প্রিয় রোদ্দুর পর্ব-২৯+৩০

0
377

#প্রিয়_রোদ্দুর🤍
#লেখনীতে:অনুসা_রাত(ছদ্মনাম)
#পর্ব:২৯

-“তুই যা সিদ্ধান্ত নিয়েছিস বুঝে শুনে নিয়েছিস তো?”

আম্মুর এমন কথায় আমি মুখ তুলে তাকালাম।গম্ভীর গলায় বললাম,

-“হুমম আমি বুঝে-শুনেই নিয়েছি।”

-“তোর চোখ-মুখ যে অন্য কথা বলছে!মায়ের থেকে কিছু লুকাতে পারবি না অতসী।”

-“আমি কিছু লুকাচ্ছি না আম্মু।আমার দ্বীপকেই পছন্দ! ”

-“তাহলে রোদ্দুর কে কেন ভালোবাসলি?”

-“আমি উনাকে ভালোবাসি না।”(আটকে আসা গলায়)

-“একবার বিয়ে কনফার্ম হয়ে গেলে কিন্তু পরে আর সুযোগ পাবি না অতসী।ভেবে দেখ।সবাই কিন্তু জীবনে নিজের ভালোবাসার মানুষ কে জীবনসঙ্গী হিসাবে পায় না।”

আমি আম্মুর দিকে না তাকিয়েই উঠে দাঁড়ালাম। আলামারি খুলে জামা বের করতে করতে বললাম,

-“আমি ভেবে নিয়েছি।”

বলেই জামাকাপড় নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে চলে গেলাম।
গোসল করে এসে আম্মুকে আর আমার রুমে পায়নি আমি।ফ্যান টা ছেড়ে ধুপ করে বিছানায় বসে পড়লাম।
আমি যা করছি সেটা কি আদৌ ঠিক করছি?
হুম করছিই তো।উনি যদি এমন করতে পারেন তাহলে আমি কেন করতে পারি না?স
ওনারা যেহেতু চান আমার আর দ্বীপের বিয়ে হোক।
তাহলে সেটাই হবে।সেদিন ওনার সেই চোখ-মুখ দেখে আমার আত্মা কেঁপে উঠছিল।কিছুতেই নিজেকে সামলাতে পারছিলাম না।মনে হচ্ছিল ঝাপটে ধরি।আর বলি,

-“আমি শুধু এবং শুধু মাত্র আপনার।”

কিন্তু বলিনি।নিজেকে সামলে দৌড়ে ঘরে চলে এসেছি।অঝোরে কেঁদেছি।নিজেকে কষ্ট দিয়েছি।কারণ আমি চাই ওনাকে বোঝাতে।একটু হলেও উনি বুঝুক প্রিয় মানুষ এমন করলে কেমন লাগে।তারপর দেখি,আমার অভিমান ভাঙাতে রাক্ষস টা কি কি করতে পারে।
আমার ভাবনার মাঝেই ঘরে ঢুকলো ফুপি।হাতে একটা বড় বাক্স।আমি একবার তাকিয়ে হালকা হাসলাম।ফুপি এসে আমার পাশে বসতে বসতে বললো,

-“এই দেখ তোর জন্য আমি কি এনেছি!”

-“কি?”(ভাঙা গলায়)

ফুপি বাক্স টা খুলতে খুলতে বললো,

-“এখানে আমার দ্বীপের বউয়ের জন্য রাখা গয়না আছে।সব তোর।এখানে রেখে যাচ্ছি যেন পরে সাজার সময় কোনো সমস্যা না হয়।আজ তোর আব্বু আসলে বিয়ের ডেট ফাইনাল হবে।”

খুশিতে আত্মহারা হয়ে কথাটা বললো ফুপি।
আমি তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললাম,

-“তুমি খুশি তো?”

-“হ্যা হ্যা।অনেক খুশি।”

-“আর এজন্যই মনে হয় অন্যদের খুশিটা বেশি তোয়াক্কা করনি।তাই না ফুপি?”

ফুপির হাসিটা মিলিয়ে গেলো।অবাক হয়ে বললো,

-“মানে?”

-“এমন কেন করলে ফুপি?”

-“কি করেছি আমি?”

-“কি করনি?তুমি রোদ্দুর স্যারের বাড়িতে গেছিলে?”

ফুপি উঠে দাঁড়ালো।চেহারার রং পাল্টে গেলো।আমতা আমতা করে বললো,

-“কে বলেছে তোকে?”

-“আমি সবটাই জানি।কেন করলে এমন?”

-“দেখ মা!আমি জানি যে দ্বীপ তোকে ভালোবাসে আর তুই দ্বীপকে।আমি চাইনি তোদের মাঝে তৃতীয় ব্যক্তি আসুক!”

-“দ্বীপ ভালোবাসে কিনা জানি না।কিন্তু আমি দ্বীপকে ভালোবাসি। তবে বন্ধুর মত।তোমাদের খুশি সরি,তোমার খুশির জন্য আমি দ্বীপকে বিয়ে করতেই পারি।কিন্তু তারপরেও আমার মন থেকে রোদ্দুর স্যারের নাম মুছবে না ফুপি।”

-“বিয়ের সিদ্ধান্ত তো তুই নিয়েছিস!’

-“তুমি অপশন রেখেছো আর?”

-“আমি তো তোদের ভালো ভেবেই..”

-“সংসার এক তরফা ভালোবাসা দিয়ে হয়না ফুপি।সংসার করতে গেলে দুই দিক দিয়েই থাকতে হয়।আমার চেয়ে তুমি বয়সে বড়।হয়ত তুমি আরো বেটার জানবে বিষয়টা।”

-“….”

-“এখন আর হয়ত কারোর জানতে বাকি নেই যে আমি রোদ্দুর স্যারকে পছন্দ করি।কিন্তু আমার দুজন প্রিয় মানুষ মানে তুমি আর রোদ্দুর স্যার আমার ভালো চাইতে এত কিছু করলে। তুমি করলে ছলনার আশ্রয় নিয়ে।আর রোদ্দুর স্যার মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে।তাই আমি কি তোমাদের দুজনের ইচ্ছে অপূর্ণ রাখতে পারি?আমি দ্বীপকে বিয়ে করব।”

-“….”

-“তুমি খুব জঘন্য হয়ে গেছ ফুপি।তুমি অনেক স্বার্থপর। আমি বিয়ে করি আর না করি,সবার সামনে তোমার মুখোশ ঠিকই খুলব।”

ফুপি এতক্ষণ মাথা নিচু করে ছিল।এখন কিছু বলতে যাবে তার আগেই কলিং বেল টা বেজে উঠল। আমি বিছানা ছেড়ে উঠতে উঠতে বললাম,

-“কে এলো আবার!”

বলেই দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম।ড্রইংরুমে যেতে যেতে বললাম,

-“কে এসেছে আম্মু?”

আমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছি। দ্বীপ আর দিয়া বর-বউয়ের বেশে দাঁড়িয়ে আছে।আমি দ্বীপকে উদ্দেশ্য করে ভ্রু কুঁচকে বললাম,

-“এসব কি!”

দ্বীপ একনজর দিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,

-“আমরা বিয়ে করেছি।”

পিছন থেকে ফুপি এগিয়ে এসে বলতে লাগলো,

-“এটা তুই কি করেছিস দ্বীপ।তোর সাথে অতসীর বিয়ে ঠিক হয়েছে।”

-“কিন্তু আমি দিয়াকে ভালোবাসি মা।”

আমার দিকে না তাকিয়েই বললো দ্বীপ।আমি দিয়ার দিকে এগিয়ে গিয়ে বললাম,

-“তুমিও দ্বীপকে ভালোবাসো?”

দিয়া মুখ তুলে তাকালো না।নিচের দিকে তাকিয়েই বললো,

-“হ্যা।”

ফুপি রেগেমেগে অস্থির হয়ে বলতে লাগলো,

-“নির্লজ্জের মত আবার ভালোবাসার কথা বলা হচ্ছে!আমি আমার ছেলেকে যার সাথে বিয়ে দিব ও তার সাথে বিয়ে করবে।তুমি কে!”

দিয়া শুধু স্বাভাবিক গলায় বললো,

-“আমি তো কেউ ছিলাম না আন্টি।কিন্তু এখন থেকে হয়েছি।দ্বীপের লিগ্যাল বউ।”

-“দেখ অতসী!মেয়েটা কিভাবে কথা বলছে!”

আম্মু এবার চুপ থাকতে না পেরে বললো,

-“আচ্ছা আমরা সবাই মিলে বসে বিষয়টা মিমাংসা করি।আর দ্বীপ!তুই তোর পছন্দের বিষয়টা আমাদের জানাতে পারতি।এভাবে পরিবারকে না জানিয়ে বিয়ে করাটা তোর অন্যায় না?”

দ্বীপ ঠান্ডা গলায় বললো,

-“আমি অনেকবার বলার চেষ্টা করেছি মামী।কিন্তু আমাকে আমার মা সুযোগ দেয়নি।”

ফুপি তখনো রেগে বোম।রাগী গলায় বললো,

-“এই মেয়েকে আমি কিছুতেই ঘরে তুলব না।চিনি না,জানি না।পরিচয় নেই।কাকে তুলে এনেছিস!”

-“না ই তুলতে পারো।আমার আলাদা বিজনেস আছে।আমি ওকে নিয়ে আলাদা থাকতে পারব।”

দ্বীপের এই কথায় ফুপি আরো তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলো।আমি ফুপিকে ধরে সোফায় বসিয়ে বললাম,

-“তুমি ঠান্ডা হও ফুপি।আমরা দেখছি বিষয়টা।দ্বীপ তুই ঘরে যা।আর দিয়া তুমি আমার ঘরে যাও।তোমার ভাইয়ার সাথে আমার কথা আছে।”

দিয়া মাথা হেলিয়ে চলে গেলো।দ্বীপ সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো।ফুপি কান্না করছে।আম্মু সামলাচ্ছে।আমি দ্বীপকে উদ্দেশ্য করে বললাম,

-“আমাকে অন্তত বলতে পারতি।”

-“আমি ভালোবাসার মূল্য দিতে জানি।তাই যাকে ভালোবাসি তাকেই বিয়ে করছি।তোর মত জেদের বশে ভুল সিদ্ধান্ত নিচ্ছি না।”

আমি হাসলাম।তারপর বললাম,

-“আচ্ছা ভালো করেছিস।এবার ফুপা,দাদী সবাইকে বুঝাস।”

বলেই চলে এলাম নিজের রুমে।রুমে ঢুকতেই দেখলাম দিয়া চুপচাপ আমার বিছানায় বসে আছে।আমি এগিয়ে গিয়ে ওর পাশে বসলাম।দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম,

-“তুমি আসলেই দ্বীপকে ভালোবাসো?”

ও কেমন চমকে উঠলো।যেন কিছু একটা ভাবছিলো।আমতাআমতা করে বললো,

-“হ্যা!”

-“তোমার ভাইয়া জানে?”

-“ন..না!”

-“ফ্যামেলি?”

-“নাহ।কেউ কিছু জানে না।”

-“সবাইকে তো জানাতে হবে।তোমার ভাইয়াকে কল দাও।”

-“কিন্তু আপু..”

-“কল দাও।”

দিয়া বাধ্য হয়ে কল দিলো রোদ্দুর স্যারের নাম্বারে। আমি হাতে হাত ভাজ কর তাকিয়ে আছি।
জানি না কি হতে চলেছে। তবে শুধু এটাই চাইব যেন যা হয় সব ভালোর জন্যই হয়।

বিয়ের মত পবিত্র বন্ধন ভাঙার শক্তি হয়ত আমাদের কারোর নেই।দ্বীপ আর দিয়া বিয়ের মত এত সুখময় আর স্বর্গীয় একটা সম্পর্কে জড়িয়েছে।এটাকে ভাঙার সাধ্যি কারোর নেই।তাই দুই পরিবার মিলে বসে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে দ্বীপের বিয়েটা মেনে নিবে।তাছাড়া তারা ভালোবেসে বিয়ে করেছে এখানে আর কার হাত থাকতে পারে।
এগুলোই বসে বসে ভাবছিলাম ছাদে দাঁড়িয়ে। চারিদিকে অন্ধকার।রাত আটটা বেজে গেছে। নিচে এখনো দ্বীপ-দিয়ার দুই পরিবার মিলে নানান কথা বলছে।আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবলাম,

-“আপনি এতকিছু না করে আমাকেই সবটা বলতেন স্যার।তাহলে আজ বিষয়টা অন্যরকম হত।”

হঠাৎ পিছন থেকে কাঁধে কেউ হাত রাখলো।
আমি কেঁপে উঠে চোখ মুছে পিছনে তাকাতেই রোদ্দুর স্যারকে দেখতে পেলাম।উনি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।ওনার চোখজোড়ায় স্পষ্ট চঞ্চলতা প্রকাশ পাচ্ছে। আমি নিচের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললাম,

-“আপনি এখানে!”

-“হুমম!”

-“কেন এসেছেন?”

-“আসতে পারি না?”

-“আমি একটু একা থাকতে চাই!”(গম্ভীর স্বরে)

-“এতটা পাল্টে গেলে কেন অতসী?”

-“আপনার বেলায়ও আমার এই প্রশ্ন টাই মাথায় এসেছিল।এত কেন পাল্টে গেলেন!”

-“আমার এমন হওয়ার পিছনে একটা কারণ ছিল।আর সেটা তোমার অজানা নয়।”

-“এক কথা বারবার আর ভালো লাগছে না।”

-“তোমার ফোলা ফোলা গালগুলো কিউট লাগছে।মন চাচ্ছে টুক করে চুমু খেয়ে নিই।”

আমি অনেক কষ্টে নিজেকে সামলাচ্ছি। এই লোক আমাকে গলিয়ে দিবে এখনই।আমি তো এটা হতে দিব না।দেখি রাক্ষস টা একটু মানুষ হয় কিনা।

-“এসব বলবেন না তো।”

বলেই চলে যেতে নিলাম।উনি পিছন থেকে আমার হাত টেনে ধরলেন।আমি আশ্চর্য হয়ে ওনার দিকে তাকালাম। হাত ছুটানোর চেষ্টা করে বললাম,

-“হাত ধরলেন কেন?”

-“আমার মন চেয়েছে তাই।”

-“হাত ছাড়ুন!”

-“ছাড়ব না।”

-“কেন ছাড়বেন না?আপনার কোন অধিকার নেই আমার হাত ধরার।”

-“আমার অধিকার আছে।”

আমি হাতটা ঝটকা দিয়ে ফেলে বললাম,

-“কিসের অধিকার আপনার?”

-“তুমি আমার উড বি ওয়াইফ!”(বাঁকা হেসে)

-“মানে!”

-“মানে আমাদের বিয়ে ঠিক হয়েছে। ”

-“দেখুন,আমার এসব ফাজলামো একদমই পছন্দ না।”

-“আমি ফাজলামো করছি না।আর কত অভিমান করে থাকবে অতসী।আমি কি একাই অপরাধ করেছি?তুমিও করেছ।তুমিও আমাকে অনেক জ্বালিয়েছ।”

-“ভালো হইছে।”(মুখ ফুলিয়ে)

-“এত রাগ,এত অভিমান।সব আমাকে দিয়ে দাও।”(হেসে)

আমি হাতের মধ্যে হাত ঘষছি।এমন সময় অনুভব করলাম আমার হাতে ভেজা কিছু লেগে আছে।আমি ভালো করে তাকিয়ে দেখোাম রক্ত।
আমার চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। আমি তৎক্ষনাৎ ওনার হাত টেনে দেখতে দেখতে বললাম,

-“এতটা কাটলো কি করে?”

-“ছাড়ো!তোমার আর কি!”

-“আ..আমার যাই হোক।দেখি..”

উনি হাতটা টেনে নিয়ে বললেন,

-“কিছু হয়নি।”

-“দেখতে দিন না!”

-“কিছু হয়নি।রাগে কাঁচের আয়নায় ঘুষি দিয়েছিলাম।”

আমি মুখে হাত দিয়ে হা হয়ে তাকিয়ে আছি। উনি মাথা চুলকে হালকা হাসলেন।ওনার চোখগুলো লাল হয়ে গেছে।আমি জোরে শ্বাস ছেড়ে বললাম,

-“আমি আপনাকে আরো আগে বিয়ে করব না।”

-“কেন?”

-“আপনি একটা পাগল।”

বলেই আমি চলে আসতে নিলাম।উনি আমাকে টেনে নিজের সাথে মিশিয়ে বললেন,

-“বিয়ে তোমাকে করতেই হবে অতসী।তাও আমাকেই।”(বাঁকা হেসে)

চলবে…

#প্রিয়_রোদ্দুর🤍
#লেখনীতে:অনুসা_রাত(ছদ্মনাম)
#পর্ব:৩০

দ্বীপ আর দিয়ার বিয়েটা মেনে নেয়ার পর আজ ১ সপ্তাহ পার হয়ে গেছে।ফুপিও ছেলে আর ছেলের বউ সমেত নিজের বাসায় চলে গেছে।কিন্তু ফুপি এখনো হয়ত দিয়াকে তেমনভাবে মেনে নিতে পারেনি।সেদিন রাতে ছাদে কথা হওয়ার পর আমার সাথে রোদ্দুর স্যারের দেখাও হয়নি আর কথাও হয়নি।আমার পরীক্ষা শেষ তাই ওনার কাছে পড়ার প্রশ্নই ওঠে না।তবে এখনো আমার মনে হয় সারাদিন কিছু তো একটা করিনি।কি করিনি?
ওইযে ঝগড়া! রোদ্দুর স্যারের সাথে ঝগড়া করিনি।
ওনাকে যতই মিস করি না কেন!আমি একটিবারের জন্য ওনাকে মেসেজ দিয়ে জিজ্ঞেস করিনি কিছু।
আর না উনি আমাকে করেছেন।ওনার শাস্তি হওয়া দরকার।কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ওনাকে শাস্তি দিতে গিয়ে আমি নিজেও কম শাস্তি পাচ্ছি নাহ!
আমার ভাবনার মাঝেই কাঁধে হাত রাখলো কেউ।
আমি বেলকনির বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাহিরের দিকে তাকিয়ে ছিলাম।সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে পিছনে তাকাতেই টিনাকে দেখতে পেলাম।
হাসি মুখে বললাম,

-“তুই?”

টিনা হেসে বললো,

-“হুম।চমকে দিলাম?”

আমি মাথা নাড়ালাম। তারপর আবারো বাহিরের দিকে তাকিয়ে বললাম,

-“নাহ।হঠাৎ তুই?বললিও না যে আসবি।”

-“তুই আমার মেসেজের উত্তর দিয়েছিস?”

-“ফোন ধরা হয় না।”

টিনা আমার গাল ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বললো,

-“হবে কি করে!আহারে!ডিপ্রেশনে গিয়ে আমার বান্ধবীটার মুখটা শুকিয়ে গেছে।”

আমি ওর হাতটা সরিয়ে মুখ ভেংচি কেটে বললাম,

-“মোটেও না।কিসের ডিপ্রেশন?”

-“তোর কি রোদ্দুর স্যারকে একটুও মনে পড়ছে না?”

আমি কিছু সময় চুপ করে রইলাম। বুকে পাথর রেখে বললাম,

-“ন..না।”

-“বেশি উল্টাপাল্টা কথা বলিস না।”

আমি মাথা নিচু করে রাখলাম।টিনা আবার আমার মুখটা তুলে বললো,

-“ইশশ রে!মুখটা শুকিয়ে গেছে।”

আমি ওর হাতটা সরিয়ে রুমের দিকে যেতে যেতে বললাম,

-“ছাড় তো।”

-“আহ্রে!এমন করে চোখ মুখ গর্তে ফেলে তুই আমার বিয়েতে নাচবি কেমনে!”

আমার পা জোড়া থমকে গেলো। খুশি হয়ে বললাম,

-“তোর বিয়ে!!”

টিনা হাসিমুখে আমার দিকে একটা কার্ড এগিয়ে দিয়ে বললো,

-“এই নে!বিয়ের কার্ড। ”

আমি কার্ডটা নিতে নিতে বললাম,

-“ও এম জি!আমার বেস্টির বিয়ে।অথচ আমিই জানি না!”

-“মেসেজ চেক করলে জানতি।”

-“বরের নাম কি রে!”

বলেই কার্ড খুলে দেখতে লাগলাম।
তারপর বললাম,

-“কেমন দেখতে রে?কি করে?”

-“দেখতে শুনতে তো ভালোই।কথাবার্তাও ভালো।”

পরক্ষণেই দুঃখী দুঃখী মুখ নিয়ে বললো,

-“আমার কপালে তো আর কোনো ক্রাশরে পাওয়া নাই।এজন্য এরেন্জ মেরেজ ই করব।আর তাছাড়া পোলাও তো সুন্দরই।বাবার বিজনেস আছে।বিজনেস সামলায়।আর নাম তো দেখলিই।”

-“সিয়াম হাহ!সুন্দর নাম।আমার সাথে দেখা করাবি না?”(দুষ্টু হেসে)

-“হুম করাব তো।আজকেই চল।”

-“আজকে?”

-“হ্যা।চল যাই।রেস্টুরেন্টে আসতে বলি ওকে।”

-“ওওওও….কে”(হেসে)

-“মজা নিস না তো।”(লজ্জা পেয়ে)

বলেই ফোন নিয়ে অন্য সাইডে চলে গেলো।আমার মনটা মুহূর্তের মধ্যে ফুরফুরে হয়ে গেলো।তাড়াতাড়ি করে আলমারির কাছে গিয়ে একটা ড্রেস বের করতেই পিছন থেকে টিনা বললো,

-“আরে কি করছিস তুই!”

আমি পিছনে ফিরে বললাম,

-“কেন?”

-“আমি তোর জন্য ড্রেস এনেছি।”

বলেই আমার দিকে একটা প্যাকেট এগিয়ে দিলো।আমি অবাক হলাম।ভ্রু কুঁচকে বললাম,

-“হঠাৎ ড্রেস আনতে গেলি কেন?”

টিনা জোরপূর্বক হেসে বললো,

-“আরে এমনি।আ..আমি আসলে গ..গেস করেছিলাম য..যে ত..তুই আমার স..সাথে যাবি।”

-“আর যদি না যেতাম?তুই কি করে এতটা গেস করলি!”(সন্দেহের চোখে)

-“হয়েছে আপনার জেরা করা?গোয়েন্দাগিরি হয়েছে? যান এখন গিয়ে রেডি হোন।”

আমি মুখ ভেংচি কেটে প্যাকেটটা নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে চলে গেলাম।
কিছু সময় পর ওয়াশরুম থেকে বের হলাম ড্রেস টা পড়ে।টিনা এগিয়ে এসে বললো,

-“তোর এখান থেকে কিছু মেকআপ নিয়ে সাজলাম। দেখ তো কেম…”

বলেই আটকে গেলো।আমি তখন ড্রেসটা ঠিক করছি।গাউন টা এত বড় যে আমি সামলাতেই পারছি না।ওকে চুপ করতে দেখে ওর দিকে তাকালাম।ও হা হয়ে তাকিয়ে আছে।

-“ওই কি দেহোস!”

টিনা বারকয়েক চোখের পলক ফেলে বললো,

-“দোস্ত তোকে তো অনেক সুন্দর লাগছে।ব্ল্যাক কালারটা তোর মধ্যে এত সুন্দর ফুটেছে।”

-“পাম দিস না তো।হেল্প কর।”

-“পাম না দোস্ত সত্যি।আজ তো জিজু শেষ!”

-“মানে?”(ভ্রু কুঁচকে)

-“না না কিছু না।বল না কি হেল্প করব!”

-“জিজু শেষ মানে কি বললি?”

-“আরে কিছু না আমার গোয়েন্দা বান্ধবী।”

-“আচ্ছা এদিকে এসে পিছনের চেইন টা লাগিয়ে দে।”

টিনা আমাকে হেল্প করলো।চুলগুলো কার্ল করে সুন্দর করে সেট করে দিলো।রেড কালারের লিপস্টিক এগিয়ে দিয়ে বললো,

-“এটা পড় দেখতে লাগবে।”

আমি লিপস্টিক টা পড়ে নিলাম।চুলে লাল রঙের গেলাপ গুঁজে দিচ্ছিলো টিনা।আমি অবাক হয়ে বললাম,

-“দোস্ত! আমাকে এমন ভাবে সাজাচ্ছিস যেন আজ আমার বার্থডে বা এঙ্গেজমেন্ট। এত বড় গাউন।এত সাজ!এগুলো নিয়ে আমি তোর বরের সাথে দেখা করতে যাব?আর তুইও তো কত সিম্পল সেজেছিস।আর আমি পুরো বউ সাজছি।কেন?”

-“আল্লাহ! এত প্রশ্ন! বড় কোনো রেস্টুরেন্টে যাব।আর তুই তো এমনিতেও এতদিন মনমরা হয়ে বসে ছিলি।আজ একটু সাজ মনমত।”

-“তোর কাজগুলো আমার মাথাতেই ঢুকছে না।আমাকে এত সাজাচ্ছিস কেন?”

টিনা কিছু বলতে যাবে তা আগেই আম্মু এসে ঢুকলো রুমে।আমাকে দেখে বললো,

-“মাশাল্লাহ! কত্ত সুন্দর লাগছে।”

-“থ্যাংক ইউ আম্মু।কিন্তু তুমি এত সেজে কই যাচ্ছো?”

-“আমাদের একটা বিয়ের দাওয়াত পড়ে গেলো। তাই সবাই মিলে যাচ্ছি।”

-“কই আমায় তো বলোনি আম্মু।”

-“ব..বলিনি?ক..ক.কই!বলেছিলাম তো।তুই ই তো বললি যাবি না।”

আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম। নির্বাক হয়ে চেয়ে রইলাম।তারপর বললাম,

-“আমি কখন বললাম!আর তুমি কখনই বা আস্ক করলে!”

-“আরে করেছি।তোরই খেয়াল নেই।আচ্ছা তুই বরং টিনার সাথেই ঘুরতে যা।বিয়েতে গিয়ে কিইবা হবে।
মানুষ শুধু তোর বিয়ের কথা জিজ্ঞেস করবে।প্যারা না?”

-“হু তা তো ঠিকই।”

-“আচ্ছা আমরা যাই তবে।”

-“সবাই যাচ্ছো?”

-“হ্যা।”

-“কিহ!”(অবাক হয়ে)

-“এত কথা না বলে রেডি হ।আর ঘর তালা মারতে ভুলিস না।গেলাম আমি।”

বলেই চলে গেলো।আমি আম্মুর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছি। আমার স্পষ্ট মনে আছে।আম্মু আমাকে বিয়ের কোনো কথা বলেনি।তাহলে মিথ্যা কেন বললো?নাকি আসলেই আমার মনে নেই কিছু। টিনা আমাকে চিমটি কেটে বললো,

-“একটু কাজল লাগা।একদম পারফেক্ট লাগবে।”

আমি কাজল লাগাতে ব্যস্ত হয়ে গেলাম।এতদিন পর বের হচ্ছি। মনটা একটু ফুরফুরে লাগছে।

গাড়ি থেকে নামতেই কেউ একজন আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল।আমি অবাক হয়ে মাথা বের করে তাকালাম।রোদ্দুর স্যার হাসি হাসি মুখ নিয়ে। তাকিয়ে আছেন। আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম,

-“আপনি?”

আমি টিনার দিকে তাকালাম। টিনা ওপর পাশ দিয়ে নেমে গেছে। রোদ্দুর স্যার বলে উঠলেন,

-“হাত দাও?”

-“একদমই না।”

উনি জোর করেই নিজের হাতে আমার হাত দিয়ে বের করলেন গাড়ি থেকে।আমি ওনার দিকে আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে আছি।কতদিন পরে দেখছি মনে হচ্ছে।বুকের ভিতরটা কাঁপছে।ওনার হাতের স্পর্শে আরো কেপে উঠলাম।ওনার পড়নে ব্ল্যাক শার্ট।আমার দিকে না তাকিয়েই হাত ধরে সামনের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। এটা জোন জায়গা!
আমি আশেপাশে তাকাচ্ছি। সাইডে তাকিয়ে দেখি আমাদের উপর সবাই ফুল ছিটিয়ে দিচ্ছে। আম্মু,আব্বু,ফুপি,দ্বীপ সবাই এখানে উপস্থিত।আন্টি, আংকেল, টিনা।মানে পরিবারের সবাই একসাথে।তারমানে আম্মু আমাকে মিথ্যা বলেছিল।আমি হাতটা যে ছাড়াব তারও উপায় নেই।
উনি আমাকে নিয়ে সামনে দাঁড় করালেন।চারিদিকে বাতাস বইছে।উনি হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন।আমার হাত ধরে বলতে লাগলেন,

-“অতসী?”

আমি মাথা তুলে তাকালাম ওনার দিকে।আশেপাশে কেউ নেই।সবাই হঠাৎ করে কোথায় চলে গেলো!
উনি বলতে লাগলেন,

-“সারাজীবন তোমার পাশে থাকতে চাই, তোমার হাত ধরে স্বপ্ন দেখতে চাই।তোমার চোখে হারিয়ে যেতে চাই, সারাজীবন তোমার সাথে থাকতে চাই।
তুমি আমার স্বপ্ন, আমার বাস্তবতা, তুমি ছাড়া আমার জীবন অসম্পূর্ণ।তোমার সাথে কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত, স্বর্গের মতো অনুভূতি।আমি জানি আমি ভুল করেছি।তোমায় অনেক কষ্ট দিয়েছি।তুমিও আমায় কম কষ্ট দাওনি অতসী।কিন্তু আমি চাই সব ভুলে নতুন করে সবটা শুরু করতে।সরি অতসী।আমার ভুলে জন্য আমায় মাফ করে দাও?”

আমি মাথা নিচু করে রইলাম। ওনার কথাগুলো আমার শরীরে বিঁধছে। কষ্ট হচ্ছে! আসলে অনেকটা কষ্ট দেয়া হয়ে গেছে ওনাকে।আসলেই কি আরো কষ্ট দেয়া উচিত?ভুল তো মানুষ মাত্রই হয়।আমার ভাবনার মাঝেই উনি বললেন,

-“You are my dream come true, I want to spend the rest of my life with you.I love you my love…will you marry me?”

হঠাৎ আশ পাশ থেকে সবাই বলতে লাগলো,

-“বলে দে অতসী।হ্যা বলে দে।আর রাগ করিস না।”

আমি অবাক হয়ে গেলাম।এরা আবার কই থেকে আসলো।এদিকে বড়দের সামনে লজ্জায় আমার গাল লাল হয়ে যাচ্ছে। উনি উত্তরের আশায় আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি চোখ বন্ধ করে হ্যা বোধক মাথা নাড়িয়ে বললাম,

-“লাভ ইউ ঠু!”

চারিদিক থেকে ফুলের পাপড়ি এসে পড়তে লাগলো আমাদের গায়ে।সবাই খুশিতে চেচামেচি করা শুরু করে দিয়েছে।উনি উঠে দাঁড়ালেন।আমি মুচকি হেসে জড়িয়ে ধরলাম ওনাকে।অবশেষে তবে সব অভিমানের ইতি ঘটলো।অতসী-রোদ্দুরের ভালোবাসা পূর্ণতা পাবে।খুব শীঘ্রই।

চলবে….

(ভুলক্রুটি মার্জনীয়!অবশ্যই ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।ভুল হলে সুশীল ভাষায় ধরিয়ে দেয়ার অনুরোধ রইলো।ধন্যবাদ ❤️)