#প্রিয়_বিকালফুল(৫৬)
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
নিতুর প্রসব ব্যথা উঠেছে। বিকেল থেকে ব্যথা হালকা হিসেবে নিয়েছিল সে। ভেবেছিল এখনও তো সময় আছে আর পেট তো মাঝেমধ্যে ব্যথা করে তাই সে কাউকে জানায়নি কিন্তু ব্যথা ক্ষণে ক্ষণে বৃদ্ধি পেতে পেতে এখন অসহ্যকর হয়ে উঠেছে। নিতুর ছটফটানি দেখে উৎস বুঝতে পেরেছিল কিছু একটা। এটা নিয়ে জিজ্ঞেস করতেই নিতু জানালো- বিকেল থেকে পেট ব্যথা করছে এখন ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। ধীরে ধীরে অসহ্যকর হয়ে উঠেছে।
নিতু অবস্থা জানা এবং বোঝার পর উৎস এক মুহূর্ত দেরি করেনি। মাকে কল করেছিল সাথে সাথে। মায়ের আসতে দেরি হতে পারে এই অনিশ্চয়তায় সে তার এক বন্ধুকেও কল করে গাড়ি পাঠাতে বলেছে। যেটা আগে আসবে সেটাতেই রওয়ানা দিতে হবে। দেরি করা কিছুতেই চলবে না।
উৎস আগে থেকে র**ক্তের জন্য যাদের বলে রেখেছিল তাদেরও পুনরায় জানিয়ে রাখল। হাসপাতালে ফোন করে আগে থেকে সুব্যবস্থা করে রাখতে তাগাদা দিল। সবদিকে প্রায় সবই রেডি কিন্তু গাড়ির দেখা মিলছে না কিছুতেই। এ সময় উৎসের মনে হলো উবারে কল করলেও উপকার পাওয়া যেত হয়তো কিন্তু এখন বড্ড দেরি হয়ে যাবে।
নিতু একবার বিছানায় গড়াগড়ি করে চিৎকার করছে আবার উঠে বসছে আবার কখনো বা হাঁটাহাঁটি করছে। ব্যবহার কেমন উন্মাদের মতো হয়ে গিয়েছে নিতুর। কিছু সহ্য হচ্ছে না তার। কিছুক্ষণ পরপর কেমন শব্দ করে উঠছে।
উৎস আগে থেকে গুছিয়ে রাখা ব্যাগটা বের করে সামনের দিকে রাখল। গাড়ি এলেই নিতু আর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের এই ব্যাগটা নিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে ছুটবে।
উৎস বারবার জানালা দিয়ে উঁকি দিচ্ছে আর মাকে ফোন করছে। মা সমানে জানাচ্ছেন তারা প্রায় এসে গেছেন। আজকে পথ যেন ফুরাচ্ছেই না। ওদিকে নিতুর মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। উৎস নিতুর দিকে এগিয়ে যেতেই নিতু এসে উৎসের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। উন্মা*দের মতো কাঁদতে শুরু করল অসম্ভব যন্ত্রণায়। উৎস শুধু নিতুকে আরেকটু সহ্য করে নিতে বলছে। সান্ত্বনা দিচ্ছে।
এভাবেই কেটে গেল কিছুক্ষণ। অতঃপর উপায় না পেয়ে বাহিরের কোন গাড়িতেই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল সে। এই সময়ে এই রাস্তায় খালি গাড়ি পাওয়া মুশকিল হবে তবুও ঘরে তো আর এভাবে বসে থাকা যাবে না। কিছু একটা করতেই হবে।
উৎস নিতু এবং ব্যাগটা নিয়ে ধীরে ধীরে বাড়ি থেকে বের হলো। এ যাবৎ কখনো মায়ের ওপর রাগ না হলেও আজ প্রচন্ড রাগ হচ্ছে তার। আজই কেন তাদের বের হতে হলো!
উৎস নিতুকে নিয়ে বাহিরে আসতেই নিজেদের গাড়ি ভেতরে প্রবেশ করল। গাড়ি থামতেই সাথে সাথে ফরিনা বেগম এবং নুরজাহান বেগম বেরিয়ে এলেন৷ নিতু এতক্ষণে ঘেমেনেয়ে অস্থির হয়ে পড়েছে। নুরজাহান বেগম দৌঁড়ে এগিয়ে এলেন মেয়ের দিকে। জড়িয়ে ধরে হা-হুতাশ করতে শুরু করলেন। ওদিকে ফরিনা বেগম নিজেও নিতুর এমন অবস্থা দেখে ভীষণ চিন্তিত। কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন।
রতন মিয়া গাড়ির ভেতর থেকেই বলে উঠলেন,“আব্বা, আম্মারে নিয়া তাড়াতাড়ি গাড়িতে উইঠা পড়েন। দেরি করা যাইবো না। আম্মার অবস্থা তো ভালো না।”
উৎস কোন কথার জবাব না দিয়ে নিতুকে আলগোছে ধরে নিয়ে গাড়ির পিছনের সিটে গিয়ে বসলো। নুরজাহান বেগম গাড়িতে উঠবেন তখনই উৎস বলে উঠল,
“গাড়িতে সবাই আটবে না। চাচা আমাদের নামিয়ে দিয়ে এক্ষুনি আবার আসবে। আপনি আর আম্মু একটু পর আসুন। এখন দেরি করার সময় নেই। চাচা গাড়ি স্টার্ট দেন। জোরে চালাবেন।”
কেউ আর কোন কথা বলল না। গাড়ি চলতে শুরু করল। আস্তে করে বাড়ির গন্ডি পেরিয়ে রাস্তায় বের হলো।
ফরিনা বেগম এবং নুরজাহান বেগম একভাবে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে রইলেন। নজর রাস্তার দিকে। ফরিনা বেগম আফসোস করে বলে উঠলেন,
“কেন যে আজই যেতে গেলাম। না জানি মেয়েটার কত কষ্ট হচ্ছে! কখন গাড়ি ফিরবে আর কখন আমরা যাব? এখন তো ছেলেকে ফোনও দিতে পারব না। রিসিভ তো করবেই না আর করলেও মেজাজ দেখাবে। জ্যামে আটকে পড়ে কতটা সময় রাস্তায় দিতে হলো।”
“আমার খুব ভয় করছে। আমাদের আগে বাড়িতে না এনে আগেই হাসপাতালে রেখে আসলেই পারত। এখন এখানে দাঁড়িয়ে, বসে দুশ্চিন্তা করা ছাড়া কোন উপায় নেই।”
“আল্লাহ ভরসা। ভেতরে চলেন এখন। এভাবে এখানে দাঁড়িয়ে থেকেও তো কোন লাভ নেই। ওযু করে দুজনে নামাজে বসি চলেন। আল্লাহ কোন না কোনভাবে সাহায্য ঠিক করবেন। নিতু আর বাচ্চা দুজনে সুস্থ থাকলেই হলো। আল্লাহ আল্লাহ করুন।”
বলেই ফরিনা বেগম বাসার ভেতরের দিকে রওয়ানা দিলেন। নুরজাহান বেগম নিজেও একবার করে পিছনে আর সামনে তাকাতে তাকাতে ভেতরের দিকে গেলেন।
রাস্তায় প্রচন্ড জ্যাম। এই সময়ে সচরাচর রাস্তায় খুব একটা ভিড় না থাকলেও আজ তার ভিন্নতা দেখা দিয়েছে। কিছুক্ষণ পরপরই গাড়ি এসে থেমে যাচ্ছে। এদিকে নিতু ব্যথায় ছটফট করছে, চিল্লাচিল্লি করছে। উৎস নিতুর মাথা নিজের বুকে ঠেকিয়ে নিয়ে হাত বুলিয়ে বারবার শান্ত হতে বলছে। নিতুর এই অবস্থা দেখে নিজেও ঠিক থাকতে পারছে না। ইচ্ছে করছে সব ছেড়েছুড়ে নিতুকে কোলে করেই রওয়ানা দিতে কিন্তু সেটা সম্ভব না। পথ অনেকটা বাকি।
রতন মিয়া গাড়ি থেকে বেরিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে বেশ কয়েকজনের সাথে কী যেন কথা বলল। কিছুক্ষণ পর ফিরে আসতেই সামনের দিকে থেকে গাড়ি একটু একটু করে সরতে শুরু করল। রাস্তা ফাঁকা হচ্ছে দেখে একটু আশার আলো যেন জ্ব*লে উঠল।
গাড়ির চাকা আস্তে আস্তে চলতে শুরু করল। ওদিকে নিতু কান্না করেই যাচ্ছে। কেঁদে কেঁদে বলছে,
“উৎস, আমি মরে যাচ্ছি। আমি আর সহ্য করতে পারছি না। আমি বোধ হয় বাঁচব না। তুমি প্লিজ আমাদের সন্তানকে আদরে বড় করবে।”
নিতুকে শক্ত করে বুকে চেপে ধরল উৎস। ভাঙা গলায় বলে উঠল,“এসব উল্টাপাল্টা কথা একদম বলবে না। কিচ্ছু হবে না তোমার। এই তো আরেকটু যেতে হবে। আর একটু সহ্য করো প্লিজ। কিচ্ছু হবে না তোমার।”
গাড়ি কিছুটা ফাঁকা জায়গায় চলে এসেছে। উৎস সেটা খেয়াল করতেই রতন মিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল,
“গাড়ির গতি বাড়ান, চাচা। সময় নেই হাতে। তাড়াতাড়ি পৌঁছতে হবে আমাদের।”
“এর চেয়ে বেশি জোরে যাওয়া কি উচিত হবে, বাবা?”
“হবে। আপনি গতি বাড়ান।”
রতন মিয়া কোন উপায় না পেয়ে উৎসের কথা অনুযায়ী গতি বেশ খানিকটা বাড়ালো। উনি নিজেও কখনো এত গতিতে গাড়ি চালাননি। বেশ সচেতনতার সাথে গাড়ি ড্রাইভ করতে শুরু করলেন তিনি। কোনভাবে নজর একটু হটলেই যা-তা হয়ে যেতে পারে।
গাড়ি তার নিজ গতিতে চলছে। নিতু ভেতরে তখনো কান্নাকাটি করেই যাচ্ছে। উৎস আর নিতুকে সামলাতে পারছে না। নিজেরও এখন কান্না পেয়ে যাচ্ছে। উৎস শক্ত মনের মানুষ কিন্তু প্রিয় মানুষের এমন যন্ত্রণা সে কিছুতেই দেখতে পারছে না।
“চাচা, আর কতক্ষণ লাগবে?” উৎসের কথায় রতন মিয়া জবাবে বলল,
“আর পাঁচ মিনিট, আব্বা।”
রতন মিয়া গাড়ি চালাতে আর উৎস যখন নিতুকে সামলাতে ব্যস্ত তখনই হঠাৎ পিছন থেকে গাড়িতে সজোরে আঘা*ত লাগল। নিয়ন্ত্রণ হারালো উৎসদের গাড়ি। ছিটকে গেল সামনের দিকে।
চারদিকে নিস্তব্ধতা কয়েক মুহূর্তের জন্য। নিতু পূর্বেই ছিটকে পড়েছে বাহিরে। উৎস বহু কষ্টে একা একা ভেতর থেকে বাহির হওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। চারদিকে থেকে মানুষ এসে ভিড় জমালো। ছুটে এলো গাড়ির দিকে। হৈ-চৈ শুরু হলো। কেউ কেউ পানি নিয়ে, স্যাভলন নিয়ে ছুটে এলো। হাত ধরে সাবধানে টেনে বের করল উৎসকে। উৎসের হাতে প্রচন্ড লেগেছে। সে বের হতে হতেই বলে উঠল,
“গাড়ির ভেতরে আরও একজন আছে। তাকে প্লিজ আপনারা একটু বের করুন। উনি জীবিত। আর আর আর আমার ওয়াইফ ছিল, সে বাহিরে ছিটকে পড়েছে। সে ঠিক আছে? সে সন্তানসম্ভবা। ডেলিভারির পেইন উঠেছে। সে কোথায়? আমাকে প্লিজ তার কাছে নিয়ে চলুন আর একটা গাড়ি বা অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করে দিন। হাসপাতালে পৌঁছতে হবে। প্লিজ আপনারা সাহায্য করুন আমাদের।“
নিতুকে ঘিরে অনেকে দাঁড়িয়ে আছে। উৎসকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হলো। কয়েকজন মিলে নিতুর হাত-পায়ের তালু ঘষাঘষি করছে। মাথায় পানি ঢালছে কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। উৎস বারবার নিতুকে ডেকেই চলেছে পাগলের মতো। কোন সাড়াশব্দ নেই৷ অ্যাম্বুলেন্সের জন্য কল করা হয়েছে। সেটাও প্রায় চলে এসেছে কিন্তু নিতু! নিতু কোনভাবেই রেস্পন্স করছে না। উৎস এ পর্যায়ে আর ধৈর্য্য ধরতে না পেরে কেঁদেই ফেলল। কেউ একজন ভিড় ঠেলে ভেতরের দিকে এসে নিতুকে পর্যবেক্ষণ করে জানালো,
“এ কি! মেয়ে তো মারা গেছে!”
#চলবে…