প্রিয় সুখ পর্ব-১৭

0
5

প্রিয় সুখ-১৭
_____________________
রুমের দরজা বন্ধ। ভয় পেয়ে যায় সবাই। মিতু আপুকে জোরে জোরে ডাকতে শুরু করে। দরজা ধাক্কাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ফাবিহা নীহারিকার হাত চেপে ধরে ভীতু সংকীর্ণ কন্ঠে সে বলে উঠে,’ নীহু মিতু আপু তো দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। এখন কি হবে? ‘
নীহারিকাকে তেমন উত্তেজিত দেখাচ্ছে না। সে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে কিছু সময়। তারপর আদরী গলা ছেড়ে বলল,’ মিতু আপু দরজাটা খোল। ভিতরে যাব।’
কোন কথা ভিতর থেকে পাওয়া গেল না। ফাবিহা চোখ উল্টে বলল,’ ভাই যদি আপু নিজের ক্ষতি করে?’
‘ পাগলের প্রলাপ বন্ধ কর। আপু তুই দরজা খুলবি? না খুললে তোর সাথে কথা বন্ধ।’ একটু কঠিন গলায় বলল নীহারিকা।
ছোট খালামনি খুব কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,’ ফাইজলামু বন্ধ করে দরজা খোল মিতু। তা না হইলে তোর মামা দরজা ভাঙ্গবো ।’ মিতু আপু এবারও সাড়া শব্দ প্রদান করল না। ফাবিহার চোখ জ্বল জ্বল করে উঠে। তার প্রচন্ড ভয় করছে। আপু আবার কিছু করে বসবে না তো? তার এখনও মনে আছে আগের বছর তার কলেজের এক মেয়ে আত্নহত্যা করেছিল। যদিও সেটার প্রেক্ষাপট ভিন্ন। তখন সে প্রেমিকের সাথে বিয়ে হয়নি বলে আত্নহত্যা করেছিল। মিতু আপুর তো কপাল ভাল। তবুও তিনি কেন এমন করছে? ক্রোধে ফেঁটে পড়ে নীহারিকা। দরজায় খুব তীব্র আঘাত করে সে। মিতু আপুকে শাসিয়ে বলল,’ এবার দরজাই ভেঙ্গে দিব। ঢং করছ? রাগ দেখাছ? আপু তুই যানছ আমি রেগে গেলে কি হবে। দরজা দ্রুত খোল। তা না হলে সত্যি খুব খারাপ কিছু আছে।’
মিতু আপু খুব কেঁদেছে। তার গলা ভাঙ্গা শব্দ ভেসে আসে,’ আমাকে একা থাকতে দে প্লিজ নীহারিকা। আমি উল্টোপাল্টা কিছুই করব না। যা তোরা। সবাইকে নিয়ে যা। কেউ বিরক্ত করবে না আমাকে।’
নীহারিকা বুঝতে পারে। মিতু আপু খুবই দুঃখ পেয়েছে। পুরোনো কথা মনে পড়ছে হয় তো। তাই তো নীহু না বলে নীহারিকা ডেকেছে। তারা দু’জনেই সরে গেল। সাথে সবাইকে নিয়ে। মামার হলুদের অনুষ্ঠান হবে না বলেই মনে হচ্ছে। সবার কেমন যেন মন খারাপ।

জীবনটা গল্পের মত নয়। জীবনটা হচ্ছে বাস্তব দৃশ্যপট। এখানে একটানা সুখের দেখা যেমন নেই একুই ভাবে একটানা দুঃখের রয়েছে অনুপস্থিতি। তবে মিতু আপুর মতে সব হবে সমান সমান। যেমন সুখ হবে ৫০ ভাগ। দুঃখ হবে ৫০ ভাগ। যদি দুঃখটাই আশিভাগ হয় তাহলে তো জীবন চলে না। চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া নোন্তা পানি তিনি খুব জোড়পূ্র্বক মুছে নেয়। বার বার এভাবে মুছার ফল স্বরূপ তার গাল রক্তাক্ত হয়ে গিয়েছে। চোখের নিচে দুই একটি নখের তীক্ষ্ন দাগ। তিনি কাঁদছেন। পুরোনা ব্যথা তাজা হওয়ার কষ্ট সবাই বুঝে না। তিনি তো প্রেম বুঝতে চায় নি। ভালোবাসার অর্থ খুঁজে বেড়ানোর বিন্দুমাত্র ইচ্ছে তার ছিলো না। কিন্তু তবুও তাকে হাত ধরে কেউ এসব শিখিয়ে দূরত্বের পাহাড় গড়ে দিয়েছিল। জীবনের মড়ে এমন একজন মানুষের সাথে দেখা হয় যে হাতে ধরে ভালোবাসার মায়াজালের বর্ণনা করবে। সেই বর্ণনায় মিশে থাকবে বিমোহীত ভাব। যাতে ডুবে যেতে যেতে অনেক দূরে তলিয়ে যায় মানুষ। গভীর সমুদ্রে সাঁতার না পারা মানুষটা যখন কারো শক্ত ভরসার হাত ধরে ডুবতে শুরু করে অতল গহ্বরে ঠিক তখনই যদি হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে ডুবিয়ে দেওয়ার একটা প্রবল ইচ্ছে মুখে প্রকাশ না করে বুঝিয়ে দেয় তখনকার কড়া বিভৎস অনুভূতি অনুভব করার মত সূক্ষ্ম চিন্তা কারও মাথায় নেই। ঠিক ততক্ষণ আসবে না যতক্ষণ সেও একুই অনুভূতির গহ্বরে না পড়ছে। মিতু আপু ভাবতে থাকে। সেই সময়ের কথা। যখন তিনি নবস্বপ্নের জোয়ারে ভাসতে শুরু করেছিলেন। কেউ একজন তাকে নতুন বধূর স্বপ্নের মায়া খেলায় বেঁধেছিল। ঠিক সেই সময়টার কথাই ভাবছে মিতু আপু।
বাতাসে তখন প্রেমের বসন্ত। চারপাশে মোহনীয় ভালোবাসার স্তর। ভোরের শিশির তখনও ঘাসের বুকে আসন পেতে বসেছিল। মিতু আপুর পা ভিঁজে। পায়জামার নিচের অংশ ভিঁজে। শরীর হীম শীতের ঝাপ্টায় লেপ্টে রয়েছে। মাথার ওড়না মৃদু পল্লবের ন্যায় দুলে উঠে। থেকে থেকে কোকিল সুর। এত ভোরে কোকিল ডাকছে! তিনি যখন হাতটা নিচু করে নীল ফুলটি হাতে নিতে যাবে ঠিক তখন কানে এসে বাড়ি খেলো একটি পুরুষালী কন্ঠ,’ চোর না কি?’
মিতু আপু চমকে উঠে সামনে তাকায়। তখন তিনি বসা ভিঁজা ঘাসের উপরে। হাঁটু তার ভাজ করা।
‘ তুই কবে থেইক্কা চোরের পেশায় নামলি ক তো? এডার জন্যেই তো ভাবি আমগো ফুল যায় কই। বাবা গো তোর মত চোর যে ওই তল্লাটে থাহে আমরা তো কইবারই পারতাম না। যদি তুই আবার না আইতি।’
‘ আমি চোর নই।’ রগরগে কন্ঠস্বর। শাহিন ভাই শয়তানী হাসি হাসে। হাতটা ধরে খপ করে। গব্জি ডুবে যায় তালুর মাঝে। মিতু আপু নিজের হাত টেনে ধরে। ক্ষীপ্ত কন্ঠে বলে,’ আপনার সমস্যা কোথায়? আমার হাত ছাড়ুন। ফুল কি আপনার বাপের? ‘
‘ থাপড়ে দাঁত ফেল্লা দিমু। বাপ তুলে কথা কইতাছস তোর সাহস তো কম না। যা ভাগ।’
মিতু আপু ধমকে ভয় পেলেন। দুই মুঠো এক সাথে করে কিছু ফুল নিজের হাতের মাঝে নিয়ে নিলেন। তারপর উঠে এক দৌড়ের চেষ্টা করলেন। শাহিন ভাই হাতের বাহু পুনোরায় ধরে বললেন,’ দাঁড়া। কই যাইতাছস?’
‘ বাড়ি।’
‘ তুই এত ভোরে নৌকা পাইলি কই? দীঘির এপাশে আইলি কেমনে?’
‘ লাফাই লাফাই। এবার যেতে দেন।’
শাহিন ভাই হো হো করে হাসলে। তাকে ডাকাতের মত দেখতে লাগল। মসৃণ ত্বক হঠাৎ আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল তার। সেই প্রথম মিতু আপু অনুভব করে বুকে তীব্র একটা হাওয়া। যে হাওয়ার বেগে তছনছ হয়ে পড়ে সে। মনের মাঝে শুরু হয় একটি ঝড়। যার নাম ভালোবাসা। আবেগে ডুবে সে তখন বলল,’ আপনার হাসিটা তো খুব সুন্দর। একে বারে ডাকাতের মত।’
‘ ডাকাতের হাসি সুন্দর? তুই কখনও ডাকাত দেখছস?’
‘ অবশ্যই দেখেছি।’
ভ্রু মিশিয়ে দিল কপালের সাথে শাহিন ভাই। তাকে খুব আগ্রহীত দেখাল। বলল,’ সত্যি? কোথায় দেখেছিস? আর তুই এত টইটই করছ ক্যান? কখন কে তুলে নিয়া যাইব ঠিক আছে এসবের।’
‘ আর কেউ নিবে না। সেই ডাকাত ছাড়া। কারণ সে আমার মনকে ডাকাতি করে অলরেডি নিয়ে গিয়েছে।’
চোখ বড় বড় করে রাগে ফেঁটে পরে শাহিন ভাই। ক্রোধে তার শরীর কাঁপনি দিয়ে উঠে। হাতটা আরও কঠিন শক্ত করে তিনি উত্তপ্ত কন্ঠে বললেন,’ কার সাথে চলে এসব? আমি বুঝিনা মনে করছস? প্রেম করছ? হুম কে সে? বল দ্রুত।’
মিতু আপু ঘাড় ত্যাড়ার মত বললেন,’ না বলুম না। কি করবেন? ‘
‘ মিতুয়া ভালো হবে না বলে দিলাম। আমার সাথে লাগতে আসবি না। বল কে সে?’
‘ বললে কি হবে?’
‘ তোদের দুইজনকে মেরে মাটিতে পুঁতে দিব। এত সাহস তোর? এতো? কিভাবে তুই অন্য কারো প্রেমে পড়েছিস? কিভাবে? এটা অসম্ভব।’
‘ আমি কি বলেছি প্রেমে পড়েছি।’
‘ তুই কি মনে করেছিস কবিদের মত ঘুরিয়ে বললে আমি বুঝব না?’ উত্তেজিত হয়ে উঠে শাহিন ভাই। শীতের এই সকালে তিনি থরথর করে কাঁপছে। ঠিক যেমন বরফ পরা শীতে খালি গায়ে হাঁটলে হয়। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে তিনি কাঁপছেন। আবার ঘামছেন। দু’টোই সমান তালে তার শরীরে ভর করছে। মিতু আপু বুঝতে পারে তার বলা ছোট কথা উল্টো পথ ধরেছে। কথা কাটিয়ে তিনি বললেন,’আমি তো একবারও বলিনি প্রেমে পড়েছি। আপনারা ক বললে কলকাতা কেন ধরে নেন? আশ্চর্য।’
শাহিন ভাই ভয়াবহ রেগে গেলেন। হুশ হারিয়ে তিনি ভয়ংকর কাজ করে বসলেন। বাম হাত দিয়ে তিনি মিতু আপুর কোমড় পেঁচিয়ে ধরলেন লতার মত। চমকে উঠে মিতু আপু। বুঝতে একটু সময় নিয়ে দ্রুত সরে যেতে চান তিনি। শাহিন ভাই নির্বিকার ভঙ্গীতে কাছে টেনে নিলেন। অকম্মৎ এই কান্ডে মিতু আপু বাকরূদ্ধ। শাহিন ভাই মায়া মায়া চোখে তাকিয়ে বললেন,’ তোর মনে কে আছে মিতুয়া? আমারে ক?’
‘ আপনি এমন করছেন কেন? আমি তো মজা করছিলাম।’
মিতু আপু দ্রুত বললেন। চারপাশের কুয়াশা থেকে ধৌয়া উঠছে। বসন্তের একটা বাতাস এসে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে শীত। কিন্তু মিতু আপুর শীত করছে না। কারও গরম উত্তাপে তিনি জ্বলছে। প্রথম প্রেমের অনুভূতি ভিন্ন। একদম নেশালো। শাহিন আরও গভীরে এসে বললেন,’ শোন মিতুয়া তুই কিন্তু আমার। অন্যের দিকে তাকালে তোর চোখ তুলে নিব।’
শাহিন ভাই শুদ্ধ বলছে পর পর। তার মানে তিনি খুব রেগে আছেন। যখন খোশ মেজাজে থাকেন তখনই তিনি আনন্দের সাথে গ্রামীণ কথা বলেন। কি এমন বলল? সামান্য মজাই তো ছিল। মিতু আপুর খুব অদ্ভুত লাগল। শাহিন ভাই বেশ আবেগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকিয়ে থাকেন। জীবনে প্রথম বার মিতু আপুর মনে হলো শাহিন ভাইয়ের চোখের ভাষায় তার জন্য বড্ড বেশি মায়া দেখতে পাচ্ছেন তিনি। এক সমুদ্র আবেগে তার কালোর সাথে অল্প সোনালির মিশ্রনের চোখ দুটি ভাসছে। মিতু আপুর মনে হলো এই মানুষটার চোখের ভাষা ভারী সুন্দর। কি মায়া মায়া মুখভঙ্গী। গালে দাঁড়ি নেই। চিক্কণ গালে তার এক দুটি তিলের দেখা মেলে। গালের হাড় দুটি স্পর্ষ্ট চোখে ধরে। তার গাল ভাঙ্গা। জন্ম থেকেই তিনি এমন। কারণ একটু চিকনাই তিনি। গায়ে তার হলুদ রঙ্গের ঢোলা শার্ট। কেচকেইচ্চা (গ্রামীণ শব্দ) হলুদ রংটা মিতু আপুর জঘন্য লাগে। নাকটা বাজে ভাবে উঁচিয়ে তিনি বললেন,’ আপনি হলুদ শার্ট কেন পড়েছেন শাহিন ভাই? ‘
‘ হলুদের মত সুন্দর রং পৃথিবীতে আর দ্বিতীয় নেই। তুই এমন কইরা নাক ছিটকাইতেছস যেন এইডা দুনিয়ার খারাপ নোংরা কিছু।’
‘ অবশ্যই নোংরা। আপনি আর হলুদ পড়বেন না। ছিঃ কি বাজে রং। চোখে লাগে খুব। আর আপনার গায়ের রং সাদা বিলাইয়ের মত না। কালা ভুতের মত। চিন্তা করেন কালা ভূত যদি এমন হলুদ পড়ে ঘুরে বেড়ায় মানুষ তো বুকের ব্যামোতে মরে যাইব।’
মিতু আপুর এমন তাচ্ছিল্য ভাবে কালা কথাটা শুনে শাহিন ভাই ভ্রু কুঁচকালেন। কোমড়ে একটা চাপা ব্যথা। মিতু আপু অনুভব করে শাহিন ভাই তার কোমড়ে নিজের হাতের আঙ্গুল ডাবিয়ে দিচ্ছে। আর কিছু হোক বা না হোক হাতের তিন চারটি নয় পাঁচটি আঙ্গুলই যে বসে যাবে মিতু আপু বেশ টের পাচ্ছে। খুব কাঁদো কাঁদো হয়ে তিনি বললে,’জল্লাদের মত খামচাচ্ছেন ক্যান? হাত সরান কইতাছি। তা না হইলে কাইট্টা দিমু।’
‘ ওরে বাবা তুই তো দেখতাছি আমার মত কথা কইতাছস। কাহিনী কি?’
‘ শাহিন ভাই আমি সময় নষ্ট করতে পারব না। আমার স্কুলে যেতে হবে। তাই ছাড়ুন।’
‘ তোকে আমি এই জীবনে ছাড়ছি না মিতুয়া। ভুলেও ছাড়ছি না।’
শাহিন ভাই কোমড় ছাড়লেন। সরে দাঁড়ালেন। সাথে উচ্চবিলাসী হাসি দিয়ে আবার বললেন,’ তুই কাউরে পছন্দ করছ না তো?’
মিতু আপু ত্যাড়া হাসে। মজার মুডে বলে,’ আরে না। কারে পছন্দ করমু? আমার আশেপাশে কি সব সুন্দর পুরুষ ঘুরে না কি? সব তো কালা কালা ভুত ভুত।’
ঢুলে ঢুলে হাসতে শুরু করল মিতু আপু। শাহিন ভাইয়ের মেজাজ গরম। তিনি মোটেও কালা ভুত না। যথেষ্ট সুন্দর তিনি। গায়ের রংটা অবশ্য একটু চাপা। কিন্তু তিনি জানেন তার পিছনে কত মেয়ে পাগল। কত মেয়ে তাকে পছন্দ করে রোজ চিঠি পত্র লিখে। নিচের ঘরে তিনি যখন পড়তে বসেন তখন জানালা ভেদ করে উড়ে আসে প্রেম পত্র। কেউ লেখে ভালোবাসি। কেউ লেখে রানী হতে চাই আপনার রাজ্যের। কেউবা তার বর্ণনা করতে করতেই পাতা শেষ করে। আর এই মিতু তাকে অপমাণ করছে? রাগান্বিত হয়ে তিনি কঠিন স্বরে বললেন,’ থাপড়ে গাল লাল করে দিব। কই থেকে দেখলি আমারে কালা? আমি পর্যাপ্ত পরিমানে সুন্দর আছি। বেশি হলে তো টানাটানি পড়ে যাবে। এখনই যা অবস্থা।’
মিতু আপু চোখ ছোট করলেন। কৌতুহলি হয়ে প্রবল আগ্রহ নিয়ে বললেন,’ কি অবস্থা?’
শাহিন ভাই গর্বে ভরা বুকটা ফুলিয়ে বললেন,’ এখনই মেয়েরা আমারে নিয়া টানাটানি করে। তোর আমারে সুন্দর কওন লাগবো না। দিনে বিশ তিশটা এমনেই আমার রূপে পঞ্চমুখ হইয়া থাকে।’
মিতু আপু হিংস্রের মত তাকায়। তার খুব জ্বলছে। কোথায় ঠিক টের পেল না। শাহিন ভাই নিজের পাওয়া চিঠির মাঝের কিছু কিছু অংশ শুনাতে লাগল। মিতু আপু আরও তেজি হিংস্র দৃষ্টি ফেলতে শুরু করল। একটা সময় রেগে তিনি চলেই যেতে নিল। শাহিন ভাই যেন যা দেখতে যেয়ে ছিল তা দেখে নিল। বিগলীত হেসে তিনি অত্যন্ত সাবধানে মিতু আপুর কোমল হাত ধরলেন। রাগে থরথর করে কম্পনরত অবস্থা মিতু আপুর। হাত মুঁচড়ে তিনি প্রচন্ড তীব্র ভাবে নিজের হাত শরিয়ে নিল। শাহিন ভাই বিস্মৃত সুরে বলল,’ তোর এত জোড় গায়ে? যেন খুন করবি। নাউজুবিল্লাহ।’
মিতু আপু জবাব দিল না। শাহিন ভাই নরম গলায় প্রশ্ন ছুড়ে,’ তুই কি রাইগ্গা গেলি মিতুয়া?’
জবাব দিল না তিনি।
‘ ওমা রাগার মত কি কইলাম? শুন তোর লগে আমার কথা আছে। খাড়া কইতাছি।’
মিতু আপু হাঁটা রেখে রেগে দৌড় শুরু করে। শাহিন ভাই জোরে জোরে চেঁচায়। একটা সময় হাত ধরে ফেলে। মিতু আপু বলল,’ কথায় কথায় হাত ধরেন কেন?’
‘ তুই তো পালাইতে ব্যস্ত । ধরা লাগবো তো।’
‘ কেন? আমারে ধরে কি হবে? আপনি বরং পত্রপ্রেমিদের ধরেন। যান ভাগেন।’
শাহিন ভাই ভ্রুকুটি করে। কি ভেবে দারুন খুশি হন। তারপর দূবাঘাসের উপরে পড়ে থাকা ফুল গুলো কড়িয়ে নিতে শুরু করেন। রাজকীয় নীল রং তার শরীরে। মাঝে যেন এক টুকরো আকাশী রঙ্গের আকাশ। লুটিয়ে পড়ে আছে ঘাসের বুকে চিৎ হয়ে। শাহিন ভাই এক একটি খুঁজে নেয়। হাতের তালুতে ফুল নিয়ে তিনি ঘাসের উপরে আসন পেতে বসেন। পা দু’টি গোল করে ভাঁজ করেন। তারপর মিতু আপুকে ইশারা করে বলেন বসতে। তিনি শুনে না। নৌকা খুঁজে চোখ বুলিয়ে দীঘির দিকে। বহু দূরে একটা নৌকা দেখা যাচ্ছে। গমগমে কন্ঠে শাহিন ভাই চেঁচালেন,’ তুই বসবি? না কি ধাক্কা মেরে নিচে ফেলে দিব?’
মিতু আপু অনিচ্ছায় বসলেন। শাহিন ভাই পরম যত্নে তার কোলে তালুর ফুল ডেলে দিলেন। আপন মনে বলে উঠলেন,’ তুই কিন্তু আমার মিতুয়া। এইডা ভুলবি না।’
‘ আপনার হতে যাব কেন? একটা মানুষ কখনো অন্যের হয় না কি?’
শাহিন ভাই হাতের উপরে হাত রাখলেন। শান্ত বাতাসের নেয় রূপ নিয়ে তিনি বললেন,’ হয়। পৃথিবীর প্রতিটা মানুষের জন্য একজন করে আমার বলার মত হয়। তুই আমার কাছে তেমনই।’
মিতু আপুর চোখ চমকে উঠে। শাহিন ভাই জীবনের প্রথম প্রেমের সূচনা করে বসেন। হাতের পাঁচ আঙ্গুলের ভাঁজে আঙ্গুল পুরে মিশিয়ে নিয়ে বলে উঠেন,’ তুই ছাড়া আমার জীবনে কোন মেয়ে আমার বলতে নেই। এই জীবনে শুধু তুই আমার। ভোরের কুয়াশা সাক্ষী, দূরের আকাশ সাক্ষী, এই সবুজ ঘাস সাক্ষী তুই শুধুই আমার হবি মিতুয়া। শুধু আমার।’
‘ এটাকে কি ভালোবাসা বলে?’ মিতু আপুর ঝাপসা কন্ঠস্বর। শাহিন ভাই মুচকি হেসে শুধু বললেন,’ ভালোবাসা মানে আমি নিজেও বুঝি না। তোর যদি মনে হয় এটা ভালোবাসা তাইলে ধইরা নে এইডাই আমার ভালোবাসা।’
‘ আপনি আমাকে ভালোবাসেন? কবে থেকে? কখন থেকে? সময় বলেন? তারিখ বলেন? আল্লাহ আমার তো দম বন্ধ হয়ে আসছে শাহিন ভাই। জলদি বলেন।’
শাহিন ভাই পাগলের মত হাসলেন। মিতু আপুর ডান গালটা আলত ভাবে স্পর্শ করে দিতেই হীম শীত অনুভব করে মিতু আপু। শরীরের রোম রোম অদ্ভুত কিছু অনুভব করে। মজার ছলেই কি তিনি প্রেম পড়ে গেল? প্রেম এত দ্রুত হয়ে যায়? এত সহজ প্রেমে পড়া? হুট করেই নোটিশ বিহীন এসে হাজির হয়? কিভাবে সম্ভব?
বৃদ্ধা আঙ্গুল দিয়ে থুতনির পাশের হাড়টি মিশিয়ে দিতে দিতে শাহিন ভাই বলল,’ তুই আমার জীবনের প্রথম অনুভূতি। যার খোঁজ আমি কখন পেয়েছি নিজেও জানি না। শুধু জানি তোরে না দেখলে আমার দম বন্ধ হইয়া আসে। দম বন্ধ হওয়া জিনিস কত মূল্যবান তুই তো জানছ। তুই হইলি গিয়ে আমার অক্সিজেন। আমার আলো আধারের স্বপ্ন। ‘
হঠাৎ শাহিন ভাই উঠে পড়লেন। কেমন যেন করে দু’পাশে চাইলেন। তারপর সাবধানে বললেন,’ শুন মিতুয়া আমি ঢাকা চলে যাইতাছি। তুই কিন্তু ছেলেগো থেইক্কা দূরে থাকবি। তা না হলে এই দীঘিত তোর লাশ ভাসামু কইয়া দিলাম। দরকার হইলে নিজেরেও তোর লগে ভাসাই দিমু। মৃত্যুরে ডরা আর পোলাগো থেইক্কা দূরে থাক। এহন বাড়িত যা। আর এই যে এই সময় যা হইল সব বাড়িতে ডুকতে ডুকতে ভুইল্লা যাইবি। পড়া লেখা করবি ঠিক মত। আর হ্যাঁ ভুলেও যদি মঞ্জুর থেইক্কা শুনি তুই ভোরে দীঘিত আসছস তাহলে তোরে খুন কইরাই শ্বাস নিমু। যা বাড়িত যা। আর আইজকার কথা ভুইল্লা যাইবি কিন্তু।’
শাহিন ভাই দ্রুত হাঁটে। মিতু আপু বুঝতে পারে, উনি জানে মিতু আপু প্রতি ভোরে আসে। তার মানে উনিও আসে। কখনো সামনে আসে না। শুধু আজ এলো। কেন? চলে যাবে বলে? না কি যাওয়ার আগে নিজের মনের কথা বলে যাবে বলে? আচ্ছা উনি কি মঞ্জু ভাইকে মিতু আপুর খবর নিতে ঠিক করেছে? মঞ্জু ভাই সব সময় আশেপাশে ঘুরে গোয়ান্দার মত। মিতু আপু অদ্ভুত আবেশে হাসল। প্রেমময় হাসি। হঠাৎ চেঁচিয়ে বলল,’ শাহিন ভাই।’
শাহিন ভাই থেমে গেলেন। দূর থেকে ফিরে তাকালেন। ধৌঁয়ার মত কুয়াশা তার শরীরে জালের মত আঁছড়ে পড়ছে। ভ্রু বাঁকিয়ে বললেন তিনি,’ আবার কি হইছে? নৌকায় উইঠা যা জলদি।’
মিতু আপু অপরূপ হাসি হেসে বললেন,’ সব ভুইল্লা যামু? যা যা কইছেন?’
শাহিন ভাই গভীর চোখে তাকায়। মিতু আপু অনুভব করে সেটা। কিছুসময় তাকিয়ে থেকে তিনি উচ্চ স্বরে বলে উঠলেন,’ হ সব ভুইল্লা যাইবি। শুধু মনে রাখবি পোলাগো লগে কথা কইবি তো দীঘির জলে তোরে আমি টুকরা করে ভাসামু কইয়া দিলাম। টুকরা টুকরা কইরা কিন্তু।’
কুয়াশার মাঝে বিলিন হয়ে যায় শাহিন নামক মানুষটি। মিতু আপুর চোখ ঝাপসা হয়। বুকে ব্যথা হয় খুব। তিনি বাম হাত রাখে নিজের গালে। ওহ চোখ ভিঁজে উঠেছে। তিনি কেঁদে দিল? সর্বনাশ। নীহু ফাবিহা দেখলে ইজ্জ্বত যাবে। দীর্ঘ শ্বাস নেয় মিতু আপু। বিড়বিড় করে চাপা কন্ঠে বলে উঠেন,’ আমি তো শুধু কথা না সংসারও কইরা ফেলছি শাহিন ভাই। কই আপনি তো আমারে দীঘির জলে ভাসায় দিয়া মুক্তিদিলেন না?’
মিতু আপু উঠে দাঁড়ান। নিস্তব্ধ নিজেকে ছাড়িয়ে তিনি হাসেন। তার চোখ জ্বলজ্বল করে উঠে। তার চিন্তাভাবনা সে নিজেই ধরতে পারছে না।
_____________________
রুমটা গমগম করছে। সবাই কেমন চুপচাপ বসে আছে। তাযিন ভিতরে প্রবেশ করে দেখল তার রুমে শুধু অর্পন না আরও অনেকে রয়েছে। বলতে গেলে পুরো পল্টন। সে সন্দেহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কিছু সময়। তারপর ভিতরে প্রবেশ করতে করতে বলল,’ কি হয়েছে? সবাই মুখ ঝুলিয়ে বসে আছিস কেন?’
‘ কারণ ঘটনা গুলো মুখ ঝুলিয়ে বসে থাকার মতই।’ তিশা গোমড়া মুখটা আরও গোমড়া করে নেয়। তাযিন প্রথমে ভ্রুক্ষেপ করল না। সে জানে এদের মাথা সব সময় স্বাভাবিক থাকে না। এখনও হয় তো নতুন কিছু এঁকেছে। চেয়ার টেনে বসে তাযিন। তারপর তাকায় সবার দিকে। দু’জন নেই। কাহিনী কি? সে প্রশ্ন করে,’ তিশা মুহিত মুহিতা কই? ‘
তিশা এই প্রশ্নের অপেক্ষায় ছিল। জোড়ে জোড়ে চেঁচিয়ে বর্ণনা করার ভঙ্গীতে বলল,’ দু’জনের মাঝে কথা কাটাকাটি হয়েছে। বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে দু’জনেই।’
ভুলবশত তিশা ভেবেছিল তাযিন গুরুতর একটি চিৎকার প্রদান করবে। কিন্তু সে তেমন কিছুই করল না। অতিবমাত্রায় স্বাভাবিক থেকে সে বলল,’ ভাল করেছে। তোরা যাবি কবে? ‘
‘ আমরা যাব মানে কি? তুই নিয়ে এসেছিস তুই দিয়ে আসবি।’ তিশা বসে পড়ে বিছানায়। শান্তর অবস্থা বেশিই করুন। সে তার বাহুতে হাত বুলিয়ে কি যেন বিড়বিড় করে বলে। তাযিন মুচকি হেসে বলল,’ এটা সত্য নয়। আমি তোদের কাউকে আমার সাথে নিয়ে আসিনি। অর্পন বাদে। তোদের আমি আগেই বলেছি আমার সাথে আসবি না। তবুও তোরা জোর করে এসেছিস। তোদের জন্যেই অর্পনকেও নিয়ে আসতে হলো।’
তিশা ভেবে নেয় পূর্বের কথা। জোরপূর্বক হেসে সে বলল,’ হ্যাঁ আমরাই এসেছি। তুই তো গাড়িতে করে নিয়ে এসেছিস তাই বললাম। কি করতাম বল, নীহারিকাকে দেখতে এসেছি। আন্টি যখনই বলল লাফাইতে মন চাইল।’
কঠিন চোখে তাকায় তাযিন। তাকে দেখে ভয়ে চুপসে যায় তিশা। ভুল কোথায় হয়েছে ধরে সে বলল,’ গ্রাম দেখতে এসেছি হয়েছে। এখন কথা হচ্ছে শান্তকে নিয়ে।’
‘ বেশ তো আছে। ওকে নিয়ে তোকে কথা বলতে হচ্ছে কেন?’
‘ ও তোর বোনের প্রেমে পড়েছে। মানে খালাতো বোনের।’
‘ কি?’ কথাটা জোরেই বলল তাযিন। খালাতো বোন মানে তার মাথায় যেন নীহারিকাই ঘুরছে আপাততো। প্রচন্ড ক্রোধে তার চোখ লাল হয়ে উঠে। তবুও সে হেসে বলল,’ উনি কি পৃথিবীর একমাত্র নারী? যে সবার উনার পিছনেই পড়তে হবে?’
অর্পন একবার ফোন থেকে চোখ তুলে তাকায়। উস্কানি মুলক কথা বলে সে ,’ তাযিন তুই তো রেগে যাচ্ছিস। আমি তো জানি তোর হাসিতেও রাগ প্রকাশের ক্ষমতা আছে। প্রতিজ্ঞার কথা ভুলে যাচ্ছিস দোস্ত?’
অর্পন ভয় ভয় পাচ্ছে মত করে তাকায়। খুব ছোট করে নেয় নিজের শরীরকে। যেন সে তাযিনের ভয়ে কাঁপছে। টিটকারি বুঝতে পারে তাযিন। শুধু তাকায় একবার। অর্পন তার অনুভূতির তামা তামা করে ফেলবে এটা সে বেশ বুঝতে পারছে। টেবিল থেকে গ্লাস তুলে নেয় সে। মাথার চুল উপর থেকে গুঁছিয়ে নিয়ে শান্ত হয়ে বলল,’ নীহারিকা বাদে কেউ হলে বল।’
শান্ত অত্যন্ত বিরক্ত মুখে বলল,’ নীহারিকা হলে কি করবি?’
অর্পন চোখ মারে শান্তকে। তাযিনকে বিরক্ত করতে তার দারুন লাগছে। স্বাভাবিক কন্ঠে তাযিন বলল,’ কিছু করব না।’
‘ যখন কিছু করবিই না এত ভাবিস কেন? আর রূবাইদা এসব দেখছে। সে তোর সম্পর্কে আমার কাছে বলেছে। তুই না কি তার সাথে দুই মিনিটও কথা বলিস না। অথচ তোদের বিয়ে ঠিক। এসব কি তাযিন? ‘
‘ রূবাইদার সাথে আমার আগেই ডিল হয়েছে। আমার গার্লফ্রেন্ড থাকবে। আর আমি তাকে সময় দিতে পারব না। এসব জেনে সে রাজি হয়েছে এখন এসব কথা আসছে কোথা থেকে?’
‘ দেখ তাযিন তুই নিজেও জানিস নীহারিকা থেকে তোর দূরে থাকা উত্তম। তবুও তুই ইচ্ছে করে আশেপাশে থাকার বাহানা করছিস। যেটা উঁচিৎ নয়।’
‘ সেটা তোদের ভাবতে হবে না।’
‘ হবে। কারণ রূবাইদা আমার কাজিন।’
‘ আমি উনাকে বিয়েতে রাজি হতে নিষেধ করেছিলাম।’
‘ অফার তোদের পক্ষ থেকে এসেছে।’
‘ শান্ত লিমিট ক্রশ করবি না। আমি সত্যি বিরক্ত হচ্ছি।’
‘ এতে আমার কিছু করার নেই। এটা বন্ধ কর।’
‘ কোনটা?’
দু’জনের তর্ক বাড়ে। অর্পন তিশা বুঝতে পারে সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছে। তিশা বিছানা থেকে লাফিয়ে দ্রুত দরজা বন্ধ করে। যাতে কথা বাহিরে না যায়। তখনই রূবাইদা রুমে এসে হাজির। শান্ত চোখে একবার তাযিন তাকায়। তিশা রূবাইদাকে রুমে ডুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। শান্ত হাইপার হয়ে পড়ে। সে একটু বদমেজাজি। হুট হাট রাগ মাথায় তাণ্ডব করে। রূবাইদাকে দেখা মাত্র আগুন যেন আরও বেরে যায়। রাগান্বিত স্বরে সে বলে উঠে,’ রূব্রা তুমি তো আগে থেকে সব চুক্তি করে বসে আছ। তাহলে আমাদের মাঝে সমস্যা সৃষ্টি করছ কেন?’
রূবাইদা একটু অবাক হয়। তাযিন যথেষ্ট স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে বলল,’ আপনি তো নিজেই বলেছিলেন শুধু বিয়ে করতে চান। তাহলে এসব কি? শান্তর কাছে বিচার দিচ্ছেন?’ তাযিন ঠোঁট ডান পাশে ঝুলিয়ে হাসল। রূবাইদা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,’ কিন্তু এখন আমার ইগনোরনেস পছন্দ হচ্ছে না। স্যরি তায।’
‘ ওকে বিয়ে ভেঙ্গে দিন। আপনার পক্ষ থেকে ভাঙ্গলে কোন সমস্যা নেই।’
রূবাইদার যেন দম বন্ধ হয়ে আসল। মুখটার অবস্থা ভয়াবহ। দেখে মনে হচ্ছে এক মুঠো রক্ত কেউ মুখে ছড়িয়ে দিয়েছে। কণ্ঠ ভিজে উঠেছে তার। চিকন গলায় সে বলল,’এটা অসম্ভব।’
‘ কেন? কেন অসম্ভব? আমি বিয়ে ভাঙ্গতে পারব না। কিন্তু আপনি তো পারবেন? রূবাইদা আপনি আমাকে রাগিয়ে দিচ্ছেন। ‘
‘ কিছু করার নেই তায। আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই।’
‘ বাট হোয়াই?’
তাযিন হাতের গ্লাস ছুড়ে মারে। টেবিলের সব বই হাতের আঘাতে নিচে ফেলে দেয়। আকস্মিক কাণ্ডে সবাই ভড়াকায়। অর্পন দ্রুত হাত চেপে ধরে বলল,’ মাথা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে? ‘
তাযিন শ্বাস নেয়। ঘাড়ের লম্বা অংশে হাত বুলায়। চুল ঠিক করে। একটু হাঁটে। তারপর শান্ত ভাবে মুচকি হাসি ঝুলিয়ে বলে,’ রূবাইদা আপনি ছোট থেকে আমাকে চিনেন। এটাও জানেন যে আমার কত গুলো গার্লফ্রেন্ড ছিল। কারণ শান্ত নিশ্চুয়ই আপনাকে বলেছে। এবং আমি আপনাকে এটাও বলেছি আমার আরও গার্লফ্রেন্ড হবে। ভবিষ্যতে থাকবে। আমি নিজেকে বাদে কখনো জোর করে কাউকে সময় দিতে পছন্দ করিনা। আমাকে মিলাতে গিয়ে আপনি বিরক্ত হবেন। অসহ্য যন্ত্রনা হবে। তবুও আমাকে মিলাতে ব্যর্থ হবেন। সবচেয়ে বড় কথা আপনাকে আমি বিয়ে করতে চাই না। এক মিনিট সময় আমি আপনার পিছনে দিতে চাই না। এটা ভাল করে জানার পরেও আপনি কিভাবে বিয়েতে হ্যাঁ করে দিলেন? যখন করেই দিয়েছেন তখন এভাবে বিরক্ত করছেন কেন? আম্মির কাছে তো কখনো আব্বির কাছে। কখনো বা শান্তর কাছে বিচার দিতে হাজির হচ্ছেন কেন? এসব মোটেও ভাল নয়। আপনি জানেন।’
তাযিন চেয়ারে বসে পা নাচায়। অর্পনের দিকে তাকিয়ে বলে,’ নিচ থেকে বই গুলো তুলেদে অর্পন।’
রাগে গিজগিজ করে উঠে অর্পন। চোখ গরম করে সে বলল,’ চাকর মনে হয়?’
‘ তার থেকেও একটু বেশি মনে করতে চাই।’
‘ পড়ব না আমি তুলে দিতে। দেখি কি করছ তুই।’
‘ বেশি কিছুই করব না।’
তাযিন উঠে চেয়ার তুলে নেয়। অর্পন বুঝতে পারে এটা এখন ছুড়ে মারবে সে দ্রুত বই তুলে দেয়। এটা ছিল মাথা নষ্ট বলার শাস্তি। অর্পন তীব্র ক্ষোব প্রকাশ করে বলল,’আর থাকব না কালই চলে যাব।’
তাযিন ভ্রু নাচিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে হাসল। শান্ত খুবই চিন্তিত। তাকে দেখে তাযিন এবার বলল,’ তোর সমস্যা কোথায়? তুই যে শুধু তোর কাজিনের জন্য আমার সাথে লাগতে আসবি এটা মেনে নিতে পারছি না। মূল ঘটনা বল।’
তিশা এবার গোল করে বসে বলল,’ আমি বলি। আমি।’
সে হাত তুলে। যেন উপস্থিতির প্রমান দিচ্ছে। তাযিন রাজার মত করে বসে হাত সামনে এগিয়ে মৃদূ নাচিয়ে বলল,’ বল।’
‘ আসলে ও ফাবিহার প্রেমে পড়েছে। কিন্তু গতরাতেই খুব বাজে ভাবে তার কাছে অপমানিত হয়েছে। মন ভেঙ্গে গুড়াগুড়া। এর চেয়ে বড় দুঃখের কথা সে শান্তকে বলেছে তার সাথে যাতে আর কথা না বলে। এরচেয়েও বড় দুঃখের বিষয় শান্তর অনেক সময়ের পরিশ্রমের চিঠি না কি মেয়েটি গুম করে দিয়েছে।’
‘ কেমন চিঠি? জানতে চাইল তাযিন। তিশা বেশ উৎসাহের সাথে বলল,’ বাংলা চিঠি দোস্ত।’
তাযিন নিচের ঠোঁট দাঁতের সাহায্যে ভিতরে নিয়ে হাসল। বলল,’ শান্ত আর বাংলা চিঠি? ভাল। প্রেম মানুষের মাথা মুহূর্তে নষ্ট করার ক্ষমতা রাখে। তারপর বল।’
‘ তারপর আর কি শান্তবাবাজির মন খুবই খারাপ। এখন তিনি প্রেমে ব্যর্থ হয়ে সুইসাইড করার চিন্তা করছে। কিরে শান্ত চিন্তা করছিস না?’
‘ ধ্যাৎ।’ শান্ত হাত সরিয়ে দেয়। তিশা অবাক হয়ে বলল,’ তুই ধ্যাৎ বলাও শিখে নিলি?’
‘ তিশা থাপ্পড় খেতে না চাইলে চুপ যা।’
তাযিন সমাধান করার পরিবর্তে বলল,’ এই বাড়ির বেশিরভাগ মানুষ প্রেম বিদ্ধেষী। মিতুয়ার বিয়েতে রাজি হয়েছে কারণ এর পিছনে বড় কারণ আছে। তোর বিয়েতে হবে কি না আই ডোন্ট নো।’
‘ আমি বিয়ে করতেও চাই না। আমরা প্রেম করব। দু’জন দু’জনের সঙ্গে থাকব ব্যস।’
‘ এটা আমেরিকা নয়। বাংলাদেশ। মুখ সামলে কথা বল আমার বোন হয় সে। তোর সো কল্ড সাদা গার্লফ্রেন্ড নয়।’
শান্ত ভাষায় রাগের বহিঃপ্রকাশ লক্ষ করে শান্ত বুঝতে পারে সে ভুল বলেছে। আসলেই তো এটা বাংলাদেশ। লিভ টুগেদার এখানে সম্পূর্ন নিষেধ। দুঃখিত ভঙ্গীতে সে বলল,’ শুধু কথা বললেই হবে। আমরা সারা জীবন এক সাথে কথা বলব।’
তাযিন হাসল। সে জানে শান্ত বিয়েতে বিশ্বাস করে না। মনে প্রাণে বিয়ে নামক সম্পর্ককে ঘৃণা করে। তিশা বেশ রগরগা ভাব নিয়ে বলল,’ কথা বলাও হারাম এখানে বলদ। তোকে করলে বিয়েই করতে হবে। এটাই নিয়ম। হালাল সম্পর্ক।’
শান্ত মুহূর্তে নাক ছিটকে বলল,’ ইম্পসিবল। বিয়ে তো আমি কখনো করব না। মরে গেলেও না।’
‘ তাহলে ফাবিহাকে নিয়ে ভাবা বন্ধ। গাইস সব ঠিক কর। কাল আমরা রাতেই ব্যাক করব। আমার এক্সাম এবং জয়েনিং করার সময় খুব নিকটে।’
‘ কালই? তুই নীহারিকাকে কিছু বলবি না? ‘
কথাটা মুখ ফঁসকে বলে দিল তিশা। সর্বনাশ সে তো লক্ষ্যই করল না রূবাইদাকে। তাযিন বই সব গুঁছিয়ে নিতে নিতে বলল,’ উনাকে আমার কিছু বলার থাকবে কেন? সি ইজ মাই কাজিন। কাজিনের সাথে এত কিসের কথা।’
রূবাইদা সেই সব কথা কানেই নিল না। শুধু কোমল গলায় বলল,’ ইউ লাইক নীহারিকা?’
তাযিন তরিৎ গতিতে পিছনে ফিরে তাকায়। রূবাইদার চোখে চোখ পড়তেই রূবাইদা চোখ সরিয়ে নিল। এই চোখ দেখলেই তার শরীর ভয়ে শিথিল হয়ে পড়ে। তাযিন চোয়াল শক্ত করে হাসে। স্পর্ষ্ট তার রাগ হাসিতে প্রকাশ পাচ্ছে।
‘ আপনাকে আগেই বলা হয়েছে আমার পার্সোনাল ব্যাপারে কথা না বলতে।’
‘ সে তোমার পার্সোনাল কিছু?’
‘ অবশ্যই সে আমার ব্যক্তিগত।’
রূবাইদা তাজ্জব বনে যায়। বিস্মৃত হয়ে পরে তার সোনালী মুগ্ধ করা চোখ জোড়া। ব্যক্তিগত কথাটা সে মেনে নিতেই চাইল না। কিন্তু সে জানে এটা সত্য। বাংলাদেশের বুকে যেদিন সে পা দিয়েছিল সেদিনই জেনেছে। রূবাইদার মন খুন্ন হয়। তবুও সে বিয়ে করবে। একশত বার করবে। যতযাই হোক সে এই বিয়ে করেই ছাড়বে। তাযিন হেসে ফেলল। হঠাৎ হাসি ধরতে পারল না কেউ। হাসির ধরণ ভিন্ন। চিবিয়ে চিবিয়ে সে বলল,’ বিয়ে করলে আমি পরিবর্তন হব ভাবা আপনার বোকামির পরিচয় দিচ্ছে রূবাইদা। ‘
শান্ত রেগে বলল,’ তুমি যখন আগেই মেনে নিয়েছ সব তাহলে এখন বিরক্ত করছ কেন? যাও তো।’
‘ তাযের একশটা গার্লফ্রেন্ড থাকলেও আমার সমস্যা নেই। আমি আগেই বলেছি ব্রো।’
‘ তাহলে সমস্যা কোথায়? আমাকে কেন বলেছ?’
‘ তোমাকে আমি নীহারিকার কথা বলেছি। সবারটা ঠিক আছে নীহারিকা কেন আসছে? আমি বোকা নই ব্রো। নীহারিকা এসবের কিছুই যখন জানে না তখন তার আশেপাশে কি করছে তায? বলো? ছাদে কেন ছিলে তুমি? ওর জন্য খাবারও তৈরি করেছ? আমি ছোট থেকে শুনে এসেছি তুমি শুধু নিজের প্রিয় বা পছন্দের কারও জন্যেই খাবার তৈরি কর। তাহলে এটা কি? এসব কি? এসব চুক্তিতে ছিলো না।’
শক্ত ভাবে উত্তরে বলল তাযিন,’ ছিল। একশবার ছিল। উনার কথা সবার থেকে আলাদা। আপনাকে আগেই বলেছি উনাকে নিয়ে কিছু বলা যাবে না। যেহেতু আপনি জানতেন। আর সে কখনো আমার অপছন্দের মানুষ ছিল না। আমি কি করব তার কইফিয়ত আমি কাউকে দিতে পছন্দ করিনা। নিজেকেও না। আউট। আই সে আউট রূবাইদা।’
রূবাইদা দরজা খুলে হনহন করে বের হয়ে যায়। শান্ত কথা বলতে চায়। তাযিন রেগে সবাইকে বের হয়ে যেতে বলে। সবাই বের হয়ে যেতেই সে দরজা বন্ধ করে দেয়। অর্পন দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকে কিছু মুহূর্ত। তারপর শান্তকে বলল,’ নীহারিকাকে কেন টানছিস সবাই? তাযিন আগেই বলেছে সে তাকে চিনে না এবং আমরাও চিনি না। সম্পূর্ণ না চিনার মত করে থাকতে বলেছে। সেই শর্তে তোরা এখানে এসেছিস। তাহলে বার বার ওর কথা বলে ডিস্টার্ব কেন করছিস? ‘
‘ নীহারিকার কাছে ও নিজেই বার বার যাচ্ছে। সো এসব আমাদের কেন বলছিস তুই? ‘ তিশার ত্যাড়া কথায় অর্পন রেগে যায়। বলে,’ সেটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। তোরা মাঝে না পড়লেই ভাল হয়। আর ওর কাজিন হয়। কথা বলতেই পারে। আমি বলি তুই বলিস সবাই বলতে পারে ও বললে সমস্যা কি? তোরা ব্যাপারটাকে বেশি এলোমেলো করছিস।’
শান্ত মন খারাপ করে বলল,’ এটা উঁচিৎ হয়নি। আমরা জানি তাযিনের অবস্থা তাকে এভাবে নীহারিকার কথা বলে উত্তেজিত করে দেওয়া উঁচিৎ হয়নি।’
হঠাৎ তিশা আঁতকে উঠে বলল,’ এই ও যদি হাত পা কাঁটে বসে?’
অর্পন তিক্ত মেজাজে বলল,’ বেশ হবে। দোষ তোদের। ইডিয়েট।’
সোজা হেঁটে সে সামনের রুমে চলে যায়। হলুদের আয়োজন হচ্ছে ছোট করে। বিশাল আয়োজন করা হবে বলেও করা হচ্ছে না। অর্পনের সাথে মামার দেখা। তিনি বেশ খোশমেজাজে বললেন,’ কেমন সময় কাঁটছে অর্পন?’
সৌজন্যবোধ হাসি দিয়ে অর্পন বলল,’ ভাল মামা।’
‘ আরে তুমি তো গ্রামটা ঘুরেই দেখলে না চল আমার সাথে। বাজারে যামু তুমিও আসো।’
অর্পন মনে প্রাণে যেতে চাইছে না। তবুও কিছু করার নেই মামা জোর করে তাকে নিজের বাইকের পিছনে বসিয়ে দিল। মুখটা তার একদম রং বিহিন হয়ে পড়ে। গ্রাম তার অসহ্য লাগে। বিকৃত মুখে সে ভাবে কিভাবে বাঁচা যায়।

তাযিন মাত্রা অতিরিক্ত রেগে গেলে খুব হাঁটে। ফ্লোরে শুয়ে পড়ে। এটা তার আব্বি তাকে শিখিয়েছে। যখন খুব রাগ হবে তখন বসে পড়বে। আরও বেশি রাগ হলে শুয়ে পড়বে। হাঁটা হাঁটি করবে। নিজের সাথে কথা বলবে। পছন্দের মুহূর্ত গুলো বেশি বেশি মনে করবে। তাযিন নিচে শুয়ে মাথার উপরে হাত রাখে। চোখ বুজে সে ভাবতে শুরু করে। তার চোখের পর্দায় এসে বাড়ি খায় কোন এক আলোর দৃশ্যপট। হলুদ আলোকিত মুখশ্রী। সে উঠে বসে। নিজের চুল টানতে টানতে ভাবে, পৃথিবীতে কি আর কোন মেয়ে ছিল না? অভাব পড়েছে? ঘুরে ফিরে এই প্রান্ত থেকে ওই প্রান্তে দৌড়ে সে কি না একুই চোখে নিবদ্ধ হয়েছে। ভাগ্য তার এত জঘন্য!’ মাথা খাঁটিয়ে সে আরও ভাবে,’ এমন কিছু কি নেই যাতে সে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ না করেই জিতে যাবে।
_______________
ভুলগুলো আল্লাহর দেওয়া মহান গুন ক্ষমার চোখে দেখবেন।
#চলবে…………
@হাফসা আলম……………..