প্রিয় সুখ-২৪
___________________
লম্বা বারান্দা জুড়ে আবছা আলোর সমারোহ বিরাজমান। টুং টুং শব্দ শুনা যাচ্ছে। কান খাড়া করলে নার্সদের আলাপ টের পাওয়া যাবে হয় তো। কিছুক্ষণ আগে একজন রোগীর মৃত্যু ঘটেছে। যা নাফিস উদ্দীনকে ভীতু সংকীর্ণ করে তুলেছে। ব্যস্ত উত্তেজিত ভঙ্গিমায় তিনি সামনে পিছনে হাঁটছেন। একটু ঘুমতে ইচ্ছে করছে। ভাগ্য সহায় হচ্ছে না। চোখ বুজেও আসছে না। এই চরম ভয়াবহ মুহূর্তে হঠাৎ করেই তার মনে প্রশ্ন জাগছে। আচ্ছা বাবারা কি এমনই হয়? এখন তিনি প্রতিষ্ঠিত। সংসার রয়েছে। নিজেও বাবা হয়েছেন। জীবনের অর্ধেকের কাছাকাছি সময়ে হাঁটছেন। বাবার প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়ার কথা। অর্থ, স্নেহ কিছুই এখন প্রয়োজন নেই। তিনি নিজে থেকে এসবের যোগান দিতে সক্ষম। শিশু , কৈশোর সর্বোচ্চ যৌবন পর্যন্ত বাবাকে বেশ প্রয়োজন পড়ে। সময়ের সাথে সাথে তা কমতে শুরু করে। অথচ আজ এই অদ্ভুৎ সময়ে এসে নাফিস উদ্দীন অবাক হয়ে উদ্ভাবন করলেন জীবনের এই মুহূর্ত গুলোতেই বাবাকে খুব দরকার। ঠিক শিশু বয়েসের মত। যখন বাবার কোলে মাথা রেখে আবদারের খেলা খেলতেন। এখনই যেন সেই বয়সে পৌছে গেলেন তিনি। লম্বা বারান্দার এক পাশে নিজের মেয়েকে উবু হয়ে বসে থাকতে দেখে মাথায় কিছু কথাই রয়ে গেল। তিনি এখন বাবা। ছেলেমেয়েকে কঠর শাসনে রাখেন। মেয়েটি তাকে প্রচন্ড ভালোবাসলেও খুব ভয় পায়। তিনি নিজেই সব সময় চাইতেন ছেলে মেয়েগুলো একটু ভয়ে থাকুক। ভয় মানুষকে অন্যায় কাজের হাতে পড়তে দেয় না তেমন। তখনকার সময়ে তো বাবা মাও এভাবে শাসন করতেন। কি আশ্চর্যের বিষয়! তখন খুব রাগ হতো। বিরক্ত লাগত। ভালোর জন্য বলা কথা গুলো চরম অসহ্যের মনে হতো। ইচ্ছে করত বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে। বাবা মাকে অপছন্দনীয় মনে হতো। বাবা না হলে হয় তো এই মুহূর্তে তাদের মর্ম ততটা উপলব্ধি সম্ভব ছিল না। আচ্ছা তার ছেলে মেয়েরা যদি মাত্রার বাহিরে গিয়ে কোন অন্যায় করে তাহলে কি তিনি ক্ষমা করে দিবেন? বাবারা কি সব সময় ক্ষমা করে? না কি সব অভিমান? আজ মনটা বড়ো প্রশ্নমুখি। প্রশ্ন করেই যাওয়া হবে তাকে। কিন্তু সে কোন উত্তরই দিবে না। নাফিজ উদ্দীন আবেগী হয়ে দোয়া পাঠ করলেন। বাবা সুস্থ হলে তিনি সব প্রশ্ন তাকে করবেন। তিনি তো প্রশ্নমুখি নয়। খুব কথা বলতে পছন্দ করেন। প্রশ্ন করতে এবং শুনতেও পছন্দ করেন। আগে এমন ছিলেন না। এখন হয়ে গেছেন। একটা বয়সে খুব সঙ্গী প্রয়োজন। ছেলে মেয়ের সঙ্গ, নাতিনাতনীর সঙ্গ। বিষয় বস্তু দাড়ায় তারা খুব ব্যস্ত থাকতে চান। বাবার সুস্থতার দোয়া করতে করতে হাতের করে কি যেন গুনছিলেন তিনি। ঠিক তখনই উল্টো পিঠের দিক থেকে গম্ভীর কিন্তু শাণিত একটি গলা ভেসে আসল,’ এখন কি অবস্থা?’
প্রথমে খুব স্বাভাবিক ভাবে পিছনে চোখ রাখলেও ক্ষণিকের মাঝে বিস্ময়কারক অনুভূতিতে ফেঁটে পড়ল আত্না। মোটা ফ্রেমের চশমা খুলে আসতে শুরু করেছে ইতিমধ্যে। তিনি তা ঠেলে দিলেন না। চোখে আগের ন্যায় হতবুদ্ধির দৃষ্টি অবাহত রাখলেন। গম্ভীর গলার মানুষটি আরও একটু গলা গম্ভীর করে বললেন,’ বাবার অবস্থা এখন কেমন? প্রশ্ন কানে যায় না?’
‘ তুই এখানে?’ নাফিজ উদ্দীন বিমূঢ়। প্রিয়ম এসে হাজির হয়েছে। বিমুগ্ধকে দেখে সে চমকে গেল। সাথে দাড়িয়ে থাকা পুরুষটিকে চিনতে পারল না। কোথাও দেখেছে দেখেছে মনে হচ্ছে। বিমুগ্ধকে দেখে প্রিয়ম বেশ খুশি হলো। হেসে উঠে বলল,’ ভাইয়া আপনি এখানে? কখন এসেছেন?’
বিমুগ্ধ চোখ সরু করে রাখল কিছুক্ষণ। জবাব দিল না। প্রিয়ম অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। পরক্ষণে ভাবল তাযিন ভাইয়া মানুষটাই এমন। কথা বলে খুব কম। নিজের বাবাকে দেখে সে একটু সরে আসল। এই দুইজন নিজেদের এমন ভয়ংকর ভাবে দেখছে কেন? পূর্বপরিচিত কেউ? কন্ঠে রাগ মিশিয়ে মানুষটি বলল,’ বাবাকে তুই এমন সস্তা হসপিটালে নিয়ে এসেছিস কেন? ডাক্তার কই আমি কথা বলব। সাথে নিয়েও যাব।’
নাফিজ উদ্দীন চমকে গেলেন। সাথে প্রিয়মও। শামা খালামনি এবং আনজুম আপু সকলেই উপস্থিত হয়েছে। ছোট খাটো জটলা জমেছে হসপিটালের করিডোরে। মিতু আপু ঘুম ঘুম চোখে বের হয়ে এসেছে। প্রিয়মকে পানি নিতে পাঠিয়েছিলেন। এই ছেলে তো গায়েব হয়ে গেল। বের হয়ে তিনি বড় একটা ধাক্কা খেলেন। বিমুগ্ধকে দেখে চমকে উঠে বললেন,’ তাযিন ভাইয়া আপনি এখানে?’ তারপর খালামনিকে দেখে সালাম দিয়ে সটাং হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। একটা যুদ্ধ যুদ্ধ পরিবেশ। হসপিটাল হবে দুঃখের। বা সুখের স্থান। যুদ্ধ কেন হবে? ছুটে গেলেন নীহারিকার কাছে। তাকে একপ্রকার টেনে তুলতে ব্যস্ত। নীহারিকার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। আজব এক রোগ। যা আগে কখনো তাকে ছুঁয়ে যায়নি।
নাফিজ উদ্দীন এবার গম্ভীর হয়ে গেলেন। সহজ সরল ভাব কাঁটিয়ে বললেন,’ বাবাকে কোথাও নিয়ে যেতে দিব না। আর এটা সস্তা হসপিটাল নয়।’
‘ ভালোও নয়।’ নাক ছিটকে বলল নবীন সাহেব। একটু থেমে বললেন,’ আমি বাবাকে সবচেয়ে ভালো হসপিটালে নিয়ে যাব। বাগড়া দিবি না। তোর সাথে কথা বলার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই আমার।’
নিজের বাবার চোখ ছলছল করতে দেখে প্রিয়ম একটু পিছিয়ে মাকে ডাকতে ছুটে গেল। নাফিজ উদ্দীন নিজের বাবার অধিকার এক চুলও ছাড় দিবে না। হয় তো অন্য সময় দেখা হলে তিনি আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়তেন। ভাইকে জড়িয়েও ধরতে চাইতেন। আজ দীর্ঘ ত্রিশ বছরের বেশি সময় পরে দু’জনের দেখা।
‘ বাবাকে আমি তোর সাথে দিব না ভাইয়া। বাবা আমার কাছে থেকেই চিকিৎসা নিবে।’
‘ এই একদম ভাই টাই বলবি না। এসব ন্যাকা লাগছে। তোর ন্যাকামি দেখতে আসিনি এখানে। ডাক্তার কই?’
এমন হট্টগোলে ডাক্তার এসেও হাজির। বিস্মৃত হয়ে তাকিয়ে দুই ভাইয়ের রাগারাগি দেখলেন তিনি। তারপর বুঝিয়ে বললেন অপারেশন, সিরিয়াস কন্ডিশনের কথা। কিন্তু নবীন সাহেব মানতে নারাজ। তিনি ভালো হসপিটাল হসপিটাল করে বেঁকে রইলেন। একরোখা, ঘাড়ত্যাড়া, গুরুগম্ভীর, কঠিন ব্যক্তিত্ব। মিতু আপু ভয় পেয়ে গেলেন। তিনি এমন ধরণের মানুষ খুব কম দেখেছেন। হঠাৎ করে মনে পড়ে গেল শাহিন ভাইয়ার মায়ের কথা। মহিলা ডেঞ্জারাস ছিলো। গালাগাল করত খুব। তবে এত কঠিন মুখ করে থাকতে দেখা যায়নি। এই লোক কে? কেন এসেছে? বুড়োকে বাবা বাবা করছে কেন? এসব প্রশ্নে নীহারিকার দু’ কান তিনি কথার বানে ছিঁড়ে খাচ্ছে যেন। মুখ গুমরে বসে বসে কাণ্ড দেখছে নীহারিকা। প্রিয়ম একটু একটু করে এগিয়ে এসে নীহারিকার কান ছুঁই ছুঁই করে বলল,’ তাযিন ভাই আমাদের কোন চাচার ছেলে? আমাদের কোন জেঠা, চাচা অবশিষ্ট আছে? ‘
মিতু আপু ভারী চিন্তিত সুরে প্রিয়মের কাঁধে হাত রেখে বললেন,’ মনে হইতাছে বুড়ার আর এক ঘরের ছেলে। ভাই তোর দাদা কয়ডা বিয়া করছে ক তো? মনে তো হচ্ছে চারের ঘর পূর্ণ করে পুরুষজাতীর নাম উজ্জ্বল করেছে। তোর কি মনে হয়?’ উপরের দিক থেকে অবলোকন করা ছেড়ে দিয়ে চোখ ঘুরিয়ে তাকাল প্রিয়মের দিকে। তারপর একবার নীহারিকার দিকে। দু’ জনেই যখন ভয়াবহ দৃষ্টিবিনিময় করছে মিতু আপু একটু সরে আসলো। কিছুই বলেনি এমন ভাব করে বললেন,’ মজা করছিলাম। তোরা দুইডা এমনে তাকায় আছিস ক্যান?’
বাবার চিৎকার শুনা যাচ্ছে,’ বাবাকে নিয়ে যেতে দিব না। তুই এতগুলো বছর যেভাবে দূরে ছিলি এখনও থাক। মাথা গরম করবি না।’
‘ আমি দূরে ছিলাম? আমি? কেন ছিলাম? বলতাম এখন? তোর আমাকে ভয় পাওয়া উঁচিত। না কি গলা বাজি করা।’
হাসতে লাগলেন তিনি। জায়গাটিকে কোন অংশেই হসপিটাল মনে হচ্ছে না। নিঃসন্দেহে মনে হচ্ছে রহস্য আর দ্বন্দ্বের আলোচন সভা। বাবার মুখের রং ধূসর হয়ে গেল কিছু সময়ের জন্য। কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে বেজাই রাগ নিয়ে বললেন,’ হসপিটালের বাহিরে যা। তোর পরিবার নিয়ে এই মুহূর্তে বেরিয়ে যা। দ্রুত।’ নাফিজ উদ্দীনের রক্তলাল চোয়াল। এক হাতে কলার চেপে ধরলেন নবীন সাহেব। শামা খালামনি মুখে হাত দিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন। মা ঠিক তখনই এসে উপস্থিত হলেন। বোনকে দেখে চোখ চিকচিক করলেও বোনের স্বামীকে তেমন মনে ধরলো না। মুখের রং উবে গেল। চেহারা ফ্যাকাশে করে আতঙ্কিত তিনি। হচ্ছেটা কি? ছোটদের মুখমণ্ডলে জানার নিরন্তর আগ্রহকে বড়রা তোয়াক্কাই করছে না। নিজেদের ঝামেলা নিয়ে তারা মশগুল। কলার টানাটানির পর্যায়টা জঘন্য ঠেকল প্রিয়মের কাছে। বাবার কলার ধরেছে? রাগ আকাশ ছুঁয়ে যাচ্ছে। তবুও চুপ করে এক কোণে দাড়িয়ে আছে। সব যেন মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। হুট করে একজন খালা চলে আসলো। যাকে তারা কেউ চিনে না। কখনো তার সম্পূর্কে কোন আলোচনা, জিকির হয়নি। সাথে আবির্ভূত হলো দুই খালাতো ভাই বোন। এই পর্যন্ত মেনে নিয়েছে। কিন্তু সেই খালার স্বামী কোথা থেকে এসে এই করুন পরিস্থিতিতে দাদামশায়কে বাবা দাবি করছে? আবার বাবার সাথে তুলুম লড়াইয়ে লিপ্ত! অহংকারী নাক উঁচু লোকটাকে একটু মাথা তুলে দেখলো নীহারিকা। লোকটির একটি পায়ে সমস্যা। খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটে। অদ্ভুৎ কিছু সরঞ্জাম আর জুতো দেখেই টের পাওয়া যাচ্ছে। লম্বা বাবার থেকে একটু বেশি। চোখমুখে বাবার অবয়ব দেখা যাচ্ছে। উঁচু নাক, কপোল, ললাট, বেশির ভাগ মিল। গায়ের রং বেশি উজ্জ্বল। দাদামশায়ের মত তার কোন ছেলে মেয়ের গায়ের রং হয়নি। হয়েছে দাদিজানের মত। এটি সত্যি তার চাচা! মনে অত্যন্ত কাতরতা নিয়ে বিমুগ্ধের তীক্ষ্ম নজরে নজর ডালল নীহারিকা। তার কোন ভ্রুক্ষেপই দেখা গেল না। নিরুত্তাপ নয়নে সে একবার পিছনে ফিরে তাকিয়ে ড্যাম কেয়ার একটা ভাব নিল। অথচ এই লোক দুই দিন আগেই তার সাথে দেখা করেছে। কি সব বলেছে। সব উড়ে গেল? চট করে মনে পড়ল নীহারিকার, বিমুগ্ধ আগে থেকে তাকে চিনত। সেই ট্রেন নয় শুধু আরও আগে থেকে। সে জানত নীহারিকা তার পরিবারের মানুষ হয়। তা সত্ত্বেও বলেনি। কিছুই না। মাথা যন্ত্রণা করে উঠল তার। রাগ না কি ঘৃণা, না কি কষ্ট ঠিক কোন জিনিসটা এই মুহূর্তে অঙ্গে অঙ্গে খেলে যাচ্ছে বুঝা বড় দায় হয়ে দাড়াল। অথচ ভীষণ মাথা যন্ত্রণায় নীহারিকা পাগল হয়ে যাচ্ছিল। আজকের দিনটি তার জন্য ঠিক বেদনার না ক্ষোভের সে ধরতে পারলো না। মন এবং মস্তিষ্ক চাইছে বিমুগ্ধের গাল বরাবর ঠাটিয়ে কয়েকটি চড় কষতে। নিরুপায় সে জানে এটি করতে পারবে না। এই সময়টুকুতে সম্ভব হবে না। কিন্তু বিমুগ্ধ কয়েকটা চড় তার থেকে পাওনা আছে। সুদ সময়ে ফিরিয়ে দিবে বলে মনকে বুঝিয়ে ঠান্ডা শীতল করতে চাইল। হলো না। সময় যেন আজ বড্ড খারাপ। একরাশ বিতৃষ্ণা কাজ করছে। সাথে যোগ হয়েছে আফসোস। এদের বাবা না অসুস্থ? যাকে নিয়ে তারা ঝগড়া করছে তার কথাই বেমালুম ভুলে বসে আছে। ভীষণ ভীতিপ্রদ একটি ঘটনার আবির্ভাব হলো। দু’ জনের বিবাদ যেই পর্যায়ে পৌছল তা দৃষ্টিকটু। কলার ধরার সাথে গলার শব্দ ভান্ডার উন্মুক্ত করে দিলেন যেন নবীন। চিৎকার করে বললেন,’ তোকে এখনই মেরে সোজা করে দিব। আমার ত্রিশ বছরের রাগটা এখন দেখানোর ইচ্ছে নেই। তবে তুই যদি বাড়াবাড়ি করিস দেখাতে বাধ্য হবো।’
‘ আমি কোন বাড়াবাড়ি করছি না। মাঝ রাতে এসে হঠাৎ করে বাবার জন্য তোর মন উতলা হয়ে গেল? উড়ে চলে আসলি? আবার ভেজাল শুরু করলি। তা কোথায় ছিলো এই বাবা বাবা ভালোবাসা? ত্রিশ বছর কম? একটা খবর তো কখনো নিয়েছিস বলে মনে হয় না। আসছিস ছেলে হতে। বাবা মা হতে যেমন যোগ্যতা লাগে ছেলে মেয়ে হতেও লাগে। সব কিছুর পিছনে একটি যোগ্যতার প্রয়োজন। সবাই চাইলেই উড়ে এসে ছেলে হয়ে যায় না।’ নাফিজ উদ্দীন ঘৃণা ভরা চোখ নিয়ে হাসলেন। তাকে হিংস্র দেখাচ্ছে। হসপিটালের নার্স, ডাক্তার, ওয়ার্ড বয়, ম্যানেজার সবাই হাজির। কেউ থামাতে পারছে না এদের তুমুল সংঘর্ষ। দু’ জনকে কোন অংশে ভাই মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে জানের দুষমন। কেন এই দুষমনি সেটা ভুলে সবাই এদের থামাতে ব্যস্ত। অন্যরোগীদের সমস্যা হচ্ছে। দু’জনকে টেনে নিয়ে আসতে চাইছে। কিন্তু গায়ে হাত দেওয়ার আগেই ভয়াবহ দৃষ্টি নিয়ে তাকাছে দুজনেই। কি আশ্চর্য সেই দৃশ্য। কলার আরও টেনে মুখের সামনে নিয়ে এসে অমায়িক হাসলেন নবীন সাহেব। নীহারিকার কানে সেই হাসি যেতেই সে বিনা ডিএনে টেস্টে একশো পার্সেন্ট নিশ্চিত বিমুগ্ধ এই লোকেরই ছেলে। দু’জনেই অসম্ভব সুন্দর করে হাসতে পারে। দাঁতে দাঁত চেপে কিড়মিড় কন্ঠে তিনি বললেন,’ সেটাই তো বুঝাতে চাইছি। তোর যোগ্যতা নেই এফোর্ড করার। বাবাকে নিয়ে যেতে দে। সব কিছুর জন্য সত্যি যোগ্যতার প্রয়োজন। তোর মতো সামান্য কোম্পানির এম্প্লয়ী এটা কখনো হিসেবে রাখতে পারবে না। তুই যদি না চাস ভরা মজলিসে তোর মুখোশ টেনে ধরি তাহলে যেতে দে। তোর সাথে কথা বলার রুচি নেই।’
‘ আমারও রুচি নেই। যা ছিল এই মুহূর্তে শেষ হয়ে গেছে। আমি তো সারাটা জীবন বিষাদ আর অনুশোচনায় ভুগেছি। ভেবেছি তুই আমার জন্য এত দূরে চলে গেয়েছিস। এখন তো দেখছি না তুই তো আগে থেকেই ছিলি এমন স্বার্থপর।’ নাফিজ উদ্দীনের গলা উঁচু। কন্ঠ ধারালো। ক্রদ্ধে তার দুই চোয়াল শক্ত কাঠের মত।
‘ তোকে ইচ্ছে করছে মেরে হাড় গুড়ো করে দিতে।’ রাগে গজগজ করছে নবীন। হাত কাঁপছে তার। চোখ ধারালো তীরের মত তীক্ষ্ন। বহু বছরের ক্ষোভ রাগ সব গলায় এসে বিধছে। নাফিস উদ্দীনের কাশি উঠে গেল। তবুও মৃদু হেসে বললেন,’ ত্রিশ বছর আগের মত? সেই নাফিস এখন আর নেই। গলা ছাড়।’
কিন্তু নবীন ছাড়লেন তো নাই উল্টো আরও গভীর ভাবে টেনে ধরলেন। শক্ত হাতে একটি কঠিন ধাক্কা প্রয়োগ করে সরে আসলেন বাবা। পায়ে সমস্যা থাকার ফলে নবীন বেশ পড়েই যাচ্ছিলেন। বিমুগ্ধ দ্রুত পিছন থেকে নিজের বাবাকে ধরলেন। হঠাৎ কি হলো কে জানে। ঝড়ের বেগে ছুটে এসে সে নাফিস উদ্দীনের বুকের কাছে মোটামোটি আকারের একটি ধাক্কা দিলো। বলা বাহুল্য এটি নিজের বাবাকে ধাক্কা দেওয়ার একটি প্রতিশোধ ছিলো। রক্তরাগ নিয়ে সে এক হাতে নিজের বাবাকে ধরে তাকিয়ে রইল নাফিস উদ্দীনের বিস্মৃত চোখের দিকে। ধাক্কায় তিনি দূরে সরে গিয়েছে। ক্ষতি বেশি নয়। তবুও হাটুর বয়সি একটি ছেলের থেকে এটি কখনো আশা করেননি তিনি। ছেলেটি কে? কথাটা মাথায় আসতেই ভ্রু কুঁচকে নিলেন। কিন্তু কল্পনায়ও ভাবতে পারেননি তার ছেলে এর বিনিময়ে কি করবে। কে হতে পারে ভাবতে ভাবতেই প্রিয়ম আছড়ে পড়ল যেন। কি হচ্ছে হসপিটালে কেউই বুঝতে পারছে না। জাওয়াদ তখন রুমের বাহিরে চলে এসেছে। প্রিয়ম এমন একটা কাজ করবে বলেই যেন ভেবে রেখেছে। এতসময় তার সব অরুণরাগ নিয়ন্ত্রণে ছিল এই অত্যল্পকালেরই জন্য। বিমুগ্ধের লম্বা শার্ট তার হাতের মুঠোয়। থরথর করে কম্পিত চোয়াল। বিমুগ্ধের অবস্থাও রক্তিম। দুই ছেলের এমন দাপিয়ে সংলড়াইয়ে সবাই হতবুদ্ধি। এবার পরিস্থিতি বেশিই অনিয়ন্ত্রিত। জাওয়াদ বুঝতে পারলো না কি হচ্ছে। দ্রুত বলল এদের আলাদা করতে। সাথে সাথে সকলে লেগে পড়ল। জটলার মত স্থানটি জটিল ধাঁধার মত গুলিয়ে যাচ্ছে। অথচ না বিমুগ্ধকে সরাতে পারছে না প্রিয়মকে। এতসময় ধরে বাবাকে যত অপদস্ত করছি তার রাগ শরীরে বাসা বাঁধছিল। কমার নামই নিচ্ছিলো না। আবার কিছু বলতেও পারছিল না। বাবা সব সময় বলে বড়দের মাঝে ছোটদের কখনো ঢুকতে নেই। কিন্তু সেই নিয়ম প্রথম ভঙ্গ করেছে বিমুগ্ধ। এতে তার রাগ তীব্র ভাবে আকাশ বাতাসে ঝড় তুললো। হসপিটালের দেয়ালে দেয়ালে আতঙ্ক বিরাজমান। সবার মুখ এতটাই থমথমে যে কেউ কিছুই বলার মধ্যে নেই। প্রিয়ম অসভ্যের মত কলার ঝাকিয়ে বলল,’ বাবার গায়ে হাত দিলেন কেন? এতো বড় সাহস কিভাবে হলো?’ বিমুগ্ধ নিরুত্তাপ। চোখ লাল তার। মুখে কোন কথা নেই। তবে ক্ষোভ ছড়াছড়ি মুখে। মা এগিয়ে এসে প্রিয়মকে সরে যেতে বললেন। সে শুনলো না। ঘাড় ত্যাড়ার মত ফোঁস ফোঁস করছে। মুখ দিয়ে শ্বাস নিচ্ছে। এত ঝামেলার মাঝেও নীরবতা রয়েছে। কেউ বেশি উত্তেজিত হয়ে খুব জোড়ে চিৎকার করছে না। কয়েকবার বেশি হয়ে গিয়েছে। তবুও একটা লিমিটের মাঝে সব ছিলো। প্রিয়মের রাগ মনে হচ্ছে সেটাও ভঙ্গ করবে। বিমুগ্ধ এত চুপ কেন? নীরবতার কারণেই প্রিয়ম আরও ফুসছে। যে কোন সময় ঘুষি পড়বে। নীহারিকা ভাইয়ের হাত টেনে খুলে নিল। সেও বোনের দিকে তাকিয়ে চুপ হয়ে গেল। কোন কথা নেই। সব নিস্তব্ধতায় ছেয়ে গেল। শান্ত চোখে একবার সে বাবার দিকে একবার তার হঠাৎ উদিত হওয়া বাবার ভাইয়ের দিকে তাকালো। হাঁপড়ের মত বুক উঠানামা করছে তার। মাথা ভর্তি যন্ত্রণা। শা শা শব্দ ভেসে আসছে শ্বাসের সাথে। চোখ মুখ রক্তজবা। চোখ কঠিন। তীর্যক চোখে সব একবার দেখে প্রিয়মের হাত নিজের হাতে নিয়ে বলল,’ চল। এটা হসপিটাল।’
‘ কিন্তু আপু এই ছেলে বাবাকে ধাক্কা দিয়েছে। তুই দেখিসনি? বড়দের মাঝে কেন ঢুকলো? বাবা আর উনার বাবা কথা বলছিলো। ঝগড়া করছিলো। তাদের দ্বন্দ্ব তারা সমাধান করবে। উনি এগিয়ে গেল কেন?’ তেড়ে আসতে নেয় প্রিয়ম। নিজের বাবাকে অসম্ভব ভালোবাসে সে। পৃথিবীর সব মাফ বাবা মায়ের বেলায় কোন সেক্রিফাইস করতে নারাজ সে। চোখ গরম করে তাকালো বিমুগ্ধের দিকে। নীহারিকা দ্রুত তাকে জড়িয়ে পিছনে ঠেলতে লাগলো। নবীন উদ্দীন কিছু বলার জন্য মুখ খুলছিলেন সাথে নাফিস উদ্দীনও। এবার গলা ফাঁটানো একটা চিৎকার দিলো নীহারিকা। সবাই যেন চমকে উঠলো। সবচেয়ে বেশি চমকে গেলেন নাফিস উদ্দীন। তার মেয়ে রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। উত্তেজিত হয়ে নীহারিকা থামা থামা শ্বাসে চেঁচালো,’ সমস্যা কি আপনাদের? এটা কি আপনাদের ঝগড়া করার জায়গা? বাবা বাবা করছেন অথচ তার কথাই ভাবছেন না। আশ্চর্য ছেলে তো আপনারা। উনি পিছনের রুমে রয়েছে ভুলে গেলেন? এই ফ্লোরে শুধু আপনাদের বাবা নয় অনেকে রয়েছে। এমন সিরিয়াস অবস্থায় আপনারা চিৎকার, মারামারি, ঝগড়া, বিবাধে লিপ্ত?’ এবার মুখে বিস্ময় ফুঁটিয়ে নীহারিকা আবিলতাশূন্য কন্ঠে বলল,’ বাবা! আপনাদের বাবা হয়? দেখে তো মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে আপনারা আরাম করে ঘরে বসে ঝগড়া করছেন। আরে উনি সিরিয়াস পেশেন্ট। জীবন মৃত্যুর সাথে লড়ছে আপনাদের বাবা। বুঝতে পারছেন? হার্টে ব্লক ধরা খেয়েছে। আপনাদের মাঝে তার বিন্দুমাত্র চিন্তা দেখছি না। দু’ জনই এখান থেকে সরুন। স্যরি বাবা যাও এখান থেকে। দ্রুত।’ নবীন হতভম্ভ হয়ে গেলেন নীহারিকাকে দেখে। মনে হচ্ছে তার মা সশরীরে তাকে বকছে। এত মিল? ছবির থেকেও বাস্তবে বেশি জীবন্ত। তিনি হা করে নীহারিকাকে দেখতে লাগলেন। বিস্ময়ে অভিভূত তার চোখ। নীহারিকার মুখশ্রীর করুন অবস্থা। তার এমন অবস্থা দেখে প্রিয়ম ভয় পেয়ে বলল,’ আপু তোর কি হয়েছে?’ নীহারিকার চোখে পানি জমে গেছে। সে নিঃশ্বাস নিতে পারছে না ঠিক ভাবে। তবুও বলল,’ বাবার সাথে যা। বাবা তুমি প্রিয়মের সাথে যাও। ফ্রেশ হও। যাও।’ নীহারিকা সরে আসছিল। হঠাৎ থমকে দাড়িয়ে বিমুগ্ধের সাথে ভয়ঙ্কর একটি ঘটনা ঘটিয়ে গেল। উল্টো ঘুরে দু হাতের শরীরের সর্ব শক্তি দিয়ে বুকে প্রচন্ড জোড়ে ঠেলা দিলো। বিমুগ্ধ তেমন নড়লো না। কিন্তু কাত হয়ে পড়লো তার বাম পাশ। আঙ্গুল নাচিয়ে রক্তহীম করা কন্ঠে নীহারিকা সুতীক্ষ্ণতা নিয়ে বলল,’ বাবাকে আঘাত করার দুঃসাহস আর কখনো দেখালে মেরে ফেলবো আপনাকে আমি। বাবা মা না। তারা সব কিছুর বাহিরে। ভুলেও তাদের টেনে নিয়ে আসবেন না।’ নাফিজ উদ্দীন মেয়ের কার্যকলাপে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলেন। বাক্যহারিয়ে গেল দুই ছেলে মেয়ের কান্ডে। বিমুগ্ধ চোখ তুলে একবার তাকালো সেই চোখের দিকে। যা মুহূর্তের মাঝে তাকে ধ্বংস করে দিল। তার সব অনুভূতিকে হারিয়ে দিয়ে সে নিজের একটি কঠিন রূপ ভেঙ্গে গুড়িয়ে যেতে দেখল। নীহারিকার সেই চোখে কি ছিলো সে জানে না। হয় তো রাগ। শুধু রাগ নয়, একরাশ ঘৃণা। কেন? বাবা কে ধাক্কা দেওয়ায়? কিন্তু না আরও কিছু ছিলো। কিছু ভাঙ্গার কষ্ট। কিছুটা কি ঠিক ধরতে পারলো না। বিমুগ্ধের চোখ হয়ে আসল শীতল। হিম। বরফের ন্যায়। ঠোঁট ফ্যাকাশে। তার বিচক্ষণ বুদ্ধীদিপ্ত মস্তিষ্ক চট করে ধরে ফেলল। নীহারিকা তাকে কোন ভাবে নিজের শত্রু ভাবছে না তো? শত্রু! বিমুগ্ধ তাকিয়েই রইলো। নীহারিকা সরে যেতে যেতেও তাকে শান্ত অথচ কঠিন বিনাশ যুক্ত নজরে দেখে নিলো। যার দৃষ্টিবানে সত্যি বিমুগ্ধের মাঝে একটি বিনাশ শুরু হলো। শুরু হলো সর্বনাশ। অসহায়িত্ব চোখে ভেসে উঠল। নিজের কঠিন ধ্বংসযজ্ঞ স্তুপে দাড়িয়ে বিমুগ্ধ আবিষ্কার করল এটা শুধু ভালোবাসা নয়। সে এই নারীর আক্রোশের নেশায় পড়ে গিয়েছে। এই নারী তার হৃদয়কে নিজ হাতে ধ্বংস করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। বিমুগ্ধের হঠাৎ মনে হচ্ছে একে সে শুধু দূর থেকে ভালোবাসতে পারবে না। এটি শুধু তার দূরের বহু দূরের ভালোবাসা নয়। এই নারী যদি তাকে ঘৃণা করে তাহলে তার সব শেষ। সে নিজে শেষ। আজ যেন বিমুগ্ধ এবং তাযিন দুই সত্তাকে পিছনে ফেলে নীহারিকার জন্য তৈরি হওয়া তার হৃদয়ে সেই পুরুষটি হুট করে জেগে উঠেছে। এই অসহায়িত্ব কখনো বিমুগ্ধ বা তাযিনকে ঘায়েল করতে পারে না। এটা শুধু নীহারিকার সেই পুরুষের চোখেই তৈরি। যে তাকে প্রথম দেখায় প্রেমে পড়েছে। যে তার ভয়ংকর রাগ, ক্রোধ, অনিয়ন্ত্রিত ক্ষোভের হাতে নিঃশেষ হয়ে গেছে। মাত্র একটি ছাতার সাথে যে মেয়েটি তার মন, আত্না, হৃদয়, অস্তিত্ব, প্রিয় শান্তি, প্রিয় সুখ সব কেড়ে নিয়েছে। হ্যাঁ তার জীবনে এরই তো কমতি ছিলো। বিমুগ্ধ ধরতে পারলো তার মাঝে এমন এক প্রেমিক বাস করে যে কখনো তার ভালোবাসার চোখে ঘৃণার বস্তু হতে চায় না। নীহারিকার চোখের ঘৃণার কাছে সে বড্ড দূর্বল। যা তার সকল অস্তিত্বকে মিথ্যে করে দিয়েছে। এটা শুধু ভালোবাসা নয়। এটা ভয়ংকর কিছু। যা তাকে কিছুক্ষণ আগের ভুলটিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। বিমুগ্ধ নিজের চুল পিছনের দিকে টেনে নিলো। জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল বাবা আর তার ভাইয়ের মাঝে আসা। হ্যাঁ বিমুগ্ধ জীবনে প্রথম নিজের ভুল এতটা ঘটা করে শিকার করছে। নীহারিকার বাবার গায়ে হাত দেওয়া একদম উচিৎ হয়নি। এই রমনীর চোখে কখনো ঘৃণা দেখতে পারবে না সে। কখনো না। শুধু, শুধু ভালোবাসা দেখতে চায় ওই চোখে। রাগ মিশ্রিত ভালোবাসা থাকবে রাগেশ্বরীর চোখে। রাগেশ্বরী!
_______________
এতসময়ের ঝামেলা একটি মেয়ের কথায় চুকে গেছে। অথচ এই মেয়ে এতসময় নিশ্চুপ হয়ে বসে ছিলো। কেন? নার্সগুলো ফিসফিস করছে। নাফিস উদ্দীনকে নিয়ে নিচে চলে গেছে প্রিয়ম। আফিয়া বিলকিস বোনের হাত ধরে তাকে কেবিনের দিকে নিয়ে গেলো। এত বড় গন্ডগোলে এই দুইবোন এতো চুপ ছিলো যে মিতু আপুর একবার মনে হলো শকে বোবা বোনে গেলো না কি? এদের স্বামীরা তাণ্ডবলীলা করেছে। আর এরা? এতো চুপ? আশ্চর্য! সত্যি চরম আশ্চর্য্যের বিষয়। বোনে বোনে এতো মিল? দু’ জনে এমন ভাবে হাত ধরে রুমে ঢুকছে যেন বেড়াতে এসেছে। আরে এদের স্বামীরা যে এখানে ঘূর্ণিঝড় তুলেছে এরা জানে না? তবুও এতো রিলেক্স? হাউ ক্যান থিস/দিস পসিবল? বিমোহিত হয়ে গেলো মিতু আপু। সবচেয়ে বেশি বিস্মৃত করেছে নীহারিকা। শুধু তাকেই নয়। সবাইকে। তাযিন ভাইকে ধাক্কা মেরে দিলো? ও মাই গড! এই মানুষটার সাথে তো নীহারিকা ভুলেও কথা বলতে চাইতো না। অথচ এমন ভাবে বলল যেন সত্যি খুন করে দিবে। আর তাযিন ভাই এমন ভাবে তাকিয়ে ছিলো যেন খুন করে মাটি চাপা দিলেও তার সমস্যা নেই। বান্দা হাজির। চলছেটা কি? মনে তো হচ্ছে নীহারিকার হাতেই মরবে এই নাক উঁচু দানবটা। মিতু আপুর মনে হচ্ছে বিয়ে থেকে পালিয়ে আসা উচিৎ হয়নি। এখন তো মনে হচ্ছে পাগল হয়ে যাবে। তাদের পরিবার তো থ্রিলার মুভি। বেশ দারুন তো। তিনি এবার হেসে ফেললেন। আনজুম আপু একা দাড়িয়ে। বাদ বাকি সদস্য ধীরে ধীরে কমে গেছে। তার বাবা ডাক্তারের সাথে কথা বলতে গেলেন তার কেবিনে। নীহারিকা দূরে একটি চেয়ারে বসেছে। এই মেয়ে ভারী অদ্ভুৎ। এখন কিছু বলা যাবে না। পরে তাকেই থাপড়াবে। বাকি রইলো তাযিন ভাই। আরে বাপরে দূর দূর। মিতু আপু তার জুটি বেধেছেন আনজুমের সাথে। আনজুম তখন নিশ্চুপ হয়ে ভাবছে, নীহারিকা একটা বাঘিনী। তার দাভাইয়ের সাথে সেই যায়। রূবাইদাটা এখানে থাকলে কয়লা হয়ে যেত। তার দাভাই একটা মেয়ের এতো ক্ষোভ গিলে গেল? সাথে ধাক্কাটাও হজম করল? সবচেয়ে সুন্দর, মনোরম, রমনীয়, হৃদয়ে হাহাকার তোলার মতো দৃশ্য ছিলো দাভাইয়ের নীহারিকার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকা। সরে যাওয়ার পরেও তাকিয়ে থাকা। ইশ। বুকে হাত দিয়ে আনজুম মুচকি হেসে দাভাইর দিকে তাকিয়ে আছে। মিতু আপু খুবই আজাইরা একটা প্রশ্ন করল। যা শুনে আনজুমের মুখ থ হয়ে গেলো। রিনঝিনে গলায় মিতু আপু বললেন,’ বুড়ো, মানে দাদামশায় কি তোমার দাদিকে বিয়ে করেছে?’ আনজুম চোখ টিপটিপ করে তাকিয়ে বলল,’অবশ্যই বিয়ে করেছে। বিয়ে না করলে আমার আব্বি তো পৃথিবীতে আসতো না।’ বেশ বুজদারের মত মিতু আপু মাথা ঝাকিয়ে বললেন,’ সেটাই সেটাই। তা কবে করেছে? জানার আগ্রহ এই আরকি। আমি কি চিন্তা করছি জানো?’ মিতু আপু থেমে গেলেন। আনজুম এবার বিরক্ত হয়ে বলল,’ না বললে কিভাবে জানবো মিতু?’
মিতু আপুর চোখ চকচকে। এই প্রথম তার বয়সী কেউ তাকে আপু ডাকেনি। ওহ আল্লাহ সে তো ভেবেছিলো এবারও বুঝি সবাই দলবেধে মিতু আপু মিতু আপু করবে। শ্বাস ফেলে তিনি হেসে উঠলেন। সুন্দর সেই হাসি। দাঁত বের করা হাসিতে ফেঁটে পড়ে বললেন,’ চিন্তা করছি কার দাদিকে আগে বিয়ে করেছে? তোমার না নীহারিকার?’ আনজুম বাক্যহারা নয়নে তাকিয়েই রইলো। কিছু বললো না। মিতু আপু এমন আজগুবি বুলি আওড়াতেই থাকল। এক সময় বিরক্তিতে তিক্ত হয়ে আনজুম মুখ খুলল,’ দাদামশায় একটা বিয়েই করেছে। আর আমার বাবা নীহারিকার বাবা আপন ভাই ভাই।’ বিস্ফারিত চোখে তাকালেন মিতু আপু। আবার চোখ বন্ধ করেও নিলেন। বিড়বিড় করে বললেন,’ কিন্তু মনে তো হলো চির শত্রু। আপন শত্রু বোধ হয় এদেরই বলে। বাবারে নীহারিকার গুষ্ঠি তো দেখি আমার গুষ্ঠির থেকেও পাগল।’
‘ দুইজনের গুষ্ঠির সব মানুষই একুই। তাই তুমি এতো চিন্তিত না হয়ে আম্মির কাছে চলো। সে আসার সময় অনেক খুশি ছিলো তোমাদের সাথে দেখা করার জন্য।’
মিতু আপুও খুশি মনে ভিতরেই যাচ্ছিলেন। হঠাৎ আবার খাম্বার মত দাড়িয়ে গিয়ে বললেন,’ আমি চিন্তা করছি কোন দিন যেন আবার এই তাযিন ভাই এসে বলে তিনি নীহারিকা বা আমার আপন ভাই আল্লাহ জানে। ভাই হওয়ার তো অনেক সখ। খালাত, চাচাত, বাপরে।’ বিড়বিড় করলেও আনজুম শুনে নিলো। চোখ বড় করে তাকাতেই মিতু আপু বিগলিত হাসলেন।
____________________
নিচের দিকে চোখ নীহারিকার। পিঠ উঠা নামা করছে। বিমুগ্ধ এই হসপিটালে এসেছিল দু’ বার। দু’ টোই কাজে। এখানের অল্প বয়সি নার্স গুলোর বড় আকর্ষণ তার প্রতি। তার স্টাইল, ফ্যাশন ফিসফিসানীর যোগ্য। জাওয়াদ শেষ দিনে বলেছিল,’ তাযিন তুমি এই হসপিটালে ভুলেও জয়েন করবে না।’ বিমুগ্ধ ভ্রু কুঁচকায়। সে বলল,’ হসপিটালের নার্সেরা তোমাকে আর আমাকে দেখতে দেখতেই দিন শেষ করে দিবে। পরে দেখা যাবে রোগী সব শেষ। তবে তুমি একটু বেশিই স্টাইলিশ। অস্থির।’ জাওয়াদ একদম সামনের দিকে দাড়িয়ে। এখান থেকে লম্বা বারান্দা দেখা সহজ। আজকের আবহাওয়া এতটা জঘন্য রূপ নিবে সে কখনো কল্পনা করেনি। মনে হচ্ছে চারপাশের পরিবেশে বিষ ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বিষাক্ত বিষ। যা মানুষের হৃদয়কে বিনাশ করে দিবে। বিমুগ্ধ খুব ধীর পায়ে নীহারিকার সামনের বেঞ্চে বসলো। সেটি লম্বা বেঞ্চ। নীহারিকারটা লাগানো চেয়ার। এক সাথে চারটি চেয়ার জুড়ে দেওয়া হয়েছে। তারটার রং কমলা। বিমুগ্ধ তাকিয়ে আছে। কমলা, লাল, হলুদ রঙ্গ মিশ্রিত একটি চাদর গায়ে। কালো ওড়না মাথায়। দু’ পাশ ঘিরে ছোট চুল এসে গাল ছুঁয়ে দিচ্ছে। নাকটা টকটকে। গাল দুটি ঠিক বুঝা যাচ্ছে না। চোখ, ঠোঁটও দেখার উপায় নেই। রাগ যে তার মাথায় চড়ে আছে বিমুগ্ধ জানে। এই মেয়েটির এতো রাগ! বিমুগ্ধ চোখে হাসলো। তাকিয়ে রইলো নির্নিমেষ। নীহারিকার খবর হলো না। সে দেখল না। বুঝতে পারল না। অনুভবও করতে পারল না। কেউ গভীর, আরও গভীর, প্রগাঢ়, জটিল অক্ষিযুগল দিয়ে তাকে দেখছে। যেই চোখের ভাষা শীতল। ঠান্ডা। কনকনে বরফখন্ডের মতই জমাটযুক্ত। অথচ চক্ষুরাজায় বিরাজমান তীক্ষ্ন অনুরাগ। বিমুগ্ধ হঠাৎ হঠাৎ শব্দবিহীন ঠোঁটে হাসছে। তার চোখ মুখের রং পরিবর্তন হয়ে গেছে। এখন আর সে বিরক্ত নয়। সে রাগীও নয়। চঞ্চলও নয়। তার মাঝে না বিমুগ্ধ আছে না তাযিন। কোথায় যেন হারিয়ে গেলো দু’ জনেই। আছে শুধু প্রেম। ভালোবাসা। একটি মেয়েকে হৃদয় দিয়ে দেখার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। এই মেয়েটি তো তাকে মুখ থুবড়ে ফেলে দিল। তার গৌরব, মহিমা, অহংকার, রাগ, ক্ষোভ, কিছুই কাজ করছে না। মন বলছে এই সময় রহস্যময় না হোক। তার মাঝে কোন গোপনীয়তা না থাকুক। তার কোন একটি প্রকৃত অস্তিত্ব ধরা দিক। যে শুধু রাগেশ্বরীর।
চোখের পানি মুছতে মুছতে নীহারিকা ক্লান্ত। এতো পানি কেন পড়ছে? চোখ খারাপ হয়ে গেল না তো? নীহারিকা প্রচন্ড বিরক্ত। কান্না তো সে করছে না। এটা তার জন্য মোটেও সহজ নয়। শরীর খুব খারাপ করছে। মাথা ঘুরছে। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। চোখ উপরের দিকে তুলতেই আবার তীব্র জটিল ক্রোধ তাকে আক্রমণ করল। চোয়াল কঠিন করে নীহারিকা তাকিয়ে রইল। তার সরু নাক ফুলে উঠছে। বিমুগ্ধের কি হলো কে জানে। সে ঠোঁট কামড়ে হাসছে। খুব হাসি। অমায়িক। হৃদয় দুলানো প্রেমময় সেই হাসি। এই হাসি দেখে পাগল হবে না এমন মেয়ে কম আছে হয় তো। নীহারিকার মনে হচ্ছে বিমুগ্ধের এই হাসি ছিনিয়ে নিতে। একদম কেঁড়ে ঠোঁট থেকে তুলে নিতে। যাতে কখনো আর এভাবে হাসতে না পারে। কখনোই না। বিমুগ্ধ একটু ঝুঁকে এগিয়ে এসে নিচু গলায় বলল,’ খুনি একটা।’
চোখমুখ ভর্তি হাসি তার। চমৎকার তার ধারা। শরীর জ্বলে উঠল নীহারিকার। তবুও চুপ করে দম বন্ধ করে রাখল। নিজের নিঃশ্বাসের শব্দও তাকে বিরক্ত করতে ব্যস্ত। বিমুগ্ধ কন্ঠ খাদে নামিয়ে নিল। নরম খুব কোমল সুর তার,’ কোন জেলে তোমাকে পাঠানো যায় বল তো?’
চরম দিশেহারা চোখে তাকাল নীহারিকা। আকাশ বাতাস সব যেন অদ্ভুৎ ঠেকছে। ‘ তুমি’ সে কবে থেকে বিমুগ্ধের তুমি হলো? এই বাক্য তো তার কাছে খুব দামী! অনুভূতিতে হারিয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও নীহারিকা হারাল না। শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। জ্বলন্ত গলায় অবহিত সুরে বলল,’ আপনাকে আমি সত্যি খুন করবো। অসভ্য, মিথ্যুক, চরম বেয়াদপ সাথে আস্ত একটা ছ্যাঁচড়া।’ বিমুগ্ধ একটু শব্দ করে হাসতে চাইল। কিন্তু হাসল না। বিমুগ্ধের এই সব আচরণ নীহারিকাকে বিভ্রান্ত করে তোলে। এমন একটা ব্যবহার যেন কিছুই হয়নি। না কখন হওয়ার কথা ছিল। কিছুক্ষণ আগের কাহিনীও মিথ্যা। এতো ভালো অভিনয় করতে নীহারিকা জীবনে কাউকে দেখেনি। কোনো অভিনেতাকেও নয়। বিষাক্ত নজরে তাকিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে নীহারিকা বলল,’ খবরদার হাসবেন না। চোখের সামনে থেকে বের হয়ে যান। আউট।’ নীহারিকার চোখ ঝাপসা। বিমুগ্ধ বিগলিত মাখন গলায় বলল,’ আমি ঠিক করেছি তোমার চোখের সামনে সামনে ঘুরবো। দুই ধরনের আত্নীয় তোমার। সম্মান করো। তোমার বাপ তোমাকে সম্মান করতেও শিখায়নি। ভারী আফসোস। আমি বয়সে তোমার কত বড় জানো?’
‘ ইচ্ছে করছে থাপড়ে গাল বাঁকিয়ে দিতে অসভ্য। আমার বাপ নিয়ে আর একটা কথা বললে আপনার বাপের নাম ভুলিয়ে দিব। বেয়াদপ একটা। চরম বেয়াদপ।’ নীহারিকার এমন লাগাম ছাড়া কথায় বিমুগ্ধ হকচকিয়ে গেল। যা এই জীবনে তার সাথে খুব কম ঘটে। দ্রুত বেঞ্চ ছেড়ে নিচে দুই হাঁটু ভেঙ্গে সে বসে এগিয়ে আসল। নীহারিকার অবস্থা খুব সিরিয়াস। সে নিঃশ্বাস নিতেই পারছে না। বিমুগ্ধ জীবনে প্রথন দুশ্চিন্তায় ব্যাকুল হয়ে পড়ল। নিজের মাঝে নিজেকেই খুঁজে পেল না সে। ঠান্ডা হওয়ার কোন শক্তি খুঁজে পাচ্ছে না। চমকে গেল। নীহারিকা এ্যাজমায় আক্রান্ত? না কি জ্বর? বিমুগ্ধ দ্রুত হাত রাখতে চাইল নীহারিকার কপালে। তার চোখ তখন বুঝে আসছিল। তবুও মুখ সরিয়ে কন্ঠ কঠিন করার চেষ্টায় বলল,’ দূরে। আমি সত্যি জুতো খুলে মারবো আপনাকে।’
‘ ঠিক আছে। এখন একদম চুপ। তা না হলে থাপড়ে তোমার গাল লাল করে দিব আমি। তোমার এ্যাজমার সমস্যা আছে? কবে থেকে? তোমার ইনহেলার কোথায়? ইউজ কর?’
এত গুরুতর সময়েও নীহারিকা জিদ দেখিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,’ একদম তুমি করে বলবেন না। আপনি বলুন।’
‘ বলব না। আর কখনো বলব না।’
‘ বলতেই হবে।’
‘ তুমি কি পাগল হয়ে গেছ?’ রেগে গেল বিমুগ্ধ। তার চোখ মুখ যথেষ্ট লাল হয়ে উঠল আগের মতো। নীহারিকা ঢুলছে। চোখ বন্ধ করে সে বলল,’ আপনি আমার বাবাকে ধাক্কা মেরেছেন। কত বড় অসভ্য হলে এটা করে জানেন?’
‘ হ্যাঁ জানি। স্যরি। আর কখনো তোমার বাবার গায়ে হাত দিব না। এখন বল তোমার ইনহেলার কোথায়?’ উদগ্রীব বিমুগ্ধের কন্ঠস্বর। তাকে আরও উদগ্রীব করে নীহারিকা বলল,’ নেই।’
‘ কি?’
‘ আমার ইনহেলার নেই। জীবনেও ইউজ করিনি।’
‘ মানে আগে ছিল না। আজকে প্রথম? ও মাই গড।’ নীহারিকা তখন বেঞ্চিতে শুয়ে পড়ছিল। সে বসে থাকতে পারছে না। বিমুগ্ধ তার মাথা ধরে বসল। গায়ে জ্বর নেই তেমন। শরীর ঠান্ডা মনে হচ্ছে। সে এবার চারদিকে তাকিয়ে দূরে জাওয়াদকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে বিরক্ত হয়ে গেল। এই মানুষটাকে সে পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি অপছন্দ করে। তবুও একে এখন ডাকতে হবে। ভাবতে শরীর রাগে রি রি করছে। বিমুগ্ধের কপাল ভালো। ডাকতে হলো না। জাওয়াদ নিজেই ছুটে আসল। ফোনে কথা বলছিল সে। লাল চোখে সে এসে দাড়ালো। উত্তেজিত গলায় বলল,’ কি হয়েছে?’
বিমুগ্ধ দ্রুত বলল,’ এ্যাজমা মনে হচ্ছে। আপনি অক্সিজেনের ব্যবস্থা করুন। দ্রুত। সাথে বিভিন্ন টেস্টেরও। দ্রুত।’
জাওয়াদ বিমুগ্ধকে কড়া ভাবে বলল,’ ওকে আমি নিয়ে যাচ্ছি। তুমি সরে বসো।’
বিমুগ্ধ রক্তিম চক্ষু নিয়ে তাকাল। জাওয়াদেরও একুই অবস্থা। দু’ জনের চোখে যেন আগুন জ্বলছে। কিসের এই আগুন জানা নেই কারো। নীহারিকারকে বিমুগ্ধ জাওয়াদের সামনে পাঁজাকোলা করে তুলে নিল। কিছুই বলল না। জাওয়াদের বিহ্বল নয়ন রাগে ক্ষোভে অপমানে ফেঁটে পড়লো। শরীরে যেন কেউ আগুন জ্বালিয়ে দিল। কঠিন আগুন। লাল টকটকা সেই অগ্নির রং। জাওয়াদের মনে হচ্ছে বিমুগ্ধ তার কলিজায় না ছুঁয়ে একটি বিশাল থাবা বসিয়ে দিল। যার ক্ষত ভয়াবহ ভাবে তাকে রক্তাক্ত করছে। অদৃশ্য রক্তক্ষরণ। যদি তার এই রক্তক্ষরণ সত্য হয় তাহলে সে কি করবে সে জানে না। এই মুহূর্তে সে পাগল হয়ে যাচ্ছে। শুধু ভাবছে বিমুগ্ধ কোথা থেকে এসেছে। কল করে সে দ্রুত সব কিছুর ব্যবস্থা করল। কেবিনে ছুঁটে গেল। বিমুগ্ধ নিজে নীহারিকার পাশে দাড়িয়ে। তার হাত দুই হাতের মাঝে নিয়ে মালিশ করছে। জাওয়াদ উৎকণ্ঠিত হয়ে বলল,’ তোমার কেন মনে হচ্ছে এ্যাজমা হবে?’ বিমুগ্ধ প্রচন্ড রেগে আছে। জাওয়াদ থেকে সে সব সময় দূরে থাকে। অসহ্য লাগে দেখলে। ইচ্ছে করে খুন করে দিতে। বিমুগ্ধ চোখ বন্ধ করে চুপ করে রইল। চোখ খুলে শুধু নীহারিকার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। জাওয়াদের দিকে অনেকক্ষণ পরে তাকাল। তার আগুন চোখ। সে মন কে বুঝিয়েই উঠতে পারছে না বিমুগ্ধ নীহারিকার কাজেন। শুধু কাজেন। তার হঠাৎ করে মনে পড়ে যাচ্ছে তাকে না চিনতে পেরে বিমুগ্ধকে চিনতে পেরেছিল নীহারিকা। অথচ বিয়েটা তার সাথে হওয়ার কথা ছিলো। বিমুগ্ধর দৃষ্টি দেখেই সে বুঝতে পারছে নীহারিকা সাধারণ নয় তার কাছে। জাওয়াদ আরও রেগে গেল। নীহারিকার পালস রেট চেক করতে হাত বাড়াতেই বিমুগ্ধ নিজের শক্ত কঠিন হাতে তা ধরে নিল। দু’ জনের মাঝে যেন একটি অঘোষিত যুদ্ধ শুরু হয়েছে। যেখানে কেউ হারতে চায় না। কি ভীষণ খারাপ সময়েও নীহাপিকা আদো আদো চোখে দু’ জনকে দেখল। এরা এত তেজি রাগ কেন নিজেদের দেখাচ্ছে সে বুঝল না। শ্বাস তখন আর নেওয়া যাচ্ছে না। নীহারিকা চিৎকার করে বলল,’ মা কে ডাকুন। আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। নিঃশ্বাস নিতে পারছি না।’ বিমুগ্ধের কান মুহূর্তের জন্য থমকে গেল। আতঙ্কে, শঙ্কায় শরীর কেঁপে উঠল। জীবনে দু’ বার সে ভয়কে এতো কাছ থেকে উপলব্ধি করেছে। তার নিজের শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে যেন। জাওয়াদের সব ভুলে দ্রুত অক্সিজেন লাগিয়ে দিল। বিভিন্ন মেডিসিন লিখে দিল। পাগলের মত কার্যকলাপ দেখে নার্স হতবাক। বিমুগ্ধের মনে হচ্ছে সে প্রচন্ড দূর্বল। এত দূর্বল সে কবে হয়ে গেল? প্রচন্ড সাহসী, রাগী, চঞ্চল, উগ্র, রহস্যজনক, হাস্যরসিক, ড্যাম কেয়ার ভাব সব কোথায় হারিয়ে গেল? এটাই কি তার জীবনের সর্বকালের সেরা সর্বনাশ? কি নাম এর?
______________
চলবে………….
ভুলত্রুটি আল্লাহর দেওয়া মহান গুন ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টি দিয়ে দেখবেন। নিশ্চুয়ই ক্ষমা একটি সুন্দর গুন।
@হাফসা_আলম