প্রিয় মন্ত্রী মশাই পর্ব-২১+২২

0
106

গল্পঃ #প্রিয়_মন্ত্রী_মশাই
পর্বসংখ্যাঃ ২১
লেখিকাঃ #আহিয়া_শিকদার_আহি

রেজাউল চৌধুরী আর তার গার্ডরা মিলে পার্টি অফিসের আনাচে কানাচে ওলটপালট করে কিছু একটা খুঁজছে।কিন্তু কাঙ্ক্ষিত জিনিসটি কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না। রেজাউল চৌধুরী বুকে হাত দিয়ে চেয়ারে বসে পড়েন। তার ধ্বংসের চাবিকাঠি অন্যকারো হাতে পৌঁছে গেছে তিনি আন্দাজ করতে পারছেন।মনে হচ্ছে এই বুঝি মৃত্যু তার দুয়ারে এসে দাঁড়াবে। ধীরে ধীরে চোখজোড়া ঝাপসা হয়ে আসছে তার। গার্ডরা তৎক্ষণাৎ তাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে।

ইমার্জেন্সিতে ভর্তি করানো হয়েছে রেজাউল চৌধুরীকে। এর আগে একবার তিনি হার্ট অ্যাটাকের শিকার হয়েছিলেন। কিন্তু তখন এতো গুরুতর অবস্থা হয়নি। এবারে ওনার অবস্থা শোচনীয়।

এর মধ্যেই হাসপাতালের বাইরে মিডিয়ার ভিড় জমে গিয়েছে।দীর্ঘ পাঁচবছর রেজাউল চৌধুরী রাজত্ব করেছেন মন্ত্রী পদে। হঠাৎ তার হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার খবর খুব দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ছে। একেকজন একেক রকম সমালোচনা করছে তার এই অসুস্থতায়।

তাদের এসব সমালোচনার মাঝেই পর পর দুটো গাড়ি উপস্থিত হয় হাসপাতালে। একটা থেকে নামেন রেজাউল চৌধুরীর স্ত্রী আয়েশা চৌধুরী আরেকটা থেকে নামেন নিজেকে সম্পূর্ণ ঢেকে রাখা একজন যুবক। আয়েশা চৌধুরী যুবকটির দিকে ছলছল নয়নে তাকিয়ে হাসপাতালের ভিতর যেতে শুরু করেন। মিডিয়ার মানুষ হামলে পড়ে তাদের উপর। যুবকটির সাথে থাকা গার্ডরা সাবধানতার সাথে সবকিছু সামলায়। আয়েশা চৌধুরী আর যুবকটি চলে যায় ভিতরে।

_______________

আরহাম শুভ্রাদের বাড়ির থেকে কিছুটা দুরত্বে গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে। পার্টি অফিস থেকে সোজা সে এখানে চলে এসেছে। মুখে মাস্ক আর মাথায় ক্যাপ থাকার কারণে কেউ তাকে দেখলেও চেনার উপায় নেই।ফোনে রেজাউল চৌধুরীর লাইভ খবরটা দেখে যতোটা না সহানুভূতি সৃষ্টি হয়েছে তার থেকে বেশি কালো কাপড়ে আবৃত যুবকটিকে দেখে ক্রুর হাসি ফুটে উঠেছে আরহামের ঠোঁটের কোণায়। বাম হাত দ্বারা চুল গুলো পিছনে ঠেলে গাড়িতে পিঠ ঠেকিয়ে আরামের সাথে হেলান দিলো আরহাম। গভীর মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করলো লাইভটি।

তখনি ফোনে’অসভ্য মেয়ে’ নামটা জ্বলজ্বল করে উঠলো। নামটা বার কয়েক উচ্চারণ করে নিজেই হেসে ফেলে আরহাম। সেই অসভ্য মেয়েটা সময়ের ব্যবধানে এখন তার অর্ধাঙ্গিনী। নামটা এখনো পরিবর্তন করা হয়নি। এখন তো নামটা হওয়া উচিত “বউ”। মন্ত্রী আরহাম শিকদারের বউ। ভাবনার মাঝেই কলটা কেটে যায়। কিন্তু একমিনিট পেরিয়ে গেলো আর কল আসলো না। আরহাম ধৈর্যহীন হয়ে পড়ল।মেয়েটা একবার কল দিয়ে আর দিচ্ছে না কেনো?ধৈর্যবান আরহামের আর এতটুকু ধৈর্য রাখতে পারলো না। মিনিটের মাথায় সে কল ব্যাক করলো।

ছাদে দাঁড়িয়ে থাকা শুভ্রা আরহামের দিকেই তাকিয়ে আছে। আকাশ মেঘলা হতে দেখে ঘর থেকে ছাদে যখন এসেছিল সে। ইদানিং হঠাৎ হঠাৎ বৃষ্টির আগমন দেখা যায়।সেই ভাবনায় বৃষ্টিবিলাস করতে এসেছিল ছাদে তখন দেখতে পায় আরহামকে। আরহাম হয়তো এখনো তাকে দেখতে পায় নি। দেখবে কি করে সেইতো ফোনের দিকে নজর। আশেপাশে উপরে নিচে তাকানোর সময় কি আর তার আছে। তাকালে হয়তো দেখতে পেতো ছাদে দাঁড়িয়ে থাকা তার বউকে।

শুভ্রা ফোনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। এই সেই মন্ত্রী মশাই।যে একসময় তাকে সহ্যই করতে পারত না। কিন্ত এখন তার চোখে শুভ্রা স্পষ্ট ভালোবাসা দেখতে পায়।

ফোন রিসিভ করার পর দুজনই নীরব হয়ে যায়। কেউ কোনো কথা বলছে না। নীরবতা কাটিয়ে শুভ্রা কথা শুরু করে।

“শশুর বাড়ির বাইরে কি করছেন মন্ত্রী মশাই? আমাকে বুঝি মিস করছিলেন?”

শুভ্রা কিভাবে জানলো ভেবে অবাক হলো আরহাম। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো কেউ নেই। শুভ্রা মুচকি হাসে।

“খুঁজে পেলেন না আমাকে? একটু উপরের দিকে তাকান। দেখুনতো আমাকে দেখতে পান কিনা?”

আরহাম তাকায় উপরের দিকে। দেখতে পায় শুভ্রাকে। বাতাসের সাথে তাল মিলিয়ে শুভ্রার খোলা চুল গুলো উড়ছে। আরো কিছু বলার আগেই প্রবল বেগে বৃষ্টি পড়তে শুরু করলো। আরহাম তড়িঘড়ি করে গাড়িতে বসলো। কিন্তু শুভ্রা ঠাওর সেখানেই দাড়িয়ে আছে। শুভ্রাকে ভিজতে দেখে আরহাম বেশ জোরেই একটা ধমক মারে ফোনের এপাশ থেকে।

” এই মেয়ে, ভিজছো কেনো? ভিতরে যাও। কি হলো কথা কানে যাচ্ছে না?”

কিন্তু শুভ্রা শুনতে পেলো কিনা কে জানে। সেখানে দাড়িয়েই আরহামের দিকে চেয়ে আছে। আরহাম বুঝতে পারছে বৃষ্টির জন্য হয়তো তার কথা শুনতে পারছে না শুভ্রা।

শুভ্রার শরীরে বৃষ্টির ফোঁটা ফোঁটা পানি পড়তেই অদ্ভুত অনুভূতি হলো তার। কতো বছর হয়ে গেছে বৃষ্টিতে ভিজে না। ভিজে না বললে ভুল হবে ভিজতে দেয়না তাকে। এই বৃষ্টিতে ভিজলে অসম্ভব পরিমাণে মাথা ব্যাথা হয় তার, সাথে তো জ্বর আছেই। বৃষ্টির দিনগুলোতে সকলে তাকে চোখে চোখে রাখে। আজকে লুকিয়ে এসেছে । হয়তোবা সকলে ভাবছে ঘরের মধ্যেই আছে সে।

শুভ্রার মাথা থেকে বেরিয়ে গেলো নিচে তার মন্ত্রী মশাই আছে। সে মেতে উঠলো বৃষ্টিবিলাসে। কিছুক্ষণ ঘুরে ঘুরে বৃষ্টি উপভোগ করে ছোটো বাচ্চাদের মতো ছাদের পানিতে লাফালাফি শুরু করলো। তাকে এখন দেখে মনে হচ্ছে পাঁচ বছরের কোনো বাচ্চা বৃষ্টির পানিতে লাফাচ্ছে।

আরহাম অবাক হয়ে দেখছে শুভ্রার বাচ্চমু। এতদিনে তার আবার মনে পড়ছে শুভ্রা আর তার বয়সের পার্থক্য। মেয়েটা তার থেকে ১২ বছরের ছোট, তবুও সে এই মেয়েটাকে নিজের অর্ধাঙ্গিনীর জায়গা দিয়েছে। বুকের বা পাশে এখন এই মেয়েটির বাস।

হঠাৎ তার মনে প্রশ্ন জাগলো , ” আচ্ছা, বয়সের এতো পার্থক্যে কি কখনও একটা সুখী সংসার গড়তে পারবে তারা? নাকি সময়ের ব্যবধানে আলাদা হয়ে যাবে তারা?”

বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো আরহামের। না কখনোই আলাদা হবে না। কখনোই না। মুগ্ধ নয়নে সে দেখতে থাকে তার বউয়ের বাচ্চামু। আরহাম এতো কিছুর মাঝে প্রায় ভুলেই গিয়েছে শুভ্রা এখন বৃষ্টিতে ভিজছে। তড়িঘড়ি করে ফাহিমের নাম্বারে ফোন দেয় আরহাম।

“এক্ষনি বাড়ির ছাদে যা। তোর আদরের বোন ভিজছে বৃষ্টিতে। কোথায় থাকিস তুই? মেয়েটাকে বৃষ্টিতে ভিজছে সেদিকে খেয়াল নেই তো। তাড়াতাড়ি যা।”

হঠাৎ আরহামের কলে ফাহিম অবাক হলেও আরহামের বলা কথা গুলো শুনতে পেয়েই দৌড়ায় ছাদের দিকে। ড্রয়িংরুমে আপাততো কেউ নেই। আরহামের আর কোনো কথা শোনার অপেক্ষা করলো না ফাহিম। এখন থেকে শুভ্রাকে থামাতে হবে। হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে তার। মেয়েটাকি ভুলে গিয়েছে তার বৃষ্টিতে ভেজা বারণ।

_____________

রেজাউল চৌধুরীকে কেবিনে সিফ্ট করা হয়েছে। আয়েশা চৌধুরী স্বামীর পাশে বসে আছেন। অনবরত কান্না করছেন তিনি। এই পৃথিবীতে তার স্বামী ছাড়া আর তো কেউ নেই।
কেবিনের দরজা খোলার শব্দ তাকান তিনি সেদিকে। কোনো কিছু না বলেই মুখ ফিরিয়ে নেন তিনি। আলগোছে বেরিয়ে যান কেবিন থেকে। তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে যুবকটি। রেজাউল চৌধুরীর জ্ঞান ফেরে নি।

” আপনি হলেন পৃথিবীর এমন একজন বাবা যে কিনা নিজের সন্তানদের খুনি নিজেই। স্বার্থে পড়ে নিজের সন্তানদের নিজেই খুন করতে পারেন। কি এমন হতো যদি ভাইয়া বেঁচে থাকত। কি এমন হতো যদি আমার ছোট্ট বোনটা বেঁচে থাকতো। কেনো তারা আপনার এই পাপের শিকার হলো। তারাতো কোনো দোষ করেনি তাহলে যেনো তাদের ভুগতে হলো।
কেনো নষ্ট করলেন আমার শৈশব। কেনো বানালেন আমাকে পাপি। আপনি যদি নিজের সন্তানদের মৃত্যুর কারণ হন তাহলে আপনার ধ্বংসের কারণও হবে আপনার সন্তান। এটাতো শুধু আপনার জন্য সামান্য ছিল। দেখতে থাকুন কি হয় আপনার সাথে।”

কথাগুলো বলেই কেবিন থেকে বেরিয়ে পড়ল যুবকটি। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা আয়েশা চৌধুরীর দিকে করুণ চোখে তাকালো সে। আয়েশা চৌধুরী মুখ ফিরিয়ে নিলেন। হতাশ হয়ে চলে গেলো যুবকটি। আয়েশা চৌধুরীর চোখ থেকে দুফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল।

” তোর ওই করুন চাহনি আমাকে ভিতরে ভিতরে শেষ করে দেয়। আমি তো মা, সন্তানের অমন চাহনি কিভাবে সহ্য করি বলতো। তবুও যে আমার কিছু করার নেই। হাত পা বাধা আমার। ক্ষমা করে দিস তোর এই অভাগী মাকে।”

____________

আরহামের উপর বেশ রেগে গিয়েছে শুভ্রা। মন্ত্রী মশাইয়ের জন্য আজ তাকে এতোগুলো কথা শুনতে হলো। বদ লোক একটা। ভাগ্যিস বাড়িতে ফাহিম ছাড়া আর তার অন্য ভাইয়েরা ছিল না। থাকলে না জানি আজকে তার উপর দিয়ে সুনামি বয়ে যেতো। তাও তো বাকিদের থেকে কম কথা শুনতে হলো না। ছোট্ট রিদ ও ছাড়েনি তাকে উপদেশ দিতে। সকলের এক কথা বারণ করা সত্ত্বেও বৃষ্টিতে কেনো ভিজলো সে। টাওয়েল দিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে মাথা মুছছিলো শুভ্রা। তখনি ডানদিকের গলার কাছে থাকা তিলটা চোখে পড়ে তার। সাথে সাথেই মনে পড়ে যায় বিয়ের দিনের কথা।

ছাদে যখন আরহাম তার কানের কাছে মুখ নিয়ে এসেছিল তখন শুভ্রার মনে সকল উল্টাপাল্টা ভাবনা ঘুরছিল। কিন্তু তার সকল ভাবনাকে মাটি করে দিয়ে আরহাম বলে উঠেছিল,

” তুমি কি জানো তোমার গলার কাছের এই তিলটা কতটা আকর্ষণ করে। জানবে কি করে। তুমিতো আর আমার মতো করে দেখো নি। আরেকটা কথা কি জানো এই তিলটার মতই একজনের তিল ছিল।”

ব্যাস এটুকুই ছিল শুভ্রাকে রাগানোর জন্য। প্রথম কথাগুলোয় লজ্জায় লাল হয়ে যাওয়া শুভ্রা তৎক্ষণাৎ রেগে আগুন হয়ে গিয়েছিল। আরেকজনের এমন তিল আছে মানে টা কি?

কথা গুলো মনে পড়তেই রেগে থাকা শুভ্রার রাগ আরো তরতরিয়ে বেড়ে যায়। এখন খুব করে ইচ্ছা করছে মন্ত্রী মশাইয়ের চুলগুলো হাত দিয়ে মুঠ করে ধরে ছিঁড়তে। কি সুন্দর ফাহিমের হাতে তাকে ধরিয়ে দিয়ে ভদ্র সাহেবের মত চলে গেলেন। অসভ্য লোক কোথাকার।

চলবে,,

গল্পঃ #প্রিয়_মন্ত্রী_মশাই
পর্বসংখ্যাঃ ২২
লেখিকাঃ #আহিয়া_শিকদার_আহি

শুভ্রার কাচুমাচু হয়ে যাওয়া মুখটা বার বার আরহামের চোখের সামনে ভাসছে। পেট ফেটে হাসি আসতে চাইছে আরহামের। কিন্তু তার চরিত্রের সাথে তো সেটা মানায় না। তাই নিজেকে যতোটা সম্ভব নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে। আপাততো সে যাচ্ছে ফাহিমকে নিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। যতোই বিরোধী দল হোক এক সময়তো কাছের মানুষ ছিলো।
ফাহিম মুখ ফুলিয়ে ড্রাইভ করছে। কোথায় চেয়েছিল আজকে একটু শান্তিতে থাকবে। কিন্তু তার শান্তিতে এক বালতি পানি ঢাললো আরহাম। কি দরকার হাসপাতালে যাওয়ার। রেজাউল চৌধুরীর নাম শুনলেই তো ওর হাত পা রাগে শক্ত হয়ে যায়। এখন নাকি তাকে দেখতে যেতে হবে।

“কালকে রাতে কোথায় গিয়েছিল ও?”

“কে?”

” শুভ্রা ইবনাত খান”

গাড়ি জোড়ে ব্রেক করে ফাহিম। প্রচণ্ড ভাবে চমকেছে। চোখ বড় বড় করে তাকায় আরহামের দিকে। আরহামের তৃক্ষ্ণ দৃষ্টি তার দিকে। ফাহিম ভেবে পাচ্ছে না এখন তার ঠিক কি বলা উচিত। আরহামকে মিথ্যা বলেও লাভ হবে না। আর সত্যি বললে আরো বেশি বিপদ। শুকনো ঢোক গিললো ফাহিম।

“বোনি আবার কোথায় যাবে ভাই? কি বলছেন এসব। বোনি রাতে বাড়ি থেকে বের হবে এটা অসম্ভব। আপনি হয়তো ভুল দেখেছেন। কিন্তু আপনি ঐ রাস্তায় কি করছিলেন? আমরা তো আপনাকে দেখতে পেলাম না।”

দুই হাতে মুখ চেপে ধরে ফাহিম।ইশ কি বলে ফেললো। এইজন্যই বুঝি রাহাত বলে “তোর মতো পেট পাতলাকে সাথে নেওয়া মানে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারা”। এখনতো কথাটা সত্যি মনে হচ্ছে ফাহিমের। আরহাম বাকা হাসে ফাহিমের বোকা কথা শুনে।

” আমি তোকে তো কোনো রাস্তার কথা বলি নি।”

ভ্রু নাচিয়ে বলে আরহাম। ফাহিমের মনে হচ্ছে এখন তার পানি খাওয়া উচিত।গলা শুকিয়ে গিয়েছে। আরহাম যদি একবার জানতে পায় ওসব বিষয়ে তাহলে নিশ্চয়ই এখন তাকে গাড়ি থেকে সোজা নদীতে ছুঁড়ে মারবে। তবুও বুকে সাহস সঞ্চয় করে বলে,

” আসলে ভাই,”

“আমি কি এখানে কোনো আসল নকল জিনিসের দোকান খুলেছি। যে আসলে বলছিস। আমার বউ মাঝ রাতে বাড়ি থেকে বের হবে আর আমি জানতে পারব না ভেবেছিস। তোদের বারণ করিনি এখনি কিছু না করতে।”

আরহামের ধমকে চুপসে যায় ফাহিম। একনাগাড়ে সব কিছু বলে দেয় আরহামকে। কিন্তু আরহামের কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখে আশ্চর্য হয় ফাহিম। আরহামের তো এখন উচিৎ ছিল ফাহিমকে ইচ্ছা মতো ধোলাই করা। কিন্তু আরহাম শান্ত হয়ে বসে আছে। আরহামের শান্ত থাকা যে ঝড়ের পূর্ব লক্ষন তাতে কোনো সন্দেহ নেই ফাহিমের। আরহামের মুখের দিকে চেয়ে আছে ফাহিম কোনো কিছু শোনার আশায়।

” আমাকে কি তোর বউ মনে হচ্ছে। এভাবে তাকিয়ে আছিস। ছি ছি কি অবস্থা। এই তুই আবার ঐরকম ছেলে নাকি? চোখ সরা তোর। আমার একমাত্র বিয়ে করা বউ এখনো আমাকে এভাবে দেখলো না আর তুই। আমি জানি আমি সুদর্শন তাই বলে তুই ছেলে হয়ে এভাবে তাকাবি।”

ফাহিম সিট থেকে কিছুটা ঝুঁকেছিল আরহামের দিকে। আরহাম যে এমন কিছু বলবে তা কল্পনাতেও কখনও হয়তো চিন্তা করতে পারেনি। ঐরকম ছেলে বলতে কি বুঝাতে চাইছে তাকে। ইয়াক ভাবতেই বমি বমি পাচ্ছে ফাহিমের। শেষে কিনা ঐরকম ছেলেদের সাথে তুলনা। নাহ্ ওদের তো ছেলে বলাও চলে না। নাহ্ আর একটা কথাও বাড়ানো যাবে না মন্ত্রীর সাথে। গম্ভীর মন্ত্রী নির্লজ্জ হয়ে গিয়েছে আবার কিছু বলে না বসে। আরহামকে কয়েকটা কথা শোনানোর ইচ্ছা হচ্ছিল ফাহিমের কিন্তু কিছুই বলল না। মাথা থেকে সব ঝেড়ে ফেলে গাড়ি আবার চালানো শুরু করলো।
__________

কেউ নেই হাসপাতালের বাইরে। বৃষ্টি হওয়ার কারণে হয়তোবা চলে গিয়েছে। আরহামদের জন্য এটা ভালোই হয়েছে।এমনিতেই মন্ত্রী আরহাম শিকদারের বিয়ের খবর চারিদিকে ছড়িয়ে আছে তারউপর যদি এখন বিরোধী দলের কাছে আরহামকে দেখে তাহলে উল্টোপাল্টা খবর চাপিয়ে দিবে। আরহাম আর ফাহিম হাসপাতালের ভিতর ঢুকে।মাস্ক আর ক্যাপ পরে থাকায় কেউ চিনতে পারল না তাদের। ওরা সোজা চলে যায় রেজাউল চৌধুরীর কেবিনের দিকে। গার্ড ঘিরে রেখেছে এরিয়াটুকু। থেমে যায় ওরা। তখনি রিসেপসন থেকে আয়েশা চৌধুরী আসেন। উনি ঠিকই চিনতে পারেন আরহামদের। কোনো কিছু না বলে নিজের সাথে রেজাউল চৌধুরীর কেবিনের দিকে নিয়ে যেতে শুরু করেন আরহামদের। গার্ডরা বাধা দিতে চাইলেও আয়েশা চৌধুরীর জন্য দিতে পারলেন না। কেবিনের দরজার কাছে এসে তিন জনই থেমে যায়। রেজাউল চৌধুরীর জ্ঞান এখনো ফেরেনি। বাইরে থেকে আরহাম আর ফাহিম তাকে দেখে আর এক সেকেন্ডও সময় ব্যয় করলো না। মুখ ঘুরিয়ে চলে আসলো তারা। রেজাউল চৌধুরীর বিশ্বস্ত গার্ড ইকবাল সবটা দেখলেন কিন্তু চিনতে পারলেন না আরহামদের। আয়েশা চৌধুরী মমতা ভরা নয়নে দেখলো আরহামকে। অনেক হয়তো সবকিছু অন্যরকম থাকতো। তাকে তার ছেলেমেয়েদের থেকে আলাদা হতে হতো না। শিকদার পরিবারের সাথে শত্রুতা সৃষ্টি হতো না।
________________

আরাজ বসে আছে টিচার্স রুমে। হাত পায়ে থাকা ক্ষতগুলোর জন্যে কতো প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হলো তাকে। এসবে বেশ বিরক্ত আরাজ।ক্ষত গুলোর দিকে তাকালে বার বার খালি রাতের কথা মনে পড়ছে তার।

রাতে যখন সে গাড়ি করে ফিরছিল তখন হঠাৎ তার গাড়ির সামনে কিছু একটা দেখতে পায়। গাড়ি থামিয়ে নেমে পড়লে কয়েকজন ছেলে তাকে ঘিরে ফেলে চারিদিক থেকে।

” এই কে আপনারা? এভাবে পথ আটকিয়েছেন কেনো?”

কিন্তু কোনো উত্তর পায়নি সে। অনেকক্ষণ ধরে এক প্রশ্ন করেও কোনো ভাবান্তর করাতে পারেনি ছেলেগুলোর। আরাজ ভালো করে তাকিয়ে দেখে পাঁচজন ছেলে। সবাই কালো রংয়ের হুডি পড়া। চেনার কোনো উপায় নেই।

” কি চান আপনারা? এভাবে আমাকে আটকে রেখেছেন কেনো? এর ফল ভালো হবে না কিন্তু।”

আর কিছু বলার সুযোগ পেলো না আরাজ। পায়ে ব্যাথা অনুভব করলো সে। একের পর এক হকি স্টিক দিয়ে তাকে মারছে ছেলেগুলো। কিন্তু এবার তাদের সাথে আরো একজনকে দেখতে পেলো আরাজ। পাঁচজনের জায়গায় ছয়জন হয়েছে। কিছুক্ষণ পর ওকে ওখানে রেখেই চলে গিয়েছিল সবাই।

আরাজকে মেরে ফেলা তাদের উদ্দেশ্য ছিল না এটা বুঝতে পেরেছিল আরাজ। সেভাবে তাকে আঘাত করেনি।

_______________

বিকেলের দিকে , বাড়িতে ঢোকা মাত্রই হঠাৎ কেউ শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আরহামকে। হঠাৎ এমন হওয়ায় হকচকিয়ে যায় আরহাম। জড়িয়ে ধরা মানুষটিকে দেখে সজোরে ধাক্কা মারে নিজের কাছ থেকে। নেহা তাল সামলাতে না পেরে নিচে পরে যায়। আরহাম অগ্নিদৃষ্টিতে তাকায় নেহার দিকে। নিতুল এসে তোলে বোনকে।নেহার চোখ ছলছল করছে। কিন্তু তাতে কোনো পরিবর্তন হলো না আরহামের। গর্জে উঠলো আরহাম। ঠাস করে থাপ্পড় মারলো নেহার গালে। নিতুলের বুকে আছড়ে পড়লো নেহ।

“তোর সাহস হলো কিভাবে আমাকে জড়িয়ে ধরার?”

ড্রয়িংরুমে উপস্থিত সকলে কেঁপে উঠলো আরহামের চিৎকারে।নীলিমা শিকদার রান্নাঘর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে এলেন। তিনি দেখেছেন সবটা। আরহামকে এখন শান্ত না করলে খারাপ কিছু হয়ে যাবে। আরহামের সামনে এসে দাঁড়ান তিনি।

” বাবা, শান্ত হ।”

” কিভাবে শান্তি হবো মা?ওর সাহস দেখে আমি অবাক হচ্ছি।”

নীলিমা শিকদার কোনরকম আরহামকে নিয়ে যান ঘরে। আরহামের শরীর জলে যাচ্ছে রাগে।সোফায় মাথা নিচু করে বসে আছেন আজাদ শিকদার। মেয়ের এমন কাজে তিনি লজ্জিত। মেয়েটাকে এতো করে বুঝানোর পরও একই কাজ করছে। তারা আসার পর থেকে বাড়িটা আরো আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু নেহার এমন কাজে সব কেমন নিস্তব্ধ হয়ে গেলো। নিতুল নেহাকে নিয়ে যায়। নেহা মনে হচ্ছে ঘোরের মধ্যে আছে। সে ভাবতেও পারেনি আরহাম এভাবে প্রতিক্রিয়া করবে।জানলে হয়তো কখনোই এই ভুলটা করতো না নেহা।

শুভ্রা আর অদিতি খিলখিলিয়ে হাসছে। তাদের কোনোভাবেই হাসি থামছে না। রাইমা চোখ গরম করে তাকায় তাদের দিকে। তিন বান্ধবী গ্রুপ কলে কথা বলছিল। রাইমা ঘর থেকে ড্রয়িং রুমে এসেছিল নীলিমা শিকদারের সাথে শুভ্রার কথা বলিয়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু তার আগেই নেহা এমন একটা কাজ করে বসলো। শুভ্রা পুরো ঘটনাটা দেখেছে। প্রথমে রাগ উঠেলছিল কিন্তু পরে মন্ত্রী মশাইয়ের নেহার সাথে করা কাজ দেখে কোনোভাবেই হাসি থামাতে পারছে না সে।

চলবে,,