#প্রিয়_বিকালফুল(৫৭)
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#অন্তিমপর্ব
“এ কি! মেয়ে তো মারা গেছে!”
এমন একটা বাক্য উৎসের কানে পৌঁছতেই প্রাণহীন চোখে যেন নিতুর দিকে তাকালো সে। নিতুর কোথাও কোন আঘা*তের চিহ্ন নেই তবুও এমন কীভাবে হতে পারে! এক পলকে নিতুর দিকে তাকিয়ে থাকার দরুন চোখ জোড়া দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল উৎসের। সে মাথা দুপাশে নাড়িয়ে বলে উঠল,
“এটা কিছুতেই হতে পারে না। কীভাবে এমন করতে পারে ও? এটা কিছুতেই হতে পারে না। কিছুতেই না।”
মুহূর্তের মধ্যে অ্যাম্বুলেন্স চলে এলো ঘটনাস্থলে। উৎস তখনও নিতুকে বুকে জড়িয়ে রেখে পাগলের মতো কান্নাকাটি করে যাচ্ছে। কয়েকজন এসে নিতু আর উৎসের কাছে এসে পৌঁছলো। নিতুকে ধরে স্ট্রেচারে তুলবে তখনই সেই একই ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল,
“মাইয়া বাঁইচা আছে? আমি তো বুঝলাম মইরা গেছে।”
অ্যাম্বুলেন্সের সাথে আসা একজন ধমকের স্বরে বলে উঠলেন,“যখন বোঝাটা ঠিক বুঝতে পারেন না তখন নিজের সেই ভুল বোঝা অন্যকে বলতে যান কেন? কে বলছে বেঁচে নেই? এই তাড়াতাড়ি গাড়িতে ওঠা।”
শেষাক্ত কথাটা নিজের সঙ্গীকে উদ্দেশ্য করে বলল লোকটা। উৎস কোন কথা বলল না। সোজা নিতুর পাশে গিয়ে হাতটা ধরে গাড়িতে বসে রইল। গাড়িতে রতন মিয়াকেও তোলা হলো। তিনিও যথেষ্ট পরিমাণে আ*হ*ত হয়েছেন। চিকিৎসার প্রয়োজন।
হাসপাতালে পৌঁছনোর পরপরই নিতুর জ্ঞান ফিরল। ডেলিভারির জন্য নিয়ে যাওয়া হলো তাকে। উৎস মাকে কল করে নিজেদের একাই চলে আসতে বলেছে। কারণ জিজ্ঞেস করলে সে আর সম্পূর্ণ কথা জানাতে পারেনি।
কেবিনের ভেতরে নিতু আর বাহিরে একটা চেয়ারে বসে আছে উৎস। হাতে আঘা**ত লাগার ফলে এখনো র*ক্ত বের হচ্ছে। তাকে ডাক্তারের চেম্বারে যেতে বললেও সে যায়নি৷ উপায় না পেয়ে হাসপাতালের পরিচিত একজন নিজেই গিয়ে একজন নার্সকে ডেকে এনেছেন আপাতত প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য।
উৎসের হাতে আঘা*তপ্রাপ্ত জায়গায় ব্যান্ডেজ করে দেওয়া হলো। বাড়ির মানুষ সবাই এতক্ষণে হাসপাতালে চলে এসেছে এবং সবকিছু জেনেও নিয়েছে। ফরিনা বেগম আসার সময়ই বোনকে খবর দিয়েছিল৷ ও বাড়িরও প্রায় সবাই চলে এসেছে। নিতুর ফোন উৎসের কাছে ছিল। বন্যা ফোন করায় সে শুধু জানিয়েছে নিতুর ডেলিভারির জন্য হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। সে লোকেশন জেনে নিজেও আশরাফের সাথে পৌঁছে গেছে।
ছেলের অবস্থা দেখে ফরিনা বেগমের সে কি কান্না! নুরজাহান বেগম নিজেও বাহিরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছেন৷ বাহিরে জামাতার অবস্থা খারাপ দেখলেও মেয়ের কী অবস্থা সেটা তিনি দেখতে পারছেন না। মেয়েটা আদৌ ঠিক আছে তো? গুরুতর আহ*ত হয়েছে রতন মিয়া। উৎসের খানিকটা লেগেছে কিন্তু নিতুকে দেখতে মনটা বড্ড আনচান করছে।
নিতুকে ভেতরে নেওয়ার অনেকটা সময় কেটে গিয়েছে। উৎস দরজার পাশেই সামনে বসে আছে বা হেঁটেহেঁটে ভেতরের খবর পেতে অপেক্ষা করছে। বাহিরে অন্যরা সবাই একজোট হয়ে দাঁড়িয়ে অথবা বসে আছে।
বাচ্চার আওয়াজ!
ভেতর থেকে বাচ্চার কান্নার আওয়াজ শোনা গেল। পায়চারি করতে করতে থেমে গেল উৎস। চোখাচোখি হলো কয়েকজনের সাথে। তারা কি ঠিক শুনলো? নাকি অতিরিক্ত উত্তেজনায় ভুল শব্দ কানে এলো! একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি হচ্ছিল। বিশ্বাস করতে পারছিল না কেউ।
পুনরায় বাচ্চার কান্নার আওয়াজ। এবার সবার মুখে খুশির ঝলকানি দেখা গেল। বাচ্চার কান্নার আওয়াজ জোরালো হচ্ছে। দরজার ঠিক সামনে গিয়ে দাঁড়ালো উৎস। মন যে আর মানছে না। নিতু ঠিক আছে তো!
মিনিট দুয়েকের মাঝে ডাক্তার নিজেই বেরিয়ে এলেন বাচ্চা কোলে নিয়ে। ছুটে এলো সবাই। উৎস এক ভাবেই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে। নজর ভেতরের দিকে। ডাক্তার উৎসের কোলে বাবু তুলে দেবে তখনই উৎস বলে উঠল,
“নিতু ঠিক আছে?”
ডাক্তার মৃদু হেসে বাচ্চাকে উৎসের কোলে তুলে দিলেন। বললেন,
“দুজনই আল্লাহর রহমতে ভালো আছে। সুস্থ আছে। বিপদ যেমন তিনি দেন সেরকম বিপদ থেকেও তিনিই উদ্ধার করেন। আপনাদের গাড়ির সাথে যে দূর্ঘ*টনা ঘটেছিল তাতে অনেককিছু হয়ে যেতে পারত কিন্তু আল্লাহ মীরাক্কেল ঘটিয়ে আপনার ওয়াইফকে কীভাবে বাহিরে বের করে দিয়েছেন। সাময়িক সময়ের জন্য জ্ঞান হারালেও উনার কিন্তু সেরকম কোন চোট লাগেনি এবং তিনি নরমাল ডেলিভারিতেই বাচ্চা জন্ম দিতে সক্ষম হয়েছেন আলহামদুলিল্লাহ। একজন মানুষের সাথে এত এত মীরাক্কেল হতে আমি কখনো দেখিনি।”
উৎস এবার বাবুর দিকে তাকালো। ভাঙা গলায় জিজ্ঞেস করল,“কী বাবু হয়েছে? ওর ইচ্ছে ছিল বাবু যেদিন পৃথিবীতে আসবে সেদিনই আমরা জানব আমাদের ছেলে বাবু নাকি মেয়ে বাবু হয়েছে। তাই কয়েকবার আল্ট্রাসাউন্ড করলেও সে কী বাবু সেটা জিজ্ঞেস করিনি।”
ডাক্তার হেসে বলললেন,“আপনি রাজকন্যার বাবা হয়েছেন। আল্লাহ আপনার ঘরে রহমত পাঠিয়েছেন। জানেন তো, আল্লাহ যাদের ওপর বেশি খুশি থাকে তাদের প্রথম কন্যাসন্তান দেন।”
উৎস তার ডান হাতে প্রথমবারের মতো বাবুর গাল, হাত, পা, পুরো শরীর অল্প অল্প করে স্পর্শ করল। ছোট পুতুলের মতো মানুষটার নরম তুলতুলে গালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে আচমকা কেঁদে ফেলল সে। ফরিনা বেগম এসে কিছুক্ষণ পর ছেলের কোলে থেকে বাবুকে নিলেন। সবাই এবার বাবুকে কোলে নিতে আর আদর দিতে ব্যস্ত।
একে একে কয়েকজন নার্স ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন। উৎস একজনের কাছে এগিয়ে গিয়ে শুধালো,“আমি কি এখন একটু ভেতরে যেতে পারব? নিতু কেমন আছে?”
নার্স জবাবে বলল,“উনি ঠিক আছেন। আপনারা এখানেই অপেক্ষা করুন। উনাকে কেবিনে শিফট করে দিচ্ছি।”
নুরজাহান বেগম এসে জিজ্ঞেস করলেন,“আজই তো বাসায় নিয়ে যেতে পারব তাই না?”
“আসলে এক্সিডে*ন্টে উনার কে*টেছিঁড়ে না গেলেও হাতের মাংসপেশিতে চাপ লেগেছে। র*ক্ত জমেছে কিছুটা। আজকের রাতটা এখানেই রাখুন। আগামীকাল বিকেলের দিকে নাহয় বাসায় নিয়ে যাবেন৷ উনার একটু চিকিৎসার প্রয়োজন আছে।”
নিতুকে কেবিনে আনার আগেই উৎস গিয়ে রতন মিয়ার খবর নিল। উনার চিকিৎসা চলছে। বাড়ির লোক এসেছে সাথে থাকার জন্য। উৎস নিজেই খবর দিয়েছিল। উৎস ডাক্তারের সাথে কথা বলে জানালো, চিকিৎসার যেন কোন ত্রুটি না থাকে, যত খরচ হবে সব উৎস নিজে দেবে। উৎস রতন মিয়া এবং বাড়ির লোককে আশ্বস্ত করে কিছুক্ষণ সেখানে সময় দিয়ে বিদায় নিল।
নিতুকে কেবিনে দেওয়া হয়েছে। উৎস রতন মিয়ার জন্য ওষুধ কিনে ফিরে এসে দেখলো বাহিরে কেউ নেই। বন্যা বাহিরে এসে জানালো সে যাওয়ার পরপরই নিতুকে কেবিনে দেওয়া হয়েছে। সবাই সেখানেই আছে আর নিতুও ভালো আছে সবার সাথে কথা বলছে। উৎসের আফসোস হলো ভেতরে ভেতরে। সে প্রথমে নিতুর কাছে যেতে পারল না ভেবে মনটা খারাপ হলো। নিতুও নিশ্চয়ই অভিমান করে আছে। সব মেয়েই তো চাইবে সে এমন একটা বিপদ থেকে বেরিয়ে নিজের প্রিয় মানুষের মুখটা আগে দেখতে। উৎস নিজেও চেয়েছিল তার জন্যই তো ডাক্তার আর নার্সকে বারবার বলছিল কিন্তু অন্যদিকের দায়িত্বও তো ছিল। সব ভাবনা সাইডে রেখে ভেতরে প্রবেশ করল সে।
উৎস ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখল ফরিনা বেগম নিতুর হাতে চুড়ি পরিয়ে দিয়ে নিতুর দুই হাত একসাথে করে চুমু খেলেন। মা নুরজাহান বেগম মাথার পাশে বসে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। দুই পাশে ঘিরে রেখেছে রিশা, জুবায়ের, মালিহা, উৎসের খালাসহ আরও কয়েকজন। উৎসকে দেখে রিশা বলে উঠল,
“ওইতো ভাইয়া চলে এসেছে। কোথায় ছিলে তুমি? তোমার বউ তোমাকে মিস করছিল।”
উৎস সবাইকে একবার দেখে জবাব দিল,“রতন চাচার ওখানে। উনাকে প্রয়োজনীয় ওষুধ কিনে এনে দিলাম৷ আমি ভেবেছিলাম কেবিনে দিতে দেরি করবে তাই গিয়েছিলাম দেখতে। এত তাড়াতাড়ি দিয়ে দেবে জানলে পরেই ওখানে যেতাম। স্যরি।”
মালিহা বলে উঠল,“এবার আমরা একটু বাহিরে যাই সবাই। বাচ্চার বাবা এবার বাচ্চার মাকে একটু সময় দিক। বাচ্চাকে কি নিয়ে যাব, বাচ্চার বাবা?”
উৎস দুপাশে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,“না, ও থাকুক।”
সবাই একে একে বেরিয়ে গেল। নিতুর পাশেই বাবুকে শুইয়ে রাখা হয়েছে। চুপচাপ শুয়ে আছে সে। কিছুক্ষণ পরপর ছোট ছোট চোখে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে, নড়ে উঠছে।
উৎস এসে নিতুর কাছে বসলো। হাতটা আলতো করে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,
“আমার ওপর অভিমান করেছ?”
“যে পুরুষ তার ব্যক্তিগত নারীর জন্য সবার সামনে কাঁদতে দ্বিধা করে না তার ওপর শুধু প্রয়োজনের জন্য বাহিরে যাওয়া আর একটু দেরি করে কাছে আসার জন্য রাগ করব? এত বোকা আমি নই। রতন চাচা কেমন আছেন এখন?”
“জ্ঞান ফিরেছে এখন একটু ভালো আছে। উনার ওখানেই দেরি হলো। আমি ভেবেছিলাম দেরি করে তোমাকে কেবিনে দেবে।”
“মেয়েকে দেখেছ? খুশি তুমি?”
“তোমার কী মনে হয়?”
“বুঝতে পারছি না।”
“আমার বিকালফুলের একাংশ ও। ওকে পেয়ে খুশি হব না?”
নিতু মৃদু হেসে বাবুর দিকে চাইলো। উৎস নিতুর হাতে চুম্বন করে বলল,“কতটা ভয় পেয়ে গেছিলাম জানো!?”
“কতটা?”
“নিজের মৃত্যু জেনেও যতটা ভয় না পেতাম ঠিক ততটা।”
নিতু প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে মুচকি হাসলো। উৎসের দিকে মায়া মেশানো দৃষ্টি ফেলে মৃদু গলায় বলল,“তোমার কখনো পরিবর্তন না হোক। এত ভালোবাসা পাওয়ার পর কখনো এক চিমটি কমে গেলে আমার খুব খারাপ লাগবে।”
উৎস উঠে নিতুর কপালে চুমু দিয়ে বলল,“আমাদের কোন পরিবর্তন না হোক।”
দুজনের মাঝে বেশ কিছুক্ষণ নিজেদের বিষয়ে কথাবার্তা হলো। উৎস জানালো, আগামীকালই তারা বাড়ি ফিরবে। তাদের রুম কাল থেকে দুজন নয় তিনজনের ভালোবাসায় মুখরিত হবে। হাসি- আনন্দে কাটবে সারাটা সময়।
কথার এক পর্যায়ে নিতু বলল,“আমাদের মাঝে এবার তৃতীয় ব্যক্তি চলে এসেছে। তৃতীয় ব্যক্তি সবসময় সম্পর্ক ভাঙে না, সম্পর্ক গাঢ়ও করে।”
উৎস মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে বলল,“এই যে আমাদের তৃতীয় ব্যক্তি!”
বাবুকে নিতুর কোলের কাছে শুইয়ে দিয়ে নিজেও সেখানেই বসলো। নিতু আলতো করে মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে বলল,
“আমাদের মেয়ে। আমাদের রাজকন্যা।”
উৎস মৃদু হেসে নিতুর কপালে চুমু খেয়ে বলল,“আমার ক্যামেলিয়া। আমার প্রিয় বিকালফুল। ”
~ সমাপ্ত🌸