প্রিয় মন্ত্রী মশাই পর্ব-৩১+৩২

0
91

#প্রিয়_মন্ত্রী_মশাই
#পর্বসংখ্যা_৩১
#আহিয়া_শিকদার

শুভ্রাদের বাড়িতে,মমতা খান রান্না করছে।পাশেই ঘুর ঘুর করছে ছেলে মেয়েগুলো। ফারহাদ হাতে হাতে এগিয়ে দিচ্ছে সব।এসব সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা আছে তার।অবশ্য ধারণা থাকার কারণ ও আছে। ফারহাদ,রাহাত,রিমন কেউ ই নিজেদের বউকে সাথে নিয়ে আসেনি।তারা চার ভাই গতকাল এসেছে।না আনার একটা মাত্রই কারণ,তাদের সাথে নিয়ে আসলে এমন বাচ্চাদের মত আচরণ করতে পারত না।আজকে আসবে তারা খান বাড়ির বাকিদের সাথে।

“আরে বাবা, তোমাকে এসব করতে হবে না।তোমার কাকাই এসে করবে।তুমি গিয়ে আড্ডা দেও ভাই বোনদের সাথে।”

“কাকিমনি,কাকাই তো বাইরে গেছে।আমাকে দেও আমি করে দিচ্ছি।তাছাড়া এতো জনের রান্না তুমি একা করলে হাপিয়ে যাবে।চিন্তা করো না,তোমার পছন্দ করা বউমার জন্য এসব করতে হয় মাঝে মাঝে।”

একটু লজ্জা লজ্জা ভাব নিয়ে বলল ফারহাদ।হেসে ফেললেন মমতা খান।

“বাব্বাহ ,নির্লজ্জের ভাই আবার লজ্জাও পায়।আচ্ছা এখন যাও।তোমাকে আর কিছু করতে হবে না।”

“একদম আমার বোনিকে নির্লজ্জ বলবে না কাকিমনি।করিনা সাহায্য তোমায়।দেখো এতজনের জন্য রান্না করতে হবে।তুমি একা পারবে না।নিজের ছেলে হলে বুঝি এমন করতে?”

মমতা খান ফারহাদের মাথায় হাত রেখে।চোখ রাঙায়।মুচকি হাসে ফারহাদ।

“তুমিতো আমারই ছেলে ফারহাদ।শুভ্রা যেমন আমার মেয়ে তোমরাও আমার ছেলে।”

“বাহ্ বাহ্,আমরা তো কেউ না।বুঝলি তো তোরা,আমাদের ভালোবেসে মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়ার কেউ নেই।চল চল এখানে থেকে লাভ নেই।”

রাহাতের কান টেনে ধরে মমতা খান।বাকি হাসে রাহাতের অবস্থা দেখে।

“বড্ড পাকনা হয়ে গেছো।আমি তোমাদের ভালবাসিনা তাইনা। তাহলে যাও,আজ থেকে তোমরা কেউ আমার কাছে ঘেসবে না।কেউ কোনো বায়না করবে না।”

রাগের অভিনয় করে মুখ ঘুরিয়ে রাখেন তিনি।জানেন এখন তারা কি করবে। ফারহাদ আর বাকি সবাই রাগি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রাহাতের উপর। ক্যাবলা হাসে রাহাত।মমতা বেগম কে একপাশ থেকে জড়িয়ে ধরে।আরেক পাশ থেকে ফারহাদ।

“এমন করো কেনো কাকিমনি?আমরা তো জানি আমাদের কাকিমনি আমাদের সব থেকে বেশি ভালোবাসে।আমিতো মজা করছিলাম”

রাহাতের কথায় হাসেন মমতা খান।অন্যদিকে গাল ফুলিয়ে দাড়িয়ে থাকে রিমন,ফাহিম,শুভ্রা। তাদের গাল ফোলাতে দেখে ভেংচি কাটে ফারহাদ আর রাহাত।

“তোমরা আবার দূরে দাঁড়িয়ে আছো কেনো? আসো আসো।”

সবাই হাসি মুখে একসাথে জড়িয়ে ধরে মমতা খানকে।কিছুক্ষন পর,

“আচ্ছা হয়েছে হয়েছে এবার ছাড়ো।রান্না শেষ করতে দেও।বাবারা আসার সময় হয়েছে।”

“আমরাও তোমাকে সাহায্য করবো মা।”

মেয়ের দিকে তাকান মমতা খান।শুভ্রাকে এখন স্বাভাবিক লাগে।তবে শরীরের অবস্থার আর উন্নতি হয়নি।চোখের নিচের কালো দাগ গুলো সরে গেছে। শুভ্রার কথায় হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায় মমতা খান।তিনি জানেন এরা নাছোড়বান্দা।না বললেও পিছু ছাড়বে না।

বেশ কিছুক্ষণ পর খান বাড়ি থেকে ফোন আসে।তারা জানায় তাদের আসতে দেরি হবে।এমনকি রাত ও হয়ে যেতে পারে।

মমতা খান সব কিছু গুছিয়ে ফারহাদদের সাথে বসে।তারা আড্ডা দিচ্ছে।শুভ্রা গিয়েছে রাইমাদের বাড়িতে।রাইমাকে আনতে।আড্ডা দেওয়ার জন্য।পাশের বাড়ি হওয়ার কারণে তার সাথে আর কেউ যায়নি।

শাহাদত খানকে একের পর এক ফোন করেই যাচ্ছে মমতা খান।কিন্তু প্রতিবারই বন্ধ বলছে।বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমেছে।কিন্তু শাহাদত খান বাড়ি ফেরেনি এখনো।আজকে তো ছুটি নিয়েছিলেন তিনি।চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন মমতা খান।ফোনে একটা মেসেজ নজরে পরে মমতা খানের।

“আমি রামিজ ভাইয়ের পুরোনো বিল্ডিং এ আছি।তুমি তাড়াতাড়ি আলমারির উপরের তাকে রাখা নীল রঙের ফাইলটা নিয়ে এসো। তাড়াতাড়ি।কাউকে কিছু বলার দরকার নেই।”

ঘন্টা খানেক আগে শাহাদত খানের নাম্বার থেকে মেসেজ টা এসেছে।অবাক হয়ে মমতা খান।শাহাদত খানে থেকে শুনেছিল ফাইলটা অনেক দরকারি।এমনকি মমতাকে খানকেও ছুঁতে দেয়নি কখনো।তাহলে আজকে এরকম বলার মানে কি?পরক্ষণেই আবার ভাব হয়তো খুব দরকার।কিন্তু রামিজ ভাইয়ের পুরোনো বিল্ডিং এ কেনো?তাদের প্রতিবেশী রামিজ সাহেবের পুরোনো বিল্ডিং টা প্রায় পরিত্যক্ত।

ফারহাদদের বলে বের হয় মমতা খান।বাজে প্রায় সাড়ে ছয়টা।শুভ্রার কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছে।চার-পাঁচ মিনিট গেলেই বিল্ডিং টা।সেদিকে রাস্তাটা প্রায় ফাঁকা।

ভিতরে ঢুকে শাহাদত খান কে খুজতে শুরু করেন তিনি।উপর তলার একটা রুমে পান। আতকে উঠেন মমতা খান।শাহাদত খানকে চেয়ারে বেঁধে রাখা হয়েছে।পাশেই কয়েকজন বন্দুকধারী লোক দাঁড়িয়ে। তাকে দেখার সাথে সাথেই শাহাদত খানের সামনে নিয়ে আসা হয়।মমতা খানের মাথায় বন্দুক ঠেকানো হয়।

“তুমি!তুমি কেনো এখানে এসেছো?”

গলা কাপছে শাহাদত খানের।তিনি মোটেও স্ত্রীকে আশা করেন নি এখানে।ভয়ে ভীতিগ্রস্থ মমতা খান স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বলেন,

“তুমি তো মেসেজ করে বললেন ফাইলটা নিয়ে আসার জন্য। এ এরা কারা।আর তোমাকে এভাবে বেঁধে রেখেছে কেনো।”

মুহূর্তেই শাহাদত খানের পুলিশে মস্তিষ্ক সবটা বুঝে ফেলে।ভয়ংকর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সামনে চেয়ারে বসে থাকা লোকটার উপর। মুখে মাস্ক পরে,হাতে বন্দুক নিয়ে বসে আছে লোকটা।

“তোর সাহস হয় কি করে,ওকে মেসেজ করার?তোর শত্রুতা আমার সাথে।ওকে কেনো জরিয়েছিস এসবে মধ্যে।একটা টোকাও যদি ওর গায়ে লাগে ,মেরে ফেলবো তোকে।”

বিশ্রীভাবে হাসে লোকটি।শাহাদত খানের মুখ বরাবর ঘুষি মারে। নাক থেকে রক্ত বের হয় শাহাদত খানের।

“এই আওয়াজ নিচে।এই অবস্থাতেও তোর তেজ কমেনি।বলতেই হবে,আমার বন্ধু সাহসী। তো ভাবিজান এনেছেন ফাইলটা?”

মমতা খানে হাতে ফাইলটা দেখে লোকটা।কোনো কথা না বলে কেড়ে নেয়।তৎক্ষণাৎ হাতের ইশারায় সেখানে উপস্থিত মানুষগুলোকে কিছু বলে বেরিয়ে পরে।

চিৎকার করে শাহাদত খান।কিন্তু শোনার জন্য কেউ উপস্থিত ছিলনা সেখানে।লোকগুলো পুরো ঘরে কেরোসিন ঢেলে বাইরে বের হয়।মমতা খানকেও বেঁধে ফেলে শাহাদত খানের সাথে।আগুন লাগিয়ে দেয়।মুহূর্তেই ছড়িয়ে পরে পুরো ঘর জুড়ে।তাড়াতাড়ি বের হয়ে যায় তারা। দাউ দাউ করে জ্বলতে শুরু করে পুরো বিল্ডিং। শোনা যায় কতগুলো আর্তনাদ।লোকগুলো মেয়েলি আরো চিৎকার শুনতে পায়।কিন্তু কোনো পাত্তা না দিয়ে বের হয়ে যায়।

_______

চোখ জোড়া থেকে অনবরত পানি পড়ছে ফারহাদের।সাথে রাহাতদের ও।হতভম্ব হয়ে যায় আরহাম।বুকের মধ্যে তীব্র ব্যথা অনুভব করে।

” শুভ্রা তখন কোথায় ছিল?”

কাঁপা কাঁপা কন্ঠে জিজ্ঞেস করে আরহাম। ফারহাদ সামলে নেয় নিজেকে।আরো অনেক কথা বলা বাকি।এতটুকু তো শেষ নয়।

“কাকিমণি যাওয়ার সময় আমাকে জানিয়ে গিয়েছিল।সন্দেহ হয়েছিল কাকিমনির যে কোনো সমস্যা হবে।তাই রানিং কলে ছিল আমাদের সাথে। সেখানকার সকল কথা,আর্তনাদ শুনেছি আমরা।পৌঁছতে দেরি হয়ে গিয়েছিল আমাদের।আমরা যতক্ষণে পৌঁছাই ততক্ষনে সব শেষ হয়ে গিয়েছিল। বোনিকে জ্বলন্ত বিল্ডিংয়ের বাইরে পাই অজ্ঞান অবস্থায়।আমাদের আজও অজানা বোনি ওখানে কিভাবে পৌঁছলো? অজ্ঞান কিভাবে হলো? সেদিনের পর থেকে বোনি নিশ্চুপ হয়ে যায়।সকলের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেয়।এমনকি কয়েকবার আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছিল।মানসিক সমস্যার দেখা দেয় বোনির মধ্যে।তার রেশ এখনো কিছুটা আছে।পাগলাটে স্বভাবের হয়ে যায়।”

ফারহাদের কথার পর কিছু বলতে চায় আরহাম।কিন্তু তার আগেই ফোনটা বেজে উঠে তার।রাইমা কল করেছে।ভ্রু কুচকে যায় আরহামের।এই সময় কেনো তাকে ফোন করছে? রিসিভ করে।

“বড় ভাইয়া কোথায় তুমি? তাড়াতাড়ি বাসায় আসো।শুভ্রা,শুভ্রা

শুভ্রার নাম শুনে বুকটা ধক করে উঠে আরহামের।ফোনের স্পিকার কিছুটা বেশি থাকায় আরহামের গা ঘেষে বসে ফাহিমরা শুনতে পায়।তৎক্ষণাৎ উঠে দাড়ায় তারা।ঘড়ির কাটায় বাজে ১১ টা প্রায়।

“কি কি হয়েছে,

চলবে,,,

#প্রিয়_মন্ত্রী_মশাই
#পর্বসংখ্যা_৩২
#আহিয়া_শিকদার

হন্তদন্ত হয়ে বাড়িতে প্রবেশ করলো আরহাম।সাথে ফারহাদ,রাহাত,রিমন,ফাহিম আর শুভ।সকলের মুখেই বিরাজমান চিন্তা।

আরহাম ঘরে ঢুকতেই বুকটা ধক করে উঠল।বাড়ির সবাই তার ঘরে উপস্থিত।সবাইকে এড়িয়ে বিছানার কাছে যায় আরহাম।পিছু পিছু ফারহাদরাও।শুভ্রার পাশে ডাক্তার আবুল খন্দকারকে দেখতে পায়।আগের মতই সোজা হয়ে শুয়ে আছে শুভ্রা।কোনো নড়া চড়া নেই। আরহামেক দেখে ডাক্তার সাহেব হাসি মুখে বলেন,

“চিন্তার কোনো কিছু নেই মিস্টার শিকদার।মিসেস শিকদারের শরীরের উন্নতি হচ্ছে।আজকের ঘটনার পর আশা করা যায় অতি শীঘ্রই তিনি সুস্থ হয়ে উঠবেন।”

চলে গেলেন তিনি।সাথে বাড়ির সবাই ঘর থেকে বের হলো।রাইমা থেকে গেলো। ফারহাদরা শুভ্রার চার পাশে বসলো।অপলক চেয়ে রইলো বোনের পানে।কষ্টে বুক চিরে যাচ্ছে তাদের।এই সেই শুভ্রা যে কিনা সারাদিন বাড়ি মাথায় তুলে রাখতো।এক সেকেন্ড ও স্থির হয়ে থাকতো না।সব সময় ছোটাছুটি করেই থাকতো।

রাইমা করুণ দৃষ্টিতে টাকায় ফাহিমের পানে।কিন্তু কোনো লাভ হলো না।ফাহিম ফিরেও তাকালো না তার দিকে।চোখ জোড়া পানিতে টইটুম্বুর হয়ে উঠলো রাইমার।

_____________

“আমরা কবে লন্ডনে ফিরে যাব?”

আজাদ শিকদার তাকান নাইজা শিকদারের দিকে।স্ত্রীর চোখ মুখ করুণ দেখে গা ঘেষে বসেন।এরকম করুন মুখে হওয়ার কারণ অজানা নয় আজাদ শিকদারের।

“এখানেই থাকবো আর ফিরব না।”

আতকে উঠলেন নাইজা শিকদার।

“তুমি সবটা জেনেও কিভাবে এই কথা বলতে পারো?”

“তোমার কি মনে হয় বাড়ির এই রকম অবস্থায় আমাদের চলে যাওয়া উচিত?”

প্রশ্নের বিপরীতে প্রশ্ন মোটেও পছন্দ হলো না নাইজা শিকদারের।কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন স্বামীর উপর।

“না যাওয়া উচিত নয়।কিন্তু তোমাকে আমাদের দিক টাও ভাবতে হবে।আমি কোনোভাবেই চাইনা সত্যিটা ও জানুক।যে কারণে দেশ ছেড়েছিলাম সেই কারণকে ফেরাতে চাইনা।তুমি দুদিনের মধ্যে সব ব্যবস্থা করবে লন্ডনে ফেরার।আর একটা কথাও আমি শুনতে চাই না”

_____________

পেরিয়েছে আরো একটা দিন।সকলেই কিছুটা খুশিতে আছে।কারণ শুভ্রার শরীরের উন্নতি হয়েছে।রাতের খাবার টেবিলে লন্ডনে ফেরার কথা জানায় আজাদ শিকদার।কেউ দ্বিমত পোষণ করে না।তবে বাধ সাধে নেহা আর নিতুল।তারা কোনোভাবেই এখন ফিরবে না।

“আর কিছুদিন থাকি ড্যাড”

নিতুলের সাথে নেহাও তাল মিলায়।আজাদ শিকদার স্ত্রীর দিকে তাকান।স্ত্রীর চোখ মুখ দেখে স্পষ্ট বুঝতে পারেন তিনি চান না।

“না।ওখানে আমাদের ব্যবসার গুরুত্বপুর্ণ কাজ আছে।আমি আর তোমাদের মা যখন যাচ্ছি তোমাদের ও যেতে হবে।এই বিষয়ে আর কোনো কথা নয়।নিজেদের বসব কিছু গুছিয়ে নেও।”

আরো কিছু বলতে চাইল নেহা আর নিতুল।কিন্তু আরহামের আগমনে চুপ হয়ে গেলো। খাবার টেবিলে কথা বলা মোটেও পছন্দ করে না আরহাম।

খাওয়া দাওয়া শেষে সবাই নিজ নিজ ঘরে চলে যায়। আরহাম ঘরে এসে কিছুক্ষণ শুভ্রার দিকে চেয়ে থেকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পরে।

গভীর রাত।নিস্তব্ধ পরিবেশ।ক্ষণে ক্ষণে একটা মানুষের নিশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে। আরহামের ঘরের দরজা খুলে গেলো।দেখা গেলো একটা লোকের ছায়ামূর্তি।লোকটি অত্যন্ত সাবধানতার সাথে প্রবেশ করলো ভিতরে।পা টিপে টিপে এগিয়ে গেলো বিছানার কাছে।ড্রিম লাইট জ্বলছে ঘরে।হালকা সবুজ আলোতে দেখতে পেলো চাদর মুরি দিয়ে শুয়ে থাকা দুজন মানুষকে।ভ্রু কুচকে এলো লোকটির।ভাদ্রের এই ভ্যাপসা গরমেও কথা গায়ে।কিন্তু সেদিকে বেশি পাত্তা দিলো না।পকেট থেকে ইনজেকশন বের করলো।শুভ্রাকে ইনজেক্ট করার উদ্দেশ্যে কথা সরালো।চোখ বড় বড় হয়ে গেলো লোকটার। কাথার তলায় বালিশ রাখা।

“দেবর সাহেব আমি এখানে।”

জ্বলে উঠলো ঘরের লাইট।চকিতে পিছনে ফিরল নিতুল।হঠাৎ আলোর কারণে চোখ জোড়া কয়েক সেকেন্ড এর জন্য বন্ধ করে ফেললো।কয়েক সেকেন্ড পর চোখ খুলেই আতকে উঠলো।সামনেই শুভ্রা দাড়িয়ে আছে মুখে হাসি নিয়ে।নাহ্ স্বাভাবিক হাসি নয়।শুভ্রার পাশে আরহাম,রাইমা আর ফারহাদরা চার ভাই।

হতভম্ব নিতুল।একই সাথে ধরা পড়ে যাওয়ার আতঙ্ক।শুভ্রার পানে তাকায়।ঠোঁট প্রসারিত করে হাসে শুভ্রা।ড্রয়িং রুমে নিতুল কে সাথে নিয়ে সবাই যায়।

ড্রয়িং রুমে একে একে বাড়ির সকলে ঘুম ঘুম চোখে হাজির হয়।রাইমা সবাইকে ডেকে এনেছে।এতো রাতে ঘুম ভাঙায় বেশ বিরক্ত তারা।ড্রয়িং রুমে সোফার উপর শুভ্রাকে হাসি মুখে বসে থাকতে দেখে ভূত দেখার মত চমকে উঠে।বার কয়েক চোখ কচলে নেয় সবাই।স্বপ্ন ভেবে নিজের হাতে নিজেরাই চিমটি কাটে।কিন্তু যখন বুঝতে পারে সামনে সত্যিই শুভ্রা তখন আর এক সেকেন্ড ও দেরি করেনা কেউ।দ্রুততার সহিত শুভ্রার কাছে যায়।নীলিমা শিকদার জড়িয়ে ধরেন শুভ্রাকে। মুচকি হাসে শুভ্রা।সবার মুখেই খুশি দেখতে পেলেও নেহার মুখে খুশির পাশাপাশি বিষাদের ছায়া দেখতে পায়।

“মা তোর কখন জ্ঞান ফিরল ?”

নীলিমা শিকদারের কথার জবাবে মুচকি হাসে শুভ্রা কিন্তু কোনো জবাব দেয়না।সবাইকে বসতে বলে।অবাক হলেও সবাই বসে।শুধু দাড়িয়ে থাকে নিতুল।তার দিকে রক্ত চক্ষু নিয়ে তাকিয়ে আছে আরহাম আর ফারহাদরা।

“আপনারা সবাই জানতে চাইবেন না আমি কিভাবে সিঁড়ি থেকে পড়েছিলাম?”

অবাক হয়ে তাকায় সবাই শুভ্রার দিকে।এটা জানতে চাওয়ার কি আছে? দৌড়ে আসতে গিয়ে পরে গেছে সবাই তো জানে।

“এসব কি বলছ বউ মা?”

আসাদ শিকদারের কথায় হাসে শুভ্রা।তারপর তাকায় নিতুলের দিকে। নিতুল মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে। শুভ্রার দৃষ্টি অনুসরণ করে সবাই তাকায় নিতুলের দিকে।তাকে মাথা নিচু করে থাকতে দেখে ভ্রু কুচকে যায় সবার। নাইজা খান বলেন,

“নিতুল,তুমি এভাবে মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছো কেনো?আর এখানে কি হচ্ছে কিছুই তো বুঝতে পারছি না?”

“একটু ধৈর্য ধরুন কাকি মণি।বলছি সব ধীরে ধীরে বলছি।আপনি তো মনে হয় কিছুটা জানেন তাই না?”

হকচকিয়ে যায় নাইজা খান।চোখ বড় বড় করে তাকায় শুভ্রার দিকে।

“নীলা এবং দাদিজানের মৃত্যু মনে আছে আপনাদের?

________

রাইমার বাড়ি যাওয়ার পর বুঝতে পারে শিকদার বাড়ির সবাই এসেছে। আরহামকে দেখে লুকিয়ে পরে শুভ্রা। আরহামকে লুকিয়ে দেখা এক প্রকার নেশা তার।বেশ কিছু সময় পর রাইমাদের বাড়ি থেকে বের হয় সে।শিকদার বাড়ির সবাই আসার কারণে রাইমাকে আর আড্ডা দেওয়ার জন্য ডাকে না।বাড়ি তে ফেরে না।বাড়ির উল্টো দিকের পথে হাটা শুরু করে।শুভ্রা সুস্থ হওয়ার পরেও যে আবারো ড্রাগে মত্ত হয়ে গিয়েছিল কেউ জানত না সেটা।যার কাছ থেকে প্রতিনিয়ত ড্রাগ নিত তার সাথেই দেখা করতে যাচ্ছে।রামিজ সাহেবের পুরোনো বিল্ডিংয়ের ভিতরে ঢুকে।উপর তলায় উঠতে উঠতে শুনতে পায় দুজন মানুষের কথোপকোথন।একজন ছেলে আরেকজন মেয়ে।শুভ্রার মনে হলো কোনো কারণে ছেলে মেয়ে দুজনের মধ্যে ঝগড়া হচ্ছে।এগিয়ে যায় সেদিকে।এক ঝলক দেখে ছেলে মেয়ে দুটোকে।তার পর আর সেদিকে পাত্তা না দিয়ে তাকে বলা জায়গাতে চলে যায়।কিন্তু সেখানে যেতেই হতভম্ব হয়ে যায় শুভ্রা। কিছুদূরের ঘরটাতে বাবা মাকে চেয়ারে বাধা অবস্থায় দেখতে পায়।ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে দেখে একটা লোক কে।বেশ চেনা লাগে তার কাছে।সবকিছু দেখে কিছুক্ষণ লাগে তার মস্তিষ্ক সচল হতে।ততক্ষনে কেরোসিন ঢালা শেষ হয়েছে ঘরটাতে।একে একে সব লোক ঘর থেকে বেরিয়েছে।তার চোখের সামনেই আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। গগনবিদারী চিৎকার করে উঠে শুভ্রা।বাবা মায়ের কাছে যেতে নিলেই পেছন থেকে কেউ তার মুখে কিছু চেপে ধরে। পরে আর কিছু মনে নেই তার।নিজেকে আবিষ্কার করে হাসপাতালের বেডে।

বোনের এমন করুন কথা শুনে চোখ ছল ছল করে উঠে ফারহাদদের।এসব তারা নিজেরাও জানতো না।এক মেয়ে তার বাবা মার মৃত্যু নিজের সামনে দেখেছে।এর থেকে করুণ আর কি হতে পারে।দুই দিক থেকে শুভ্রা দুই হাত চেপে ধরে ফাহিম আর রিমন।শুভ্রা সেদিকে তাকিয়ে হাসে।কি বেদনা দায়ক সেই হাসি। আরহাম চেয়েও পারছে না শুভ্রাকে সান্ত্বনা দিতে।তার নিজের ই বুক চিরে যাচ্ছে।সেদিন সেও তো তার আদরের কলিজার টুকরা টাকে সারাজীবনের মতো হারিয়েছে।

শিকদার পরিবারের চোখেও পানি।তারা কিছু বলার আগেই হাতের ইশারায় তাদের থামিয়ে দেয় শুভ্রা।

“সেদিন সেই ছেলে মেয়ে দুটো কে ছিল জানেন মন্ত্রী মশাই?”

না সূচক মাথা নাড়ায় আরহাম।তবে মনে হলো কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছে।

“আপনার আদরের একমাত্র বোন নীলা আর,,

বলতে গিয়েও থেমে যায় শুভ্রা। আরহামের অবস্থা বোঝার চেষ্টা করে। আরহামের মুখ করুন হয়ে উঠেছে।চোখে মুখে ভেসে উঠছে কষ্টের ছাপ।সাথে পুরো শিকদার পরিবারের ও।

” ঝগড়া করা মেয়েটি ছিল নীলা।তখন আমি ওকে চিনতে পারি নি।কারণ আগে কখনো ওকে দেখিনি।তার ঠিক সামনেই যে ছেলেটির সাথে নীলা ঝগড়া করছিল সেটা ছিল নিতুল”

চমকে উঠে সবাই।বাড়ির সবাই যতোটা না অবাক অবাক হয়েছে তার থেকে কয়েক গুণ বেশি অবাক হয়েছে নিতুল।হয়তো ভাবতেও পারেনি শুভ্রা এসব জানে।

“বাকিটা আমি বলব নাকি আপনি বলবেন দেবর সাহেব?”

নিতুল বুঝতে পারে সত্যিটা তাকে বলতেই হবে।মায়ের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে বলতে শুরু করে,

“ছোট বেলা থেকেই নীলা ভালোবাসতো আমাকে।আমার কোনো কালেই ওর উপর কোনো ইন্টারেস্ট ছিল না।কিন্তু যখন ক্লাস টেনে পড়ে তখন ওর প্রতি কিছুটা ঝুঁকে পরি আমি।না ভালোবাসার টান নয়। ওর শরীরের টানে।প্রপোজ করি ওকে। নীলাও সাথে সাথেই একসেপ্ট করে।কয়েক মাস প্রেম চলে।মাঝে মাঝে ঘুরতে যেতো আমার সাথে।বাড়িতে দুজনই আলাদা আলাদা বাহানা দিয়ে বের হতাম।ওকে নিয়ে নানান জায়গায় যেতাম।তখনো বুঝতে পারেনি ও আমার মতলব।বেশ কয়েকবার খাবারের সাথে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে খাইয়েছিলাম।তারপর,,,
ধীরে ধীরে ওর শরীরের পরিবর্তন লক্ষ্য করি।দাদিজান ও কিছুটা বুঝতে পেরেছিলেন ওর অবস্থা।আমি সিউর ছিলাম না।এড়িয়ে চলতাম ওকে।কথা বলতে চাইলেও কথা বলতাম না।কিন্তু যেদিন রাইমাদের বাড়ি যাই সেদিন রামিজ আংকেলের পুরোনো বিল্ডিংয়ে হুমকি দিয়ে ডেকে পাঠায় আমাকে।সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে আমিও যাই সেখানে।জানতে পারি ও অন্তঃসত্বা। ও বুঝতে পেরেছিল আমি ওর অনাগত সন্তানের বাবা।তখন কিছুই বুঝতে পারছিলাম না কি করবো।কথায় কথায় ওর সাথে ঝগড়া লেগে যায় আমার।এক পর্যায়ে রাগের মাথায় দেয়ালের সাথে বারি মারি ওর মাথা।তৎক্ষণাৎ অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে ওখানেই মারা যায়।পাগল প্রায় লাগছিল আমার।কিন্তু আমাকে বাঁচাতেই হয়তো বিল্ডিং এ আগুন লেগেছিল।কোনদিক না দেখেই ওকে ওখানে রেখেই বেরিয়ে পরি বিল্ডিং থেকে।”

বিস্মিত সকলে।কারোর যেনো বিশ্বাস হচ্ছে না।অতিরিক্ত রাগ আর কষ্টের ফলে আরহামের কপালের রগ ফুলে উঠেছে।চোখ জোড়া ধারণ করেছে রক্তবর্ণ।শুভ্রা দেখলো আরহামকে।উঠে গিয়ে চেপে ধরলো আরহামের একহাত।অশ্রুসিক্ত চোখ জোড়া দিয়ে তাকালো আরহাম শুভ্রার পানে।চোখের ইশারায় শান্ত হতে বলল শুভ্রা।তার ও বুক কাপছে।এতো মাত্র কিছুটা সত্যি জেনেছে।সব কিছু জানলে প্রিয় মানুষটার অবস্থা কেম হব ভেবেই তার কলিজা কেঁপে উঠছে।

নীলিমা শিকদার হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছেন তেড়ে আসেন তিনি নিতুলের দিকে।কয়েকটা চর বসান গালে। নাইজা শিকদার আগলে নেন নিতুলকে।আসাদ শিকদার ধরে ফেলেন নীলিমা শিকদারকে।ডুকরে কেঁদে উঠেন তিনি।

নেহা এখনো বিশ্বাস করে উঠতে পারছে না তার ভাই এমন কিছু করেছে। ফারহাদদের কি বলা উচিত বুঝতে পারছে না তারা।পাথর হয়ে বসে আছেন আজাদ শিকদার।তার পাশেই বসেছেন আজমল শিকদার।ছেলের অবস্থা বুঝতে পারেন তিনি।ভিতরে কি চলছে অজানা নয় তার।

“এত টুকুতেই উত্তেজিত হলে চলবে।এটা তো সবে শুরু আরো কত সত্যি জানার আছে।”

চলবে,