#প্রিয়_রোদ্দুর🤍
#লেখনীতে:অনুসা_রাত(ছদ্মনাম)
#পর্ব:১৫
মেহেদী দিতে আমার ভীষণ ভালো লাগে।সবসময়ই মেহেদী দিয়ে হাত রাঙিয়ে রাখি।কখনো হাত খালি রাখি না।জন্মদিনে দেয়া উপহারের মধ্যে মেহেদীও ছিলো।সেখান থেকেই একটা নিয়ে হাত ভরে দিয়েছিলাম।ভালোই রঙ হয়েছে। ছাদে উঠে হাতটার ছবি তুললাম সুন্দর করে।এত সুন্দর একটা রঙ হলো সেটা রাখতে হবে তো।
ভাবলাম ছবিটা প্রোফাইল দিলে কেমন হয়!
ভেবেই ফেসবুকে ঢুকতেই একটা আইডি হঠাৎ মিউচুয়ালে দেখতে পেলাম।
‘jonaki ahmed simu’
প্রোফাইলে যে মেয়েটার ছবি দেয়া সেটা একদম হুবহু সেই মেয়েটার মত যাকে স্যারের সাথে দেখেছিলাম মেয়েটার আইডিতে ঢুকেও বের হয়ে এলাম।কারণ এখানে লক দেয়া।আইডি লক।
থাকুক!আমার কি!
এই মেয়েটাই স্যারের গার্লফ্রেন্ড। আমি সিউর।মিউচুয়ালে আছে যেহেতু।
আমি যখন এসব ভাবতে ভাবতে একদম ছাদের কোণায় ঠিক সেসময় আম্মু হঠাৎ পিছন থেকে এসে বলতে লাগলো,
-“কিরে রোদ্দুর এলো,আর তুই এখনো ছা…”
কথাটা বলতে বলতে দৌড়ে এসে আমাকে ছাদের সাইড থেকে সরিয়ে নিয়ে বললো,
-“এক্ষুনি তো পড়ে যেতি।কোনো আক্কেল আছে তোর!”
-“আরে পড়তাম না আম্মু।আমার এভাবে হাঁটতে ভালো লাগে।”
-“সন্ধ্যার সময়। শয়তানে ধাক্কা মারলে বুঝবি! ”
-“হইছে বুঝলাম।স্যার এসেছে? ”
-“হুম।জলদী যা।”
-“আরে এত জলদী যাওয়ার কি আছে।স্যার আমায় কিছুই বলবে না।”
বলতে বলতে আমি সিড়ি দিয়ে নিচে নেমে এলাম।আমাদের বাসার কলিং বেল বাজালাম।শ্রেয়া এসে দরজা খুলে দিলো।আমি রুমে ঢুকে স্যারকে সালাম দিলাম।আমার আম্মুর সামনে বলা কথাটাকে পাল্টে দিয়ে উনি বলে উঠলেন,
-“কতক্ষণ ধরে বসে আছি আমি!তুমি জানো না যে আমি এসময় আসি?”
আমি টেবিলে বসতে বসতে বললাম,
-“সরি স্যার আসলে…”
-“এত আসল-নকল আমি দেখতে চাচ্ছি না।আমি আমার গুরুত্বপূর্ণ সময় নষ্ট করে তোমার জন্য বসে থাকতে পারব না অতসী! ”
-“…….”
-“আমি আমার সময় যদি তোমার পিছনেই ব্যয় করি তাহলে বাকি স্টুডেন্ট দের কি দিব?তোমার কোনো সময়জ্ঞান নেই।পড়াশোনার মধ্যেও ফাঁকি বাজি ”
আমি নিম্নস্বরে বললাম,
-“স্যার আমি তো কাপড় আনতে গিয়ে…”
-“হয়েছে অনেক।আমি আর এক্সকিউজ শুনতে চাইনা।আমার পড়াশোনা রেখে আমি তোমার পিছনে এত সময় নষ্ট করতে পারব না।বই বের কর!”
আমার আর একটা কথাও না শুনে তিনি নিজের মত করে বই নিয়ে পড়াতে লাগলেন।
আমিও আর কিছু বললাম না।কিন্তু আমার মন এখনো সেই ব্যবহারটার মধ্যেই আছে।এটা কোনো ব্যবহার হলো?মানুষ এমন ব্যবহার কি করে করতে পারে।১০ মিনিট লেট হতেই পারে।
তাছাড়া উনি তো আমায় চেনেন,আমি কেমন।অযথা সময় নষ্ট কেন করব আমি।এতগুলো কথা শুনিয়ে দিলেন।
আমার ভাবনার মধ্যে হঠাৎ উনি বললেন,
-“এই,তুমি কি বুঝতেছো?”
আমি চমকে উঠে বারকয়েক মাথা নাড়িয়ে বললাম,
-“হ্যা!”
উনি কলমটা রেখে দিলেন খাতার উপর।হাতে হাত ভাজ করে বললেন,
-“বলোতো এখানে b=√67 কিভাবে হলো?পুরো ম্যাথটা বুঝাও তো।”
এই রে! হয়ে গেলো!আমি ঢোক গিলে তাও চেষ্টা করতে লাগলাম।কিন্তু লেকচার ই তো শুনিনি।ফলসরূপ কিছু হলোও না।উনি আমার সামনে থেকে খাতাটা টান দিয়ে নিয়ে বললেন,
-“কি হচ্ছে এটা?”
-“স..স্যার আপনিই তো বললেন! ”
-“আমি তোমাকে কি বলেছি?ম্যাথ বোঝাতে।কুয়েশ্চন মুখস্থ করতে বলিনি। ৫ মিনিট ধরে কুয়েশ্চন ই দেখছো।আনসার আর বলতে পারছ না।”(দাঁতে দাঁত চেপে)
আমি মাথা নিচু করে নিলাম।উনি নিজের কপালে দু আঙুলের সাহায্যে ঘষে বললেন,
-“তোমার দ্বারা কিছু হবে না আসলে।তোমার পিছনে আমার সময়গুলো শুধু শুধু নষ্ট হচ্ছে আমার।আচ্ছা একটা কথা বলোতো!”
আমি প্রশ্নবোধক চাহনি নিয়ে তাকালাম।উনি আবার বললেন,
-“ডাক্তার হতে চাওয়াটা কি তোমার শুধু মাত্র মুখেরই কথা?মানে আশেপাশের বান্ধবীরা বললো তাই তুমিও হ্যা তে হ্যা মিলালে?আমার তো তাই মনে হচ্ছে। কারণ তোমার পড়াশোনার যা অবস্থা তাতে মেডিকেলের দরজা অবধি যেতে পারবে কিনা সন্দেহ! ”
আমি অসহায় চোখে তাকালাম তার দিকে উনি বেশ রাগ নিয়েই তাকিয়ে আছেন।গম্ভীর গলায় আবার বললেন,
-“একটা সাধারণ ম্যাথ পারো না তুমি এইচএসসি টপকাবে কিভাবে?মেডিকেল তো দূর একটা ভালো ভার্সিটির দরজা পর্যন্ত যেতে পারবে না তুমি।”
আমি তখনো চুপ করে আছি।কথাগুলো আমার খুব গায়ে লাগছে।এভাবে কেউ কোনোদিন বলে নি আমায়।স্যার নিজেও না।উনিই উল্টে বলেছেন যে তুনি পারবে অতসী।চেষ্টা করো।আর তার মুখে এসব শুনে আমি হতভম্ব। আমার মুখ থেকে একটা শব্দও বের হচ্ছে না।উনি আমার সামনে খাতাটা জোরে টেবিলে রেখে বললেন,
-“আমার কথা কানে যাচ্ছে তোমার!নাকি এখনো অন্য ভাবনায় ডুবে।তোমার মনটা থাকে কোথায় বলোতো!পড়াশোনার নামগন্ধও নেই।আমাকে কি জোকার মনে হয়?খেলা দেখাতে আসছি?”
আমি অবাক হয়ে তাকালাম তার দিকে উনি শক্ত গলায় বললেন,
-“আজ আর মাফ নেই।হাত পাতো ”
আমি চুপচাপ হাতটা এগিয়ে দিলাম।উনি নিজের ব্যাগ থেকে একটা স্কেল বের করে আমার হাতে জোরেশোরে চারটা বাড়ি মারলেন।আরেক হাতেও চারটা।হাতটা কেটে গেলো মনে হয়।আমি মাথা নিচু করে ফেললাম।কান্না এলো!কিন্তু কান্না করলাম না।
চুপ করে বসে রইলাম।উনি জোরো শ্বাস ছেড়ে বললেন,
-“পাগল পাইছে আমারে! ”
পড়ানো শেষ করে উনি চলে যেতেই আমি দরজা লাগিয়ে বিছানায় বসে কাঁদতে লাগলাম।
হাতের দিকে তাকিয়ে দেখি কেটে রক্ত বের হচ্ছে।
আমার কান্না আরো বেড়ে গেলো।উনি হঠাৎ এতটা রিয়াক্ট কেন করলেন!আগে তো আরো কত বড় বড় অপরাধ করেছি তখন তো কিছু বলেনি।আজ হঠাৎ এত রাগলেন কেন!আমার হাতগুলো টুকরো টুকরো করে ফেলছে পুরো।নিজের দেয়া মেহেদী রাঙানো হাত নিজেই রক্তে লাল করে দিলো।একবারো হাত কাঁপলো না।কিসের জিদ দেখালো আমার উপর?আমি আর কোনোদিন আপনার সাথে কথা বলব না স্যার।কোনোদিন না!
।
সেদিনের পর থেকে রোদ্দুর স্যারের সাথে অতিরিক্ত কথা বলা আমি বন্ধ করে দিয়েছিলাম।হাতের ব্যাথায় জ্বর উঠে গিয়েছিল। অথচ সেই জ্বরেও সে আমায় পড়িয়েছে।একবারো জিজ্ঞেস করেনি যে জ্বর কেন হলো আর হাতের অবস্থা কি।নিজের কৃতকর্মে কোনো গিল্টি ফিল নেই তার।
কিছুদিনে তার উপর যে ভালোলাগা টা সৃষ্টি হয়েছিল সেটা এখন ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে।
লোকটাকে অসহ্য লাগছে।আবার আগের মত।
কিন্তু আগে সে এতটাও রুড ছিল না।
আমার জ্বর শুনে টিনা দৌড়ে বাসায় চলে আসে।আমি তখন বসে বসে সেই পুরনো কথাগুলোই ভাবছিলাম।
আমার ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে টিনা বললো,
-“কিরে!রোগীর জ্বর কেমন এখন?”
আমি টিনার দিকে তাকিয়ে দূর্বল গলায় বললাম,
-“হুম আগের থেকে ভালো।”
টিনার আমার পাশে বসে বলতে লাগলো,
-“তোর তো সচরাচর জ্বর হয় না।আজ হঠাৎ? ”
-“আমার বিয়ে খেতে আসছে!”
-“কি যে বলিস!”
-“তো কি বলব।জ্বর কি বলেকয়ে আসে?”
টিনা কথা বলতে বলতে হঠাৎ আমার হাতে দিয়ে তাকিয়ে আঁতকে উঠে বললো,
-“একি তোর হাতের এই অবস্থা কেন!”
আমি হাতগুলো লুকানোর ট্রাই করলাম।কিন্তু ও টেনে নিয়ে বললো,
-“ফুলে গেছে তো।”
-“হুমম..”
-“কিভাবে হলো?”
আমি টিনাকে সবটা খুলে বললাম।টিনা চিন্তিত গলায় বললো,
-“আমার মনে হয় গার্লফ্রেন্ড না করেছে তোর সাথে বেশি মিশতে।”
-“আরে ধূর!শোন,শয়তান শয়তানই থাকে।শয়তান কখনোই ভালো হয় না।”
-“এভাবে বলছিস কেন!
-“তো জামাই আদর দিয়ে বলবো?আমাকে কতগুলো কথা শুনিয়ে শুধু শুধু কেন মারবে।বাজে লোক একটা।অসহ্যকর!”(রেগে)
টিনা হাজার চেষ্টা করেও আমাকে থামাতে পারছে ন।ইচ্ছে মত বকাঝকা করে শান্ত হলাম আমি।আর সিদ্ধান্ত নিলাম যে এই লোকটার কাছে কখনো নত হব না আমি।কখনো না।
।
কলেজ থেলে ফেরার পথে আমি আর টিনা যখন হাসাহাসি করছিলাম হঠাৎ দেখি সেই জোনাকি নামের মেয়েটার সাথে আবারো স্যার।
এসব কি আমার সামনেই পড়ে নাকি!
আমি চলে যেতে নিব ঠিক সেসময় টিনা বললো,
-“আরে কোথায় যাচ্ছিস!”
-“বাসায়!”
-“আরে দেখি না ওরা কি বলে!”
-“ওদের কথা শুনে আমার কি লাভ বলতো!”(বিরক্ত হয়ে)
-“একটু দাঁড়িয়ে থাক।চল ওই দিকটায় ফুচকা খাই।তাহলে দেখতে পাবে না আমাদের। কিন্তু আমরা শুনতে পারব।”
-“কিন্তু কেন!”
-“আমাদের জানার দরকার যে এই জোনাকি আসলে কে!”
টিনা টানতে টানতে আমাকে নিয়ে ফুচকাওয়ালার সামনে দাঁড় করিয়ে ফুচকা অর্ডার দিলো।আমি আড়চোখে বারবার দেখছি।রোদ্দুর স্যার মেয়েটার সাথে হেসে হেসে কথা বলছে।আর আমাকে মারে!
কেমন বাজে লোক।আর আমি কিনা ভেবেছিলাম ফেমেলি প্রবলেম। টিনা ঠিকই বলেছে।রোদ্দুর স্যার মেয়েটিকে বলছে,
-“সরি। আর হবে না।”
-“তুমি সবসময় এমন কেন করো রোদ্দুর!”
-“সত্যি আর হবে না।”
এরপর ওনারা হাঁটতে হাঁটতে দূরে চলে যাচ্ছেন। তাই আর কিছু শোনা গেল না।টিনা পাশ থেকে বললো,
-“নে তোর ফুচকাটা।ওমা!ওরা কই?”
-“ওরা চলে গেছে। ”
-“এত জলদী।আচ্ছা থাক।নে ফুচকা!”
আমি ওর দিকে একবার তাকিয়ে ছুটে চলে এলাম সেখান থেকে।টিনা পিছন থেকে ডাকছে আমায়।কিন্তু এই মুহূর্তে আমার ফুচকা খাওয়ার মত ইচ্ছে নেই।আমার ভীষণ রাগ হচ্ছে নিজের উপর।এমন একটা মানুষের জন্য অনুভূতি সাজাচ্ছিলাম যে কিনা আমার নয়।
আমি যখন মাথা নিচু করে আনমনে হাঁটছি ঠিক তখনই একজনের সাথে ধাক্কা খেলাম।ধাক্কা খেয়ে সোজা নিচে পড়ে গেলাম।চোখ তুলে দেখলাম এটা রোদ্দুর স্যার।আমি আশেপাশে তাকালাম। এতটা দূরে চলে এসেছি!
আমি পড়ে গেলাম অথচ উনি আমায় ধরলেনও না।আমি নিজে নিজেই উঠলাম।তারপর বললাম,
-“আসসালামু আলাইকুম। ”
-“তুমি এখানে কি করছ?”(ভ্রু কুঁচকে)
-“কিছু না।বাসায় যাচ্ছি! ”
উনি পথ ছেড়ে দিলেন।আমি ওই মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বললাম,
-“ইনি কে স্যার?”
উনি হেসে বললেন,
-“ইনি তোমার মেডাম।”
আমি অবাক হয়ে তাকালাম।উনি আবারো বললেন,
-“জোনাকি,এটা আমার স্টুডেন্ট। অতসী।”
মেয়টি আমার দিকে হাত বাড়িয়ে বললো,
-“হ্যালো অতসী”
আমি হাত মিলিয়ে জোরপূর্বক হাসলাম।স্যার আমাকে পাত্তা না দিয়ে জোনাকি কে নিয়ে চলে গেলো।আমাকে একবার বললোও না সাবধানে যেতে।
আমি ওনার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম।উনি হাসতে হাসতে মেয়েটার সাথে চলে গেলেন।
আমার বুকের মধ্যে কেমন চিনচিন করে উঠলো।
দোষটা আমারই।আমিই এসবে জড়িয়ে গেছি।ওনার গার্লফ্রেন্ড আছে এটা জেনেও আমার ওনার জন্য অনুভূতি জমানো উচিত হয়নি।অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে। অনেক বড় ভুল!
চলবে….
#প্রিয়—রোদ্দুর🤍
#লেখনীতে:অনুসা_রাত(ছদ্মনাম)
#পর্ব:১৬
জোনাকি ঘটনার পর আজ ৪ দিন হচ্ছে আমি রোদ্দুর স্যারের সাথে তেমন একটা কথা বলি না।আর উনিও বলেন না।দিনকে দিন ওনার বিহেভিয়ার আমার প্রতি এত খারাপ হচ্ছে যে কি বলবো!
আমি জানি না হঠাৎ এমন পরিবর্তন কেন ওনার মধ্যে!
মাঝের কিছু দিন তো ভালো ব্যবহার করেছিলো যেগুলোর মানে আমি খুঁজে পাইনি।আর আজ যখন আবার আগের মত করছে সেটার মানেও আমি খুঁজে পাচ্ছি না।তবে আমার ধারণা ওনার গার্লফ্রেন্ড হয়ত অনেক ইনসিকিউরড ফিল করে তাই এমন করেছে।
আমার এই শিক্ষার দরকার ছিলো অবশ্য। ওনার গার্লফ্রেন্ড আছে এ সম্পর্কে জানা স্বত্বেও আমার মনে তার জন্য অনুভূতি জমানো আমার অনুচিত বলে আমি মনে করি।হুম ঠিকই আছে।এটা আমার প্রাপ্য!
-“অতসী?”
রোদ্দুর স্যারের ডাকে ঘোর কাটে আমার।উনি খাতার দিকে তাকিয়েই বলছেন,
-“মনোযোগ কোথায় তোমার?”
আমি মাথা নিচু রেখেই বললাম,
-“দেখছি স্যার।”
-“হুমম!”
বলে উনি আবারো অংক করাতে লাগলেন।বাড়তি একটা কথাও বললেন না।আর না আমি কথা বাড়ালাম। আজকাল উনি আমার দিকে তাকিয়ে কথা বলেন না।কেন সেটা আমার জানা নেই।মনে হয় এটাও জোনাকিই নিষেধ করেছে। থাক!আমার আর কি!
হঠাৎ একটা অংকে এসে উনি বললেন,
-“বলোতো,এটা কিভাবে হলো?”
আমি মুচকি হেসে বলে দিলাম।উনি ভ্রু উঁচিয়ে সন্দিহান হয়ে আমার দিকে এক নজর তাকালেন।আমি সেটা বুঝতে পারলাম।কিন্তু তাও খাতা থেকে চোখ সরিয়ে ওনার দিকে তাকালাম না।
উনি শুধু বললেন,
-“হুম গুড।”
যাক বাবা!ভাগ্যিস আগের থেকে জানা ছিল।নয়ত এখন যে বাঁশ খেতাম।আমি যথাসম্ভব মনোযোগ দিলাম।কারণ এখন না পারলে আমাকে আবার পিটাবে।সেদিনের সেই পিটুনির কথা মনে পড়লে আমার আজও চোখজোড়া ছলছল করে উঠে।
হাতগুলো কেমন লাল লাল হয়ে গেছিল।
উনি খাতা বন্ধ করতে করতে বললেন,
-“হুম,তাহলে এতটুকুই এনাফ।!”
আমি মাথা নাড়ালাম।উনি চা খেতে লাগলেন।আমি চুপচাপ বসে আছি।কিন্তু কিছু বলছি না।উনিই বললেন,
-“পড়াশোনা কি কিছু করো তুমি?”
-“হ্যা,করবো না কেন!”
-“আমার তো তোমার পড়াশোনার হাল অনেক বেহাল মনে হচ্ছে! ”
-“এমন মনে হওয়ার তো কোনো কারণ নেই স্যার।আমি ভালোভাবেই পড়ছি।”
-“সেটা তো পরীক্ষার সময়ই দেখা যাবে।”
আমি চুপ করে রইলাম।উনি আবার বললেন,
-“ফাঁকি বাজিটা কমিয়ে করো।আর পড়াশোনায় মনোযোগ দাও।এতটাও বয়স হয়ে যায়নি।সবে তো এইচএসসি। পড়াশোনা করো।আজেবাজে চিন্তা মাথা থেকে নামাও।”
-“আমার মাথায় কিসের আজেবাজে চিন্তা আসবে!”
-“সেটা তুমি ভালো বলতে পারবে।ভুলে যেওনা আমি কিন্তু তোমার টিচার।”
-“এটা আমাকে বারবার মনে করাতে হবে না স্যার।আমি খুব ভালো করেই জানি যে কে কি!”
-“মানে?কি বলতে চাইছো?”(রেগে)
-“আমি বলতে চাইছি যে আপনি যে আমার টিচার এটা বারবার বলতে হবে না।এটা আমার মস্তিষ্কে সেভ করা আছে।”
-“এত অতিরিক্ত কথা কেন বলো তুমি?”
বলেই চেয়ার ছেড়ে উঠে গেলেন।আমিও সাথে উঠে দাঁড়িয়ে গেলাম।হালকা হেসে বললাম,
-“আপনি শুরু করলেন!”
-“তুমি হাসছো কেন?”
-“এক্সকিউজ মি!হাসলেও কি আপনার পারমিশন লাগবে নাকি?”
-“তুমি আমার সাথে এভাবে কথা বলছো কোন সাহসে।আমি তোমার টিচার।তোমার থেকে কত বড়।”
আমি মাথা নিচু করে বললাম,
-“সরি স্যার।”
-“ডোন্ট ক্রস ইউর লিমিট অতসী।সরি বললেই সব সমাধান হয় না।”
আমি তখনও চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি। কারণ উনি আমার স্যার।উনি চাইলেই এতগুলো কথা বলতে পারেন কিন্তু আমি পারব না সমস্ত কথার জবাব দিতে।এটাকে বেয়াদবি বলা হবে।মনের কথা মনেই রয়ে গেলো আর উনি বলে উঠলেন,
-“তুমি একটা বেয়াদব অতসী!”
আমি মুখ তুলে তাকালাম ওনার দিকে।উনি আবার বললেন,
-“তোমার মত নির্লজ্জ মেয়ে আমি একটাও দেখিনি।”
-“স্যার আপনি…”
-“কি আমি?আর একটা কথাও বলবে না।স্টুডেন্ট, স্টুডেন্টের মত থাকবে।আর পারলে পড়াশোনাটা করো।আমার তো মনে হয় তোমার কাছে ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছে টা একটা সো অফ মাত্র!”
-“স্যার আপনি কিন্তু…”
আমার কথার মাঝেই আম্মু রুমে ঢুকলো কি হয়েছে বলতে বলতে।
আমি সেখানেই আঁটকে গেলাম।কারণ আম্মু এসব শুনলে আবার আমাকেই বকবে।উনি আমার দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে আছেন।আম্মু এসে বলতে লাগলো,
-“কি হয়েছে বাবা?”
উনি আম্মুর দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললেন,
-“কিছু না আন্টি।পড়াশোনা করান ওকে।বোঝান যে পড়াশোনা কতটা জরুরি! ”
-“আবার কি করেছে?”
-“কি আর করবে।অমনোযোগী ভীষণ।ফোনটা নিয়ে নিবেন।”
-“আচ্ছা আমি বোঝাব ওকে।”
বলেই আম্মু এগিয়ে এসে আচমকা আমার গালে চড় বসিয়ে বললো,
-“কি সমস্যা তোর?পড়াশোনা নেই?”
আমি গালে হাত দিয়ে তাকিয়ে আছি আম্মুর দিকে।রোদ্দুর স্যারের দিকে তাকিয়ে দেখলাম উনি কিছু বলছেন না শুধু হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিচের দিকে তাকিয়ে আছেন।
আম্মু আমার ফোনটা টেবিলের উপর থেকে নিতে নিতে বললো,
-“আজ থেকে ফোন বন্ধ। পড়াশোনা করো না আবার ফোন!”
আমার চোখ দিয়ে টপটপ পানি পড়ছে।কিন্তু কিছু বলছি না।রোদ্দুর স্যার ইচ্ছে করে আম্মুর কাছে আমাকে মার খাওয়ালেন।উনি এতটা খারাপ!
আমি ওনাকে কতটা ভালো ভেবেছিলাম। আর উনি কিনা!
আম্মু আমাকে কথা শোনাচ্ছে,
-“তোর কোনো ফোন নেই,পড়তে বস যা।বাপ-দাদার হোটেলে খেয়ে খেয়ে শরীর তো বানাচ্ছ। কিন্তু পড়াশোনার বেলায় ডাম্বো।”
আমি নাক টেনে টেবিলে বসে পড়লাম।আম্মু আবার বললো,
-“এখান থেকে রাত ১২ টার আগে যেন উঠা না হয়।”
বলেই চলে গেলো।আমি ঠায় বসে আছি। আজ অনেক দিন বলতে গেলে অনেক বছর পর আম্মু আমার গায়ে হাত তুললো।আম্মু সচরাচর আমার গায়ে হাত তোলে না।খারাপ রেজাল্ট করলেও না
আর আজ কিনা এত সাধারণ একটা বিষয় নিয়ে শুধু শুধু বকলো।
রোদ্দুর স্যার যখন রুম থেকে বের হবেন ঠিক তখনই ওনার ফোনটা বেজে উঠল। উনি দাঁড়িয়ে রিসিভ করলেন,
-“হুম বলো।”
অপরপাশ থেকে কি বলছে শোনা যাচ্ছে না।উনি বললেন,
-“আরে না জোনাকি।আজ আমাদের বাসায়ই চলে এসো।মজা হবে একসাথে সবাই।”
আমি ঘৃণার চোখে তাকালাম।উনি অবশ্য আমার তাকানো দেখেননি।উনি একসাথে মেয়েদের সাথে রাত কাটান।ছিহ!আমার তো ওনার কথাতে তাই মনে হচ্ছে।
-“আরে না।আমি বাসায়ই থাকব।হুম ফ্রী।”
-“…..”
-“আচ্ছা দেখা হচ্ছে। হুম আমিও মিস করি।”
-“….”
-“আচ্ছা টাটা।”
বলেই উনি চলে গেলেন।কিন্তু কথাগুলো আমায় শুনিয়ে গেলেন।এটা আমি ভালোই বুঝতে পারছি। তারমানে ওনার প্রতি জন্মানো অনুভূতিটা৷ সম্পর্কে উনি অবগত।আর হয়ত আমাকে মাঝখান থেকে সরানোর জন্য বোঝাতে চাচ্ছে যে উনি কতটা সুখে।
আমি নিজে নিজে বিরবির করলাম,
-“আমার তো এত ঠেকা পড়েনি তোর মত রাক্ষসের সাথে….
হাহ কোনোদিন না।আসলে শয়তান তো শয়তানই।
আমাকে ইচ্ছে করে মার খাওয়ালি।তোর সাথে আমি আর কোনোভাবে কোনোদিন কথা বলব না।তুই তোর গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে শুয়ে থাক।”
আমার কি!
ওনার প্রতি ধীরে ধীরে আমার ঘৃণা জন্মাতে লাগল।কারণ উনি যে এমন সেটা আমার আগে জানা ছিল না।রাত-বিরেতে গার্লফ্রেন্ড কে ডাকছে।ছিহহ!
।
অনেকদিন পর ফুপিকে আমার বাসায় দেখে আমি অবাক হলাম।কলেজ থেকে ফিরেই দেখি ড্রয়িং রুমে বসে চা খাচ্ছে আম্মু আর দাদীর সাথে। আমি খুশি হয়ে বললাম,
-“ফুপি তুমি!”
-“হ্যা চলে এলাম।আয় বোস!”
আমি গিয়ে ফুপির পাশে বসে পড়লাম।আম্মু চোখ রাঙিয়ে বললো,
-“রোদ্দুর আসবে।আগে ফ্রেশ হয়ে নাও।”
আম্মুর শুধু রোদ্দুর আর রোদ্দুর। আমি পাত্তা দিলাম না।ফুপিকে জড়িয়ে আহ্লাদী গলায় বললাম,
-“ফুপি,তুমি সেই যে বার্থডের দিন দেখা দিয়ে চলে গেলে,আর তো এলে না।”
-“আরে সায়ন্তির পরীক্ষা তো।এইযে আজ এলাম।”
-“সায়ন্তি কই?”
-“তোর রুমেই তো।ফ্রেশ হতে গেলো।”
-“আচ্ছা যাক।তো আজকে হঠাৎ কি মনে করে আমাদের কথা মনে পড়লো?”
ফুপি কেমন দুষ্টু হেসে বললো,
-“সারপ্রাইজ আছে।”
-“সারপ্রাইজ? “(প্রশ্নবোধক চাহনি)
-” হ্যা।”
-“কার জন্য? ”
-“তোর জন্য।রেডি থাক।সারপ্রাইজ আসছে।”
-“কই দেখি।”
-“রাস্তায় আছে।”
ফুপির কথার আগাগোড়া বুঝলাম না আমি।কিছু বলব তার আগেই কলিংবেল বাজলো।আমি দ্রুত চলে গেলাম রুমে।আমি সিউর যে রোদ্দুর স্যার এসেছে।
আমি ঢুকতে ঢুকতে সায়ন্তি বের হলো।আমার তাড়াতাড়ি করতে দেখে বললো,
-“কিরে এমন করছিস কেন!প্রকৃতি ডাক দিলো নাকি?”
-” আরে সর তো।বাঘ এসেছে! ”
-“ব..বা..বাঘ।”
আমি ওকে সরিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলাম। সেদিন ১০ মিনিট দেরী হওয়ায় কি করছিলো!
আমি তাড়াহুড়ো করে চোখেমুখে পানি দিলাম শুধু। চেঞ্জ করার সময় নেই।যম আমার দুয়ারে।
আমি ওয়াশরুম থেকে বের হতেই ধাক্কা খেলাম রোদ্দুর স্যারের বুকে।এখনো মুখ মুছিনি।চুলগুলো গালে গলায় লেপ্টে। ওনার শার্টে একটু পানি ভরে গেলো।আমি জিভে কামড় দিলাম।উনি শার্ট টা দেখে বললেন,
-“ডিজগাস্টিং!একটা কাজও ভালো করে করতে পারো না।তুমি ২ মিনিট ৩০ সেকেন্ড লেট করেছো।আবার আমার শার্ট টাও নষ্ট করে দিলে।”
-“সরি স্যার।একটু পানিই তো।”
-“তোমার মুখের তাও।”
আমার অনেক অপমানিত বোধ হলো।আমি মাথা নিচু করে বললাম,
-“সরি।আমি আমার কাজের জন্য দুঃখিত।আমি পরিষ্কার করে দিচ্ছি।”
বলেই পানি নিয়ে সেই জায়গায় একটু দিয়ে বললাম,
-“হাত লাগালে আবার সমস্যা হবে না তো?হাতটাও তো আমারই।”(মলিন হেসে)
উনি শুধু আমার দিকে তাকালেন একবার।কিছু বললেন না।আমি হাত লাগালাম না।ছোট্ট ফ্যানটা দিয়ে ওনার বুকের কাছে ধরে শুকিয়ে দিতে লাগলাম।উনি আমার দিকে কিছু সময় তাকিয়ে রইলেন।আমি সেটা বুঝেও কিছু বলছি না।আমার চোখগুলো ছলছল করছে তাও পানি ফেলছি না।আমার ইগোতে লেগেছে কথাগুলো।উনি আমার হাতটা সরিয়ে দিলেন।বললেন,
-“আমার সময় নষ্ট করো না।”
তারপর আমার হাতটা টেনে নিয়ে টেবিলের দিকে যেতে লাগলেন।আমি ওনার হাতের দিকে তাকিয়ে রইলাম।এখন যে আমার হাত ধরলেন এটা কি?
আমি হাতটা ছাড়াবো,তাহলেই তো মুখের উপর ঝামাটা পড়বে।এটা ভেবে যেই না হাতটা সরাব অমনি স্যারের হাতের উপর আরেকটা ঘড়িওয়ালা হাত পড়লো।ছেলের হাত!
হাতের উপর হাত পড়তেই রোদ্দুর স্যার থেমে গেলেন।পিছনে ফিরে ভ্রু কুঁচকে তাকালেন।আমি হাত অনুসরণ করে উপরে তাকাতেই অবাক হয়ে গেলাম।মুখে বড় একটা হাসি ফুটে উঠলো।সে এক রাশ হাসি নিয়ে বলে উঠলো,
-“চাঁদনী!”
চলবে…