প্রিয় সুখ পর্ব-৩৭

0
63

প্রিয় সুখ-৩৭
হাফসা আলম
______________
মানব জীবন আশ্চর্যজনক। কখন সুখ তো কখন দুঃখ। অদ্ভুৎ এই জগতে মানুষ নিজেদের সব সময় সুখি দেখতে পছন্দ করে। ভালো, আনন্দের জীবন সকলের স্বপ্ন। দুঃখ যেন ছুঁয়ে না দেয় তাদের। সকল প্রার্থনায় থাকে সুখ। কেউ কি কখনো দুঃখকে প্রার্থনায় রেখেছে? না। কারণ মানব মন সুখ, দুঃখকে অন্যরকম সমীকরণে বেঁধেছে। তাদের কাছে দুঃখ মানে কষ্ট। সুখ মানে আনন্দ। কষ্ট কেউ উপভোগ করে না। ভোগ করে। যা কেউ চায় না। ব্যালকনিতে বসে আকাশ দেখছিলো বিমুগ্ধ। কফির কাপটি পড়ে আছে অযত্নে। ঠান্ডা আস্তরণ পরছে ধীরে ধীরে। টি টেবিলের উপরে খোলা বিখ্যাত সাইকোলজি বুক। মানব মন নিয়ে বিখ্যাত সব গবেষণার কথা লিখা। পড়তে পড়তে বিমুগ্ধ নিজের মনের ভিতরে প্রবেশ করে ফেলেছে। মন নিয়ে তার তেমন মাথা ব্যথা ছিলো না কখনো। সব সময়ের ধারণা সে খুব সহজে মানুষকে পড়তে পারে। অথচ জায়গা মত এসে ধরা খেয়ে বসে আছে। জীবনের একটি অধ্যায় সে কখনো সম্পূর্ণ করতে পারবে না। তার মন বুঝতে পারবে না। তার চিন্তাচেতনা বুঝতে পারবে না। সম্পূর্ণ তাকেই সে কখনো বুঝতে পারবে না। কারণ সে বুঝতে চায় না। এটি একটি করুন ব্যথা। তাকে খনে খনে মিষ্টি বেদনাদায়ক আনন্দ দেয়। বিমুগ্ধের কাছে সুখ কি? সবার কাছে যা তার কাছেও সুখ মানে আনন্দ। কিন্তু প্রিয় সুখ সকলের কাছে ভিন্ন ভিন্ন। প্রিয় জিনিসটি সবার দৃষ্টিতে এক নয়। এই অনুভূতি সম্পূর্ণ অন্যরকম। নীহারিকা নামক সেই নারী বিমুগ্ধের জীবনে প্রিয় সুখ। সকল সুখের মাঝে প্রিয় সেই সুখ। সমুদয় অনুভূতির রাজা সেই উপলব্ধি। যাকে পাওয়া সহজে সম্ভব নয়। না পেয়েও শান্তি মিলছে না। ভালোবাসাগুলো এত অন্যরকম কেনো? কেনো ভালোবাসার পিছনে ছুটতে ছুটতে মানুষ হাপিয়ে উঠে না? এক ঝলকের এই প্রেমের জন্য মানব মন কত মরিয়া, উম্মাদ! বিমুগ্ধ কি তাদের দলের?
নবীন উদ্দিন এসে বসেছে তার পাশে। ধ্যান মগ্নের মত ছেলেকে চুপ করে থাকতে দেখে গলা পরিষ্কার করে বললেন,’ কি হয়েছে তোমার?’
ঝুম করে বৃষ্টি নামার মত বিমুগ্ধও বাস্তব জগতে নেমে এসে বলল,’ কিছু হয়নি। তবে হবে।’
‘ আমি জানতাম তুমি নীহারিকার কাছে প্রত্যাখ্যান হবা। বাবার বাধ্য মেয়ে। তোমার মত নয়। তোমাকে তার পাশে ভালো লাগে না।’
‘ কার পাশে কাকে ভালো লাগে সেটা সময় বলে দিবে। আপনি মেইন ট্রাম্প কার্ড বের করবেন এবার।’
‘ অসম্ভব। এসব বলার জন্য ডেকেছ?’
‘ আব্বি আপনি কি বুঝতে পারছেন না আপনার ছেলের বয়স হয়েছে। বিয়ে করতে হবে না।’
বিমুগ্ধ হাসছে। নবীন সাহেব খুব বিরক্ত হলেন। উঠে চলে যেতে নিয়ে আবার বসে বললেন,’ স্বপ্ন দেখা ভালো। নাফিস তোমার স্বপ্নেও এটা হতে দিবে না। জাওয়াদের কাছেই মেয়ে বিয়ে দিবে।’
‘ আপনি আবার ওই ছেলের নাম নিয়েছেন? ওকে কিন্তু আমি সত্যি খু/ন করব।’
‘ তার দরকার নেই। সে নীহারিকা জপ করতে করতে মরে যাবে। বেঁচারা খুব ভালোবাসে মেয়েটিকে। ওর জন্য নীহারিকা পারফেক্ট। আমার প্রেমিক মন বলছে তারা ভালো থাকবে।’
বিমুগ্ধ চমৎকার চোখে তাকিয়ে নিজের বাবাকে হঠাৎ জড়িয়ে ধরে বলল,’ আমার কাছে আরও ভালো থাকবে আব্বি। তাকে যে আমার শেষ নিঃশ্বাসে চাই। প্লিজ আব্বি।’
নবীন সাহেব সিরিয়াস হয়ে গেলেন। ছেলেকে জড়িয়ে ধরে ভাবছেন তার ছেলে তো এমন নয়। কিন্তু বিগত দুই মাস ধরে তিনি দেখেছেন তার পরিবর্তন। তার হাসি হারিয়ে গেছে। তার আনন্দিত সেই চোখ বিলুপ্ত প্রায়। কেনো সে বাচ্চাদের মত করছে। নীহারিকা কি সত্যি জাদু করেছে তার ছেলেকে? সেই ভয়ংকর জাদু! যা সকল বুদ্ধিদীপ্ত, জ্ঞানী, পূর্ণবিকশিত মানুষকেও অবুঝ, বোকা, অন্ধে পরিণত করে দেয়? অনুরক্তির সেই ছোঁয়া বিমুগ্ধের পরিপক্ক হৃদয়কে তীরের তীক্ষ্ন ফলায় ক্ষতবিক্ষত করেছে কখন? কিভাবে? কেন? নবীন তো যানে কতটা যন্ত্রণা সেই ব্যথায়।
ছেলের গায়ে আদুরে হাত বুলিয়ে তিনি বললেন,’ আমি কথা বলবো।’
‘ বললে হবে না আব্বি। আপনি এমন কিছু করুন যেন সে শুধু আমার হয়ে থাকে। শুধু আমার। আমার বাগানের সৌন্দর্য্য হবে সে। আমার হৃদয়ের সম্রাজ্ঞী। আমার ঘরের সুভাষিণী।’
নবীন ছেলের সেই চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। অনেক সময়। অনেকক্ষণ। চলে যাওয়ার আগে শুধু বলল,’ ভালোবাসা যেন শান্তির বার্তা হয় মাই বয়।’
বিমুগ্ধ বিছানায় উপুর হয়ে শুয়ে বিড়বিড় করে বলল,’ আমার জন্য সে শান্তি, স্বস্তি, খুশি, আনন্দ। সে আমার জীবনের সেই প্রিয় সুখ যাকে পেলে আমার জীবন স্বপ্নের নীল আকাশের মত সুন্দর হয়ে যাবে আব্বি।’
_____________
সকাল সাতটা।
মাঘের গায়ে শীত লেগেছে।
ছড়িয়েছে আকাশে কুয়াশা।
দূর দূর থেকে ঠান্ডা আসছে ভাসিয়া ভাসিয়া।
বাসার সামনের একটি শিরীষ গাছ। সাধারণত বসন্ত থেকে গ্রীস্ম কালে এই গাছে ফুল ফুটে। কিন্তু আশ্চর্য চরম আশ্চর্যের বিষয় এই গাছটিতে সারা বছর রানী গোলাপির সাথে হালকা গোলাপি রঙ্গে ভরা রেশমের মত নরম পাঁপড়ি যুক্ত ফুল ফুটে। এই বিরল দৃশ্য পৃথিবীর আর কোথাও হয় কি না বলা যাচ্ছে না। শীতের কুয়াশার চাদর গায়ে দিয়ে দুলে দুলে উঠছে সৃষ্টিকড়াই গাছের ফুলগুলো। সাদার সাথে গোলাপি মিশে কি চমৎকার দৃশ্য। নীহারিকা জানালার উপরে বসে নিচে পা ঝুলিয়ে দিল। তার গায়ে একটি ধূসর রঙ্গের উপরে লাল লাল ছিটে ফুলের চাদর। হাত গুলো বাহিরে। রক্তজমা হাতের তালু সাদা হয়ে আছে বরফে জমে। পা ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে সে গুন গুন করে একটি কবিতা তৈরি করেছে। হাস্য কর মনে হতেই মুখ গম্ভীর করে বসল। পাশে রাখা চায়ের কাপে বাতাস জমছে একটু একটু করে। কম্পিত হচ্ছে চা। নীহারিকা হাত পিছনে দিয়ে পা ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে ভাবছে আজ থেকে অনেক বছর পূর্বে সে জানালাটার দারুন একটি ব্যবহার করেছিল। বুদ্ধি করে বাবাকে দিয়ে খুলিয়ে ছিল। লাল টকটকে বেনারসি ঝুলিয়ে পালিয়ে ছিল এক অন্যরকম দুনিয়ায়। সেই দুনিয়ায় তার সাথে পাগল রাজকুমারের দেখা হলো। অদ্ভুত উম্মাদময় তার আচরণ চমকে দিয়েছিল তাকে। অস্তিত্বে নিয়ে এসেছিল বসন্ত। একটি রাত সে অচেনা মানুষের পাশে দাড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে তার হৃদয় হোঁচট খেয়ে পড়ল। মুখ থুপড়ে। নীহারিকা পা একদম সরু করে নিল। বিমুগ্ধের সাথে তার দেখা হয় না দু’ মাসেরও বেশি সময়। সে কয়েকবার তার রেস্টুরেন্ট হসপিটালে চক্কর কেটেছে। মানুষটা কেমন গায়েব হয়ে গেল। কেন? নীহারিকা জানে কেন। তবুও প্রশ্ন করে। বার বার করে। ইশ বিমুগ্ধ যদি মানুষের মন পড়তে না পাড়ত! তার অনুমান ক্ষমতা প্রবল না হতো! তাহলে তো কোন দোষের কিছু ছিল না। নীহারিকা তো সত্যি তাকে ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিল। অথচ সে শেষ করতে পারল না। কথার মাঝেই বিমুগ্ধ বুঝে নিল। মানুষটা কি একটু বেশিই অসাধারণ? কেন?
কোলাহল ধ্যান ভাঙ্গল নীহারিকার। তার ক্লান্ত মন। সতেজ সকাল। প্রতিদিনের এক কাপ সকালের চা। শুভ্র অনুভূতি। পুরোনো স্মৃতি। মলিন মুখ। আর একটু একটু জমানো গোপন ভালোবাসা।
কেউ চিৎকার করছে। নীহারিকা দ্রুত নামতে গিয়ে কাপ ফেলে দিয়েছে। আজ সে প্রায় অনেক দিন পরে নিজের রুমে এসেছে। জীবনে প্রথম সে নিজের জিনিসকে নিজের মনে করছে না। এটি তো বিমুগ্ধের রুম। এই বিছানা দেয়ালে দেয়ালে, আলমারির কাবার্ডে তার গায়ের গন্ধ, স্মৃতির আনন্দ, হাসির রেশ মাখানো আছে। এসব ছুঁয়ে দিয়ে সে মুছে দিতে চায় না। নিচে নেমে নীহারিকা প্রথমেই চমকালো। এই মেয়ে কে? অনেক দিন পরে বাড়িতে নতুন কেউ এসেছে। নীহারিকা দেখল কাঁধের উপরে করে কাঁটা চুল। হাঁটু পর্যন্ত সাদা গোলাপী ফ্রগ। পায়ে একটি সাদা ক্যাডস। গোলাপ সুন্দর একটি মেয়ে। কি করছে তাদের বাড়িতে? মেয়েটি মিষ্টি করে হেসে বলল,’ নীহারিকা আপু আপনি তো সত্যি খুব সুন্দর।’
নীহারিকা অপ্রস্তুত হাসল। মেয়েটি প্রচুর কথা বলে মনে হয়। সে এগিয়ে এসে হুট করে জড়িয়েও ধরল। গাল টেনে দিয়ে বলল,’ আপনার রাগ না কি অনেক বেশি? আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। আপনি তো অনেক সুন্দর। আল্লাহ এতো মায়া কেনো? আপনি কি আমার থেকেও সুন্দর! দেখুন তো?’
মেয়েটি হাত বাড়িয়ে দিল। নীহারিকা কিছুই বুঝতে পারল না। তার মা মুখ গম্ভীর করে দাঁড়িয়ে। নিশ্চয় গন্ডগল আছে।
‘ কে আপনি?’
‘ আপনি বলছেন কেন? আমি তো আপনার ছোট। প্রিয়মের সাথে পড়ি।’
‘ ওর ফ্রেন্ড?’
‘ আরে ধুর এই ছেলের বুন্ধ কে হয়। আমি তো ওর বউ হবো।’
ব্যস নীহারিকার কাশতে কাশতে শ্বাস টান শুরু হয়ে গেল। সে সোফার গায়ে হেলান দিয়ে বসল। মেয়েটি এমন ভাবে গ্লাস এগিয়ে দিল মনে হচ্ছে এটা তার বাসা। নীহারিকা অতিথি। মায়ের দিকে আড়চোখে তাকাল সে। আগুন গরম চোখে তিনি তাকিয়ে আছে। মনে মনে নীহারিকা দোয়া করল প্রিয়ম যেন না আসে। ভুলেও না। সে সকাল সকাল একটা বাচ্চাকে পড়াতে গেছে। সাতটা থেকে পড়ানোর কথা। মা আজকে অবস্থা খারাপ করে দিবে।
‘ তোমার নাম কি?’
‘ আমার নাম রৌদ্রমূখী।’ মেয়েটি কেমন লাজুক হাসছে। নীহারিকার মনে হলো আজ মেয়েটির বিয়ে। পাত্রী দেখতে এসেছে সে। তার মা এই বিয়েতে রাজি নয়। ফলস্বরূপ তার বীভৎস চাহনী। পানির গ্লাস টেবিলে রেখে শান্ত চোখে তাকাল নীহারিকা। মেয়েটি নিঃসন্দেহে সুন্দর। তার ছোট ভাই প্রেম করছে? কি যুগ এসেছে ছোট বড় কোন লেভেল নাই। সবকটা প্রেমে পাগল হয়ে যাচ্ছে। প্রেম করা কি খুব সহজ? একটা করে দেখলে বুঝা যেত। আজকে আফসোস হচ্ছে। ইশ কেন করল না। এসব যুগ তো সে পার করে এসেছে। মেয়েটি পাশে বসে পড়ল। খুবই অমায়িক হাসল। হাসির কথা থেকে নীহারিকার বিমুগ্ধের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। লোকটি তার জীবনে অসুখ হয়ে নেমেছে। উঠতে বসতে তার কথা মনে পড়ছে। যেন তাকে বিহিন প্রিয় বলতে কিছু নেই। ছাদ, বারান্দা, সামনের গাছপালা সব জায়গায় মনে হয় মানুষটা বসে আছে। দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে তার অদ্ভুত পোশাক। একদিন নীহারিকা দেখল একটি কমলা গেঞ্জির উপরে সে দু’ টি শার্ট পড়ে দাড়িয়ে আছে। একটির রং সাদা, অন্যটির রং নীল। সে বাস্তব ভেবেছিল। কিন্তু যখন নিচে আসল দেখল না এটা ভ্রম মাত্র।
‘ কোথায় হারিয়ে গেলেন?’ রৌদ্রমূখী ঝাকিয়ে দিল নীহারিকাকে। মুখ কুঁচকে সে বলল,’ তুমি কি চাইছ বলো তো?’
‘ এই তো আপনি রেগে গেলেন। সত্যি আপনার রাগ দ্রুত উঠে। মেহমানদের সাথে কেউ এমন ব্যবহার করে? চা কফিও অফার করল না কেউ। কাহিনী কি বলুন তো?’
নীহারিকা লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে বলল,’ তোমাকে দেখে আমার মা খুশি হতে পারছে না। তাই কিছু অফার করছে না। তুমি কি বলবে কেন এসেছ?’
মেয়েটি উঠে দাড়িয়ে গেল। সোজা মায়ের সামনে গিয়ে বলল,’ আন্টি আপনার কি শাড়ি আছে? আমার শাড়ি পড়তে ইচ্ছে করছে।’
মা মুখ থমথমে করে বলল,’ আছে।’
‘ চলুন পড়ে আসি।’
নীহারিকাকে অবাক করে দিয়ে তার মা মেয়েটিকে নিয়ে গেল। এবং দশমিনিট পড়েই একটি সুন্দর মেরুন শাড়ি পড়িয়ে নিয়ে আসল। মুখের ভাব এখনও মায়ের থমথমে। তিনি গুমুট মেরে আছে। মনে হচ্ছে ছেলে সত্যি বিয়ে করে নিয়েছে। মেয়েটির দিকে তাকিয়ে চমকে গেল নীহারিকা। কি অসাধারণ লাগছে। কাঁধ সমান চুল। সাদা গায়ে মেরুন রঙ্গ এটেশেটে আছে। পরিপাটি চলা ফেরা। হাঁটার ভঙ্গী। এতো পারফেক্ট একটা মেয়ে এই বাসায় মানায় না। ভুলেও না। মেয়েটি নীহারিকার সামনে এসে বলল,’ চুল গুলো আগে দেখুন।’
‘ কেন?’ অবাক হয়ে জানতে চাইল নীহারিকা।
‘ মেয়েদের দেখতে গেলে তো এসবই দেখে। আপনি জানেন না?’
‘ না জানি না। আমাকে কেউ দেখতে আসেনি। আসলেও কখনো এমন অদ্ভুৎ কিছু করতে বলবে না।’
‘ বলবে কিভাবে? আপনাকে দেখেই সবাই ফিদা। আপনার মডেলিং করা উচিৎ।’
‘ আস্তাগফিরুল্লাহ্। এই মেয়ে আমার মেয়ের মাথায় ফালতু জিনিস ঢুকাবে না।’ আফিয়ার রাগান্বীত কণ্ঠস্বর।
‘ ফালতু বলছেন কেন? আমি তো একজন মডেল।’
নীহারিকা মাথায় হাত দিয়ে বসে রইল। এতো আরও সাঙ্ঘাতিক ঘটনা। মডেল? এমন একটা মেয়েকে কিভাবে প্রিয়ম খুঁজে বের করল? মেয়ের কি অভাব পড়েছে? মায়ের চোখ বড় বড় হয়ে আছে। আজকে প্রিয়মের যে কি হবে আল্লাহ ভালো জানে।
‘ তুমি আসলে কি করতে এসেছ বলো তো?’
মেয়েটি খুশিতে বাকবাকুম হয়ে বলল,’ বিয়ে করতে। আপনার ভাই আপনাকে প্রচন্ড ভালোবাসে। তার সব পোশাক না কি আপনিই পছন্দ করেন। আপনার পছন্দ হলে তারও পছন্দ হবে। আর আপনারা তো আমাদের বাসায় গিয়ে আমাকে দেখবেন না। তাই আমি চলে এসেছি নিজেকে ইন্ট্রোডিউস করাতে। আমার নাম রৌদ্রমূখী রহমান। বাবা একজন বিজনেসম্যান। মা একজন টিচার। ভিকারুননিসার। আমার কোন ভাই বোন নেই। আমি একমাত্র ওয়ান পিস। টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছি আপনার ভাইয়ের সাথে। প্রথম বর্ষ শেষ করে দ্বিতীয়তে উঠেছি। মডেলিং করা সখ। তাই ছোট থেকে আমি বিভিন্ন ফটোশুট করে থাকি। আপনি আমাকে দেখেছেন। এই যে আপনাদের বাসার পত্রিকায় ছাপানো হয়েছে। এটা কয়েকদিন আগের। দেখুন।’
পত্রিকা টেবিল থেকে তুলে মেয়েটি খুলে দিল। নীহারিকা অবাক হয়ে গেল। হ্যাঁ এই মেয়েকে তো সে দেখেছে। সুন্দর করে একটি হাতা কাঁটা লাল ব্লাউজের সাথে সাদা নকশি করা শাড়ি পড়েছে। তার উপরে অর্ধ লাল ব্লেজার ঝুলছে এক পাশে। মেয়েটির ঠোঁটে হাসি মৃদূ। মুখ ভর্তি আধুনিকতা। এই মেয়ে তাদের কাছে আসল কেন? মাথা কি পাগল টাগল হয়ে গেল না কি?
‘ তোমার সমস্যা আমি এখনো বুঝতে পারছি না। প্রিয়মের সাথে কি তোমার রিলেশন আছে?’
মেয়েটি চেয়ার টেনে নিয়ে আসল। তার কর্মকান্ড হতবাক করে তুলছে নীহারিকা সহ তার মাকে। মনে হচ্ছে তার বাড়ি। বাসায় এখনো বাবা বা দাদামোশাই উঠেনি। আজ বিশেষ কারণে অফিস বন্ধ।
‘ আপনার ভাইকে আমার পছন্দ। এখন তার কাছে গিয়ে বললাম কথাটা। সে রিলেশন টিলেশন করবে না। ভাবলাম আমার মত এতো ভালো মেয়েকে বেচারার কপাল থেকে তুলে নিলে তো হবে না। তাই আমি চলে আসলাম পরিবারের সাথে কথা বলতে। প্রেম হারাম বিয়ে তো হালাল তাই না।’
‘ তুমি আর সে ক্লাসমিট। লেখাপড়া শেষ হয়নি। বিয়ে বিয়ে করে নাচতেছ কেন?’ আফিয়া বিলকিসের গঠিন গলা। নীহারিকা মাঝে প্রতিরোধ তুলে বলল,’ তোমার বাবা মা কোথায়?’ রোদ্রমূখী কিছু বলতে চাইল তার আগে প্রিয়ম ঘরে ঢুকল। এক ঘন্টা কি শেষ! সর্বনাশ! প্রিয়ম প্রথমেই টাশকি খেয়ে দরজার একটু ভেতরে দাড়িয়ে গেল। শুরুতে কিছুক্ষণ দেখেই তার মেজাজ খারাপ। অসভ্য এই মেয়ে এখানে কি করছে? শাড়ি পড়ে রঙ্গঢংও করছে দেখি। সে রাগে গজ গজ করে বলল,’ এই বেয়াদপ তুই এখানে কি করছিস?’
রৌদ্রমূখী ইনোসেন্ট মুখ করে নীহারিকার একদম গা ঘেষে লুকিয়ে পড়ল। গলা একটু বাড়িয়ে বলল,’ আমাকে আপনি বাচাবেন তো? আপনার ভাই রাক্ষস।’
নীহারিকার মুখ হা হয়ে আছে। প্রিয়ম কাছে আসতে মেয়েটি সাপের মত প্যাচিয়ে ধরল নীহারিকাকে। দম বন্ধ হয়ে লাল হয়ে গেল সে। প্রিয়ম এই দৃশ্য দেখে এক ধমক দিয়ে বলল,’ এই মেয়ে ওকে ছাড়।’
‘ তুই চিৎকার করছিস কেন? তোর বাসায় একটু বেড়াতে আসলাম। আসসালামু আলাইকুম আন্টি। ভালো আছেন?’
আফিয়া বিলকিস ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে আছে। মেয়েটি সুর পাল্টে নিল! সে যে এতক্ষণ বিয়ে বিয়ে করে নাচানাচি করছিল তা কি?
‘ তুই এসেছিস আমার বাসায় বেড়াতে? আমার বাসা ধর্মশালা মনে হয়? না কি টুরিস্ট স্পট? অপরিচিত মানুষের বাসায় আসতে নেই জানিস না?’
‘ আরে তুই তো আমার ক্লাসমিট।’
‘ তোকে আমি থাপড়ে সোজা করে দিব। আমার বোনকে ছাড়।’
‘ না ছাড়ব না। উনি এখন আমারও বোন। কেমন আছেন আপু? আপনি খুব শুকিয়ে গেছেন। খাওয়া দাওয়া করেন না?’
নীহারিকা হেসে ফেলল। তার হাসি দেখে অবাক হয়ে গেল মেয়েটি। চোখ বিস্ময়ে অভিভূত করে বলল,’ এতো সুন্দর হাসি! আল্লাহ আমি ক্রাশিত।’
‘ তাহলে তুই কি ভেবেছিস তোর মত ভুতুম প্যাঁচা হবে? আমার বোন মহা সুন্দরী আমি জানি। এবার ওকে ছাড় আর কি কাজে এসেছিস বল?’
‘ এই মেয়ে তোকে বিয়ে করতে এসেছে?’ আফিয়া ছেলের দিকে তাকিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল। প্রিয়ম আকাশ থেকে পড়ল এমন চোখমুখ নিয়ে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। স্তব্ধ সে। ছুঁটে এসে নীহারিকার সামনে দাড়িয়ে বলল,’ আপু ধাক্কা মেরে বের কর এই বেয়াদপ কে। কত বড় অসভ্য! এই বের হ। গেট আউট। যা এখান থেকে। আউট।’ রৌদ্রমূখী বাচ্চাদের মত ঠোঁট উল্টে নিল। নীহারিকা প্রিয়মের দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে বলল,’ সুন্দর করে কথা বল প্রিয়ম। বাবা বাসায় আছে।’
কথাটা শেষ করতেই গম্ভীর গলা পাওয়া গলে। সবাই পিছনে ঘুরে দেখল নাফিস উদ্দীন দাড়িয়ে আছে। তার চোখ মুখ উগ্র। নিশ্চয়ই আগে এসেছে। তিনি আসতেই রৌদ্রমূখী তার কাছে গিয়ে বলল,’ আসসালামুয়ালাইকুম আঙ্কেল। ভালো আছেন।’
‘ ওয়ালাইকুম আসসালাম। তুমি কে? এখানে কিসের বিয়ের কথা হচ্ছে? প্রিয়ম চিৎকার করছ কেন অভদ্রের মত?’
রৌদ্রমূখী ভয়াবহ অভিনয় করতে পারে। নীহারিকা সহ সকলে থ হয়ে গেল। কাঁদো কাঁদো মুখ করে সে বলল,’ আপনার ছেলেকে বিয়ে করতে চাই আঙ্কেল। কিন্তু আমাকে বের করে দিচ্ছে।’
বাবাকে বলছে বিয়ে করতে চাই? প্রিয়মের ঘাম জমে গেল কপালে। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। এই মেয়ে নিশ্চয়ই কোন মতলবে এসেছে। নাফিস উদ্দীন থমথমে গলায় বললেন,’ ফাজলামি করছ তুমি?’
‘ আচ্ছা বিয়ের কথা বললেই কেন আপনাদের মনে হয় ফাইজলামি করছি? দেখুন প্রেম হারাম বিয়ে তো নয়। তাহলে বিয়ের কথা শুনলে এতো বড় হা করে ফেলেন কেন আঙ্কেল। এই আপনাদের মত বাবা মা বিয়ে বিষয়কে কঠিন করে দিয়েছেন আঙ্কেল। তাই তো ছেলেমেয়ে প্রেম করছে অহর অহর। দুঃখ। ইশ আফসসো।’
রৌদ্রমূখী অভিনয় জগৎ থেকে এসেছে। নীহারিকা বুঝতে পারছে। কঠিন ভাবে পারছে। এই মেয়ে বাবাকে চেতিয়ে দিচ্ছে। নাফিস উদ্দীন চোখ বড় করলেন। তার আগ্রহের সাথে আশ্চর্য দৃষ্টি। কথা তো সত্য। ছেলের দিকে একবার তাকাল তিনি। প্রিয়মের গলা কাঁটা মুগরীর মত অবস্থা।
‘ আচ্ছা। বিয়ে করতে চাইছ ভালো। আমি সাপোর্ট করছি। কিন্তু এই সমাজের কিছু নিয়ম আছে। মেয়েরা ছেলেদের বাড়ি বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে আসে না। ছেলেরা যায়। তুমি একা এসেছ?’
রৌদ্রমূখী প্রচন্ড কনফিডেন্সের সাথে বলল,’ জি। আঙ্কেল সমাজের নিয়ম ভেঙ্গেছেন কখনো?’
‘ প্রতিদিন ভাঙ্গী।’
‘ মজা আছে না? এই সমাজের নিয়ম ভাঙ্গতে আমার মজা লাগে। তাই ভেঙ্গে দিলাম। ভালো করলাম না প্রিয়ম।’ রৌদ্রমূখী প্রিয়মের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপ মারল। আফিয়া এই দৃশ্য দেখে বিষম খেল। কি সাঙ্ঘাতিক মেয়ে। এই মেয়েকে মরে গেলেও তিনি বউ করবেন না। কখনো না। আবার না কি মডেলিংও করে। তার ছেলের চোখে মেয়ে পড়েনি? নাফিস উদ্দীন সোফায় বসলেন। তার পিছন পিছনে এসে রৌদ্রমূখী দাড়িয়ে রইল। যেন সত্যি আজ সে বিয়ে করবে। করবেই। নাফিস উদ্দীন অনেক সময় চুপ থেকে বলল,’ বিষয় খুলে বলো।’
রৌদ্রমুখীর বিষয় বস্তু শুনে প্রিয়ম বাবার অনুমতি ছাড়াই সোফায় বসে পড়ল। এতো মিথ্যা কথা এই মেয়ে কিভাবে বলতে পারে? হায় আল্লাহ। নীহারিকাকে ফিসফিস করে বলল,’ আপু বিশ্বাস কর এই মাইয়া ডাহা মিথ্যা কথা বলতাছে।’
‘ করতে পারছি না।’ নীহারিকা চোখ উল্টে নিল। প্রিয়ম হতাশ গলায় বলল,’ সত্যি বিশ্বাস করছিস না?’
‘ না করছি না। তুই চুপ থাক। মেয়েটি ইন্টারেস্টিং খুব।’
‘ এই মাইয়া আস্ত পাগল আপু। যা বলতাছে সব মিথ্যা। পাই পাই মিথ্যা। শালিরে যদি আমি এর শাস্তি না দি নাম পাল্টাই ফেলমু।’
‘ তুই চুপ কর।’
‘ তোমার বাবা মায়ের নাম্বার দেও। আমি কথা বলব।’ নাফিস উদ্দীনের শক্ত কন্ঠ। রৌদ্রমূখী খুক খুক করে কাশতে লাগল। নীহারিকা গোপনে হাসল। রৌদ্রমূখী করুন চোখে তাকিয়ে বলল,’ তাদের কি কাজ আঙ্কেল?’
‘ গার্ডিয়ান ছাড়া আমাদের ধর্মে বিয়ের নিয়ম নেই। ফোন নাম্বার দেও। দ্রুত।’ রৌদ্রমূখী ভয় পেয়ে গেল। নাম্বারও দিয়ে দিল। প্রিয়ম হুলুস্থর রেগে বলল,’ বাবা তুমি এই বেয়াদপ মেয়ের কথায় চলে আসতে পারো না? আমি মরে গেলেও এই মেয়েকে বিয়ে করব না।’
‘ তোমাকে তো কেউ বিয়ে করতে বলছে না। তোমাকে তো বাসায় মেয়ের হেটে আসার ব্যবস্থা করতে বলেছি তাই না? একজন মেয়ে বাসায় তোমাকে বিয়ে করার কথা বলতে আসে কিভাবে? ফাইজলামি করো তোমরা? এত সহস?’ সবাই ভয়ে চুপ হয়ে গেল। রৌদ্রমূখী এবার গুরুতর ভয় পেয়েছে। কি রাগ! তাকে কেউ কখনো এভাবে চিৎকার করে কিছু বলেনি। নাফিস উদ্দীন ফোন করে শুরুতেই বললেন,’ আপনার মেয়ে বিয়ে করতে চাইছে। ছেলের বাসায় এসে নিজেকে ইন্ট্রোডিউস করাচ্ছে। আপনি কি আমাদের বাসায় আসতে পারবেন? এড্রেস লেখুন?’
ভদ্রলোক থতমত খেয়ে বললেন,’ কে আপনি?’
‘ ছেলের বাবা। যার বেকার ছেলেকে বিয়ে করার জন্য সাত সকালে এসে হাজির হয়েছে আপনার কন্যা।’
নীহারিকা বুঝতে পারছে তার বাবা রেগে আছে। সে আরও চুপ করে রইল। তা না হলে একটু সুপারিশের ব্যবস্থা করত। প্রিয়ম বাবার সামনে থেকে রৌদ্রমূখীর হাত টেনে পিছনে নিয়ে এসে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,’ এসব কি? তুই এখানে মুলত এসেছিস কেন?’
‘ এটা প্রাঙ্ক ছিল ইয়ার।’ মুখ নিচু করে বলল সে। প্রিয়মের মুখ থেকে কোন কথাই বের হলো না। সে তাকিয়ে রইল। চোয়াল শক্ত করে। সে জানত এই মেয়ে এসবই করে বেড়ায়। আজ দেখেও নিলো। মেজাজ এতো খারাপ হলো যে তার ইচ্ছে করছে একটা চড় বসিয়ে দিতে। সে দিতেও নিয়েছে। নাফিস উদ্দীন কটমট চোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে আছে। প্রিয়ম বলল,’ আজকে যদি তোর জন্য উল্টোপাল্টা কিছু হয় তোরে আমি খু/ন করে দিমু বলে রাখছি। এই আমি কি তোর ফ্রেন্ড লাগি? পরিচিত কেউ হই? প্রাঙ্ক করলি কোন সাহসে?’
‘ আমরা অবশ্যয় ফ্রেন্ড। আর তুই এতো রেগে যাচ্ছিস কেন? এটা সামান্য একটা বিষয়। আমাকে মাহি এই কাজ করতে বলেছে। দশ হাজার টাকা ডিল হয়েছে। পাঁচ আমি তোরে দিয়ে দিমু নে। এখন এতো বকাঝকা করবি না। চিল ব্রো।’ রৌদ্রমূখী মিষ্টি করে হাসল। তার সেই হাসিতে গা জ্বলে উঠল প্রিয়মের। সে একটা গালি দিয়ে বলল,’ কু/ত্তা আমি তোর ফ্রেন্ড না। আমরা ক্লাসমিট মাত্র। আর তুই আমাকে ডিস্টার্ব করা পার্সোন।’
‘ তোকে আমি ডিস্টার্ব করি?’
‘ এখন কি করতাছিস? ধুর বা/ল তোর জন্য আজকে বাবার কাছে আমি কালার। তোরে যদি আমি..।’
প্রিয়ম কথা শেষ করতে পারল না। বাবা এসে বললেন,’ তোমার মা বাবা আসছে। কথা বলে জানাচ্ছি বিয়ে হবে কখন।’
‘ মানে কি?’ দু’ জনেই এক সাথে চিৎকার করে উঠল। নাফিস উদ্দিন চোখ ছোট করে বলল,’ তুমিই তো বিয়ে করতে চেয়েছ? আর আমরা না কি বিষয়টাকে কঠিন করে তুলছি। তাই আমি ভাবলাম সহজ করা যাক। শুরুটা আমার থেকেই হোক। বাবা মায়ের ছেলে মেয়েদের বিয়ে বিষয়ে সচেতন হওয়া উচিৎ। আফিয়া আমার রুমে আসো।’
মা রাগে গজ গজ করতে করতে চলে গেল। প্রিয়ম ঠাস করে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিল গালে। সাদা গাল লাল হয়ে গেল। রৌদ্রমূখী যেন লোহার তৈরি। মেয়েটার রাগ কম। আচরণ এলোমেলো। কোন কিছুতেই তার কিছু যায় আসে না। ডোন্ট কেয়ার ব্যাপার স্যাপার। সে গাল ঘোষে বলল,’ থাপড়াবিনা বলে দিলাম। আমি মডেলিং করি। গালের কিছু হলে সর্বনাশ।’
‘ তোর এই গাল ছিঁ/ড়ে দিব হারামি। বিয়ে খাওয়ামু তোরে। কে বলছে এতো রঙ্গতামাশা করতে? তাও এতো সকালে? এখন যদি কাহিনী ভয়াবহ হয় তোরে আমি কি করমু আমি জানি না।’
রৌদমিলা মিষ্টি হেসে বলল,’ মাহি বলছে। দশ হাজার টাকা দোস্ত!’
‘ আমি তোর কোন জনমের দোস্ত? তোর সাথে আমি কোনদিন সেভাবে কথা বলেছি? তুই আমারে ক্যান ফাঁসাইলি?’
‘ আরে তুই সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছিস কেন?’
‘ তোর বাবা মা আসছে। আমার বাবা খুবই সিরিয়াস। আর তুই বলছিস সিরিয়াস হবো না?’ প্রিয়ম বোনের দিকে তাকাল। তার বোনও তাকে বিশ্বাস করছে না। আজব দুনিয়া। ভালো মানুষের কি কোন দাম নেই? এদের মানুষ এপ্রিল ফুল, প্রাঙ্ক, মজা এসবের জন্য ইউজ করে? দুঃখ ভরাক্রান্ত হৃদয়ে প্রিয়ম গালি দিচ্ছে। রৌদ্রমূখী আরও একটু হাসি বাড়িয়ে শক্ত বাহুতে থাপড়ে থাপড়ে বলল,’ এতো সিরিয়াস হয়ে কাজ নেই। বিয়ে হবে না দেখিস। আরে বিয়ে এতো সহজ? তুই জীবনে দেখেছিস বাবা মায়েদের মত হিটলার জাতি এতো সহজে এক বলায় বিয়ে করিয়ে দিবে ছেলে মেয়েকে? তার উপরে যারা প্রতিষ্ঠিতই না। এতো ছোট বয়সে বিয়ে করানোর নিয়মই তো নেই আমাদের দেশে।’
‘ মেয়েদের আঠারো ছেলেদের একুশ। প্রিয়মের বয়স বাড়াতে হবে মনে হচ্ছে।’ নীহারিকা ফোঁড়ন কাঁটল। প্রিয়ম আসহায়ের মত বলল,’ আপুকে বুঝা। তা না হলে তোরে যে আমি কি করমু আল্লাহ মালুম।’
‘ তোর আপুকে? মিস নীহারিকাকে? রাগেশ্বরীকে? ভাই এটা পারমু না।’ রৌদ্রমূখী চেপে দাঁড়াল। নীহারিকা অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকল। রাগেশ্বরী! কত দিন পড়ে কেউ ডাকল। এটা তো বিমুগ্ধের দেওয়া নাম। কেউ কেন ডাকছে? নীহারিকার রাগ হলো। নাক ফুলে গেল। গাল লাল হয়ে কপালে পড়ল ভাজ। রৌদ্রমূখী এই দৃশ্য দেখে আরও ভয়ে সিটিয়ে গেল। বলল,’ দোস্ত তোর বোনের সত্যি অনেক রাগ। সর ভাই।’
‘ তুই বলবি?’ প্রিয়ম রেগে তেড়ে আসল। রৌদ্রমূখী মহা বিপদে পড়ে গেল। নীহারিকার সামনে এসে বলল,’একটা কথা বলব আপু?’
‘ না বলবে না। আমার শুনতে ইচ্ছে করছে না।’ নীহারিকা টেবিল থেকে নাস্তা উঠিয়ে নিল। রৌদ্রমূখী আরও কাছে গিয়ে বলল,’ একটা কথাই বলব?’ নীহারিকা চোখ গরম করে তাকাতেই সে ঢোক গিয়ে বলল,’ আমি কি নাস্তা পেতে পারি? ক্ষুধা লেগেছে তো তাই। হি হি।’ সে হাসছে পাগলের মত। নীহারিকা মনে মনে হাসল। নিজের হাতের নাস্তা এগিয়ে দিল। প্রিয়ম দেয়ালে বাড়ি দিচ্ছে নিজের মাথা। রৌদ্রমূখী ছুঁটে এসে বলল,’ কি রে তুই শক্ট খেয়ে আবার পাগল টাগল হয়ে গেলি না তো? শুনেছি তোর এক ভাই আছে পাগলের ডাক্তার। নিয়ে যাব?’
সে রুটি মুখে পুরে নিল। আহা কি মজা খেতে। তাদের বাসায় মায়ের হাতের খাবার পাওয়া চাঁদ হাতে পাওয়ার মতই দুষ্কর। প্রিয়মের সাথে ছয় মাসের একটা বিয়ে করলে কেমন হবে? পুরাই বিনোদন পাওয়া যাবে। কি অস্থির পরিবার। গম্ভীর এক বাবা, অতি সিরিয়াস একজন মা, অস্থির সৌন্দর্য্যের সাথে ভয়াবহ রাগী এক বোন। ওহ দারুন তো। সে আরাম করে বসে বসে খাচ্ছে। আর প্রিয়মকে একটু পর পর বলছে,’ কি রে তোর কি সিরিয়াস অবস্থা? হসপিটালে যাবি? আমি নিয়ে যাব?’
প্রিয়ম তেড়ে এসে খাবার প্লেট নিয়ে নিজে পাশে বসে খেতে খেতে বলল,’ আগে খেয়েনি তার পর তোর ব্যবস্থা করতাছি দাড়া।’
দু’ জনের টানা টানি অবস্থা। এক প্লেটে খাচ্ছে। একজন আর একজনকে ইচ্ছা মত মারধরও করছে। রৌদ্রমূখী মেয়েটা রৌদের মত চকচক করছে। মেরুন রং রক্তের মত উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। দক্ষিণের জানালা ভেদ করছে আলো। চোখে মুখে পড়ে তার মুখ বিকৃত করে রেখেছে। দৃশ্যটি সুন্দর তো! ঝগরুটে এক পরিবেশের সাথে অসম্ভব সুন্দর একটি দৃশ্য। নীহারিকার মন বলছে, আত্মা বলছে এখানে একটি সুন্দর প্রেম হবে। অতিশয় এক অবিশ্বাস্য অপ্রতিরোধ্য প্রেমের সূচনা ঘটবে।
____________________
চলবে…
ভুলত্রুটি আল্লাহর দেওয়া সবচেয়ে সুন্দর গুন ক্ষমার চোখে দেখবেন। নিশ্চুয়ই ক্ষমা একটি মহান গুন।