#প্রিয়_বিকালফুল(৫৫)
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
বেশ ধুমধামে বন্যা এবং আশরাফের বিয়েটা সম্পন্ন হয়েছে। নিতু এবং উৎস হলুদ থেকে শুরু করে বিয়ের শেষ অবধি যতটা থাকা সম্ভব ততটা থেকেছে। বন্যা বারবার নিতুকে আসতে এবং থাকতে বললেও কল্পনা করতে পারেনি নিতু সত্যিই এতটা সময় সেখানে থাকতে পারবে তবুও সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে। বান্ধবীকে খুশি করতে পেরে নিতু নিজেও খুশি। কৃতজ্ঞ সে উৎসের প্রতি। উৎসের জন্যই এতকিছু সম্ভব হয়েছে। বিয়ের পরপরই নিজ বাসায় নতুন যুগলকে দাওয়াতও করেছে নিতু এবং উৎস। সবকিছু বেশ সুন্দরভাবেই মিটে গিয়েছে। নিতুর নিজেরও আর কোন ধরণের আক্ষেপ নেই।
এখন সময়টা শুধু নিতু, উৎস আর তাদের অনাগত সন্তানের। নিতু হাতেগোনা ক’দিনের মধ্যে বাচ্চা জন্ম দেবে অথচ তার এখনকার আচরণ একদম বাচ্চাদের মতোই। শুয়ে, বসে বা কোন কিছু করার সময় যখন পেটে বাচ্চার নড়ে ওঠা বুঝতে পারে তখনই সব ফেলে পেটের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসে আর উৎসকে ডেকে দেখায়।
সকালের ঘটনা। উৎস কারও সাথে ফোনে ব্যস্ত ছিল। নুরজাহান বেগম বেশ কিছু ফল কেটে নিতুকে খাওয়ার জন্য দিয়ে গিয়েছে। বসে বসে সেগুলোই খাচ্ছিলো নিতু। হঠাৎই পেটে বাবুর নড়েচড়ে ওঠা বুঝতে পেরে আচমকা স্বর উঁচু করে উৎসকে ডেকে ফেলে। এমনভাবে ডেকেছে যেন কোন অসুবিধা হয়েছে। ফোন কেটে দৌঁড়ে এলো উৎস। কপালে চিন্তার ভাজ ফেলে শুধালো,
“কী হয়েছে? খারাপ লাগছে?”
নিতু তখনো পেটের দিকে তাকিয়েই আছে। উৎস তড়িঘড়ি করে গিয়ে নিতুর পাশে বসলো। গালে হাত দিয়ে মুখটা উঁচু করার চেষ্টা করে বলল,
“কী হয়েছে বলবে তো!”
নিতু মুখ সোজা করে পূর্বের ন্যায় পেটের দিকে তাকিয়েই বলে উঠল,“ও নড়ছে। পেটে ব্যথা দিয়ে নড়ছে। দেখো এই পাশে উঁচু হয়ে আছে। ঠেলে ওপরে উঠেছে।”
উৎস নিতুর দিকে একবার আর তার পেটের দিকে একবার অসহায় ভঙ্গিতে চাইলো। প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে বলল,
“আমি ভেবেছিলাম তোমার কিছু হয়েছে। কী ভয়টাই না পাইয়ে দিয়েছিলে ওভাবে ডেকে!”
নিতু মুচকি হেসে বলল,“আরে ওসব ছাড়ো। ওকে দেখো তুমি।”
কী আর করার! পাগলের সাথেই যেন পাগলামি করতে হলো উৎসের।
____
নিতুর সন্তান প্রসবের তারিখের আর তিন- চারদিন বাকি। ফরিনা বেগম এখনো নিতুকে উপহার হিসেবে সেরকম কিছু দিতে পারেননি। আজ সকালে ঘুম থেকে উঠেই এ কথা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল তার। একা একা এখন বাহিরে যাওয়ার সাহস তিনি করতে পারেন না। কিছুদিন আগেই অসুস্থ হয়েছিলেন তিনি। শরীরটা বেশ দূর্বল। ছেলেকে সাথে করে নিয়ে যাবেন তারও উপায় নেই। ভাবনা-চিন্তা করে নুরজাহান বেগমকে সাথে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। ভাবলেন বিকেলের দিকে একটু বের হয়ে বোনের বাসায় গিয়ে বোনকেও সাথে নেবেন। বোনকে ফোন করে বিষয়টা জানাতেই তিনি জানালেন রিশার শাশুড়ি বেশ কয়েকদিন ধরে বাসায় যাওয়ার কথা বলছিলেন তাই গতকাল বিকেলে তিনি সেখানে গিয়েছেন। আগামীকাল বাসায় ফিরবেন। সুতরাং উপায় না পেয়ে ফরিনা বেগম নিতুর মাকে নিয়ে বিকেলে বেরিয়েছেন। উদ্দেশ্য ছেলের বউয়ের জন্য অল্প পরিমাণে হলেও একটা স্বর্ণের উপহার দেওয়া। বাচ্চা পৃথিবীতে এলে তো সবাই তাকেই উপহারে উপহারে ডুবিয়ে দেবে অথচ যে নারী এতগুলো দিন সব কষ্ট সহ্য করে একটা বাচ্চাকে জন্ম দেবে তার কি প্রাপ্য কিছুই নেই!
ফরিনা বেগম নিতুর জন্য উপহার কিনতে যাওয়ার পূর্বে নুরজাহান বেগমকে জানিয়েছেন। এ ব্যাপারে তিনি আর কাউকেই কিছু জানাননি। নুরজাহান বেগম দুপুরে খাওয়া দাওয়া শেষ করে নিতুকে রুমে পৌঁছে দিয়ে নিজে ফরিনা বেগমের রুমে আসতেই দেখলেন ফরিনা বেগম আলমারি থেকে টাকা বের করে সেখানেই সামনে দাঁড়িয়ে টাকা গুনছেন। নুরজাহান বেগম গলা খাঁকারি দিয়ে নিজের উপস্থিতি বোঝাতেই ফরিনা বেগম মৃদু হেসে বললেন,
“ওহ বেয়াইন! আমি আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। নিতু রুমে গেছে?”
নুরজাহান বেগম হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লেন। বললেন,
“ওকেই রুমে দিয়ে এলাম।”
ফরিনা বেগম এগিয়ে এলেন। টাকাগুলো টেবিলে রাখা নিজের সাইড ব্যাগে রেখে বললেন,“বিকেলে ফ্রি আছেন তো তাই না?”
“তা আছি৷ কেন বলুন তো?”
“দুইজন মিলে একটু বের হব।”
“কোথায়?”
“একটু স্বর্ণ কিনতে হবে। ছেলের বউ প্রথম বংশেরবাতি জ্বা*লবে আর শাশুড়ির পক্ষ থেকে কোন উপহার পাবে না সেটা কী করে হয়? নাতি-নাতনি যেই আসুক সে তো উপহার পাবেই আর তাকে আনার জন্য যে এত কষ্ট সহ্য করছে, নিজের প্রাণের ঝুঁকি নিয়েও একটা প্রাণকে পৃথিবীতে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে উপহার পাবে না!? আমার বউমা বলে কথা। আমার পক্ষ থেকে সে কিছু না কিছু পাবেই।”
ফরিনা বেগমের চিন্তাভাবনা অনেক উন্নত সেটা নুরজাহান বেগম এ বাড়িতে এসেই বুঝেছিলেন তবে সর্বদা এত সুন্দর তার চিন্তাভাবনা সেটা আশা করেননি৷ মৃদু হেসে নুরজাহান বেগম প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে মেয়ের ভালো ভাগ্যের জন্য শুকরিয়া আদায় করেন তিনি। রাজি হয়ে যান মেয়ের শাশুড়ির সাথে যেতে। তবে ভেতরে ভেতরে একটা লজ্জাও কাজ করে। এ সময় তার নিজের হাতে কোন টাকা পয়সা নেই মেয়েকে স্বর্ণের কিছু দেওয়ার মতো। সামান্য কিছু টাকা তিনি আলাদা করে রেখেছেন নাতি-নাতনি যেই আসুক তাকে স্বর্ণের কিছু দেওয়ার জন্য। তিনি মনে মনে ভাবলেন, মেয়েকে স্বর্ণের কিছু দিতে না পারলেও সুন্দর একটা শাড়ি তিনি দিতেই পারবেন।
অনেকগুলো দোকান ঘুরে ঘুরে ফরিনা বেগম নিতুর জন্য এক জোড়া স্বর্ণের চুড়ি নিলেন। পছন্দ দুজন মিলেই করেছেন তবে ফরিনা বেগমের কথা, বউমাকে একটা জিনিস উপহার দেব সেটা অবশ্যই ভালো আর সুন্দর হতে হবে। শুধু দেব বলে যা-তা তো দেওয়া যায় না৷ সুন্দর ডিজাইনের দিতে হবে যেন সেটা দেখে নিতু খুশি হয় এবং পছন্দ করে। হলোও তাই। ফরিনা বেগমের পছন্দের ওপরও নুরজাহান বেগমের ভরসা জন্মাতে বাধ্য হলো।
স্বর্ণের দোকানগুলো পেরিয়ে এসে নুরজাহান বেগম
আমতা আমতা করে বললেন,
“আপা, আমি চাচ্ছিলাম মেয়েটাকে একটা শাড়ি দিতে৷ মা হই, আমারও তো কিছু দিতে ইচ্ছে করে তবে এখন হাতে সেরকম টাকা নেই৷ একটা শাড়ি যদি দিতে পারতাম!”
ফরিনা বেগম উচ্ছ্বসিত হলেন। বেশ খুশি খুশি মুখ করে বললেন,“মায়ের দেওয়া উপহারের আবার টাকা দিয়ে বিচার হয় নাকি? চলেন তো! মেয়ে আজ খুশি হয়ে যাবে। ওর মুখের হাসি দেখার জন্য মনটা ছটফট করছে।” বলেই একটা শাড়ির দোকানের দিকে রওয়ানা দিলেন ফরিনা বেগম।
পেছন থেকে নুরজাহান বেগম বলে উঠলেন,“আপনি একজন সত্যিকারের দারুণ মানুষ, আপা। আপনার মতো শাশুড়ি সব মেয়ের ভাগ্যে জুটুক৷ মেয়েরা একটু ভালো থাকুক, স্বস্তি পাক। আল্লাহ আপনাকে সবসময় ভালো রাখুক। আপনার মানসিকতা অনেক উন্নত, আপনাকে যত দেখছি ততই অবাক হচ্ছি। আপনার মতো মানুষ যদি সবাই হতো!”
ফরিনা বেগম দাঁড়িয়ে গেলেন। মৃদু হেসে বললেন,“দোয়া দাঁড়িয়ে কেন করতে হবে? আসুন তো। বাসায় ফিরতে অনেক দেরি হয়ে যাবে। এই সময়ে আমাদের এভাবে বাহিরে থাকা উচিত না। পরে সময় পাব না বলে আজই বের হয়েছি। আসেন আসেন।” বলে নুরজাহান বেগমকে টেনে দোকানের ভেতরে নিয়ে গেলেন।
দিন ছোট হওয়ায় বিকেল হতে হতেই সন্ধ্যা হয়ে গেল। নিতুর জন্য শাড়ি কিনে বাড়ির উদ্দেশ্যে বের হলেন দুজন। এখন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়ি ফিরতে হবে।
রাস্তার দিকে এসে ড্রাইভারকে কল দিলেন ফরিনা বেগম। গাড়িতে তেল না থাকায় ড্রাইভার গিয়েছিল তেল তুলতে। ফরিনা বেগম কল করার মিনিট কয়েক পরেই গাড়ি সামনে এসে হাজির হলো।
দুজনে গাড়িতে উঠবেন তখনই ফরিনা বেগমের ফোনটা বেজে উঠল। ফোনস্ক্রিনে চোখ বুলাতেই দেখলেন উৎস কল করেছে। ফরিনা বেগম নুরজাহান বেগমকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“দেখেছেন বেয়াইন, উৎস কল করেছে। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে বলবে হয়তো।”
ফরিনা বেগম কল রিসিভ করে নিজেই বলে উঠলেন,“আমরা রওয়ানা দিচ্ছি, বাবা।”
ওপাশ থেকে উৎস বলে উঠল,“আম্মা, তাড়াতাড়ি বাসায় এসো। নিতু কেমন যেন করছে। ওকে নিয়ে জলদি ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। ওকে দেখে সুবিধার লাগছে না। তাড়াতাড়ি এসো।”
#চলবে….