প্রিয় সুখ পর্ব-১৬

0
6

প্রিয় সুখ-১৬
____________________
‘ আমি মিতুয়াকে বিয়ে করতে চাই খালা।’
আকস্মিক কথায় বাড়ি ভর্তি সবাই হতভম্ভ হয়ে পড়ে। শাহিন ভাই নির্বিকার ভঙ্গীতে সোফার মাঝে বসে আছেন। তার ডান পাশে তার মা। বাম পাশে বাবা বসে আছেন। সাথে কিছু লাঠিয়াল বাহিনীর লোক দাঁড়িয়ে আছে। নীহারিকা যখন দেখল সেই ডাইনি মহিলা বসে আছে সাথে সাথে ভয়ে একটু দমে গেল। মিতু আপুর পিছনে সে নিজেকে আড়াল করে প্রশ্ন করল,’ এই ডাইনি এখানে কি করছে মিতু আপু?’
মুখটা থমথমে গুমোট মেরে মিতু আপু পিছনে মুখ ফিরিয়ে বলল,’ আমি কি সর্বজান্তা?’
রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটে মানুষের চোখে। পৃথিবীর সবচেয়ে বিচিত্র জিনিস এই চোখ। খুব আনন্দিত হলে তা স্পষ্ট হয়ে উঠে চোখের পর্দায়। কান্না তো চোখেই ভাসে। রাগের আবির্ভাব চোখের কোনে পরিপূর্ন হয়ে উঠে মুহূর্তে মুহূর্তে। মিতু আপুর ঠিক তাই হচ্ছে। নীহারিকা লক্ষ করল। মিতু আপুর হাত জোড়া কম্পিত ভঙ্গীতে নড়েচড়ে উঠছে। ছোট খালামনির দিকে রগরগা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সে তাকিয়ে আছে। খালামনি কয়েক মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে রইল। পরে মুখ খুলে বললেন,’ এসব কি ধরণের মজা শাহিন। আমি বা আমরা কেউই এসব পছন্দ করছি না।’
শাহিন ভাই ঘাড় ত্যাড়া ভাবে বলল,’ মোটেও মজা না খালা। আমি সত্যি বিয়ে করতে চাই।’
মিতু আপুর নাক ফুলে উঠছে। হাত খাঁমচে ধরেছে ফাবিহা। এখানের বেশিরভাগ মানুষ কাহিনী বুঝতে অক্ষম। তাযিন আসে বই মুখে করে। তারপর শাহিনের দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচায়। শাহিন ভাই এক পলক দেখে দ্রুত চোখ নামায়। কি থেকে কি হয়েছে ভেবেই তার বুকের শব্দ তীব্র হচ্ছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে। তার মনে হচ্ছে মিতু যদি না করে দেয় এই দম বন্ধ হয়ে সে মরে যাবে।
তাযিনের পাশে ফিসফিস করে নীহারিকা প্রশ্ন করল,’ এসব আপনার প্ল্যান? তাই না?’
‘ নিঃসন্দেহে আপনার ভুল ধারণা।’
‘ ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলবেন না।’
‘ বলছি না। চুপ করে দেখুন। কি হচ্ছে। ‘
শাহিন ভাইয়ার মা এবার নরম গলায় বলল,’ দেখ তোর মেয়েকে বউ করতে চাইতাছি এইডাই অনেক। প্যাঁচাল মাইর্রা লাভ কি ক?’
বড়দের মাঝে একটা কথা কাঁটা কাঁটির ঝড় বয়ে যায়। একটা সময় মিতু আপু তীব্র গলা উঁচিয়ে বলে উঠে,’ আমি বিয়ে করছি না। শাহিন ভাইকে তো মরে গেলেও না। ভাই আপনি যাইতে পারেন এবার। বহুত নাটক হইল। রাইতে আমগো অনুষ্ঠান আছে। আপনাগো ফালতু নাটক দেখবার সময় নাই।’
তিনি রুম ছেড়ে চলে গেলেন। শাহিন ভাই আহত ক্ষতবিক্ষত দৃষ্টিতে সেদিকে তাকায়ে রইল। ছোট খালামনির শ্বশুড়ি এসেছেন বিয়ে উপলক্ষ্য। সবার মাঝ থেকে তিনি হঠাৎ বললেন,’ ওর কথায় কিছু মনে করিও না। একটা রগ বাঁকা মাইয়া। তুমি কি সত্যি বিয়া করবার চাও?’
নানু অনেক সময় নিয়ে এসব দেখছিল। কিছুই বলল না। শাহিন ভাই বিনিত ভঙ্গীতে বলল,’ খালা আপনি তো জানেন আমি মিতুয়াকে পছন্দ করি। আমি সত্যি তাকে বিয়ে করতে চাই। একদম সত্যি।’
চোখ জ্বালা করছে তার। কি অদ্ভুত মিতু আপুর দেওয়া কষ্ট নিতে পারে না কেন শাহিন ভাই? ভালোবাসার ব্যাপার গুলো বড্ড এলোমেলো হয়ে মাথায় স্থান করে নেয়। মিলিয়ে দেখতে বসলে নীহারিকা হারিয়ে যায় গভীরে।
একটা পর্যায়ে নীহারিকা বুঝতে পারল বাড়ি ভর্তি সবাই মিতু আপুর ইচ্ছেকে ঠেকরে দিয়ে দ্বিতীয় বারের মত তার অমতে বিয়ের জন্য হ্যাঁ বলে দিল। রাগে সে মায়ের প্রতি খুব বিরক্ত হয়ে বলল,’ মা তুমিও রাজি হচ্ছো?’
আফিয়া বিলকিস হেসে বললেন,’ তাছাড়া উপায় আছে। মেয়েটার তো বিয়ে দিতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা ডিভোর্সি হয়ে এত ভালো ছেলে কপালে জুটছে। তাও অবিবাহিত। আমরা কিছু বললে পরে দেখা যাবে এসব আমাদের গায়েই আসবে। আর তাছাড়া ছেলে ভাল। তুই বল ভাল না?’
‘ মিতু আপু রাজি না মা।’ মুখটা মলিন করে নিল নীহারিকা। মা মুখটা কেমন যেন করে বলল,’ সে কোন মেয়েই প্রথমে রাজি থাকে না। আর এই ছেলেকে তোর মিতু আপুই পছন্দ করত।’
‘ দেখ মা এসবই আমার পছন্দ না। তোমরা বাবা মারা কখনো ছেলেমেয়ের পছন্দ অপছন্দকে দাম দিতে চাও না। আর মানুষের পছন্দ বদলে যায় মা। সব সময় এক থাকে না। যখন ছিল পাত্তা দিলে না। যখন পছন্দ না তখন উঠে পড়ে লেগেছ ঘাড়ে চাপাতে। পৃথিবীর সবকিছুর মত ভালোবাসা বা পছন্দ সবই পরিবর্তনশীল মা।’
‘ ভালোবাসা একুই থাকে নীহু তুই বুঝবি না।’
কথাটা বলে ফাবিহা আনন্দিত হাসি হাসল। শুধু নীহারিকা আর মিতু আপুই খুশি হতে পারল না। বাকি সবাই উৎসবে ফেঁটে পড়ল।
______________________
সন্ধ্যার আমেজ চারপাশে এসে লাফিয়ে পড়ছে। এই সময়টা না কি ভাল না। গ্রামের মানুষের মতে এই সময় দ্রুত ঘরে প্রবেশ করা উঁচিৎ। ছাদে উঠা উঁচিৎ নয়। ভুত জিন এই সময় নিজেদের মত ঘুরে বেড়ায়। খপ করে ধরে তাদের দুনিয়ায় নিয়ে যেতে পারে। অথচ নীহারিকা এই ভরাট হয়ে আসা সন্ধ্যার বুকে আসন পেতে বসে চা খাচ্ছে। ছাদের পূর্ব দিকের জায়গায় বসে আছে সে। অন্যপাশে স্টেজ সাজানো হচ্ছে। বৃষ্টি হওয়াতে ছাদ পিচ্ছিল হয়ে আছে। সবুজ, কালসেটে শেওলার প্রলেপে ঢাকা ছাদের কোনায় কোনায় বাহারী সবজি গাছ। লতার মত বেয়ে উঠেছে ছাদের সিড়ি দেয়াল বেয়ে। এ পাশের গ্রীল নেই। যে কেউ পিছন থেকে ধাক্কা মারলে একে বারে পুকুরে পড়বে। সাঁতারু হওয়ায় তেমন ভয় করছে না নীহারিকার। দীর্ঘ লম্বা পা জোড়া নিচের দিকে ঝুলিয়ে বসে বসে সে ঘ্রাণ নিচ্ছে। হাসনাহেনার রাজ্য বলা চলে তার নানুর বাড়িকে। রাতে এই ফুলের তীব্র ঘ্রাণে শরীর শিরশির করে উঠে। ঘুম ভয়াবহ ভাল হয়। বাড়ির চারপাশে এই ফুলের গাছ। নানুর খুব প্রিয় একটি ফুল বলেই মনে হয় নীহারিকার। তা না হলে নিজের ঘরের আশেপাশে এত লাগাবে কেন। অবশ্য ক্ষতি হয়নি। সুন্দর ঘ্রানে মত্ত হচ্ছে তারা। চায়ের ঘ্রাণের সাথে হাসনাহেনার সতেজ সদ্য উড়ে আসা ঘ্রাণ মিশে নতুন স্বাদের সন্ধান দিচ্ছে। তার গ্রামটা খুব সুন্দর। একদম চায়ের চুমুকের মত এর স্বাদ অনেক সময় ধরে মনে বাস করে। জীবনে প্রথম তার এই প্রিয় নানুর বাড়িটি অপছন্দ হচ্ছে। ভাল লাগছে না। সে দ্রুত নিজের বাড়িতে যেতে চাইছে। এই বাড়ির সব কেমন যেন অদ্ভুত ঠেকছে তার কাছে। কেন? তাযিন নামক অবাধ্য অসভ্য প্রানীর জন্য? নীহারিকা দীর্ঘশ্বাস নেয়। আবার ভাবছে সে। অবাধ্য জিনিস মস্তিষ্কে ঘুরে বেশি। মনে মনে খুব ক্ষুদ্ধ সে তাযিনের প্রতি। এই জীবন দশায় সে এত রাগ আর কারও প্রতি প্রকাশ করেনি। হঠাৎ তাযিনের সাপের প্রতি ভীতির কথা মনে পড়তেই নীহারিকা নিজে নিজে হাসল। মনে মনে ঠোঁট নাড়িয়ে বলল,’ বেশ হয়েছে। বেয়াদপ ছেলের সাথে লতাপাতাও বেয়াদপি করে।’
ডান পাশে হাত দিতেই নীহারিকা চায়ের কাপ পেলো না। কিঞ্চিত বিরক্তি প্রকাশ করে সে পাশে তাকিয়ে লাফিয়ে উঠে। এক হাতের দীর্ঘ বড় থাবা দিয়ে বাহু চেপে ধরে তাযিন। একটুর জন্য পুকুরের মুখে পড়ার থেকে বেঁচে গিয়েছে সে। বুকে দ্রুত থুথু ছিটিয়ে ছিটকে দূরে সরে বসে নীহারিকা।
‘ আপনার সমস্যা কি? ভুতের মত এভাবে হুট করে আসেন কেন? আজব।’ কথা বলার সময় নীহারিকার ঠোঁট নড়ে। কম্পিত হয় কন্ঠস্বর। চোখ বার বার এলোমেলো উত্তেজিত হচ্ছে। তাযিন চোখ শক্ত করে তাকিয়ে রইল কিছু মুহূর্ত। তারপর সোজা মুখ করে বলল,’ হুট করে উড়ে এসেছি বলে আমার মনে হচ্ছে না। পা চালিয়ে এসেছি। এখনও পায়ে রেশ লেগে রয়েছে।’
তাযিনের জুতো নেই। নীহারিকা বীভৎস চোখে চেয়ে রইল। তাযিন অর্ধ খাওয়া চায়ের কাপে চুমুক বসিয়ে বলল,’ চা টা ভাল হয়েছে। ছোট আন্টি ভাল চা তৈরি করতে পারে। আই এম ইমপ্রেস।’
আশ্চর্য রকমের উচ্চ স্তরের অবাক নীহারিকা। কাপের দিকে সে অপলক তাকিয়ে রইল। তার ঠোঁটের জায়গা জুড়ে একটি বাষ্প সৃষ্টি হয়েছিল। লাল আভার আকাশের আলোর মাধ্যমে সে তা আবিষ্কার করল। তাযিনের ঠোঁট চায়ের সেই স্থান ছুঁয়ে চুমুক বসিয়ে কাপের গায়ে সুরসুরির সৃষ্টি করছে। থ হয়ে নীহারিকা রিনরিনে কন্ঠে বলল,’আমার মুখের চা ছিল!’
‘ সো? ‘
তাযিন ফুঁ দিয়ে দিয়ে চায়ের ধৌয়া উড়িয়ে দিচ্ছে। নীহারিকা সামনে তাকায়। ভ্রু দুটি এদিক সেদিক করে মনে মনে বলে,’এসব কি? এই ছেলের সমস্যাটা কোথায়? আমার পিছনে এসে কেন হাজির হয়? যখন কাছে যাই তাড়িয়ে দেয়। আমি দূরে সরে যেতে চাইলে নিজে এসে হাজির হয়। চাইটা কি?’
‘ আমি কাছে আসব এবং আমি দুরত্বের পাহাড় গড়ব। সে শুধু আমার উল্টো পথের সাথী হয়ে রইবে।’
মুখটা ফিরে তাকায় নীহারিকা। অবাকিত চোখে তাকিয়ে থাকে। চোখে প্রশ্ন। কথাটা কি তার জন্য? তাযিন নিজে নিজে হাসে। অদ্ভুত হাসি। নীহারিকা কথা বলে না। দু’জনে নীরব দর্শকের মত অপলক সামনে তাকিয়ে থাকে। পুকুরের পানির উপরে বাতাস বয়ে চলে। পানি ঢেউ খেলানো চুলের নেয় এঁকে বেঁকে উঠে। একটি মাছরাঙ্গা পাখির দেখা মিলে। ঠোঁটে তার পুঁটি মাছ। সূর্য হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে ডুব দেয়। দূর আকাশে রংধনুর দেখা মিলে। বিমোহিত চোখে তাকিয়ে থাকে নীহারিকা। রং রঙ্গা ব্যাপার গুলো তার ভাল লাগে না। কিন্তু রংধনু খুব প্রিয়। কারণ তার দাদুর খুব প্রিয় ছিল। দাদুর সাথে তার অবিশ্বাস্য মিল রয়েছে। যা মুহূর্তে মানুষকে চমকে দিতে বাধ্য। নীহারিকার চোখ মুখ খুশিতে নেচে উঠে। সাতটি রং এক সাথে ভেসে উঠে। কি ভয়ংকর সৌন্দর্যে মন্ডিত আকাশ! পাগল করা রূপ তার। স্রষ্টার প্রতিটি সৃষ্টিতেই রূপের ছড়াছড়ি।
‘ আপনার রংধনু পছন্দ?’
‘ খুব। দেখুন কত সুন্দর। ওহ আল্লাহ।’ হাত দু’টি মুষ্ঠি বদ্ধ করে থুতনির নিতে রাখে নীহারিকা। তার চোখ গুলো জ্বলজ্বল করে উঠে। মুখটার মুগ্ধতা হঠাৎ করে ফুঁটে উঠেছে। হঠাৎ রেগে সে বলল,’ আপনি যাবেন? না আমি?’
নীহারিকার এহেন কাণ্ডে তাযিন নিঃশব্দে হাসল। তাকে দারুন সুন্দর দেখাল। কিছু সময়ের জন্য নীহারিকা বিমুগ্ধকে আবিষ্কার করে ফেলে। মনটা বাজে ভাবে খারাপ হয়। উঠে যেতে নেয় সে। তাযিন হাত টেনে ধরে। ছোঁয়াটা অদ্ভুত। শরীরে একটা বাতাস প্রবাহের শক্তি রাখে নিজের মাঝে। সামান্য ছোঁয়ার এত শক্তি?
জিজ্ঞাসুক দৃষ্টি নীহারিকার। তাযিন হঠাৎ পাশ থেকে একটি প্লেট এগিয়ে দিয়ে গম্ভীর ভঙ্গীতে বলল,’ এটা আপনার জন্য।’
একটি ছোট গোল কাপকেক। চকলেটের একটি গোলার মত দেখতে সেটি। তার পাশে সাজানো মিষ্টি। চকলেট কেকের উপরে রসালো চকলেটের আবরণ। গড়িয়ে পড়ছে চকলেট কেকের গা থেকে। তার উপরে ছোট চকলেটের তৈরি কাঠি। চারকোনা, গোল নানা আকৃতির চকলেট। সবকিছুর উপরে একটি দু’টি হাসনাহেনা, পুদিনা পাতা। মিষ্টিটি নীহারিকার পরিচিত। মায়ের সবচেয়ে প্রিয় মিষ্টি রসগোল্লা। যার উপরে গোলাপের পাপড়ি। সাদা একটি পাপড়ি চিৎ হয়ে শুয়ে আছে মিষ্টির পিঠ জুড়ে। অসাধারণ। চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য। খাওয়ার চেয়ে দেখতে ইচ্ছে হবে বেশি।
‘ তাকিয়ে থাকবেন?’
নীহারিকার হুশ ফিরে। হাসলা হেসে সে বলল,’ আমি মিষ্টি পছন্দ করিনা। দুঃখিত।’
‘ টেস্ট খারাপ না। চেক করে দেখুন।’
নীহারিকা প্লেট হাতে তুলে নেয়। কৌতুহলি হয়ে প্রশ্ন করে,’ এসব আনতে আপনি বাজারে গিয়েছিলেন?’
‘ উহু। প্রয়োজনীয় জিনিস নিতে গিয়েছিলাম।’
নীহারিকা চামুচে কেক তুলে নেয়। ছোট অংশ মুখে পুড়তেই সে বিস্মৃত। অদ্ভুত স্বাদের এই কেক সে জীবনে খায়নি। কিভাবে এতটা মজার হতে পারে? ভেবেই সে বিস্মৃত বিমোহিত হয়ে তাযিনের দিকে তাকায়। তাযিনেক দৃষ্টি তখন আকাশের রংধনুতে। বেশ উৎকন্ঠা গলায় নীহারিকা বলল,’অসাধারণ। আমার জীবনে আমি এতটা বিপদজনক স্বাদের সন্ধান পাইনি। আপনি কোথায় পেয়েছেন এই কেক?’
তাযিন প্রথম কথাটা কানে তুলে নিয়ে বলল,’ স্বাদ বিপদজনক হয়?’
‘ হয়। মাত্রা অতিরিক্ত সবই বিপদজনক। বলুন কোথায় পেয়েছন?’
‘ আপনার নানুর বাড়িতেই তৈরি।’
বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে নীহারিকা বলল,’ আপনি তৈরি করেছেন?’
‘ না। তবে এরা দু’জন মিলে করেছে।’ তাযিন নিজের হাতের তালু তুলে ধরে। নীহারিকা আশ্চর্য হলো। মিহি কন্ঠে বলল,’ আপনি এত ভাল রান্না করতে পারেন? খেয়ে তো পুরাই প্রফেশনাল ফিলিংস আসছে।’
সে মিষ্টি মুখে পুরে নেয়। তার মনে হচ্ছে হাওয়াই মিঠাইয়ের মত সেই মিষ্টি মুখে একটা তান্ডব করেই মিলিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেই তান্ডবের রেশ রেখে যাচ্ছে দাঁতে দাঁতে। গালে গালে। জিভে জিভে। চোখ বুজে নীহারিকা ঘ্রাণ অনুভব করছে। গোলাপের একটা ঘ্রাণ। চোখ খুলে সে চমকিত হয়ে বলল,’ আপনি এখানে গোলাপ ব্যবহার করেছেন! ‘
তাযিন কথা বলল না। সে নিজের মত আকাশ দেখছে। খাওয়া থামিয়ে নীহারিকা বলল,’ আপনি হঠাৎ আমার জন্য এত বিপদজনক খাবার নিয়ে হাজির হয়েছেন কেন?’
তাযিন ঠোঁটজোড়া অনেক সময় নিয়ে চায়ের কাপের মুখে চেপে ধরে রাখে। তারপর সোজা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,’ আমি দুঃখিত। সকালের ব্যবহারের জন্য। সাথে বিকেলে ঘটে যাওয়া ঘটনার জন্য।’
নীহারিকার মনে পড়ে এই লোক তার সাথে কি কি করেছে। রাগ উঠাতে চাইল সে। কিন্তু রাগী ভাবের জন্মই হলো না। বিরক্ত হয়ে সে বলল,’ তাই আপনি ঘুষ দিতে এসেছেন?’
‘ না। দুঃখিত ফ্রীতে বলা উঁচিৎ নয় আমার নিয়মে। এটা আমার নিয়মের অংশ।’
‘ বাহ বাহ কি নিয়ম আপনার। ভাল ভাল। কিন্তু আপনি এত ভাল রান্না কিভাবে পারেন?’
‘ ছোট থেকেই আমি রান্না পছন্দ করি। আর একা থাকা হয়েছে অনেক। অবসর সময় আমি রান্না করে বিরক্তিকর সময় পার করতাম। যদিও এখন এটা আমার কাজের অংশ।’
‘ কিভাবে?’
‘ আব্বির রেস্টুরেন্ট রয়েছে দুটি। আমি মাঝে মাঝে সেখানে ঢুকে পড়ি। রান্না আমার মন খারাপের অংশ। দুঃখের সাথে জড়িত। তাই দুঃখিত প্রকাশের ভঙ্গীও রান্না।’
ছেলেটা খারাপ। হতে পারে খুব খারাপ। কিন্তু মাঝে মাঝে ধপ করে ভাল একটি দু’টি দিক জ্বলে উঠে। নীহারিকা মুগ্ধ করা হাসি হাসে। সে এই লোকটার প্রতি না চাইতেও মুগ্ধ। তাযিন প্লেট টেনে নেয়। চামুচ হাত থেকে ছাড়িয়ে নিজের হাতে আবদ্ধ করে। তিন আঙ্গুল দিয়ে প্যাঁচিয়ে সে কেক মিষ্টি এক সাথে তুলে নেয়। নীহারিকার দিকে নিচ থেকে চোখ উপরে তুলে তাকিয়ে বলল,’ হা করুণ।’
নীহারিকা বাধ্যের ন্যায় হা করে। তাযিন মুখের মাঝে দু’টি অংশই রেখে চামুচ বের করে নিয়ে আসে। ভ্রু কুঁচকিত করে এবার সে বলল,’ খেয়ে বলুন টেস্ট কেমন?’
নীহারিকা খেতে খেতে মন্ত্রমুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। উৎফুল্ল হয়ে সে বলল,’ ও মাই আল্লাহ। সিরিয়াসলি! এতটা মজাও খাবার হয়?’
‘ খেতে জানলেই খাবার মজা। তো স্যরি কি গ্রহনীয়?’
‘ নিজের কাজ দ্রুত হওয়া চাই। স্বার্থপর একটা।’ নীহারিকা বিড়বিড় করল। তাযিন হাসল। একটা সময় নীহারিকা বলল,’ আচ্ছা আচ্ছা মাফ করলাম। শুধু খাবারের জন্য। তাছাড়া আপনার মত অসভ্য মানুষকে আমি কখনো ক্ষমা করতাম না। আপনি কি জানেন আপনি কত বড় বেয়াদপ?’
‘ কত বড়?’ মাথা ভর্তি চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল সে।
‘ অনেক বড়। আপনি কিভাবে নিজের বাবার সমান একজনকে অসভ্য বলতে পেরেছেন? কিভাবে?’
তাযিন জবাব দিল না। কিছু সময় নীরবতায় ডুবে গেল। নীহারিকা প্রশ্ন করল,’ আপনি কি আমাকে চিনতে পেরেছেন? ‘
তাযিন হেসে বলল,’ না চিনার কি আছে।’
‘ আরে বিমুগ্ধ রূপে চিনতে পেরেছেন? না কি এখনও বলবেন চিনি না?’
তাযিন জবাবে শুধু হাসল। আগের বারের মত ডিরেক্ট নাকচ করে দিল না। সে কি তাহলে চিনেছে? নীহারিকা ভাবে। আরও ভাবে। মিষ্টি কেক খাওয়া বাদ দিয়ে সে নিজেকে নিয়ে তলিয়ে যায়। কথা বলে না। কিন্তু সে জানতে চায়।
‘ আপনার এই চোখ, এই ঠোঁট, এই নাক, এই মুখশ্রী আমি জন্মের পর থেকে দেখে এসেছি। আপনাকে ভুলা অসম্ভব।’ খুব ধীরে আস্তে করে বলল তাযিন। নীহারিকা শুধু অসম্ভব বাক্যই শুনতে পেল।
‘ কি অসম্ভব? আর কেনই বা অসম্ভব?’
‘ পরে কখনো বলব। আজ থাক।’
‘ পরে টরে না বাবা। আমি আর এই জীবনে আপনার সাথে দেখা করতে চাই না। আপনি হচ্ছেন আমার জীবনে সবচেয়ে বিচিত্র আর জঘন্য অধ্যায়। যা আমি আর উল্টেপাল্টে বিপদে পড়তে চাই না।’
‘ কেন?’
রেগে উঠে নীহারিকা। বেশ উত্তেজিত হয়ে সে চোখ লাল করে বলল,’ আপনি আমার সাথে কত বাজে ব্যবহার করেছেন কল্পনাও করতে পারিনি এসব আমি কখন। কেউ আমার সাথে এমন করেনি। তাড়িয়েও দিয়েছেন। কি কি সব করেছেন। ভাবলেই মাথা গরম হয়। আগুন জ্বলে। অসহ্য মানুষ আপনি।’
মেয়েটা বড্ড ঠোঁট কাঁটা। এত কম কথার মেয়ে তার সাথে এত কথা বলছে? তাযিন কিঞ্চিত ঝুঁকে বলল,’ এই অসহ্য মানুষটাই যদি আপনার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান গুরুত্বপূরণ অধ্যায় হয়ে উঠে?’
‘ অসম্ভব।’
‘ আপনার রাগ নিয়ন্ত্রণের বাহিরে। সব সময় এমন ক্ষীপ্তরানীর মুকুট পড়ে বসে থাকেন কেন? ‘
রাগ যেন আরও বেড়ে গেল নীহারিকার। হঠাৎ তার রাগে ঘিয়ের মত এসে পড়ল রূবাইদা। প্লেট সামনে থেকে ছো মনে নিয়ে সে খেতে খেতে বলল,’ তাযু তুমি যদি সাইক্রিয়াটিস্টের পেশা ছেড়ে একে বারে রান্নায় মন দেও তাহলে নিঃসন্দেহে তুমি সেরা সেফ হবে। আমি বিশ্বাস করি।’
‘ ওটা আমার ছিল রূবাইদা আপু।’
রূবাইদা হেসে বলল,’ তাতে কি? বানিয়েছে তো তায। ও যাই তৈরি করবে সবই আমার। খেতে ইচ্ছে হলে তাযু তোমাকে আবার তৈরি করে দিবে। এখন এটা আমি খাই।’
রাগে নীহারিকার শরীর কেঁপে উঠল। রূবাইদাকে তার সহ্য হয় না। কেন সে জানে না। ইদানিং তার কাউকেই সহ্য হচ্ছে না। নানুরবাড়িই ভাল লাগছে না। এই লোকের জন্য। দেখ কেমন হেসে হেসে তাকিয়ে আছে। থাকবেই তো বউ হবে। বিদেশি বান্দর বউ। যতসব। নীহারিকা উঠে দাঁড়ায়। রূবাইদা বলল,’ দাঁড়িয়ে পড়লে যে? বস?’
‘ আমার আপনাদের সঙ্গ ভাল লাগছে না। তাই চলে যাচ্ছি। ‘
‘ নিয়েছি বলে রাগ করলে? স্যরি। তুমিই নেও।’
রূবাইদা প্লেট এগিয়ে দিল। নীহারিকা জোর করে ঠোঁট মেলে বলল,’ তার প্রয়োজন নেই। আপনি খেয়ে উদ্ধার হন।আর অন্যের জিনিসে আমার তেমন ইন্টারেস্ট নেই।’
ধাক্কা দিয়ে মাঝ পুকুরে ফেলে দিতে ইচ্ছে হলো নীহারিকার। দু’জনকেই এক সাথে। শেষের কথায় তাযিনের কানের উপরীভাগ লাল বর্ণ ধারণ করে। মুখে অবাস্তব হাসি ঝুলিয়ে সে ভয়ংকর বাক্যাংশ মুখ দিয়ে বের করে বলল,’ আপনি তো দেখছি আমার হবু বউয়ের উপরে রেগে আগুন হচ্ছেন? ঝগড়া করতে চাইছেন মনে হচ্ছে?’
বাহ ভাই বাহ বউ! ওয়াও। ব্রেব। খুবই ভাল। নীহারিকা তীর্যক চোখে তাকিয়ে বলল,’ করতে চাইলে কি করবেন? তার পরিবর্তে আপনি আমার সাথে ঝগড়া করবেন?’
‘ মোটেও না। মেয়েদের ব্যাপারে মেয়েদের থাকাই ভাল। আমি বরং তাকে শিখিয়ে দিব কিভাবে ঝগড়া করতে হয়। বিদেশিরা তো বাংলার মেয়েদের মত চুল ছিড়াছিড়ি করতে পারে না।’ যথেষ্ট শান্ত ভাবে বলল তাযিন। নীহারিকা ক্রদ্ধে ফেঁটে পড়ে বলল,’ আপনার স্যরি গ্রহন করলাম না। ফিরিয়ে দিলাম। অসভ্য ইতর লোক একটা।
স্যতি যেন গায়ের উপরে ছুঁড়ে দিয়েছে সে। তাযিন অনুভব করছে একটা অদ্ভুত আনন্দ। মজা পাচ্ছে সে। হেসে সে তাকিয়ে থাকে অপলক। রূবাইদা বাম হাতের বাহু ছুঁয়ে দিতেই বিরক্ত চোখে তাযিন বলল,’ টাচ করার মানে কি?’
‘ ও সেই নীহারিকা না?’
তাযিন কিছু বলল না। রূবাইদার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। তার মনে পড়ে পুরোনো কথা। শব্দ করেই সে বলে উঠে,’ ও মাই গোড। সি ইজ ইউর.’
বাকি অংশ শেষ করার আগেই তাযিন বলল,’ ক্ষেপা মহিলা। নীহারিকা।’ তাযিন উঠে দাঁড়ায়। রূবাইদা থ হয়ে যায়। এই সে নীহারিকা? তার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না। তাযিন কাপের দিকে তাকিয়ে হাঁটে। চা তো কত আগেই শেষ। কিন্তু তার অনুভূতির রেশ এখনও জব্ধ করে রেখেছে কাপটিকে। এইসব অনুভূতি জঘণ্য হয়। কখনো ছাড়তে চায় না। সে ভাবছে কি করবে? পিছিয়ে আসবে? না এগিয়ে যাবে। যদি সে পিছিয়ে আসে তাহলে জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন জিনিস হারাতে হবে। যদি এগিয়ে যায় তাহলে শূন্য হৃদয় নিয়ে জীবন অতিবাহিত করতে হবে। হঠাৎ ভরাট হওয়া স্থানের শূন্যতা অবিশ্বাস্য কষ্ট দায়ক। ছুরির আঘাতের মত তীক্ষ্ন এর যন্ত্রণা। এক সাথে দু’টি জিনিস পাওয়া কি যায় না?
_______________________
ছাদ থেকে নামার পথে মুহিতার সাথে দেখা। নীহারিকাকে দেখেই মুহিতা আপু উল্টো পথে হাঁটা শুরু করে। নিচ থেকে একজন উপরের দিকে উঠার কারণে সে আর নামতে পারে না। না চাইতেও নীহারিকার মুখোমুখি হতে হয় তাকে। ভদ্রতার খাতিরে সে নিজেই বলল,’ কেমন আছ নীহারিকা?’
‘ ভাল। আপনি?’
‘ আমিও ভাল। তা উপরে কি করছিলে?’
দুজনের কথা খুবই অদ্ভুত। তারা যেন আজই পরিচিত হচ্ছে। কথার মাঝে হঠাৎ মুহিতা ভুল করে বসে। বলে বসে,’তোমাকে ওইদিন তাযিন নিতে গিয়েছিল। পেয়েছিল তোমাকে?’
‘ কোথা থেকে নিতে গিয়েছিল?’ কৌতুহলি কন্ঠে জানতে চাইল নীহারিকা।
‘ সেদিন রাতে। যেদিন আমরা হোটেল থেকে পালিয়ে ছিলাম। মজার কথা শুনো আমরা যখন হোটেল থেকে বের হয়েছিলাম তখন ভুল করে সামনের পথে হাঁটতে শুরু করলাম। সবাই অনেকটা যেতেই দেখলাম কিছু মাতাল বসে আছে। বসে বসে একজন আর একজনের দুঃখের গীত গাইছিল। যেমন একজনের বাবা মারা গেছে। মা কাজ করে খায়। চাচা খুব জঘন্য তার। বেচারার প্রেমিকাও ছিল। সে খুব মদ মাতাল হয়ে থাকে। তাই প্রেমিকা বিয়ে করবে না বলে দিয়েছে। সে আরও খারাপ হয়ে গেছে। বিমুগ্ধ তো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েই উল্টো পথে হাঁটতে বলে। অর্ধেক পথে এসে মনে পড়ে তোমার কথা। তখন তার রিয়েকশন যা হয়েছিল আমি এই জীবনে আগে কখনো দেখিনি। দৌড়ে গেল তোমাকে নিতে। তুমি তো সে পথেই হাঁটবে তা…।’
মুহিতা নিজের মুখ চেপে ধরে। সে সব বলে দিল? সর্বনাশ। তাযিন তাকে কুঁচি কুঁচি করবে। মুহিব তো ডিভোর্স দিয়েই ছাড়বে। আর কিছু না বলে সে পিছনে দৌড় দিতে নেয়। নীহারিকা ঠান্ডা হয়ে আসা কন্ঠে বলল,’ এই বিমুগ্ধ কারও অতীত বলতে পারত না। সে আগেই কোন ভাবে তা জেনে নিত তারপর এমন ভাবে সাজিয়ে বলত যাতে মনে হয় সে অতীত সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। দারুন তো।’
নীহারিকা হাসল। হঠাৎ তার মনে পড়ে মুহিতা তো বলেছে তাকে চিনে না। তাহলে জানলো কিভাবে? দৌড়ে পিছনে যায়। মুহিতা তখন পালাতে ব্যস্ত। নীহারিকা সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে। বলে ,’ আপনি তো আমাকে চিনেন না। তাহলে সেদিন রাতের কথা জানলেন কিভাবে?’
মুহিতা চুপ করে থাকে। শেষ। সে একেবারে শেষ।
‘ তার মানে আপনি নাটক করছিলেন? আপনারা সবাই চিনেও না চিনার ভান করছিলেন? কেন?’
রাগে টগবগ করছে নীহারিকার রক্ত। সে আবার ছাদের দিকে যেতে নেয়। মুহিতা বিপদের সংকেত পাওয়া মাত্র হাত টেনে ধরে বলল,’ আরে কই যাও?’
‘ উনাকে প্রশ্ন করতে। আমার সাথে নাটক করার সাহস হয় কিভাবে? আমাকে মিথ্যুক প্রমান করেছেন আপনারা। ভাবতে বাধ্য করেছেন সে রকম কোন রাতই ছিল না। পাগল পেয়েছেন? ‘
‘ কুল নীহারিকা। তুমি রেগে যাচ্ছ কেন?’
নীহারিকা কিছুই বলল না। শুধু তাকিয়ে রইল। তার কঠোর ভয়াবহ চাহনীতে মুহিতা আরও ঘাবড়ে গেল। সে বলল,’ আমি তো বলিনি যে তুমি আমাদের সাথে ছিলে। আমাদের একটা অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছি মাত্র। তুমি তো সিরিয়াস হয়ে গেলে।’
নীহারিকা উপহাসের হাসি হেসে বলল,’ তাই না কি? তা আপনাদের অভিজ্ঞতার সেই বিমুগ্ধের সাথে আমার সেই রাতেই দেখা হয়েছিল কেন? এবং তিনি সেই কথা গুলোই, যেগুলো কিছুক্ষণ আগে আপনি আমাকে বলেছেন ছেলেগুলোকে বলে বোকা বানিয়ে আমাকে বাঁচিয়েছিল। এবার বলুন আপনার অভিজ্ঞতায় আমি আছি কি না?
মুহিতা নিচু গলায় বলল,’ হ্যা তোমাকে আমি চিনি। মানে আমরা চিনি। বিমুগ্ধই নিষেধ করেছে যাতে তোমাকে এসব জানতে না দি।’
‘ এসব উনি বলেছে?’
‘ হুম।’
নীহারিকা কিছুই বলল না। মুহিতা বিনিত ভঙ্গিতে বলল,’ প্লিজ তুমি তাযিনকে এসব জানিও না। ও খুব রাগ করবে।’
‘ তাযিন আর বিমুগ্ধ একুই মানুষ না?’ নীহারিকা আশ্চর্য হলো। দু’জন এক। চেহারার দিকে শুধু। অথচ দু’জনের আচরণে আকাশ পাতাল তফাৎ। নামটাও ভিন্ন!
‘ না দু’জনেই ভিন্ন। তাযিন আলাদা বিমুগ্ধ আলাদা। এদের একের সাথে অপরের চরিত্রের কোন মিল নেই।’
‘ কি বলছেন এসব? চেহারা কিভাবে মিলল? বিমুগ্ধ কি উনার ভাই?’
মুহিতা সাথে সাথে বলল,’ হ্যাঁ বিমুগ্ধ তাযিন না। আলাদা। তুমি ভুলেও ওর কাছে বিমুগ্ধের কথা জানতে চাইবে না। খুব রেগে যাবে। একজন আর একজনকে পছন্দ করে না একদম। আমি যাই।’
মুহিতা দৌড়ে পালায়। নীহারিকা বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকে। কিছুসময় সে একুই স্থানে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার পর মনে মনে খুব খুশি হয়। তাযিন বিমুগ্ধ ভিন্ন মানুষ শুনেই তার ভালো লাগছে। তাযিনকে একদম পছন্দ না তার। তাযিনই যদি বিমুগ্ধ হত তাহলে তার খুব খারাপ লাগত। এতদিন তাযিনের সাথে সে কথা বলত বিমুগ্ধ ভেবেই। আজ থেকে সে এই খারাপ ছেলেটি থেকে দূরে থাকবে বলেই ঠিক করে মনে মনে। নীহারিকা খুব খুশি। খুশিতে তার নেচে গেয়ে বেড়াতে ইচ্ছে করছে। সে ভেবে পায় না বিমুগ্ধ ছেলেটা কেন তার এতটা প্রিয় হয়ে গিয়েছে। কোন ভাবে সে এই বিমুগ্ধের কোন এক মুগ্ধ দুনিয়ায় প্রবেশ করছে না তো? করলে করবে। নীহারিকার তাতে বিন্দুমাত্র দুঃখ নেই। সে এতটাই আনন্দিত যে পর পর মা আর শামা খালামনির গায়ের উপরে পড়েছে সে দু’বার। তাযিন বিমুগ্ধ নয়। এই একটা কথা তার মন প্রাণ আত্না সবকিছুকে শান্ত শীতল করে দিয়েছে। তার চোখের পর্দায় জায়গা করে নেয় হাস্যোউজ্জ্বল বিমুগ্ধ। কি সুন্দর করে ছেলেটা হাসে। কানে বাজে কথা গুলো। নীহারিকা নিজেই নিজেকে বলে,’ মিস ক্ষেপা মহিলা কি সব চিন্তা করছেন আপনি।’
তাযিনের সাথে তখনই বেসামাল ভাবে ধাক্কা লাগে। খুব বিরক্ত হয়েও নীহারিকা বিনীত ভঙ্গীতে বলল,’ দুঃখিত ভাইয়া। ভুল করে ধাক্কা লেগেছে ইচ্ছে করে নয়।’
তাযিন নীরব চক্ষু মেলে দেখে। নীহারিকার সাথে তার যতবার দেখা হয়েছে কথা হয়েছে সব কিছুর মাঝে আজই প্রথম বার এত সম্মান দেখিয়ে কথা বলেছে। এত ভদ্রতা তুলে ধরেছে। তাযিন লক্ষ্য করল নীহারিকা তার দিকে তাকিয়ে কথা বলেনি। সে নিচের দিকে বা উপরের দিকে চোখ ঘুরাতে ব্যস্ত ছিল। হলোটা কি? নীহারিকা মুচকি হাসি দেয়। আজ থেকে এই ব্যক্তির সাথে সে কখনো লাগবে না। অতিবসম্মানের সাথে কথা বলবে। খুব বাজে ব্যবহারেরও বিপরীতেও কিছু বলবে না। মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলবে না। চেহারা দেখলেই মনে হবে বিমুগ্ধ। চেহারা তো একুই। অপাততো তার আর কিছু চিন্তা মাথায় আসছে না।
‘ ভাইয়া’ কথাটা শুনেই তাযিনের সর্বাঙ্গ জ্বলে ছাই ছাই হয়ে গিয়েছে যেন। চক্ষুতে তা ঠিক প্রকাশিত হচ্ছে। তার মাঝে সম্মানিত স্থান পেয়ে সে খুবই অসন্তুষ্ট চোখে তাকিয়ে বিষয়টি বুঝতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এর মাঝেই হৈচৈ পড়ে যায়। সবাই মিতু আপুর রুমের দরজার কাছে উপস্থিত হতে বাধ্য হয়।
_______________
ভুলগুলো আল্লাহর দেওয়া মহান গুন ক্ষমার চোখে দেখবেন।
#চলবে…………
@হাফসা আলম……………..