প্রিয় সুখ-২১
__________________
মানসিক রোগ একটি মানুষের জীবনকে থমকে দেয়। কেড়ে নেয় পরিবার, পরিজন, আত্নিয়স্বজন, সমাজ, এমন কি নিজেকে। পৃথিবী কতটা বিচিত্র! নিজেকে মানুষ কত সহজে নিজেই ভুলে যেতে পারে। মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রণ হারায়। জীবন ব্যহত হয়। তীব্র মানসিক যন্ত্রণায় ভোগে। সৃষ্টিকর্তা কত সুন্দর নেয়ামত দান করেছেন। সুস্থ জীবনেই সব। অর্থের অভাবে মানুষ ভেঙ্গে পড়ে। প্রেমের ব্যর্থতায় জীবন বিলিয়ে দেয়। নেশাকে জীবনে জড়িয়ে নেয়। অথচ তারা ভুলে যায় কত সুন্দর জীবন তাদের। সুস্থতার মত এত বড় সম্পদ থাকতে অন্য কিছুর চিন্তা করা মানুষজাতীর উচিত নয়। তাদের উচিত নিজেকে নিয়ে বাঁচা। নিজের জন্য বাঁচা। কেন মানুষ আত্নহত্যা করতে চায়? নীহারিকা তাজ্জব হয়ে গেল যখন সে দেখল একজন প্রেসেন্ট কম করে হলেও পাঁচ ছয়বার আত্নহত্যা করতে চেয়েছে। এই সংখ্যাটা শুনে সে অর্ধেক বিস্মৃত হলেও যখন শুনল একজন বিশবার চেষ্টা করেছে সে পুরোই কাত হয়ে পড়ল। কিভাবে সম্ভব? একটি মানুষ তো তার চোখের সামনে ছুরি নিজের হাতে চালাতে বসেছিল। ভাগ্যিস বিমুগ্ধ ভালো অভিনয় করতে পারে। তা না হলে তো এই মেয়ে নিজেকে মেরেই দিচ্ছিল। বিমুগ্ধকে যতক্ষণ দেখেছে নীহারিকা, বিমুগ্ধ হয়ে চেয়ে থেকেছে। একটা মানুষ এত চরিত্রে অভিনয় করতে পারে? কখনো ছেলে, কখনো বাবা, কখনো বন্ধু তো কখনো স্বামী। সে নিজের মত করে ক্যারেক্টার তৈরি করে নেয়। কখনো সাধারণ ডাক্তারের মত আচরণ তার। নীহারিকা বশীভূতর সাথে আশ্চর্য। তার ভালো লাগছে। এত মানুষের অনুভূতি পড়তে পেরে তার চোখ ঝাপসা হয়ে এসেছে। বাংলাদেশের এত মানুষ মানসিক রোগে আক্রান্ত? সত্যি ব্যাপারটা আশ্চর্যতম। সে আগে ভাবত এটা মানেই পাগল। এখন সে বুঝতে পারছে এটি একটি রোগ। সাধারণ রোগের মতই যে কেউ এতে আক্রান্ত হতে পারে। বিমুগ্ধের মতে বাংলাদেশে গড়ে প্রায় অনেক মানুষ এতে আক্রান্ত। কিন্তু তারা নিজেরাও এটি ধরতে পারছে না। সব সমস্যা পাগলামির দ্বারা প্রকাশ পায় না। মস্তিষ্ক হচ্ছে শরীরের সবচেয়ে কোমল। কারণ সামনে যাই ঘটে যাচ্ছে, যাই চিন্তা করছে, এবং যাই সে করতে চাচ্ছে সব এই মস্তিষ্ক পর্যবেক্ষণ করছে। রোগটিকে হালকা ভাবে নেওয়ার ফলে আত্নহত্যা, নেশার প্রবণতা, রেপ, খুন বিভিন্ন অপরাধ বাড়ছে। কারণ সুস্থ মানুষ কখনো এসবে জড়িয়ে পড়ে না। বিষন্নতা, হতাশা এসব অনেক বড় ভূমিকা পালন করছে। সিরিয়াসলি? নীহারিকা তো আগে কখনো এসব ভেবেই দেখেনি। তার মতে পরিবারের দোষ। শিক্ষা দেয়নি ঠিক করে। এখন বুঝতে পারছে যার মস্তিষ্কই অসুস্থ তাকে শিক্ষা নয় চিকিৎসা দেওয়া উচিত। প্রকৃত অর্থে আমরা জ্ঞান দান করি, আমরা সাবধান করি, তাকে বুঝিয়ে বলি। আমরা নিজেদের মত করে ভাবি। সে কেন এমন করল? বলে দি এটা অন্যায়। বলে দি এটা উচিত নয়। সে খারাপ। কিন্তু প্রকৃত সত্য সকলের একটি করে গল্প হয়। প্রতিটি খারাপের শুরুর গল্প আমরা পড়ি না। শেষের অংশেই সিদ্ধান্ত শুনিয়ে দি। ভুলটি এখানে। একটি পাপ উপড়ে ফেলতে হলে আগে অবশ্যই তার গোড়ায় আঘাত করতে হবে। মানুষের জঘন্য অপরাধ এটি। কেউ পৃথিবীতে খারাপ হয় না। নিজের জায়গা থেকে সবাই সঠিক হয়। শুধু কারো হেঁটে যাওয়া পথটি অন্যায় পথ। কারোটা সঠিক। একজন দিক নির্দেশক প্রয়োজন, সঠিকের পথে হাঁটার জন্য। এটি সত্য নয়। সৃষ্টিকর্তা আপনাকে মস্তিষ্ক নামক সবচেয়ে সচল যন্ত্র দিয়েছে। খারাপ ভালো চিনার চেতনা দিয়েছে। আপনাকে প্রানীদের মাঝে শ্রেষ্ঠ করেছে। নিজের শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় দিতে নিজের বিবেক বুদ্ধিকে কাজে লাগানোর দায়িত্ব আপনার। তাই আপনার সঠিক পথ আপনি। নীহারিকা অনেকের ঘটনা শুনেছে। কারো বেলায় সে লুকিয়ে কেঁদেছে। একটি ঘটনা খুব করুন। মহিলার ছেলের বউ তাকে পাগল বানিয়ে হসপিটালে রেখে গিয়েছে। বিমুগ্ধ যে কেন তাকে ভর্তি করিয়েছে বুঝতে পারছে না নীহারিকা। সে নিজেই দেখেছে মহিলা সুস্থ। সে কাঁদছে। এটা কেমন নিয়তি? সাগরিকা প্রথমে তার মাকে নিয়ে এসেছে। তিনি আগে থেকেই ভর্তি রয়েছে। তবুও দেখাতে এসেছে সাগরিকা। মায়ের পাশে বসল সে। নীহারিকার দিকে একবার চোরের মত তাকাল। তার মায়ের আচরণ খুব অস্বাভাবিক। তিনি বার বার মেয়েকে বিয়ে দিতে চাইছেন। বিমুগ্ধ তার হাত ধরলেন। মায়া ভরা কন্ঠে বলল,’ মেয়ের বিয়ে পড়ে দেওয়া যাবে আগে ছেলের বিয়ে তো দেন।’
ভদ্র মহিলা রেগে গিয়ে বললেন,’ আমার তো ছেলে নেই।’
বিমুগ্ধ অভিমানের সুরে বলল,’ কে বলল নেই? আমি কে? আপনি আমাকে ভুলে গেলেন? কথা দিয়েছেন আমার বিয়ে আপনি আপনার পছন্দের মেয়ের সাথে দিবেন। কই মেয়ে কই? আমি তো চিরকুমার হতে হতে রয়ে গেলাম।’
এবার তিনি ভ্রু কুঁচকে বললেন,’ আমি বলেছি?’
বিমুগ্ধ এবার টেবিল থাপড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,’ তা নয় তো কি? মেয়ে পেয়েছেন কি না বলুন?’
ভদ্র মহিলার মন ভুলিয়ে বিমুগ্ধ তার সাথে গল্প করতে লাগল। একটা পর্যায়ে তিনি হেসে বললেন,’ তুমি খুব সুন্দর করে কথা বলো।’
বিমুগ্ধ অবাক হয়ে হেসে বলল,’ তাই না কি? জানতাম না তো। আর কি কি সুন্দর আছে আমার মাঝে বলুন তো।’
ভদ্র মহিলা একটু চুপ হয়ে গেলেন। ভাবনায় পড়ে গেলেন মনে হচ্ছে। বিমুগ্ধও চুপ করে তার দিকে তাকিয়ে রইল। যেন সে খুব আগ্রহিত জানার জন্য। হঠাৎ তিনি খুব স্বাভাবিক ভাবে বললেন,’ হাসি সুন্দর। তুমি দেখতেও সুন্দর। চোখগুলো একটু কম সুন্দর। তোমার বউয়ের চোখ অনেক সুন্দর হবে।’
‘ কিভাবে বুঝলেন?’ উদগ্রীব হয়ে জানতে চাইল বিমুগ্ধ। ‘ তোমারটা সুন্দর না তাই মনে হচ্ছে।’ সাগরিকা অবাক হয়ে দেখছে ওর মা খুব স্বাভাবিক ব্যবহার করছে।
‘ আমার মেয়েকে তুমি বিয়ে করে নেও। ও একটা ছেলেকে খুব ভালোবাসে। কিন্তু সে বিয়ে করবে না। এখন আমার মেয়ের কি হবে? বলো।’
‘ আপনার মেয়ে? কই দেখি তো। সে নিঃসন্দেহে আপনার মত সুন্দরী হবে।’
‘ অনেক সুন্দর। কিন্তু কিন্তু আমার মেয়ে কই? আমার মেয়ে কই যেন? ওহ খুঁজে পাচ্ছি না। সানজিদা কই তুই? ‘
তিনি উত্তেজিত হয়ে টেবিলের নিচে খুঁজতে শুরু করলেন। মাথায় বাড়ি খেতে নিবে দেখে নীহারিকা দ্রুত এসে মাথার পিছনে হাত রাখল। ধীরে বের করে নিয়ে আসল। এবার তিনি নীহারিকাকে দেখে বললেন,’ এই তো আমার মেয়ে। কিন্তু তোর চেহারা এমন রোগা হয়ে গেছে কেন? এই তুই ব্যথা পেলি কিভাবে?’
নীহারিকা মুচকি হেসে বলল,’ আমি তো আপনার মেয়ে ন।’ কথা শেষ না করতেই সাগরিকা বলল,’ আপু তুই ব্যথা পেলি কিভাবে?’
নীহারিকা প্রথমে অবাক হলেও সে বুঝতে পারল ভদ্র মহিলা নিজের বড় মেয়ের চেহারা ভুলে গিয়েছেন। তাই চুপ করে গেল। সাগরিকার মা নীহারিকার হাত ধরে ঘুরিয়ে বিমুগ্ধের সামনে নিয়ে বলল,’ ও আমার মেয়ে। সুন্দর না অনেক?’ বিমুগ্ধ এবার হেসে ফেলল। বুকে হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে নাটকিয় কর্মকান্ড করে বলল,’ ওহ আপনার মেয়ে তো সত্যি খুব সুন্দরী।’
মহিলা গর্ভবোধ করে বলল,’ দেখেছ বলেছি না সুন্দরী।’
‘ হুম কথা সত্য।’ বিমুগ্ধ কাগজে ভদ্র মহিলার সিনড্রোম হিসেবে ঔষুধ লিখতে বসেছে। আগের প্রেসক্রিপশন গুলো চেক করে ঔষুধ পরিবর্তন করছে। মহিলা এবার ছুঁটে গিয়ে বিমুগ্ধের হাত ধরে বলল,’আমার মেয়েকে বিয়ে করবে না?’
বিমুগ্ধ একটু উপরের দিকে তাকিয়ে ভাববার অভিনয় করে
বলল,’ না করে উপায় নেই। এত সুন্দর বউ হাতছাড়া করতে আছে, বলুন?’
ভদ্র মহিলা তিপ্তির সাথে হাসল। বিমুগ্ধ অনেক বুঝিয়ে তাকে তার কক্ষে পাঠিয়ে দিল। নীহারিকাও ভদ্র মহিলার সাথে বেড়িয়ে গেল। তার বাসায় যেতে হবে দ্রুত। পিছন থেকে বিমুগ্ধ ডেকে বলল,’ আমার জন্য অপেক্ষা করবেন। চলে গেলে খবর আছে।’
নীহারিকা বিরক্তি প্রকাশ করলেও মনে মনে হাসল। সাগরিকার মায়ের রুমটি যথেষ্ট ভালো। বুঝাই যাচ্ছে হসপিটালে ভালো মানের রুমও আছে। সাগরিকা আবেগি হয়ে নীহারিকাকে জড়িয়ে ধরে বলল,’ তোকে ধন্যবাদ। তুই প্লিজ কাউকে বলিস না। সবাই আমাকে পাগলের মেয়ে বলবে। ভালো লাগে না আমার শুনতে। আমার চাচিও আমাকে পাগলের মেয়ে বলে। অনেক কষ্ট হয় আমার।’ চোখ মুখ খিঁচে সাগরিকাকে সরিয়ে দেয় নীহারিকা। এসব জড়িয়ে ধরা তার পছন্দ না একদম। এই জীবনে তাকে মিতু আপু আর ফাবিহাই বেশি জড়িয়ে ধরেছে। আর একজন আছে। তিনি দেখলেই জাপ্টে ধরে। ফুফিমনি। ওহ ভাবতেই নীহারিকার শরীর কেমন ঝনঝন করে উঠল। নিজেকে ছাড়িয়ে সে আশ্বস্ত হয়ে বলল,’ আমি কাউকে বলব না।’ সে একবারও জানতে চাইল না কিভাবে? কখন? কেন তার মা এমন হয়েছে। সে খুব স্বাভাবিক আচরণ করছে। যেন মানসিক রোগী হওয়া খুব স্বাভাবিক কিছু। সাগরিকা যত দেখছে তত অবাক হচ্ছে। রুম থেকে যেতেই নিচ্ছিল নীহারিকা। সাগরিকার মা তাকে চেপে ধরল। বলল,’ তুই চলে যাচ্ছিস কেন?’
না চাইতেও তাকে বসতে হল উনার পাশে। তিনি যতসব হুজুগে গল্প করছেন। তবে কথার মার প্যাচে নীহারিকা এটা বুঝতে পেরেছে সাগরিকার বোন আমেরিকা ছিল অনেক বছর। তার বাবা তার মায়ের পাগলামি সহ্য করতে না পেরে হসপিটালে ভর্তি করিয়েছে। ফলে সাগরিকা তার বাবাকে খুবই অপছন্দ করে। এবং নিজের খালামনির বাসায় থাকে। এভাবে নিজের চেতনা হারানোর পিছনে সাগরিকার বড় বোন দায়ি। এবং এটাও বুঝতে পেরেছে যে সাগরিকার বাবা যথেষ্ট পয়সাওয়ালা। ভদ্র মহিলার সাথে গল্প করতে করতে নীহারিকার নিজেরই ঘুম পেয়ে যাচ্ছে। সাগরিকার বড় বোন খুব ভালো গান করতে পারত। তার গান শুনতে না কি অনেক বেশি সম্মোহনী। এখন তার মায়ের ইচ্ছে নীহারিকা তাকে গান শুনাবে। যেহেতু নীহারিকা এখন সাগরিকার বড় বোনের জায়গায় অভিনয় করছে তাই তাকে অবশ্যই গান গাইতে হবে। তা না হলে মহিলা ক্ষেপে যেতে পারে। কিন্তু সে তো গানই পারে না। এত মোহা বিপদ! নীহারিকা রাগ রাগ ভাব নিয়ে সাগরিকার দিকে তাকাল। জোড়পূর্বক হেসে সাগরিকা অসহায়ি হয়ে হাত জোড় করে গান গাইতে অনুরোধ করল। কিন্তু নীহারিকা তো গান পারেই না। এই জীবনে সে তেমন গানই শুনে নি। যদি কোন গান সে পারফেক্ট ভাবে মনে রাখতে পেরেছে তা বাংলাদেশের সম্মানিত জাতীয় সংগীত। নীহারিকা গলা পরিষ্কার করে ছাত্রীছাত্রী লুক নিয়ে গাইতে শুরু করল,’
‘ আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।
চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস, আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি
ও মা, ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে,
মরি হায়, হায় রে-
তার দম বন্ধ হয়ে আসছে যেন। ভাগ্যিস জোর করে স্কুলে দৈনিক সমাবেশে জাতীয় সংগীত গাইতে হয়। তা না হলে আজ তো তার পাত্তা কাঁট হয়ে যাচ্ছিল। নীহারিকার উপরে সৃষ্টিকর্তার দয়া ছিল। জাতীয় সংগীত শুনেই ভদ্র মহিলা ঘুমিয়ে গিয়েছিল। এত জাদু জাতীয় সংগীতে? সাগরিকার প্রচুর হাসি পাচ্ছিল। নীহারিকা বাচ্চাদের মত করে গাইছিল। দরজার কাছেই বিমুগ্ধ দাঁড়িয়ে ছিল। সে দরজার সাথে হেলে বুকে দু’ হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে জাতীয় সংগীতের আনন্দ লুফে নিচ্ছিল। হাসিতে তার পেট ব্যথা হওয়ার উপক্রম।হাসি থামাতে গিয়ে দম বন্ধ হয়ে আসছিল। একটা সময় সে উচ্চ শব্দে হাসতে হাসতে দরজার সামনে থেকে সরে গেল। সাগরিকাও আর নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারল না। সেও হেসে দিল। নীহারিকার রাগান্বিত চাহনী। ক্রুদ্ধে তার শরীর কাঁপতে লাগল। নাক ফুলিয়ে সে সাগরিকাকে কঠিন গলায় বলল,’ তুই থাক। আমি যাচ্ছি। আর ক্লাসে যদি আমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করিস খবর করে দিব।’
সে হনহনিয়ে বের হয়ে গেল। একটু যেতেই বিমুগ্ধকে দেখল। সে কাঠের বেঞ্চিতে বসে নিজে নিজে হাসছিল। নীহারিকা মুখ ঢেকে দ্রুত হাঁটল। বিমুগ্ধ যে তার পিছন পিছন আসছিল সেটাও খবর ছিল না। রাগে তার মাথায় আগুন জ্বলছে। আজ তাকে কত কিছু করতে হয়েছে। শুধু জীবন বাঁচানোর প্রতিদান দিতে গিয়ে। ওহ, অসহ্য। শেষে কি না গান? বাহিরে এসে রাস্তায় দাঁড়িয়ে সে জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিতে শুরু করে। ইচ্ছে করছে এই হসপিটালকে এক হাতে তুলে অন্যহাতে ছুঁড়ে দিতে। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ সে বিমুগ্ধের সামনে এসে পড়ে। প্রথমে ভয় পেয়ে পিছিয়ে যায়। তারপর ক্রোধান্বিত গলায় বলল,’ ভুতের মত সামনে ঘুরঘুর করছেন কেন?’ একটু থেমে সে দু’ হাতের দু’ আঙ্গুল তুলে আবার বলল,’ পৃথিবীতে কি আপনি এই হসপিটালই পেয়েছেন? আজকের জন্য হলেও গায়েব থাকতে পারতেন। আপনি আমার লাইফের একটা বিপদ। দেখা মাত্র বিপদে পড়ব নিশ্চিত। অসহ্য।’
বিমুগ্ধ সিরিয়াস ভাব নিল। কিন্তু বেশিক্ষণ নিয়ে রাখতে পারল না। সে হু হা করে ডাকাতের মত হেসে উঠল। নীহারিকা বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেল। সে হা করে তাকিয়ে রইল। তার চোখের নিষ্প্রভ দৃষ্টি দেখে বিমুগ্ধ নিজেকে শুধরে নিয়ে হালকা রসিকতা করে বলল,’ গানের গলা খারাপ না।’ এটা বলেই সে মুখ গম্ভীর করল। একদম বিচারকের মত। নীহারিকার চোখ মুখ গরম হয়ে উঠল। ধোয়ার মত ভাব বের হতে লাগল শরীর মস্তিষ্ক থেকে। বিমুগ্ধ ব্যাপারটা বুঝতে পেরে দ্রুত গাড়ির দিকে মুখ করে তাকাল। সে জাতীয় সংগীত গাওয়ার পূর্ণ মজা নিচ্ছে বুঝতে পেরে নীহারিকা তার জুতো দিয়ে বিমুগ্ধের পায়ে খুব জোড়ে মাড়ালো। বিমুগ্ধের কোন রিয়েকশন পাওয়া গেল না। সে স্বাভাবিক ভাবে বলল,’ বড়দের লাথি মারা আপনার বাবা শিখিয়েছে না?’
এবার নীহারিকা সীমাহীন মাত্রায় রেগে বলল,’ বাবাকে টানছেন কেন? এবার কিন্তু মুখ ভেঙ্গে দিব। অসভ্য, অসভ্য, অসভ্য।’ রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে নীহারিকা সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। বিমুগ্ধ নিজের হাতের জড়ুরি জিনিস গুলো দ্রুত গাড়িতে ঢুকিয়ে রেখে তার সামনে গাড়ি নিয়ে গেল। দরজা খুলে দিয়ে চোখ দিয়ে ইশারা করল উঠতে। নীহারিকা নাছরবান্দা। সে উঠলই না। রিকশা খুঁজে নিল। বিমুগ্ধ আরও ত্যাড়া বিহেভ করল। রিকশাচালককে টাকা দিয়ে তাড়িয়ে দিল। একটা সময় নীহারিকা বিরক্ত হয়ে বলল,’ সব কিছু আপনার ইচ্ছে মত হবে? আজব লোকতো। আমি কিন্তু খালামনির কাছে বিচার দিব। উনার নাম্বার আছে আমার কাছে।’
‘ দিতে পারেন। আমি আম্মিকে ভয় পাইনা। ভালোবাসার মানুষকে ভয় পাওয়া উচিত নয়।’ বিমুগ্ধ এবার পিছনের দরজা খুলে দিয়ে বলল,’ চলুন আজ আপনার ড্রাইভার হয়েই গাড়ি চালাতে চাই।’
নীহারিকা তবুও অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল। একটা সময় বিরক্ত হয়ে উঠল। বলল,’ বাসায় দিয়ে আসবেন।’
‘ কার বাসায়?’
‘ অবশ্যই আমার।’
‘ আগে একহাজার টাকা দেন।’
‘ গাড়ি ভাড়া এত?’
‘ এই গাড়িতে উঠার ভাড়া আরও বেশি। আপনি শুধু আমার পাওনা টাকা দেন।’
‘ আমি কেন দিব?’ আশ্চর্য কন্ঠস্বর তার। বিমুগ্ধ বাঁকা ঠোঁটে হাসতে হাসতে বলল,’ আপনি ভুলে গেলেন আপনার থেকে আমি একহাজার টাকা পাই।’
বেকুব হয়ে যায় নীহারিকা। সে তো ভুলেই গিয়েছিল। কথাটা ভুলার মত। উনি যে পরিমানে অভিনয় করে, এবং করছে তাতে তো সে সব ভুলেই যাচ্ছে। নীহারিকা এবার নিভলো। মনে মনে ভাবল এখন টিভি সিনেমার মত এক হাজার টাকার জন্য এই লোকের ঘরে কাজ করতে হবে না তো? কথাটা ভেবেই বুকটা ধক করে উঠল। আমতা আমতা করে সে বলল,’ পরে দিয়ে দিব।’
‘ আবার দেখা করবেন আমার সাথে? আমাকে না আপনি পছন্দ করেন না?’ বিমুগ্ধ ফিচেল হাসছে। নীহারিকা ব্যাগ চেক করে দেখে এত টাকা তার কাছে নেই। বাসায় যেতে হবে। তখনই দিতে পারবে। তাই সে বলল,’ আপনি বরং আমাকে বাসায় নিয়ে যান আমি আপনাকে টাকা দিয়ে দিচ্ছি।’
‘ সেটার ভাড়াও যোগ করা হবে।’
‘ আপনি মহা কিপটা। এতটা হওয়া উচিত নয়।’ মিহি কন্ঠে বলল নীহারিকা।
‘ আর আপনি কি? ধার করে পরিশোধ না করাকে কি যেন বলে? আমি ভুলে গিয়েছি। মিস ক্ষেপা মহিলা আপনার কি জানা আছে?’ সুর টেনে বলল বিমুগ্ধ। নীহারিকার খুব হাসি পেল। কিন্তু তা প্রকাশ করল না সে। রাগী লুক নিয়ে বলল,’ আপনার মাথা বলে, মিষ্টার বিষাক্ত অসভ্য।’
দু’জনের মাঝে কিছু এলোমেলো কথা হল। যে কথার কোন মানে নেই। কোন অর্থ নেই। অর্থ বোধোকহীন কথাবার্তা গুলো খুব দ্রুত সময়কে তাড়িয়ে নিয়ে যায়। যেন এক টুকরো ঝড়োবাতাস। এলো আর চলে গেল। সারা দিন কিছু খায়নি নীহারিকা। তার প্রচন্ড ক্ষুধায় মাথা ঘুরছিল। তাই সে জানালার সাথে ঠেসে ঘুমানোর চেষ্টা করছে। ঘুম ক্ষিদে থেকে বাঁচার একটি গোপন পথ। নীহারিকা হঠাৎ করে বলে উঠল,’ আপনি এই হসপিটালেই কাজ করেন?’
বিমুগ্ধ গাড়ির মোড় ঘুরিয়ে বলল,’ না। আরও কিছু হসপিটালে বসি। তবে এখানে আমি বেশি সময় কাটাই।’
‘ পাগলদের সাথে থাকতে আপনার ভয় করে না?’ ছোট করে প্রশ্নটা করল নীহারিকা। বিমুগ্ধ হালকা ঠোঁটে হাসল। বলল,’ এটাই আমার পেশা। আপনি যাদের পাগল বলছেন তারা মানুষ। তাই পাগল বলে নিজের স্বজাতিকে অপমান করার কোন মানে হয় না।’
দ্রুত জিভ কাটল নীহারিকা। বিমুগ্ধের যেন মন মেজাজে এক গ্লাস করলা ঢেলে দেওয়া হল। পাশে থেকে সে ছোট নোটবুক নিয়ে দেখতে লাগল।
‘ আপনার হাতের লেখা এতটা খারাপ কেন? দেখ মনে হচ্ছে নার্সারির বাচ্চার লেখা।’ তিরস্কার প্রকাশিত হলো বিমুগ্ধের কণ্ঠে। নীহারিকা একটু উঠে এসে দেখল। না একদম ঠিক আছে। উল্টো একটু বেশি সুন্দর।
‘ আপনার চেয়ে যথেষ্ট ভালো দেখতে।’ তার স্বরে তেজ।
‘ আমি তো ডাক্তার। তাই হাতের লেখার অবস্থা একটু খারাপ। কিন্তু আপনার এই অবস্থা কেন?’
‘ ও হ্যালো খারাপ কোথায় হ্যাঁ? দেখুন কত সুন্দর।’
বিমুগ্ধ লেখাদেখে রিতিমত হাসছে। নীহারিকা মুখ ফুলিয়ে বসে রইল। বিমুগ্ধ আবার বিরক্ত করার জন্য প্রশ্ন করল,’ আপনার স্বপ্ন কি, জীবনে কি করতে চান? লেখা দেখে মনে হচ্ছে বাড়ি বসে থাকতে হবে।’
ব্যত্যয় বিশিষ্ট হয়ে সে বলল,’ মোটেও না। স্বপ্ন শুধু নিজের আপন মানুষকে বলা উচিত। যাকে তাকে বললে এর ক্ষমতা কমে যেতে পারে। প্রিয় মানুষদের বললে পাওয়ার বেড়ে স্বপ্ন পুরোন হয়ে যেতে পারে। সো আপনাকে বলে আমি নিজের ক্ষতিসাধান করতে চাই না পাগলের ডাক্তার।’
বিমুগ্ধ ভ্রু কুঁটি করে সামনের আয়নায় তাকাল। আবেশ ভাবে বিহ্বল হয়ে বলল,’ আমি আমেরিকা ফিরে যেতে চাই। নিজের প্রিয় প্রফেসসের সাথে কাজ করতে চাই। অনেক কিছু শিখতে চাই তার থেকে। তারপর দেশে ফিরে এসে সেগুলোকে কাজে লাগাতে চাই। মানুষের মনের প্রতি আমার বিশেষ দূর্বলতা রয়েছে। সেই মন আমি জয় করতে চাই। আমি আব্বিকে খুব সম্মানীত করতে চাই। যেমনটা তিনি চান। আমি প্রিয় মানুষগুলোর সাথে থাকতে চাই প্রিয় মানুষটির হাতে হাত রেখে। অভিনয় করে আমি মানুষের অনুভূতির সাথে খেলতে চাই না। এসব করে আমি তাদের সুস্থ করে তুলতে চাই। আমি সৃষ্টিকর্তার কাছে একজন মানুষ হিসেবে ফিরে যেতে চাই। বলতে পারেন আমি অনেকটা ঊর্ধ্বস্থিত হতে চাই। আমি যাকে ভালোবাসি সব সময় তার সাথে থাকতে চাই। তার সাথে পানিতে ডুবতে চাই। আকাশে ভেসে বেড়াতে চাই। স্বপ্নের মত বাস্তবে বাঁচতে চাই। যাকে ভালোবাসি তার মাঝে নিজের প্রিয় সুখ সন্ধান করতে চাই। আমি এভাবেই বেঁচে থাকতে চাই এভাবেই পৃথিবী ছাড়তে চাই।’ হতবিহ্বল হয়ে নীহারিকা বলল,’ আপনি আমাকে এসব বলছেন কেন?’ বিমুগ্ধ আড়চোখে তাকিয়ে উত্তরে বলল,’ জানি না তো। কেন বললাম? সত্যি তো কেন বললাম? আপনি জানেন?’ নীহারিকা মৃদু শব্দে হাসল। রিনঝিনে কন্ঠে বলল,’ ইনশাআল্লাহ আপনার স্বপ্ন পূরণ করতে মহান আল্লাহ সাহায্য করবেন।’
জানালা গুলো খুলে দিল বিমুগ্ধ। বাতাসে তার চুলের অপূর্ব সুভাস ছড়িয়ে পড়ল। আচ্ছন্ন হয়ে আসা কণ্ঠে সে বলল,’ সত্যি ক্ষমতা বেড়ে যায়।’
নীহারিকা জানতে চাইল,’ আপনি তো আমেরিকার মানুষ। সেখানে যেতে স্বপ্ন দেখতে হচ্ছে কেন?’
‘ সেখানে যেতে স্বপ্ন দেখতে হচ্ছে না। প্রফেসসের সাথে কাজ করার জন্য সুযোগের প্রয়োজন। উনি অনেক বড় এবং অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞ। তার সাথে কাজ করার স্বপ্ন আমি পড়া চলা কাল থেকেই দেখে এসেছি। কখনো হয়ে উঠেনি। তাই এটি স্বপ্ন।’
‘ আপনি যথেষ্ট ভালো স্টুডেন্ট ছিলেন মনে হচ্ছে। এত পেশা থাকতে পাগলের ডাক্তার হতে গেলেন কেন?’ নীহারিকার কণ্ঠে পরিহাস। বিমুগ্ধ একবার পিছনে ঘাড় কাত করে তাকিয়ে বলল,’ আমেরিকার গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় এটি। আমি সেখানেই পড়েছি। আর বাবাও এই পেশায় ছিল। আমি তার থেকেই মানুষের মন বুঝার বিশেষ ক্ষমতা শিখেছি। বাংলাদেশের মানুষ দরিদ্র হওয়ায় অনেকে এই রোগে আক্রান্ত হলেও ডাক্তারের কাছে তেমন আসে না। কারণ মনকে গুরুত্ব দেওয়ার মত সময় এই দেশের মানুষের কাছে তেমন নেই। তারা সারাদিন উপার্জন, খাওয়া, ঘুম, অলসতা, কাজে যাওয়া, কাজ করা, এসব নিয়ে ভাবে। জীবনে উঁচু হওয়ার প্রবল ইচ্ছের ফলে নিজেদের দিকে খেয়াল রাখে কম। তাই এ দেশে এই পেশা খুব একটা বিশেষ খাতে নেই। বিদেশিরা এদিকে বহু উন্নত।’
ভারী গলায় নীহারিকা বলল,‘ উন্নত না ছাই। প্রকৃত অর্থে মদ গাঁজা খেয়ে এরা পাগল হয়ে যায়। টাকা বেশি হলে যা হয়। ফলে আপনাদের মত পাগলের ডাক্তারের প্রয়োজন হয়। আমাদের দেশের মানুষ যথেষ্ট সুস্থ। এখানে আপনার ভাত নেই। নিজের দেশে ফিরে যান। পাগলের ডাক্তার।’
‘ এটিও আমার দেশ। তাই আমি ব্রিটিশদের কায়দা এপ্লাই করছি।’
‘ কিভাবে?’ আগ্রহের সাথে ঝুঁকে বসল নীহারিকা। বিমুগ্ধ একটু ভেবে প্রগাঢ় গলায় বলল,’ যেমন ওরা সারা পৃথিবী থেকে চুরি করে নিজের দেশকে উন্নত করেছে। ঠিক একুই ভাবে আমি সারা পৃথিবী থেকে কিছু না কিছু শিখে নিজের দেশের কাজে লাগাতে চাই। আইডিয়া ভালো না?’ নীহারিকা ছোট করে তালি দিয়ে উচ্চধ্বনিযুক্ত কণ্ঠে বলল,’ আপনার মাথায় বুদ্ধি আছে। যতটা গাঁধা ভেবেছিলাম ততটা আপনি নন।’ বিমুগ্ধ চমৎকার করে হাসল। হঠাৎ গাড়িটা শব্দ করে থামে। নীহারিকা ছিটকে সামনের সিটের সাথে কপালে ধাক্কা খায়। আজকের এই ধাক্কাধাক্কির দিনটি যেন শেষই হচ্ছে না। তার বিমুগ্ধকে চিৎকার করে অকথ্য ভাষা শুনিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু সব সময় নিজের ইচ্ছেকে সমান তালে স্বাধীন ভাবে চলতে দেওয়া বিপদ। সে ভাবল হয় তো বাড়ির সামনেই চলে এসেছে। নামতে গিয়ে হতবাক হয়ে গেল। বিমুগ্ধের দিকে তাকাল সে। সে নিজেকে আয়নায় দেখতে ব্যস্ত। ছেলে মানুষের এত ঢং! বিমুগ্ধ বের হতে হতে বলল,’ ড্রাইভারের সাথে সাথে বডি গার্ডের দায়িত্বও পালন করতে হবে?’
‘ আমি এখানে কি করছি?’ বেশ জোড়পূর্বক গলায় জানতে চাইল নীহারিকা। চোখের সানগ্লাস পড়ে নিয়ে বিমুগ্ধ তাকাল,’ সে তো আপনি জানেন। চোখ তো আপনারও আছে।’
চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নীহারিকা দেখল এটি একটি রেস্টুরেন্ট। কয়েক বছরে বেশ নাম ডাক হয়েছে এমন একটি রেস্টুরেন্ট এটি। সে কয়েকবার শুনেছে প্রিয়মের কাছে। খাবার না কি অসাধারন। তার চেয়েও বেশি অসাধারণ ভিতরের পরিবেশ। প্রিয়ম অনেক ছবিও তুলেছে। সাধারণত প্রিয়ম ছবি তুলতে পছন্দ করে না। এই রেস্টুরেন্টে স্পেশাল কিছু তো আছে। বিমুগ্ধ সামনে এগিয়ে যেতে যেতে বলল,’ দ্রুত আসুন। পালানোর চেষ্টা করলে এই রেস্টুরেন্টের সব থালাবসন আপনাকে দিয়ে পরিষ্কার করানো হবে।’
‘ আমি পালাবো কেন? ‘ নীহারিকা পিছনে আসে ছোট ছোট পা ফেলে। মুখটা তার কিঞ্চিত চঞ্চল। ঠিক ডুব দেওয়া সূর্যের মত। মুখের মাঝে পরমানন্দিত হাসি ঝুলিয়ে বিমুগ্ধ বলল,’ আপনার তো পালানোর স্বাভাব আছে তাই বলেছি।’
দীর্ঘশ্বাস ফেলল নীহারিকা। এত তর্ক বিতর্ক করতে পারে লোকটি! আজ নীহারিকার কি যেন হলো। সে সময়কে ভুলে গেল। ঘড়ি দেখতে ভুলে গেল। দ্রুত ফিরার কথাও মনে নেই। তার এত ভুলের মাঝের কিছু অংশ ছিল খুবই গরুতর। যেমন খুব পাশেই তার বাবার অফিস!
রেস্টুরেন্টের নামটা এতটাই অদ্ভুত যে মানুষ বেশ কিছুক্ষণ সেটা নিয়ে চিন্তায় পড়ে যাবে।
“ water hyacinths pond “ “ কচুরিপানার ডোবা “। আজবের একটি কারখানা এই শহর। যখন তখন চমকে দিতে পারে। যেমন নীহারিকা এই কচুরিপানার ডোবার নাম শুনে চমকে যাচ্ছে। ভিতরের পরিবেশ দেখে সে আরও চমকে গেল। সীমাহীন সৌন্দর্য্যে ভরা রেস্তোরা। কোন মিউজিক নেই। শুধু পাখিদের কিছু শব্দ ভেসে আসছে পিছনের দিক থেকে। তাও খুব মৃদু ভাবে। বিশাল জায়গা জুড়ে রেস্টুরেন্ট। সব টেবিলে একটি জিনিস খুব কমন। তা হলো কচুরিপানা। নামের সাথে সামঞ্জস্য রেখেই এটির আয়োজন। কিন্তু এত ফুল হয় কোথায়? কথাটা ভাবতে ভাবতেই নীহারিকা টেবিলের সাথে ধাক্কা খেল। এবার ব্যথা পেল পায়ে। বিমুগ্ধ কর্ণারের একটি টেবিলে উপস্থিত হল। সব গুলো টেবিল গোলাকার। সাধারণত প্রতিটি রুমের কোনা হয় চারটি। কিন্তু এই রেস্টুরেন্টের কোনা ছয়টি। অবাক হওয়ার মত ব্যাপার হলেও এটি সত্য। আলোটা খুব নিম্ন উজ্জ্বল। সোনালী রং ছড়িয়ে দিচ্ছে চারপাশে। টেবিল চেয়ার সব কিছু সাদা আর ছাই রঙ্গের মিশ্রনের ফলে সতেজ দেখাচ্ছে। চেয়ার টেনে দিয়ে বিমুগ্ধ বলল,’ এখানে বসে থাকুন আমি না আসা পর্যন্ত।’ কথাটা বলেই সে একটি ছোট দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকে গেল। নীহারিকা এতই মগ্ন হয়ে দেখতে লাগল যে তেমন লক্ষ্য করতে পারল না। টেবিলের উপরে রাখা ছোট ছোট ফুলদানি গুলোর গায়ে বিশেষ কারুকাজ খচিত। প্রতিটির রং সাদা। টেবিলের উপরে রাখা কাপড় থেকে শুরু করে ছোট বাটিগুলোও সাদা। শুধু কচুরিপানা বেতিত। সব সাদা রঙ্গের সাথে সে নিজেকে মিলিয়ে যাচ্ছে। এক এক টেবিলের ফুল এক এক রঙ্গের। কোনটি নীল। কোনটি আবার হাসকা গোলাপি। কিছু কিছুর রং বেগুনী। একটি ফুলের এত রং এক সাথে দেখতে পারাই মুগ্ধকর। অনেক সময় পরে নীহারিকা খেয়াল করল তার টেবিলের ফুলগুলোর রং কিছু নীল, কিছু গোলাপি, কিছু বেগুনী তো কিছু সাদা। সে চোখ ঘুরিয়ে সব টেবিল দেখল। তারপর দেখল নিজেরটা। এটি সম্পর্ন আলাদা টেবিল। যেমন এর রং ভিন্ন তেমন এর মাঝের সব জিনিস ভিন্ন। কেন? বিমুগ্ধ কই? তাকে প্রশ্নটা করতে হবে। নীহারিকা এবার বিমুগ্ধকে খুঁজতে শুরু করল। তার খুব ক্ষিদেও পেয়েছে। সে অর্ডার করার জন্য পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেকে ডাক দিল। একটি ছেলে খুবই ভদ্র ভঙ্গীতে এসে পাশে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করল,’ বলুন মিস।’ এখানের সবাই শুদ্ধ বাংলায় কথা বলে। তবে এরচেয়েও মজার কথা যারা গ্রাম থেকে আসে তাদের সাথে এরা তাদের ভাষায় কথা বলছে। সব শ্রেনীর মানুষ রয়েছে এখানে। যারা নিয়ম জানে না। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে এমন সব মানুষের সাথে কিছু আলাদা লোক নিয়োগ রয়েছে। যাদের গায়ের ড্রস কোড নেভি ব্লু। বাকিদের গায়ের শার্ট সাদা। কিছু মেয়ে কর্মচারীকেও দেখা যাচ্ছে। খুবই নামিদামীই মনে হচ্ছে নীহারিকার। কিন্তু কিছু মানুষকে দেখে সে অবাক হচ্ছে। এরা ঢুকেছে কিভাবে? কারণ সাধারণত এসব মানুষকে কখনো ভালো রেস্টুরেন্ট গুলোতে ঢুকতে দেওয়া হয় না। খাবারের দাম যথেষ্ট কম। নীহারিকা বিড়বিড় করে বলল,’ বাপরে বাপ রেস্টুরেন্টের মালিক তো খুবই ভালো মনে হচ্ছে। আমাদের মত গরিবের জন্যেই এই রেস্টুরেন্ট।’ সে নিজে নিজে হাসল। স্টুডেন্ট মানুষরা এক প্রকার গরিবই হয়। ছেলেটি অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। প্রশ্ন করল না। বিরক্ত হলো না। মুচকি হাসি ঝুলিয়ে রেখেছে সে। তার গায়ের রংটা হাসির কাছে হার মানতে বাধ্য। নীহারিকা মেনু কার্ড দেখে বলল,’ এই খাবার গুলোকি এখন পাওয়া যাবে?’
ছেলেটি অত্যন্ত ভদ্রতার সাথে বলল,’ যাবে। কিন্তু দুঃখিত মিস। আপনার অর্ডার নিতে নিষেধ করা হয়েছে।’
চোখ বড় বড় করে নীহারিকা বলল,’ কে করেছে? কেন করেছে? আজব পাবলিক। খেতেই যখন পারবো না থেকে কি হবে।’
ছেলেটি আরও বিনিত হয়ে পড়ল, ‘ মিস আপনি যেতে পারবেন না। স্যার বলেছে যতক্ষণ তিনি না আসছে আপনি যেন এখানেই থাকেন।’
‘ এই স্যার আবার কে?’ দ্বিধাগ্রস্ত কন্ঠ তার। ছেলেটি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। কয়েক সেকেন্ড পরে বলল,’জিনি আমাদের স্যার। তিনিই এই স্যার।’
‘ সেই জিনি তিনি টা কে? ‘ বিরক্তি নিয়ে বলল নীহারিকা।
‘ তিনি স্যার মিস।’ ছেলেটি এবার রোবটের মত দাঁড়িয়ে পড়ল। মনে মনে নীহারিকা বলল,’ আপনার মাথার তার কি ছেঁড়া?’ কিন্তু সামনে কিছুই বলল না। টেবিলে সে মাথা ফেলে শুয়ে রইল। বিমুগ্ধ কোথায় গেল ভাবতে ভাবতেই তার ঘুম চলে আসল। এসির ঠান্ডা কন কনে বাতাসের সাথে বাহিরের মেঘ মেঘ ভাব যুক্ত হচ্ছে। পরিবেশ ঠান্ডা ঠান্ডা। চারপাশের সুন্দর ঘ্রাণ আরও জাদু করছে। গভীর ঘুম যখন নীহারিকাকে জড়িয়ে ধরল নিজের কোমল স্পর্শের সাথে ঠিক তখনই তার এত সুন্দর ঘুম নষ্ট করে দিয়ে টেবিলে শব্দ করে উঠল কেউ। নীহারিকা লাফিয়ে উঠে দেখল বিমুগ্ধ টেবিলে কাঁটা চামচ দিয়ে শব্দ করছে। নীহারিকার চোখ লাল হয়ে উঠল। তার মাথাও ধরল ভালো করে। তাকে এলোমেলো দেখাচ্ছে। বিমুগ্ধ ধিমি কণ্ঠে একটি মেয়েকে ডাক দিয়ে বলল,’ মিস জেবা উনাকে ওয়াশরুমে নিয়ে যান।’ নীহারিকা কিছু বলতে চাইল। কিন্তু বলতেই পারল না। মেয়েটি তার পাশে এসে যাওয়ার জন্য বলতে শুরু করল।
ওয়াশরুমে ঢুকে নীহারিকা পানির মাঝে নিজের মুখ চুবিয়ে রাখল অনেকক্ষণ। তার মাদকের মত ঘুম পাচ্ছে। নেশালো অনুভূতি হচ্ছে। শরীর ভার ভার লাগছে। কি ঘুমটাই না এসেছিল। বিমুগ্ধ তার জীবনের শনি। এত অসহ্য মানুষ সে লাইফে দেখেনি। ঘুমিয়ে ছিল কোথায় ঘুমাতে দিবে তা না উঠিয়ে দিল। এমন মানুষ হয়? বাহির থেকে মৃদু শব্দ শুনা যাচ্ছে। নীহারিকা দরজা হালকা খুলে শুনতে চাইল। মিস জেবা তার একজন সহকর্মীর সাথে গল্প করছে দেয়ালে হেলান দিয়ে। মেয়েটি চোখ কপালে তুলে বলল,’ তুমি সত্যি বলছ?’
জেবা বেশ ভাব নিয়েই বলল,’ অবশ্যই। আমি নিজে তাকে নিয়ে এসেছি। ওয়াশরুমেই আছে। আস্তে কথা বলো।’
‘ তুমি শিউর এই মেয়ে স্যারের গার্লফ্রেন্ড?’
‘ আরে না। গার্লফ্রেন্ড হবে কেন? দেখে গার্লফ্রেন্ড মনে হচ্ছে না। বোরকা পড়া। একটু অদ্ভুত। তবে স্যার এই প্রথম কোন মেয়েকে নিজের রেস্টুরেন্টে নিয়ে এসেছে। এমন কি তিনি অন্যটিতেও কোন মেয়ে নিয়ে কখনো যায়নি। শুধু তার মাকে নিয়ে এসেছিল দু’বার।’
‘ অন্যটির খবর তুমি জানো কিভাবে? তুমি তো এখানে কাজ কর।’
এবার জেবা নিজের চুল হাতের একটি আঙ্গুলে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বলল,’ তাযিন স্যারের সব খবর আমার কাছে পাবে তুমি। দেখনি উনি কেমন নিজের সব কাজে আমাকে ডাকে।’
মেয়েটি নাক ছিটকাল। জেবাকে সে খুব একটা পছন্দ করে না। কিন্তু এটা সে প্রকাশও করে না। কিছুসময় পরে হেসে হেসে বলল,’ এটা প্রথম ছিল। আর উনি মেয়ে বলে তোমাকে ডেকেছে। নিজেকে স্পেশাল ভেবে কাজ নেই।’
‘ অবশ্যই আমি স্পেশাল। তুমি কখনো তাযিন স্যারের হাতের খাবার খেয়েছ? আমি খেয়েছি। বিশ্বাস কর অস্থির খেতে। আমি স্পেশাল তাই তো খেয়েছি। স্যার সাপ্তাহে মাত্র দু’বার খাবার তৈরি করে। বুঝতেই পারচ্ছ।’ গলার পাশে হাত দিয়ে চুল সরিয়ে জেবা পাশে তাকাতেই নীহারিকাকে দেখে নিল। দ্রুত সোজা হয়ে গেল নীহারিকা। চোখ ছোট করে তাকাতেই জেবা ভদ্র ভাবে বলল,’ দুঃখিত মিস। আপনি কখন বের হয়েছেন?’
‘ বেশি সময় হয় নি।’ নীহারিকা যখন সামনে হাঁটতে শুরু করল জেবা পিছন পিছন আসতে লাগল। নীহারিকা নিষেধ করে বলল,’ আমি যেতে পারব মিস জেবা।’
‘ কিন্তু স্যার আমাকে দাঁয়িত্ব দিয়েছে মিস।’ জেবা মনে মনে ভয় পাচ্ছিল। তার কপাল বেয়ে ঘাম ঝরতে লাগল। তাযিন খুব অদ্ভুত। সে খুব কম খুশি হয়। যখন খুশি হয় সে খুবই সুন্দর ব্যবহার করে তার স্টাফদের সাথে। যদি ক্ষেপে যায় তো বিপদ। সে যে এত কথা বলেছে সব যদি নীহারিকা স্যারকে বলে দেয়? চাকরীটা চলেও যেতে পারে। সফিক স্যারকে বলেও তখন কাজ হবে না। নীহারিকা ঠোঁট টিপে হেসে বলল,’ ভয় পাওয়ার কিছু নেই আমি কিছুই বলব না। ভুলটা আমার। কারণ আমি লুকিয়ে শুনছিলাম। কারো কথা লুকিয়ে শুনা অনেক বড় অন্যায়। আমার বাবা বলে। তাই দুঃখিত।’ পিঠ চাপড়ে দিল নীহারিকা। জেবার পা থেমে গেল। নীহারিকা হাসতে হাসতেই টেবিলের কাছে গেল। তার বেশ মজা লাগে কাউকে নিজের আচরণ দ্বারা অবাক করে দিতে। বিমুগ্ধের গায়ে কালো শার্ট। ডান পাশ থেকে শার্টের বিশেষ অংশ এসে বাম পাশে থেমেছে। বুতাম গুলো এক পাশের কাধ থেকে বুক বেয়ে অন্য পাশের কাধে এসে একদম নিচের দিকে নেমেছে। হাতের বাহুতে একটি ছোট পকেট রয়েছে। যার ভিতরে ছোট কাঠের চামচের ছবি লক্ষ্যনীয়। বুকের এক পাশে কিছু লেখা যুক্ত প্লেট যার উপরে খাবারের ছবি এবং আগুনের ছবি ও রয়েছে। বিমুগ্ধ হাতা হালকা উঠিয়ে বলল,’ দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বসুন।’
নীহারিকা অবাক হয়ে প্রশ্ন করল,’ শেফ কোট কেনো পড়েছেন? আপনি এই রেস্টুরেন্টের শেফ?’
খাবার পরিবেশন করতে করতে বিমুগ্ধ বলল,’ না। chief chef।’
নীহারিকা আগ্রহীত হয়ে চেয়ার টেনে দ্রুত বসল,’ আপনি কবে থেকে রেস্টুরেন্টে কাজ করছেন?’
‘ সব সময় না মাঝে মাঝে আসি।’ বিমুগ্ধকে খুব মনোযোগী দেখাল নিজের কাজের প্রতি। নীহারিকা একটু জোড়ে বলল, ‘ তবুও কাজে রেখে দিল?’ কথাটা শুনা মাত্র অনেকে তাদের দিকে তাকাল। বিমুগ্ধ চেয়ারে হেলে হাসল। সবাইকে চোখের ইশারা করল। তারপর নীহারিকাকে বলল,’ মেয়েদের কণ্ঠ এত বড় হওয়া উচিত নয়।’
এবার নীহারিকা একদম কাছে ঝুঁকে আস্তে করে জানতে চাইল,’ আপনি সত্যি শেফ? তাও এই রেস্টুরেন্টের? এটা অনেক নাম করা রেস্টুরেন্ট। মাত্র কিছুদিনেই বেশ নাম ডাক হয়েছে। বুঝেন এবার কত দক্ষ এটি। আপনি কিভাবে কাজ পেয়েছেন? আপনি তো ডাক্তার। পাগলদের সাথে থাকতে হয় বেশিরভাগ সময়। মাঝে মাঝে কাজে আসলেও আপনাকে রেখে দিল?’
এত এত প্রশ্ন শুনে বিমুগ্ধ হাসতে শুরু করল। নীহারিকা চুপ হয়ে গেল। চারপাশে তাকাতে লাগল। বিমুগ্ধ একটি চামচ ধরিয়ে দিতে নীহারিকার হাত ধরতে গেল। সাথে সাথে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল নীহারিকা। শাসিয়ে বলল,ভুলেও হাত যদি ধরেন আপনার খবর করে দিব।’ বিমুগ্ধ ভয় পাওয়ার ভং ধরল। নিজেকে গুটিয়ে বলল,’ ও মাই গর্ড।’ সাথে সাথে নীহারিকা আবার প্রতিবাদ করে বলল, ‘ একদম নাটক করবেন না। মেজাজ এমনেই গরম আছে।’ বেশিরভাগ স্টাফের চোখ তাদের টেবিলে। যা দেখে বিমুগ্ধ চোখ গরম করে তাকায়। নীহারিকাও তা দেখে ভয় পেয়ে যায়। সবাই দ্রুত নিজেদের দৃষ্টিসংযত করে।
‘ এটি আমার রেস্টুরেন্ট নীহারিকা। কেউ আমাকে বের করতে পারবে না যতক্ষণ আমি নিজে চাইব না। আব্বিও পারবে না। কারণ এটি সম্পূর্ণ আমার। আমেরিকায় আমাদের রেস্টুরন্ট রয়েছে। সেখান থেকেই অভিজ্ঞতা নিয়ে এসেছি। আমি শেফের কোর্স করেছি আব্বির কাছে। ছোট থেকে রান্না আমার হবি। আমার আব্বিও ভালো শেফ। সাথে তিনি একজন মনোবিজ্ঞানী। এই কাজ গুলো আমাদের পেশা নয়। শুধু নেশা। প্রিয় মানুষের জন্য এই নেশার জন্ম। আমি প্রিয়দের জন্য রান্না করতে পছন্দ করি। সবার জন্য নয়। এতে আমি একপ্রকার প্রশান্তি পাই। এবার খাওয়া শুরু করা যাক।’
এবার সব পরিষ্কার হলো নীহারিকার কাছে। কেন মেয়েগুলো স্যার স্যার বলছিল। বিমুগ্ধ এত মিষ্টি মধুর করে কথা গুলো বলল যে নীহারিকার মনে হতে লাগল থেমে গেল কেন? আরও কিছু কথা বলুক না। কথা বলা তো দোষের নয়। একটি মানুষের সব জিনিস কিভাবে সুন্দর লাগতে পারে? তার কথা সুন্দর, আচরণ মনে ধরার মত। আর সবচেয়ে সুন্দর তার হাসি। যা হৃদয় কাড়া। কিছু কিছু মানুষের জন্মই হয় কিছু মানুষের চোখে ভালো লাগার জন্য। যেমন এই মানুষটির। নীহারিকা খাবার খাওয়ার সময় দেখল বিমুগ্ধ খুব নিম্ন শব্দ করে খায়। কথা বলে না। ডান পাশ থেকে খাওয়া শুরু করে। খাওয়ার মাঝে একবারও পানি পান করে না। চামচে বিন্দু পরিমান শব্দ হয় না। সে একদম নিঃশব্দে খাবার খেতে যানে। খাবার গুলোর নাম উচ্চারণের সময় নীহারিকার মনে হলো তার দাঁত ভেঙ্গে প্লেটে চলে আসবে। এত অদ্ভুত খাবার বা নাম কোনটিই সে শুনেনি। এগুলো বিমুগ্ধের সিগনেচার আইটেম। ভেবেছিল জঘন্য হবে। কিন্তু বিমুগ্ধের হাতে যেন জাদুর ছোঁয়া আছে। এত অসাধারণ খাবার একটি ছেলে রান্না করতে পারে ভাবতেই তার শরীর মন হতবাক হয়ে গেল। ভালো লাগায় তার গলা রিনরিন করে উঠল। তবুও সে একফোঁটা প্রশংসা করলো না। বলল না যে আপনার রান্না মারাত্নক, জাদু আছে হাতে, আপনার হাতটা একটু ছুঁয়ে দেখি, বা কেঁটে আপনার হাত বাড়িতে নিয়ে যাই। সে শুধু খেয়েই গেল।
বিমুগ্ধ খাবারের বিল তৈরি করে দিল নীহারিকাকে। বিল দিতে দিতে নীহারিকা মনে মনে বলল,’ আস্ত কিপটা। প্রথম তার রেস্টুরেন্টে এসেছি কোথায় নিজে বিল দিবে। উল্টো কাগজ ধরিয়ে দিল। জীবনেও মানুষ হবে না এই লোক।’
টাকা গুলো বিমুগ্ধ গুনে গুনে নিল। নীহারিকা আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে রইল। কেমন ছেলে? পুরো ছেলে জাতির ইজ্জত ডুবিয়ে ছাড়বে। একটি মেয়েকে দিয়ে বিল দেওয়াল?
নিজের পোশাক পাল্টে এসে বিমুগ্ধ দেখল নীহারিকা নেই। সে দ্রুত ছুঁটে বের হয়ে খুঁজতে শুরু করল। আজ তার ভাগ্য তার সঙ্গী। সে কখনো নিজে থেকে নীহারিকার সাথে দেখা করে না। ভাগ্য তাদের দেখা করিয়ে দেয়। ভাগ্যের দেওয়া সামান্য সময় তার কাছে অনেক। সে হারাতে চায়না সময় গুলো। কুড়িয়ে নিতে চায় নিজের বুক পকেটে। তাদের সম্পর্কটাই অদ্ভুত সুতোয় বাঁধা। নীহারিকা হাঁটছে সরু রাস্তা ধরে। মাথার উপরে বিশাল আকাশ তার। চারপাশের পরিবেশ ঝিমঝিম ধরে রয়েছে। বৃষ্টির সময়টা সুন্দর। কিন্তু সে চলে গেলে রেখে যায় বিষন্নতা। ঠিক ব্যর্থ ভালোবাসার মত। আশেপাশের গাছগুলো দেখতে দেখতে সে হাঁটছিল। গুটি কয়েক পা ফেলে আবার দাঁড়িয়ে গেল। নিজে নিজে সে চোখ মুখ কুঁচকে বলল,’ শয়তান লোক একটা। কে বলেছিল রেস্টুরেন্টে নিয়ে যেতে? সব টাকা শেষ। এখন হেঁটে যেতে হবে। ওহ।’ নীহারিকা দীর্ঘশ্বাস নেয়। এখান থেকে বাসার দূরত্ব অনেক বেশি। রিকশা পাওয়া যাচ্ছে না। তার কাছে টাকাও নেই। যদি বাড়ি গিয়ে টাকার খোঁজ করে মা অনেক ঝারি দিবে। মানুষটার সাথে দেখা হলেই সে বিপদে পড়ে। নীহারিকা উপরের দিকে তাকিয়ে কিছু বলল। সৃষ্টিকর্তার কাছে সে বিচার প্রদান করল। তারপর আবার ধিরে ধিরে হাঁটতে শুরু করল। একটু হেঁটেই তার পা ব্যথা হয়ে উঠল। দেরি হয়েছে? আরও দেরি করবে। আজকে সে অনেক বকা খাবে। দরকার হলে এক ঘন্টার বদলে দু’ঘন্টা বকতে বলবে। খারাপ দিনকে খারাপ দিয়েই বিদায় করবে সে। বিরক্তি নিয়ে নীহারিকা রাস্তার পাশে বসে পড়ল। সে একা একাই ভাবনায় বিভোর। কি নিয়ে সে নিজেও জানে না। আকাশে আজ সূর্য উঠেনি। চাঁদও উঠবে না। সারা দিন বৃষ্টি হলেই পারত। মনে মনে সে দোয়া করে দিল। যাতে প্রচুর বৃষ্টি হয়। সে ভিঁজে চুপচুপ হয়। তার পায়ের জুতো যাতে ছিঁড়ে যায়। একটি গাড়িও যাতে সে না পায়। এই পিচঢালা কঠিন রাস্তা জুড়ে হেঁটেই যেন তাকে বাড়ি যেতে হয়। সে ফুঁ দিয়ে শ্বাস ছাড়তে লাগল। বৃষ্টি আজ তার। শুধু তার। দোয়া কবুল হয়ে গেল। ঝুমঝুম করে নামল সে। নুপুরের ঝুনঝুন শব্দ তুলল রাস্তার বুকে। দু’হাত তুলে নীহারিকা হাসতে লাগল।
, ‘ বলা মাত্র হাজির হবে জানলে আরও কিছু দোয়া করে দিতাম।’
‘ কি কি দোয়া করতেন?’ কথাটা বৃষ্টির পানিতে ভিঁজা ভিঁজা শুনাল। চমকে উঠে নীহারিকা পাশে তাকাল। সাথে সাথে সে বিরক্ত হয়ে বলল,’ আপনার সমস্যাটা কি?’
‘ সুস্থ মানুষের কিসের সমস্যা। আমি সমস্যা সারিয়ে তুলি। ডাক্তার আমি। ভুলে গেলেন?’
রেগে গেল নীহারিকা। এত সময়ের চেয়ে অনেক অনেক বেশি। সে উঠে হাঁটতে শুরু করল। বিমুগ্ধ পিছন থেকে বলল,’ হাত ধরব কিন্তু এখন।’
নীহারিকা পা থেকে জুতো গুলো খুলে রাস্তায় ছুঁড়ে দিল। আশেপাশের অল্প মানুষজন তাদের পাগলামি দেখে চোখ উল্টেপাল্টে তাকাচ্ছে। এতে কিছু যায় আসে না নীহারিকার। আপাতত তার রাগ আকাশচুম্বি। কারণ বিমুগ্ধের জন্যেই তার এত দেরি হয়েছে। হচ্ছে, আল্লাহ জানে আর কত হবে। বিমুগ্ধ রাস্তা থেকে জুতো কুড়িয়ে নিল। তার জুতোর রং বাদামি। ফিতে যুক্ত। একদম মাটির সাথে লাগানো জুতো। বিমুগ্ধ পিছন থেকে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল,’ আপনি হিল পরেন না?’
পিছনে ঘাড় ঘুরিয়ে নীহারিকা চেঁচাল,’ আপনি এখনও পিছনে পিছনে হাঁটছেন? চিৎকার করলে কিন্তু মানুষের হাতে মার খেতে হবে।’
‘ বিমুগ্ধ এসবকে ভয় পায় না। পিঠ এখনও ব্যথায় কাতর।’
‘ মার আবার পড়বে পিঠে। চিৎকার করব?’ নীহারিকা থেমে ঘুরে তাকাল। দু’জনে ভিঁজে যাচ্ছে। বৃষ্টির পানি একটু ধির হয়েছে। নীহারিকা চোখ ছোট করে রেখেছে। তার গাল কুঁচকানো। কপালে ভাজ পড়া। বিমুগ্ধ এবার বসে পড়ে বলল,’ বসুন তারপর বলব।’
‘ আজ কি আপনি আমার সাথেই থাকবেন বলে ঠিক করেছন? বেশ কঠিন গলায় বলল নীহারিকা। বিমুগ্ধ এতেও মজা পাচ্ছে। হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলল,’ আমি তো সব সময় থাকতে চাই। কপালে নেই কি করব বলুন। আপনার আবার ডাবল জল্লাদ বাপ।’
এবার নীহারিকা বসল। বিমুগ্ধ হাতে একটি প্যাকেট ধরিয়ে দিল। নীহারিকা তাও নিল। খুব শান্ত ভাবে সে জানতে চাইল,’ আমার বাবার সাথে আপনার কি কখনো দেখা হয়েছে?’
বিমুগ্ধ নিজেই সেই প্যাকেট খুলে জিলাপি বের করল। চিকন মিহি ছোট জিলাপির টুকরো গুলো দেখতে প্রচন্ড সুন্দর। নীহারিকা তাকিয়ে রইল সেই জিলাপির দিকে। এটি তার খুব প্রিয়। মিষ্টি সে পছন্দ না করলেও জিলাপির প্রতি তার চরম দূর্বলতা রয়েছে। প্রিয়ম এবং সে তো অনেক জিলাপি এক সাথে এক বসায় খেতে পারে। বিমুগ্ধ কিভাবে জানল? এত রহস্য একটি মানুষের মাঝে থাকাটা কতটা যৌক্তিক? বিমুগ্ধ সারাক্ষণ হাসছে। তার হাসি কখনো একটু কমছে তো কখনো একটু বাড়ছে। ঠিক যেমন বৃষ্টি খেলছে। বিমুগ্ধ জিলাপি খেতে ব্যস্ত।
নীহারিকাও আজ বসে রইল। একটি কথাও বলল না। ভিঁজে উঠা মাঝের সরু চুলগুলো পিছনে ঠেলে দিয়ে বিমুগ্ধ এবার বলল,’ তার সাথে আমি দেখা করতেও চাই না।’
‘ আমার সাথেও করবেন না। এটাই যেন শেষ হয়। কাল এসে টাকা নিয়ে যাবেন। আমার সব খবর তো থাকে ভার্সিটির খবরও নিশ্চয়ই রয়েছে। সেখানে আসবেন।’ বিমুগ্ধ প্রচন্ড জোড়ে হাসতে শুরু করল।
‘ আপনার সাথে আমার কখনো ঘটা করে দেখা হওয়া সম্ভব না। ভাগ্যে থাকলে হবে।’
‘ আপনার ফালতু ভাগ্য নিয়ে আপনি থাকুন। আমার সাথে আর দেখা করবেন না। কাল টাকা নিতে চলে আসবেন।’ ঝাঁঝাল সুরে বলল নীহারিকা। বৃষ্টির পানি তার ঠোঁট ভিঁজে গড়িয়ে পড়ছে। বিমুগ্ধ ভারী হওয়া কণ্ঠে বলল,’ আপনি বাবার মতই হয়েছেন।’
মাথা কাত করে নীহারিকা গর্ভের সাথে বলল,’ কারণ আমি বাবার মেয়ে।’
‘ খাচ্ছেন না কেন?’
‘ আমি জিলাপি খাই না।’ একটি জঘন্য মিথ্যে বলে দিল সে। বিমুগ্ধ বিনিময়ে হাসল। নীহারিকার হঠাৎ মনে পড়ে ফোনের কথা। সে যে বন্ধ করে রেখেছিল আর তো খোলোই হয়নি। দ্রুত সে ফোনটি ব্যাগে রেখেই চালু করে। তারপর সেটাতে সকালের পেচানো পেকেট সহ কানে ধরে। মা আর্তনাদ করে কথা বলতে শুরু করলেন। প্রথমে ইচ্ছে মত ঝাড়ি দিলেন। তারপর খুবই গুরুতর তলব করে বলল,’ তুই দ্রুত বাসায় আয়। একটা ঘটনা ঘটে গেছে।’
নীহারিকা উত্তেজিত হয়ে জানতে চাইল,’ কি ঘটেছে মা।’ আফিয়া বললেন না। শুধু বললেন অনেক গুরুতর। দ্রুত ফিরে আয়।’ নীহারিকা শুনতে পেল বাসায় বাবার খুব গম্ভীর গলা পাওয়া যাচ্ছে। তিনি কাউকে খুব জেরা করছে। আফিয়া বিলকিস দ্রুত ফোন রাখতে রাখতে বলল,’ নীহা তুই দ্রুত আয়। হায় আল্লাহ এটা কি করল।’
মায়ের কথা শুনে আতঙ্কিত হয়ে নীহারিকা বাড়িতে ফিরার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। আশেপাশে চোখ ঘুরিয়ে সে গাড়ি খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। বিমুগ্ধ এই প্রথম জানতে চাইল,’ খালামনি কেমন আছে নীহারিকা?’ প্রশ্নটা শুনে অবাক হয়ে গেল নীহারিকা। আগে কি বিমুগ্ধ খালামনিই ডাকত মাকে? তার মনে পড়ছে না। কিন্তু আজকের কন্ঠস্বর একদম আলাদা। সে দ্রুত বলল, ‘ ভালো। আপনার বাসার সবাই কেমন আছে? আপনার বাবা কেমন আছে?’
বিমুগ্ধ চোখ তুলে তাকাল। সে নীহারিকার বাবার কথা কখনো সুন্দর করে জিজ্ঞেস করেনি। অথচ নীহারিকা করছে। মেয়েটি কি তার বাবাকে অপছন্দ করতে পারে না? যেমনটা সে করে?
‘ আপনার বাবাকে আমি কিন্তু খুব অপছন্দ করি।’
‘ আমি মানুষকে অপছন্দ করতে পছন্দ করি না। খুব প্রয়োজন না হলে আমি কাউকে অপছন্দ করি না। বড়দের আমি সম্মান করি। এটা আমার বাবা আমাকে শিখিয়েছেন।’ বিমুগ্ধ নিচের দিকে তাকিয়ে রইল। নীহারিকা গাড়ির জন্য অপেক্ষা করতে করতে জানতে চাইল,’ বাই দ্যা ওয়ে আপনার বউ কেমন আছে? নিজের বউকে রেখে এখানে পাগলের মত রাস্তায় ঘুরছেন কেন? তাও অন্য মেয়ের সাথে?’ ভ্রু নাচাল নীহারিকা। কপালে হাত বুলাতে বুলাতে বিমুগ্ধ বলল, ‘ কে আমার বউ? কোথা থেকে এসেছে এই বউ?’ মুখের ভাবটা এমন করল যেন সে এই প্রথম বউ সম্পর্কে শুনেছে। নীহারিকা এবার জিলাপি খেতে নিল। বৃষ্টির পানিতে মিষ্টি কমে গিয়েছে একটু। তবুও দারুন খেতে। নিশ্চয়ই এটি বিমুগ্ধের হাতের তৈরি। কারণ এর স্বাদ রং একদম ভিন্ন। আলাদা।
‘ আপনার হবু বউয়ের কথা জিজ্ঞেস করছি। রুবাইদা আপু কেমন আছে?’
‘ রুবাইদা ভালো আছে। কিন্তু সে আমার বউ নয়।’
‘ হবু তো। একটা হলেই হলো।’ বিয়ে এখনও হয়নি শুনে নীহারিকা একটু অদ্ভুত অনুভব করল। এটার নাম ভালো লাগা না খারাপ লাগা বুঝতে পারল না সে। তার অনুভূতিগুলো খারাপ ভালোর মাঝে পার্থক্য করতে পারছে না। বিমুগ্ধ হঠাৎ আজব একটি বাক্য বলে বসল।
‘ আপনি আমার হবু বাচ্চার হবু আম্মি।’
‘ পাগলের প্রলেপ বকছেন কেন?’ উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল নীহারিকা। তার চোখমুখের আতঙ্ক দেখে বিমুগ্ধ উচ্চ শব্দ বের করে হাসল। পিছনে দু’হাত ঠেসে হাসতে লাগল।
‘ সব হবু বউ, বউ হয় না। আমি কখনো বলিনি সে আমার বউ। বা বউ হবে।’
‘ সব হবু মানেই হবে হবে।’ যুগযুগ থেকে এমনটাই হচ্ছে।’
‘ তাহলে তো অবশ্যই আপনি আমার বাচ্চার আম্মি হচ্ছেন।’
‘ আবার ফাইজলামু শুরু করেছেন। বাড়ি জান আমাকেও যেতে দিন।’
‘ বৃষ্টি স্বাক্ষী আমি ভালোবাসতে জানি।’
নীহারিকা পিছনে ফিরে হেসে বলল,’ আমি কখনো বলেছি জানেন না। বাসার জনকে এসব বলুন। আপনি এখনও ভুলে জাননি ভেবে আমি অবাক হচ্ছি। তবে জিলাপির জন্য ধন্যবাদ।’
‘ আমি অপেক্ষা করেছি। করব। করতেই থাকব।’
নীহারিকা কিছু বলল না। বিমুগ্ধ বৃষ্টি ভেঁজা এই শহরের বুকে কিছু কবির মত লাইন বসিয়ে দিল নিজের ভাষা
দিয়ে,’ love is fire. It will burn you. Will extinguish. Will float.Your heart will shut up. Will transform you into a strange one. It will become the most beloved happiness of your life. Whom you would love to wait.(ভালোবাসা আগুন। এটি তোমাকে জ্বালিয়ে দিবে। নিভিয়ে দিবে। ভাসিয়ে দিবে। তোমার অন্তরআত্নাকে বন্ধী করবে। রূপান্তরীত করবে অদ্ভুত এক তুমিতে। হয়ে উঠবে তোমার জীবনের ভয়ংকর প্রিয় সুখ। যার অপেক্ষা করতে তুমি ভালোবাসবে। )
নীহারিকা ব্যাগ রেখে এসেছিল। পিছনে গিয়ে সে আবার দাঁড়াল বিমুগ্ধের সামনে। সে মজা করে বলল,’আপনি সত্যি অসাধারণ অভিনয় করতে পারেন।’
বিমুগ্ধের চেহারা বিষন্ন হয়ে পড়ে। ঠিক আকাশের মত। অভিনয় করতে করতে তার সত্যিকারের সত্তাটিও বোধ হয় নীহারিকার কাছে হারিয়ে যাচ্ছে। মুখের ভাব দেখে নীহারিকা বৃষ্টির পানি মুখে ছিঁটিয়ে বলল,’ দেখা হলেই বৃষ্টি কেন হয় বলুন তো? শীতের সকালে দেখা হলেও কি বৃষ্টি হবে? ঝুম বৃষ্টি।’
‘ আমি আপনার সাথে রৌদউজ্জ্বল বৃষ্টিতে ভিঁজতে চাই মিস নীহারিকা।’ মাতালতা মিশানো এই সুর হৃদয়ে গিয়ে বিঁধলো। কঠিন হৃৎপিণ্ডের দরজা ধাক্কাল। আঘাতের পর আঘাত করল। দৃষ্টিকে নেতিয়ে নিল। একটি শুভ্র ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ল। বৃষ্টির ঘ্রাণ তার সাথে তালে তাল মিলাল। দূরের অন্ধকার একটু একটু করে জড়িয়ে ধরল শহরকে। খালি হচ্ছে পথঘাট। যাত্রীরা ফিরছে গন্তব্যে। শুধু টুকরো টুকরো বৃষ্টি রয়ে যাচ্ছে। তার পরিবেশ বস করছে শরীর। গাছ মৃদু দুলে নৃত্যু করছে নিজেদের মত। সব এত সুন্দর কেন হয়ে উঠে? যখন মানুষটা আশেপাশে বিচরণ করে। মন যেন স্বর্গে চলে গিয়েছে। চোখ সৌন্দর্য্যের দুনিয়ায় রয়েছে। সুগন্ধিতে ভরে উঠেছে শ্বাস প্রশ্বাস। দৃষ্টি স্থির হতে ভালোবাসে। শুধু দেখতে। এসবই কি সেই অনুভূতি? যা যুগ যুগ ধরে ভালোবাসার নামে চলে আসছে। নীহারিকা মাথা ঝাকিয়ে নেয়। কি সব আজেবাজে চিন্তা। নিজে নিজে হাসে। নিজের দু’গালে আস্তে করে থাপড়ে দেয়। বিমুগ্ধ ব্যাগ এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘ আপনি আমার জীবনের প্রিয় সুখ না অসুখ?’
নীহারিকা উত্যক্ত গলায় বলল,’ বাজে অসুখ। যা ঔষুধ খেলে সেরে যাবে। রুবাইদা নামক ঔষুধ।’
কথাটা বলে নীহারিকা ব্যাগ, জিলাপির প্যাকেট নিয়ে উঠে দাঁড়াল। এই বোরকার অবস্থা করুন। ফেলেই দিতে হবে মেনে হচ্ছে। কিছুদূর হেঁটে যেতেই হাতে টান অনুভব হয়। পিছনে ফিরে সে তাকায়। ঘোলাটে আকাশে সব বিষন্ন দেখায়। বিমুগ্ধ আরও একটু কাছে আসে। নীহারিকার চোখের সামনে সে ফুঁ দেয় তিনবার। তার এই সব আজগুবি কান্ড নীহারিকাকে হাসাচ্ছে। সে হাত ছাড়িয়ে নিতে চেয়ে বলল,’ এসব কি? হাত ধরতে নিষেধ করেছি কিন্তু।’
বিমুগ্ধ কোমল গলায় দুষ্টুমি করে বলল,’ হাত তৈরি করা হয়েছেই ধরার জন্য।’
হাতে বাড়ি দিয়ে নীহারিকা বলল,’ আপনার মত অসভ্য হাত ধরার অধিকার পায় না। ছাড়ুন।’
‘ আপনি আমার জীবনের প্রিয় সুখ। মানুষের জীবনের চরম সত্য অসুখ, খারাপ সময়। আমার জীবনের খারাপ সময়টি আমি পার করার সাহস পাই আপনার জন্য। জীবনে একটি লক্ষ্য থাকা উচিত। যা আপনার জীবনের খারাপ সময় গুলো পার করতে সাহায্য করবে। আপনি আমার জীবনের সেই লক্ষ্য। মানুষ সুখের জন্য অপেক্ষা করে। দুঃখের সময় সুখ হচ্ছে আশার আলো। ভরসা। যখনই খুব খারাপ কিছু আমার সামনে এসে পড়ে তখন আমার মনে একটা কথাই আবির্ভূত হয় এর পরের সময়টা সুখের। রাত হলে সবাই যেমন জানে দিন আসবেই দুঃখ তেমন। দুঃখের সময় শেষ হলে সুখ আসবে। যার অপেক্ষা শক্তি বাড়ায়। দুঃখকে নিরোধ করার চরম সেই শক্তি সুখ। এটাই অপেক্ষার মজা। অপেক্ষা শেষ হলেই আনন্দ। সবারই উচিত দুঃখের স্বাদ নেওয়া। তাহলেই সুখের দেখা পাবে। আপনি আমার জীবনের সেই সুখ। যাকে আমি সব সময় নিজের মত সময়ের তালে চলতে দিয়েছি। সময় ঘুরে আপনি আমার ভাগ্যে ফিরে আসবেন এই আশায়। সুখের আশায়। তাই আপনি আমার প্রিয় সুখ। প্রিয়দের মাঝের প্রিয়।’
কথাটা বলেই বিমুগ্ধ নীহারিকার হাতের উপরে মসৃণ পিঠের দিকে মাথা ঝুঁকিয়ে নিল। কিন্তু সে হাত ছেঁড়ে দিয়ে নিজের হাতের তালুতে উত্তপ্ত হয়ে উঠা গরম লাল ভিঁজা ঠোঁট জোড়া বসিয়ে অনুভূতি জমা করল। বাতাসের সাথে মিশিয়ে তাকে নীহারিকার দিকে ছুড়ে দিয়ে বলল,’ তাযিন হয়ে, প্রয়োজন ছাড়া হাত না ছোঁয়ার প্রমিস করলাম। বিমুগ্ধ কথা রাখতে না জানলেও তাযিন কখনো ওয়াদা ভঙ্গ করে না।’ রাস্তা নিরব হওয়ার শর্তেও কিছু মানুষ তাকিয়ে হাসছে। বিমুগ্ধ সরে গেল। নীহারিকা স্থির নিরব দৃষ্টিতে তাকিয়েই রইল কয়েক সেকেন্ড। সংবিৎ ফিরে পেতেই সে নিজের হাত অন্যহাতের তালু দিয়ে ঘঁষে রাগী দৃষ্টিতে তাকাল। ছোঁয়াটা তার পছন্দ হলো না বুঝিয়ে দিল। প্রকৃত অর্থে কিছু ছোঁয়া বিষাক্ত হওয়ার শর্তেও পছন্দ হয়। বিমুগ্ধ ঠোঁট কামড়ে হাসল। নীহারিকা ফিরে যাওয়ার জন্য রিকশা, সিএনজি খুঁজল। বিমুগ্ধ নিজের কালো গাড়িটি নিয়ে এসে তার সামনে থামাল। কিন্তু উঠতে বলল না। জানালার কাঁচ নামিয়ে বলল,’ এক’ হাজার তিনশত ষাট টাকা।’
বিমুগ্ধের কথার কোন মানে বুঝল না নীহারিকা। সে হা করে তাকিয়ে বলল,’ মানে কি?’
‘ এই টাকা আমি আপনার থেকে পাব। মানে আমি পাওয়নাদার।’
নীহারিকা কিছু বলতে চাইল। তার আগেই বিমুগ্ধ জানালা বন্ধ করে দিল। এবার প্রচন্ড বিরক্ত হলো সে। এলো ঝড়ের মত চলেও যাচ্ছে ঝড়ের মত। বিদায় তো ঠিক মত দিবে! সে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বিমুগ্ধের কালো মার্সিডিস রাস্তার বুকের পানি গুলো উড়িয়ে দিয়ে উধাও হয়ে গেল। ভাগ্য ক্রমে সাথে সাথেই একটি সিএনজি সেদিক থেকে আসল। নীহারিকা বলার আগেই থেমে গেল। দূরের পথের দিকে তাকিয়ে নীহারিকা হাসল। সে যেমন নিজেকে দেখাতে চায় সে ঠিক তেমন নয়। সে অন্যরকম। অন্য একটি প্রজাতির প্রানী সে। নিজেকে লুকিয়ে রেখে সে অভিনয় করতে পছন্দ করে। তাকে বুঝা কঠিন। একটু কঠিন। কখনো সে মৃদু হাওয়ার মত। তো কখনো সে সুবাসের মত। যা একটু একটু করে ছড়িয়ে পড়ে নিঃশ্বাসে। নীহারিকা বৃষ্টি দেখতে দেখতে ভাবল,’ বাড়িতে কি হয়েছে? হঠাৎ কি হলো? গুরুতর কিছু? নতুন করে ঝামেলার উৎপত্তি। ‘ তারপর সে মাথা বের করে পিছনে তাকাল। তাদের কখনো সময় করে, হিসেব করে দেখা হয় না। হুট করে দেখা হয়। যেখানে পরিকল্পনা থাকে না। যোগাযোগও থাকে না। প্রতিবার বিচ্ছেদের পরের তারা একে অপরের স্মৃতি মনে রাখতে চায় না। তবুও ভাগ্য তাদের হঠাৎ বৃষ্টির মত দেখা করিয়ে দেয়। সত্যি কাকতালীয় বলতে কিছু নেই। তাদের দেখা হওয়া লেখা ছিল। তাই হয়েছে। আবার কখন দেখা হবে? ভাগ্য পড়তে পারার শক্তি কি পৃথিবীর কারো আছে? সে জানে নেই। যদি থাকত তাহলে অবশ্যই সে পড়িয়ে সেই সময় যেনে নিত। খুব নিঁখুত ভাবে সেঁজে হাজির হত। চমকে দিত সে। সাঁজ! নিজেই চমকে যায় নীহারিকা। মাথার উপরে হাতের চারটি আঙ্গুল ঠেকিয়ে থাপড়ে দেয়। কি সব পাগলের মত চিন্তা করছে। বুদ্ধি কি খারাপ হয়ে গেছে? অবাস্তব জিনিস থেকে দূরে থাকা উচিত। তাহলে কষ্ট ব্যথা এসব অনুভব হবে না। নীহারিকা কঠিন হৃদয়ের মেয়ে হলেও সে ভয় পায় এসব জিনিসকে। যা হৃদয়কে ভেঙ্গে অদৃশ্য ভাবে টুকরো টুকরো করে। ক্ষতবিক্ষত করে তুলে কলিজা। এই অনুভূতি গুলো পৃথিবীর সবচেয়ে বিষাক্ত ভয়ংকর অনুভূতি। যা মানুষের জীবনের রাস্তা ঘুরিয়ে মোড় পরিবর্তন করে দিতে পারে। এত কিছু ভেবেও নীহারিকা আবার তার কথা ভাবতে শুরু করে। কিভাবে? কিভাবে তার এত অদ্ভুত আচরণের মানুষের কথা ভাবতে এত ভালো লাগছে? সে কি পাগল হয়ে গিয়েছে? মস্তিষ্কের নিউরন গুলো বোধহয় কাজ করছে না। দু’হাতে নিজের মাথা চেপে নীহারিকা আওয়াজ করে বলল,’ আমি কি অসুস্থ হয়ে পড়ছি! কারো জন্য কিভাবে কেউ অসুস্থ হতে পারে?’ সে এবার জিলাপি খেতে শুরু করল। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে সুস্বাদু খেতে মনে হচ্ছে তার। নীহারিকা এবার ড্রাইভার বৃদ্ধাকে প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বলল,’ দাদু আপনি একটা খেয়ে বলুন তো টেস্ট কেমন?’
ভদ্র লোক প্রথমে নিলেন না। নীহারিকার জোড়ে নিতে বাধ্য হলেন। তারপর জিলাপির মত মিষ্ট করেই হেসে বললেন,’ খুবই ভালো মা।’ নীহারিকা অবাক হয়ে ভাবল,’ শুধু খুবই ভালো? কিন্তু তার তো আরও বেশি ভালো লাগছে! আজ বাসায় গিয়েই সে বাবাকে বলবে তাকে ডাক্তার দেখাতে। নীহারিকা এবার চেঁচিয়েই বলল,’ বাবা তোমার মেয়ে পাগল হয়ে যাচ্ছে।’ প্রকৃত অর্থে ভালোবাসাগুলো কিছুটা পাগলামি বটে। তাই তো ভালোবাসা অন্ধ হয়। অন্ধকারের মত ঘটঘুটে কালো। যার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত অদৃশ্য। ঠিক তাদের মত। যেমনটা তাদের ভাগ্য অদৃশ্য।
_____________________
ভুলগুলো আল্লাহর দেওয়া মহান গুন ক্ষমার চোখে দেখবেন।
সবার জন্য রইল অন্ধ অদৃশ্য ভালোবাসা।
@হাফসা……..