে শুরু করেছে। সন্দেহ জেগেছে মনে। তারই ফলাফলের সম্মুখীন হতে চলেছে সে। মনে একটাই প্রশ্ন-

কীসের সম্মুখীন হবে সে? নিজেকে সে কিছুক্ষণের মধ্যে কোথায় নিয়ে গিয়ে দাঁড় করাবে? কে আজ তার সঙ্গ দেবে? সুখ নাকি দুঃখ?

#চলবে…..