প্রিয় মন্ত্রী মশাই পর্ব-০৬

0
106

#প্রিয়_মন্ত্রী_মশাই
#পর্বসংখ্যা_৬
#আহিয়া_শিকদার

( অনুমিত ব্যতিত কপি করা নিষেধ)

ভোরের আলো ফুটেছে বেশ কিছু সময় আগে। রেজাউল চৌধুরীর ভোরে হাঁটার অভ্যাস আছে।প্রতিদিন সকালে তিনি কয়েকজন গার্ডকে নিয়ে বের হন হাঁটার জন্য। আজকেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। খুশিমনে তিনি বের হলেন গার্ডের নিয়ে।কিন্তু কে জানতো আজকের সকাল তার জন্য এমন হবে? জানলে হয়তো তিনি বের হতেন না বাইরে অথবা আরো নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতেন? তার চোখের সামনে পড়ে আছে সাজিদের ক্ষতবিক্ষত দেহ। আতকে উঠেন তিনি। কি নির্মমভাবে মারা হয়েছে ছেলেটাকে। ভাবতেও তারা শরীরের শির দারা বয়ে যাচ্ছে আতঙ্কের জোয়ার। লাশটার দিকে তাকানো যাচ্ছেনা। বিভৎস অবস্থা। শরীরের প্রতিটি জায়গায় কাটা। সামান্য জায়গাও ফাঁকা নেই। দেখে বোঝাই যাচ্ছে ব্লেড দিয়ে কাটা হয়েছে।
রেজাউল চৌধুরীর শরীর থরথর করে কাঁপছে।সাথে থাকা গার্ডরা তার দিকে অদ্ভুত নজরে তাকিয়ে আছে। তারা বুঝতে পারছে না এনার মতো জঘন্য একজন মানুষ কেনো সামান্য একটা লাশ দেখে এমন ভয় পাচ্ছে। তার কাছে তো এসব দেখা নিত্যদিনের ব্যাপার। তিনি নিজেই তো এই কাজ করেন।

রেজাউল চৌধুরী দাড়িয়ে থাকতে পারলো না আর। গার্ডদের সাহায্যে চলে আসে বাড়ির ভিতরে। বলে আসেন লাশটা সরিয়ে ফেলতে।
_______________

শিকদার বাড়িতে চলছে নিরবতা। কালকে সকালেও এই বাড়িতে ছিল খুশির আমেজ। খাবার টেবিলে সকলে নিরবতা পালন করছে। কারোর মুখে কোনো কথা নেই। তাদের বাড়ির ছেলেতো সুস্থ আছে। কিন্তু তাদের ছেলেকে বাঁচাতে গিয়ে যে মেয়েটি নিজের জীবনের পরোয়া করেনি তার জন্য চিন্তায় সবাই। মেয়েটিকে দেখার কৌতূহল সকলের মধ্যে বিদ্যমান।

আরহাম সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে দেখে নেয় সকলের ভাব-ভঙ্গি।তার সব কাজিনদের মধ্যে বড় সে। নিজেকে আলাদা এক কঠোরতার পর্দায় আবৃত করে রেখেছে। যার কারণে কারোর সাথে খুব বেশি সক্ষতা নেই তার। কাজিনরা সকলে তাকে ভয় পায়। এমনকি তার মুখের উপর কেউ কথা বলে না পরিবারের।

তাকে নামতে দেখে নীরব ডাইনিং টেবিল যেনো আরো নিরব হয়ে গেলো। সকলে মাথা নিচু করে মনোযোগ দিলো খাবার খাওয়ায়। আরহাম তার নির্দিষ্ট চেয়ারে বসলো। সকলের দিকে একবার তাকিয়ে নিজেও খাওয়ায় মনোযোগ দিলো।

” বাসায় কি কিছু হয়েছে মা?”

হঠাৎ আরহামের কথা শুনে সকলে চমকে উঠে। শান্ত পরিবেশে হঠাৎ এমন কন্ঠস্বর যেনো প্রতিধ্বনি হচ্ছে। সকলে তাকায় আরহামের দিকে।
কি নিষ্ঠুর এই পুরুষ। কতো বড় বিপদ হতে যাচ্ছিল ভাবতেই সকলের অন্তরাত্মা কেঁপে উঠছে। নেহাতই মেয়েটা ছিল। আর ইনি বলছেন কোন কিছু হয়েছে। নীলিমা শিকদার শান্ত দৃষ্টি ফেলে আরহামের উপর।

” নাহ্, কিছুই তো হয়নি। কি হবে এই বাড়িতে। যেখানে স্বয়ং মন্ত্রীর বাস সেখানে কি আর কিছু হতে পারে। ”

মায়ের কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আরহাম। রাজনীতির বিরুদ্ধে প্রথম থেকেই তার মা। পছন্দ করেন না এসব নীলিমা শিকদার। কিন্তু আরহাম তো আরহাম। সে সেই রাজনীতি করেই ছাড়লো। ছেলে মন্ত্রী হয়েছে তবুও তার কোনো হেলদোল নেই।
বাকিদের নীলিমা শিকদারের কথা শুনে হাসি পেলেও চুপ করে আছে তারা। এখানে হাসলে তাদের যে একজনের মাথাও ঘাড়ে থাকবে না ভালো করেই জানে।
আরিফা তালুকদার আরহামকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠেন ,

” আরহাম,মেয়েটাকে দেখতে যেতে চাচ্ছি”

আরহাম একবার তাকায় তার ফুপির দিকে। তার পর বাকি সকলের দিকে। সকলের মুখেই সে দেখতে পাচ্ছে শুভ্রাকে দেখার কৌতূহল।

” টিভিতে নিশ্চই দেখেছো”

হতাশ হন আরিফা তালুকদার। তার ভাইয়ের ছেলে বরাবরই ঘাড় তেরা। একটু সহজ ভাবে বললে কি হয় সে দেখতে যেতে হবে না।

” মেয়েটা সুস্থ হোক তার পর নাহয় একদিন এবাড়িতে আনা যাবে। তখন দেখো সবাই। মেয়েটা ফাহিমের চাচাতো বোন।”

নীলিমা শিকদার আর আসাদ শিকদার বাদে সকলে অবাক হয়। এরা দুই ভাইবোন তাহলে একই রকম। এই যেমন ফাহিম আরহামের সকল বিপদে আগে থেকে তেমন মেয়েটাও। মুগ্ধ হয় সকলে শুভ্রার উপর।

” আরহাম, খাওয়া শেষ হলে আমরা যাচ্ছি হাসপাতালে। মেয়েটিকে দেখে আসতে হবে।”

” আচ্ছা”

কথা বলতে বলতেই খাওয়া শেষ হয়েছে আরহামের। নিজের কাজে বের হয় সে। সকলে একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে। খাবার টেবিলে কথা বলা আরহামের পছন্দ নয়। তাও আজকে কথা বললো।

___________________

শুভ্রা পারছে না নাচতে। খুশি খুশি লাগছে ওর। সকলে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। তাতে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই শুভ্রার। সে তো নিজ কাজে ব্যস্ত।
তার মন্ত্রী মশাই রাতে তাকে দেখতে এসেছিল। কিছু সময় আগে ফারহাদ জানিয়েছে তাকে। তখন থেকেই শুভ্রার মুখ থেকে যেনো হাসি সরছেই না।

” শুভ্রা মামণি , তুমি হাসছো কেনো এভাবে? তুমি না ব্যাথা পেয়েছো। তোমার কষ্ট হচ্ছে না”

ছোট্ট রিদের কথায় ধ্যান ভাঙ্গে শুভ্রার।সে বাচ্চাটাকে কিভাবে বুঝাবে তার মামণি কেনো হাসছে। ৬ বছরের রিদ শুভ্রা ন্যাওটা হয়েছে।

” বাবু, তোমার শুভ্রা মামনির ব্যাথা একদম সেরে গেছে। দেখো একটুও ব্যথা করছে না।”

” বাবাই যে বললো তুমি অনেক ব্যাথা পেয়েছো তাই আমি তোমার কোলে উঠতে পারব না।”

” ব্যাথা পেয়েছিলাম তো সোনা। কিন্তু দেখো এখন আমি একদম সুস্থ আছি।”

” তাহলে আমাকে কোলে নেও”

রুপন্তি এসে চট করে কোলে তুলে নেয় রিদকে। সে ভালো করেই বুঝতে পেরেছে শুভ্রা কষ্ট হলেও রিদকে কোলে নিতে চাইবে।

” শুভ্রা একদম পাকনামি করবে না। ব্যথার চোটে নড়তেই পারছে না সে নাকি এখন রিদকে কোলে নিবে। চুপচাপ শুয়ে থাকো। আর রিদ দেখছো তোমার শুভ্রা মামণি অসুস্থ তাহলে কেনো কোলে উঠতে চাচ্ছো?”

ধমকে উঠে রুপন্তি। রিদ আর শুভ্রা কাচুমাচু হয়ে যায়। সকলে মুখ টিপে হাসছে। শুভ্রা কিছু বলতে যাবে তার আগেই সেখানে উপস্থিত হয় নীলিমা শিকদার আর আসাদ শিকদার।

শুভ্রা অবাক হয় তাদের দেখে। বাকি সকলে শান্ত ভাবেই আছে। তারা এসেছে মনে নিশ্চই তার মন্ত্রী মশাইও এসেছে। ভাবতেই আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠে তার মন। কিন্তু নাহ্, দিলো তো তার মনটা ভেঙে। আসেনি তার মন্ত্রী মশাই।

” কেমন আছো মা?”

” একদম সুস্থ শাশুড়ি মা”

বলেই জিভে কামড় দিয়ে ধরে শুভ্রা। এটা কি বললো ও। খান বাড়ির সকলে একটু অবাক হয়ে তবে পাত্তা দেয় না। তারা জানে এমন কিছুই হওয়ার ছিল। নীলিমা শিকদার আর আসাদ শিকদার অবাক নয়নে তাকিয়ে আছে শুভ্রার দিকে।

” দুঃখিত আন্টি। আসলে মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে। কিছু মনে করবেন না।”

বোকা বোকা হেসে বলে শুভ্রা। তারাও আর এ বিষয়ে কান না দিয়ে কিছুক্ষণ শুভ্রার সাথে কথা বলে চলে আসে। তাদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আলতো হাসে শুভ্রা। ইশ কি লজ্জার বিষয়। নিজেই নিজেকে বলে ,

” শুভ্রা এটা তুই কি করলি। আল্লাহ্, কি লজ্জা কি লজ্জা।”

আবার বলে,

” শুভ্রা তুই আবার কোন দিন থেকে লজ্জা পাওয়া শুরু করলি।”

এসব আজগুবি জিনিস ভাবতে ভাবতেই ফিক করে হেসে দেয় সে। কি সুন্দর প্রাণোচ্ছল সেই হাসি। চোখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে।
তাকে হাসতে দেখে খান পরিবারের সকলের মুখে হাসি ফুটে উঠে।

____________

কেটে গেছে একমাস। শুভ্রাকে বাড়িতে আনা হয়েছে আরো আগে। এখন সে সুস্থ প্রায়। এর মধ্যে একদিনও তার মন্ত্রী মশাইয়ের সাথে দেখা হয়নি। সে ভেবে রেখেছে আর মন্ত্রী মশাইয়ের সাথে কথা বলবে না। শুভ্রা অসুস্থ তবুও কেনো তাকে আর দেখতে এলো না।
কিন্তু তার বেহায়া মন শুনলো কি তার কথা সেই তো ফোন দিয়ে দিলো আরহামের নাম্বারে।
কল যাওয়ার কিছু সেকেন্ডের মধ্যে রিসিভ হয় অপরপাশ থেকে। যেনো অপরপাশের ব্যক্তি জানতো এখনি তাকে কেউ কল করবে। অবাক হয় শুভ্রা।

” আসসালামুআলাইকুম মন্ত্রী মশাই”

আরহাম কিছুসময় তাকিয়ে থাকে ফোনের দিকে। অতঃপর নিজের কণ্ঠে কঠোরতা এনে জবাব দেয় সে।
শুভ্রা বুঝতে পড়লো মন্ত্রী মশাই কোনো করবে রেগে আছে হয়তো। তাই যথাসম্ভব নিজের কন্ঠে কোমলতা এনে বলে,

“কেমন আছেন মন্ত্রী মশাই?”

” এই মেয়ে তুমি এটা জানতে রাত ১২ টায় আমায় কল করেছো?”

” আপনি কি কোনো কারণে রেগে আছেন মন্ত্রী মশাই?”

” তোমাকে বলতে বাধ্য নই”

বলেই ঠাস করে কল কেটে দেয় আরহাম। শুভ্রার চোখে পানি ছলছল করছে। সে এমন কি বলল যার জন্য তার সাথে এভাবে কথা বললো। উঠে দাড়ায় সে। বিছানার পাশের টেবিল থেকে বাবা-মায়ের একটা ছবি নিয়ে চলে যায় বারান্দায়।

_____________

আরহাম নিজের মাথা দুই হতে চেপে ধরে বসে আছে খাটের এক পাশে। সামনে পড়ে আছে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাওয়া ল্যাপটপ। ল্যাপটপটার কোনো অস্তিত্ব খুজে পাওয়া যাবে না কি না সন্দেহ।এমন অবস্থা হয়েছে।
কোনোভাবেই নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না সে।সব সময় শান্তভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া আরহাম কিছুতেই আজ নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রন করতে পারছে না।

শুভ্রার সাথে কথা বলার সময় আরহাম ল্যাপটপে কিছু একটা করছিল। তখনি ল্যাপটপে কিছু একটা নজরে আসতেই মুহূর্তেই শান্ত আরহাম আগ্নেয়গিরির মতো জলে উঠে। চোখ জোড়া অসম্ভব পরিমাণে লাল হয়ে আছে তার।

তাই যতো দ্রুত পারলো কল কেটে ফেলেছে সে। যেনো তার রাগের প্রতিক্রিয়া শুভ্রার উপর না হয়। তবুও তার মনে হচ্ছে শুভ্রা কষ্ট পেয়েছে। আরেকটু স্বাভাবিক ভাবে কথা বলা উচিত ছিল। পরক্ষণেই আবার মনে হলো, মেয়েটাকে নিয়ে এত ভাবার কি আছে। সেতো অন্য সকল সাধারণ মানুষদের মধ্যে একজন তার কাছে।
সত্যিই কি তাই? নিজ মনে প্রশ্ন জাগে তার। আবার নিজে নিজেই উত্তর দেয় সে,’হ্যাঁ সত্যিই তাই। মেয়েটা তাকে ভালবাসে সেতো বাসে না।’

আর কিছু ভাবতে পারলো না আরহাম। তার পাশে পরে থাকা ফোনটা স্বশব্দে বেজে উঠলো। আরহামের ঠোঁটে ভেসে উঠলো চমৎকার এক হাসি। দমে গেলো সকল রাগ। কিন্তু ফোন হতে নেওয়ার পর কাঙ্ক্ষিত মানুষটির কলের জায়গায় অন্য কারোর কল দেখে মূর্ছা গেলো তার হাসি। মুখে ভেসে উঠলো কিছুক্ষণ আগের দমে যাওয়া রাগ।

___________

চলবে,,,,,