প্রিয় সুখ পর্ব-৩৪

0
69

প্রিয় সুখ-৩৪
_________
গাড়ির হর্ন, ধূলো মাখা রাজপথ, মানুষের ভিড় এসবের মাঝে দাড়িয়ে থাকতে ভালো লাগার কথা নয়। ফুটওভার ব্রিজটি সামনে। তার সিঁড়ি পাশে। পুলিশের গাড়ি একটু দূরে। অফিসার খুব ভয়াবহ মানুষ মনে হচ্ছে। নীহারিকা একটু কাছে আসল। বিমুগ্ধের গায়ের কাছে। বিমুগ্ধ হাই তুলছে। মধ্য দুপুরে একটি ছেলে পুলিশের গুরুতর সমস্যায় জড়িয়ে এভাবে দাড়িয়ে হাই তুলতে তুলতে চারপাশে তাকাচ্ছে। কি এক দৃশ্য! বিমুগ্ধের চুল এলোমেলো, মুখশ্রী ঘামে ভিজা। গেঞ্জির গলা চুপচুপ। নীহারিকা তাকাল। গভীর ভাবে। এভাবে তাকানো উচিৎ নয়। তবুও তাকাচ্ছে। নিষিদ্ধ জিনিস গুলো না থাকলে ভালো হতো। দুধের জায়গায় মদের অনুমতি থাকলে ভালো হতো। লোকে তাহলে মদ খেত না।
‘ একটা আইডিয়া এসেছে।’ নিরানন্দ গলায় বলল নীহারিকা। বিমুগ্ধ চোখ টেনে টেনে খুলে পাশে তাকাল। বলল,’ আমি জানি কি আইডিয়া।’
চোরা চোখে পুলিশ অফিসারের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস গলায় বলল,’ না শুনে জানলেন কিভাবে?’
‘ শুনতে হবে না। আমি জানি।’
‘ কি জানেন দেখি বলুন?’ নীহারিকা বিমুগ্ধের গায়ের সাথে চেপে দাড়াল। অতিষ্ঠ নজর বিমুগ্ধের। নীহারিকা কেন এতো কাছে? এসব যেন তার অসহ্য লাগে। বিমুগ্ধ সরে দাড়িয়ে বলল,’ লাল সিড়ি বেয়ে দৌড়ে পালিয়ে যাওয়ার প্ল্যান কাজ করবে না নীহারিকা। পুলিশে, বাঘ এদের সামনে না পালিয়ে দাড়িয়ে থাকতে হয়।’ বিমুগ্ধ দাড়ায়ে দাড়িয়ে ঘোড়ার মত চোখ বুঝে ঘুমচ্ছে মনে হয়। নীহারিকা ভীষণ আশ্চর্য্য!
মেয়েটি পুলিশ অফিসারের কাছে এসে ভীতু গলায় বলল,’ আসলে লোকটি আমাকে হ্যারেস করেছিল। উনি মনে হয় তাই এমনটা করেছে।’
অফিসার ফায়ার চোখে তাকিয়ে বলল,’ কিভাবে হ্যারেস করেছে খুলে বলুন?’ আবার বিড়বিড় করে বললেন,’ হ্যারেস করলে কি দেশে আইন নেই? কাউকে এভাবে আঘাত করে আইন নিজের হাতে নেওয়ার কোন মানে হয় না। আপনার কি হয় এই ছেলে?’
‘ কিছু না।’
‘ কিছু না! একজন মানুষ কখনো অন্য মানুষকে শুধু শুধু মেরে প্রতিবাদ করে না। এখনে নিশ্চয়ই অন্য কারবার আছে। আপনাকে আমাদের সাথে যেতে হবে মিস্টার। আপনার নামে এরেস্ট ওয়ারেন্ট আছে। কেস ফাইল করা হয়েছে।’
‘ আচ্ছা। কিসে করে যাব? হেঁটে যেতে পারব না অফিসার।’ বিমুগ্ধের গম্ভীর গলা। নীহারিকা তাজ্জব হয়ে বলল,’ আপনি পুলিশ স্টেশনে যাবেন?’
‘ ইয়েস। মজার জায়গা রাগেশ্বরী। তুমি সিএনজিতে করে বাসায় চলে যাও।’ নীহারিকা ঝড়ের বেগে বলল,’ আমি আপনার সাথেই যাব। কিন্তু জেল কেমন হয়? ফিল্ম, সিনেমার মত?’ নীহারিকার চোখে একরাশ ভীতি। কণ্ঠে নিরুদ্বেগ ভাব। বিমুগ্ধ হাসল তার চোখে তাকিয়ে। বলল,’ তুমি বাসায় যাও আমি এসব হ্যান্ডেল করতে পারব।’
নীহারিকা নাছোড়বান্দা। সে যাবেই। বিমুগ্ধ কিছু ভেবে বলল,’ ভালো আইডিয়া দু’ জনেই জেল দেখে আসব। জেলের ভাত না কি অস্থির খেতে হয়।’
‘ আপনি জেলের ভাতও খাবেন?’
‘ অবশ্যয় খাব। জেলে যাব আর তার ভাত খাবো না এটা হতে পারে না। রাতে থাকবও। তুমি যদি যাও তাহলে তোমার জন্য আমি বাহিরে ভালো চেয়ার দেওয়ার সুযোগ করে দিতে পারব।’
‘ আমি বাবাকে কল করছি। আপনাকে এখনি ছাড়িয়ে নিবে।’
বিমুগ্ধ ঠোঁট কামড়ে ধরে বলল,’ রাত আট্টার আগে কেউ ছাড়াতে পারবে না। এই অফিসার ভদ্রলোকের বন্ধু হয়। প্রিয় বন্ধু।’
পুলিশ অফিসার চমকে গেলেন। কিভাবে বুঝল ভেবে তিনি গম্ভীর ভাবে একটা ধমক দিলেন। বিমুগ্ধ নীহারিকাকে ফিসফিস করে বলল,’ চুপ থাকো। এই লোকের মাথা প্রচন্ড গরম থাকে। ভালোর সাথে তেমন সম্পর্ক নেই।’ একজন এসে নীহারিকাকে সরিয়ে নিতে চাইল। বিমুগ্ধ ভয়ংকর লাল চোখে তাকিয়ে অতিঠান্ডা গলায় বলল,’ ও আমার সাথে যাবে এবং আমার সাথে থাকবে যতক্ষণ আমি থাকছি। কাছে যেন কেউ না আসে। ওর এসবে কোন লেনা দেনা নেই। দূরত্বে থাকবেন।’ বিমুগ্ধ নীহারিকার কোমল ঠান্ডা হাত টেনে নিজের আরও কাছে নিয়ে আসল।
পুলিশের লোক দুনিয়ার ত্যাড়া। জীবনেও মানতে চাইবে না। তারা নীহারিকাকে যেতে বলছে। ত্যাড়ামি করছে। গালাগাল দিচ্ছে। বিমুগ্ধ আজ নীহারিকাকে জেল দেখাবেই। সে শপথ করেছে। জেল যেন কয়েদীদের জায়গা নয় একটি টুরিস্ট স্পট। মেয়েটি বর্ণনা করার লজ্জায়, ভয়ে চুপসে গেল আরও অনেক আগে। সে একটু দূরে দাড়িয়ে। চোখ মুখ অসহায়ত্বে ভরা। নীহারিকা মেয়েটির কাছে এসে বলল,’ আপু আপনি বলুন যে এসব বিমুগ্ধ ইচ্ছে করে করেনি। আপনার সাথে খারাপ ব্যবহারের ফলে করেছে। রেগে গেলে একটু গোলমাল করে কিন্তু প্রকৃত পক্ষে সে এমন নয়। আপনি না বললে পুলিশ কেস নিয়ে অনেক সমস্যা হবে। প্লিজ।’ বিমুগ্ধ প্রচন্ড বিরক্ত হলো। নীহারিকার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,’ তোমাকে প্লিজ বলতে বলেছে কেউ? একদম চুপ করে দাড়িয়ে থাকবে তা না হলে ধাক্কা মেরে রাস্তায় ফেলে দিব।’
‘ আপনি আমাকে ফেলে দিবেন?’
‘ আমি সব পারি রাগেশ্বরী।’ বিমুগ্ধ ফু দিল নীহারিকা চোখের উপরে। লালবর্ণ অরুণ রাগ নীহারিকার চোখে। বিমুগ্ধ সুন্দর হাসল। মেয়েটি এসব দেখল। পুলিশ দেখে তার ভয় করছে। কাঁপছে। সে যানে তাকে এখন কি করতে হবে। তবুও সে করতে পারছে না। ভয়ে তার কলিজা ধকধক করছে। পুলিশের ঝামেলায় ফাঁসার ভয়, টাকা পয়সার ভয়, সবচেয়ে বড় কথা এক পুরুষের গুণধর কাজ অন্য পুরুষকে বুঝিয়ে বলতে হবে। ভেঙ্গে ভেঙ্গে। একটা মেয়ে হিসেবে এটা তার কাছে খুবই কষ্টদায়ক। সে একদম ঝামেলা মুক্ত থাকতে চায়। ভীতু প্রকৃতির হওয়ার শর্তেও সে ঠিক করেছে বলবে। মানুষটা তার জন্য বিপদে পড়েছে। পুলিশ অফিসারের কাছে এসে দাড়াতেই বিমুগ্ধ বলল,’ আপনার বাবা না অসুস্থ? হসপিটালে যাওয়া উচিৎ আপনার।’
মেয়েটি হতভম্ভ গলায় বলল,’ আপনি কিভাবে যেনেছেন?’
‘ আমি জানি। আপনার এখানে কোন কাজ নেই। কি হয়েছে এসব এই মুহূর্তে বলতে হবে না। যেতে পারেন।’
মেয়েটি কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে বিমুগ্ধের দিকে তাকিয়ে রইল। তার চোখে মুখে মুগ্ধতার সাথে প্রেমে পড়ার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। সে গভীর ভাবে বিমুগ্ধের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের প্রেমে পড়ে গেল। মানুষটার স্মার্টনেসের সাথে চরিত্রটাও যেন অসম্ভব অদ্ভুৎ। বিমুগ্ধ বিরক্ত চোখে তাকিয়ে নীহারিকাকে বলল,’ জেলে যাবে না?’
‘ আপনি যাবেনই?’
‘ অফ কোর্স। এবং তুমিও যাচ্ছ।’ বিমুগ্ধ টেনে নীহারিকার বই গুলো হাত থেকে নিয়ে ব্যাগে ঠুকিয়ে দিচ্ছে। যত্ন করে। একবার টেনে দেখল ভারী কি না। নীহারিকা চেঁচাল,’ সমস্যা কি?’ বিমুগ্ধ আরও কঠিন টান দিল। চোখে রাগ ভাসছে নীহারিকার। মেয়েটি আর তাকালো না। বিমুগ্ধের মত একটি মানুষকে সবাই পায় না হয় তো। অতি দুষ্প্রাপ্য বিষয়গুলো পৃথিবীতে এতই কম থাকে যে তা একের অধিকের ভাগ্যে জুটে না। বিমুগ্ধ গাড়িতে নিজে থেকে উঠে বসল। নীহারিকাকে বসতে বলল ড্রাইভারের পাশের সিটে। পিছনে তিনজন বসেছে। বিমুগ্ধের নিরুত্তাপ আচরণ অফিসারকে রাগিয়ে তুলছে। তিনি বেশ অকথ্য ভাষা ব্যবহার করল। বিমুগ্ধ তবুও চুপ করে বসে আছে। তার চোখ আপাতত সামনে।

পুলিশ স্টেশনে এসে দু’ জনেই বসল একটি বেঞ্চে। নীহারিকা বিমুগ্ধের দিকে প্রচন্ড রেগে তাকিয়ে বলল,’আপনার এটা করা একদম উচিৎ হয়নি। আপনি তাকে সাবধান করে দিতে পারতেন। বাসে উঠেছেন কেন? বাবা আসলে এখন কি বলবে বলুন তো? আমি কি বলব? দু’ জনকে এক সাথে দেখেই তিনি চমকে যাবে।’
নীহারিকার তপ্ত নিঃশ্বাস। বিমুগ্ধ হাসল। কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,’ বলবে আমরা বিয়ে করে নিয়েছি। কোড ম্যারেজ।’
‘ ফাইজলামি পেয়েছেন? আপনাকে আমি কখনো বিয়ে করব না। জীবনেও না।’
‘ আচ্ছা। করতে হবে না। আমার ঘুম পাচ্ছে। তোমার স্কন্ধ ধার দিতে পারবে? আমি তোমার হাজবেন্ড থেকে অনুমতি নিয়ে নিব?’
‘ না দিব না। আমার হাজবেন্ডও অনুমতি দিবে না।’ নীহারিকা অন্যদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে নিল। বিমুগ্ধ কিছুই শুনলো না যেন। সে সত্যি যেন অনুমতি নিয়ে গর্ভের সাথে মাথা ফেলে দিল নীহারিকার কাঁধে। তার ভারী মাথা নীহারিকার পাতলা ঘাড়, গলা, কান ভার করে তুলল। নীহারিকা বিহ্বল নয়নে তাকিয়ে আছে। গভীর নিঃশ্বাসের অস্তিত্ব পাওয়া যাচ্ছে। বিমুগ্ধের চিত্তা দুলছে মৃদু মৃদু। তার ঠোঁট কাঁপছে অল্প স্বল্প। নীহারিকা ভেবে পাচ্ছে না এমন একটা ভয়ংকর কাজ করে জেলে এসে এতোটা আরাম করে ঘুম আসে কিভাবে? অসম্ভব সব জিনিস কেন তার আশেপাশেই ঘটে?
ঘুম গভীর অতরল। বিমুগ্ধের শরীর জুড়ে শীতলতা। মন জুড়ে দুরূহ হিমায়ল। প্রিয় একজন মানুষ তার পাশে। নিষ্ঠুর এক ভালোবাসা যাকে ঘিরে কাজ করে। অথচ বেশি কাছে আসলে তার শরীর মন আত্মা নারীটিরে সহ্য করতে পারে না। গা কাঁপিয়ে তখন তার জ্বর আসে। হৃদয় ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়। কি আজব এই দুনিয়া আর এই দুনিয়ার নিয়ম। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়টি হচ্ছে ভালোবাসা। এর চেয়ে দুর্বোধ্য কিছু আর কখনো চোখে পড়েনি বিমুগ্ধের। আগের সব অদ্ভুৎততাকে ঠেকরে সবার উপরে এখন এর অবস্থান। নীহারিকা অনুভব করল বিমুগ্ধের শরীর ঘেমে একাকার। ব্যাগ থেকে পাতলা খাতা বের করে সে ডান হাতে হাওয়া দিচ্ছে তাকে। বিমুগ্ধের ঘুম আরও গভীর। নীহারিকা হাসল। বিমুগ্ধের খোঁচাচুল গুলোতে হাত রাখল একদম আস্তে করে অদৃশ্য ভাবে।
এসপি সাহেব বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। তার এতো বছরের ক্যারিয়ারে তিনি কখনো কোন আসামীকে পুলিশ স্টেশনে এসে এভাবে ঘুমাতে দেখননি। বিমুগ্ধের দিকে তিনি বেশ অনেক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। নীহারিকা কাঁধ ঝুঁকিয়ে বিমুগ্ধকে সরিয়ে দিতে চাইছে। কিন্তু পারছে না। বিমুগ্ধ পাক্কা ঘন্টাখানেক ঘুমালো। তারপর আড়মোড় ভেঙ্গে হাই তুলতে তুলতে নীহারিকাকে বলল,’ সমস্যা কি? এভাবে নড়াচড়া না করলে তোমার হচ্ছে না?’
‘ না হচ্ছে না। এটা আপনার বাসা না পুলিশ স্টেশন। আর আপনি পড়ে পড়ে ঘুমচ্ছেন? তাও আমার কাঁধে? আপনার সাহস অনেক বেশি বেড়েছে। জেলের ভাত খাওয়ার খুব দরকার পড়েছে বুঝতে পেরেছি। সরুন।’ নীহারিকার চোখ রক্তজবা। বিমুগ্ধ এসব খুব একটা গায়ে মাখছে না। সে একজনকে ডেকে বলল,’ খাবার দাবারের ব্যবস্থা নেই?’
‘ না নেই।’ অবাক হয়ে বলল লোকটি। বিমুগ্ধ অত্যন্ত বিরক্ত চোখে তাকিয়ে গম্ভীর মনভাব পোষণ করে বলল,’তাহলে দুপুরে ধরে নিয়ে এসেছেন কেন? খাবার খাওয়ার পরেই নিয়ে আসতে পারতেন। এখন যখন নিয়ে এসেছেন তখন আমার খাবার চাই।’
‘ এটা তো হোটেল না। এটা পুলিশ স্টেশন। আপনি কি মজার মুডে আছেন? তখন থেকে দেখছি নাটকের উপরে নাটক করছেন। ইউটিউবে চ্যানেল আছে না কি?’ দারোগা সাহেবের স্পষ্ট গলা। বিমুগ্ধ বলল,’ খুললে আপনাকে জানিয়ে যাব। এখন আমি ক্ষুধার্ত। খাওয়ার প্রয়োজন। আর আপনারা যদি এসবের ব্যবস্থা না করেন তাহলে আমি নিজেই করছি। বাহিরে যেতে দিন।’
‘ পাগল পাইছেন আমাদের? যখন যা আসছে বলছেন। হাজতে ঢুকিয়ে কয়েকটা দিলেই মাথা ঠিক হয়ে যাবে।’
বিমুগ্ধকে বসানো হয়েছে। তাকে একের পর এক প্রশ্ন করছে সে কিছুরই উত্তর দিচ্ছে না। নীহারিকা একটা সময় বিরক্ত হয়ে তার নবীন উদ্দীনকে কল করল। বাবাকে বলা যাবে না। নবীন উদ্দীন ছিলেন খুব স্বাভাবিক। নীহারিকা ভাবছে বিস্ময়ে জ্ঞান হারালো না তো? নীহারিকাকে দেখে অফিসার জিজ্ঞেস করল,’ উনি কে? আপনার বউ? বোন? গার্লফ্রেন্ড, আত্মীয়?’ বিমুগ্ধ টেবিলের উপরের কাগজ পত্র দেখছে। কি পাগলরে। অফিসার বিরক্ত হয়ে গেলেন। ধমকে ধামকে দেখলেন। বিমুগ্ধকে হাজতে ঢুকানোর নির্দেশ দিলেন। ওসি সাহেব খুব খুশি। তার বন্ধু তাকে গুরুতর কাজ দিয়েছে। এই ছেলেকে সোজা করে ছাড়বে। একটা চেয়ারে বসিয়ে তিনি দেখতে চাইলেন বিমুগ্ধ কি করে। সে পুলিশ অফিসারের সামনে প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করল। অনেক দিন খায় না। আজ হঠাৎ এই মুহূর্তে মনে পড়েছে এই প্যান্টের পকেটে একটি প্যাকেট আছে। বিমুগ্ধ ধরালো। অফিসারের নেম প্লেটে লেখা মোবারক। বিমুগ্ধ একটা সিগারেট এগিয়ে দিয়ে বলল,’ নিন মোবারক সাহেব।’
‘ আমি সিগারেট খাই না।’ দম্ভীক গলা তার।
‘ মিথ্যে কথা। আপনি একজন চেইন স্মোকার। আর দিনে আপনি চার প্যাকেট সিগারেট খান।’
অফিসার বিস্ময় ধরে রাখতে পারল না। বিমুগ্ধ বেশ মজা পাচ্ছে। এই যে তিনি কিছু না বলে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। বিমুগ্ধ বলল,’ একটা ভালো চেয়ার হবে? আপনাদের অফিসের চেয়ারগুলো তেমন ভালো না। ভালো একটা চেয়ারে বসার ব্যবস্থা করে দিব বলেছিলাম রাগেশ্বরীকে। অথচ সে দাড়িয়ে আছে।’ বিমুগ্ধ দেখলো নীহারিকা বেশ দূরে দাড়িয়ে। সে তাকে দেখলেও নীহারিকা তাকে দেখছে না। অফিসার বিমুগ্ধর গালে একটা ঘুষি মেরে রাগে গজগজ করে বলল,’ ফাইজলামি পাইছস? অনেক নাটক হইছে।’
‘ রাগেশ্বরীকে আপনারা দাড় করিয়ে রেখেছেন। আমার ভালো লাগছে না। সত্যি ভালো লাগছে না।’ বিমুগ্ধ নিজের ঠোঁট মুছতে মুছতে বলল। তার কণ্ঠ অত্যন্ত শীতল। অফিসার রেগে গেল আরো। বিমুগ্ধকে দুই তিনটা থাপ্পড় দিয়েই ফেলল। টি-শার্ট টেনে ধরল কয়েকবার। বিমুগ্ধ কিছুই বলল না। অনেকক্ষণ দাড়িয়ে থেকে নীহারিকার পা ধরে গেল। বিমুগ্ধের বাবাকে দেখা যাচ্ছে। নীহারিকা একটু শান্তি পেল। সব পুলিশ তার দিকে কেমন কেমন নজরে তাকিয়ে আছে। নীহারিকা কাছে যেতেই তিনি চোখ গরম করে বললেন,’ তুমি এখানে কি করছ?’
‘ বড় বাবা সেসব পরে বলব আগে উনাকে ছাড়িয়ে নিন।’
‘ না ছাড়াব না। ওকে কয়েক ঘন্টা মারা উচিৎ। জেলের মার কেমন হয় ও কখনো দেখেনি। চলো বসি।’ তিনি একটা বেঞ্চে বসল। নীহারিকা তাজ্জব হয়ে তাকিয়ে রইল। তার হাতে একটি ফ্লাক্স। সাথে একজন সহকারী। সে মগে চা ডেলে দিচ্ছে। তিনি খাচ্ছেন আরাম করে। সাথে নীহারিকাকেও খেতে বলছেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলল নীহারিকা। বাবার চিন্তায় এবার সে অস্থির। যদি এসব জানে তখন কি হবে? একজন অফিসার জিজ্ঞেস করল,’ কিছুক্ষণ আগে যে আসামিকে নিয়ে আসা হয়েছে তার গার্জিয়ান কে?’
‘ আমি।’ নবীনের স্বাভাবিক কণ্ঠ স্বর। অফিসার বিষম খেল। ছেলে জেলে তিনি খাচ্ছেন চা! নিজেকে স্বাভাবিক করে বললেন,’ আপনি আমার সাথে আসুন।’ নবীন আশ্বস্ত করে বলল,’ চা’ টা শেষ করে আসছি।’
অফিসার বিড়বিড় করল কিছু একটা। নবীন চা শেষ করল। নীহারিকাকে বলল,’ আমার সাথে সাথে থাকো। তোমাকে কে বলেছে এখানে আসতে। জেলের ভাত খেতে ইচ্ছে হয়েছে বুঝি?’
নবীন উদ্দীনের শাসনের সুর। নীহারিকা চোখ নিচু করল। তিনি চেয়ার টেনে অনুমতির আগেই বসে পড়লেন। তার সামনে ক্লান্ত গলায় ওসি বললেন,’ আপনার ছেলের মাথায় কি কোন সমস্যা আছে? নামটা পর্যন্ত এখনো বলেনি। আপনি জানেন সে কি করেছে? একজনকে আহত করে হসপিটালে পাঠিয়েছে। লোকাল বাসে উঠে হাঙ্গামা করেছে। আপনাকে দেখে তো ভদ্র মনে হচ্ছে। আপনার ছেলের সমস্যা কি?’
নবীন উদ্দীন মিশ্র হাসলেন। বললেন,’ আমার ছেলের নাম তাযিন শাহামাত। পেশায় একজন সাইকিয়াট্রিস্ট। সখের দিক থেকে একজন সেফ। আপাতত ভবঘুরে।’
‘ সাইকিয়াট্রিস্ট!’ বিস্মৃত অফিসার। চোখ কটর ঠেলছে যেন। নবীন উদ্দীন নিরহঙ্কার হাসছেন। এ সমাজের নীতি ভদ্ররা অভদ্রতা করতেই পারে না। অফিসার বলল,’ আমি যদি একবার ভিতরে ঢুকিয়ে দি বছরের পর বছর জেলে থাকতে হবে। জরিমানা করেছে তিনি। যার হাত আপনার ছেলে ছিদ্র করে দিয়েছে।’
‘ জরিমানা দিব কেন? ও থাক জেলে। জেলে কখনো আসেনি আমার ছেলে। এটাই প্রথম।’
‘ থাকবে মানে কি? আপনি তাকে ছাড়াতে আসেননি?’ অফিসারের মুখ হা। নবীন উদ্দীন আরও এক কাপ চা নিয়ে তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,’ আমি তাকে শুভেচ্ছা দিতে এসেছি। জীবনে অনেক কিছু করলেও সে কখনো জেলের ভাত খায়নি। তাই আমি আনন্দিত মিস্টার সৌভিক সাহেব।’ নীহারিকা রেগে বলল,’ বড় বাবা এসব বন্ধ করে ছাড়িয়ে নিন। আমাদের বাসায় যেতে হবে।’
‘ তুমি রেগে যাচ্ছ কেন? কথায় কথায় এতো রাগ ভালো না।’
‘ আপনি আমাকে রাগিয়ে দিচ্ছেন। এটা চা খাওয়ার জায়গা হলো? আপনার ছেলে এসেছে ভাত খেতে আর আপনি এসেছেন চা খেতে। দারুন।’
‘ মায়ের মত ব্যবহার করবে না। তুমি আমার মা নও।’
‘ আমি এই মুহূর্ত থেকে আপনার মা। উঠুন।’ নীহারিকা টেনে তুলে দিল নবীনকে। তাকে আর তার ছেলেকে এই মেয়েটাই চমকে দিতে পারে। বাদ বাকি সবাইকে তো তারা নজরে নজরে নাচিয়ে বেড়ায়। বিস্ময় নিয়ে তিনি বললেন,’ তোমাকে এখন মা ডাকতে হবে? মানে তোমার এখন আমার মত এতো বড় ছেলে আছে? তোমার তো বিয়ে হবে না। কেউ আমার মত দামড়া ছেলেকে দত্তক নিবে না।’
‘ নিতে হবে না। আপনি খাওয়াবেন আমাকে। ফলে বিয়ে করার প্রয়োজন নেই। আপনি উকিলের সাথে কথা বলুন। আপনার ছেলে এখানে থাকবে না।’
‘ তুমি আরও রেগে যাচ্ছ। চোখ লাল তোমার। আমার ছেলের জন্য এতো চিন্তা কেন?’
‘ মোটেও চিন্তা না। সে অন্যায় ভাবে শাস্তি পাচ্ছে।’
‘ অন্যায় কিভাবে হলো? সে একজনের হাতে আঘাত করেছে। মানুষ হয়ে আমি এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না। শুনুন আমার ছেলেকে প্রচন্ড মারবেন। অনেক দিন মার খায় না। তাই এমন অবাধ্য হয়ে গেছে। লাঠিটি আমাকে দেখাবেন। কেমন লাঠিতে সে ব্যথা পাবে আমি জানি।’
নীহারিকা মাথায় হাত দিয়ে দাড়িয়ে রইল। নবীন উদ্দীন অফিসার থেকে অনুমতি নিয়ে ছেলের সাথে দেখা করতে গেলেন। বিমুগ্ধের সামনে এখন ওসি সাহেব। তার ঠোঁট, গাল লাল হয়ে উঠেছে। মেরেছে মনে হচ্ছে। আব্বিকে দেখে সে হাসল। সেকেন্ড অফিসার আর নিতে পারছে না। সীমানা ছাড়িয়ে পাগল এই ছেলে। তিনি লাথি মারল চেয়ারে। উঠে যেতে যেতে বলল,’ তোকে আমি ছাড়ছি না।’
নবীন উদ্দীন সহমত পোষণ করে বললেন,’ ছাড়ার প্রশ্নই আসে না। জেলের ভাত খেতেই হবে।’ অফিসার তাকালেন। বললেন,’ আপনি কে?’
‘ এই অপরাধীর বাপ।’
‘ রঙ্গকৌতুক করেন মিঞা?’
‘ প্রশ্নই আসে না অফিসার। সরে দাড়ান দেখা করতে এসেছি সময় দশ মিনিট আপনি দুই মিনিট খরচ করেছেন ফলে সময় বাড়ানোর দায়িত্ব আপনার।’
তিনি সবাইকে উপেক্ষা করে ভিতরে প্রবেশ করে ছেলের সামনে বসল। বলল,’ জেলে কেমন লাগছে? ‘
বিমুগ্ধ হো হো করে হাসল। দারগা সহ অফিসার বিস্মৃত। বিমুগ্ধ ফিস ফিস করে কিছু বলল। তারা বাপ ছেলে হাসলো কিছুক্ষণ। তারপর বলল,’ খাত না খেয়ে বাসায় যাচ্ছ না তুমি।’
তিনি বেরিয়ে গেলেন। নীহারিকার পাশে বসে বললেন,’ মা বলে ডাকব না নীহারিকা।’
‘ আপনার যা খুশি।’
‘ তোমার বাসায় যেতে ইচ্ছে করছে?’
‘ না।’
‘ ভয় করছে?’
‘ হুম করছে।’
‘ করারই কথা তোমার বাপ তো বজ্জাতের শেরে বাংলা। ছেলে মেয়েদের টর্চারে কোন কমতি নেই তার। অসভ্য একটা। তোমার সামনে তোমার বাবাকে গালি দিতে ভালো লাগে। তুমি কি রাগ করছ?’
‘ না করছি না।’
‘ বাসায় যাবে? গাড়িতে করে পাঠিয়ে দিব?’
‘ না দরকার নেই। আমি নিজে নিজেই যেতে পারব। কিন্তু এখন যাচ্ছি না।’
‘ আমার ছেলের সাথে বেশি মিশবে না। মানুষ ভালো না। তুমি ভালো মেয়ে। তোমার বাপ হচ্ছে জঘণ্য কিট। তবে তুমি লক্ষী। তোমার পাত্র হতে হবে দশভূজা টাইপের। আচ্ছা দশভূজার মেইল ভার্সন জানা আছে তোমার?’
‘ না নেই। আমার পাত্র আপনাকে খুঁজতে হবে না। আমার বাবা আছে।’
‘ সে তো গাঁধা। জাত গাঁধা। ভালো ছেলে খুঁজে বের করতে পারবে না। আমার কাছে একজন আছে। ডাক্তার জাওয়াদ বিন মেসবাহ। ছেলেটা অস্থির সুন্দর। বিয়ে করে নেও। বাংলাদেশে সুন্দর ছেলে এবং সরকারী ক্যাডার এক সাথে পাওয়া যায় না। এদেশের রূপবতী মেয়েরা জন্ম নেয় কোটিপতির ঘরে যাওয়ার জন্য। এর একটা কারণ আছে। তুমিই বলো সুন্দর, দামী, মূল্যবান জিনিস তো দামি ঘরেই যাবে তাই না। এতে মেয়েদের কোন দোষ নেই। অন্যদিকে সুন্দর মেয়েকে বউ হিসেবে চায় না এমন কোন পুরুষ আছে? বলো? সেই চাওয়ার সুবাদে অধিক পড়ালেখা করে ক্যারিয়ার, টাকা বানাতে বানাতে বেচারারা হয়ে যায় ভূতের মত। এতে কি তাদের দোষ? সব মিলিয়ে রূপের সাথে ক্যারিয়ারের বিয়ে পারফেক্ট ব্যাপার। যাদের কাছে দুইটাই নেই তারাই শুধু বকবক করে দুঃখ প্রকাশ করে। বেকার ছেলে দেখে তো তুমি নিজেই নিজের বোনের বিয়ে দিবে না। তাহলে তোমাকে কেউ কেন করবে বলো? তুমি কি করবে?’
‘ না করব না। করা উচিৎ নয়। বেঁচে থাকার জন্য টাকা ভালোবাসা দু’ টোরই প্রয়োজন। তবে টাকার প্রয়োজন একটু বেশি। মেয়েরা ঠিক করে।’ নীহারিকা মনে মনে কষ্ট পাচ্ছে। তার যদি এখন হাতে অনেক টাকা থাকত সে বিমুগ্ধকে এভাবে মার খেতে, জেলে বসে থাকতে কখনো দিত না। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। এতো মনস্তাপ হচ্ছে কেন আল্লাহ!
‘ ছেলেরাও ঠিকই করে। এই যে তোমাকে একটা ছেলে খুঁজে দিলাম। তুমি হচ্ছো পৃথিবীর সবচেয়ে লাকি মানুষ। কেন বলেছি এখন বলব না। পরে একদিন বলব।’
‘ তাকে আমার বাবাই খুঁজে বের করেছে।’
‘ ও তাই না কি। তাহলে সমস্যা থাকতে পারে। বিয়ের আগে ভালো করে চেক করবা।’
‘ করব।’
‘ কিছু খাবা? আমি নিয়ে আসি?’
‘ আপনি আমার এতো যত্ন করছেন কেন? এতো সুন্দর করে কথাইবা বলছেন কেন?’ নীহারিকা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। নবীন উদ্দীন হাসেন। চোখে মুখি ভারী উজ্জ্বলতা। কেউ বলবে এই বান্দার পুত্র জেলে? কেউই বলবে না। নীহারিকা দেখেও বলতে পারছে না। বাবাকে সে এখনো জানায়নি। এটা শুনলে তিনি কি রিয়েক্ট করবে ভাবছে নীহারিকা। রাত আটায় বিমুগ্ধকে জেল থেকে বের হতে দিল। সে সত্যি জেলের কয়েদিদের জন্য নিয়ে আসা খাবার খেয়েছে। মেয়েটির নাম সাবিনা। সে এসেছে। তার মামাকে নিয়ে। সব বুঝিয়ে খুলে বলেছে। তার মামা কয়েকজনকে ফোনও করেছে। বিমুগ্ধ এটারই অপেক্ষা করেছে। ভয়কে জয় করাই মূল্যবান কাজ। তার সাথে অন্যায় হয়েছে। সে তো অন্যায় করেনি। তাহলে চুপ কেন থাকবে? মেয়েটি উল্টো কেস ফাইল করেছে। বিমুগ্ধ বের হয়ে সোজা ফার্স্ট অফিসারকে উপেক্ষা করে সেকেন্ড অফিসারের সামনে বসল। তারপর বলল,’ আমি আপনাদের এক নেতার আত্মজীবনী পড়েছিলাম। সেখানে এই ভাতের ভয়ংকর বর্ণনা দেওয়া হয়েছিল। আসলে কিন্তু ওতো খারাপ নয়। সরকার যে আমাদের মত অপরাধীদের খাওয়াচ্ছে এটাই অনেক। একটা অপরাধ করায় এখন আমিও অপরাধী। বাই দ্যা ওয়ে আপনাদের দেশের মানুষ খুবই উগ্র এবং উশৃঙ্খল। খু/নি যদি বলে আমি খু/ন করিনি। তাহলেও এদেশের পুলিশ বিশ্বাস করবে না। আবার কেউ স্বাক্ষী দিলেও বিশ্বাস করে না। আসলে সমস্যা হচ্ছে এরা বিশ্বাস করতেই পারে না। শুধু পারেন হেনস্তা করতে। হেনস্তা কথাটা কি ঠিক বাংলা বলেছি? অনেক কঠিন বাংলা আমি ধরতে পারি না। কথায় আসা যাক। আপনি এতো ভয় পাচ্ছেন কেন? পরের কথাটা শুনুন, এই আপনারাই আবার খু/নি এই ব্যক্তি জেনেও স্বাক্ষী খুঁজে মরে যান। ভারী ইন্টারেস্টিং।’
‘ আপনাদের দেশ আপনাদের দেশ বলছেন কেন? আপনি কি বিদেশি?’
‘ না। আমি আধা বাংলাদেশি আধা আমেরিকান। এবার একটি ভালো চেয়ারের ব্যবস্থা করুন।’
অফিসার করলেন। তিনি নিজে টাকা দিয়ে চেয়ার কিনে নিয়ে এসেছেন। যাকে তিনি ঘুষি, লাফি মারতে কমতি রাখেননি তার এক কথায় তিনি একটি দামি চেয়ার কিনে নিয়ে এসেছেন দেখে নীহারিকা হকচকিত। বিমুগ্ধের সাথে ভদ্র পুলিশ মহাশয় খুবই বিনয়ী এই মুহূর্তে। তিনি সুন্দর ভাবে বললেন,’ আমি দুঃখিত ডাক্তার। বুঝতে পারিনি আপনি কে। মানে আমি মনে করেছি আপনি হয় তো.’
‘ আমি হয় তো কি সেটা বড় কথা নয় আপনাকে ধন্যবাদ। ভাতের অভিজ্ঞতা নিতে পেরেছি বলে কথা। রাগেশ্বরী এবার তুমি বসো এখানে।’
নীহারিকা বসল। বিমুগ্ধের দিকে তাকিয়ে আছে। এই মানুষটা পৃথিবীর সবচেয়ে আজব প্রানী। ঠিক তার বাপও। নবীন উদ্দীন মুখটা ভার করে বললেন,’ আমি ভেবেছিলাম তুমি একদিন জেলে থাকবে।’
‘ আব্বি আজকে একটা কাজ আছে। বের হওয়া জরুরী।’
আসলে সাবনার কথায় এতো শক্তি ছিলো না। এতো আপ্যায়নের কারণ অন্য। বিমুগ্ধের এক পরিচিত ব্যক্তি এদের ফোন করেছে। কারণ সে ক্ষিপ্ত বিমুগ্ধকে ধরার ফলে। পরিচিত ব্যক্তি এদের স্যার হয় সম্পর্কে। এসব চাকরীজীবীদের কাজই উপরের পদের মানুষের গোলামী করা। ফলে বিমুগ্ধ এখন খুবি সম্মানী ব্যক্তি। বন্ধু বান্ধব আত্মীয় এক পাশে স্যার এক পাশে। চাকরীর পাওয়ার এবং দুঃখের বিষয় এটিই। বিমুগ্ধ এক কাপ চা খেলো। একটা সিগারেট সে অফিসারকে অফার করল। তিনি লুফে নিল। দু’ জনের এসব কর্মকান্ড বাকি সবাই ড্যাব ড্যাব করে দেখল। বিমুগ্ধ কিন্তু কিছুই বলেনি। শুধু তার বাবার একটা ফোন কলেই সে নির্দোষ হয়ে গেল। আজব কারবার না! নবীন নীহারিকার দিকে তাকিয়ে আছে। এই মেয়েটির জন্য আজ তিনি নিয়ম ভেঙ্গেছেন। তিনি কখনো ফোন করতেন না। আজ করেছেন। শুধু এই মেয়েটির অতি চিন্তিত চোখ দেখে। মেয়েটি একটু বেশি চিন্তা করছে না? মুখ দিয়ে নিঃশ্বাস ত্যাগ করে তিনি চোখ ফিরিয়ে নিলেন। কিছু মানুষের চরম শক্তি থাকে। পাথর গলগলিয়ে গলে পড়ে এদের সামনে।

বিমুগ্ধ উঠে গেল। অফিসার বলল,’ কোন নেতা সেটা তো বললেন না।’
‘ বলা যাবে না। নিজে খুঁজে নিবেন। পেলে এই নাম্বারে কল করে বলে দিবেন। এটা আপনার পরীক্ষা। এদেশে থাকবেন আর এদেশের নেতার ইতিহাস জানবেন না এটা তো হতে পারে না মিস্টার অফিসার।’ বিমুগ্ধ নিজের ফোন নাম্বার দিল। তারপর নীহারিকার হাত নিজের আব্বি সহ সকলের সামনে ধরে তাকে দাড় করিয়ে দিল। লজ্জায়, চোখে তম্বুল রাগ। ব্রীড়ায় নীহারিকা থরথর করে কাঁপতে লাগল। বিমুগ্ধের ভ্রুক্ষেপ নেই। নবীন উদ্দীনের মুখ থমথমে গুমুট। তিনি বললেন,’ তুমি এখন কোথায় যাচ্ছ? ওকে আমি নিয়ে যাচ্ছি। নিজের বাসায় যাও।’
বিমুগ্ধ জবাব দিলো না। নিজের বাবার সামনে দিয়ে সে নীহারিকাকে নিয়ে রাস্তায় নেমে গেল। নীহারিকা বিকট রাগে ফেঁটে পড়ল যেন। হাত ছাড়িয়ে নিতে নিতে বলল,’ থাপড়ে গাল লাল করে দিব অসভ্য একটা।’ বিমুগ্ধ এক গাল বাড়িয়ে বলল,’ পাঁচ আঙ্গুল যেন বসে যায়।’
নীহারিকা কথাই বলল না। সে দ্রুত হাঁটতে লাগল। বিমুগ্ধ দৌড়ে গিয়ে হাত ধরল শক্ত করে। নীহারিকা বলল,’ আপনাকে না বললাম আমার হাত ধরবেন না।’
‘ বলেছিলে।’
‘ তাহলে ধরেছেন কেন?’
‘ আমি তো তোমার হাত ধরছি না।’
‘ এটা কার হাত তাহলে?’ নীহারিকার হাত বিমুগ্ধের শক্ত হাতে বিলুপ্ত প্রায় হয়ে ডেবে আছে। বিমুগ্ধ হাসল। চারপাশে হাত নেড়ে চেড়ে বলল,’ হাত কোথায়? এটাকে তো বলে অনুভূতি। তুমি কখনো অনুভূতির সাথে ডিল করেছ? মারাত্মক কষ্ট হয় ডিলে। ছাড়তে পারবে না আবার ধরতে পারবে না টাইপের।’ বিমুগ্ধ আরও শক্ত করে ধরল। কালো আধার রাতে মিলিয়ে গেল তার অনুভূতি। অনুভবে রয়ে গেল তার রেশ। মাথায় থালার মত রূপর চাঁদ। আদুরে বাতাস। গাড়ির ভয়াল শব্দ। মানুষের কোলাহল। ছুটছে গাড়ি। গড়ছে বাড়ি। ভাঙ্গছে মানুষ। গড়ছে ভালোবাসা। নীহারিকা বিমুগ্ধের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে হাঁটছে। কিছু ছোঁয়া ভালোবাসার হয়। অনুভূতির হয়। যা আমরা রোজ পেতে চাই। রোজ আমরা চাই কেউ এভাবে ভালোবাসুক। আগলে রাখুক। নীহারিকাও চায়। ইদানিং বেশি চায়।
এই ব্যস্ত রাস্তা তাকে মনে করিয়ে দিল বহু বছর আগের একটি রাত। একটি অচেনা মানুষকে অবিশ্বাস্য ভাবে বিশ্বাস করে সে হেঁটে ছিল রাস্তার পর রাস্তা। ভিজে ছিল বৃষ্টির মত প্রেমে। হ্যা সে তো তখনই প্রেমে পড়ে ছিল। একটি অন্যরকম মানুষের গভীর প্রেম তাকে আকর্ষণ করেছিল। নীহারিকা সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে বিমুগ্ধের সাথে হাঁটতে। সেটা এই মুহূর্তে এসে তার চরম ভাবে অনুভব হচ্ছে। নীহারিকা হাত ছাড়িয়ে নিল। কিছু ছোঁয়া অসম্ভব ভালো লাগলেও তা অনুচিতের খাতায় থাকে। পৃথিবীতে নিষিদ্ধতা আছে বলেই তো এতো আকর্ষণ, এতো ভালো লাগা, এতো ভালোবাসা। বিমুগ্ধের চোখ এই অন্ধকারেও জ্বলছে। বিড়ালের চোখ যেমন চকচক করে। ঠিক তেমন। নীহারিকা মিহি গলায় জানতে তাইল,’ আমরা কোথায় যাচ্ছি?’
‘ তোমাকে বলেছিলাম সারপ্রাইজ দিব। আজ সেটি দেওয়ার সময় এসে গেছে।’ নীহারিকা ভাবতে লাগল কি হতে পারে? কিন্তু ভেবে পাচ্ছে না। সে যেন সারপ্রাইজ জানার জন্য পাগল হয়ে যাচ্ছে। বিমুগ্ধ হাসতে লাগল। এই দিকে মানুষজন নেই। হাসির শব্দ ভূতুড়ে শুনাচ্ছে। বিমুগ্ধ ঈষৎ কাছে এসে বলল,’ এতো চিন্তার কিছু নেই। তোমাকে চমকে দেওয়ার মত সারপ্রাইজ কিন্তু।’
‘ আপনি আমাকে কেন সারপ্রাইজ দিতে চাইছেন?’
‘ কারণও বলব আজকে। আজই বলব।’
_____________
নীহারিকা হাঁটতেই থাকল। একটি বাগানের সামনে এসে ভ্রু কুঁচকে নিল। এই রাত নয়টার দিকে কেউ বাগানে আসে? কি কাজ এখানে। বিমুগ্ধ ভিতরে ঢুকতেই লাইট জ্বলে উঠল। নীহারিকা চমকে ভিতরের দিক দেখে। গাছে গাছে ফুল। সব নীল ফুল। যত ধরণের নীল ফুল হতে পারে সব এখানে। একটু দূরে একটা রেস্টুরেন্ট দেখা যাচ্ছে। নীহারিকা বুঝল এটি বিমুগ্ধের আব্বির। কারণ পাশেই খোদাই করে তার আম্মির নাম লেখা আছে ‘ শামা’। বিমুগ্ধ একটি চেয়ার টেনে দিল। বাহিরের আলো জ্বলছে জ্বল জ্বল করে। নীহারিকা বসতে নিল বিমুগ্ধ তার ব্যাগটি নিয়ে সেটির উপরে রেখে দিয়ে বলল,’ চলো।’
‘ কোথায়?’
‘ ফুল ছিড়ব।’
‘ রাতে গাছের পাতা ছিড়াই উচিৎ নয়। আপনি ফুল ছিড়তে চাইছেন?’
‘ হ্যাঁ চাইছি। আল্লাহর কাছে মাফ চেয়ে নিব যদি এমন কোন হাদিস থেকে থাকে।’
‘ জেনে শুনে গুনাহ করলে কোন মাফ নেই।’
‘ আগে এমন হাদিস খুঁজে বের করতে হবে। আর বের করলেও আমি এখনো এটা সম্পর্কে জানি না। ফলে জেনে শুনে তো হলো না। আর তুমি বললেই তো হবে না। চলো।’
নীহারিকাকে টেনে নিয়ে গেল। রেস্টুরেন্ট বন্ধ। কিন্তু স্টাফ আছে ভিতরে। তাদের কলকল কথা শুনা যাচ্ছে। বিমুগ্ধ একটি গাছে জড়িয়ে থাকা লম্বা লতা ছিড়ে ফেলল টান মেরে। সাথে সাথে ঝমঝম মচমচ শব্দ করে সেটি বিমুগ্ধের হাতে চলে আসল। বিমুগ্ধ গোল করে প্যাচাতে লাগল। তারপর নীহারিকার হাতে ঢুকিয়ে দিয়ে তার হাত ধরল। নীহারিকার হাত জমে যাওয়া বরফের চেয়েও কঠিন ঠান্ডা। হিমালয় তার হাতেই এসে থেমেছে। বিমুগ্ধ প্রতি গাছ থেকে একটি করে ফুল ছিড়ল। সেটি প্যাচানো লতায় ডুবিয়ে দিতে লাগল। লতার ভাঁজ ফুলে ফুলে ভড়ে উঠছে। বিমুগ্ধ নীহারিকাকে চমকে দিয়ে বলল,’ তোমাদের দেশে প্রপোজাল দেয় কিভাবে?’
নীহারিকার গলা কাঁপছে। বিমুগ্ধকি আজ ভয়ংকর কিছু করবে? যা নীহারিকা মে/রে ফেলবে। নীহারিকার শরীর কাঁপছে। বুকের শব্দ থামছে বাড়ছে। শরীর শিরশির করছে। মাথা করছে ঝিমঝিম। চোখ ঘোলা হয়ে আসছে। বিমুগ্ধ আবার বলল,’ শুনেছি প্রপোজ করলে না কি জুতো পিটা করা হয়?’
‘ প্রপোজ করলে নয় বিরক্ত করলে।’
‘ ওহ আচ্ছা। নীলের সাথে সাদা দিলে ভালো লাগবে?’
‘ জানি না।’ নীহারিকার গলার কাঁপন ধরতে পেরে বিমুগ্ধ হাসতে লাগল। নীহারিকার আরও ভয় লাগছে। সে হাত মচড়ামচড়ি করছে। বিমুগ্ধ কোমল গলায় বলল,’ তোমার আমাকে ভয় করছে?’
‘ করছে।’
‘ আমারও ভয় করছে। আমি জীবনে যে কাজ করিনি আজ করব।’
‘ করার দরকার নেই। চলুন চলে যাই।’
‘ করতেই হবে। পৃথিবীর সবকিছুর নিয়ম আছে। নিয়ম মেনে মাঝে মাঝে বাঁচতে হয়। আজ নিয়ম পালন করব রাগেশ্বরী। তুমি রেগে যাচ্ছ?’
‘ খুব।’
নীহারিকার গলা শুকিয়ে কাঠ। বিমুগ্ধ সম্পূর্ণ লতায় জড়িয়ে দিল সুন্দর সব নীল ফুল। নীলাভ কুসুমস্তবক দেখে বিস্মৃত নীহারিকা। স্তব্ধ হয়ে সে তাকিয়ে আছে। বিমুগ্ধ একটি গাছের কাছে আসল। সাদা কাঠের বেঞ্চের উপরে বসল। তার মাথার উপরের গাছে লাইট চলছে। সাদা ফেরিলাইট। কি অসম্ভব সুন্দর একটি জায়গা। কাল্পনীক শহর মনে হচ্ছে। সাদা লাইটের নিচে নীল ফুলের বাগান। নীহারিকা বসল না। বিমুগ্ধ চারপাশে তাকিয়ে বলল,’ আমার আব্বির প্রিয় রং নীল। তোমার কি নীল পছন্দ?’
‘ না।’ নীহারিকার খুবই ক্ষুদ্র গলা। বিমুগ্ধ হাত টেনে পাশে বসিয়ে দিল। নীহারিকার দিকে তাকাল। সাদা লাইটের নিচে তার মিশমিশে কালো চোখ জ্বলছে নীল নীল হয়ে। বিমুগ্ধর চোখে খেলে গেল এক নেশা। চূড়ান্ত আবেগ। পাগল করা অনুভূতি। সে জেলে গিয়েছে এই মেয়েটির জন্য। জেলে সে যতক্ষণ ছিল মেয়েটিও ছিল। মেয়েটি আজ দুপুর থেকে তার সাথে। শুধু তার সাথে। বিমুগ্ধের দেহপিঞ্জরে আফিমের নেশার চেয়েও ভয়াবহ নেশা ভালোবাসা দৌড়ে বেড়াচ্ছে। সত্যি কি সত্যি এসব! নীহারিকা তার জন্য পুলিশ স্টেশনে ছিল! ঘন্টার পর ঘন্টা! বিমুগ্ধের গভীর দৃষ্টি। মুগ্ধ অনুভবের অনুভূতি। কি দারুন ভালো লাগার সব। কি দারুন!
‘ তোমার মনে কি চলছে বলতো? আমি বুঝতে পারছি না। তোমার চোখ পড়া যাচ্ছে না।’
‘ আমার চোখ পড়ে আপনার কাজ নেই। বাসায় চলুন।’
নীহারিকা শান্ত হতে চাইল। বিমুগ্ধ হেসে বলল,’ কাজ আছে।’
‘ না নেই।’
‘ তুমি এতো নার্ভাস হয়ে যাচ্ছ কেন? বিবাহ নিবন্ধনে সাইন করতে বসেছ না কি?’
নীহারিকা দাড়িয়ে পড়ে বলল,’ এসব কি ধরনের কথা?’
‘ তুমি এতো হাইপার হচ্ছো কেন? রেগে যাচ্ছো কেন? তোমার মুখশ্রী প্রচন্ড লাল। আমি বুঝতে পারছি। খুব করে। কি আজব!’
বিমুগ্ধ হাসছে কুটকুট করে। নীহারিকা রেগে গেল। বলল,’ আপনাকে একটা থাপ্পড় আমি দিবই।’
‘ আমিও থাপ্পড় খাবই।’
বিমুগ্ধ নীহারিকার হাত টেনে ধরল। পাশে বসাল আবার। এই অন্ধকার রজনীকে স্বাক্ষী রেখে সে নীহারিকার মাথায় নীল ফুলের মুকুট জড়িয়ে দিল। নীহারিকার সারা দেহ কাঁপতে লাগল। বুক উঠানামা করছে হাঁপড়ের রোগীর মত। শ্বাস কষ্ট হতে শুরু করেছে। পায়ের তালুতে ভর দেওয়া কঠিন খুব। বিমুগ্ধ তাকিয়ে আছে। কিছু দেখা যাচ্ছে না। তবুও এতো মুগ্ধতা চোখে! বিমুগ্ধ এই চোখের আগুনে পাগল হয়ে যাচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। কি গভীর চোখ। কি লাল রাগ! বিমুগ্ধ কণ্ঠে আবেগ মিশিয়ে বলল,’ তুমি অসম্ভব সুন্দর নীহারিকা। অসম্ভব। যে সৌন্দর্য্যের সজ্ঞা নেই। ব্যাখা নেই। কিন্তু এটি অর্থ বহন করে। শব্দ নেই। বাক্য নেই। কিন্তু এটি কথা বলে। আমি কখনো কোন মেয়ের সৌন্দর্য্য এতো গভীর ভাবে উপলব্ধি করিনি। আচ্ছা তুমি এতো সুন্দর কবে হয়ে গেলে নীহারিকা? কবে?’ নীহারিকা কিছুই বলছে না। তার চোখ দূর দূর দৃশ্য দেখছে। মস্তিষ্ক ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। বিমুগ্ধ তাকিয়েই রইল। দশ মিনিট, বিশ মিনিট, হয় তো ত্রিরিশও হয়েছে। বিমুগ্ধ একটি ছবি তুলল। সামনে তাকিয়ে একটি মেয়ে বসে আছে। যার চোখ জ্বল জ্বল করে জ্বলছে। নীল নীল মনি হয়ে আছে। কালোর সাথে সেই নীল মিশে কি অবাস্তবিক দৃশ্য! মাথায় নীল মুকুট। নীল ফুলে ভরা তার কপালের উপরিভাগ। বিমুগ্ধ আরও একটি ফুল গুঁজে দিল। নীহারিকার চোখের দিকে তাকিয়ে অতলে হারিয়ে যাওয়া উন্মাদময় কণ্ঠে বলল,’ তোমাকে আমার এই মুহূর্তে, এই সময়ে, এই যামিনীতে, এই ভাবে, এই পোষাকে, এই অনুভূতিতে আদ্রীকৃত করে, বিয়ে করে নিতে ইচ্ছে করছে নীহারিকা। বিপদজনক বিয়ে। যেমন বিপদজনক আমার অনুভূতি। যেমন বিপদজনক আমার ভালোবাসা।’
বিমুগ্ধ থেমে গেল। আর কিছুই সে বলতে পারল না। তার কণ্ঠ রোধ হয়ে গেল। নাক মুখ লাল হয়ে উঠল। তার শরীর গরম হচ্ছে একটু একটু করে। বিমুগ্ধ দেখল নীহারিকা কাঁদছে। সে চমকে গেল। চরম ভাবে। নীহারিকা তো সহজে কাঁদে না। অথচ বিমুগ্ধ তাকে কত বার কাঁদিয়েছে। ভালোবাসা তো কাঁদায় না। হাসায়। তাহলে নীহারিকা কেন কাঁদে? কেন সে নীহারিকার জীবনের অসম্ভব কঠিন বিষয়, কান্নাকে অতি ক্ষুদ্র কারণে ঝরিয়ে দিতে পারে? তাহলে কি হাসি কান্না সব একুই সুত্রে গাঁথা? প্রেম সূত্রে! বিমুগ্ধ চোখ বন্ধ করে নিল। নীহারিকা কাঁদলে তার ভালো লাগে। অসহ্য যন্ত্রণাময় ভালো লাগায় কেয়া দুলে। আবার বক্ষপিঞ্জরের মাঝে একটি ব্লেড বসে। কাঁট কাঁট করে কেঁটে যাওয়ার মত জঘন্য অনুভূতিও হয়। ভালো খারাপ পাশাপাশি থাকতে না পারলে ভালো লাগা আর কষ্ট পাওয়া এক সাথে থাকে কিভাবে? বিমুগ্ধ বিড়িবিড় করা গলায় বলল,’ আমার বুক জ্বলছে রাগেশ্বরী। তোমাকেও জ্বালীয়ে দিতে ইচ্ছে করছে।’ থেমে থেমে আবার ঘোর গলায় বলল,‘ তোমার উচিৎ ভালোবাসার অত্যাচারে পুড়ে যাওয়া। ঠিক তোমার রাগের মত।’
নীহারিকা এতো চুপ কেন? প্রকৃতি চঞ্চল হয়ে যেন জানতে চায়। হাওয়ায় জড়ানো বাতাসে সব দুলছে। লাইট দুলছে। আলো দুলছে। নীহারিকার চোখ ভিজে যাচ্ছে। বিমুগ্ধের জ্বর আসছে। শীত শীত অনুভূতিতে কাঁপছে তার শরীর। নেশা নেশা অনুভূতি শরীর বেয়ে মস্তিষ্কে ভর করছে। নীহারিকা দু’ হাত সে শক্ত করে ধরল। নীহারিকা চমকে গেল। তার চোখ মুখ বিস্ময়ে বড় হয়ে আসল। ঠোঁট ঝুলে গেল। বিমুগ্ধের মাদক চোখে পাগল করা জ্বর। লাল হয়ে আসা শুভ্রতা। প্রচন্ড বেসামাল কন্ঠ ধ্বনি,’ তুমি আমাকে ধ্বংস করেছ। আমার জীবন বদলে দিয়েছ। নদীর স্রোত হয়ে চলা আমাকে তুমি নিজের ইচ্ছের ঊর্মিলহরী করে তুলেছ। আমি তোমার বিনাশ করে দিব। তোমাকে এই প্রলয় স্তুপের উপরে বাস করতে হবে। ঘর তৈরি করতে হবে। এখানেই থাকতে হবে। i am officially announcing today, You have to survive on this heap of ruins. You must be a prisoner in my heart. This time you will give me a slap. Hit me. ( আমি আনুষ্ঠানিকভাবে আজ ঘোষণা করছি, তোমাকে এই ধ্বংস স্তুপের উপরে বেঁচে থাকতে হবে। তোমাকে আমার হৃদয়ে বন্দি হতে হবে। এবার তুমি আমাকে একটি চড় মারবে। মারো আমাকে।)’ বিমুগ্ধের কন্ঠে খেপামি ভড়াট চিৎকার।
নীহারিকা তাকিয়ে রইল বিমুগ্ধের চোখের দিকে। তারপর খুব জোড়ে একটি চড় ছুঁয়ে দিল তার গালে। শক্ত সেই চড় খেয়ে বিমুগ্ধ হাসল। নীহারিকা কাঁদতে কাঁদতে বলল,’ আমি বাসায় যাব। দ্রুত।’ বিমুগ্ধ হেসে ফেলল আরও জোরে। নীহারিকার মাথার লতানো ফুলের বৃত্ত ঠিক করে দিয়ে বলল,’ সারপ্রাইজ তো এখনো দেওয়া হয়নি রাগেশ্বরী।’
‘ আমি আর কোন সারপ্রাইজ চাই না।’
‘ তোমাকে তো সারপ্রাইজটা নিতেই হবে। চলো।’ বিমুগ্ধ টেনে তুলল। নীহারিকার কান্নার শব্দ তার কানে আসছে। গাল জ্বলে যাচ্ছে। ভয়ংকর নারী রাগেশ্বরী। এই মেয়েকে ভালোবাসা সহজ। যে কেউ একে ভালোবেসে ফেলতে পারবে। কিন্তু এর ভালোবাসা পাওয়া এতো সহজ নয়। সাঙ্ঘাতিক কঠিন একটি বিষয় এটি। নীহারিকা মহা কষ্টে পড়েছে। তার রাগ উঠছে না। তার হৃদয় ভেঙ্গে যাচ্ছে। থাপ্পড়টা না মারলে ভালো হতো। রেগে থাকা যেত। মনে মনে শপথ করল সে বিমুগ্ধকে আর কখনো থাপ্পড় দেওয়ার কথা চিন্তা করবে না। শুধু চিন্তা করবে রেগে থাকার উপায়।
বিমুগ্ধ খাবার নিয়ে আসল। নিজের গাড়িও পেয়ে গেল সে এখানে। শান্ত নিয়ে এসেছে। নীহারিকা বসল পিছনের সিটে। বিমুগ্ধ চোখে হাসল। নীহারিকা তার দেখা পৃথিবীর সবচেয়ে আশ্চর্য জনক মেয়ে। নিজের থেকেও বেশি আশ্চর্য্যের এই নারীকে দেখলে তার হৃদয়ে উথাল পাথাল হয়। ভাঙ্গে। গড়ে। ফুলের সৌরভ ছড়ায়। আবার তাকে এই নারীই ধ্বংস করার ক্ষমা রাখে। পৃথিবীতে এসব মেয়ে আসেই পুরুষজাতীকে বিধ্বস্ত করতে। কিন্তু অতি দুঃখের বিষয় এদের কেউ বিনষ্ট করতে পারে না। এরা জন্ম নেয় অসীম এক মনশক্তি নিয়ে। যাদের আত্মা ভাঙ্গে, মন ভাঙ্গে, হৃদয় হারায়, সব শেষ হয়ে যায় তবুও এরা দাড়িয়ে থাকে। অপ্রতিরোধ্য তুফানও এদের অধঃপতন ঘটাতে পারে না। এই যে এতো এতো কান্না, এতো অনুভূতির আদান প্রদান, এতো আবেগ, সব ঠেলে সে ঘুমিয়ে পড়েছে। পিছনের সিটে পা গোল করে নিয়ে নীহারিকা ছোট বাচ্চার ন্যায় ঘুমিয়ে আছে। তার চোখের পাঁপড়িতে জমা পানি থৈ থৈ করছে। মেয়েদের এতো শক্তি? বিমুগ্ধের মনে হলো পৃথিবীতে সবচেয়ে শক্তিশালী সত্ত্বার নাম নারীজাতি। এরা ভয়ংকর শক্তি নিয়ে জন্মেছে। নীহারিকার শক্তি একটু বেশিই। না একটু নয়। অনেক বেশি। নীহারিকার হাতে ফুলের তোড়াটা সুন্দর করে আগলে রাখা। বিমুগ্ধ তাকিয়ে থাকল। তারপর পাশ থেকে লং শার্ট নিয়ে নীহারিকার গায়ের উপরে দিয়ে দিল। অনিষ্টকর একটা কাজ সে করে বসল। নীহারিকার চোখের পাতা ছুঁয়ে দিল। চোখটা কি ভীষণ গরম! বিমুগ্ধের হাতে জমল পানি। সে বিড়বিড় করল,’ তোমার হৃদয় সবচেয়ে শক্তিশালী রাগেশ্বরী। ভয়ংকর এই হৃদয় জিনি তৈরি করেছে তাকে ধন্যবাদ। যে আগলে রেখেছে তাকেও ধন্যবাদ। তোমার বাবাকে আমি কিন্তু এখনও অপছন্দ করি। তবুও ধন্যবাদ। তুমি তার মেয়ে। তার অস্তিত্ব। কি ভয়াল পাগল করা সৌন্দর্য্য তার মাধ্যমে তুমি পেয়েছ। তুমি আমাকে সত্যি রোপ করে দিয়েছ রাগেশ্বরী। তোমার রাগ পুরুষজাতীকে নিভিয়ে নিঃশেষ করে দেয়। ঠিক তোমার আগুন চোখের শীতলতার মত।’

‘ সে রূপনগরের রানী
রূপোর হাসি তার বানী
রূপ সাগরে ডুব বসিয়ে
আমি হৃদয় হারাতে যানি।’

_______
ঘড়ি নেই। কটা বাজে জানার উপায় নেই। ঘুম থেকে উঠে নীহারিকা নিজেকে একা গাড়িতে পেয়ে ভয় পেয়ে গেল। অন্ধকারের বন্ধ দরজায় তার দম আটকে আসতে চাইল। জোরে শ্বাস নিতে নিতে সে জানালায় বাড়ি দিল। বিমুগ্ধ বাহিরে ছিল। এতো কড়া আঘাতে সে দ্রুত খুলে দিল। নীহারিকা পড়ে গেল তার বুকের উপরিভাগে। বিমুগ্ধ দু’ হাতে আগলে নিয়ে বলল, ‘ কি হয়েছে?’
‘ আপনি আমাকে এভাবে অন্ধকারে রেখে কখনো যাবেন না। কখনো না। আমি অন্ধকার ভয় পাই।’ বিমুগ্ধর থেকে দূরে সরে বসল সে। বিমুগ্ধ মাথায় হাত বুলিয়ে হাসল। যাকে পুরুষজাতীর কিছু পুরুষ ভয় পায় সে কি না অন্ধকারকে ভয় পায়! মুখে বলল,’ যাব না। কখনো না।’ নীহারিকা কথাটা বলেই ব্যাক্কেল হয়ে গেল। নিজের কাজে সে বিরক্ত হয়ে গেল। বিমুগ্ধ সরে এসে বলল,’ নেমে পড়ো।’
‘ এটা কার বাড়ি? এটা তো আমাদের বাসা নয়? আপনাকে এবার আমি কি করব আমি নিজেও জানি না।’ রাগে চিৎকার করল নীহারিকা। বিমুগ্ধ হাসল। নীহারিকা তার গায়ে বিমুগ্ধের শার্ট দেখে আরও বিরক্ত হয়ে ছুঁড়ে দিল। গা থেকে বিমুগ্ধের পারফিউমের ঘ্রাণ ভেসে আসছে। রোষ গলায় ফেঁটে পড়ে বলল,’ আপনাকে খু/ন করব এবার শয়তান লোক।’ সে জুতো খুঁজে বের হলো। বিমুগ্ধের হাত নীহারিকার দিকে আসতেই সে মুচড়ে ধরল। বিমুগ্ধ ব্যাথা পেলো না। কিন্তু অভিনয় করল ঠিকই। নীহারিকা বলল,’ এটা কার বাসা?’
‘ আমার।’ নির্লিপ্ত গলা তার। নীহারিকা দু’ হাতে মাথা ধরে বলল,’ আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি।’
‘ সমস্যা নেই ডাক্তার তোমার সঙ্গে আছে।’
‘ আপনি কি আমাকে বিরক্ত করতে করতে শেষ করে দেওয়ার প্ল্যান করেছেন?’
‘ না।’
‘ তাহলে এসব করছেন কেন? আজব পাগলামী না কি?’
‘ আমি তোমাকে ভালোবাসতে বাসতে পাগল করে দিব রাগেশ্বরী। সেটাই আমার প্ল্যান।’
‘ আপনার না বিয়ে হবে কয়েকদিন পরে?’
‘ তা তো অবশ্যয় হবে। লিভ টুগেদার তো তোমরা বাংলাদেশিরা সহ্য করতে পারো না। ১৮৬০ সালের ৪৯৭ ধারা অনুয়ায়ি ৭ বছর সশ্রম বা বিনাশ্রম ও জরিমানা হবে। অথচ ঠিকই রুমডেটে ইন্টারেস্টিং লাগে।’
‘ ছিঃ। নোংরা মানসিকতার লোক।’ নীহারিকা নাক ছিটকে নিজের ফোন খুঁজতে লাগল। কিন্তু নেই। ব্যাগ থেকে কোথায় গেল? বিমুগ্ধকে দেখে বলল,’ আপনি নিয়েছেন?’
‘ জানি না।’
‘ এসব কেন করছেন?’
‘ জানি না।’
‘ আপনার হবু বউয়ের কাছে যাচ্ছেন না কেন? আপনি কি রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতার অমিতের রোল প্লে করছেন?’
‘ কেন সে কি করেছিল? আমার মত কি বিখ্যাত বিমুগ্ধ সে? না কি জিনিয়াস? এই আমি কিন্তু টপার ধরণের ছেলে। তোমাদের দেশের ভবিষ্যৎ। পৃথিবীর উন্নতি। ভেবে কথা বলবে।’
‘ তার শেষের দিতের উক্তি ছিল, ‘কেতকীর সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভালোবাসারই। কিন্তু সে যেন ঘড়ায় তোলা জল, প্রতিদিন তুলব, প্রতিদিন ব্যবহার করব। আর লাবণ্যের ভালোবাসা, সে রইল দীঘি। সে ঘরে আনবার নয়, আমার মন তাতে সাঁতার দেবে। মানে ঘরে এক বাহিরে আর এক। যেমন আপনার একজনের সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে আর একজনের সাথে আপনি নাটক করছেন।’
‘ আমি একজনকেই ভালোবেসেছি। বাসব। বেশিই যাব। এবং একজনকেই বিয়ে করব। রূবাইদার সাথে বিয়ের কাহিনী আমি অনেক আগেই শেষ করেছি। ফলে আমি অমিত নই। চলো। তোমার সারপ্রাইজ উপরে।’
‘ আপনার বাসায় কেউ আছে? আমাকে আপনি কোন সাহসে একা বাসায় যাওয়ার অফার করছেন?’
বিমুগ্ধ হো হো করে হেসে উঠল। নীহারিকা আরও রেগে গেল। বিমুগ্ধের পিছনে হেঁটে সে বাসায় আসল। তার কিন্তু ভয় করছে না। জীবনে কিছু মানুষকে কখনো ভয় করে না। বিমুগ্ধ তার জীবনে এমনই একজন। যাকে একনজরে সে প্রচন্ড বিশ্বাস করে। দরজা খুলল যে মানুষটা তাকে দেখে নীহারিকা আকাশ থেকে পড়ল। ভিতরে প্রবেশ করে সে ডেকুরেশন দেখে যতটা না বিস্ময় হয়েছে তার থেকে বেশি বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেছে সোফার উপরে বসে থাকা মানুষগুলোতে দেখে। তার চোখ বড় হয়ে বেরিয়ে আসবে যেন। আতঙ্কিত চোখে সে বিমুগ্ধের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠে বলল,’ এসব কি?
____________
চলবে………….
ভুলত্রুটি আল্লাহর দেওয়া মহান গুন ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টি দিয়ে দেখবেন। নিশ্চুয়ই ক্ষমা একটি সুন্দর গুন।
@হাফসা_আলম