প্রিয় সুখ-২৭
________________
মায়ের সুবাসিত রান্নার ঘ্রাণে শরীর মন জুড়িয়ে যাচ্ছে। নীহারিকা কাউকে খুঁজে পাচ্ছে না। যে তার সাথে রুমে গিয়ে বিমুগ্ধকে ধাক্কা দিয়ে বের করবে। বাবা ইলিয়াস ভাইয়াদের সাথে কথা বলছে। মা ফুফু মিলে রান্নার কাজে ব্যস্ত। আনজুম আপুর সাথে তিন ফুফাত বোনের গল্পের শেষ নেই। প্রিয়ম বজ্জাত কই? নীহারিকা অনেক খুঁজেও প্রিয়মকে পাওয়া গেল না। সে বাজারে গিয়েছে। কিছু টুকিটাকি জিনিস নিয়ে আসতে। বিরক্তিতে তেঁতো মুখ নীহারিকার। আনজুম তাকে ডাক দিল। নীহারিকা তাদের সাথে যুক্ত হবে ভাবছে। তাই হেসে এগিয়ে গেল। আনজুম নীহারিকার হাত ধরে বলল,’ কেমন আছ? তোমাকে তো খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছে না?’
নীহারিকা ভদ্রতা সূচক হেসে বলল,’ ভালো আছি আপু। আপনি কেমন আছেন?’ বাকি প্রশ্নের উত্তর দিল না। এমনেই মন মেজাজ খারাপ। যতকম কথা বলা যায়। মিতু আপু আসার আগ পর্যন্ত চুপ। অথচ তারা চুপ থাকতে পারল না। আনজুম আপু যে এত মিশুকে আর মজার তা নীহারিকা আজ আবিষ্কার করল। তিনি তার আমেরিকার জীবনী বলছেন। মৌরি, মমতা, মিতা আপুরা মনোযোগ ঢেলে শুনছে। মজার একটি ঘটনা আছে। আনজুম আপু তার এক সিনিয়ারের মাথায় ভুল করে পানি ঢেলে দিয়েছিল। তিনি অবশ্য স্যরি বলেছিলেন। কিন্তু কাজ হলো না। সেও কম না উঠে এসে পানি ঢেলে দিল। আপুও কম না সেও আবার ঢাললেন। এভাবে পুরো এক মাস তারা পানি মারামরি করেছে। নীহারিকা শব্দ করে হাসছে। সাধারণত সে এভাবে হাসে না।
‘ বাংলাদেশের মত ঘাড় ত্যাড়া মানুষ বিদেশেও আছে?’ নীহারিকা হাসতে হাসতে বলল। আনজুম সে হাসির দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল। একটা মেয়ে এত সুন্দর করে হাসতে জানে অথচ সারাদিন রেগে রেগে ঘুরে বেড়ায়! তিনি লুকিয়ে নীহারিকার কয়েকটি ছবি তুললেন। তারপর হাসির সাথে তাল মিলিয়ে বললেন,’ বিদেশি হলে স্যরির মর্ম বুঝে ক্ষমা করে দিত। কিন্তু সে তো বাংলাদেশি ছিল।’ আবার হাসলেন। বিস্মৃত হয়ে নীহারিকা বলল,’ সেও বাংলাদেশি?’
‘ জি হ্যা। বিদেশিদের ওতো সময় নেই পানি মারামরি খেলার। এসব সময় বাঙ্গালীদের কাছে ভরপুর।’
‘ বিদেশিরা কত ভালো জানা আছে। অসভ্য একটা।’ একদম ধিম গলা নীহারিকার। কেউ শুনল না। গল্প নিয়ে আবার মেতে উঠল সবাই। এবারের গল্পটি মমতা আপুর বিয়ের। আপুর বিয়ে হয়েছে প্রায় তিন বছর। অনুষ্ঠানে নীহারিকার পিছনে ঘুরে ঘুরে মমতা আপুর দেবরের কি হাল হয়েছিল সে গল্প শুনে আনজুম প্রায় গড়াগড়ি খাচ্ছে। রেগে গিয়ে নীহারিকা বেচারার মাথায় এক গ্লাস জুস ঠেলে ছিল। এখনও না কি দুঃখ করে প্রায় বলে ভাবি তোমার সেই বোনের খবর কি? শরবত ওয়ালী। কি রাগ বাবা গো।’ আনজুম হাসতে লাগল আরও জোরে। শরবত ওয়ালী! দারুন তো। তার ভাই নাম দিয়েছে রাগেশ্বরী। এই নীহারিকার তো তাহলে নামের অভাব নেই। তিনি আবার শব্দ করে হাসছেন। বিকেলের নাস্তা খেতে খেতে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রায় গল্প করলেন। সূর্য ডোবার একটু আগে চোখ মুখ ফুলিয়ে ঘরে প্রবেশ করলেন মিতু আপু। খালি পায়ের জুতো তার হাতে। নীহারিকা পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে বলল,’ চল রুমে। ফ্রেশ হয়ে কান্নার কারণ বলবি চল।’ মিতু আপু ভ্যা ভ্যা করে আবার কাঁদলেন। ওহ অসহ্য। নীহারিকা ধমকে ধামকে তাকে রুমে নিয়ে আসল। সাথে সাথে এক চিৎকারে তিনি বাহিরে চলে এসে বললেন,’ তোর রুমে একটা ছেলে আছে। বয়ফ্রেন্ড বাসায় নিয়ে আসলি কেন? এই জিনিস লুকিয়ে রাখার জানিস না? কি সাঙ্ঘাতিক মেয়ে তুই নীহু? তওবা তওবা।’ তিনি হা হুতাশ করে উঠলেন। নীহারিকা বিরক্তি নিয়ে ভিতরে উঁকি দিল। তার ঠোঁট আপন শক্তিতে আলাদা হয়ে গেল। এটা কি হলো? কে ঘুমিয়ে আছে? মাথা কাত করে সে দেখল এটা বিমুগ্ধ। যে গলার নিচ থেকে গাল পর্যন্ত দুই হাত জড়ো করে ঘুমচ্ছে। বাচ্চা বাচ্চা চেহারার নিষ্পাপ শিশু। তার মাথার উপরে একটি বালিশ। মাথার নিচ খালি। কাঁথা জড়িয়ে সে মমতায় জড়িয়ে ঘুমাচ্ছে। নীহারিকা মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় শক্ট হয়ে দাড়িয়ে আছে। খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছে। পৃথিবীর প্রতিটি সৃষ্টি এত সুন্দর না কি চোখের দৃষ্টি সুন্দর? ধরতে পারছে না নীহারিকা। তার চোখ মুখের রং একদম পাল্টে গেল। জীবনে প্রথম তার মনে হচ্ছে ছেলেটার মাথার চুলগুলো ছুঁয়ে দিলে কেমন হয়? এই যে ছোট করে আর্মি কাটিং চুল গুলোতে কাউকে এত সুন্দর লাগে? পৃথিবীতে কে বেশি সুন্দর? মানুষ না কি মন? মিতু আপু একটা ধাক্কা দিয়ে নীহারিকাকে বাস্তবে মুখ থুবড়ে ফেলে দিলেন। নীহারিকা চোখ ঝাকিয়ে মুখ বাকিয়ে নিল। ইশ কি সব ভাবছে সে? এই মানুষটা থেকে দূরে থাকতে হবে। এতটুকু। না এতটুকু। আরও একটু। নীহারিকা একদম দূরে গিয়ে দাঁড়াল। মিতু আপু তার কান্ড দেখে টপ করে ধরে নিল এখানে তাযিন ভাই আছে। দ্রুত তিনি ঝুঁকে বালিশের নিচে তাকিয়ে দেখে বললেন,’ উনি তোর রুমে কি করছে?’ সন্দেহান দৃষ্টি মিতু আপুর। রাগ দেখিয়ে নাহারিকা বলল,’ দখল করে বসে আছে। আপু এই লোকটাকে বের কর তো। আমি চেষ্টা করেও পারিনি। এখন আবার আমার বিছানায় ঘুমিয়েছে। কিছু কর।’ মিতু আপুর তাযিন ভাইকে দেখে মাথা গরম হয়ে গেল। রাগ তার আকাশের সমতুল্য। এই সুযোগে তিনি এই মানুষটাকে একটা শাস্তি দিতে চাইছেন। চরম শাস্তি। এক দৌড়ে মিতু আপু ওয়াসরুমে গেলেন। পানি ভর্তি মগ নিয়ে এসে বললেন,’ আমি ঢালি নীহু?’ নীহারিকার জানের প্রিয় বিছানা। এই বিছানার ডিজাইন সে নিজে করেছে। বাবাকে দিয়ে কত কষ্ট করে তৈরি করেছে। এক কথায় তার প্রচন্ড প্রিয় একটি জিনিস তার বিছানা। এ বাড়ির সব পুড়িয়ে দিলেও তার দুঃখ হবে না কিন্তু বিছানার কিছু হলে সে মূর্ছা যাবে। তাই মিতু আপু অনুমতি নিলেন। শুধু শুধু নীহারিকাকে রাগিয়ে দিতে চাইছেন না। ছাড়বে না তিনি তাযিন ভাইকে। কখনো না। নীহারিকা সাবধান করে বলল,’ ভুলেও না মিতু আপু। অন্যভাবে ব্যবস্থা কর।’ বিরক্ত হয়ে মিতু আপু রাশভারী গলায় বললেন,’তাহলে কি আদর করে উঠাব? তুই উঠা। যা। মায়ের মত আদর করে বল বাবা উঠো। মা তোমার জন্য খাবার নিয়ে এসেছি। আমার লক্ষী সোনা। কলিজা পাখি। উঠো মা ভাত খাইয়ে দি। যা বল।’ নীহারিকার এখন ইচ্ছে করছে এক লাথিতে এই মানুষকে অপর পাশে ফেলে দিতে কিন্তু সে এটা করতে পারছে না বলেই বেশি দুঃখ। তার অবস্থা খুব ঘোরাল। কন্ঠ নরম করে সে বলল,’ শুনো আপু ধিরে ঢালবে। আমার বিছানার ডিজাইনে যাতে না লাগে। পানি লাগলে রং নষ্ট হয়ে যেতে পারে।’ মিতু আপুর কি যে অসহ্য লাগছে কথা গুলো বলার বাহিরে। এতো যত্ন তো নিজেরও নেয় না এই মেয়ে। মিতু আপু অনুমতি পাওয়া মাত্র মগ ভর্তি পানি ঢেলে দিলেন। কিন্তু প্রচণ্ড মূক বিষয় হচ্ছে বিমুগ্ধ এক তিলকও চমকাল না। লাফিয়ে উঠল না। কোলাহলও করল না। খুব সাবধানে বিছানায় উঠে বসে সে চোখে মুখের পানি দু’ হাতে সরিয়ে নিয়ে তাকাল মিতু আপুর দিকে। অন্তর আত্না উবে গেল মিতু আপুর। লাল টকটকে চোখে তাযিন ভাইকে দেখে তিনি সত্যি ভয়ে পিছিয়ে গেলেন। সব রাগ অভিমান উড়ে গেল মুহূর্তে। নীহারিকাও খানিক ভড়কেছে। সেও অবাক চোখে তাকিয়ে। বিমুগ্ধ কি আগেই জানতো এমন কিছু হবে? বিমুগ্ধ দাঁড়িয়ে জামা ঝেরে বলল,’ মিতুয়া আপনি কাজটা মোটেও ভালো করেননি। স্বপ্নে আমি একটি দারুন জিনিস দেখছিলাম।’ বিমুগ্ধের কণ্ঠ অতিশয় ঠান্ডা। যার অর্ধেকও থাকার কথা না। মিতু আপু সুক্ষণ মেজাজে বললেন,’ আপনিও তো আমার সাথে ভালো কিছু করেন নি। শোধ বোধ।’
‘ এভাবে তো হবে না। আমি এর প্রতিশোধ নিয়ে ছাড়ব। আপনি জানেন স্বপ্নে আমি কাকে দেখছিলাম? বলুন কাকে দেখেছিলাম।’ থতমত খেয়ে মিতু আপু বললেন,’ আমি কিভাবে জানব ভাইয়া।’
‘ জানতে হবে। বলুন কাকে দেখেছি? কুইক।’ বিমুগ্ধ গেঞ্জি খুলতে প্রস্তুতি নিচ্ছে। চেঁচিয়ে উঠে পিছনে ঘুরে নীহারিকা বলল,’ হচ্ছেটা কি? আপনি এসব কি ধরণের অসভ্যতা করছেন? অসহ্য।’
‘ অসভ্যতা? তুমি কাপড় পাল্টাও না ভিজে গেলে? কি করো? শরীরে রেখে দেও? তুমি কি সূর্য? তেজি সূর্য কি নিজের পোশাক নিজে শুকায়?’ বিমুগ্ধ প্রচণ্ড রেগে আছে। তার চোখ মুখ দেখে বেশ বুঝা যাচ্ছে। নীহারিকা একটু চুপ করে থেকে বলল,’ আপনি আমার রুমে কেন ঘুরছেন? নিজের রুমে যাচ্ছেন না কেন? আপনি আসবেন বলে আমার দাদামশায় নিজে দাঁড়িয়ে রুম রেডি করেছে। ছাদে চলুন। আপনার রুম দেখিয়ে দিচ্ছি।’ নীহারিকা এটা বলে বিমুগ্ধের দিকে তাকাল। রেগে আগুন প্রায় বিমুগ্ধ মিতু আপুর হাতের মগ দেখতে মগ্ন। নিরবতা ভেঙ্গে সে আবার আওড়ানো শুরু করেছে,’ কি স্বপ্ন দেখেছি মিতুয়া বলুন?’
ভয় পেয়েও মিতু আপু দমে গেলেন না। আজকে তিনি রেগে আছেন। তাই কর্কশ কণ্ঠে বললেন,’ আমি জানি না।’
‘ আপনি আমার ঘুমটা যে নষ্ট করেছেন তার বিনিময় মূল্য কি হবে? আমি স্বপ্নে আমার ওয়াইফকে দেখছিলাম। যে রান্নার কাজে ব্যস্ত। আমাকে হেল্প করার জন্য ডেকেছে। আপনার জন্য যাওয়া হলো না। আপনার জন্য দেখা হলো না মিতুয়া। আমার ইচ্ছে করছে আপনাকে রুম থেকে ছুড়ে ফেলে দিতে।’ মিতু আপু ভীতু প্রকৃতির। ভয়ে তিনি কেঁপে উঠলেন। বিমুগ্ধ এবার গটগট পায়ে হাঁটতে শুরু করল। নীহারিকার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বলল,’ এই রুম আজ থেকে আমার। এই বিছানাও আমার। তুমি কোথায় থাকবে ব্যবস্থা করো।’
‘ বললেই হলো? এটা আমার রুম আপনি কিভাবে নিবেন? আজব।’ নীহারিকা হাসল। চোখে উপহাস। বিমুগ্ধ জবাবে কিছু বলল না। সোজা ডাইনিং রুমে নাফিস উদ্দীনের পাশে বসে পড়ল। নীহারিকা চোখ বড় বড়। নাফিস উদ্দীন সম্পূর্ণ চমকে উঠলেন। বিমুগ্ধ তার চোখের দিকে চোখ রেখেছে। হাঁটুর বয়সী একটা ছেলে অথচ সাহস আকাশ ছোঁয়া। বিমুগ্ধ কোন আড়ম্বরপূর্ণ কথারাম্ভ না করে বলল,’ এই বাড়িতে কি আমাকে কোন রুম দেওয়া হবে? থাকার জন্য। যেমন পার্মানেন্টলি? ‘ বিমুগ্ধ এখনও চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। নাফিস উদ্দীন বিপর্যস্ত বোধ করলেন। ছেলেটা এমন চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে কেন? চারপাশে চোখ নিয়ে তিনি মৃদু হেসে বললেন,’ অবশ্যই। এটা তোমারও বাড়ি।’
‘ আমার কি রুম পছন্দ করার অধিকার আছে?’ নাফিস উদ্দীন এবার একটু নড়েচড়ে বসলেন। তারপর শান্ত চোখে তাকিয়ে বললেন,’ আছে। তোমার যে রুম পছন্দ হবে নিয়ে নেও। কেউ কিছু বলবে না। এই বাড়ির অর্ধেক মালিক তোমার বাবা।’ বিমুগ্ধের চোখ সহজ হয়ে আসল। সে এবার হাসছে। মুচকি হাসি। নাফিস উদ্দীন বিমোহিত চোখে সেই হাসি দেখলেন। একদম ভাইয়ের মত হাসে। তার কলিজা ধক করে উঠল। বিমুগ্ধ চোখের সামনে ঘুরলেই মনে হচ্ছে ভাই ঘুরছে। তিনি উঠে দাড়ালেন। ছেলেটি সুবিধার নয়। বাবার ভাইকে ধাক্কা দিয়েছে। স্যরি পর্যন্ত বলেনি। ভাইটা ভালো শিক্ষা দিতে পেরেছে বলে মনে হচ্ছে না। তিনি এক বুক আশা নিয়ে নিজের ছেলে মেয়ের দিকে তাকালেন। এদের তিনি ভালো শিক্ষা দিতে চান। অনেক ভালো। বিমুগ্ধও তড়িৎ করে উঠে দাঁড়াল। তারপর হাত বাড়িয়ে বলল,’ হ্যান্ডশেক করুন। আপনার এই কথাগুলো আমার পছন্দ হয়েছে। যদিও আপনাকে আমার পছন্দ না।’ মুখে এক রাশ বিরক্তি নিয়ে বলল বিমুগ্ধ। নাফিস উদ্দীন হাসলেন। হাতও মিলালেন। মনে হচ্ছে ভাইয়ের সাথে মিলাচ্ছে। ছেলেটা ভারী অদ্ভুৎ। বিমুগ্ধ এবার ঘোষণার মত করে বলল,’ আমি দক্ষিণের তিন নাম্বার রুমে থাকতে চাই। রুমটি আমার পছন্দ হয়েছে। আজ থেকে সেটি শুধু আমার রুম হবে।’ সবার আগে নাফিস উদ্দীন বিচলিত হয়ে গেলেন। তার মেয়ে যে নিজের রুমকে কতটা ভালোবাসে তিনি জানেন। এই রুমটা কেন চাই বিমুগ্ধের? খুব রাগ হচ্ছে তার। কিন্তু কিছু করার নেই। মেয়ের দিকে তাকালেন নাফিস উদ্দীন। এমন কি বাড়ির সবাই নীহারিকার দিকে তাকিয়ে আছে। দাদামশায় উদগ্রীব হয়ে বললেন,’ দাদাভাই তুমি অন্য রুম নেও। তুমি বরং আমার রুম বা তোমার চাচ্চুদের রুম নেও। সেগুলো অনেক সুন্দর। নীহু দাদুভাইয়ের রুমটা ছোট আর ভালো জিনিসও নেই। তুমি অন্য রুম নেও।’ নীহারিকা মুখ শক্ত করে তাকিয়ে আছে বিমুগ্ধের দিকে। নিজের হাত কচলাচ্ছে সে। বাড়ির সবাই বিমুগ্ধের দিকে মুখিয়ে আছে। সে যদি নিজের মতামত পরিবর্তন করে এই আশায়। কিন্তু বিমুগ্ধ ত্যাছরা উত্তর প্রদান করল,’ আমার ওই রুমটাই চাই। অন্য
কোন রুম নয়। তাহলেই আমি থাকব। তা না হলে দুঃখিত।’ নীহারিকার দিকে তাকিয়ে ফিচেল হাসল। নিচের ঠোঁটের ডান পাশ তার দাঁতের নিচে। রাগেশ্বরী কি রেগে যাচ্ছে? মুখ লাল হচ্ছে মনে হয়।
‘ আচ্ছা ঠিক আছে। ওই রুম তোমাকে দেওয়া হবে। নীহারিকার রুমের জিনিসগুলো আমাদের রুমে নিয়ে আসার ব্যবস্থা কর প্রিয়ম। আমি আসছি।’ তিনি জায়গা ত্যাগ করার আগে বিমুগ্ধ দ্বিতীয় বোমা ফাঁটিয়ে প্রবল উৎসাহ নিয়ে বলল,’ কোন প্রয়োজন নেই। ওই রুমের সব আমার পছন্দ হয়েছে। কিছু সরাতে হবে না। যেমন আছে ঠিক তেমনই যেন থাকে।’ বিমুগ্ধ উঠে চলে গেল। নাফিস উদ্দীন বিস্মৃত চোখে তাকিয়ে আছে। মনে প্রশ্ন জাগছে তার মেয়ের সাথে বিমুগ্ধের সমস্যা কি? অতিসামান্য জিনিসগুলো বিমুগ্ধের কিভাবে পছন্দ হতে পারে? কিভাবে? বাড়ির বাহিরের অংশ দেখছে বিমুগ্ধ। সামনের বিল্ডিংটা আব্বি শুধু শুধু তুলছে। স্বর্গ তো এই বাড়ির ভিতরে। ওই যে লতানো কোনার রুমটিতে। বিমুগ্ধ বারান্দার তুতু বেরিককে হাত নাচিয়ে হায় করল।
নীহারিকা আগুন ঝলসানো চোখে তাকিয়ে বলল,’ আমি ছাদের ঘরে যাব। অন্যকোথাও না।’ নাফিস উদ্দীন পড়েছে মহা বিপদে। মেয়ে তার কলিজা। কিন্তু বিমুগ্ধ তো অতিথি। এই ঘরে তার অধিকার আছে। নীহারিকার আগে সে পৃথিবীতে এসেছে। সে হিসেবে ঘরের সবচেয়ে পছন্দের রুমটি সে নিজের জন্য নিতেই পারে। এই বাড়িতে বড় হলে নীহারিকা সব পরে পেতো। আগে তো তাদের অধিকার। নীহারিকার কলিজায় হাত দিয়েছে তাযিন ভাই। কপালে তো শনি আছে। এবার নীহু তো ছাড়বে না। তাযিন ভাইয়ের অবস্থা কি করে আল্লাহ মালুম। প্রিয়মের এই দুঃখের সময়ে হাসি পাচ্ছে। খুব হাসি। তার বোনের রাগ সবার জানা।
________________
ছাদে দু’টি রুম আছে। এই বাড়িতে মোট বারোটি রুম। কলকাতার পুরোনো বাড়িগুলোর ডিজাইনে গড়া এই বাড়িটি দাদামশায় নিজে পছন্দ করে তৈরি করেছেন। তিনি ছিলেন ব্যারিস্টার মানুষ। কলকাতায় একটা কাজে গিয়ে নিজের বন্ধুর বাড়ি ঘুরে এসেছিলেন। তারা জয়েন্ট পরিবার থাকত। বিশাল বড় ঘর তাদের। মাঝে গোল ড্রইং ডাইনিং। চারপাশ জুড়ে সব রুম। সখ করে তৈরি করেছেন এই বাড়ি। বিশাল বড় এই বাড়ির সব ফার্নিচারও বেশিরভাগ তার কেনা। সব গুলো রুমে একটি বিছানা, একটি আলমারি আর একটি টেবিল থাকেই। কিন্তু নীহারিকার ঘরের সব জিনিস তার নিজের বাবার কিনে দেওয়া। নীহারিকার জীবনে প্রিয় কিছু জিনিসের মাঝে তার রুম তার বিছানা বেশি প্রিয়। সেই রুম ছাড়া ঘুমাতে হবে ভেবেই কান্না পাচ্ছে। নীহারিকার অনেক কান্না করতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু সে কেন কান্না করতে পারছে না? কান্নাটা ঠিক আসছে না। কিন্তু বিমুগ্ধ ঠিক তাকে কাঁদিয়ে ছেড়েছে। নীহারিকার আজ মনে হচ্ছে বিমুগ্ধ তাকে কষ্ট দিতে, কাঁদাতে এসেছে। সে নীহারিকাকে কষ্ট দিয়ে আরাম পায়। আনন্দ পায়। সে মুলত নীহারিকাকে যন্ত্রণায় মারতে এসেছে। ইচ্ছে করে পরিকল্পনা করে এসেছে তার জীবনে। প্রতিশোধ নিতে নয় তো? কিসের প্রতিশোধ ভাবতে নীহারিকার মনে পড়ে গেল তার বাবাকে তো বিমুগ্ধ অপছন্দ করে। তাহলে কি এই কারণেই তার পিছু নেওয়া? তিক্ত বিষন্নতায় মন খারাপ করে বসে আছে নীহারিকা। আজকে একটু বৃষ্টি হওয়া উচিৎ। ঝপঝপ করে বৃষ্টি নামুক। নীহারিকা ভিজবে। অনেক ভিজবে। যতক্ষণ জ্বরে গা পুড়ে না যায় ঠিক ততক্ষণ ভিজে সে শ্বাস কষ্টে দম বন্ধ করে নিবে। ছাদের ফ্লোরের উপরে বসে আছে সে। ঠান্ডা হাওয়া গায়ে এসে লাগছে। তার ছাড়া লম্বা চুল ছাদের ফ্লোরে বিক্ষিপ্ত অবস্থায় স্থিত হয়ে আছে। বাতাসের ছটায় সেই চুল তার চোখে মুখে এসে লেপ্টে যাচ্ছে। কানে কানে বাতাসের ফিসফিস শব্দ। শরীরে কাঁপন ধরিয়ে দেওয়ার মত। চোখ বন্ধ করল নীহারিকা। সে স্পষ্ট যাকে দেখল তারপর আর চোখ বন্ধ করার সাহস পাচ্ছে না। মানুষটা তার জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছে। নীহারিকা ফ্লোরে হাত পা ছড়িয়ে চেঁচাচ্ছে। মিতু আপু নিচে খাবার খেতে গিয়েছিল। এসে এই অবস্থা দেখে তিনি হাসছেন। আফিয়া বিলকিস মেয়ের জন্য খাবার নিয়ে এসেছে। তিনি মেয়ের পাশে বসলেন। হালকা ধমকে বললেন,’ চুল খুলে এই রাতে তুই ছাদে বসে আছিস কেন?’ তিনি নীহারিকার চুল বেঁধে দিলেন হাত খোঁপা করে। ওড়না মাথায় ভালো করে জড়িয়ে প্যাঁচিয়ে দিলেন। আজকে তার মেয়ের অবস্থা কেমন তিনি বেশ ধরতে পারছেন। ছোট থেকে একটু আপন চিন্তার মেয়ে তার। নিজের জিনিস প্রিয় মানুষগুলোকে ছাড়া কাউকে দিতে চায় না। তাযিনকে যে মেয়ে একদম সহ্য করতে পারে না তা তিনি হসপিটালের সেই দৃশ্য দেখে বুঝতে পেরেছেন। যে রেগে গিয়েছিল! তিনি নিজে ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে মা বললেন,’ সামান্য একটা রুমের জন্য তুই এমন করছিস? তোর মন এত ছোট কেন মা? তুই তো মুরগির কলিজা খাছ না। গরুরটা খেয়েও তোর কলিজা ছোটই রয়ে গেছে। এখন কি তিমিরটা খাবি? তোর বাবাকে বলতে হবে বাজারে তিমির কলিজা পাওয়া যায় কি না। তোর জন্য নিয়ে আসা উচিৎ।’ খুব চিন্তিত সুরে সিরিয়াস ভাব নিয়ে কথা শেষ করলেন আফিয়া। মেয়ের দিকে তাকিয়ে তিনি আরও সিরিয়াস লুক দিলেন। যেন সত্যি তিনি তিমির কলিজার সন্ধানে নেমে পড়েছেন। নীহারিকা শান্ত চোখে তাকিয়ে শীত শীত কণ্ঠে বলল,’মা আমার রুমে ওই বজ্জাত ছেলে থাকবে। আমার বিছানায় ঘুমাবে। আমার আলমারি ধরে টানাটানি করবে। উনি পাগলের বই আমার টেবিলে পড়বে। আমার তো দম বন্ধ হয়ে আসছে। মা! কিছু করো? প্লিজ।’ নীহারিকা আকুতি মিনতি করতে শুরু করল। আফিয়া বেশ চিন্তিত সুরে বললেন,’ ওরা তো বেশি দিন থাকবে না। চলে যাবে দেখিস। কয়েকটা দিনেরই তো ব্যাপার। এখন যদি পছন্দের রুম না পায় ছেলেটা চলে যাবে। অনেক রাগী দেখলি না তোর বাবার সাথে কিভাবে কথা বলল। পরে সত্যি চলে গেলে দাদামশায় কষ্ট পাবে। ওদেরও তো এ বাড়িতে অধিকার আছে।’ নীহারিকার তরতর করে রাগ উঠে গেল মাথায়। চেঁচিয়ে সে বাচ্চাদের মত হাত পা ছুড়তে শুরু করল। মেয়ের অবস্থা দেখে আফিয়া হেসে ফেললেন চুপি চুপি। এত বড় মেয়ে অথচ বাচ্চাদের মত ব্যবহার করছে। তার মেয়েটা পৃথিবীর কাছে বড়, রাগী, চুপচাপ ধরনের হলেও বাসায় সে বাঘিনী। এই যে এখন ছাদ মাথায় করে রেখেছে। নীহারিকার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। মনে হচ্ছে কেউ তার রুম নয় তার কলিজা ছিড়ে নিয়ে গেছে। প্রিয়ম ছাদে উঠে এসেছে। সেও ছাদে থাকবে। দুই বোন একা ছাদে থাকবে এটা তো হয় না। তার রুম ইলিয়াস ভাইয়াদের দেওয়া হয়েছে। অথচ ঘরে এখনও চারটার মত রুম খালি। বোনের এমন আহাজারি দেখে প্রিয়ম চুল টেনে ধরে বলল,’ নাটক বন্ধ কর নটাংকি বাজ। তোর রুম নিচ্ছে। তোরে না।’
‘ প্রিয়ম মাথা গরম আছে। ধাক্কা মেরে ফেলেদিব কিন্তু।’ নীহারিকার তার সুর। প্রিয়ম হাসতে হাসতে ফ্লোরে বসে পড়ল। মিতু আপুও বসল। আফিয়া বিলকিস উঠে পড়লেন। এই মেয়ে আজ রাতে আর ঘুমাবে না। মেয়েটার কলিজা আসলেই ছোট। নীহারিকা চিৎকার করে গলা ফাঁটয়ে বলল,’ মা কিছু করো। ওই অসভ্য যেন আমার রুমে না থাকে।’ আফিয়া চোখ গরম করে চুপ করতে বললেন। নীহারিকা আরও কিছু গালি দিল। বিমুগ্ধ দরজার গায়ে হেলান দিয়ে বুকে হাত ভাঁজ করে এসব দৃশ্য দেখছে। এটা নীহারিকা? রাগেশ্বরী? বিমুগ্ধ হাসল। রাগেশ্বরীর মাঝে যে একটি বাচ্চা শিশু লুকিয়ে আছে তার জানা ছিল না। এই ব্যাপারটা তাকে পুলকিত করছে। সামান্য রুমের জন্য এভাবে রিয়েক্ট করতে পারে কেউ? বিমুগ্ধ নীহারিকার পিছনে গিয়ে দাঁড়াল। আফিয়া বিলকিস বেশ লজ্জিত হয়ে বললেন,’ চুপ করবি তুই, বেয়াদপ।’
‘ আমি বেয়াদপ না। সবচেয়ে বড় বেয়াদপ হচ্ছে ওই অসভ্য।’ নীহারিকা আবার পা ঝারা দিল। বিমুগ্ধের দিকে তাকিয়ে আফিয়া বললেন,’ স্যরি আব্বু। অবুঝ তো তাই এমন করছে।’
‘ আমি মোটেও অবুঝ নই। ম’ থেমে গেল নীহারিকা। পিছনে তাকিয়ে বিমুগ্ধকে দেখে চেতে গেল সে। রেগে উঠে দাড়িয়ে বলল,’ নামুন। ছাদ থেকে দ্রুত নামুন। তা না হলে খারাপ হয়ে যাবে।’ নীহারিকা এবার দম ছেড়ে চুপ হয়ে গেল। একটু বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে। আফিয়া বিলকিস বললেন,’ তোমার কিছু লাগবে?’ বিমুগ্ধ নীহারিকার দিকে বাঁকা চোখে তাকিয়ে বলল,’ চা প্রয়োজন খালামনি। আমার কিছু কাজ আছে। রাতজেগে করব।’
‘ আচ্ছা আমি তোমার রুমে পাঠিয়ে দিচ্ছি।’
‘ রুমে নয় এখানে পাঠিয়ে দিবেন। আপনাদের ছাদটা তো সুন্দর। একটু ঘুরে দেখি।’
‘ শুধু দেখবেন কেন? নিয়ে যান। ছাদও দখল করুন।’ নীহারিকা দাঁত কটমট করে তাকাল। বিমুগ্ধ গম্ভীর হয়ে তার দিকে তাকিয়ে। আফিয়া বিলকিস বললেন,’ প্রিয়ম চল চা নিয়ে আসিস।’ প্রিয়ম যেতে চাইল না। কিন্তু কিছু বলতেও পারছে না। আপাতত যেতে হবে। প্রিয়ম আর মা ছাদ থেকে নামতেই মিতু আপু রাগে গজগজ করে বললেন,’ আপনি শাহিন ভাইয়ের সাথে যুক্ত তাই না? ইচ্ছে করে আমাকে তার অফিসে পাঠিয়েছেন। কেন?’ বিমুগ্ধ গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,’ আমি তো আপনাকে শুধু তার অফিসে পাঠিয়েছি বলে মনে হচ্ছে না। আরও দু’ টোতে পাঠিয়েছি। এখন আপনার লাক কোথায় ঠেকবে সেটা আমি কিভাবে জানে?’ বিমুগ্ধ ছাদের গ্রিলের উপরে উঠে বসেছে। নীহারিকার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে সে চোখে হাসছে।
‘ আপনি আসলে চাইছেনটা কি বলুন তো?’ নীহারিকা ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলো। বিমুগ্ধ হাই তুলতে তুলতে বলল,’অনেক কিছু।’
‘ অনেক কিছুটা কি কি বলুন। দেখি সেসব দিয়ে আপনাকে বের করতে পারি কি না।’ নীহারিকা আবার বসল ছাদের মেঝেতে। মিতু আপুর গোয়েন্দা নজর। বিমুগ্ধ হাত দু’ টো উঁচু নিচু করে বলল,’ সময় আসলে বলে দিব। তোমার জন্য দারুন একটি সারপ্রাইজ আছে রাগেশ্বরী।’
‘ আমার জন্য?’ অবাক হয়ে একটি আঙ্গুল নিজের দিকে দেখাল নীহারিকা। বিমুগ্ধ চোখ নাচাল। তারপর নেমে নীহারিকার পাশে বসে পড়ল। চাদের আলো তখন নীহারিকার চোখে মুখে খেলছে। তার অবাক চোখের দিকে তাকিয়ে বিমুগ্ধ হাসছে। তারপর নিজের হাত থেকে সবচেয়ে সুন্দর একটি সিলভার রঙ্গের ব্রেসলেট খুলে নিল। নীহারিকা এবার কৌতুহলি হয়ে তাকিয়ে আছে। মিতু আপুর আগ্রহ আকাশ সম। তিনি এগিয়ে এসে আরও কাছে বসলেন। তাযিন ভাই এমন একটি কাজ করতে পারে তিনি কল্পনাও করেননি। আসলে তাযিন ভাইকে তিনি খুবই গম্ভীর, রাগী, বদমেজাজি, চুপচাপ ধরনের মানুষ ভেবে এসেছেন। তিনি যে কথায় কথায় এমন হাসতে পারে এটা তিনি কখনো চিন্তা করেননি। আসলেই বিমুগ্ধের হাসিটি নজর কাড়া। মিতু আপুর মনে হচ্ছে উনি আকর্ষিত। সাথে সাথে মাথা ঝাকিয়ে নিজেকে মনে মনে একটা গালি দিল। তারপর আবার মনোযোগ দিল। নীহারিকার হাত দুটি ফ্লোরে ভার দিয়ে রাখা। বিমুগ্ধ বাম হাত টেনে নিজের হাতে নিল। চমকে গেল নীহারিকা। হাতের দিকে একবার বিমুগ্ধের দিকে একবার তাকাতে তাকাতে সে জমে গেল। শীতল হয়ে এসেছে রক্ত। বিমুগ্ধের গরম হাতে তার হাত। স্পর্শ, অনুভূতি, চাঁদ, আলো মিশে একটি অন্যরকম জগৎ তৈরি করেছে। বিমুগ্ধ হাতের মাঝে নিজের ব্রেসলেট গলিয়ে দিল। সুন্দর করে সেট করে একবার মনোযোগ দিয়ে দেখল। চাঁদের আলোতে চিকচিক করছে সিলভার রং। সাদা হাতের উপরে দারুন নজরকাড়া সৌন্দর্য। বিমুগ্ধ মুগ্ধ হয়ে গেল। নীহারিকা তখনও অজ্ঞানের মত তাকিয়ে। মিতু আপু মুখে হাত দিয়ে চোখ বড় বড় করে চেয়ে আছে। যে কোন সময় তার চোখ বের হয়ে আসবে। বিমুগ্ধ হাত আবার আগের জায়গায় গুঁছিয়ে রেখে বলল,’ একটি জিনিসের বদলে একটি জিনিস। এটা আমার সবচেয়ে দামি ব্রেসলেট। তোমার বেডের মত প্রিয় এটি আমার কাছে। আজ থেকে তোমার। আর হ্যাঁ জাওয়াদ থেকে দূরে থাকবে। সে কাল আসবে।’ মিতু আপুর মুখ ঝুলে গেল। হা করে তিনি কথাই বলতে পারছেন না। বিমুগ্ধ নীহারিকাকে পছন্দ করে! তিনি একটু চেঁচিয়ে উঠে বললেন,’ তাযিন ভাই আপনার কি নীহারিকাকে পছন্দ? প্রেম করছেন না কি আপনারা?’ বিমুগ্ধ হাসি থামিয়ে তাকিয়ে রইল মিতু আপুর দিকে। তারপর বিরক্তি কণ্ঠে মিশিয়ে বলল,’ পছন্দ করার মত আছে কি এর মাঝে? এর চেয়ে সুন্দর সুন্দর মেয়ে আমি জীবনে দেখেছি। পছন্দ তো হয় সবচেয়ে সুন্দর জিনিসকে। যেমন আমরা শপিংমল থেকে সবচেয়ে সুন্দর পোশাকটি ক্রয় করি। আর কিসের প্রেম? নিজেরটা ঠিক করে করুন। জাফরান রঙ্গের শাড়ি পেয়েছেন?’ মিতু আপু অবাক হয়ে বলল,’ আপনি পছন্দ করেন না?’
‘ না করি না।’ বিমুগ্ধ নীহারিকার দিকে তাকাল। প্রতিক্রিয়া বুঝার চেষ্টা। নীহারিকা স্বাভাবিক। সে দ্রুত হাতের ব্রেসলেট খুলতে ব্যস্ত। বিমুগ্ধ শান্ত স্বরে বলল,’ এটা খুলে ফেললে আমি কিন্তু তোমার অবস্থা খারাপ করে দিব। বিমুগ্ধকে তুমি নিশ্চয় চিনে নিয়েছ।’ উঠে দাড়িয়ে গেল সে। মিতু আপু তখন হা করে আছে। হচ্ছে কি? বিমুগ্ধ ইশারায় মুখ বন্ধ করতে দেখিয়ে বলল,’ অফিসে যাওয়া বন্ধ করে দিলে আপনি সত্যি আর কখনো জব করতে পারবেন না। তাই ভেবে চিন্তে কাজ করুন। শাড়ির ব্যবস্থা করুন দ্রুত।’
বিমুগ্ধ হেঁটে যেতে গিয়েও আবার ফিরে এসে নীহারিকার পাশ ঘেষে বসে তার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,’ হাত পা ছড়িয়ে চিৎকার করলে তোমাকে বাচ্চা মনে হয়। সেটা আমার পছন্দ হয়েছে। কিন্তু তোমার মত মেয়ে কখনো আমার পছন্দ হতেই পারে না। আই রিয়েলি ডোন্ট লাইক ইউ। রিয়েলি।’
‘ এক মিনিট। আপনার সাথে আমার কথা আছে।’ নীহারিকা উঠে দৌড়ে বিমুগ্ধের সামনে এসে দাড়াল। বিমুগ্ধ হেসে বলল,’ তোমার বাবার ব্যাপারে আমি কিছু জানি না। ত্রিশবছর পূর্বে কি হয়েছে আমি জানি না।’
‘ তাহলে আপনি তাকে এতো অপছন্দ করেন কেন? সে আপনাকে কি করেছে? সবার সাথে আপনি সুন্দর করে কথা বলছেন বাবার সাথে এত বাজে ব্যবহার কেন?’
‘ কারণ সে অনেক বড় কিছু করেছে যার জন্য মানুষের জীবনে দুর্যোগ নেমে এসেছে। তার ব্যাপারে আমি কথা বলতে চাইছি না।’
‘ কিন্তু আমি জানতে চাই।’ বিমুগ্ধ এবার ঘুরে দাড়িয়ে কিছু একটা ভেবে ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,’ জানালে কি পাব? আমার লাভ কি?’
‘ যা চাইবেন তাই। শুধু আপনার বাবার সাথে আমার বাবাকে মিলিয়ে দিন। আমার বাবা তার ভাইকে হয় তো খুব ভালোবাসে। আমি বুঝতে পারি।’
বিমুগ্ধ উচ্চ শব্দে হাসল। বাতাসে বাতাসে তার হাসির রেশ ছড়িয়ে পড়ল। নীহারিকা চোখ ঘুরিয়ে নিচের দিকে তাকাল। বিমুগ্ধ হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,’ চলো তোমাকে সাহায্য করব বলে ঠিক করেছি। তার বিনিময়ে আমারও কিছু চাই।’ নীহারিকা হাত মিলাল না। বলল,’ ওকে। ডিল। তবে আগে খুজে বের করুন তাদের মাঝে সমস্যা কি?’
বিমুগ্ধ হাসল। রহস্যময় হাসি। নীহারিকা চট করে ধরে ফেলল বিমুগ্ধ সব জানে। সব। অথচ বলছে না। কেন? বিমুগ্ধ হাসতে হাসতেই যাচ্ছিল। নীহারিকা দ্রুত তার লং শার্ট টেনে ধরল। বিমুগ্ধ ফিরে তাকাল না। একদম না। নীহারিকা বলল,’ আপনি জানেন?’
‘ তুমি কোনটা চাও অতীত জানতে না তোমার বাবা আর আব্বিকে মিলিয়ে দিতে। যে কোন একটি হবে।’ নীহারিকা ত্যাড়া ভাবে বলল,’ আমি দু’ টোই চাই।’
‘ অসম্ভব। একটি উপকার করব। তুমি তো জানো আমি স্বার্থপর মানুষ। তুমি আমার একটা উপকার করবে আমিও তোমার একটি।’
নীহারিকা কিছু বলল না। শার্টও ছাড়ল না। বিমুগ্ধ একটু ঝুঁকে এসে বলল, সারাজীবন ধরে রাখার ইচ্ছে মনে হচ্ছে। ধরে রাখো। শক্ত করে কিন্তু।’ নীহারিকা ছেড়ে দিল। বিমুগ্ধ চোখ বুঝে হাঁটছে। কিছু মানুষের অতীত লুকোনো থাকা ভালো। বাবা মায়ের অতীত ছেলে মেয়েদের একদমই জানা উচিৎ নয়। একদমই না। কিছু কষ্ট ভালোবাসার মানুষকে দেওয়া অসম্ভব। নীহারিকা কি তার সেই ভালোবাসা? যাকে সে কষ্ট দিতে চাইছে না। জীবনেও চাইবে না। বিমুগ্ধ সিঁড়ির কাছে বসে গেল। বসেই রইল।
মানুষটা এমন কেন? অল্প সংখ্যক মানুষের মাঝে সব সময় রহস্য থেকেই যায়। নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে আছে সে। হাত মুখের সামনে নিয়ে আসতেই এক মহনীয় ঘ্রাণ ভেসে আসে নিঃশ্বাসে। নীহারিকার রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে যাচ্ছে সেই সুগন্ধি।
___________
ঘড়ির কাঁটা রাত দু’টোর কাছে। নীহারিকার ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছে। সে ক্ষুধার্ত। নিপুণ ভাবে সিঁড়ী ভেঙ্গে সে রান্না ঘরে পা রাখল। খাবার তার জন্যে রেখে দেওয়া আছে। প্লেট হাতে নিতেই কলিংবেলের আওয়াজে ভয়ে ছিটকে গেল নীহারিকা। হাত থেকে ধপ করে প্লেট পড়তেই নিচ্ছিল। দ্রুত প্লেট ধরে সে সদর দরজার দিকে তাকাল। এতো রাতে কে আসতে পারে? জীবনে কখনো তাদের বাসায় এতো রাতে কেউ আসেনি। আজ কে আসল? ভাবতে ভাবতে নীহারিকা নিজের ফোন খুঁজে বের করল। মিতু আপুকে কল করতেই তিনি ধরে ফেললেন। এই মেয়ে কাল সারা রাত ঘুময়নি। অথচ নীহারিকা ভেবেছিল তার ঘুম আসবে না। কিন্তু ব্রেসলেট নিয়ে ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল খবরই ছিল না। মিতু আপু শুনা মাত্র হন্তদন্ত হয়ে দৌড়ে এসে হাজির। ড্রইং রুমের লাইট জ্বালানো। মিতু আপু গলা খাদে নামিয়ে অতি সাবধাণে বললেন,’ চোর এসেছে মনে হয়?’
‘ চোর তো কলিংবেল দিবে না আপু।’ নীহারিকার হৃৎকম্পন শুরু হয়েছে। মিতু আপু বললেন,’ চল খুলে দেখি।’ নীহারিকা হাত টেনে ধরল। যদি সত্যি চোর ডাকাত হয়? মিতু আপু শুনলেন না। সাহস যেন উপচে পড়ছে। টেবিল থেকে ছুরি তুলে নিয়ে তিনি দরজার কাছে দাঁড়ালেন। বুকে ফুঁ দিয়ে দরজা খুলতেই ছুরি ধরলেন। সাথে সাথে চিৎকার চেঁচামেচিতে সকলের ঘুম ভেঙ্গে গেল। ছুঁটে বেরিয়ে আসলেন বাড়ি ভর্তি সব মানুষ। নীহারিকা প্রথমে ভয়ে মৃদু চিৎকার করলেও এবার সামনে গিয়ে সে হতভম্ভ হয়ে গেল। রাত দুটো বাজে কেউ মানুষের ঘরে আসে? এই মানুষটাকে তো সে স্বপ্নেও কল্পনা করেনি। আশ্চর্য হয়ে সবাই তাকিয়ে রইল আগন্তুকের দিকে।
______________
চলবে………….
ভুলত্রুটি আল্লাহর দেওয়া মহান গুন ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টি দিয়ে দেখবেন। নিশ্চুয়ই ক্ষমা একটি সুন্দর গুন।
@হাফসা_আলম