প্রিয় সুখ-২০
___________________
পরীক্ষা জিনিসটির সাথে একটি জাতি দুশমনি রয়েছে নীহারিকার। সে সবই পারে। এক কথায় সে টপারদের মাঝের একজন। কিন্তু পরীক্ষার সময় তার কি জানি হয়। সব ভুলে তার শুধু ঘুম পায়। এটা অদ্ভুত! কিভাবে একটা মানুষের পরীক্ষার মত সিরিয়াস মুহূর্তে ঘুমের মত নিরবতা এসে হানা দেয় তা বুঝা মুশকিল। যাই হোক তার সাথে এটা ঘটেই। এর ফলেই তার রেজাল্ট ভালো হতে হতে হয় না। ভার্সিটির বাহিরের অংশটা সুন্দর। পিছ ঢালা রাস্তার বুকে বৃষ্টি শুয়ে আছে। কালসেটে দেখাচ্ছে রং। তার উপরে কয়েকটি রাঁধাচূড়া লেপ্টে মিশে রয়েছে। একটি দু’ টি গর্তে পানি জমেছে। অনেকটা পথ হেঁটে যাত্রী ছাউনি। ছাত্র-ছাত্রীরা সখানেই ভীর করে। তাদের জমানো ভীর ঠেলতে ভালো লাগে না নীহারিকার। তার মন বলে এর চেয়েও উত্তম নিজে একটি ছাউনি ঘর তৈরি করে ফেলা। মেয়েদের জীবন বিচিত্র। এরা সব সময় সমান তালে এগিয়ে যেতে পারে না। যতই বলুক সমঅধিকার, তা হয় না। জীবনটাই এমন। ভির পূর্ণ জায়গা গুলো তো আরও কষ্টকর। কিছু ছেলেরা সুযোগে থাকে। গায়ে, হাতে, জামায় হাত বুলিয়ে কিসের এত বাহাদুর পুরুষ হয়ে উঠে বুঝতে পারে না সে। সে অবশ্য নারীবাদী নয়। তার মতে নারীদের স্থান পুরুষের উপরে। ফলে তাদের সমানে এসে নিজের সম্মান কমানোর মত বোকা সে নয়। আজ অনেকটা এমনই কিছু লিখে এসেছে সে খাতায়। উদ্ভট টাইপের। প্রশ্ন গুলো একটু কড়া ছিল। তবে দোষ তারই। পড়েনি ঠিক করে। নীহারিকা অন্যমনস্ক হয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়েছে মাত্র। গাড়িটির রং নীল। উড়ে এসে জুড়ে বসার মত করেই সে নীহারিকার পোশাকে কাঁদার পানি ছুড়ে দিল। একে পরীক্ষা তার নিজের মত হয়নি। তার উপরে এই বিপদটি নীহারিকার হজম করতে অসম্ভব কষ্ট হল। নিজের উপরে নিয়ন্ত্রণ রাখতে নীহারিকা দীর্ঘলম্বা শ্বাস নিয়ে নিচু হয়ে গেল। গাড়িতে নিশ্চয় কোন অসভ্য বসেছে। এটা ভাবতে ভাবতে নীহারিকা নিজের নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরল।
‘ এই যে, এই মেয়ে আমি তোমাকে ডাকছি। শুনতে পাচ্ছ? এই মামনী?’
গাড়িটি দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। ভিতরে কোন এক ভদ্র মহিলা খুব নম্র ভাষায় নীহারিকাকে আদর করে ডাকছে। ত্যাড়া নীহারিকা শুনেও না শুনার ভান ধরে পড়ে রইল। ড্রাইভার গাড়ি পিছনে নিয়ে আসতে গিয়ে তাকে আবার ভিঁজিয়ে দিল। নীহারিকা একটু খানি রাগী মেয়ে। এই জিনিসটি কখনো তার নিয়ন্ত্রণে থাকে না। তার মধ্যে একুই ভুল দু’ দু বার! দাঁতের সাথে দাঁত ঘষতে লাগল নীহারিকা। একটি সুন্দর কোমল স্নেহ ভরা কণ্ঠে মহিলাটি কাঁচ নামাতে নামাতে বলল,’ আমি দুঃখিত মা। আসলে সে খেয়াল করেনি।’
নীহারিকা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে আস্তে করে বলল,’ ইটস ওকে। আপনি যেতে পারেন মেম।’
মহিলাটি ব্যস্ত ভঙ্গীতে ডাক দিল,’ কামাল, এই কামাল আমাকে একটু বের করও তো।’
কামাল ছুটে আসল। বের হতে হতে তিনি প্রশ্ন করল, মুক্তা জাওয়াদের পছন্দের মেয়েটি না এই ভার্সিটিতেই পড়ে?’
মুক্তা ধরে ধরে নামালেন ভদ্র মহিলাকে। বিগলিত হেসে বলল,’ হ খালাম্মা। কিন্তু ভাইজান কইছে আপনি যাতে তার লগে দেহা না করেন। ভাবিজান বহুত ক্ষেপা মানুষ।’
চোখ গরম করে মহিলা বললেন,’ ভাবিজান আবার কি? বিয়ে তো হয়নি এখনো। তুই এভাবে ডাকঠিস কেন?’
মুক্তা চোখ মুখ কুঁচকে নিয়ে বলল,’ আর কইয়েন না খালাম্মা ভাইজান আমারে একদিন এমন ঝাড়ি দিলো। শুধু নাম ধরে কইছি হের লাইগা। তাই ভাবিজান কই ডাকি। ভাইজান বহুত খুশি হইয়া যায়।’ মেয়েটি বাম চোখ টিপ দিল। জাওয়াদ নামটি নীহারিকার পিছনে আঠার মত লেগে রয়েছে। মহিলাটির দিকে তাকাল সে। হুইল চেয়ার! উনি কি হাঁটতে পারে না? নীহারিকা খুব আহত চোখে তাকিয়ে স্বাগতীক্ত হয়ে ভাবল, জাওয়াদ বলেছে তার মা বেশির ভাগ সময় অসুস্থ থাকে। কারণ মনে হয় এটাই। মিষ্টি করে হেসে নীহারিকা ভদ্র মহিলার হাত ধরে বলল,’ দুঃখিত বলার কোন প্রয়োজন নেই আন্টি। আপনি যেতে পারেন। আমি কিছু মনে করিনি।’
সপ্রতিভ ধর্মী নারীরা প্রচন্ড ভয়াবহ হয়। জাওয়াদের মা অনেকটা তেমনই। তার নাম লীলাবতী। পরনে কটকটে লাল রঙ্গের কামিজ। চোখে সানগ্লাস। হাবভাব একটু ভয়ংকর। নীহারিকা পাশ কাঁটিয়ে যেতে নিতেই তিনি হাত টেনে ধরে বললেন,’ তোমাদের ক্লাসে নীহারিকা নামের কেউ পড়ে?’
‘ না তো। এই নামে বুঝি মানুষও হয়? এটা কোন নাম হলো।’ ভ্যাঙ্গমা করে বলল নীহারিকা। নিজের পরিচয় গোপন করতে বড্ড ইচ্ছে করছে তার। মহিলা চোখ রাঙ্গানী দিল চশমা খুলে। মুখে বললেন, না চিনলে বলবে চিনি না। নাম নিয়ে কথা বলতে বলেছে কে? এই কামাল একে কিছু টাকা দিয়ে দে। পোশাক খারাপ হয়ে গেছে ওর। আমিই খুঁজে নিব তাকে। আমার ছেলের মাথা পুরো খারাপ করে ছেড়েছে সে। তাকে তো খুঁজে বের করতেই হবে।’
‘ আপনার ছেলের মাথা আগে থেকেই খারাপ। কষ্ট করে আর করতে হবে না।’
কথাটা বলেই জিভ কাঁটল সে। লীলাবতী বুঝে নিলেন। এই মেয়েই নীহারিকা হবে বা তাকে চিনে। দ্রুত পা চালিয়ে নীহারিকা উত্তর না দিয়ে হাঁটতে লাগল। প্রসস্থ রাস্তা ধরে হাঁটছে সে। হঠাৎ গাড়ির শব্দে চমকে পিছনে তাকাল। কেউ একজন তার এক হাত চেপে টেনে নিচে ফেলে দিল। সব কিছু এত দ্রুত ঘটল যে নীহারিকা ঠাহর করে উঠতে পারল না। ধপ করে নিচে পড়ল সে। তার একটি পায়ের নিচে অন্যকারো শরীরের অংশের উপস্থিতি অনুভব হতেই সে ছিটকে দূরত্বে চলে আসে। মেয়েটির এলোমেলো কোকড়া চুল বিছানো মুখের সামনে। ব্যথায় কাতর কন্ঠে সে বলছে,’ সরে যাও প্লিজ। পায়ে লাগছে।’
নীহারিকা স্তব্ধ হয়ে রইল। সে তো আরও আগেই সরে গেছে। এখনও চেঁচাচ্ছে কেন? পরক্ষণেই সে ভাবল, মেয়েটি তাকে বাঁচিয়েছে। সে কি সব ভাবছে। দিন দিন খুব খারাপ মেয়েতে রূপ নিচ্ছে সে। হাতগুলো ধরে উঠাতে উঠাতে নীহারিকা দুঃখে ভারাক্রান্ত হয়ে বলল,’ স্যরি, স্যরি।’
মেয়েটি উঠতে উঠতে কয়েবার চেঁচাল। রাস্তায় বসেই সে নিজের ক্ষতস্থান দেখতে শুরু করল। নীহারিকা ব্যগ থেকে পানির বোতল বের করে বলল,’ খাবেন?’
চোখ বড় বড় করে তাকাল মেয়েটি। তাকে চেনা চেনা লাগছে। কিন্তু ধরতে পারছে না নীহারিকা। গলার কন্ঠ ভেঙ্গে ভেঙ্গে মেয়েটি বলল,’ তুমি আমাকে আপনি করে বলছ কেন? চিনতে পারছ না? আমি সাগরিকা।’
কিছু বললনা নীহারিকা। নামে মিল থাকলেই চিনতে হবে? বুঝতে চেষ্টা করল কিভাবে চিনে? মেয়েটি নিজে থেকেই বলল,’ তোমার ক্লাসমেট। তুমি সত্যি আশ্চর্য মেয়ে। ক্লাসে কারো সাথে মিশো না। তাদের কথা মনেও রাখ না। জামা পরিষ্কার করতে সাহায্য কর। আমার যেতে হবে।’
নীহারিকা জানে সে একটু আলাদা। কথা কম বলে। কারো সাথে মিশতে তেমন পছন্দ করে না। নিজে থেকেই সে দূরে থাকে। ক্লাসের অনেকে তার সাথে কথা বলতে আসলেও সে কথা বলে না। ফলে সবাই পিছনে তাকে নিয়ে উল্টোপাল্টা কথা বলে। এভাবে প্রায় তিন বছরের কাছাকাছি চলে এসেছে সে। এই মেয়ে তার ক্লাসমেট! অথচ সে চিনেও না। ভদ্রতার খাতিরে সে বলল,’ আমি স্যরি। আসলে কারো সাথে আমার জমে না ভালো।’
‘ না মিশলে জমবে কিভাবে? শুনো তোমাকে আর তুমি করে বলতে পারছি না। আমার ধারনা নিজের বড় কাউকে তুমি বলা ঠিক না। আমরা তো সমবয়সী। তুই করে চলবে?’
মনে মনে নীহারিকা কয়েক বার জপ করল, চলবে না। চলবেই না। মুখে আলগা হাসির রেখা মেখে সে বলল,’ চলবে। তুমি কোথায় যাবে আমাকে বলো আমি সিএনজি ঠিক করে দিব।’
মেয়েটি হঠাৎ করে অন্যকরম ভাবে বলল,’ কোন দরকার নেই।’
নীহারিকা দেখল মেয়েটির হাঁটু কেঁটেছে। হাত কেঁটেছে। মাথায়ও ব্যথা পেয়েছে সে। ব্যাপারটা খারাপ লাগল তার। নিজের জন্য সে কখনো অন্যকাউকে বিপদে ফেলতে চায় না। এটা তার নীতির বিরুদ্ধে। নীহারিকা জোরপূর্বক বলল,’ আমি তোমাকে দিয়ে আসব। বলো কথায় যাবে।’
‘ এই না। তুই নিজের ঘরে যা। আমাদের ক্লাসের সবচেয়ে ভদ্র এবং ছেলেদের পছন্দের মেয়ে হচ্ছিস তুই। আমার সাথে ঘুরে কাজ নেই।’
‘ তোমাকে কে বলেছে আমি ভদ্র? বা আমাকে ছেলেরা পছন্দ করে?’
মেয়েটি এবার নীহারিকা হাত ধরে বসল। বিরক্ত লাগলেও নীহারিকা হজম করে নিল।
‘ তোর তো ক্লাসে খবর থাকে না। আমরা সবই শুনি। তোর বাবা এখনও তোকে নিতে আসে। কত যত্ন করে তোকে। তার মাঝে সব রকমের আড্ডা থেকে বিরত থাকিস। ছেলেরা পিছনে বসে এটাই বলে যে বউ হলে নীহারিকার মত হওয়া উচিত। অনেকে তো তোর বিয়েও নিজের সাথে ঠিক করে রেখেছে। ভয়ে তোকে কেউ কিছু বলে না।’
‘ আমাকে ভয় পায় সবাই? ’ ঠোঁট উল্টে জানতে চাইল নীহারিকা। সাগরিকা ভয়াবহ সিরিয়াস হয়ে বলল,’ অবশ্যই ভয় পায়। আমি নিজেও পেতাম। যেহেতু আমি তোর জীবন বাঁচিয়েছি সে হিসেবে তুই আজ আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করবি না। তাই ইচ্ছে মত কথা বলে নিচ্ছি।’
মেয়েটি আঁকাবাঁকা দাঁতে হাসল। বাহ সবাই নীহারিকার সুযোগ নিচ্ছে আজ। আর বেশি কথা বলল না নীহারিকা। একটি সিএনজি ডেকে সে সাগরিকাকে বসিয়ে দিল। তারপর নিজেও বসল। নীহারিকাকে বসতে দেখে সাগরিকা আতঁকে উঠা গলায় বলল,’ তুই আমার সাথে যাবি?’
‘ এভাবে তো তুমি যেতে পারবে না। হসপিটালেও নিতে হবে। যেহেতু আমার জন্য হয়েছে আমি চিকিৎসার সম্পূর্ন খরচ দিব।’
দ্রুত মাথা ঝাঁকিয়ে সাগরিকা বলল,’ না না তুই আমার সাথে যেতে পারবি না।’
অবাক হয়ে নীহারিকা প্রশ্ন ছুড়ল,’ কেন? কোন সমস্যা?’
‘ অনেক বড় সমস্যা। আমি যেই জায়গায় যাচ্ছি সেখানে তুই যেতে পারবি না। পরিবার বাদে আজ পর্যন্ত আমি কখনো কাউকে নিয়ে যাইনি সেখানে।’
‘ ঠিক আছে তাহলে তুমি চিকিৎসার টাকা নিয়ে নেও আমি নেমে যাচ্ছি।’
বিমোহিত চোখে তাকিয়ে রইল সাগরিকা। মেয়েটিকে সে ভয়ংকর কিছু ভেবেছিল। সব সময় রাগী চোখে তাকানো মেয়েটি যে এতটা দয়ালু সে ভাবতে পারছে না। এই একটি মেয়ের সাথে কথা বলার খুব ইচ্ছে তাদের ক্লাসের মেয়েদের। খুব কম কথা বলে সে। বললেও সব সময় প্রয়োজনে। যেমন কারো খাতার প্রয়োজন হলে, কলমের প্রয়োজন হলে, বা পড়ার কিছু লাগলে। সাগরিকা স্টুডেন্ট হিসেবে খারাপ না। তবে নীহারিকার মত ভালোও না। এই অদ্ভুতুড়ে মেয়েটির সাথে কথা বলতে পেরে তার যতটা ভালো লাগছে তার পাশে বসে আরও বেশি ভালো লাগছে। গায়ে কি একটা ঘ্রাণ মেখেছে কে জানে? কিন্তু মোহনীয় গন্ধে তার নাক কান ঝাঁঝড়া হচ্ছে। নীহারিকা দ্রুত টাকা বের করে দিতে চাইল। সাগরিকা নিল না। উল্টো বলল,’ আমার বাবার চিকিৎসার টাকা আছে। তুই আমার সাথে যাবি?’
এবার নীহারিকা একটু চমকালো। সে চোখ বাঁকিয়ে তাকাল। সাগরিকা একটু সংকীর্ণ হয়ে বলল,’ এভাবে তাকাচ্ছিস কেন? আমি যেখানে যাব তোকেও নিয়ে যাব।’
‘ আমাকে?’ আঙ্গুল উঁচিয়ে বুকে তাক করে নিজেকে দেখাল সে। সাগরিকা চোখ নিভিয়ে দাঁত বের করে হাসল। নীহারিকা ঢোক গিলে গলা ভিঁজিয়ে বলল,’ তুমি তো কাউকে নিয়ে যাও না। আমাকে কেন নিচ্ছ?’
‘ কারণ আমার মনে হচ্ছে তুই ভালো মেয়ে।’
‘ হঠাৎ এমন অদ্ভুত জিনিস মনে হচ্ছে কেন?’
‘ জানি না। তোকে আমার ফ্রেন্ড বানাতে ইচ্ছে করছে। তুই বরং আমার সাথে ফ্রেন্ডশিপ কর।’
রহিত করে নীহারিকা সাথে সাথে উত্তর প্রদান করল,’ দুঃখিত। আমি কারো সাথে বন্ধুত্ব করি না। আমার ভালো লাগে না।’
সাগরিকার একটু অপমানিত অনুভব হল। সেটা খুব একটা জাহের না করে সে বলল,’ কেন? বন্ধুত্ব ভালো তো। তোরও থাকা উচিত। চলার পথে বন্ধু লাগে।’
‘ বন্ধুত্ব হওয়া উচিত এমন কারো সাথে যে তোমার সব গোপনীয়তা জানবে এবং লুকিয়ে রাখবে। এমন বন্ধু মানুষ খুব কম হতে পারে। এক কথায় হতেই পারে না। কারণ পৃথিবীতে সবার কাছে সব বলা যায় না। এবং সবাই সব গোপনও রাখতে পারে না। তাই আমি বন্ধুত্ব করতে পছন্দ করিনা।’
‘ তোর কোন বন্ধু নেই? কখনো ছিলোও না?’ উদ্বিগ্ন হয়ে সাগরিকা প্রশ্ন করল।’
‘ খুব ছোটবেলায় ছিল। এখন সে অনেক দূরে। বন্ধুত্বও তেমন নেই। সেহিসেবে আমার বন্ধু নেই।’ কুন্ঠারাহিত্য উত্তর দিল নীহারিকা।
সাগরিকার মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল। তার মনে হচ্ছে যেখানে সে যাচ্ছে সেখানে এই মেয়েকে রেখে আসলে কেমন হবে? কথাটা মাথায় ঘুরপাক খেতেই তার হাসি পেয়ে গেল। একটু অবাক হয়ে নীহারিকা বাহিরের দিকে চোখ ফিরিয়ে নিল। প্রশ্ন করা যেহেতু তার পছন্দ না তাই সে জানতে চাইলো না কেন হাসছে?
মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। সিএনজির শব্দের সাথে সাগরিকার কন্ঠের বেশ মিল পাচ্ছে নীহারিকা। মেয়েটা মাত্রা অতিরিক্ত কথা বলে। বাতাসের শব্দ পর্যন্ত শুনতে পাচ্ছে না সে। বিরক্তি নীহারিকার শরীরে হামাগুড়ি দিচ্ছে। যেভাবে সাগরিকার বকবক তাকে আশ্চর্য করছে ঠিক একুই ভাবে তার চুপ করে থাকাটা সাগরিকাকে করছে। নীহারিকা নিজের নেকাব খুলে দিল। বাতাসে তার মুখের সব ঘাম বরফে পরিণত হতে শুরু করল। সে চোখ বুঝে রইল। আজ সকালে ঘুম কম হয়েছে। রাতেও সে ঘুমায়নি। পড়েছিল। নীহারিকা লুকিয়ে পড়তে পছন্দ করে। সবার সামনে বা সবাইকে দেখিয়ে পড়ার রোগটি তার নেই। তাই ঘরের সব মানুষ ঘুমিয়ে পড়লে সে পড়ে। তার রীতিনীতি দুনিয়ার সাথে কম মিলে। তাই তার ভাই তাকে পাবনা ফেরত পাগল বলেও ডাকে।
সাগরিকা থেমে গেল। পাশে তাকাল। দেখল, যার সাথে সে কথা বলছিল মেয়েটি ঘুমচ্ছে। সাথে সাথে তার মেজাজ খারাপ হলো। একে এত চুপচাপ তার উপরে ঘুম। অসহ্য। কিছু সময় সে নিজেও ঘুমতে চাইল। কিন্তু পারল না। তার সত্য জেনে যাবে ভেবে সে উত্তেজিত। বার বার নীহারিকাকে দেখছে সে। এই মেয়েটি তার সাথে বসেছে? ও মাই গড! ক্লাসে গিয়ে সে সবাইকে বলবে সে এই অদ্ভুতের সাথে অনেক সময় কাঁটিয়েছে। সাগরিকা একটু ঝুঁকে তাকাল। চোখের পাঁপড়ির বড় বড় অংশ দেখে সে আরও চমকিত। হালকা হাতে সে টানতেই যাচ্ছিল। ভয়ে আর পাড়লো না। আজ প্রথম সে নীহারিকাকে দেখছে। আহামরি সুন্দর মেয়েটি নয়। তবে কি যেন একটি আলাদা আচ্ছাদনী আছে। যা মানুষকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম। তার ঠোঁট লাল হয়ে আছে। মোটা ভ্রু, চোখের সেপ অনেক সুন্দর করে বাঁকা চাঁদের মত হয়ে আছে। পাঁপড়ি গুলো উঠে উঠে আছে। গালে দুই একটি ছোট তিলের বসবাস। নাকটা নিচের দিকে বেঁকে গিয়েছে। গালে খুব ক্ষুদ্র লোম। ঠোঁট ছোট। চিকন। কপালে রক্ত! ও মেয়েটিও জখম হয়েছে। অথচ তার তেমন ভাবান্তরই হলো না। গায়ে কেমন শুকনো কাঁদা। নিশ্চয় পড়ে যাওয়ায় লেগেছে। না মেয়েটির রঙ্গের চেয়েও চেহারা বেশ সুন্দর। বিদ্যুৎ বেগে নীহারিকা চোখ খুলে ঝাটকি মেরে সাগরিকাকে সরিয়ে দিল। সাগরিকা মাথায় আবার ব্যথা পেল। চেঁচিয়ে উঠল তার কণ্ঠস্বর। নীহারিকা এবার স্যরি না বলে রেগে বলল,’ কি করছিলে তুমি?’
সাগরিকা দ্বিগুন চেঁচিয়ে বলল,’ আমি মেয়ে ছেলে নই। আমি তো তোকে দেখছিলাম। আগে কখনো দেখিনি তো তাই।’
‘ আমাকে কি দেখতে মানুষের মত নয়? এভাবে দেখার কি আছে? এই আমি বাড়ি যাব। তোমার সাথে যাচ্ছি না।’ নীহারিকা গাড়ি থামাতে বলল। সাগরিকা ঝড়ের গতিতে জড়িয়ে ধরে বলল,’ তুই রাগ করিস না। আমি তো এমনেই তাকিয়ে ছিলাম।’
নীহারিকা অনেকক্ষণ ছাড়াতে চাইল। সে তো আঠার মত ধরে রইল। এ তো মহা বিপদ! অধৈর্য্য গলায় নীহারিকা বলল,’ ঠিক আছে ছাড়। আমি রাগ করছি না। ছাড়।’
সাগরিকা বিগলিত হাসি হেসে ছাড়ল। নীহারিকা দেখল সিএনজি থেমেছে। নামার আগে সাগরিকা হাতটি ধরে নিজের হাতে রাখল। নীহারিকা যত দেখছে তত আশ্চর্য হচ্ছে। এই মেয়ের মাথা খারাপ না কি? সাগরিকা রিনরিনে গলায় বলল,’ দেখ তুই যে এখানে এসেছিস এটা কাউকে বলবি না। আর আজকের দিনের কথাও কাউকে বলবি না প্লিজ। ‘
‘ ওকে বলব না।’
বের হতে হতে নীহারিকা ভাবল কি এমন জিনিস এত গোপন? বের হতেই সাগরিকা নিজের হাসি মাখা মুখ নিয়ে আবার জড়িয়ে ধরল। এমন জাপটা জাপটিতে নীহারিকার দম ফুরাবে ফুরাবে ভাব। সে দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে বলল,’ তুমি আর যদি জড়িয়ে ধরেছ তো খবর আছে।’ কথা শেষ করতে করতে সামনে তাকাল নীহারিকা। প্রলয় যেন এখানেই? চোখ বড় বড় হয়ে উঠে তার। ঠোঁট হা হয়ে যায়। জিভ নাড়ানোর শক্তি ক্ষয় হয়। আনমনেই সে জানতে চায়,’ তুমি কি পাগল? ‘
সাগরিকা চেতে যাওয়া গলায় বলল,’ মানে?’
প্রবোদ দেওয়া গলায় নীহারিকা বলল,’ আমার আগেই মনে হয়েছিল তোমার মাথায় সমস্যা আছে। কিন্তু তুমি যে পাগল আমি জানতাম না।’
‘ মানে কি? আমি পাগল হতে যাব কেন? সিরিয়াসলি! তোর আমাকে এমন মনে হচ্ছে? আরে আমি পাগল হলে ভার্সিটিতে কিভাবে পড়ছি?’
মনে মনে শুধরালো নীহারিকা। কথা সত্য। আহ নীহারিকা তুই একটা গাঁধা। নিজের ভুলের জন্যে সে মুখের তেজ নিভিয়ে বলল,’ দুঃখিত।’
সাগরিকা বোধহয় একটু রাগ করেছে। কিছু না বলে সে সামনে হাঁটল। নীহারিকা বাধ্য হয়ে পিছনে পিছনে গিয়ে স্যরি বলল। এবার আবার জড়িয়ে ধরল নীহারিকাকে। এবার নীহারিকার গাঁ জ্বালা ভাব হলো না। তবুও সে অস্বস্তি অনুভব করল। সাগরিকা ভিতরে প্রবেশ করল। নীহারিকার প্রচুর ভীতি কাজ করছে। সাধারণত সে ভয় পায় না। কিন্তু পাগল দেখলে তার শরীর কাঁটা দেয়। সে খুব হরহর মুভি ভক্ত। সে হিসেবে একা অনেক মুভি সে দেখেছে। হসপিটালের চেয়েও মেন্টাল হসপিটালের ভুত গুলো ডেঞ্জারাস খুব। এটি মেন্টাল এসাইলাম। লম্বা বারান্দা। তার পাশ দিয়ে বেয়ে উপরে উঠেছে সিঁড়িগুলো। নীহারিকার পালাতে ইচ্ছে করছে। মেয়েটা পাগলাগারদে কেন এসেছে? আজব! সাগরিকার সাথে হাঁটতে হাঁটতে নীহারিকা আশেপাশে দু’তিনজন মানুষকে অদ্ভুত অস্বাভাবিক আচরণ করতে দেখল। ভয় পেয়ে সে প্রথম বারের মত সাগরিকার হাত ধরে বলল,’ তুই এখানে নিয়ে আসলি ক্যান?’ সাগরিকা এতটাই অবাক হলো যে ভাষা খুঁজে পেল না। নীহারিকা বুঝতেই পারল না সে কি বলল। তার ভয়ে হাড় কাঁপছে থরথর করে। হাতের তালুতে ঝিঁ ঝিঁ করছে। তাকে ঘামাচ্ছে। মুখের নেকাব খোলা। তবুও সে অনবরত ঘামছে। সাগরিকা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,’ তোর কি ভয় করছে? পাগল দেখলে ভয় করে?’
‘ অবশ্যই করে। করার মতই জায়গা। তুই ধরে বেঁধে পাগলাগারদে নিয়ে আসলি কেন?’
নীহারিকা খুবই ফ্রি ভাবে কথা বলছে। সাগরিকার ভালো লাগছে। সে আজ তার জীবনের অনেক বড় সত্য নীহারিকাকে বলবে। থমকে দাঁড়িয়ে সে বলল,’ তুই চলে যা নীহারিকা। তোর ভালো লাগবে না থাকতে।’
কথাটা শুনা মাত্র নীহারিকা দ্রুত হাঁটল। কিন্তু কয়েক পা গিয়ে সে ফিরে এসে বলল,’ তুমি কাঁদছ কেন?’
‘ তুই থেকে তুমিতে চলে গেলি কেন?’
‘ ওটা তো আমি টেনশনে বলে দিয়েছি। স্যরি।’
‘ তুই প্লিজ আমাকে তুই করেই বল। আমার ভালো লাগে। আমার আপ্পি আমাকে তুই করে ডাকত।’
নীহারিকা মাথা খাটাল। তবুও ধরতে পারল না এত ইমোশনাল হয়ে উঠার করনটা কি? এসাইলামে এসে তো মানুষ ভয় পাবে কিন্তু কান্না কাঁটি কেন করবে? আজব সব কিছু। সাগরিকা চোখ মুছতে মুছতে বলল,’ তুই পালা তো। বেশিক্ষণ থাকলে জাপ্টে ধরে রাখমু বলে দিলাম।’
নীহারিকা সাহস সঞ্চয় করে বলল,’ আমি বরং থাকি। চল দেখি কি আছে ভিতরে। ভুত টুত দেখার বহু দিনের সখ।’
সাগরিকা এক চিলতি হাসি ছুড়ে দিল। নীহারিকাও হাসল। মেয়েটি অনেক মায়াবী। ইশ মাত্র একঘন্টার মাঝে তার সাথে কারও এত ভালো সম্পর্ক হলো। সে শতভাগ নিশ্চিত এই মেয়ে ভালো। অনেক ভালো। ভালো না হলে আর যাই হোক তার সাথে তালমিলাতে পারত না। সাগরিকা নীহারিকাকে বেছে বেছে ভালো জায়গা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এই এসাইলামে খুব কম মানুষের ঢুকার অনুমতি আছে। মূল ফটকে সাগরিকা একটি কার্ড প্রদর্শন করল। সাথে সাথে তাকে দু’জন মহিলা এসে এগিয়ে নিয়ে গেল। নীহারিকা পাশে দাঁড়িয়ে এসব দেখছে। কি অপরিষ্কার। ঔষুধের গন্ধ। নীহারিকার শরীর ঘিনঘিন করে উঠল। দম বন্ধ হয়ে আসতে নিল। ‘ এত নোংরা জায়গায় মানুষ থাকে কিভাবে?’
‘ এটা তো অনেক পরিষ্কার। এর চেয়েও ভয়ংকর আছে।’
‘ কি?’ আতঁকে উঠল নীহারিকার কন্ঠনালী। সাগরিকা মিটমিটিয়ে হাসল। একটা জায়গায় থেমে বলল,’ আমার মা এবং বোন দু’জনেই এখানে থাকে। তাদের কি তুই পাগল বলবি? তাহলে আমার অনেক কষ্ট হবে।’
নীহারিকা তাজ্জব হয়ে গেল। আকাশ থেকে পড়ল যেন সে। তার চোখমুখ সব কিছু স্তব্ধ হয়ে রইল। নিজের কানকে কিছু সময়ের জন্য তার বিশ্বাস হলো না। সাগরিকা উৎসুক হয়ে তাকিয়ে রইল মুখের দিকে। নীহারিকা কি বলবে সে ভাবছে। কিন্তু নীহারিকা কিছুই বলল না। হঠাৎ রোদের মত সে স্বাভাবিক হয়ে বলল,’ চল তাহলে আজ আন্টি আর আপ্পির সাথে দেখা করব। আমার কোন বড় বোন নেই। তবে খালাতো বোন আছে। বড় বোন গুলো অনেক কিউট হয়।’
সাগরিকার শরীর বেয়ে শীতল হওয়ার ন্যায় বাতাস ছড়িয়ে পড়ল। সে নিজের সমস্ত আবেগ দিয়ে নীহারিকার দিকে তাকাল। মেয়েটি তার দেখা সবচেয়ে আশ্চর্যতম মেয়ে। সে যদি ছেলে হত এই মুহূর্তে প্রেমে পড়ে যেত। এই সহজ শান্ত চোখের চাহনীতে। সত্যি মেয়েটি পৃথিবীর বিখ্যাত সুন্দরী।
_______________
হসপিটালের দেয়াল জুড়ে সব লেখা। আজেবাজে লেখার আশেপাশে কিছু মূল্যবান উক্তি। দেখে বড় কারও উক্তি মনে হলেও এসব সাধারণ কেউ হয়ত লিখেছে। যেমন একটি উক্তি ছিল এমন,’ পৃথিবীকে ভালোবেসো না। নিজেকে বাসো। কাজে দিবে।’
পাশেই লিখা,’ পৃথিবীকে ভালোবেসে বাঁচার চেয়ে, নিজেকে ভালোবেসে মরা উত্তম।’
নীহারিকা এই লেখার মালিককে খুঁজতে চায়। সে জানতে চায় কেন এই উক্তির জন্ম দিয়েছে সে। কিন্তু এখানে শতকের কাছাকাছি মানুষ। কাকে রেখে কাকে প্রশ্ন করবে? মনে মনে নীহারিকার কাঁপনী ছুঁটে যাচ্ছে। মানষিক রোগীরা তার দিকে ভয়াবহ দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে। ছেলেদের পোশাক নীল। মেয়েদের সাদা নীল। ইউনিট ভিন্ন। একদম মুভির মত। অনেক নার্স রয়েছে। এত তো মনে হয় সাধারণ হসপিটালেও নেই। অনেক রুম। দেয়ালে দেয়ালে ছবি আঁকা। হঠাৎ পাশের একটি রুমে সে হাত তালির শব্দ শুনল। থমকে গেল পা। পিছনে ঘুরে তাকাল। কয়েকটি ছেলে বসে আছে। তাদের মাঝের কেউ খুব গল্প বাজি করছে। কি কি যেন বলছে। তার চেহারা দেখা মুশকিল। কিন্তু কন্ঠ খুব নিকটে শুনা যাচ্ছে। পরিচিত স্বর। বিশাল আকারের না হলেও মোটামুটি মাঝারি সাইজের রুমটিতে পাঁচ ছয়জন পুরুষের মাঝে এই একটি পুরুষালী কন্ঠই কেন নীহারিকার এত পরিচিত মনে হচ্ছে? সে এগিয়ে যেতে চাইল। হাত টেনে ধরল কেউ। একেই ভয়ে রয়েছে সে। হাতে ছোঁয়া পেতেই শিউরে উঠল। চেঁচাতে ইচ্ছে করল। নিজেকে ভীতু প্রমান করার বিন্দু মাত্র ইচ্ছে না থাকায় সে চেঁচাতে পারল না। ধীর গতিতে পিছনে তাকিয়ে তার অন্তর আত্না কেঁপে উঠল। এবার চিৎকারটা সে দিয়েই বসল। একজন মধ্য বয়সি নারী তার হাত ধরে টানাটানি করছে। নীহারিকার বীভৎস দৃষ্টি। পাগলাটে চুলে ভরা মাথা তার। নীল সেলোয়ার কামিজ গায়ে। নীহারিকা নিজেকে সামলাতে বারং বার চেষ্টা করে ব্যর্থ। তার হাত কাঁপছে। পা কাঁপছে। অতিরিক্ত প্রেসারে তার মাথা ঘুরাচ্ছে। সে এই মুহূর্তে নিচে পরল বলি। শুকনো গলায় সে ডাকল,’ সাগরিকা? সাগরিকা? তুমি কি এদিকেই আছ?’
সাগরিকা হড়বড়ানো চালিয়ে বহু পথ চলে গিয়েছে নিজে নিজে । ডাকটা কান ছুঁতে পারল না। মেয়েটি হলুদ দাঁতে হেসে বলল,’ তোর নামই রইমা না? আমার একমাত্র সতীন। তোরে আজকে আমি বাইন্ধা পিটামু। শালির ঝি শালি। আমার জামাইরে বশ করছ? তুই জানছ কত বছরের প্রেম আমাদের? পুরা সাত বছরের। তিন বছরের সংসার। মোট হইল দশ। দশ মানে বুঝছ?’
মেয়েটি নিজের হাতের পাঁচটি আঙ্গুল করে দশটি খুলে দেখাল। নীহারিকা এই সুযোগে সরে যেতে চাইল। কিন্তু বেশি দূর যেতে পারল না। তার গায়ে সদ্য ফ্লোর পরিষ্কার করার জন্য যে পানি নিয়ে আসা হয়েছে তা ছুড়ে মারা হল। নীহারিকা এসিড ছুড়ার মত চিৎকার করে ডাকল। বীভৎস রাগে অঙ্গ অঙ্গ জলে উঠল। ছুটে আসল অনেকে। মেয়েটি এবার পরিষ্কার করার লাঠিটি হাতে নিয়ে বাড়ি দিতে এগিয়ে আসল। দু’হাতে নিজের মুখ ঢেকে নিয়ে মৃদূ আর্তনাদ করে উঠল নীহারিকা। কিন্তু বাড়ি তার গায়ে পড়ল না। কেউ একজন নিজের শক্ত বাহুতে তার ছোট হয়ে আসা শরীরের দু’বাহু জড়িয়ে ধরল। ধাপে ধাপে ছটি বাড়ি তার শরীর ছুয়ে গেল। একজন বিকারগ্রস্ত মানুষের শক্তি কয়েকগুন বেশি হয়। তার মাঝে এই রোগীর ড্রাগের নেশা আছে। এখনও তা পুরোপুরি ছাড়ানো হয়নি। অল্প মাত্রায় দেওয়া হচ্ছে তাকে। ফলে লাঠি বাঁকা হয়ে গিয়েছে। তার কঠিন শক্তি দেখে সবাই হতভম্ভ হয়ে রইল। তিনচারজন নার্স মিলেও তাকে সামলাতে পারছে না। ছুটাছুটি লেগেই আছে। পিছন থেকে গগনবিদারী চিৎকার করে ডেকে উঠল সাগরিকা,’ নীহারিকা। আল্লাহ তুই ঠিক আছিস তো? স্যরি দোস্ত।’
বলতে বলতে এগিয়ে আসল সাগরিকা। চোখ খুলে নীহারিকা যখন ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল তখন একটা কড়া আতরের স্নিগ্ধ সুবাস তার শরীর মন জুড়িয়ে শীতল করে তুলল। সে আদো আদো চোখ খুলে দেখল একটি আকাশী শার্টের বোতাম গুলো। উপরের দুয়ের স্থানে তিনটি বোতাম খোলা। সাদাটে ভাব আঁকা সেই বুকের উপরে যা গলার দিকে লালছে। সাথে পরিহিত এপ্রোন দেখে সে বুঝে গেল এ কোন ডাক্তার হবে। পাগলও হতে পারে। যা নজিরা সে দেখল আত্না তার শরীর থেকে উড়ে গিয়ে আবার ফিরে এসেছে। শরীর তো ছেলেদের মনে হচ্ছে। নীহারিকা দ্রুত ছাড়াতে শুরু করে। হঠাৎ কেউ উচ্চ শব্দে হেসে উঠে বলল,’ আরে মিস ক্ষেপা মহিলা যে। রোগীদের সাথেও ক্ষেপে যাচ্ছেন? আজব পাবলিক তো। এখানে কেন এসেছেন? আমি আগেই জানতাম আপনি কোন একদিন এই হসপিটালে ভর্তি হবেন। কারণ মাথার যা অবস্থা দেখেছি। আপনি তো আগে থেকেই পাগলী।’
শেষের কথাটা আস্তে করে বলল ছেলেটি। নীহারিকা চকিতেই তাকাল। মুহূর্তের মাঝে সে চিনে নিল। এটা তো বিমুগ্ধ। আরে হ্যাঁ। কিন্তু এই মুহূর্তে কোন রোলে আছে সে? ভাবতে ভাবতেই সে বলল,’ বিমুগ্ধ না তাযিন?’
বিমুগ্ধ ঈষৎ বিরক্তির হাসি হেসে বলল,’ আমি বিমুগ্ধ। তাযিনটা কে? আমি চিনি না।’
‘ চিনেন না? ব্রিলিয়ান্ট।’ রেগে হাসল নীহারিকা। উপরের দিকে চোখ করে দেখল কয়েক বার।
সাথে সাথে একটি নার্স এসে দুজনকে দুরে সরিয়ে দিয়ে বলল,’ উনি ডা. তাযিন শাহামাত। স্যার আপনার পিঠ তো শেষ। আমার সাথে আসুন আমি মেডিসিন লাগিয়ে দিচ্ছি।’
বিমুগ্ধ কঠিক করে সেই নার্সকে বলল,’ মিস সানজু আপনাকে কেউ আমার নাম জিজ্ঞেস করেছে? আগবাড়িয়ে কথা বলতে বলেছে কে? এটা আমার পার্সোনাল মেটার। সবাই কাজে যাও।’
নীহারিকা ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,’ আপনি জীবনেও বদলাবেন না। এত মিথ্যা! এত মিথ্যা মানুষ বলে?’
‘ আমি বলি। আমাকে দেখতে কি মানুষ মনে হচ্ছে না? দেখুন আমার চার হাত পা আছে। আপনার সাথে সব মিলে শুধু বুদ্ধি বাদে। আপনি তো আপাদমস্তক গাঁধী।’ বিমুগ্ধ নীহারিকার কপালে টুপ করে একটি টোকা মেরে বসে। তারপর হাসতে হাসতে নিজের স্টেথোস্কোপ নিয়ে নীহারিকার বুকের কাছেই যাচ্ছিল। তরিৎ গতিতে সরে গিয়ে নীহারিকা বলল,’ আমি সুস্থ মানুষ। পাগল নই।’
মানসিক ভাবে আক্রান্ত মহিলা আরও ক্ষেপে গিয়ে বলল,’ তুমি দেখেছ আবার আমাকে পাগল বলেছে? তুমি তোমার দ্বিতীয় বউকে কিছু বলো। তা না হলে আজ তোমার একদিন কি আমার একদিন।’
নীহারিকা থ বনে গিয়ে আওড়াল,’ আপনি এই মহিলাকে বিয়ে করেছেন?’
‘ হ করছে তোর সমস্যা। আরে তুই হলি দ্বিতীয়। আমি প্রথম।’ গর্ভের সাথে আবার বলল মেয়েটি। তারপর তেড়ে আসল। বিমুগ্ধ নীহারিকাকে বাম হাতে সরিয়ে নিজের পিছনে নিয়ে গেল। খুব মিষ্টি করে হেসে হাত ধরল মেয়েটির। নীহারিকার চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম। এটা কি হচ্ছে? তার মস্তিষ্ক শূন্য শূন্য হয়ে আসছে। আদরের শহিত মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বিমুগ্ধ বলল,’ আমার ভালো বউ, রাগ করছেন কেন? এই ক্ষেপারানীকে আমি শায়েস্তা করব। আমার বউকে বিরক্ত করা। দাঁড়া।’
মেয়েটি শান্ত হয়ে গেল পানির মত। বিমুগ্ধ আদরী ভাব নিয়ে মাথায় হাত বুলাল। যেন পোষা প্রাণী। চুল ঠিক করে সরিয়ে দিল। মাথার চুল পিছনে কত সুন্দর করে যে বিছিয়ে দিল তা নীহারিকা চোখে বিশ্বাস করতে পারছে না। মুগ্ধকরা দৃশ্য ছিল এটি। একটা সময় মেয়েটির শরীরে ইনজেকশন পুশ করা হল। এবং তাকে নিজের রুমের দিকে নিয়ে গেল। বিমুগ্ধ ফিরে তাকাল। নীহারিকাকে আগ্রহের সাথে দেখল। তারপর হাসল। নীহারিকা নিস্তব্ধ হয়ে রইল। হঠাৎ আজ কেন দেখা হল? সে বলতে চাইল আপনি চলে যান সামনে থেকে। আপনাকে দেখলে আমার হৃদয় নামক সেই বিখ্যাত অবাধ্য যন্ত্রটি আমার নিয়ন্ত্রণ ছুটে পালায়। বার বার শব্দ করে। মনে হয় একটি করুন পরিণতি আমার সমনে ঘুরপাক খাচ্ছে। এই ঘ্রাণ, এই শব্দ, যেন দম বন্ধকর। অসহ্য যন্ত্রণা। উপরের ভাবটা যতটা মজবুত নীহারিকার, ভিতরের চিন্তাচেতনা নারকেলের ভিতরের অংশের মত নরম। যে অংশটাকে সে ঢেকে রাখতে চায় শক্ত আবরণ দিয়ে। কিন্তু এই মানুষটা তার বড্ড ক্ষতি করে। সামনে এসেই আগুণের তাপে ফেলে। নীহারিকা উল্টো পথে হাঁটা ধরে। এটা যে পাগলদের আস্তানা সে ক্ষনিকের জন্য ভুলতে বসে। সাগরিকা তার পিছনে দৌড়ে দৌড়ে যায়। বিমুগ্ধও কয়েক পলক তাকিয়ে থেকে সেও দৌড় লাগায়। এত দ্রুত টাইসের উপরে সে স্লিপ খেয়ে গেল যে পড়লে মাথা খন্ড খন্ড। নীহারিকার পিছনের লম্বা হেজাব টেনে ধরে সে। সাথে সাথে রেগে আগুন হয়ে নীহারিকা ফিরে তাকাল। মুখে তিতা করলার মত ভাষা যুক্ত করে বলল,’ সমস্যা কি? অসভ্যতা করছেন কেন?’
বিমুগ্ধ হেজাব ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল,’ আমি অসভ্য তাই অসভ্যতা করছি। আপনি তো ভালো মেয়ে তাহলে এমন লাফালাফি ঝাপাঝাপি করছেন কেন?’
ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল নীহারিকা। কথা বলা বেকার। সে বলতে চায় না। বিমুগ্ধ নিজের হাত দু’টি লম্বা করে আড়মোড় ভাঙ্গল। নীহারিকার নাকের সামনে দিয়ে সে হাত উঠিয়েছে। নাকে ব্যথা পেয়েছে সে। এবার আবার হাত উঠাতেই নীহারিকা মাথা পিছনে নিয়ে গেল। বিমুগ্ধ নিজের এপ্রোন খুলল। শার্টের বোতাম আর একটা খুলল। স্টেথোস্কোপ গলা থেকে নামাল। তারপর ছোঁ মেরে নীহারিকার ভিঁজা হাতটা উপরে তুলে তাতে সব ঝুঁলিয়ে দিল। বিমুগ্ধের এহেন কান্ডে নীহারিকা সহ সবাই বিস্মৃত। সাগরিকা তাদের কান্ড দেখে এটা বুঝল তারা পূর্ব পরিচিত। সে এগিয়ে এসে ভ্রু কুঁচকে বলল,’ তোরা একে অপরকে চিনিস?’
‘ না। উনি কে? আমি চিনি টিনি না। আর এসব কেমন অসভ্যতা? নিজের জিনিস আমার হাতে কেন দিলেন? দ্রুত এসব নেন। তা না হলে ফেলে দিব।’ কঠিন গলায় কথা গুলো বলল নীহারিকা। বিমুগ্ধ বদমাইশের মত শিস বাজালো। সাগরিকা ধরতে পারল এটি গানের লিরিক্স। কিন্তু সে বিস্মিত হলো এত সুন্দর সুর দেখে। বিমুগ্ধ নিজের ঘাড়ে হাত বুলিয়ে সামনে হাঁটতে হাঁটতে বলল,’ আমার সাথে আসুন।’
‘ জীবনেও না। এখনি এসব ছুড়ে দিব।’ যেই কথা সেই কাজ। নীহারিকা ফেলেই দিচ্ছিল। বিমুগ্ধ ভয়ংকর ধমক দিয়ে উঠল,’ ভুলেও না।’ নীহারিকা ভয় পেয়ে যায়। ধমকটা একটু জোড়েই ছিল। সাগরিকা বলল,’ চল আমিও যাব। আম্মু আর আপুকে এই ডাক্তারের কাছেই দেখাব।’
যেতে যেতে সাগরিকা ফিসফিসিয়ে বলে উঠল,’ তুই সত্যি উনাকে চিনিস না?’
নীহারিকার লাল চোখ। গাল লাল। নিজের ঠোঁট সে নিজেই কামড়ে কেঁটে ফেলছে। নিজের হাত সে নিজের হাত দিয়ে খামচি দিচ্ছে। আঁচরের দাগ বসে যাচ্ছে সাদা হাতে। সাগরিকা ভীতু চোখে তাকাল। নীহারিকা থেমে গিয়ে বলল,’ উনি আমার খালাতো ভাই। অসহ্য লোক। তোকে বুঝাতে পারব না। আজকের দিনটাই খারাপ।’
অবাক হয়ে সাগরিকা বলল,’ মানে কি? তোকে তো আপনি করে ডাকছে। তুই বড়?’
‘ তোর এই বুড়াকে দেখে মনে হচ্ছে আমি এর বড়? সিরিয়াসলি? ক্লাসের সবাই তোকে সাদে গাঁধী বলে না।’
কথাটা বলে নীহারিকা ভুল করেছে। কিন্তু তার মাঝে অনুতাপ নেই। সাগরিকা গায়ে মাখল না। হেসে উড়িয়ে দিল। তারপর নিজের মাকে নিয়ে আসতে চলে গেল। রুমটির সামনে এসে নীহারিকা আরও অবাক হল। তার হাতে এখনও বিমুগ্ধের জিনিস গুলো। সেগুলোর দিকে একবার দেখে নীহারিকা মুচড়ে দেয়। তারপর আবার রুমের দিকে তাকায়। এত সুন্দর রুম এই হসপিটালে? রুম জুড়ে সাদা রং। মাঝ দেওয়ালে ছোট বড় করে ছবি, সার্টিফিকেট ঝুলান। মানুষটা পাইরেটস অব দ্য ক্যারিবিয়ান মুভির ভক্ত! এত মুভি থাকতে এটাই কেন? কয়েকটি জাহাজের ছবি দেখা যাচ্ছে। জাহাজের প্রতি দুর্বলতা রয়েছে। টেবিলের উপরে অনেক সরঞ্জাম। পাশেই একটি বোর্ড। সেটিতে লাগান ছোট ছোট কাগজে অনেক লেখা। একটি একজনের বিছানা। লাইট, আর মস্তিষ্কের আকৃতি। আরও অনেক জিনিস আছে। যা নীহারিকা চিনতে পারছে না। একজোড়া স্নিকারও রয়েছে। এটা আজব। দু’টি ছেলেকে দেখা গেল। নীহারিকা অবাক হয়ে দেখল একটি ছেলেকে সে চিনতে পারছে। আরে এটা তো ঝালমুড়ি বিক্রেতা সেই ছেলেটি। একটু বড় হয়েছে। কিন্তু এখানে কি করছে? নীহারিকাকে দেখেই সে অষ্টম আশ্চর্য আবিষ্কার করল যেন। এমন একটা হা করে বলল,’ আপনি এখানে?’ নীহারিকাও প্রশ্ন করতে চাইল তুই এখানে কেন? তার আগেই আব্দুল নামের বড় ছেলেটি তাকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। বিমুগ্ধ একটি তোয়ালে নিয়ে এসে নীহারিকার সামনে দাঁড়াল। ভ্রু কুটি করে নীহারিকা প্রশ্নবোধক চেহারা করল। বিমুগ্ধ হাসল। তাকিয়ে থাকল। নীহারিকা অস্বস্তি অনুভব করছে। সরে যেতে নিলে বিমুগ্ধ তার এপ্রোন টেনে ধরে। নিচু মলিন গলায় বলে,’ এভাবে দাঁড়িয়ে থাকুন। অনেকক্ষণ পর্যন্ত। যতক্ষণ না আপনার পা ব্যথা হয়ে যাচ্ছে। যতক্ষণ না আপনার গভীর ঘুমে চোখের পাতা বন্ধী হয়ে আসছে। ঠিক ততক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকুন যতক্ষণ আপনি নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছেন না। দাঁড়িয়ে থাকুন।’ নীহারিকা থাকল। দাঁড়িয়েই। বিমুগ্ধ হাতে ধরা ঠিক বিশমিনিট তাকিয়ে রইল। এটা তার খাবারের সময় ছিল। যা সে নীহারিকার দিকে তাকিয়ে একে বারে শূন্য করে ফেলেছে। যখনই ঘড়ির কাঁটা সময় পেরোল বিমুগ্ধ ফিচেল হাসল। নীহারিকার এতঘুম পাচ্ছে যে সে ভাষায় প্রকাশ করতে পারছে না। দাঁড়িয়েই ঘুমিয়ে যাচ্ছিল সে। বিমুগ্ধ যতক্ষণ তাকে দেখেছে ঠিক ততক্ষণ সে চোখ রেখেছিল নিচের দিকে। ছাদের দিকে। দেওয়ালের দিকে। লেখাগুলোর দিকে। বিমুগ্ধের হাসি দেখে সে বলল,’পাগলদের চিকিৎসা করতে করতে আপনি পাগল হয়ে গেছেন।’
বিমুগ্ধ আরও হাসলো। তোয়ালে নীহারিকার গায়ের উপরে বিছিয়ে দিয়ে বলল,’ এখানে এসেছেন কেন?’
‘ সাগরিকা নিয়ে এসেছে।’
‘ আপনাকে নিয়ে এসেছে?’ অবাক হওয়ার অভিনয় করল বিমুগ্ধ। চেয়ার টেনে দিল। নীহারিকা ধপ করে বসল। বিমুগ্ধ তার কান্ডে হাসি অব্যাহত রেখেছে। নীহারিকা নিজের পা চেপে বসল কিছুক্ষণ। তার দিকে চেয়ার নিয়ে আসল বিমুগ্ধ। তারপর সাদা রঙ্গের বক্স থেকে মেডিসিন বের করেত লাগল। নীহারিকা প্রশ্ন করল,’ এগুলো কি?’
‘ আপনার মাথা কেঁটেছে।’
‘ আমার? ‘ অবাক হয়ে হাত দিয়ে কপাল ছুঁয়ে দিল সে। এখন সে ব্যথা পাচ্ছে। এতসময় তো খবরই ছিল না। বিমুগ্ধ নিষ্কম্প চোখে তাকিয়ে রইল। নীহারিকা নামক মেয়েটি সত্যি তার জীবনের অদ্ভুত, অবাস্তব থেকে বাস্তব হয়ে উঠা অধ্যায়। সে সরস উপহাস করে বলল,’ আপনার তো পুরো কপাল ফাঁটা।’ নীহারিকা চোখ বড় করে নেয়। বিমুগ্ধ মজা নেয় সেই সুযোগের। সে মেডিসিন লাগিয়ে দিচ্ছে। ফুঁ দিয়ে যত্ন করে তার কপালে ছোট ব্যান্ডেজ করে দিল।
‘ আপনার বউ কি পাগল?’ নীহারিকা বিড়বিড় করে বলল। বিমুগ্ধ স্বউচ্চ শব্দে হেসে উঠে বলল,’ আর ইউ জেলাস?’
‘ মোটেও না। আপনার সাথে আমার জেলাসি জনিত কোন সম্পর্ক নেই।’ অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল নীহারিকা। বিমুগ্ধ রসিয়ে রসিয়ে বলল,’ তাই নাকি? কিন্তু আমার আপনার সাথে জেলাসির চরম সম্পর্ক আছে। আমি আগেই বলেছি আমার অনুভূতিকে হালকা ভাবে নিবেন না। আপনার সাহস তো কম নয়।’
‘ আমি কি করলাম?’ উৎকন্ঠিত হয়ে বলল নীহারিকা।
‘ জাওয়াদের গাড়িতে কেন উঠেছেন? তার সাথে হেঁটেছেন কেন? কথা বলেছেন কেন?’ বিমুগ্ধের হাসির মাঝে কেমন যেন একটা উদ্ভট ঝাঁঝ প্রকাশ পাওয়া যাচ্ছে। নীহারিকা বিচলিত হয়ে বলল,’ আপনি কিভাবে জানলেন?’
বিমুগ্ধ হাসিতে ফেঁটে পড়ে বলল,’ ম্যাজিক। ভুলে গেলেন আমি ম্যাজিক পারি।’ চোখ এক টিপে বন্ধ করে বিমুগ্ধ সরে গেল। খুব সিরিয়াস হওয়া গলায় বলল,’ এদিকে চলে আসুন। আমার রোগী দেখার সময় এটা।’
নীহারিকা দ্রুত বের হয়ে যেতে নেয়। বিমুগ্ধ এক চোখ ছোট করে তাকায়। নীহারিকা পাত্তা দিতে চায় না। পরে ভাবে সে একটু দেখবে কিভাবে মানসিক রোগীদের দেখা হয়। তাই সে একটু দুরে বসল। বিমুগ্ধ একটি কলম আর খাতা তার মুখের দিকে ছুড়ে দিল। খাতা ধরতে পারলেও কলমটি নীহারিকার নাকে এসে বাড়ি খেল। ফলে সে ব্যথা পেয়ে উঠল। চোখ গরম করে তাকাতেই বিমুগ্ধ না দেখেই বলল,’রোগীদের নাম, ঠিকানা, কার কি ঔষুধ এবং কোন সময়। এসব লিখুন। আর হ্যাঁ সিনড্রোম কি সেটাও লিখবেন। আমি বলে দিব।’
‘ আমি কি আপনার এসিস্টেন্ট?’ রাগে গিজগিজ করে উঠল নীহারিকা। বিমুগ্ধ কথা বলা বন্ধ করে দিল। নীহারিকা রেগে তার ছবি আঁকা শুরু করল খাতায়। খাড়া খাড়া চুল নাক আর খুবই বাজে আকৃতির ছবি। যা ক্লাস ওয়ানের বাচ্চার চেয়েও জঘন্য হয়েছে। সেই ছবি দেখে নীহারিকা কিছুক্ষণ পাগলের মত হাসল। বিমুগ্ধ পিছনের আয়নায় ছবিটি দেখেও চুপ করে রইল। মেয়েটি খুব কম হাসে। পৃথিবীতে মেয়েদের দু’টি অনুভূতি খুব সুন্দর। একটি তাদের হাসি। অন্যটি তাদের কান্না। কিন্তু বিমুগ্ধের কাছে মনে হয় একজনের ক্ষেত্রে তিনটি জিনিস সুন্দর। রাগটি ছাড়া নীহারিকাকে অসম্পূর্ণ অসম্পূর্ণ মনে হয়। বিমুগ্ধ মুচকি হেসে নিজের কপাল চাপড়ে ধরল। আজকের দিনটি তার জন্য অসম্ভব সুন্দর। বরফের শহরে যেমন রোদটা সুন্দর, রৌদেলা শহরে যেমন বৃষ্টি সুন্দর ঠিক তেমন। এই শহরের বুকের লেপ্টে থাকা বৃষ্টির মতই আজকের দিনটি বিশেষ সুন্দর।
____________________
প্রিয়ম ঘরময় পাইচারী করছে। নীহারিকা কখনো এত দেরিতে ফিরে না। কিন্তু এখন কি এমন হয়েছে যে সে ঘরে আসছে না। ফোনটাও ধরছে না। আজকে বাসায় আসলে সে এই শাকচুন্নির চুল ছিড়বে বলে ঠিক করেছে। আফিয়া বিলকিস বার বার বাহিরে উঁকি দিচ্ছেন। ভাগ্যিস এখনও নাজিম উদ্দিন এসে পড়েনি। আজ তার খুব কাজ। তাই তিনি আসেনি। কিন্তু ফোন দিয়ে খবর নিয়েছেন। তখন মিথ্যা বলতে হয়েছে আফিয়াকে। বলেছে নীহারিকা তার কোন বান্ধবীর সাথে আছে। তাই একটু দেরী হচ্ছে। তার সাথে কথা হয়েছে। সবটাই বানোয়াট। তিনি এখনও তার সাথে যোগাযোগ করতে পারেনি। প্রিয়মের মনে পড়ে সকালে জাওয়াদ বলেছে সে নীহারিকাকে নিতে আসবে। যদিও প্রিয়মের জাওয়াদকে একটুও পছন্দ না। কিন্তু বাবা খুব পছন্দ করে। তাই যেতে দিতে হল। কথাটা মনে পড়তেই প্রিয়ম জাওয়াদের ফোনে কল দিল। কিন্তু ফোন ধরল জাওয়াদের এসিস্টেন্ট। সে বলল জাওয়াদ কিছুক্ষণ আগেই সার্জারি করেছে। ফলে সে এখন কারো সাথে কথা বলতে চাচ্ছে না। প্রিয়ম বুঝিয়ে বলল,’ আপনি উনাকে বলুন যে নীহারিকার ভাই ফোন করেছে। তিনি নিশ্চয় কথা বলবে।’ জাওয়াদের এসিস্টেন্ট মেয়ে। নাম অনিমা। তার একদম পছন্দ না নীহারিকাকে। কারণ জাওয়াদের সাথে সে আজ তিন বছর কাজ করছে। কোন মেয়ের প্রতি তাকে এত বেশি আগ্রহিত, পাগল পাগল পাগলামী করতে দেখেনি। এটাই প্রথম। অনিমা বললনা। কিন্তু জাওয়াদ হঠাৎ ফোন চেয়ে বসল। অনিমা আশ্চর্য হয়ে দেখল একটি মেয়ের ছবি ঝুলছে ফোনের উপরে। এতসময় সে এটি লক্ষ করেনি। মেয়েটির চেহারা দেখা যাচ্ছে না। শুধু চোখ দেখা যাচ্ছে। জাওয়াদ অধৈর্য্য গলায় আবার ফোন চাইল। সে নিজের রুমে থাকা সোফায় শুয়ে ছিল। অনিমা টেবিলের পাশে। এবার জাওয়াদ নিজে চলে এসে ফোন কেড়ে নিয়ে বলল,’ আমার ফোন তুমি আর ধরবে না। অন্যসব কাজের দায়িত্ব তোমার আমার ফোনের নয়।’
অনিমা হাস্যোজ্জ্বল মুখে বলল,’ মেয়েটি কে?’
জাওয়াদ নিজের সিল্কি চুল উড়িয়ে দিতে দিতে বলল,’ আমার বউ।’
‘ বিয়ে করেছেন কবে? ‘ চিন্তিত দেখাল অনিমাকে। জাওয়াদ মুচকি হেসে বলল,’ দ্রুত করব। দাওয়াত তোমাকেও দেওয়া হবে।’
‘ তার মানে এখনও বিয়ে হয়নি?’ স্বস্তির শ্বাস ফেলল সে। তাকে দেখে জাওয়াদ একটু সন্দেহান চোখে তাকিয়ে বলল,’ আমার বিয়ে নিয়ে এত চিন্তা কেন তোমার? নিজেরটা নিয়ে ভাব।’
পৃথিবীর সবমেয়েকে জাওয়াদের আগে সন্দেহ হতো। তার মতে সবাই তাকেই পছন্দ করে। করবে। তার মাঝে এমনই গুলাবলি এবং রূপের উৎকর্ষ রয়েছে। কিন্তু একটি মাত্র মেয়ে তার এই ধরণার পরিবর্তন করে তাকে নিঃস্ব করে দিয়েছে। জাওয়াদ নিজের মাথার চুলের ভাঁজে হাত ডুবিয়ে হাসছে। অনিমা তাকিয়ে আছে। লোকটা তার দেখা সবচেয়ে সুন্দর পুরুষ। ছেলেরা এত সুন্দর হয় কিভাবে? ওহ হাড় কাঁপানো সৌন্দর্য্য।
জাওয়াদ ফোনে প্রিয়মের নাম্বার গোমড়া শালামশাই দিয়ে সেভ করেছে। কারণ প্রিয়ম তার সামনে সব সময় মুখটা গোমড়া করে খুব ভাবুক হয়ে ঘুরে বেড়ায়। ব্যাপারটা তার দারুন লাগে। তাই সে এই নামটি তাকে প্রদান করেছে। প্রিয়ম কখনো তাকে কল করেনি। সে নিজেই করত সব সময়। খুব কম কথা বলে সে ফোন রেখে দিত। এই প্রথম প্রিয়ম তাকে কল করেছে। দেখা মাত্র জাওয়াদের মাথা গরম হয়ে যায়। কিছুক্ষণ আগে তো সে ফ্রি ছিল। অনিমার দিকে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সে বলল,’ প্রিয়ম কল করেছে আমাকে বলনি কেন? আমি প্রশ্ন করছি বলনি কেন?’
অনিমা ভয় পাওয়া গলায় বলল,’ আমি ভেবেছি তেমন গুরুত্বপূর্ণ না। আর আপনি সার্জারি করেছেন কিছু সময় পূর্বে।’
‘ তো কি হয়েছে? তুমি একদম আমার ফোন ধরবে না। ওহ প্রথম বার প্রিয়ম কল করেছে। তোমার জন্য ধরতে পর্যন্ত পারলাম না। লিভ।’
অনিমা দুঃখে কাঁদো কাঁদো অবস্থা নিয়ে বের হয় রুম থেকে। সে এতবছর কাজ করছে তার সাথে এভাবে ব্যবহার করতে পারল?
জাওয়াদ প্রিয়মের ফোনে কল করা মাত্র উত্তেজিত কন্ঠে প্রিয়ম বলে উঠে,’ আপু কি আপনার সাথে?’
কথাটা কানে পৌছনো মাত্র জাওয়াদ চমকে যায়। বিচলিত হয়ে সে বলে উঠে,’ মানে কি? নীহারিকা বাসায় যায়নি? তার পরীক্ষা তো অনেক আগে শেষ হয়েছে।’
‘ আপনি কি করছিলেন? আপুকে দিয়ে যেতে পারেন নি? আজব পাবলিক তো। দিয়ে যখন যেতে পারবেন না, নিয়ে গেলেন কেন?’ প্রিয়ম আগুন হয়ে আছে। তার কথাগুলো কাঁটার মত। জাওয়াদ দ্রুত ফোন রাখার ভাব নিয়ে বলল,’ আমি এখন রাখছি। ওর ভার্সিটিতে গিয়ে দেখছি। আমার সার্জারি ছিল তাই নিতে যেতে পারিনি।’
‘ কোন দরকার নেই। আমি নিজেই পারব খোঁজ করতে। আপনি আপুর কাছ থেকে দুরে থাকবেন। অর্ধেক কাজ করা মানুষ আমার একদম পছন্দ না।’ প্রিয়ম রেগে ফোন কেঁটে দিল। এই লোকটাকে সে পার্সোনালি পছন্দ করে না। কারণ বিহিন এই একটা মানুষকেই সে পছন্দ করে না। দ্রুত রুমে গিয়ে চেঞ্জ করে সে বেরিয়ে পড়ল। প্রায় তিনটা বাজতে চলল। এখনও তার বোন ঘরে এসে পৌছয়নি। তার মাঝে নীহারিকার পালানোর স্বাভাব আছে। যা তাকে আরও ভীতু করে দিচ্ছে। সে জানে নীহারিকার রাগ একটু বেশি। কিন্তু তেমন কিছুই তো হয়নি। তাহলে গেল কই?
প্রিয়ম ভার্সিটিতে গিয়ে পৌছে দেখল সেখানে আগে থেকেই জাওয়াদ খোঁজ করছে। সে নীহারিকার অনেক টিচারকে প্রশ্ন করছে। এত বড় মেয়েকে নিয়ে টেনশন করা খুব হাস্যকর হলেও ক্লাসের কিছু প্রফেসররা জানে নীহারিকা একটু আলাদা ধর্মী মেয়ে। সে তেমন কারো সাথেই মিশেনা, যায় না, ঘুরে না। তার বাবা খুব বেশি যত্নবান তার প্রতি। তার মাঝে ভার্সিটির সবচেয়ে শান্ত মেয়ে সে। অন্য স্টুডেন্টের জন্য এটি কোন দেরি নয়। তবে নীহারিকার জন্য দেরি। অনেক দেরি। প্রিয়ম নিজেকে নিয়ন্ত্রন করে জাওয়াদকে বলল,’ আপনি এখানে কি করছেন?’
‘ খুঁজতে এসেছি। দেখতেই পাচ্ছ।’ সে নিজের কাজে মন দিল। ভার্সিটির গার্ডকে প্রশ্ন করতেই তিনি অল্প কিছু ইনফরমেশন দিতে পারল। কারণ ছোট একটা হট্টগোল তার সামনেই হয়েছে। সেখানে তিনি নীহারিকাকে দেখেছেন। এত ছাত্রছাত্রীর মাঝে কাউকে চিনা মুশকিল। প্রিয়ম নিজের সাথে বোনের একটি ছবি দেখাল। তিনি বললেন,’ ছোট একটা ধাক্কাধাক্কি ঘটেছে। তারপর সে একটি মেয়ের সাথে কোথায় যেন গিয়েছে।’
জাওয়াদ ফোনটা কেড়ে নিয়ে প্রিময়কে অনুরোধ করে বলল,’ প্রিয়ম এই ছবিটি কি আমাকে দেওয়া যাবে?’
এত সিরিয়াস সময়ে জাওয়াদের এমন উদাসিন কথায় প্রিয়মের মাথা আরও গরম হয়ে গেল। সে রিকশা নিয়ে এখান থেকেই চলে গেল। জাওয়াদ ভার্সিটির সামনেই একটি খোলা জায়গায় বসে বসে অপেক্ষা করতে লাগল। তার ধারণা নীহারিকা এখানে ফিরে আসবে। তখন সে তাকে বাসায় নিয়ে যাবে। প্রিয়ম আর রেগে থাকবে না। প্রিয়ম বোনের মত হয়েছে। কথা কম বলে রাগ বেশি দেখায়। এদের বাবাও এমনই। একটা সময় জাওয়াদ গাড়ি নিয়ে আশেপাশে খোঁজ করল। তার চিন্তা আরও বেড়ে যাচ্ছে। কোথায় যেতে পারে? তার কোন বন্ধু বান্ধুবীও নেই। কোন পরিচিতদের বাসায়ও যায়নি। কোথায় গেল তাহলে?
মা বার বার কল করছে। সেটাও ধরল না জাওয়াদ। তার মাথাই কাজ করছে না। বুক ধুকধুক করছে। হাতটাও কাঁপছে অনবরত। এই হাত কখনো সার্জারি করতেও কাঁপে না। এখন টেনশনে কাঁপছে। থরথর করে। পানির বোতল কিনে খেয়েছে প্রায় পাঁচটা। তার খুব পিঁপাসা পাচ্ছে। বাহিরে রোদও এসে গায়ে পড়ছে। তার ধবধবে সাদা শরীর লাল হয়ে গিয়েছে। সূর্যের সাথে সেও ঘামছে। তার রূপ ঝলসে পড়ছে।
_____________________
ভুলগুলো আল্লাহর দেওয়া মহান গুন ক্ষমার চোখে দেখবেন।
সবার জন্য রইল অন্ধ অদৃশ্য ভালোবাসা।
@হাফসা……..