প্রিয় সুখ-২২
___________________
গোলির মোড়টি বেশ জমজমাট। দোকান পাট সব সামনে। দু’পাশে ফার্মেসি রয়েছে দু’টি। তার একটু ভিতরে প্রবেশ করতেই সবজির ছোট বাজার বলা চলে। হরেক রকমের সবজি রয়েছে এখানে। তার একটু পরে ছোট ব্রিজটি। এই ব্রিজের উপরে মেয়েদের সেই বিখ্যাত খাদ্যদ্রব্য গুলো সহজেই পাওয়া যায়। ফুচকাওয়ালা, চটপটিচাচা, ঝালমুড়ি কাকু সহ সব কিছুই কম বেশি বিছানো রয়েছে এই ব্রিজটিতে। এর নাম নীহারিকা দিয়েছে মেয়েদের ব্রিজ। যেহেতু মেয়েরা রোজ বিকেলে ভীর করে এখানে সে হিসেবে ছেলেদেরও একটি ছোট জটলা অপেক্ষা করতে থাকে এদের জন্য। জুটি বেধে এসব ছেলে মেয়েই আবার প্রেমে মত্ত হয়। বাবা তো ভয়ংকর নজরে দেখে এদের। ফলে ফুচকা খেতে যদি খুবই ইচ্ছে হয় তাহলে আবশ্যকিয় ভাবে প্রিয়মের হাত ধরতে হয়। সন্ধ্যার সময় এত ভীর এই ব্রিজে তা নীহারিকা আগে তেমন দেখেনি। কারণ সন্ধ্যার পরে এদিকে আসা অনেকটা নিষেধ। আজ বুঝতে পারছে বাবা কেন নিষেধ করে। মেয়ে এবং ছেলেদের ছোট জটলা বেঁধেছে এখানে। দেখেই নীহারিকা বিস্মৃত। সিএনজির শব্দ বাড়ির সামনে হলে যদি বাবা থাকে তাহলে বিপদ। নীহারিকা সিএনজি থামাতে বলল। টাকা পরিশোধের কথা বলতেই সে জানতে পারল টাকা আগেই কেউ দিয়ে দিয়েছে। নীহারিকা অবাক বা বিস্মৃত হলো না। ধরে নিল এটি বিমুগ্ধের অব্যক্ত কোন কাজ। নিচু পথ ধরে নীহারিকা একটু দ্রুত হাঁটতে লাগল। এদিকে কিছু দোকান রয়েছে। যেমন ছোট খাটো কসমিটিকের দোকান, মুদি দোকান, ফাস্ট ফুডের দোকান আরও অনেক দোকানের ভীরে একটি দোকানের সামনে হেঁটে যেতেই নীহারিকাকে কেউ উদগ্রীব হয়ে ডেকে উঠল। চমকে গেল নীহারিকা। কিছু সময় পিছনে না তাকিয়ে চুপ করে রইল। ডাকটা একটু গাঢ় হতেই হকচকিয়ে যায় সে। হিজাব থেকে একটি পিন নিজের হাতে নেয়। চট করেই পিছনে ফিরে সে। দেখে আবছা আলোয় একটি ফর্সা মুখশ্রী নজরে আসছে। ভালো করে দেখে নীহারিকা ভ্রু কুঁচকে কপালে ভাঁজ ফেলল। তীক্ষ্ণস্বরে জিজ্ঞেস করল নীহারিকা,’ আপনি এখানে কি করছেন? তাও এই সময়ে?’
জাওয়াদ এবার চওড়াও হয়ে বলল,’ তুমি এত সন্ধ্যায় কোথা থেকে এসেছ? ফোন কই তোমার? পরীক্ষা দিয়ে কোথায় গিয়েছিলে?’ নীহারিকা অনমনেই বলে উঠল,’ সে আমি একটি কাজে ছিলাম। কিন্তু আপনি এখানে কি করছেন?’
‘ তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।’ জাওয়াদ নিচু কণ্ঠে বলে উঠল। নীহারিকা যথেষ্ট বিরক্তি নিয়ে বলল,’ আমার জন্য অপেক্ষা করতে কে বলেছে? আজব লোক তো আপনি। এত নিষেধ করছি কিছুতেই কাজ হচ্ছে না। থ্যাতা কোথাকার।’ কথাটা বলেই নীহারিকা হাঁটতে শুরু করল। জাওয়াদের চেহারা পাংশু বর্ণ ধারণ করেছে। সাথে রাগটাও চওড়াও হয়ে উঠল। সে বেশ উঁচু গলায় বলল,’ তুমি কোথায় ছিলে না বললে আমি কিন্তু তোমার সাথে তোমার বাসায় চলে যাব।’ নীহারিকা দ্রুত পিছনে এসে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,’ পাগল হয়ে গেলেন না কি? আবার সকালের মত শুরু করেছেন। আমি কোথায় যাব, কি করব কোনো কিছুরই কৈফিয়ত দিতে আমি পছন্দ করি না।’ নীহারিকা চোখ বড় করল। জাওয়াদ হাসতে শুরু করল। পাগল বলে আখ্যায়িত করে নীহারিকা আবার হাঁটা শুরু করে। মনে মনে সে এই দিনটিকে অপয়া অলক্ষ্যি বলে প্রচন্ড ঝাড়তে লাগল। জাওয়াদ নিজের শার্টের হাতা গুঁছিয়ে নিয়ে নীহারিকার পিছনে পিছনে আসতে শুরু করেছে। যা দেখে নীহারিকা আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করল,’ আমার পিছনে আসছেন কেন? বাসায় যান।’
জাওয়াদ নিজের একটি হাত চুলে রেখে তা কপালের পাশ থেকে সরিয়ে দিয়ে বলল,’ আমার খুব ক্ষিদে পেয়েছে নীহারিকা। তুমি কি নিজের বাসায় নিয়ে খাওয়াতে পারবে? তোমার সাথে?’
এবার নীহারিকা শান্ত চোখে তাকিয়ে রইল। তার এভাবে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা দেখে জাওয়াদ ভড়কে গেল। এদিক সেদিক তাকিয়ে সে ঠোঁট উঁচু নিচু করে বলল,’ এভাবে তাকিয়ে আছ কেন? সত্যি ক্ষিদে পেয়েছে। আমি সারা দিন কিছুই খাইনি। সকালে ভালো ব্রকফাস্টও হয়নি। দুপুরে তো সার্জারিতে ছিলাম। যখন খাওয়ার সময় হল তখন তোমাকে খুঁজতে বের হয়েছি। কোথায় ছিলে তুমি? ’ নিজের চোখ মুখে হাত রেখে ক্লান্তি প্রকাশ করল জাওয়াদ। চোখের পলক ফেলল না নীহারিকা। সে ভেবে পাচ্ছে না কি বলবে। তার অবাক লাগার বিষয় এটি কিন্তু লাগছে না। প্রচন্ড বিরক্তি কাজ করছে।
‘ কে বলেছে আমার খোঁজ করতে? আমি কি শিশু? বাচ্চা? যে হারিয়ে যাব?’ নীহারিকা নিম্ন স্বরে কথা গুলো বলতে বলতে ভাবছে কি করা যায়। জাওয়াদ ভারী কণ্ঠে বলে উঠল,’খেতেই তো নিয়ে যেতে বলেছি। যাও তোমাকে নিতে হবে না। আমি নিজেই যাচ্ছি। আন্টি নিশ্চয়ই আমাকে না খাইয়ে পাঠাবে না? তুমি বাবার মত হয়েছ। তোমার মা অসম্ভব ভাল। বাবা যেমন মেয়ে তেমন। আজব প্রকৃতির।’ পাশ কাটিয়ে জাওয়াদ যেতেই নিচ্ছিল। যা দেখে নীহারিকা দ্রুত বলল,’ দাঁড়ান। যেতে হবে না। খাবারের ব্যবস্থা করছি। কি খাবেন বলুন?’
‘ তোমার বাসায় গেলে কি হবে?’
এবার নীহারিকা তিক্ত স্বরে বলল,’ আমি এখন যাব বাসায় তাই আপনি যেতে পারবেন না। এক সাথে বাসায় গেলে সবাই মনে করবে আমি আপনার সাথে ছিলাম। যা আমি ভুলেও চাই না। বলুন কি খাবেন।’
জাওয়াদ মুচকি মুচকি হাসল। তার হাসি দেখে ভ্রু উঁচিয়ে নিল নীহারিকা। একটু ভেবে জাওয়াদ বলল,’ মিষ্টি কিছু খেতে ইচ্ছে করছে।’ কথাটা বলতেই নীহারিকার মনে পড়ে গেল জিলাপির কথা। সে ব্যাগ থেকে জিলাপির প্যাকেট বের করে দিয়ে বলল,’ এখানে অনেক মিষ্টি আছে। সব নিয়ে বাড়ি চলে যান। দেখে তো আপনাকে বড় লোক বাপের ছেলে মনে হয়। নিজের বাবার মানসম্মান রাস্তায় দাঁড়িয়ে শেষ করতে লজ্জা করে না? এসেছে অন্যের বাসায় খেতে। ধরুন।’ জাওয়াদ নীহারিকার একটি কথাও কানে ঢুকালো না ভালো করে। সে অধীর আগ্রহে পেকেট খুলে দেখল লাল জিলাপি। সাথে সাথে সে নাকটা কিঞ্চিত কুঁচকে বলল,’ আই ডোন্ট লাইক জিলাপি। খেতে বাজে হয়।’
‘ কে বলেছে বাজে হয়?’ প্রতিবাদের সুরে বলল নীহারিকা। জাওয়াদ পেকেট ফিরিয়ে দিয়ে বলল,’ আমি মিষ্টি পছন্দ করি। তবে জিলাপি খুবই অপছন্দ করি। কারণ এর স্বাদ খুবই রসালো। প্রচুর মিষ্টি। যা খেতে ভালো লাগে না। আর এটি খাবারের মাঝে খুবই বাজে একটি খাবার। তুমি ব্যাগে নিয়ে ঘুরছ কেন?’ বাজে কথাটা শুনা মাত্র নীহারিকা গরম চোখে তাকাল। প্রগাঢ় ভাষায় সে বলল,’ আপনার পছন্দ না হতে পারে। তাই বলে বাজে বলবেন কেন? খেতে হবে না। নিজের বাসায় গিয়ে খান।’ রেগে সে ব্যাগে জিলাপি ঢুকিয়ে নেয়। জাওয়াদ বুঝতে পারে সে মস্ত বড় ভুল করে ফেলেছে। তবুও একবার শিউর হতে সে ইতস্তত করে প্রশ্ন করলো,’ তোমার জিলাপি পছন্দ?’
‘ সেটা যেনে আপনার কাজ নেই।’
জাওয়াদ ব্যাপারটা বুঝতে পেরে নিজের মাথার পিছনের অংশে হাত দিয়ে দুই তিনটি বাড়ি প্রয়োগ করল। ফলে তার সিল্কি চুল সামনে ঝুলে কপালে এসে ঠেকল। চোখের উপরি ভাগ দখল করে নিয়ে তারা নড়েচড়ে উঠল। জাওয়াদ এবার নিচু গলায় বলল,’ স্যরি। আজ থেকে আমিও জিলাপি খাব। প্রমিস। এবং নিজের প্রিয় খাবারের তালিকায় রাখব।’ জাওয়াদের এমন উদ্ভট বাচ্চাদের মত ব্যবহার দেখে নীহারিকা হাসতে শুরু করল। জাওয়াদ বার বার জিলাপির পেকেট চাইল। নীহারিকা হাসল কিছুক্ষণ। তারপর শান্ত ভাষায় বলল,’ অন্যের জন্য নিজেকে সেক্রিফাইস করা মানুষ গুলো আমার খুব অপছন্দ। যেটা আপনার পছন্দ না তা সরাসরি বলা ভালো। মানুষের রুচি একের সাথে অপরের মিলে না। ফলে পছন্দ অপছন্দ সম্পূর্ণ ভিন্ন হওয়া স্বাভাবিক। নিজের ইচ্ছে কে প্রথমে রাখবেন। আমার পছন্দ বলে আপনারও পছন্দ হতে হবে এমন কোন নীতি নেই। তাই এত উত্তেজিত হওয়ার কিছু হয়নি। এখানে মিষ্টির দোকান নেই। ঝাল কি খাবেন বলুন।’
জাওয়াদ আশ্চর্য চোখে তাকিয়ে রইল। তার চোখের দৃষ্টি সম্পূর্ণ এক দিকে। সেই চাহনীর কোন পরিবর্তন হলো না। নীহারিকা দু’ বার চোখের সামনে হাত নাড়াল। কোন প্রতিক্রিয়া না পেয়ে সে এবার মাত্রাঅতিরিক্তি রেগে ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে জাওয়াদের মুখে ছিটাল। জাওয়াদ চমকে উঠল। নীহারিকা তাজ্জব হয়ে গেল। দাঁড়িয়ে থেকে কেউ বেহুশ হতে পারে?
‘ তুমি খুব ভালো নীহারিকা। প্রচন্ড ভালো। তোমার এই ভালো দিক গুলো আমাকে ভালোবাসতে শিখায়।’
‘ এত ভালবাসা ভালবাসা করছেন যে, এটার মানে জানেন?’ চোখ গুলো বাঁকিয়ে প্রশ্ন করল নীহারিকা। জাওয়াদ হালকা হেসে বলল,’ জানি না। শুধু জানি আমার প্রথম ভালোবাসা তুমি।’
নীহারিকা আশেপাশে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,’ বিরিয়ানি খাবেন? সন্ধ্যার বিরিয়ানি?’
জাওয়াদ নিজের ইচ্ছে জাহের না করে জানতে চাইল,’ তুমি বিরিয়ানি পছন্দ করও?’
‘ আগেই বলেছি অন্যের পছন্দকে নয় নিজের পছন্দকে দাম দিতে। খেলে বলুন তা না হলে যেতে দিন।’
কথাটা বলে নীহারিকা অর্ধ অন্ধকারে ডুবে যাওয়া রাস্তাটি ধরল। দ্রুত গামি হয়ে জাওয়াদ বলল,’ সত্যি খিদে পেয়েছে। আচ্ছা বিরিয়ানি চলবে। তবে বিরিয়ানি পাবে কই?’
‘ চলুন আমার সাথে।’ কথাটা বলে এগিয়ে গেল নীহারিকা। জাওয়াদও পিছনে পিছনে হাঁটতে লাগল। অথচ সে বিরিয়ানিও পছন্দ করে না। কিন্তু প্রথম বারের সেই ভুল সে দ্বিতীয় বার করতে চাইছে না। নীহারিকার কথা গুলো সে এই কান দিয়ে ঢুকিয়ে ওই কান দিয়ে বের করে দিয়েছে। ফলে নীহারিকার শুধু শুধু জ্ঞানদান করাটা বৃথা গিয়েছে ভেবেই জাওয়াদ অনমনেই হাসতে লাগল। ব্রিজের একদম পাশেই দোকানটি। ছোট একটি দোকানে একজন লোক বসে রয়েছে। দু’জন কাস্টমার সামলাচ্ছে। জাওয়াদ ছোট এই রেস্তোরাঁর অবস্থা দেখেই নিজেকে সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এসব জায়গায় সে কখনো খাওয়াদাওয়া তো দূরের কথা বসবেও না। অথচ প্রেমে পড়ে তার কত কিই না করতে হচ্ছে। নীহারিকা বসে থাকা লোকটির দিকে তাকিয়ে মশ্রীন ভাষায় বলল,’ আসসালামু আলাইকুম হাতিম চাচা।’ প্রচন্ড মাত্রায় খুশি হয়ে তিনি সালামের জবাব দিলেন। বুঝাই যাচ্ছে নীহারিকাকে তিনি ব্যক্তিগত ভাবে পছন্দ করে। জাওয়াদ মনে মনে বলল,’ কথা শুনলেই তাকে সবাই পছন্দ করে। কত সুন্দর করে কথা বলে। ইশ।’ হাতিম আলী নামের এই লোকটিকে সবাই হাতি আলী বলে ডাকে। যুগে যুগে তার নাম প্রায় বিলুপ্ত হতে শুরু করেছিল। যেহেতু উনি একটু নাদুসনুদুস ফলে তাকে হাতি ডাকাই বেশি বাহুল্য হয়ে পড়ে। শুধু নাফিস উদ্দীনের পরিবার তাকে নাম ধরে ডাকে। এমন কি বাসার কাজের মেয়েটিও। ছেলে মেয়েকে নাফিস উদ্দীন যথেষ্ট ভালো শিক্ষা দিয়েছে। তাই তো পাড়ায় একটি আলাদা সম্মান রয়েছে। তিনি অনেকের ছেলে মেয়েকে দেখেছেন বড়দের নামও বিগড়ে কথা বলে। তবে এরা তেমন নয়। কত সুন্দর করে হাতিম চাচা ডাকে। শুনলেই মন প্রান জুড়িয়ে যায়। মনে হয় নামটা স্বার্থক। নীহারিকা সাধারণত দোকানে আসে না। আজ এসেছে দেখে তিনি খুবই আপ্যায়ন ভরা ব্যবহার করতে শুরু করছেন। নিজে নেমে আসলেন। সবচেয়ে ভালো চেয়ার দিতে বললেন। এত ভালো ব্যবহার বিস্মৃত করল জাওয়াদকে। তার ধরনা ছিল না এসব জায়গায়ও ভালো ব্যবহার পাওয়া যায়। নীহারিকা মিষ্টি মধূর ভাষায় বলল,’ এখন বসব না। আপনি এক পেকেট সন্ধ্যার বিরিয়ানি দিন। টাকা আমি এখনই প্রিয়মের হাতে পাঠিয়ে দিচ্ছি।’ হাতিম আলী তো ফ্রিতেই দিয়ে দিতে চাইলেন। জাওয়াদ অবাক হয়ে বলল,’ আমি দিচ্ছি। তোমার দিতে হবে না।’
‘ যেহেতু আপনি আমার জন্য খেতে পারেননি তাই এটা আমার দায়িত্ব। এছাড়া আমি কখনো আপনাকে খাওয়াতে ইচ্ছুক নই। কারণ আমার কাছে টাকার গাছ নেই। সো পেকেট নিয়ে নিজের বাড়ি যান।’ নীহারিকা লক্ষ্য করল মেয়েরা হা করে তাকিয়ে দেখছে জাওয়াদকে। কানে কানে ফিঁসফিঁস করছে। চোখে মুখে মুগ্ধতা। জাওয়াদের সে দিকে নজর কম। তবুও সে বুঝতে পারছে মেয়েরা তাকে ভয়াবহ রকমের পছন্দের দৃষ্টিতে দেখছে। কিন্তু তার পাশের মেয়েটার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। সে নিজের মত পেকেটের অপেক্ষা করছে। জাওয়াদ অন্যমনষ্ক হয়ে জানতে চাইল,’ তোমার কেমন ছেলে পছন্দ?’
নীহারিকা জবাবই দিল না। যা উত্তর হলো, সে কথা বলতে পছন্দ করছে না। জাওয়াদ নাছরবান্দা। সে বারং বার একুই প্রশ্ন করে বিরক্ত করে ফেলল তাকে। ফলে সে বলল,’ সুন্দর ছেলেদের আমি পছন্দ করি না। বিশেষ করে যাদের মেয়েরা হা করে দেখে।’
‘ কেন?’ জাওয়াদ আগ্রহীত হয়ে পড়ে। নীহারিকা বিরক্তির চরম স্থানে রয়েছে। খাবারের পেকেট হাতে ধরিয়ে সামনের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে সে বলল,’ গাড়ি ওদিকে। প্রশ্ন করা বন্ধ করে রাস্তা মাপুন।’
ঝটপট হাঁটতে শুরু করল নীহারিকা। রাস্তা পেরিয়ে বাড়ি বেশি দূর নয়। ভিতরের দিকে একটু অন্ধকার। গেট পেরিয়ে বাড়ির সদর দরজার কাছে এসে থমকে দাঁড়াল নীহারিকা। দরজা খোলা। ভিতর থেকে থমথমে আভাস বুঝিয়ে দিচ্ছে গরুতর কিছু হয়েছে। আঙ্গুল চিপে নীহারিকা যখন ভিতরে প্রবেশ করল ঘূর্ণিঝড়ের আভাস বুঝতে পেরে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। চোখ উপরে তুলে সোফার দিকে তাকিয়ে কয়েক পা পিছিয়ে গেল। বাবা সোফায় বসে তার দিকে তাকিয়ে আছে। মুখটা যতটা সম্ভব ভয়ংকর। রাগে লাল হয়ে আছে। নীহারিকার শরীর কেঁপে উঠে। মাথা নিচু হয়ে যায় আপন শক্তিতে। নিজের ঠোঁট চেপে বুকের শব্দ শুনতে শুরু করে সে। ডান হাত মুষ্টি করে বুকের বাম পাশে ধুম ধাম করে দুই তিনটি ছোট ঘুষি বসিয়ে দেয়। পৃথিবীতে এত এত মানুষের মাঝে বাবাকে সে একটু বেশিই ভয় পায়। হাতটির পিঠের নীলছে রগ গুলো লাফাতে লাগল। নাফিস উদ্দীন গুমুট মেরে রইলেন অনেকক্ষণ। মেয়ের দিকে দৃষ্টিপাত তার। মেয়েটি তার অতিশাসনে বিরক্ত ছিল খুব। তাই একটু ছাড় দিচ্ছিলেন। মনে হচ্ছে না খুব ভালো কাজ করেছেন। আফসোস হচ্ছে খুব। সাথে রাগ। মাথা কাত করে দাঁড়িয়ে রইল নীহারিকা। ঠিক ততক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে যতক্ষণ বাবা কিছু না বলে। নাফিস উদ্দীন গলায় শব্দ করে বললেন,’ এসব কি নিজের খালাতো বোনের থেকে শিখেছ তুমি?’ কথাটা বাম পাশে তাকিয়ে বললেন তিনি। চমকে উঠে নীহারিকা সেদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আকাশ থেকে পড়ল। মুহূর্তে ঠোঁট উল্টে বলল,’ মিতু আপু তুই? ‘
‘ বেয়াদপের মত চিৎকার করছ কেন?’ কড়া গলায় বললেন নাফিস। ভয় পেয়ে নীহারিকা আবার মাথা নিচু করল। নিজ মনে ভাবতে লাগল আজ তো মিতু আপুর বিয়ে ছিল। পরীক্ষা হওয়ায় তারা যেতে পারেনি। বিয়ের তারিখ পিছাবে না বলে দিয়েছিল মিতু আপু। এটা সত্যি আশ্চর্য ব্যাপার ছিল। কারণ মিতু আপু নীহারিকাকে ছাড়া বিয়ে করবে এটা ভাবা ভারী অদ্ভুত। কিন্তু সে এটি করেছে। বাবাও নিষেধ করেছে বিয়েতে যেতে পারবে না কেউ। তা না হলে মায়ের যাওয়ার কথা ছিল। পরিবেশ ভালো না। মিতু আপুর চোখ মুখ কাঁদো কাঁদো। তার গায়ে লাল বেনারসি। গা ভর্তি জুয়েলারি। হাত ভর্তি চুড়ি। চোখটা নিচে রেখেই নীহারিকা চারপাশে তাকিয়ে শাহিন ভাইয়াকে খুঁজার চেষ্টা করল। না তার নাম চিহ্ন পর্যন্ত নেই। এই দম ধরা পরিবেশকে ঠেকরে প্রিয়ম প্রশ্ন করল,’ কোথায় ছিলি তুই আপু?’ রাগে শরীর জ্বলে গেল নীহারিকার। মিতু আপুকে বাঁচাতে তাকে ফাসিয়ে দিয়েছে প্রিয়ম। বাবা নিশ্চয়ই তাকে ধরবে এখন। ব্যাপারটা মাথায় আসতেই নীহারিকার বুকের শব্দ ভান্ডার তাণ্ডব করতে শুরু করল। নাফিস উদ্দীন গরম হয়ে বললেন,’ তোমার বোন বেয়াদপের তালিকায় নিজের নাম বসিয়েছে। এখন থেকে সে এই সময়েই বাড়ি আসবে মনে হচ্ছে।’ একটু থেমে তিনি আবার বললেন,’ কোথায় ছিলে?’ নীহারিকা মাথা আরও ঝুলিয়ে নিল। বাবা চেঁচিয়ে বললেন,’ কানে কথা যাচ্ছে না?’
‘ স্যরি বাবা।’ নিচু গলায় বলল নীহারিকা। নাফিস উদ্দীন বুঝলেন যেখানেই গিয়েছিল সে বলবে না। আগেই আত্নসমার্পণ করছে। মাথা আরও গরম হওয়ার আগেই জাওয়াদ উড়ে আসার মত করে টপকে পড়ল। ছুঁটে এসেছে বলে তার গেঞ্জির উপরের শার্ট উড়ে এক পাশে চলে গেছে। চুল কপালের উপরে এসে পড়েছে। ভ্রু কুঁচকে তাকায় বাবা। জাওয়াদ নিজেও নীহারিকার বাবাকে ভয় পায়। সে নীহারিকার দিকে একবার তাকিয়ে সহসী হয়ে বলল,’ এক বান্ধবীর সাথে ছিল। আসার সময় আমি নিয়ে এসেছি।’
নাফিস উদ্দীন প্রথমে বিশ্বাস করতে চাইলেন না। জাওয়াদ আশ্বস্ত করে বলল,’ সত্যি বলছি আঙ্কেল। খুব জরুরি কাজ ছিল বান্ধুবীর সাথে। ’ বাবা গুরুগম্ভীর হয়ে বললেন,’ পছন্দ করি বলে সব কিছু পছন্দ করি না। আমার মেয়ের সাথে বেশি মিশার কোন প্রয়োজন নেই। আশা করি মনে থাকবে তোমার।’ জাওয়াদ আতঙ্কিত হয়েও গম্ভীর ভাবে বলল,’ আপনার মেয়েই আমার সাথে তেমন মিশে না। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন আঙ্কেল।’
বাবা উঠে দাঁড়ালেন। যাওয়ার আগে মিতু আপুর দিকে সরু চোখে তাকিয়ে বললেন,’ মানুষের ভালো গুন নেওয়া উঁচিত। খালাতো বোনের বেয়াদপি গুলো শিক্ষা নেওয়ার মাঝে বাহাদুরি নেই।’ মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,’ তোমরা বোনেরা মেয়েদের ভালো কিছু শিখাতে পারো না? এমন অবাধ্য হয় কিভাবে? ’ গাল ফুলিয়ে আফিয়া উঁচু গলায় বললেন,’ হ্যাঁ হ্যাঁ ভালো কিছু হলে মেয়ে আমার। খারাপ কিছু হলে মেয়ে তোমার। এসবই পারো তোমরা।’
নাফিস স্ত্রীর কথাটি না বাড়িয়ে নিজের মনের কথা প্রকাশ করল, ‘ তোমার মেয়েকে আমার চোখের সামনে থাকতে নিষেধ করবে। ওকে বুঝানোর কিছু নেই আমার কাছে। যেমন খুশি তেমন চলতে বলো।’ বাবা নিজের রুমের দিকে চলে গেলেন। প্রথমে নীহারিকা জাওয়াদের দিকে তাকাল। জাওয়াদ ছোট করে বলল,’ দুঃখিত।’ তারপর সে সোফায় বসল। আফিয়া মেয়ের সাথে কথা বললেন না। প্রিয়ম কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সেও সোফায় বসল। এবার মিতু আপুর পালা। বাবা রুম ত্যাগ করতেই তিনি আয়েশ করে ডাইনিং টেবিলের এক পাশে বসে পড়েলেন। নীহারিকা দ্রুত পায়ে তার কাছে উপস্থিত হয়ে বলল,’ তুই এখানে কি করছিস? আজ না তোর বিয়ে?’
একবার চোখ তুলে তাকিয়ে তিনি ফলের ঝুঁড়ির দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন,’ ছিল তো কি হয়েছে।’
‘ কি হয়েছে মানে? তুই এখানে কি করছিস?’
‘ নিজের বিয়ে থেকে পালিয়ে এসেছি।’
কথার আগাগোড়া বুঝতে পারল না নীহারিকা। মিতু আপু চমৎকার ভাবে আপেলে কামড় বসালো। তাকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি মুভি দেখতে এসেছে থিয়েটারে। হাত থেকে আপেল কেড়ে নিয়ে নীহারিকা বলল,’ পাগলামি করছিস কেন? শাহিন ভাইয়া কই? উনাকে দেখছি না কেন? তোরা এক সাথে এসেছিস?’
‘ মানুষ কি বিয়ে থেকে নিজের হবু বউ বা জামাই নিয়ে পালায়? তুই কি এই জাওয়াদরে নিয়া পালাইছিলি? আমি কেন ওই শাহিনরে নিয়া পালামু?’ নির্লিপ্ত ভঙ্গি মিতু আপুর। সবিস্ময়ে নীহারিকা বলল,’ মানে কি এসবের?’
‘ মিতু আপু নিজের বিয়ে থেকে পালিয়ে এসেছে। ঠিক তোর মত। বাবা বলল না তোর থেকে শিখেছে। এবার এসব আজাইরা প্রশ্ন বন্ধ কর।’ টিভি অন করতে করতে বলল প্রিয়ম।
মিতু আপু বিয়ে থেকে পালিয়েছে ভাবতেই আশ্চর্য হচ্ছে নীহারিকা। যেহেতু বাসা ভর্তি সবাই তার প্রতি রাগানিত্ব তাই সে আর প্রশ্ন না করে রুমের দিকে যাত্রা করল। জাওয়াদকে বসে মায়ের সাথে কথা বসতে দেখে নীহারিকা দূরত্ব কমিয়ে কাছে এসে বলল,’ আপনাকে আমি দেখে নিব।’
‘ উপকারের প্রতিদানও দিতে জানে না আন্টি আপনার মেয়ে। কেমন যেন।’ কথাটা বলেই ডান চোখ টিপল সে। প্রিয়ম দেখল। বোনকে ধাক্কা দিয়ে সে রুমে পাঠিয়ে দিল। তার প্রচন্ড রাগ উঠছে জাওয়াদের উপরে। কেন? সে জানে না।
_________________
লালাভ আলোর রং ছড়িয়ে আছে রাস্তার উপরে। চারপাশের অন্ধকার রাজ্যসমেত বিস্ময় নিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বিশাল এলাকা জুড়ে। ফিনফিনে বাতাস বইছে। এক স্থান ব্যতিত সব অন্ধকারে ডুব মেরেছে। আলোকরশ্মির সেই স্থানে এসে উপস্থিত হলো বিমুগ্ধ। তাকে দেখে অনেকটা অবাক মুহিত এবং মুহিতা। যেন আজ এটি অকল্পনীয় ঘটনা ছিল। বিমুগ্ধ একটি চেয়ার টেনে বসল। তার লম্বা শার্ট ছড়িয়ে দিল পিছনে। আমেরিকায় থাকা কালীন সে লম্বা ব্লেজার পরিধান করত। কারণ সেখানে বরফ পড়ত খুব। সেই অভ্যাসের ফলে সে এখনও মাঝে মাঝে লম্বা পাতলা শার্ট পড়তে পছন্দ করে। মানুষ সত্যি অভ্যাসের দাস। শার্টের একটি পাশ সাদা অপর পাশ কালো। হাতের ঘড়ি খুলতে খুলতে সে বলল,’ এভাবে তাকিয়ে থাকার মত কিছু নেই আমার মাঝে। সবাই জটলা বেঁধেছিস কেন বল?’ শান্ত এবার সচকিত হয়ে বলল,’ তুই আসবি বলিসনি তো।’
‘ আসবো নাও তো বলিনি।’
জায়গা জুড়ে তেমন কিছু নেই। শুধু আলো আর একটি ছোট দোকান। এই দোকান আমেরিকায় হলে সবাই হাসাহাসি করত। কিন্তু শান্তর বেশ প্রিয় একটি জায়গা এটি। তিশা রসিয়ে রসিয়ে বলল,’ জানিস মুহিত বাপ হবে বাপ। অন্যদিকে আমরা শালা বিয়াই করতে পারলাম না।’ কথাটা যতটা উত্তেজনা পূর্ণ ততটা দেখালো না বিমুগ্ধকে। সে খুব শান্ত নিরিবিলি ভাবে বলল,’ শুভকামনা রইল।’ ধপ করে নিভে গেল তিশা। ঠোঁট উল্টে নিয়ে সে বলল,’ একটু তো খুশি হতেই পারিস। শত হোক তুই চাচা মামা এক সাথে হবি।’
‘ খুশি হওয়া উঁচিত বুঝি?’ প্রশ্নটা অদ্ভুত ভাবে করল সে। তিশা বলল,’ অবশ্যই হওয়া উঁচিত।’ এবার বিমুগ্ধ প্রান কাড়া হাসি দিয়ে জড়িয়ে ধরল মুহিতকে। এত শক্ত করে ধরল যে বেচারার জান বাবা হওয়ার আগেই যেন যাবে। মুহিত না পেরে উঠে বলল,’ আর খুশি হতে হবে না। এনাফ।’ বিমুগ্ধ দম বন্ধ করা অনুভূতি প্রকাশ বন্ধ করে বলল,’ অর্পণ কই?’ সবাই একটু চমকিত হল। সত্যি তো অর্পণ কই? তার আশার কথা সবার আগে। সময়ের একদম পাক্কা সে। কখনো এদিক সেদিক করে না। আজ আসল না কেন? ‘
চা চলে এসেছে। এখানের চা খেতে খুব একটা ভালো নয়। তবুও সবাই এখানের চা পছন্দ করে। বিনা কারনে খাবারের জিনিস পছন্দ হয় না কখনো। অথচ তারা শুধু শুধু এই লোকের চা খেয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা গল্প করত আগে। দু বছরের কাছাকাছি টানা চা খেয়েছে বিমুগ্ধ এখানে। যখন সে ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত বাংলাদেশে ছিল। শান্ত বাদে বাকিরাও তার সাথেই ছিল। এখন সবাই মোটামুটি ব্যস্ত। ফলে তেমন দেখা করার সুযোগ হয়ে উঠে না। জীবনটাই এমন। বন্ধুত্ব একটা সময় প্রাণ মনে হয়। দূরত্বের কথা মাথায় আসলেও তখন মনে হয় এদের ছাড়া বাঁচা অসম্ভব। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এক একজনের সাথে বছর, মাস পর পর দেখা হয়। এবং তাদের ছাড়াই জীবন সময়ের পাল্লা ধরে অতিক্রম হতে থাকে। ক্রমান্বয়ে বয়স বাড়ে। বৃদ্ধ হয়ে পড়ে। সুখের স্মৃতি গুলো মনে পড়তে শুরু করে। কিন্তু আর ফিরে যাওয়া হয় না। অথচ সবাই বেঁচে থাকে।
‘ কাউকে ছাড়া কেউ মরে না। তবে বাঁচার মত বাঁচার জন্য প্রিয়দের খুব প্রয়োজন পড়ে।’ সবাই অর্পণকে ফোন লাগায়। কিন্তু তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। বিমুগ্ধ নিশ্চিন্তে চায়ের কাপটি শেষ করল। তারপর কল দিল অর্পণের হসপিটালে। খবর পাওয়া গেল সে অনেক আগেই বের হয়ে গিয়েছে। শান্তের মনে পড়ল কিছু একটা। সে চিন্তিত হয়ে বলল,’ অর্পণের বাবার কোম্পানিতে কয়েকদিন থেকে অনেক প্রবলেম চলছে। একদল মাফিয়াকে তার বাবা নিজের পাঁচটি বিশাল জাহাজ ভাড়া দিয়েছে। কারণ কোম্পানী লসে রয়েছে।’
মুহিত বলল,’ তো কি হয়েছে।’
‘ সমস্যা সেটি নয়। সমস্যা হচ্ছে আঙ্কেল আগে জানত না এরা মাফিয়া থেকে বিলং করে। জানার পরে তিনি বুঝতে পারে বেআইনি কাজ করা হবে জাহাজ দিয়ে। তাই তিনি জাহাজ না দিয়ে টাকা ফিরিয়ে দিতে চাইল। কিন্তু তারা মেনে নিচ্ছে না। দেখে আঙ্কেল কেইস করেছে। জাহাজ এখন তাদের দখলে। কেইস করায় তাদের অনেক মাল পুলিশের হাতে চলে গিয়েছে। এতে ক্ষেপে তারা আঙ্কেলকে কেইস তুলে নিতে হুমকি ধামকি দিচ্ছে। অর্পণ এসব নিয়ে চিন্তিত ছিল কিছু দিন।’
শান্ত চায়ের বিল পরিশোধ করতে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। সবার দিকে তাকিয়ে বলল,’ খাইলি তোরা বিল দিমু আমি? ক্যান ভাই আমার কি টাকার গাছ আছে?’ সে আবার বসে গেল। তিশা চায়ের কাপে চুমুক বসিয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে শ্বাস ফেলে বলল,’ বিদেশি টাকা তো আছেই। আমেরিকার এক ডলার বাংলাদেশি ৮৫. ৯৬ টাকা। সে হিসেবে তোর আমাদের প্রতি কাপের বিল দেওয়া বড় কোন ব্যাপার না।’
‘ যা ভাগ। বিদেশ থেকে ব্যাগ ভর্তি করে টাকা তোদের চা খাওয়াতে নিয়া আসি নাই।’ শান্ত চেপে বসল। মানে আজ সে উঠছে না। তিশাও ছাড়ল না। কাপের টং টং শব্দ চালিয়ে গেল। মুহিত উঠে বলল,’ আজ আমি দিয়ে দিচ্ছি।’ কথাটা বলা মাত্র শান্ত আর তিশা দৌড়ে বিল দিতে গেল। যা দেখে বিমুগ্ধ ভ্রু কুঁচকাল। কাপালের উপরে তার দু’টি ভাজ। বৃদ্ধা আঙ্গুল চোখের উপরে রেখে সে প্রশ্ন করল,’ কাহিনী কি?’ সবাই আবার চুপ মেরে গেল। কিন্তু মুহিতের এক হাত ধরে রাখল। যা দেখে বিমুগ্ধ সন্দিহান দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়ে তাকিয়ে রইল। তার এভাবে তাকানো দেখে শান্ত জোড়পূর্বক হেসে বলল,’ আমার বাপের অনেক টাকা। তাই আমিই বিল দিমু। তা না হইলে ইজ্জতে পানি পড়ব ভাই।’
তিশাও হেসে তাল মিলিয়ে বলল,’ সেটাই।’ দু’জনের হঠাৎ ভাবনার পরিবর্তেন ব্যাপারটা হজম হয়ে উঠল না বিমুগ্ধের। সে বেঞ্চের মধ্যগগনে হাত রেখে দৃষ্টি আরও উঁচুতে তুলল। এবার না চাইতেও শান্ত বলল,’ এভাবে তাকাচ্ছিস কেন? মুহিত বলতে নিষেধ করেছে।’ সে মুহিতের হাতে খোঁচা মেরে বলল। অন্য সময় এই পরিবেশের পূর্ণ মজা নিত মুহিত। এবার নিলো না। সে চুপ করে বিল দিয়ে আসল। মুহিতার মুখের ভাবও খুব একটা সহজ নয়। আলতো হাতে বিমুগ্ধ চুলের মাঝে একটি আঙ্গুল ঘুরিয়ে নিয়ে এসে বলল,’ মুহিত বল। কি হয়েছে?’ কিন্তু মুহিত বলল না। তিশা নিচু গলায় বলল,’ মুহিতের চাকরিতে প্রবলেম হয়েছে। তাই একটু চিন্তিত।’ মুহিতা উঁচু কর্কশ গলায় বলল,’ প্রবলেম নয় চাকরি শেষ। তার মাঝে নতুন ঝামেলা।’ তিশা পিঠ চাপড়ে
প্রবোধ দেওয়া গলায় বলল,’ কিসব বলছিস। এসব বলা উঁচিত নয়।’
‘ পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ নিজের ভাগ্য নিজে নিয়ে আসে। চাকরি চলে গিয়েছে এটা আহামরি কিছু নয়। চাকরি যাওয়ার খুশিতে লেবু চা আমার পক্ষ থেকে।’ বিমুগ্ধের এমন উদাসিন কণ্ঠ সহ্য করতে কষ্ট হলো মুহিতের। সে বেশ রেগে বলল,’ সব মজা না। তোর সহজ মনে হতে পারে আমার কাছে নয়। পরিবার, স্ত্রী, এখন আবার সম্তান। এদের চিন্তা কখনো করেছিস? করলে বুঝতি।’
অসহায় চোখে নিচে তাকায় সে। এটা বড় একটি ঝড় তার জীবনে। সে অর্পণের মত কোটিপতির ছেলে নয়। বা বিমুগ্ধের মত আপন চিন্তাশীল ভালো ডিগ্রী ধারি বিদেশি নাগরিকত্ব যুক্ত ছেলে নয়। সে খুবই মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। মুহিতার সাথে তার বিয়েটা বহু কষ্টে হয়েছে। মেয়েটিকে সে সুখি করতে চায়। অথচ তার চাকরীর টাকায় তাকে চলতে হবে ভেবেই মাথাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। এসবের মাঝে জীবনে নতুন অতিথি আসছে। ঢাকায় সে একটি ফ্লাট কিনেছে। যার ফলে লোন নিতে হয়েছে অনেক। সেটাও পরিশোধ করতে হবে। সব মিলিয়ে তার এই মুহূর্তে আনন্দ বা খুশি কোনটিই হচ্ছে না। যদি পরিস্থিতি অন্যরকম হত তাহলে সে বাবা হওয়ার আনন্দে পাগল হয়ে যেত। হয় তো ঢাকা শহরের মিষ্টির দোকান শেষ করত। অথচ সে এসব কিছুই করতে পারছে না। অনেক সময় মন পৃথিবীর বিচিত্র নিয়মে বাঁধা পরে। বিমুগ্ধ হালকা হাসল। উঠে দাঁড়িয়ে মুহিতের পিঠে হাত রেখে বলল,’ দোস্ত এত টেনশন নিস না। পৃথিবীর বিচিত্র সব বিপদ জিনি তৈরি করেছে এর থেকে বের হওয়ার রাস্তাও তিনি বানিয়েছে। ইঞ্জিনিয়ার মানুষ চাকরী তোর পায়ের নিচে থাকবে। জীবনের এত বড় খুশি সেলিব্রেট করা উঁচিত। কারণ সুখ খুব অল্প সময়ের জন্য ছুঁয়ে যায়। তাই এই ছোঁয়া গুলো প্রাণ ভরে নেওয়া উঁচিত।’ বন্ধুদের মাঝে একটি পিনপতন নিরবতা বিরাজ করল। কথাগুলো বলে বিমুগ্ধ একটু দূরে গিয়ে দাঁড়াল। কিছুক্ষণ পর যখন ফিরে আসল সে খুবই গম্ভীর হয়ে গেল। কয়েক মিনিটে সে পরিবর্তন হয়ে গেল দেখে তিশা বলল,’ তোরে আল্লাহ কোন মাটি দিয়া বানাইছে? এমন কা তুই? আজব পাবলিক।’ মুহিতের ফোনে কল আসল। কল লিস্টের অপরিচিত নাম্বারটি দেখেই মুহিত আর ফোন তুলল না। যা দেখে শান্ত বলল,’ কল ধর। কে করেছে?’
‘ একটা ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম তিনদিন আগে। বার বার ফোন আসলে আমি মনে করি এই বুঝি তাদের কল। অথচ এমন কিছুই হচ্ছে না। আগের অফিসের কিছু কাজের জন্য এখনও আমার কাছে কল আসে। প্যারা দায়ক। বাল এসব ভাল্লাগে না। তাই ধরমু না ঠিক করছি।’
পর পর দুইবার বাজার পর শান্ত বিরক্ত হয়ে ফোন কানে ধরিয়ে দিল। মুহিত যেন মুহূর্তে পাহাড় থেকে পড়ল। এই পড়ায় না শব্দ আছে না ব্যথা। শুধু আছে হঠাৎ ভয়ংকর বিপদের হাত থেকে বেঁচে ফিরার অনুভূতি। কিছুক্ষণ স্থির হয়ে বসে রইল সে। এদের সবার সাথেই সে নিজের প্রবলেমের কথা শেয়ার করেছে অনেক আগে থেকে। বিগত কিছুদিন তারা রোজ এখানে আসছে। তবে অদ্ভুত জিনিসটা আজই হলো। তার চাকরি হয়ে গেল! সে আবেগে আপ্লুত হয়ে বিমুগ্ধতে জড়িয়ে ধরতে যায়। যা থেকে কয়েক পা দূরে সরে আসে বিমুগ্ধ। এক হাত বাড়িয়ে বলে উঠে,’ দূরে থেকে বল যা বলার। বউয়ের সামনে গায়ে পড়ার স্বাভাব এখনো গেল না।’
‘ তুই তো লাকি আমার জন্য। দেখ তোর সাথে দেখা হওয়ার সাথে সাথে আমার লাক ভালো হয়ে গেছে। এতদিন দেখা করছ নাই কা শালা?’
বিমুগ্ধ পকেট থেকে ফোন বের করে বলল,’ তোদের লাক ভালো করার জন্য আমি সারা দিন নিজের লাক খারাপ করে তোদের সামনে বসে থাকতে পারবো না। দূরে যা।’
মুহিত ভেবে দেখল। এই চাকরিটা তার জন্য খুব প্রয়োজন ছিল। অথচ এর জন্য অনেক ভালো ভালো ক্যান্ডিডেট ছিল। কিন্তু সে মাঝে থেকে এই অসম্ভব চাকরি কিভাবে পেয়ে গেল? সুপারিশ করা হয়েছে তার জন্য? হ্যাঁ মহিলাটি এমনই বলেছে। এটা কে করল? যেহেতু শান্ত আগে থেকেই জানত ব্যাপারটা তাই মুহিত তার দিকে তাকাল প্রশ্ন করল। দু’ হাত উপরে তুলে শান্ত বলল,’ আমি কিছু করিনি। কারণ নিজেই অসহায় হয়ে একটি চাকরি জোগাড় করেছি অনেক কষ্টে। তোদের দেশে চাকরি পাওয়া আর সোনার হরিণ পাওয়া এক কথা। আমি তো এদেশের কাউকে চিনিনা। ফলে তোর চাকরিতে আমার বিন্দু মাত্র হাত নেই। এভাবে তাকিয়ে থাকবি না।’ এবার মুহিত একটু চিন্তা করতে বসল। তার সাথে তাল মিলিয়ে চিন্তা করতে বসল মুহিতা। এবার তিশা আর শান্ত গালে হাত বসিয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে চোখ একবার বন্ধ করে তো আর একবার খোলে। শান্ত বলল,’ আমার একটা প্রশ্ন আছে। উত্তর দিয়ে চিন্তা করতে বসলে ভালো হয়।’ মুহিত নির্বিকার গলায় বলল,’ বল।’
‘ তোর আর তোর বউয়ের নাম মিলল কিভাবে? শুনে মনে হয় ভাই বোন। বাপ মা নাম মিলাই রাখছে। মুহিত, মুহিতা। তোরা কি ভাই বোন লাগিস না কি?’ বলেই শান্ত তিশা একচোটে হাসল। গম্ভীর ভাব ছেড়ে বিমুগ্ধের মুখেও চওড়া হাসি ফুটে উঠেছে। শান্ত অবিরাম ভাই বোন বলে ভেঙ্গাতে লাগল। যা দেখে মুহিতা ধমকের সুরে বলল,’ থাপড়ামু বলে দিলাম। ভাই বোন হতে যামু ক্যান? নাম খুঁজে প্রেম করছি । তাই মিললা গেছে।’ মুহিত সায় দিয়ে বলল,’ হ হ। ওর ইচ্ছা ছিল যার সাথে নাম মিলে তার সাথে প্রেম করার।’
‘ তা না হইলে ওর মত আবুলের লগে প্রেম করতে যামু ক্যান বল? এত সুন্দর মাইয়া শুধু নামের কারণেই পাইছে।’ মুখে একটা ভাব টেনে ধরল মুহিতা। তিশা পিছনে এসে তার এলোমেলো পাখির বাসার মত চুলের কয়েক গাঁছি উপরে তুলে বলল,’ তোর এই হাল কেন? চুল আঁছড়াস না কত দিন?’
‘ বেশি দিন হবে না। দশ বারো দিন।’
শান্ত নাক মুখ কুঁচকে বলল,’ পাগল মনে হইতাছে তোরে।’ হাতের আঙ্গুল দিয়ে তিশা চুল ঠিক করতে লাগল। ব্যথা পেতেই চেঁচালো মুহিতা। মাথায় কয়েকটা থাপ্পড় লাগাল তিশা। অগোছালো মেয়ে মুহিতা। সে কখনো নিজেকে পরিপাটি করে রাখে না। চুল ঠিক করে বাঁধে না। ড্রেস পড়ে উল্টোপাল্টা। রাস্তায় হাঁটার সময় হুট হাট উসঠা খায়। ঝগড়ায় খুব পটু। বিশেষ করে মুহিতের সাথে। বাবা মায়ের এক মাত্র মেয়ে হওয়ায় বরাবরই তাকে তার মা খুব গুঁছিয়ে রাখে। কিন্তু প্রেম করে বিয়ে করার ফলে বাবা মায়ের সাথে একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে। মুহিত অত্যন্ত যত্নবান ছেলে। সে খুব গুঁছিয়ে রাখে এই পাগলাটে আবুল প্রকৃতির মেয়েকে। এখন হয় তো সেও খুব চিন্তায় ছিল বলে খেয়াল করতে পারেনি। কুরিয়ার বয় এসে হাজির। সবাই একজন আর একজনের মুখের দিকে তাকাল। বিমুগ্ধ পেকেট নিয়ে ছোট টেবিলটিতে রাখল। বন্ধুরা অবাক। বিমুগ্ধ নিয়ে এসেছে মানে অবশ্যই ভয়ংকর কিছু থাকবে। এত সময় সে চুপ করে সবার কথা শুনছিল। বিমুগ্ধের মুড খুব ভালো হলে সে অনেক কথা বলে। মুড খারাপ তো সে শুধু শুনে। যেমন এখন অদৃশ্য কারণে তার মনের মাঝে ভারী মেঘের আনাগোনা। লাল পেকেট গা থেকে ছাড়াতেই একটি কেকের দেখা মিলল। একজন আর একজনের মুখ চাওয়াচায়ি করে তিশা বলল,’ কার জন্মদিন আজ?’ হাত তুলে শান্ত বলল,’ শীতের সময় আমার জন্ম। সে হিসেবে বৃষ্টির সাথে আমার সম্পর্ক নেই।’ মুহিতদেরও জন্মদিন নয়। বিমুগ্ধের তো আরও পরে। তাহলে কেক কেন? ভেবে পেল না কেউ। একটা হৈ হৈ পড়ে গেল। সবাই নিজেদের পরিবারের মানুষের জন্মদিনও হিসেব করতে বসেছে দেখে বিমুগ্ধ বলল,’ তোদের কারো জন্য নয়। চাচা, মামা হওয়ার খুশিতে এটা।’
মুহিত চোখ টিপে বলল,’ বুঝি তো। চাচা হওয়ার খুশি পালন করে বাবা হওয়ার ইচ্ছে জাহের করা হচ্ছে।’ পায়ের উপরে পা তুলে ঊর্ধ্বে নজর দিল সে। ঠোঁটে অভিজাত হাসি ফুঁটিয়ে বলল,’ আমি জাহের করতে পছন্দ করিনা। ইচ্ছে হলে সব করে বসি। যেমন বাবা হতে ইচ্ছে হলে বিয়ে করে নিব।’
‘ তার আগে করবি না? ভাই তোর রানী নিয়ে জাওয়াদ ভাগার প্লান করছে। পরে ভাগে শূন্য থালা। তুই আদো বিয়ে করতে পারবি? বিয়ে বাদ দে প্রেমটাও পারবি না। প্লান কি তোর? না রুবাইদাকে বিয়ে করছিস। না নীহারিকাকে পটাতে পারছিস। এটার জন্যেই বলে অতি বুঝদারের মাথায় কাজের সময় বুদ্ধি আসে না। মুহিতকে দেখে কিছু শিখ।’ শান্ত মুখ গুঁজে বসল। তার নিজের বোনের জন্য দুঃখ হওয়া উঁচিত। অথচ সে চাইছে তাদের বিয়ে যাতে না হয়। ভুলেও না। হঠাৎ ফাঁকা শূন্য অনুভব হতে শুরু করে। রোজ তার একটি শ্যামকন্যার কথা মনে পড়ে। কত প্রেম সে করেছে এই কয়েক দিনে। ব্রেকাপ করেছে। কিন্তু সবাইকে ভুলে গিয়েছে। শুধু একজনকে ছাড়া। যে রোজ রাতে তাকে বিরক্ত করতে চলে আসে। স্বপ্নে কল্পনায় এমন কি মাঝে মাঝে সে বাস্তবেও অস্থিত্ব খুঁজে পায়। বিমুগ্ধ নিচে থেকে লাথি মেরে বলল,’ জ্ঞান দিবি না। ব্রেকাপ হয়েছে না? বুঝতে পেরেছি ব্যাপারটা।’ সবাই হাসিতে ফেঁটে পড়ল। শান্ত সচরাচর জ্ঞান দেয় না। যখনই ব্রেকাপ জনিত ঘটনা ঘটে তখন সে খুবই জ্ঞানীর ভং ধরে। বিমুগ্ধ ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,’ দিনে কয়টা প্রেম করিস? টায়ার্ড হস না তুই?’
‘ হুজুর সাঁজো?’
‘ মোটেও না। আমি বরাবরই হুজুর।’
শান্ত চোখ মুখ বাঁকিয়ে বলল,’ ভুতের মুখে রাম রাম। আমেরিকায় কয়টা গার্লফ্রেন্ড রেখে আসছস? মনে করো খবর রাখি না? তুমি যে কি আমি ভালো করেই জানি মামু। শালা আস্ত নাটক বাজ।’
শান্ত আজেবাজে ভাষায় কথা বলা শুরু করতেই বিমুগ্ধ বলল,’ তোর মুখের ভাষা এত নিম্ন লেভেলের কেন?’ মুহিত তিশার মাথায় গাট্টা মেরে বলল,’ ক্রেডিট গোস ট্যু তিশা। এই শালী ওরে এসব শিখাইছে। আগে কত ভদ্রই না ছিল পোলাডা।’ রেগে আগুন হয়ে তিশা বলল,’ মোটেও না। শান্তইয়া আগে থেকেই পাঁকনা।’
‘ তিশা শিখান লাগে কা? আমি আগে থেকেই এসব জানতাম। আর আমি মোটেও পাঁকনা। না তিশা। শুধু বুদ্ধি একটু বেশি।’
‘ তুই সত্যি পাঁকনা। শেষ গার্লফ্রেন্ডের সাথে কি করেছিলি বলে দি?’ দ্রুত শান্ত মুখ চেপে ধরে। তিশা ছটফট করতে থাকে। চুল টেনে ধরে শান্তর। ঘুষি মারে। মরা মরা শরীর ঘেমে উঠে। শান্ত হাঁপিয়ে উঠে ছেড়ে দিয়ে বলল,’ বাংলাদেশের মেয়েগুলো পুরাই ডাকাত দোস্ত। চল আমাদের দেশে ফিরে যাই।’ বিমুগ্ধকে উদ্দেশ্য করে বলেছে শান্ত। সে হেসে দীর্ঘ উচ্চ শ্বাস বাতাসে ছড়িয়ে দিয়ে বলল,’ এ দেশে আমার খুব মূল্যবান একটি জিনিস রয়েছে। পেয়ে গেলে ফিরে যাব। এসব ছেড়ে কেক শেষ কর। বাসায় যাব। খুব ঘুম পাচ্ছে।’ আকাশ থেকে পড়ার মত করে সবাই বিমুগ্ধের দিকে তাকাল। নিজেকে এভাবে অদ্ভুত দৃষ্টির সামনে পেয়ে সে খুবই বিরক্ত হওয়ার অভিনয় মুখে ফুটিয়ে তুলল। মুহিতা অবাক গলায় বলল,’ তোর ঘুম পাচ্ছে মানে? বাজে মাত্র দশটা। নীহারিকার সাথে কথা হয়েছে তোর? আমি শিউর। আমি শিউর।’ বলেই সে লাফালাফি ঝাপাঝাপি করতে শুরু করে। বিমুগ্ধ একটু ভাবে, তার মনে পড়ে নীহারিকার সাথে তার কথা হলেই খুব দ্রুত ঘুম আসে। অলৌকিক একটি ব্যাপার বটে। তবে সত্য এটি। বিদেশী জীবন যাত্রার সাথে মিলিয়ে তার ঘুম নরমালি আসে একটা কি দু’টো বাজে। উঠে নয়টার একটু আগে।তাড়াহুড়ো করে ফিরে কাজে যেতে হয়। শুধু নীহারিকা নামক এই মেয়েটির সাথে যখন কথা হলো অনেক দিন পর্যন্ত তার ঘুম দশটার মধ্যেই এসে হাজির হয়েছে। ঘুমাতে না চাইলেও আসে। যতদিন নীহারিকার কথা তার মনে মাথায় ঘুরবে এটি ঠিক ততদিন কার্যকর। একজন সাইক্রেট্রিস্ট হওয়ার পরেও সে এর কারণ খুঁজে পায়নি। বাবাকে প্রশ্ন করায় তিনি বলল,’ মানুষের মস্তিষ্ক ক্লান্ত হয়ে আসলে ঘুম বেড়ে যায়।’ সে নিজের মনের মত করে হাসতে শুরু করল। সবাই অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে রইল। মনে মনে ভাবতে লাগল বিমুগ্ধ পাগল হয়ে গেল না তো? মুহিতা মুহিতের কানের কাছে ফিঁসফিঁস করে বলল,’ আগে আমার বিমুগ্ধের মাঝের তাজিনকে ভয় করত। সে খুবই গম্ভির এবং চুপচাপ থাকে। এখন তো নীহারিকাকে করছে। মেয়েটা অদ্ভুত বিমুগ্ধকে আরও অদ্ভুতুরে করে দিয়েছে। তাজিন তো সব সময় চোখের সামনে পড়ে না। খুবই কম দেখা মিলে। তবে এই নীহারিকা সারাজীবন চোখের সামনে ঘুরবে।’ মুহিত হেসে ফেলল। তারা একসাথে অনেক সুন্দর খুনশুরিতে ভর্তি সময় কাঁটাল। এর মাঝে বিমুগ্ধ সবাইকে অবাকের চরমে ঠেলে দিয়ে টেবিলের উপরে ঘুমিয়ে পড়ল। কয়েকবার ডাকার পরেও সে উঠল না। তার জন্য সবাইকে বসে থাকতে হল। কেউ বাড়ি ফিরতে পারল না। এর মাঝে বিমুগ্ধের ফোন আজব আওয়াজের সাথে শব্দ করে উঠল। ঘুম ছুঁটে গেল তার। হসপিটাল থেকে ফোন এসেছে ভেবে সে মাথা টেবিলের উপরে রেখেই রিসিভ করে ফেলল। ওপাশে কি বলল কেউ শুনল না। কিন্তু বিমুগ্ধের দ্রুত কার্যকলাপ সবাইকে হতভম্ভ করে দিল। বিমুগ্ধ ফোন পকেটে ঢুকিয়ে নিল। লং শার্ট খুলে শান্তর মুখের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলল,’ তোর গাড়ি নিয়ে এসেছিস?’ শান্ত প্রথমে না বলতে চাইল। কারণ তার সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি। শব্দ করে বাজে ভাবে। সবাই এটি নিয়ে মজা নেয়। তখন নতুন এসেছে এই শহরে। টাকা পয়সা আহামরি ছিল না। গাড়ি ছাড়া চলতেও পারে না সে। বাবার কাছেও চাইতে পারল না। তখন তারই এক কলিগ একটি গাড়ি বিক্রি করবে বলেছে। মাত্র ছয়লক্ষ টাকা শুনে সে কিনেও ফেলল। এখন অবশ্য পরিবর্তন করতে পারে। কিন্তু তার মায়া লাগে। গাড়িটা তার খুব প্রিয় হয়ে গেছে। একপ্রকার দুঃসময়ের বন্ধুর মত। শান্ত কিছু বলার আগেই বিমুগ্ধ বলল,’ তোর গাড়ি নিয়ে গেলে আমার পৌছাতে কাল সকাল হয়ে যাবে। মুহিত তোর বাইকের চাবি দে। আমার কার হসপিটালে রেখে এসেছি। আর তোরা এই দুই মহিলাকে বাসায় দিয়ে অর্পণের বাবার অফিসে দ্রুত আয়। আমি যাচ্ছি।’ চাবি নিয়ে বিমুগ্ধ মুহূর্তে গায়েব হয়ে গেল। মুহিত বলতে চাইল তুই তো মেইনরোডে ভালো বাইক চালাতে পারিস না। এক্সিডেন্ট হয় চালাতে গেলেই। কিন্তু সে বলতে সময় টুকু পায়নি। দ্রুত সবাই সব গুঁছিয়ে নেয়। অর্পণের কিছু হয়েছে ভেবেই তিশা উদগ্রীব হয়ে যায়। চিন্তায় শরীর দুলে উঠে। মুহিতা যাওয়ার বায় না করে। কিন্তু মুহিত জোড় করে তাকে নিয়ে বাড়ির দিকে যায়। তিশা মুহিতাকে নামিয়ে দিয়ে আসতে হবে। কারণ এই চিপার মোড়ে রাতের এগারোটা বাজে কোন গাড়ি পাওয়া যায় না। সবার মাঝে উত্তেজনা কাজ করতে শুরু করল অর্পণের জন্য। শান্ত একটু ভয় পেয়ে গেল। ফলে কয়েকবার গাড়ি ধাক্কা খেয়েছে।
________________________
সিড়ি বেয়ে নামতে নামতে জাওয়াদ উঁচু কন্ঠে তার বাবাকে বলল,’ বাবা নীহারিকা নামক মেয়েটিকে তোমার কেমন লাগে?’
লীলাবতী সোফায় বসে স্বামীর সাথে একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করছিলেন। প্রিয় জ্ঞানী ছেলের মুখ থেকে ওই মেয়ের নাম শুনেই যেন গায়ে আগুন লাগল। তিনি বেশ রেগে গেলেও শান্তস্বরে বললেন,’ সে তো বিয়ে থেকে পালানো মেয়ে। পছন্দ হওয়ার মত নয়।’
জাওয়াদ লাফিয়ে মায়ের বাসে বসে বলল,’ কিন্তু সে অসাধারণ মা।’
‘ অসাধারণের কিছুই নেই। বেয়াদপ মেয়ে। তোমার জন্য আমি একটি মেয়ে দেখেছি। খুবই সুন্দরী এবং ডাক্তার। দেখা করে আসবে।’ কঠিন কন্ঠ লীলাবতীর। জাওয়াদ শান্ত চোখে একবার তাকিয়ে বাবার দিকে তাকাল। জিনি মা ছেলের সংঘর্ষ বেশ আয়েশ করে দেখছিলেন। ছেলের দৃষ্টি নিজের দিকে দেখে তিনি ভাব নিয়ে বসলেন। জাওয়াদ নিচু গলায় বলল,’ বাবা তুমি তো বললে না কেমন লাগে?’
‘ ও কি বলবে? আমি বলছি শুনো। ভালো মেয়ে হলে তো আর বিয়ে থেকে পালাতো না। তার চেয়ে বড় কথা সে একটা আহাম্মক। যে আমার ছেলের মত কোটিতে একটি হয় এমন ছেলেকে বিয়ের মঞ্চে রেখে পালায় সে কত বড় গাঁধা আশা করি তুমি বুঝতে পেরেছ। একজন ডাক্তার হয়ে তুমি এমন গাঁধা, বেয়াদপ, আহাম্মক মেয়েকে কেমন লাগার আশা করছ?’
কি ভেবে খুব হাসল জাওয়াদ। তার অতিসুন্দর রূপ লীলাবতীকে বিস্মিত করে তুলে। কোন ছেলে কি এতো সুন্দর হয়? আর ওই বজ্জাত মেয়ে তার এই চাঁদের চেয়ে দামি ছেলেকে ফেলে ভেগেছে? আশ্চর্য্য!
‘ তোমার ছেলেকে সে রিজেক্ট করেছে বলেই তোমার ছেলের তাকে পছন্দ মা। আর বাবা তুমি একটু আঙ্কেলকে আমার দিকে নিয়ে এসো। দ্রুত বিয়ে করতে চাই।’
বাবা মায়ের সামনে এমন লজ্জাজনক বক্তব্য রেখেও জাওয়াদ দারুন খুশি। মনে হচ্ছে নীহারিকা নামক এই মেয়েটি ছাড়া সে দম নিতে পারছে না। এই মেয়েটি কি রক্তে মিশে যাচ্ছে? আচ্ছা নীহারিকা যদি জাওয়াদের রানী না হয় তখন কি হবে তার? জাওয়াদ মায়ের দিকে নিরবে নিভৃতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে উঠে পড়ল। কথাটা মাথায় কেন আসল?খুব রাগ হচ্ছে তার। কষ্ট হচ্ছে। ভালোবাসায় এত কেন কষ্ট? এত কেন দুঃখ? নীহারিকা কবে বুঝবে? এ জগতে তাকে কেউ অক্সিজেনের মতো প্রয়োজনীয় মনে করে।
চলবে………….
ভুলত্রুটি আল্লাহর দেওয়া মহান গুন ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টি দিয়ে দেখবেন। নিশ্চুয়ই ক্ষমা একটি সুন্দর গুন।
#হাফসা