#প্রিয়_বিকালফুল(৫৪)
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
উৎস বাড়ি ফিরলো অনেক রাত করে। বাসার সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। উৎসের কাছে বাসার আলাদা চাবি থাকায় সেটাই আজ ব্যবহার করতে হয়েছে তাকে। নিতু নিজেও ঘুমিয়ে গিয়েছিল কিন্তু রুমে উৎসের উপস্থিতি বুঝতেই জেগে উঠেছে সে। আজকাল গভীর ঘুম হয় না তার। কেউ যেন রুমে পা ফেললেও সেটা সে ঘুমের মধ্যেই বুঝে যায়। আজও তাই হলো।
উৎস ফ্রেশ হয়ে রুমে এসে নিতুকে খাটে হেলান দিয়ে বসে থাকতে দেখে বলল,“ঘুমোওনি তুমি!”
“ঘুমিয়েছিলাম তো। আপনি আসায় ঘুম ভেঙে গেল। কোথায় গেছিলেন? এত রাত হলো কেন ফিরতে?”
উৎস মৃদু গলায় বলে উঠল,“একসাথে কতগুলো প্রশ্ন করবে বলো তো! একটা একটা করে করো।”
নিতু কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে উৎসের দিকে চেয়ে রইল। উৎস আপন মনে নিজের পোশাক পরিবর্তন করে যাচ্ছে। নিতু ফের শুধালো,
“এত দেরি কেন হলো ফিরতে?”
“কাজে আটকে গিয়েছিলাম।”
“কাজ বলতে?”
উৎস নিতুর পাশে এসে বসলো। নিতুর চোখে চোখ রেখে বলল,“ভেবেছিলাম তোমার চিরশত্রুকে মা*রার সুযোগ দেব তোমায়। নিজে হাতে তাকে শেষ করবে, এত বছরের ভীতি, ঘৃণা দূর করবে কিন্তু সেটা হলো না।”
নিতু আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করল,“তা তার মানে তুমি কিছু করেছ?”
“আমি কিছু করলে সেটাও শান্তির হতো কিন্তু তার আগেই নিজে নিজে বিদায় নিয়েছে।”
“মানে?”
উৎস সবটা জানালো নিতুকে। স্পষ্ট করেই জানালো নুরুল পালানোর পর দূর্ঘটনার বিষয়টা। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে হাসপাতালে নেওয়ার আগেই ঘটনাস্থলে প্রাণনাশ ঘটে।
উৎস তখন সেই লোকের কথা শুনে আগ্রহ দমাতে না পেরে এক নজর দেখতে গিয়েছিল। রাস্তা পার হয়ে দেখতে যাওয়ার আগ মুহূর্তেই নুরুল ইসলাম দুনিয়া ত্যাগ করে। এত কয়েকদিনের নির্ম**ম অত্যা**চার এবং দূর্ঘ*টনার আঘা**ত তার অসুস্থ, নির্জীব দেহ সহ্য করতে পারেনি।
উৎসের সব কথা শুনে নিতুর মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। চোখজোড়া বড় বড় আকার ধারণ করল। সে এক পলকে উৎসের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“সত্যি সত্যি মা**রা গেল!?”
“হ্যাঁ। আগামীকালই হয়তো তোমার মা-ও জানতে পারবে আর লা**শ তোমাদের বাড়ির ঠিকানায় পাঠানো হবে। সে আর যাই হোক, ঠিকানাটা বলে যেতে পেরেছে।” চকিতে জবাব দিল উৎস।
নিতুর মধ্যে কোন খারাপ লাগা দেখা গেল না। শুধু অবাক হয়েছে সেটা কিঞ্চিৎ বুঝলো উৎস। উৎসের কথা শেষ হলে দুজনই কিছুক্ষণ নিরব রইল। এভাবেই কিছু সময় কেটে গেলে নিতু আয়নার দিকে তাকিয়ে শুধু বিড়বিড় করে বলে উঠল,
“আফসোস, তাকে আমি শেষ করতে পারলাম না।”
পরদিন বিকেলের দিকে সত্যি সত্যি নুরুল ইসলামের মৃতদেহ গাড়ি করে তার নিজ বাড়িতে নিয়ে আসা হলো। যোগাযোগ করে জানানো হলো নুরজাহান বেগমকে। নুরজাহান বেগম কাঁদতে কাঁদতে রওয়ানা দিলেন। লোকটা যা-ই করে থাকুক না কেন, যতই অমানুষ হোক না কেন তিনি তো দীর্ঘ সময় ধরে সব ভুলে অন্ধের মতো এই অমানুষটাকেই ভালোবেসেছিলেন।
উৎস নিতু এবং ফরিনা বেগমকেও সাথে করে গিয়েছিল। কাফন, দাফন শেষ করে রাতেই সবাই বাড়ি ফিরেছে। সেখানে শুধু রয়ে গিয়েছে নুরজাহান বেগম৷ তিনি জানিয়েছেন, কয়েকদিন পরই তিনি আবার নিতুর কাছে ফিরবেন৷ এখন, এই সময়ে নিজের বাড়ি ছেড়ে থাকা ঠিক হবে না। নিতুও প্রথমে মায়ের সাথে থাকতে চেয়েছিল কিন্তু নিতুর এই সময়ে বাসার বাহিরে এমন পরিবেশে থাকা উচিত হবে না বলে নুরজাহান বেগম নিজেই মেয়েকে সাথে রাখেননি। তাছাড়া তিনি খুব বেশিদিন এখানে থাকবেনও না। অতঃপর উপায় না পেয়ে উৎস, নিতু এবং ফরিনা বেগম নুরজাহান বেগমকে রেখেই নিজেদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিল। বাড়ি ফেরার সময় উৎস নুরজাহান বেগমকে জানালো, বাড়ি ফেরার আগে যেন উৎসকে একবার জানানো হয় তাহলে সে নিজেই এসে নুরজাহান বেগমকে বাড়ি নিয়ে যাবে। নুরজাহান বেগমও রাজি হয়েছেন।
___
আজ হঠাৎ করে নিতুর মাথাব্যথাটা বেড়েছে। দুপুর থেকে বিছানায় পড়ে আছে সে। উৎস বিকেলে হাঁটতে বের হওয়ার কথা বলতেই নিতু বলল,
“আজকে বের হব না৷ মাথাটা খুব ব্যথা করছে। মনে হয় না আজ হাঁটতে পারব একটুও।”
উৎস ঘড়ি পরতে পরতে নিতুকে বিছানা ছেড়ে উঠতে বলেছিল। নিতু উক্ত কথা জানাতেই ত্রস্তপায়ে তার পাশে এসে বসলো। গালে, কপালে, গলায় হাত দিয়ে গায়ের তাপমাত্রা বোঝার চেষ্টা করল সে। তাপমাত্রা ঠিকই আছে শুধু মাথাব্যথা!
উৎস শুধালো,“কখন থেকে এমন?”
“দুপুরে ঘুমানোর পর থেকে। মাথাব্যথায় ঘুম ভেঙে গেছে।”
“আমাকে জানাওনি কেন?”
“ভাবলাম ঠিক হয়ে যাবে। অনেকদিন সেভাবে মাথাব্যথা করে না। আজ হঠাৎ এমন হয়েছে। আমি মাথা নাড়াতে পারছি না।”
উৎস নিরব ভঙ্গিতে নিতুর দিকে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। নিতু নিজেও পূর্বের ন্যায় বসে রইল মাথা সোজা করে। উৎস নিতুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
“আমি ডাক্তারকে কল করছি। এখন এই সময়ে যেকোন ওষুধ তো তোমাকে খাওয়ানো যাবে না। ডাক্তার যতক্ষণে আসবে ততক্ষণে কি আমি তোমার মাথায় তেল দিয়ে দেব? তেল নিলে হয়তো কিছুটা সময়ের জন্য ভালো লাগবে। তাছাড়া মাথাব্যথায় কেউ মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেই শান্তি লাগবে দেখবে।”
নিতু উৎসের চোখে চোখ রাখল।
“সাহেব এখন বউয়ের মাথায় তেল দিয়ে দেবে?”
“আগে দেইনি?”
“উমম তা দিয়েছ।”
“তুমি বোসো। আমি আসছি এখনই।”
উৎস উঠে ডাক্তারকে একটা কল করল। ডাক্তার জানিয়ে দিল কোন ওষুধ খেতে হবে। উৎস নিজে না গিয়ে বাসার সামনে থেকেই কিনে আনতে ড্রাইভার চাচাকে পাঠিয়ে দিল। অবশেষে তেল নিয়ে এসে প্রথমে ধীরে ধীরে আলতো করে নিতুর চুল আচড়ে দিয়ে বিলি কেটে তেল দিতে শুরু করল। নিতু চোখ বন্ধ করে বসে রইল৷ উৎস নিতুর মাথায় তেল দেওয়ার ফাঁকে জিজ্ঞেস করল,
“বন্যার বিয়ে কবে যেন? যাওয়ার কোন প্ল্যান আছে?”
নিতু চোখ বন্ধ করেই বলে উঠল,“সেরকম কোন প্ল্যান করার সময় কি আমার আছে? তবে ওকে বলেছিলাম, বিয়ের দিন গিয়ে ঘুরে আসব। এই তো সামনে শুক্রবারেই বিয়ে ওদের। আমাকে তো ডেইলি একবার করে ফোন করবেই। কী কী কেনা হয়েছে, কী কী করা হচ্ছে, কী কী করা বাকি সবকিছু জানায়। মেয়েটার বিয়েতে আগে থেকে থাকতে না পেরে খারাপই লাগছে কিন্তু নিজের কথাও তো ভাবতে হবে তাই আর ওসব দিকে মন দিচ্ছি না।”
“তোমার এত চিন্তা করতে হবে না। প্রয়োজনে আমি তোমাকে বৃহস্পতিবারেও নিয়ে গিয়ে ঘণ্টাখানেকের জন্য ঘুরিয়ে নিয়ে আসব। সেটা তোমার বান্ধবীকে জানানোর প্রয়োজন নেই। তোমাকে হুট করে দেখলে খুশি হয়ে যাবে।”
“যেতে পারব বলছো?” জিজ্ঞেস করেই উৎসাহে পিছনে ঘুরে তাকালো নিতু।
উৎস নিতুর কপালে একটা চুমু খেয়ে বলল,“তোমাকে নিয়ে যাওয়া এবং নিয়ে আসা আমার দায়িত্ব। বাড়িতে বসে আফসোস করার চেয়ে ঘণ্টাখানেক ঘুরে আসলে কিছু হবে না।”
নিতু কপাল উঁচিয়ে, ঠোঁট উল্টে ছোট বাচ্চাদের মতো ধন্যবাদ জানালো। উৎস হেসে পেছন থেকেই জড়িয়ে ধরল নিতুকে।
____
বৃহস্পতিবার। আজ উৎসদের বাড়িতে ফিরলেন নুরজাহান বেগম। নিতুকে জানানোর পর উৎস নিজেই গিয়ে নিয়ে এসেছে শাশুড়িকে। নিতু মনে মনে আশ্বস্ত হয়েছে এটা ভেবে যে, সন্ধ্যার দিকে বন্যার গায়ে হলুদে তারা দুজনে গেলে ফরিনা বেগমকে আর একা থাকতে হবে না। দুই বেয়াইন মিলে একসাথে গল্প করে সময়টা কাটাতে পারবে তাছাড়া মা একা একা ওখানে থাকায় চিন্তাও হচ্ছিল তার। এখানে চলে এসেছে ভালোই করেছে। নিতু এখন সবদিক দিয়ে নিশ্চিন্ত। জীবনের পূর্ণতার খাতায় একে একে সব মিলতে শুরু করেছে তার। উৎসকে পেয়েছে সে। ভালো একটা সংসার, শাশুড়ি, ছোটবেলা থেকে ঘৃণা করে আসা অমানুষটির দূর্ঘট*নায় মৃ**ত্যু সবই তো নিতুর পূর্ণতা। এবার শুধু গর্ভের সন্তান সহি-সালামতে পৃথিবীতে আসা বাকি। এরপর নিতুর আর কিছুই চাওয়ার নেই।
নিতু গোসল শেষ করে খাবারের জন্য নিচে এসেছে। নুরজাহান বেগম এবং ফরিনা বেগম দুজনেই মাত্র নামাজ শেষ করে জায়নামাজেই বসে আছেন। নিতুকে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ফরিনা বেগম বলে উঠলেন,
“বাহিরে কেন রে, মা? ভেতরে আয়।”
নিতু মৃদু হেসে ভেতরে প্রবেশ করল। বিছানার ওপর গিয়ে বসতেই দুজনে জায়নামাজ উঠিয়ে যথাস্থানে রেখে নিজেরাও এসে বসলেন। ফরিনা বেগম নিতুকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“কিছু বলবি, মা? মুখ দেখে তো মনে হচ্ছে কিছু বলতে এসেছিস।“
নিতু ইতস্তত করে জবাব দিল,“তোমার ছেলে বলছিল ঘণ্টাখানেকের জন্য বন্যাদের বাড়িতে নিয়ে যাবে সন্ধ্যার দিকে। বন্যাও ফোনের ওপর ফোন করছে। আমি কি যাব?”
নুরজাহান বেগম ফরিনা বেগমের দিকে বলে উঠল,“এই সময়ে বিয়ে বাড়ির অনুষ্ঠানে যাওয়া কি ঠিক হবে?”
“উৎস বলছিল নিয়ে যাবে” চকিতে জবাব নিতুর।
ফরিনা বেগম বললেন,“উৎস যদি সাথে সাথে থেকে আবার সাথে করে নিয়ে আসে তাহলে যা। যদি বলে রাখতে যাবে আবার নিয়ে আসার সময় নিয়ে আসবে তাহলে ওভাবে যাওয়ার প্রয়োজন নেই।”
নিতু তড়িৎ বলে উঠল,“না, না। ও নিয়ে যাবে, সাথে সাথেই থাকবে আর নিয়েও আসবে।”
“তাহলে যা সমস্যা নাই। কিন্তু মা, সাবধান। নিজের খেয়াল রাখবি। খারাপ লাগলে উৎসকে নিয়ে সোজা বাসায় চলে আসবি।”
“ঠিক আছে।”
শাশুড়ির অনুমতি পেতেই যেন কোন এক অদৃশ্য বোঝা নেমে গেল মাথা থেকে। খাওয়া দাওয়া শেষ করে বিশ্রাম না নিয়েই আলমারি খুলে জামাকাপড় বেছে বেছে ঠিক করতে থাকলো কোনটা সে এখন পরতে পারবে। আগের কোনকিছুই এখন হতে চায় না। শরীরের ওজন বেড়ে যাওয়াই তার কারণ। পছন্দের শাড়িটা পরবে তারও উপায় নেই। আগের কোন ব্লাউজ আর তার হচ্ছে না। একটা একটা করে পরে পরে দেখছিল কিন্তু কোনটাই ঠিকঠাক হচ্ছে না। মনটাই খারাপ হয়ে গেল নিতুর। জামাকাপড় বিছানায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে মন খারাপ করে বসে রইল সে। উৎস নিজেও বাসায় নেই। নিতু মনে মনে ভাবলো, উৎস থাকলে নিশ্চয়ই কোন একটা উপায় বের করে দিত কিন্তু সে কোথায়? খাওয়া দাওয়া করে বেরিয়েছে সে। বন্যার বাসায় যেতেও বেশি সময় নেই। কী রেখে কী করবে কিছুই বুঝতে পারছে না নিতু। ফোনটা খুঁজলো সে। ডায়াল করল উৎসের নম্বরে। উৎসের ফোন বেজে উঠল দরজার দিকে। সেদিকে তাকাতেই উৎসকে শপিংব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল নিতু। ফোন কেটে শুধালো,
“কোথায় গিয়েছিলে তুমি?”
উৎস এগিয়ে এসে ব্যাগটা রেখে বিছানায় একবার চোখ বুলিয়ে নিল।
“বিছানার এই অবস্থা কেন? কী করছিলে তুমি?”
নিতু মুখভার করে জবাব দিল,“শাড়ি পরব ভেবেছিলাম কিন্তু কোন ব্লাউজ হচ্ছে না আমার। মুটিয়ে গেছি।”
উৎস এবার ব্যাগখানা নিতুর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,“এখানে তোমার নতুন শাড়ি আর নতুন মাপের ব্লাউজ আছে। পরে রেডি হয়ে নাও। আমার মনে হয় এটা তোমার পারফেক্ট হবে।”
নিতু উৎসের হাতে থেকে ব্যাগটা নিয়ে শাড়ি, ব্লাউজ বের করে দেখে উৎসকে জিজ্ঞেস করল,“তুমি এসব নিয়ে আসতেই বের হয়েছিলে?”
“জি ম্যাম!”
“কতদিকে নজর তোমার!”
“নজরের সবদিকে তুমি থাকলে নজর তো এতদিকে থাকবেই। নাও নাও রেডি হয়ে নাও। সন্ধ্যা নামবে এখনই।”
নিতু ধীরে ধীরে নিচে নেমে এলো বিছানা থেকে। বলল,“তুমি বোসো। আমি জামাকাপড়গুলো আলমারিতে রেখেই রেডি হয়ে নিচ্ছি। বেশি সময় লাগবে না।”
উৎস বাঁধা দিয়ে বলল,“উহু, আমি সব গুছিয়ে রাখছি। তুমি তৈরি হয়ে নাও।”
নিতু শুধু একটা প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে মৃদু গলায় উৎসের দিকে চেয়ে বলল,“এই তুমি এমন না হয়ে অন্যরকম হলে আমার যে কী হতো। আল্লাহর কাছে থেকে পাওয়া শ্রেষ্ঠ উপহার তুমি আমার জীবনের। শুকরিয়া, হাজারবার শুকরিয়া তোমাকে পাওয়ার জন্য।”
#চলবে……