#প্রিয়_বিকালফুল(৪৮)
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
বিয়ে, অনুষ্ঠান, প্রয়োজনীয় যেকোন কাজ সবকিছু মিটে গিয়েছে। বাহিরে বের হওয়া বা কোথাও উপস্থিত হওয়ার প্রয়োজনীয়তা এখন আর নেই। আলোর বেগে সময় কেটে যাচ্ছে। উৎসের কাজে ফিরতে হয়েছে পুনরায়৷ এ সময়ে নিতুর সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন উৎসের তবুও সে সময়টা উৎস দিতে ব্যর্থ। পরিবার, স্ত্রী ভুলে ফিরতে হয়েছে তাকে৷ রিশার বিয়ের কিছুদিন পরই চলে যেতে হয়েছে তাকে। নিতুর মা নুরজাহান বেগম এসে থাকছেন মেয়ের কাছে। মেয়ের যাবতীয় দেখাশোনা তিনিই করছেন। যখন যা প্রয়োজন তখন তা পূরণ করছেন তিনি৷
নিতুর শারীরিক পরিবর্তন ঘটতে শুরু করেছে। প্রথম চার মাস তার খাওয়া দাওয়ার প্রচন্ড সমস্যা হয়েছে। যা খেয়েছে তার সবই যেন মুহূর্তের মধ্যে বমি করে বের করে দিতে হয়েছে তাকে। পেটে কিছু সহ্য হয়নি। এখন পরিস্থিতিতে কিছু ভিন্নতা আসতে শুরু করেছে। খাওয়া দাওয়াতে আগের মতো খুব একটা সমস্যা নেই তাই। ওজন বাড়তে শুরু করেছে। দিনে কতবার যে আয়নায় নিজেকে দেখে আর বিলাপ করে বলে- আমি মোটা হয়ে যাচ্ছি! ওজন পরে কীভাবে কমাবো?
নিতুর মা এবং শাশুড়ি বোঝান এই সময় ওজন বাড়বে। কতকিছু ত্যাগ করতে হবে! বাচ্চা হলে ওজন ধীরে ধীরে আবার কমে যাবে এগুলো চিন্তার কোন বিষয় না। নিতু মেনে নেয়। তারা যেহেতু বলেছে তাহলে হয়তো সঠিকই বলেছে।
উৎস বাড়ির বাহিরে আজ অনেক দিন। প্রতিনিয়ত ফোনকলে কথা হয় বাড়িতে। অন্যান্য কাজের মতো কথা বলা, নিতুর সার্বিক খোঁজ খবর নেওয়া নিত্যদিনের কাজ হিসেবে ধরা দিয়েছে তার কাছে। নিতুর এখন সারাদিন শুয়ে বসে, শাশুড়ি -মায়ের সাথে গল্প করেই দিন কাটছে৷ শুয়ে শুয়ে রিলস দেখে, বাবুর কোন ভিডিয়ো সামনে এলেই সেটা হাসি হাসি মুখ করে দেখে, পেটে আলতো করে হাত বুলিয়ে দেয়। কিছু ভিডিয়ো আবার সে উৎসকেও পাঠায়। উৎস ফ্রি হয়ে কল দিলে নিতু জানতে চায় ভিডিয়ো দেখেছে কি-না? দেখলে সেসব নিয়ে কথা আর না দেখলে সেটা নিয়ে মান অভিমান চলে কিছুক্ষণ। এভাবেই দিনের পর দিন সময় কেটে যাচ্ছে তার।
পেটের ভেতরে থাকা ছোট প্রাণের উপস্থিতি আজকাল টের পায় নিতু। কিছুক্ষণ পরপরই নড়েচড়ে ওঠে। নিতু চুপ করে সেটা অনুভব করে। এই সময়টায় সে উৎসকে ভীষণভাবে মিস করছে। এত এত সুন্দর মুহূর্ত একা উপভোগ করা যায়? পেটের মধ্যে বাবু যখন নড়েচড়ে ওঠে নিতুর ইচ্ছে করে উৎস সেই সময়টায় তার পাশে থাকুক। বাবু নড়লেই চট করে উৎসের হাতটা পেটের ওপর নিয়ে উৎসকে দেখাবে কীভাবে ভেতরের প্রাণটা জানান দেয়! উৎস টের পেলে নিশ্চয়ই আশ্চর্য হবে তৃতীয় জনের উপস্থিতি বুঝতে পেরে।
নিতু সকালের খাবার খেয়ে নিজের রুমেই শুয়ে শুয়ে ফোন নিয়ে সময় কাটাচ্ছিল। এক অচেনা নম্বর ভেসে উঠল ফোনস্ক্রিনে। সাথে সাথে ওপরে মেসেজের নোটিফিকেশন,
“দোস্ত, লোকটা আমাকে জ্বা*লিয়ে মারছে। এবার তুই সামলা।”
বন্যার মেসেজ দেখে ভ্রু কুঁচকে বসে রইল নিতু। কলটা কেটে মেসেঞ্জারে প্রবেশ করতেই পুনরায় কল এলো। কিছু ভেবে সময় নষ্ট না করে কলটা নিজেই কেটে দিল নিতু। বন্যাকে কল করল সে। মুহূর্তের মধ্যে রিসিভ হলো, বন্যা ওপাশ থেকে চকিতে বলে উঠল,
“সে আমার বাড়িতে অবধি বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। আমার বাড়ির মানুষদের হাত করে ফেলেছে। তারা এখন আমাকে সকাল-বিকাল ফোন করে আশরাফের সাথে বিয়ের কথা বলে। এমন করে বোঝায় যেন আমি ছোট বাচ্চা, আমি কিছু বুঝি না। আমার বাড়িতে যাতায়াত করে আশরাফ। আমার এখানে বাসার নিচে দাঁড়িয়ে থাকে। কল করে। আমি নিজেও এই কয়েকটা মাস এত ইগনোর করেছি যে এখন আমি সেটা করতেও ক্লান্ত৷ একটা মানুষ এভাবে কীভাবে পিছে পড়ে থাকতে পারে বল আমায়?”
নিতু বন্যার সব কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সন্দিহান গলায় শুধালো, “উনি আসলেই এতসব করছে?”
“হ্যাঁ, না করলে কি আমি মিথ্যা বলব?”
নিতু নখ কামড়ে ধীরগতিতে বলল,“না, কিন্তু মানুষ এত ভালো হয়ে যায়?”
বন্যা বলে উঠল, “সে কি আসলেই খারাপ ছিল? সেদিনের ঘটনা বাদ দিয়ে একটু বিচার করবি? কী করব আমি?”
নিতু ভাবনায় পড়ে গেল৷ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,“তুই বিকেলে আমার বাসায় আয়। আমাকে আশরাফ বারবার কল করছে৷ নম্বর দিয়েছিস হয়তো?”
“আমি বলেছি নিতু রাজি না হলে আমি বিয়ে করব না তাই তোর নম্বর চাইলো। আমিও দিয়ে দিয়েছি। এবার দেখ ভাই-বোন মিলে তোকে দিনরাত বিরক্ত করবে৷ আশা মেয়েটাও কম না৷ সারাক্ষণ ভাবি ভাবি করতেই থাকে। দুই ভাইবোনের প্যারা আমি আর নিতে পারছি না। বিয়ের জন্য কোন মেয়ের পিছনে কেউ এভাবে পড়ে থাকে আমার জানা ছিল না। আমি এখন অতিষ্ঠ। মনে হচ্ছে হ্যাঁ বলে দেই নইলে অন্য দুনিয়ায় গিয়ে দুইটা ঘণ্টা শান্তিতে ঘুমাই।”
বন্যাকে থামিয়ে দিয়ে নিতু বলে উঠল, “হয়েছে হয়েছে! আমি তোর জন্য চিন্তিত ছিলাম বলেই ওর সাথে মিশতে না করেছিলাম কিন্তু এখন তো পুরো বিষয়টিই উল্টো দেখছি৷ আমার নিজেরই এখন আর আশরাফকে খারাপ লাগছে না। তুই চাইলে একবার খোলামেলাভাবে কথা বলে দেখতে পারিস। ”
বন্যা অবাকভঙ্গিতে বলে উঠল, “তুই বলছিস এই কথা?”
“হ্যাঁ বলছি। তোর কথা শুনে মনে হয়েছে তুই নিজেও আশরাফকে অপছন্দ করিস না। সেই কবে আমার সাথে একটা খারাপ ঘটনা ঘটেছিল তার জন্য সারাজীবন একটা মানুষ খারাপ থাকবে সেটাও তো বলতে পারি না। তুই উনার সাথে দেখা-সাক্ষাৎ কর, দুই একদিন কথাবার্তা বল, খোঁজ নিয়ে দেখ সে কি আসলে বদলে গেছে নাকি নাটক চলছে?”
বন্যা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। বন্যাকে চুপ থাকতে দেখে নিতু আবার বলল,“আজ বিকেলে তুই আশরাফের সাথে দেখা কর আর ওখান থেকে সোজা আমার বাসায় চলে আয়৷ তুই আজ আমার বাসায় থাকবি।”
“তোর কী অবস্থা? ভাইয়া কবে আসবে? তুই তো বলেছিলি, ভাইয়া এবার লম্বা ছুটি পাবে। কই উনি? তোরও তো সময় প্রায় হয়ে আসছে৷ এখন তো অন্যদের চেয়ে ভাইয়াকে বেশি প্রয়োজন তোর।”
নিতু প্রলম্বিত শ্বাস ছাড়ল। “লম্বা ছুটিতে আসবে বলেই একটু দেরি হচ্ছে৷ সামনে সপ্তাহে চলে আসবে হয়তো। তুই এসেও তো কয়েকটা দিন থেকে গেলে পারিস।”
“বান্ধবীর বাসায় থাকাট খারাপ দেখায় তবুও আজ গেলে দুইদিন তোর সাথে থেকে তারপর আসব যাহ।”
নিতু মৃদু হেসে বলল,“হ্যাঁ হ্যাঁ আয়। বিয়ে হয়ে গেলে আবার আসতে পারবি কি-না!”
বন্যা মেকি রাগ দেখিয়ে বলল,“ঠাট্টা করিস না তো! ভালো লাগে না।”
নিতু খিলখিল করে হেসে উঠল। তক্ষনি দরজায় ঠকঠক আওয়াজ হতেই সেদিকে তাকালো সে। বলল,“বন্যা ফোনটা রাখ তো, কেউ এসেছে।”
“আচ্ছা” বলে কল কেটে দিল বন্যা। নিতু গলা উঁচিয়ে জানতে চাইলো,“কে?”
বাহিরে থেকে ফরিনা বেগম কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠলেন,“আমি।”
“আম্মা?”
“হ্যাঁ। ”
“ভেতরে আসুন।”
ফরিনা বেগন ভেতরে পা দিয়েই বলে উঠলেন, “একটু নিচে আসতে পারবে?”
“কেন কী হয়েছে? আর আপনাকে এমন চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন, আম্মা? সব ঠিক আছে তো? আমার আম্মা? আম্মা ঠিক আছে?”
ফরিনা বেগম ওপর নিচ মাথা নেড়ে বললেন,“হ্যাঁ।”
“তাহলে কী হয়েছে? আমাকে বলুন, আম্মা। আপনাকে দেখতে মোটেও ঠিক লাগছে না। আমার চিন্তা হচ্ছে।”
ফরিনা বেগম ডান হাতের শাহাদাত আঙুল কাধের ওপর রেখে পেছনে, বাসার বসার ঘরকে ইশারায় বুঝিয়ে বলল,
“বসার ঘরে চলো একটু। গেলেই দেখতে পাবে।”
নিতু এবার জিদ নিয়ে বলল,“আপনি না বললে আমি কিছুতেই যাব না।”
“আপনার ছেলে এসেছে!?” পরক্ষণেই প্রশ্নটা করল নিতু।
ফরিনা বেগম দুইপাশে মাথা নেড়ে বলল,“জুঁই এসেছে। নিচে বসে আছে।”
নিতু চোখ বড় বড় করে বলে উঠল, “জুঁই! কিন্তু কেন?”
#চলবে…….