প্রিয় সুখ পর্ব-৩৮

0
39

প্রিয় সুখ-৩৮
(নীহারিকা, বিমুগ্ধ প্রেমিদের জন্য। )
হাফসা আলম
__________
বিমুগ্ধ কচুরিপানার ডোবায় ঢুকেই থমকাল। তার শরীর বেয়ে নেমে গেল এক স্রোত। প্রবল বর্ষণে পাহাড়ের বুক বেয়ে নামে যেমন ঝিরি ঝিরি করে। এই স্রোতের চলন তেমন। বাতাসের মৃদূ শব্দে পাতা নেচে নেচে যে শব্দের সঞ্চার দেয় এই বলন তেমন। সে কিছুক্ষণ দাড়িয়ে রইল দরজার কাছে। তার স্টাফ এ বিষয়ে তেমন মাথা ঘামালো না। এই রেস্তুরার কিছু একচ্ছত্র নিয়ম আছে। তার মাঝের নিয়ম নাম্বার একই হলো
১.বস/ মালিক/ শেয়ারহোল্ডার/ প্রতিষ্ঠাতা/ প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে দেশের কোন উচ্চ পদের মানুষের জন্য বিশেষ ভাবে ব্যস্ত হওয়া যাবে না। প্রধানমন্ত্রীও যদি এসে পড়ে সব থাকবে স্বাভাবিক। বিস্ময় প্রকাশ করা যাবে না। উত্তেজিত হয়ে বাকি কাস্টমারদের দায়িত্বে অবহেলা করা সম্পূর্ণ নিষেধ। অন্যথায় এধরনের কাজের জন্য চাকরীচুত করা হবে।
এই রুলস ফলো করতেই সবাই নিজের কাজে ব্যস্ত। বিমুগ্ধ দরজা দখল করে দাড়িয়ে আছে। তার গায়ে একটি সাদা ঢোলা টি শার্ট। লুজ টাউজার। টি শার্টের সামনের দিক সে আবার ইন করে রেখেছে। আসলে সে ইন করেনি। পড়ার সময় ঠিক করতে ভুলে গেছে। পিছনের দিক খোলা। হাফ হাতা। পায়ে হলুদ ফিতার স্লিপার। হাতে তার এলোমেলো সব ব্রেসলেট ঝুলছে। বাম হাতের বৃদ্ধা আঙ্গুলে সিলবার রঙ্গা চিকন একটি আংটিও দেখা যাচ্ছে। চুল একটু বড় হয়েছে। কা টা হয়নি এ মাসে। ব্যস্ত কি খুব?
রেস্টুরেন্টের সারি তিন ভাগে ভাগ করা। প্রথম দুই সারি তার প্রথম রুলস একেবারেই ভঙ্গ করেনি। কিন্তু তিন নাম্বার সারির কয়েকজন আড়চোখে তাকে দেখছে। তার বিশেষ কারণ কর্নারের টেবিল। এই টেবিলের একটি নাম আছে। ‘ রঙ্গন’ এবি। বিভিন্ন রঙ্গের ফুল সব সময় এই টেবিলে থাকবে। এখানে সাধারণত কাস্টমার বসে না। বিমুগ্ধের গ্রুপ বসে। তার বন্ধুবান্ধব পরিবার। কিন্তু আজ থেকে সে এই টেবিলের নাম চেঞ্জ করবে ভাবছে। রঙ্গন এবি টেবিল অন্য পাশে নিয়ে যাবে। এই টেবিলের একটাই নাম হবে। বিমুগ্ধ একটি চেয়ার টেনে দরজার সামনেই বসে পড়ল। তাকে এভাবে বসতে দেখে বেশ অস্বস্তি বোধ করছে এম্প্লয়ীরা। একে রুলস ভাঙ্গতে পারবে না। তার উপরে আবার তিনি নিজেই সবার চোখের সামনে এভাবে বসে আছে। ইগনোর ব্যাপারটা প্রচন্ড কষ্ট দায়ক। তবুও করতে হবে। এই শেফের কোন বিশ্বাস নেই। হতে পারে তাকিয়ে থাকার জন্য কাউকে প্রমোশন দিয়ে দিল। আবার দেখা যাবে কারো সেলারিও বাড়িয়ে দিল। কিন্তু সবচেয়ে ঝুঁকির বিষয় কাউকে কাউকে তিনি রিজাইন লেটার জমা দিতে বলে দিল। লাভের চেয়েও ঝুঁকি অনেক অংশে বেশি। তবুও মেয়ে স্টাফগুলো ফিসফিস করছে। বিমুগ্ধ ঘন্টা খানের বসে টেবিলের দিকে তাকিয়ে ছিল। তার সব কাস্টমার তাকে দেখছে। কথা বলছে ইনিয়ে বিনিয়ে। বিমুগ্ধ চুপচাপ শান্ত হয়ে দেখছে। হঠাৎ হেসে ফেলল। নিজের ঠোঁটে হাত দিয়ে সে ভাবল অনেক দিন পড়ে হাসছে। এভাবে হাসছে। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ দুঃখি। প্রচন্ড মাত্রায় দুঃখি। আর এই দুঃখের মাঝে সত্যি খুশির অভাব। বিলাসবহুল জীবন থেকে শুরু করে পরিবার বন্ধু, এমন কি নিজেও সব সময় সব খুশির সঞ্চার করতে পারে না। কিছু খুশি একজনের নামেই বরাদ্ধ থাকে। সেই খুশি, সুখ, ডাকপিয়নের খামে করে বুকে এসে পোছানোর জন্য তাকে প্রয়োজন। তার দেখা পাওয়া প্রয়োজন। তাকে সামনে থেকে, কাছে থেকে চিঠি রূপে দেখার প্রয়োজন। বিমুগ্ধ দেখছে। আজ বহু দিন পরে এতো কাছে, এতো পাশে, এই তো মাত্র কয়েক হাত। মেয়েটা একটু বেশিই কাছে নয় কি? এভাবে কাছে কাছে থাকলে কি হয়? হয়। বুকে শব্দ হয়। চোখ শীতল হয়। ঠোঁটে পাগল করা বৃষ্টি মেঘের বর্ষণের পরের রং ধনুর ছোঁয়া পাওয়া যায়। একটু মরুর বুকে এক সমুদ্র নীল রঙ্গের কাঁচ ঘর তৈরি হয়। হাজারো পাখির সাথে প্রজাপতির মিলন হয়। পৃথিবী জুড়ে অনুভূতিদের দেখা হয়। বেশিই আবেগী হওয়া যায়। এই যে, সে আবেগী হয়ে যাচ্ছে। চারপাশের এতো চোখ, এতো শব্দ, কাঁ টা চামচের টং টং কিছুই তাকে স্পর্শ করছে না।
ম্যানেজার ছুটে আসল। বিমুগ্ধকে বিনয়ী হয়ে বলল,’ সেফ মেয়েটিকে আমি নিষেধ করেছিলাম সেখানে না বসতে। তবুও বসেছে। আমি দুঃখিত। এক্ষুনি আমি তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করছি।’
‘ আজ থেকে এই টেবিলে এই রমনী ব্যতিত কেউ যেন কখনো না বসে মিষ্টার এম। এই টেবিল শুধু তার। এর ডান পাশের টেবিলটি আজ থেকে আমার পার্সোনাল মানুষের জন্য। বিষয়টি যেন আপনার সরণে থাকে।’
ম্যানেজার কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর বলল,’ ইয়েস সেফ। মনে থাকবে। একশবার মনে থাকবে।’
‘ আপনাকে আমি একবার বলেছিলাম উত্তর দিবেন এক কথায়। মনে হচ্ছে ভুলে গেছেন।’
‘ স্যরি।’
ম্যানেজার দাঁড়িয়ে আছে। বিমুগ্ধ বিরক্ত হলো। তার সামনে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকার কি আছে? সে অসহ্য চোখে তাকাল। ম্যানেজার সরল না। সে কিছু বলতে চায়। বিমুগ্ধ বুঝতে পেরে উঠে পড়ল। চেয়ার ঠেলে দিয়ে বলল,’ এভাবে তাকানোর কিছু হয়নি। রাগেশ্বরী কিছু খেয়েছে?’
ম্যানেজার হা করে তাকিয়ে রইল। বিমুগ্ধ আরও বিরক্ত হয়ে বলল,’ উনি কিছু খেয়েছে এসে?’
‘ না।’
‘ চার ঘন্টা ঘুমাচ্ছে। কাহিনী কি?’ বিমুগ্ধ বিড়বিড় করতে করতে টেবিলের দিকে চলে গেল। গ্লাস টেনে দিল। পর্দা টেনে দিল। সবাই এবার ভয়াবহ চোখে তাকিয়ে রইল। ম্যানেজার চোখ গরম করে বলল,’ শেফের রিলেটিভ হয়। এভাবে তাকিয়ে না থেকে কাজ করো।’
নীহারিকা এখানে এসেছে চারঘন্টা আগে। সকাল সাতটায়। এখন বাজে এগারোটা। এসেই সে সেই সিটে বসে পড়ল। সাধারণত এই রেস্টুরেন্ট কখনো বন্ধ করা হয় না। সারা রাত দিন সাধারণ নিয়মে খোলা থাকে। স্টাফদের টাইম সেভাবে ভাগ করা থাকে। সকাল ছয়টা থেকে বারোটা পর্যন্ত একটা শিফট কাজ করে। বারোটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা সন্ধ্যা ছয়টা থেকে রাত বারোটা। আর রাত বারোটা থেকে সকাল ছয়টা। চক্রের মত ক্রমাগত ঘুরছে। এই রেস্টুরেন্ট প্রথম যখন চালু হয়েছিল তখন মাত্র চারজন স্টাফ ছিল। আজ থেকে পাঁচ বছর আগেও এই “ কচুরিপানার ডোবা/ water hyacinths pond” একটি সাধরণ রাস্তার পাশে একতলা বিশিষ্ট্য রেস্তুরাই ছিল। যার রং করা থেকে শুরু করে টেবিল সাজানোর কাজ করে ছিল বিমুগ্ধ একা। যার প্রতিটা কোনা তৈরি করেছিল নিজের পছন্দ রুচি ইচ্ছের মাধ্যমে। বন্ধুদের সাহায্য যার অর্থায়ণ করেছিল সে। এখানের বেশিরভাগ ফার্নিচার কিনেছিল শান্ত, অর্পণ। আজ সেই রেস্তুরার দিকে তাকালে বিমুগ্ধের চমকে যাওয়া উচিৎ। একটা মোটামুটি নাম ডাক হয়েছে। মানুষের পছন্দের হয়ে উঠেছে। রুচিবোধ পাল্টেছে। কিন্তু বিমুগ্ধ এতো সাফল্যেও চমকে না। অথচ আজ সে চমকে গেল। এই নারীকে দেখে। বিমুগ্ধ চেয়ার টেনে নীহারিকার পাশে বসল। তার এলোমেলো ঘুম। মুখের কাপড় সরে গেছে। কয়েক গাছি চুল হেলেদুলে পড়েছে গালে। লাল হয়ে আছে চোখের উপরীভাগ, গাল, নাক। ঠোঁট তেমন দেখা যাচ্ছে না। বিমুগ্ধ চট করে ধরে নিল নীহারিকা আজ তিনদিন ঘুমায়নী। সে টানা জেগে ছিল। নিজের রুমে বন্দি হয়ে সে দুই’ দিন কিছুই খায়নি। তার এখন নীহারিকার জন্য খাবার তৈরি করা উচিৎ। প্রয়োজন। ভয়াবহ দরকার। কিন্তু সে উঠছে না। তার উঠতেই ইচ্ছে করছে না। ফেরিটেলের মত সময় থামিয়ে তার চুপ করে এভাবে বসে তাকে দেখতে ইচ্ছে করছে। মেয়েটি কত শান্ত! তার চোখের পাতা যেন কথা বলে। তার ক্লান্তি যে বিষণ্ণতা ছড়ায়। কি অপূর্ব লাগছে। বিমুগ্ধ বিমোহিত হয়ে গেল। আচ্ছা নীহারিকার একটি ছবি তুললে কেমন হয়? বিমুগ্ধ সত্যি একটি ছবি তুলল। এপাশ থেকে ওপাশ ফিরতে গিয়ে নীহারিকা ফুলের টব ফেলে দিল। পানি সহ কচুরিপানা টেবিলের উপরে গড়াগড়ি খাচ্ছে। বিমুগ্ধ দু’ হাতে পানি সরিয়ে দিল। নীহারিকার হাতের এক পাশ ভিঁজে গেছে। তার খবর নেই। সে বেহুশের মত ঘুমচ্ছে। পাগল করা ঘুম। বিমুগ্ধ এপাশে এসে বসল। নীহারিকার মুখ দেখা যাচ্ছে না ওপাশ থেকে। বেশ সময় পরে নীহারিকা চোখ খুলল। একটু একটু দৃষ্টি ফেলে সে উঠে বসতে বসতে হাই তুলছে। বিমুগ্ধ ফুল গুলো সুন্দর করে টবে পুরে রাখতে রাখতে বলল,’ এই রেস্টুরেন্ট তোমার ঘুমের জন্য তৈরি করা হয়নি। সব সময় এসেই ঘুমিয়ে পড় কেন?’
নীহারিকা চোখ কুচলে তাকাল। আরে বিমুগ্ধ যে! এতোগুলো দিন পরে দেখা পেয়ে হঠাৎ নীহারিকা পাল্টে যাওয়া গলায় উত্তেজিত হয় বলল,’ সাত দিন! সাত দিন আমি আপনার এখানে এসে খোঁজ করেছি। কোথায় ছিলেন বলুন তো? আপনি তো প্রতি সাপ্তাহে এক বার করে হলেও আসতেন। অথচ আমি খুঁজতে এসে দেখি নাই। কাহিনী কি?’ বিমুগ্ধের বরফ চোখ। তার খোঁজ করছে! চুপ করে থাকতে দেখে নীহারিকা শুধু শুধুই রেগে গেল। টবের সব ফুল আবার টেবিলে ঢেলে দিয়ে বাচ্চাদের মত বলল,’ খাবার তৈরি করতে যান। আমি দু’ দিন কিছুই খাইনি। এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? যেতে বললাম না। যান।’
বিমুগ্ধ উঠে পড়ল। কিছুই বলল না। বের হওয়ার সময় নীহারিকা পিছন থেকে ডেকে বলল,’ টাকা নেই আমার কাছে। ফ্রিতে খাওয়াতে হবে।’
‘ আমার রেস্তুরায় ফ্রি সার্বিস দেওয়া হয় না মিস নীহারিকা।’
‘ আমাকে দিবেন।’
‘ দিতেই হবে? সিরিয়েস ইস্যু?’
‘ অফকোর্স। বের হন।’
বিমুগ্ধ আজ একদম থ। নীহারিকা এমন এলোমেলো ব্যবহার করছে কেন? সে তো কখনো এমন বাচ্চাদের মত কথা বলে না। নীহারিকা মাথা ফেলে দিল। এই টেবিলে বসলে তার ঘুম আসে। ভয়াবহ রকমের রূপকথার রাজ্যের ঘুম।
বিমুগ্ধ এসে বসল। সে দেখছে নীহারিকা ফুলের সব পাপড়ি ছিড়ে ফেলেছে। টেবিলের উপরে পানি। সেই পানিতে ভাসছে পাপড়ি গুলো। গোলাপি সাদা নীল হালকা বেগুনী। ভারী আকর্ষণীয় লাগছে। নীহারিকা অন্য মনস্ক হয়ে বসে আছে। বিমুগ্ধ তার চোখের দিকে তাকাল। আজকে এই মেয়েটি কাঁদবে। বিমুগ্ধের কাছে এসেই কেন কাঁদতে হবে? আজব। নীহারিকা খেয়ালই করল না বিমুগ্ধ এসেছে। যখন খেয়াল হলো তখন খুব অসহ্য হয়ে তাকাল। চোখে চোখ পড়তেই তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। চার জোড়া চোখ একে অপরকে দেখছে। সুন্দর। হ্যাঁ এই দৃশ্যকেই সুন্দর বলে। খাবারের প্লেট দেখে নীহারিকা ভ্রু কুঁচকে রাখল। আজকে কোন বিদেশি খাবার নেই। বিমুগ্ধের হাতের যত খাবার নীহারিকা খেয়েছে সব বিদেশি খাবার। তাদের নামও ভিন্ন। অদ্ভুৎ। আজকেরটা সহজ। বাসমতি চালের উপরে পানি ঢেলে দিয়েছে বিমুগ্ধ। তার উপরে ভাসছে দু’টি সবুজ কাঁ চামরিচ। পাশে কয়েক রকমের ভর্তা। নীহারিকা পান্তা ভাত দিয়ে ভর্তা খেতে এই এতো সুন্দর রেস্টুরেন্টে এসেছে? দীর্ঘশ্বাস ফেলল নীহারিকা। রাগ উঠছে। খুব রাগ। কিন্তু প্রকাশ করল না। সে প্লেট টেনে তাতে ভাত নিল। একদম শান্ত হয়ে খাচ্ছে। বিমুগ্ধের হঠাৎ মনে হচ্ছে এটা রেস্তরা না হয়ে গ্রামের একটি সবুজ মাঠ হলে ভালো হতো। নীহারিকা মাঠের পাশে বড় আম গাছের নিচে বসে এভাবে খাবার খাবে। পান্তা ভাত খাবে। হৃদয় কাড়া বাতাস বইবে। বিমুগ্ধ দেখবে। এভাবেই। ঝাল খেয়ে নীহারিকার চোখ মুখ জ্বলে গেল। কিন্তু তার কাছে খাবারটি অসাধারণ মনে হলো। এটা সাধারণ কোন পান্তা ভাত নয়। ভাতের পানিতে কিছু মশলা মিশানো ছিল। যা এর টেস্ট পাল্টে দিয়েছে। ভর্তা গুলো একদম ভিন্ন রকম। বিমুগ্ধ কি অসাধারণ কোন সেফ? নীহারিকা খাচ্ছে আর আড়চোখে তাকাচ্ছে। খাবার শেষ না করেই সে সরাসরি বলল,’ আপনি এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? অন্য দিকে তাকান। টাকা দিতে পারব না বলেছি দেখে আমাকে রেস্টুরেন্টের পুরানো খাবার ধরিয়ে দিয়েছেন। লজ্জা করে না? শ্যাম ওন ইউ। ছিঃ।’
বিমুগ্ধ হাসল। এই খাবার তৈরি করতে সে আধাঘন্টা ব্যয় করেছে। সব নতুন করে তৈরি করেছে। পরিশ্রম দিয়েছে। মেয়েটি কত নাখোশ ব্যক্তিত্বের অধীকারি!
নীহারিকা হাত ধুয়ে নিয়ে বলল,’ আপনার মাস্টার শেফে অংশ গ্রহন করা উচিৎ। ইন্ডিয়ায় হয় এই মাস্টার শেফ। ওখানের একজন শেফ আমার পছন্দের। আমি নিশ্চিৎ আপনি জিতবেন। জিতে গেলে আমাকে তার সাথে দেখা করিয়ে দিবেন। দিবেন তো?’
‘ না। জীবনেও দিব না। আমি চাইনা কোনো পুরুষের সাথে আপনি দেখা করুন। আর মাস্টার শেফে আমার যাওয়ার প্রয়োজন নেই। একজন আমেরিকান কেন ভারতে যাবে? আমার প্রয়োজন হলে আমি ‘দ্য মাস্টার শেফ অস্ট্রেলিয়া’ যাব।’
‘ তাহলে যাচ্ছেন না কেন? বাংলাদেশের মানুষকে খাবার খাইয়ে লাভ নেই। এরা সব ভুলে যাবে। কারণ আমরা ভোজন রসিক নই। আমরা ক্ষুদার্থ মানুষ।’
‘ তুমি কি আজ আমাকে রান্না নিয়ে জ্ঞান দিতে এসেছ?’
‘ না। তবে আমি এটা সম্পর্কেও জ্ঞান দিব। আপনি বিশ্বের কোন সেরা শেফের সাথে দেখা করেছেন?’
বিমুগ্ধ মুখটা বাঁকিয়ে বলল,’ আমার আব্বিই একজন ভালো শেফ। বিশ্ব সেরা দেখে কি লাভ?’
‘ করেছেন কি না বলুন?’ নীহারিকা ঠোঁট উল্টে নিল। বিমুগ্ধ হেসে ফেলল। আজকে এই মেয়ের হয়েছে কি?
‘ হুম দেখা হয়েছে। তিন জনের সাথে। ম্যাক্রো পিয়েরে হোয়াইট তাদের মাঝের একজন।’
‘ এ আবার কে? সঞ্জীব কাপুরের সাথে আপনার দেখা হয়েছে? এশিয়া সহ বিশ্বে তার নাম ডাক আছে। কি সব হোয়াইট ব্লাকের সাথে দেখা করেছেন।’ নীহারিকা হাসতে লাগল। শুধু শুধু। এখানে হাসার কিছুই হয় নি। বিমুগ্ধ কথা বাড়ালো না। নীহারিকার দিকে তাকিয়ে বলল,’ তুমি আজকে অনেক পড়ালেখা করে এসেছ দেখছি। মনে তো হচ্ছে তিন দিনই বই পড়ে কাটিয়েছ। শেফ নিয়ে এতো গবেষণা করছ কেন? তুমি কি কোন ভাবে আমাকে মিস করছিলে? তোমাদের পরিবারে আমি আর আব্বি বাদে কেউ তো প্রফেশনাল শেফ নয়। এম আই রাইট মিস রাগেশ্বরী?’
বিমুগ্ধ চোখ টিপ টিপ করে তাকিয়ে হাসছে। নীহারিকা রেগে বলল,’ মোটেও না। আপনাকে মিস করার কিছু নেই।’
‘ কিছুই নেই?’ বিমুগ্ধের কন্ঠে অবাকতা।
‘ না নেই।’ নীহারিকা মুখ ঘুরিয়ে নিল। টেবিল বিমুগ্ধ নিজেই পরিষ্কার করে দিল। নীহারিকার জন্য সে এক কাপ গরম চা নিয়ে আসল। নীহারিকা অবাক হয়ে গেল। ভাত খেয়ে কেউ চা খায়? কিন্তু এটাও সত্য তার খুব খেতে ইচ্ছে করছিল। একজন চা খোর হয়ে সে তিন দিন চা থেকে বিরত ছিল। কাপের গায়ে সোনালীর উপরে সবুজ কাজের ছাপ। নীহারিকা সেই কাপ দেখেই মাথা ব্যথা শুরু হলো। চায়ের নেশা ভয়ংকর ভাবে চেপে বসল। নীহারিকা চা খেতে খেতে সবচেয়ে জঘন্য কাজটি করল। যে কাজটি করতে সে এসেছে। কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল সে। তার চোখের পানিতে চা থৈ থৈ করে নেচে উঠছে। বিমুগ্ধ চোখ সরিয়ে নিল। একদম ঘুরে গেল। তার কষ্ট হচ্ছে। বুকের এক পাশ এক পাশ করে ব্যথা গায়ে ছড়িয়ে পড়ছে। নীহারিকা কাঁ দতে কাঁ দতে টেবিলে মাথা রাখল। বিমুগ্ধ এখনো তাকাচ্ছে না। তার ভালো লাগছে না। নীহারিকা কাঁদলে তার ভালো লাগে। কিন্তু আজ লাগছে না। আজকের কিছুই তার ভালো লাগছে না। হঠাৎ হঠাৎ মনে হচ্ছে নীহারিকা নামক এই রমনী তার জীবনে না আসলে সবচেয়ে ভালো হত। পৃথিবীর সেরা একটি কাজ হতো। বিখ্যাত একটি ব্যাপার ঘটত। অথচ এখন রচনা হয়েছে একটি জঘন্য হৃদয় বিদারক কষ্টের। নীহারিকা কি জানে বিমুগ্ধের সাথে তার প্রথম দেখা কবে হয়েছিল?
সেদিন ছিল ঝুম বৃষ্টির দিন। বিমুগ্ধ প্লেনের টিকেট কেঁটে বাসায় ফিরছিল। একদিন পরেই তার ফ্লাইট। সে বাংলাদেশ ছেড়ে একেবারে আমেরিকায় চলে যাবে। তার জন্ম ভূমির কাছে। যেমনই হোক জন্মভূমি তো জন্মভূমিই হয়। বিমুগ্ধ রাস্তার পাশ ঘেঁষে হাটছিল। এই মাটি এই গাছ এই আকাশ এই বৃষ্টি এসব তার জন্ম ভূমি নয়। কিন্তু এখানের সব কিছুতে সে আম্মির গায়ের গন্ধ পায়। আব্বির ঘামের একটা ছাপ পায়। এই শহরের বুকে তার বাবা মা বাস করত। তাদের প্রেম হয়েছিল। তাদের ভালোবাসা হয়েছিল। তাদের বিয়ে হয়েছিল। এই শহরের বক্ষ পিঞ্জিরায় তার পরিবার নামক ছোট একটি জগৎ রয়েছে। যাদের সে কখনো দেখেনি। যাদের কথা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। আচ্ছা দাদুজানের সাথে এক বার দেখা করলে কেমন হয়? বিমুগ্ধ ভাবল আজ সে হাঁটতে হাঁটতে তার দাদুর বাড়ি যাবে। কিন্তু রাস্তায় এলোমেলো হাঁটতে গিয়ে সে একটি বাচ্চা মেয়েকে ফেলে দিয়েছিল। সে কি রাগ! বিমুগ্ধ প্রথম সেই রগচটা কন্ঠ শুনেছিল। আগুন চোখে দশ এগারোবছর বয়সী মেয়েটি তার দিকে তাকিয়ে বলেছিল খারাপ লোক। বিমুগ্ধ তখনও জানত না এই মেয়েটিই তার দাদুর বাড়ি। যেখানে সে পথিক রূপে মুসাফিরের মত যাওয়ার জন্য হাঁটছে। বিমুগ্ধের মাথায় নীল ছাতা। মেয়েটি উঠে গেল। কাঁদা পরিষ্কার করে কিছুক্ষণ চুপ করে বিমুগ্ধের দিকে তাকিয়ে ছিল। হঠাৎ খুব শান্ত হয়ে গেল। রাগ হারিয়ে গেল। চুপ করে ভালো মেয়ের মত তার পাশে এসে দাড়াল। ছোট একটি মেয়ে। পনিটেল করে বাঁধা কালো রেশমের মত চুল বৃষ্টিতে কাঁক ভেঁজা। গাল বেয়ে পড়ছে পানির টপ টপ বর্ষণ। হাত বাড়িয়ে সে বলেছিল,’ আপনার ছাতাটা দিবেন? আই হেইট বৃষ্টি। ছিঃ।’
বিমুগ্ধ হেসে ফেলেছিল। বৃষ্টিকে কেউ এতোটা ঘৃণা করতে পারে, সেই মুহূর্তে জীবনে প্রথম বিমুগ্ধ অনুভব করল। মেয়েটির চোখের দিকে তাকিয়ে বিমুগ্ধের মনে হলো এই ছাতা তার দিয়ে দেওয়া উচিৎ। একশত ভাগ উচিৎ। সে ছাতা দিয়ে দিল। নিজে ভিঁজে ভিঁজে হাঁটতে শুরু করল। পিছনে ফিরে দেখল মেয়েটি হাসছে। বৃষ্টি থেকে বাঁচার আনন্দ।
যদি সেদিন বিমুগ্ধ বুঝতে পারত এতটা বছর পরে এসে সে ওই মেয়েটির জন্য এমন হৃদয় হাহাকার করা ভালোবাসার বৃষ্টিতে ভিঁজে যাবে তাহলে সেদিন ছাতা সে কখনো দিত না। জীবনেও না। আজ এই মুহূর্তে এমন কান্না দেখে তার আফসোস হচ্ছে। অসম্ভব রকমের আফসোস। যা তার হৃদয় জ্বালিয়ে দিচ্ছে। ইশ কি ভিষণ যন্ত্রণা!
‘ কান্না বন্ধ করো। তোমাকে দেখতে ভূতের মত লাগছে নীহারিকা।’
‘ লাগুক। আপনি তো অন্য দিকেই তাকিয়ে আছেন। সমস্যা কি?’ নীহারিকার গলা ভেঙ্গে গেল। শ্বাস টান বেড়ে গেল। বিমুগ্ধ নীহারিকার ব্যাগ থেকে ইনহেলার বের করে তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,’ তুমি ইদানিং অল্পেই কাঁদছ। কান্না নয় রাগই তোমার অস্তিত্ব।’
নীহারিকা শব্দ করে কাঁদছে। বিমুগ্ধ তাকিয়ে দেখল বাহিরের সবাই তাদের দেখছে। নীহারিকা কখন পর্দা টেনে দিল সে বুঝতেই পারেনি। দ্রুত উঠে বিমুগ্ধ পর্দা টেনে দিয়ে বলল,’ সমস্যা কি? কাঁদার কি হলো?’
‘ আপনি আগে থেকেই জানতেন তাই না?’
‘ হ্যা জানতাম। তো কি হয়েছে?’
‘ আপনি বুঝতে পেরেছেন আমি কিসের কথা বলছি?’ নীহারিকা বিস্মৃত চোখে তাকিয়ে রইল। বিমুগ্ধের শীতল গলা ভেদ করে ভেসে আসল,’ জি আমি বুঝতে পারছি। তুমি ঠান্ডা হও।’
‘ বাবার জন্য একজন মানুষ মা রা গেছে। আমার বাবা একজনের খু নের সাথে যুক্ত। আপনি বলছেন ঠান্ডা হতে?আমার বাবা বে পরোয়া গাড়ি কখনো চালায় না। কখনো না।’ নীহারিকা বুকে হাত দিয়ে কাঁদছে। তার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। ঠান্ডা লেগেছে। যার ফলে শ্বাস টান বেড়ে যাচ্ছে। অ্যানজাইমার সবচেয়ে বড় বন্ধু ঠান্ডা। বিমুগ্ধ এসি অফ করে দিল। হেসে উঠে বলল,’ এটা বড় কোন অ পরাধ নয়। খু ন করা খুবই স্বাভাবিক বিষয় নীহারিকা।’ বিমুগ্ধ নীহারিকার ঠান্ডা হাত দু’ টি নিজের হাতের ভাঁজে নিলো। দু’ হাতের তালুতে হাত ঘষে দিচ্ছে সে। ঠান্ডা বরফ হয়ে আছে হাত। নীহারিকা এখনও হা করে তাকিয়ে আছে। তার কি খুব অবাক লাগছে? মানুষটা তো এভাবেই সিরিয়াস বিষয় উড়িয়ে দেয়। নীহারিকার কিংকর্তব্যবিমূঢ় নয়ন ঠেলে বিমুগ্ধ বলল,’ খু ন করা অ পরাধ কিন্তু মহা অ পরাধ নয়। বিশেষ মানুষরাই এসব করতে পারে। তোমার বাবাও একজন বিশেষ মানুষ।’
‘ তাই আপনি তাকে এতো অপছন্দ করতেন?’ নীহারিকার চোখ ইমোশনালে ডবিয়ে দেওয়ার চরম ক্ষমতা সম্পূর্ণ বিমুগ্ধ আরও হাসল। মুখের লম্বা হাসির সাথে ঠোঁটের আকৃতি মিশিয়ে সে বলল,’ জি না। তাকে আমি অন্য কারণে অপছন্দ করি।’
‘ আমার বাবা এমন কাজ করেছে আমার ভাবতে কষ্ট হচ্ছে খুব বিমুগ্ধ।’ নীহারিকা কাঁদতে কাঁদতে বিমুগ্ধের হাতের উপরে মাথা রাখল। পিলে চমকে উঠল বিমুগ্ধ। নিজেকে সামলে নিতে বেশ সময় লেগেছে তার। নীহারিকা বলল,’ আমি বাবা আর দাদামশায়কে কথা বলতে শুনেছি। বাবা কার এ ক্সিডেন্ট করে বড়বাবার প্রিয় বন্ধুকে মে রে দিয়েছে। অথচ তিনি এই গু নাহর জন্য কোন শা স্তি ভোগ করেনি। তার বাবা একজন ভালো আ ইনজীবী হওয়ার সুবিধা নিয়েছে। আমি এসব মানতে পারছি না। আমার বাবা এমন নয়। হতেই পারে না। সে তো অ ন্যায় মেনে নিতে পারে না।’
‘ পৃথিবী একটি গোলক ধাঁধা। তুমি যা দেখ যা শুনো তা সত্য হতেও পারে। আবার নাও হতে পারে। তোমার বাবা সৎ চরিত্রের অধিকারী।’
‘ আপনি আরও কিছু জানেন? আপনি কি সবার গো পনীয়তা র ক্ষার কাজ করেন?’
‘ না। আমি মানুষের কথা লুকিয়ে রাখতে পছন্দ করি না। কিন্তু যখন কেউ লুকিয়ে রাখতে চায় আমি শুধু সাহায্য করি।’
‘ আপনার এটা করা উচিৎ নয়। কখনো না। আপনাকে আমার থা পড়ে গাল লা ল করে দিতে ইচ্ছে করছে।’ নীহারিকাকে মাত্রা অতিরিক্ত উত্তেজিত হতে দেখে বিমুগ্ধ চুপ করে রইল। নীহারিকা বাচ্চাদের মত কাঁদছে। শব্দ করে। সে নিজের মাথার হিজাব টানাটানি করছে। হাত টেবিলে ঘষছে। টেবিলের টব ফেলে ভেঙ্গে ফেলেছে। তার উপরে চায়ের কাপটিও ভে ঙ্গে ফেলল। বিমুগ্ধ এসব দেখছে। তার চোখের সামনে নীহারিকার কত রূপ যে এক সাথে প্রকাশিত হচ্ছে সে বুঝতে পারছে না। ধরতে পারছে না। সে কি এখন নীহারিকাকে জড়িয়ে ধরবে? নীহারিকা ফ্লোরে বসে কাঁদছে। হাটুতে মুখ গুঁজে সে অসহায় একটা পরিবেশ সৃষ্টি করছে। কঠিন, শক্ত মানুষগুলোকে এভাবে কাঁদতে দেখলে কেমন অনুভব হয় বিমুগ্ধ প্রকাশ করতে পারবে না। নীহারিকাকে কাঁদলে সবচেয়ে অসুন্দর লাগে। এই মুহূর্তে তো তাই লাগছে। বিমুগ্ধ এক হাঁটু ভে ঙ্গে বসে পড়ল। নিচে বসে সে নীহারিকার হাত টেনে নিজের কাছে রাখল। নীহারিকা একটুও চমকাচ্ছে না। সে এতোটাই বিভোর নিজের কান্নায় যে অনুভবই করতে পারল না বিমুগ্ধের স্পর্শকে। বিমুগ্ধ এই প্রথম নীহারিকার গালে হাত রাখল। টিস্যু দিয়ে সে চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বলল,’ সব রহস্যেরও রহস্য থাকে। তোমার বাবা এমনটি করেনি। তিনি এসব করতেই পারে না। হি ইজ এ ব্রেভ বয়। অসাম ম্যান। আমি জীবনে যত স্পেশাল মানুষ দেখেছি সে তাদেরই অন্তর্ভূক্ত। আমি তাকে অ পছন্দ করি ঠিক কিন্তু তিনি পৃথিবীর সব ভালো মানুষের একজন। যাদের বেস্ট
মানুষ বলা হয়।’
‘ এই মুহূর্তে আমি কেন তার বেস্ট জিনিস গুলো মনে করতে পারছি না? হোয়াই?’
‘ তোমাকে শুধু মনে রাখতে হবে সে তোমাকে খুব ভালোবাসে। তুমি তাকে খুব ভালোবাসো। ভালোবাসা ব্যতিত চোখের সামনে কিছুই দেখবে না। শুধুই ভালোবাসা দেখো। যানো তো ভালোবাসা অন্ধ হয়।’ বিমুগ্ধ মুচকি হাসল। নীহারিকা তাকিয়েই রইল। তিনদিন আগেই সে এই কঠিন কথা গুলো জেনেছে। পরিবারে কত রহস্য থাকে! কিন্তু সে কাউকে বলেনি। প্রিয়মকেও না। বাবা প্রিয়মের আইডল। সে এটা মানতেই পারবে না। মাকেও বলা যাবে না। তিনি যদি জানতে পারে নীহারিকা জেনে গেছে তাহলে কষ্ট পাবে। নীহারিকার ভালো বন্ধু বান্ধবও নেই। হঠাৎ তার মনে হলো বিমুগ্ধকে দরকার। এই মানুষটার সামনে সে কাঁদতে পারে। কাঁদতে পারবে। হ্যাঁ কান্নার জন্যেই তো। নীহারিকা বিমুগ্ধের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,’ আমি বাবাকে খুব ভয় পাই এমনটা সত্য নয়। আমি তাকে সম্মান করি। তার সব কথা শুনার পিছনের সবচেয়ে বড় কারণ আমি তাকে খুব ভালোবাসি। তার সিদ্ধান্তকে সঠিক মনে করি। শ্রদ্ধা আর সম্মানের পাহাড় সে। আমি অসম্ভব রকমের বিশ্বাস করি তাকে। হ্যা আমি তার কথা, নিয়ম, আমার জন্য বরাদ্ধকৃত সব রুলস ভাঙ্গতে চাইতাম। কিন্তু আমি সত্যি তাকে খুব ভালোবাসি। আমি চাইনা এই সম্মান ভালোবাসা এই আত্মবিশ্বাস ভেঙ্গে যাক। কখনো তাকে বলা হয়নি আমি তাকে মেয়ে হিসেবে নয় একজন মানুষ হিসেবে খুব সম্মান করি, ভালোবাসি। আমার মনে হচ্ছে আমি মরে যাচ্ছি। দম কেমন বন্ধ হয়ে আসছে। আমার বিশ্বাসের পাহাড় ভাঙ্গছে। আমি কিভাবে বাঁচব? আপনি কি আমাকে একবার জড়িয়ে ধরবেন? শক্ত করে? আমার খুব জ্বর জ্বর লাগছে। আমি বাবাকে খুব ভালোবাসি বিমুগ্ধ। বাবা এধরেন কাজ করতে পারে না। আমি জানি সব মিথ্যা। অথচ সত্য।’ বিমুগ্ধ নীহারিকার কপালে হাত দিল। প্রচন্ড জ্বর তার। বিমুগ্ধ বুঝতে পেরেছে নীহারিকা কেন এতো এলোমেলো আজ। সে আরও কাছে এসে বলল,’ সত্যি জড়িয়ে ধরব?’
নীহারিকা কঠিন গলায় বলল,’ অবশ্যয় ধরবেন। শক্ত করে। যতটা শক্ত হলে আমার শীত করবে না। আমার কষ্ট লাগবে না। আমার কিছু অনুভব হবে না। আমার মন মস্তিষ্ক বরফে জমে যাবে। আমার স্মৃতি নষ্ট হয়ে যাবে। তিন দিন আগের ঘটনা আমি ভুলে যাব। প্লিজ হাগ মি।’ নীহারিকা সত্যি দু’ হাত মেলে দিল। বিমুগ্ধ তাকিয়ে রইল। কাছে গেল না। সে জানে আজ যদি কাছে যায় তাহলে কখনো এই সুঘ্রাণ যুক্ত বক্ষ থেকে বিমুগ্ধ বের হতে পারবে না। সে ম রেই যাবে। অনুভূতিতে দম বন্ধ হয়ে।
‘ আমি খু নির মেয়ে নই। আমার বাবা এমন নয়। আপনি কি এই কথাটা বিশ্বাস করছেন?’ নীহারিকা লাল চোখে তাকাল। বিমুগ্ধ হাসল।
‘ হ্যাঁ করছি। তোমার সব কথা আমি সব সময় বিশ্বাস করি। কারণ তুমি আমার মত মিথ্যে কথা বলো না।’
নীহারিকা কাঁদতে কাঁদতেই হাসল। বিমুগ্ধ টিস্যু বক্স এগিয়ে দিয়ে বলল,’ তোমার লজ্জা করে না আমার সামনে কাঁদতে? বড় গলা করে যে বলে বেড়াও আমি কাঁদি না সেটার কি হবে?’ বিমুগ্ধ তার লম্বা নাক এমন ভাবে উঁচু করল নীহারিকা রেগে গেল। দু’ চোখ মুছে নিয়ে বলল,’ চলুন আজকে আপনার সাথে আমি হাঁটতে বের হবো।’
বিমুগ্ধ ফ্লোরে বসে পড়ে বলল,’ তোমার বাবার অফিস পাশেই। তুমি কি বিষয়টি জানো না?’
‘ তাতে কি? চলুন। উঠুন বলছি।’
নীহারিকা উঠে গেল। টিস্যু দিয়ে মুখ মুছল। তারপর পর্দা ঠেলে সবার দিকে একবার তাকাল। ম্যানেজারকে এভাবে আড়াআড়ি চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে নীহারিকা মাথা কাত করে বলল,’ আপনাদের সেফ আমার কাজিন হয়। ভাইয়ের রেস্টুরেন্টে তো আসতেই পারি না কি? আপনি যে আমাকে তাড়িয়ে দিতে চেয়ে ছিলেন সেটা আমি এখনো বলিনি।’ অথচ সে বিষয়টি বিমুগ্ধের সামনেই বলল। বিমুগ্ধ ম্যানেজারকে বাঁকা চোখে দেখে নিলো। কিন্তু কিছু বলল না। ম্যানেজার ভয়ে ভয়ে বলল,’ স্যরি শেফ আমি জানতাম না উনি আপনার বোন হয়।’
‘ আপনি এখনো যানেন না। সে আমার বোন নয়। সব কাজিন বোন হয় না। আর ইউ, সেট আপ। চলো এখান থেকে। তোমার বাসায় যাওয়া উচিৎ।’
বিমুগ্ধ কড়া গলায় বলল। নীহারিকা হুশ করে মাছি তাড়ানোর মত কথা উড়িয়ে দিয়ে বলল,’ শুনুন আমি উনার বোনই হই। চাচা তো খালাতো বোন। আপনার কি এমন কোন বোন আছে?’
‘ চাচাতো বোনও আছে খালাতো বোনও আছে। কিন্তু দু’ জনই আলাদা আলাদা মানুষ।’
‘ কিন্তু আমি একজনই।’ নীহারিকা একটা খালি চেয়ার দেখিয়ে বলল,’ চলুন বসে গল্প করি। আমার প্রচন্ড কথা বলতে ইচ্ছে করছে। কার সাথে যে বলি বুঝতে পারছি না। আপনাকে পছন্দ হয়েছে।’ নীহারিকা চেয়ারে বসে পড়ল। বিমুগ্ধ বিষ্ময় চোখে তাকিয়ে রইল। ম্যানেজারকে সত্যি সত্যি বসতে দেখে সে রেগে গেল। নীহারিকার হাত ধরে টেনে দাড় করিয়ে দিল। ম্যানেজারকে বলল,’ আপনার কাজে যান।’
‘ আরে এটাই তো উনার কাজ। কাস্টমারকে কোম্পানী দেওয়া।’ নীহারিকা হাসছে। রসিয়ে রসিয়ে কথা বলছে। এই মেয়ের মাথায় সমস্যা দেখা দিয়েছে না কি? বিমুগ্ধ এখনো হাত ধরে রেখেছে। তার গরম তালুতে নীহারিকার হাত। নীহারিকার ভালো লাগছে। সে হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। ম্যানেজারকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে বিমুগ্ধ বিরক্ত গলায় বলল,’ সে আপনার ক্লাইন্ড নয়। আমার ক্লাইন্ড। দূরে থাকুন।’ ম্যানেজারের মুখ হা হয়ে গেল। শেফ কি তাকে ওয়ার্নিং দিয়েছে? কিন্তু কেন? এতো রেগে যাচ্ছে কেন? মেয়েটি কি তার প্রেমিকা? শেফের কি গার্লফ্রেন্ডও আছে? মেয়েটির কথা গুলো খুব সুন্দর। মেয়েটিও কি সুন্দর! চাচাতো খালাতো বোনের সাথে প্রেম কেমন হয়? যে কি না ডাবল বোন! ম্যানেজার হা করেই দরজার দিকে তাকিয়ে রইল। বিমুগ্ধ নীহারিকাকে রাস্তার পাশে নিয়ে এসে বলল,’ তোমার বাসায় যাওয়া উচিৎ। ঔষুধ খাওয়া উচিৎ। জ্বর খুব।’
নীহারিকা একটু ভেবে বলল,’ তাহলে বরং আমাকে জাওয়াদের হসপিটালে ছেড়ে আসুন। সে আপনার থেকে ভালো ডাক্তার। ঔষুধ বাসায় গিয়ে খেতে হবে না। সে দিয়ে দিবে।’ নীহারিকা দেখল বিমুগ্ধের বিদেশী ঢঙ্গের মুখশ্রী লালাভ হয়ে উঠেছে। তাকে দেখতে এখন লাল মরিচ লাগছে। একেই কি বলে জেলাসি? হিংস্রতা? নীহারিকা হঠাৎ বিমুগ্ধের হাত থেকে নিজের হাত সরিয়ে রাস্তার পাশ ঘেষে হাঁটতে শুরু করল। বিমুগ্ধ বুঝতেই পারছে না আজ নীহারিকার কি হয়েছে। সেও তার পিছনে হাঁটতে লাগল। নীহারিকা নিজের জুতো গুলো খুলে ফেলে দিল রাস্তার পাশে। বিমুগ্ধ কুড়িয়ে নিল। হাতে নিয়ে হাঁটছে সে। নীহারিকার হাতের কব্জিতে ঝুলছে তার দেওয়া ব্রেসলেট। পাউডার ব্লু রঙ্গের একটি পোশাক পড়েছে সে। যার উপরে সাদা সুতার সাথে স্টোন ওয়ার্ক। বিমুগ্ধ আবিষ্কার করল নীহারিকাকে পৃথিবীর সব রঙ্গে সুন্দর লাগে। অসম্ভব সুন্দর। নীহারিকা যেতে যেতেই থেমে গেল। উল্টো পথ ধরে সে বিমুগ্ধের দিকে আসছে। এক প্রকার ছুটে। বিমুগ্ধ দাঁড়িয়ে গেল। বুঝার চেষ্টা করছে। নীহারিকা কাছে এসে হাত ধরে ফেলল। বিমুগ্ধ চমকের উপরে আছে। নাহারিকা ফিসফিস করে বলল,’ দ্রুত হাঁটুন।’
‘ কেন?’
উত্তর দেওয়ার আগেই পিছনের মেয়েটি আশ্চর্য হওয়া গলায় বলল,’ নীহারিকা!’ নীহারিকা নিজের কপালে চামড় মারল। তার ক্লাসমিট ছিল এক সময়। খুবই বিরক্তিকর মেয়ে। অন্যের ব্যাপারে সমালোচনা করে বেড়াতে সে খুবই পছন্দ করে। নীহারিকার সবচেয়ে অপছন্দের মানুষের তালিকা ভুক্ত এই দোলাকে আজকেই এখানে আসতে হয়েছে? নীহারিকা সামনে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,’ কেমন আছিস?’
দোলা পা থেকে মাথা পর্যন্ত আগে নীহারিকাকে দেখে নিলো। বিমুগ্ধের দিকে তাকিয়ে সে চরম অবাক হলো এমন ভাবে জিজ্ঞেস করল,’ এই ছেলে কে রে?’
নীহারিকা বিমুগ্ধকে মনে মনে গালি দিলো। দাড়িয়ে থাকার কি দরকার ছিলো? দোলা আবার বলল,’ আমি দোলা নীহারিকার বান্ধবী।’
বিমুগ্ধ চোখ ছোট করে বলল,’ কিন্তু নীহারিকার তো কোন বান্ধুবী নেই।’
মেয়েটি অপমানিত হয়ে গেল। মুখ রক্তিম করে নীহারিকার পাশে এসে বলল,’ তুই সবাইকে এসব বলে বেড়াস?’
‘ আমি বলিনি উনাকে। তুই এখানে কি করছিস?’ নীহারিকা কেঁটে পড়ার ধান্ধায় আছে। বিমুগ্ধ ব্যাপারটা বুঝতে পেরেও দাড়িয়ে রইল। আজকে এখানে একটি ঘটনার জন্ম দিবে। মনে মনে হাসল সে। দোলা বিমুগ্ধকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে বলল,’ ওই যে রেস্টুরেন্ট সেখানে এসেছিলাম। খাবারের মান খুব উন্নত। ক্লাসিও খুব। হাই ক্লাসের খাবার দাবার। তুই তো জানিস আমি আবার সব রেস্টুরেন্টে খেতে পারি না। চল গিয়ে বসি।’
নীহারিকা বিমুগ্ধের দিকে তাকালো। সে নড়ছেই না। নীহারিকা হাসার চেষ্টা করে বলল,’ আমি মাত্রই এসেছি।’
‘ কি বলিস! তুইও চিনিস এই রেস্টুরেন্ট? বেশ নাম ডাক হয়েছে। অনেক মানুষ দেখছি চিনে। তুই শুনলে অবাক হয়ে যাবি আমার ভার্সিটি ফ্রেন্ড থেকে শুরু করে বাসার সবারই এই রেস্টুরেন্টের খাবার পছন্দ। একটা সিক্রেট বলি? এখানের ওনার একজন শেফ। কি যে অস্থির খাবার তৈরি করে বলে বুঝাতে পারব না। আমি খুব লাকিলি খেতে পেরেছি। চল আজ তোকে খাওয়াব। পরিচিত হয়ে গেছে এখন অনেকে।’
বিমুগ্ধ নির্বিকার ভঙ্গীতে এসব শুনছে। তার হাতে এখনো নীহারিকার জুতা। নীহারিকা বলল,’ এখন পাবি না। উনি আজ আর রান্না করবে না।’
দোলা অদ্ভুৎ চোখে তাকিয়ে বলল,’ তুই জানলি কিভাবে?’
‘ কারণ সে আমার সাথেই রেস্টুরেন্ট ছেড়েছে।
সে বিশ্বাসই করতে পারছে না নীহারিকা মানুষটাকে চিনে। দোলা খুবই রাগান্বিত হলো। কিন্তু তা দেখালো না। নীহারিকার কাছে ঘেষে বলল,’ ছেলেটা কে রে?’ মূলত এটাই হচ্ছে আসল প্রশ্ন। নীহারিকাকে আটকে রাখতে এতো কথা বলল। নীহারিকা বিমুগ্ধের দিকে তাকিয়ে কিছু বলবে তার আগেই বিমুগ্ধ চট করে বলল,’ বয়ফ্রেন্ড। দেখছেন তো তার জুতোও ক্যারি করছি।’
নীহারিকা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল। দ্রুত হাত থেকে জুতো কেড়ে নিতে চাইল। বিমুগ্ধ মাঝ রাস্তায় হাঁটু ভেঙ্গে বসল। দোলা এসব ফিল্মি কাহিনী দেখে থ হয়ে গেল। নীহারিকার মত এমন খ্যাত মার্কা মেয়ের বয়ফ্রেন্ড একজন সুন্দর ছেলে? তাও এতো স্টাইলিশ ফ্যাশেনেবল? কিভাবে সম্ভব? বিমুগ্ধের কাজে নীহারিকা লজ্জিত হয়ে চার পাশে তাকাচ্ছে। অথচ বিমুগ্ধের ওসবে এতো মনোযোগ নেই। সে খুব যত্ন করে জুতো জোড়া পড়িয়ে দিচ্ছে। পায়ের পাতাও হাত দিয়ে ঝেড়ে পরিষ্কার করে নিচ্ছে। এসব দেখে দোলা আকাশ থেকে পড়ল। সে কল্পনায় ভাবতে পারে না ইন্টার পড়ুয়া বরিং, বিরক্তি কর, চুপচাপ থাকা রাগী এই বেয়াদপ মেয়ের এমন একটা বয়ফ্রেন্ড হতে পারে? সে কয়েক সেকেন্ড ভাষা হারিয়ে ফেলল। নীহারিকা বিমুগ্ধের দিকে তাকিয়ে আছে। জুতো পরাতে পরাতে সে বলছে,’ এভাবে মাঝ রাস্তায় জুতো খুলবে না। দেখো পা কেমন লাল হয়ে আছে। এসব পাগলের মত কাজ করা বন্ধ করবে। তোমাকে এসবে মানায় না। রাগেশ্বরীকে রাগলেই ভালো দেখায়।’ নীহারিকার অন্যরকম লাগছে। এই যে আশেপাশের গাছ গুলো দুলছে। পাতা নড়ছে ঝকঝক করে। চারপাশে কিসের যেন ঘ্রাণ ছড়াচ্ছে। মাঝ দুপুরের রোদ এতো ঝকমকে সুন্দর কেন? পিছঢালা রাস্তাটি এতো কালো কেন? সূর্যও বুঝি এতো রূপবান? নীহারিকার চোখ হাসছে। বিমুগ্ধ উঠে বলল,’ চলো।’
দোলা বলল,’ আরে বলছেন কি? এতো দিন পরে দেখা একটু গল্প তো করতেই পারি আমার বান্ধুবীর সাথে। তা আপনার নাম কি? কি করেন? স্টুডেন্ট বুঝি? আচ্ছা আপনি কি বিদেশি? আপনার চেহারায় অনেকটা বিদেশি ছেলেদের মত ছাপ আছে। আপনাদের দেখা হয়েছে কোথায়? কত দিনের রিলেশন?’
নীহারিকার অসহ্য দৃষ্টি। বিমুগ্ধ কথাই বলল না। সে দোলার দিকে তাকাচ্ছেই না। দোলার কালো পোশাকে পাথর ঝকঝক করছে। সেই ঝকমকও তাকে আকর্ষণ করতে পারছে না। দোলার মুখ অপমানে থরথর করে কাপছে। বেয়াদপ মেয়ে দেখি বেয়াদপ বয়ফ্রেন্ড জুটিয়েছে। নীহারিকা দোলার এই অবস্থা দেখে বলল,’ আসলে উনি আমার কাজিন হয়। বয়ফ্রেন্ড নয়। মজা করেছে তোর সাথে। জাস্ট ফ্যান।’
দোলা খুশিতে গদগদ হয়ে গেল। কে বলবে এই মেয়ে কিছুক্ষণ আগেও বি ষ নজর দিচ্ছিল। সে নীহারিকার পাশে আরও ঘেষে বলল,’ কেমন কাজিনরে?’
‘ আমার বড় বাবা আর খালামনির ছেলে।’
দোলার সময় লাগল বুঝতে। সে বলল,’ নাম কি আপনার?’
বিমুগ্ধ বললই না। নীহারিকাই বলল,’ বিমুগ্ধ।’
‘ বি’ দোলা কথা শেষ করার আগেই বিমুগ্ধ কাঠ কাঠ গলায় বলল,’ তাযিন শাহমাত। আমার নাম।’
দোলা বিমুগ্ধের এটিটিউড দেখে ইম্প্রেস হয়ে বলল,’ কোন ভার্সিটিতে পড়?’
‘ সে জব করে। আচ্ছা আসি অন্যদিন কথা বলব।’ নীহারিকা চলে যেতে চাইল। তার মাঝে রাগ কাজ করছে। এভাবে দেখার কি আছে? ছেলেই তো! ভুত তো না। বিমুগ্ধ ব্যাপারটায় মজা পাচ্ছে। তবে সে যেতেই চাইল। কিন্তু দোলা দাড় করিয়ে ইমোশনাল লুক দিয়ে বলল,’ তুই কি আমার সাথে কথা বলতে চাইছিস না?’
‘ তা হবে কেন? আসলে বাসায় যেতে হবে তো তাই।’
‘ তোর বাবা মায়ের সেই ননাই মার্কা নাটক এখনও চলে? বুঝলে নীহারিকাকে তার বাবা খুবই চাপের মধ্যে রাখে। তোমার চাচ্চু মানুষ ডেঞ্জারাস। তা তুমি কি করো?’
তুমি! নীহারিকার শরীর জ্বলে গেল। সে বিমুগ্ধের দিকে আগুন চোখে তাকিয়ে রইল। বিমুগ্ধ বিষয়টিতে নির্দোষ হয়েও ফেঁসে গেল। সে চোখ উঁচু নিচু করে বুঝাতে চাইল তার কি দোষ! নীহারিকা রাগে গজ গজ করা গলায় গরগর করে বলল,’ নাম তাযিন শাহমাত। জন্ম সূত্রে সে আমেরিকান। বাবা মা বাংলাদেশি। পেশায় সাইক্রাটিস্ট। ওই যে রেস্টুরেন্টের কথা বলছিলি সেটা উনারই। উনিই সেই শেফ। যার হাতের খাবার লাজাবাব তোর ভাষ্য মতে। যেহেতু আমার সাথেই বের হয়ে গেছে ফলে তুই খাবার পাবি না। ইভেন আর জীবনেও পাবি না। উনি না কি এখন থেকে শুধু নিজের পরিবারের মানুষের জন্য রান্না করবে। ওতো সময় নেই তো। আসলে খুব ব্যস্ত থাকে। তোর কখনো উনার হাতের খাবার খেতে ইচ্ছে করলে আমাকে বলিস। আমি তো উনারই পরিবারের লোক। আমি বললেই উনি রান্নায় ডুবে যাবে। কি যাবেন তো?’ নীহারিকা দাঁতে দাঁত চেপে কথাগুলো বলল। বিমুগ্ধ তড়িৎ বেগে মাথা নাচিয়ে বলল,’ ইয়েস।’
‘ আর কিছু বলবি দোলা?’ নীহারিকা বিনিত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল। দোলার কি যে গায়ে লাগল বলে বুঝানো যাচ্ছে না। তার চোখ মুখ লাল নীল। তবুও হেসে নীহারিকার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,’ তুই রেগে যাচ্ছিস কেন? নাম্বার আছে তোর কাছে? দে তো।’ হঠাৎ থেমে বিমুগ্ধকে সরাসরি বলল,’ আপনার নাম্বার পাওয়া যাবে? আমার কাজিনের মানসিক সমস্যা আছে। সে খুবই ডিপ্রেশনে থাকে।’
নীহারিকা বিমুগ্ধের হাত ধরল শক্ত করে। তারপর সোজা হাঁটা শুরু করল। পিছনে ফিরে বলল,’ তোর কাজিনকে বল বেশি বেশি আইসক্রিম খেতে। ডিপ্রেশন তুড়ি বাজিয়ে গায়েব হয়ে যাবে। আমি কিন্তু সিরিয়াস খুব। বাই ফ্রেন্ড।’
মুখে বিড়বিড় করল,’ শয়তান একটা।’
বিমুগ্ধ মাঝ রাস্তায় পাগলের মত হাসল। নীহারিকার জ্বর অনেক বেড়েছে। সে ফুঁটপাতে বসে আছে। আকাশের দিকে খালি চোখে তাকিয়ে আছে। সূর্য তার চোখের উপরে পড়ছে। বিমুগ্ধ উদ্ভাবন করল, পৃথিবীতে মেয়েদের সৌন্দর্য্য আরও একটি কারণে বেড়ে যায়। পছন্দের কারো জন্য হিংসাত্মক হলে। জেলাসি ফিল করলে। তাদের মুখের রং তখন লালাভ হয়ে যায়। চোখের তারা তখন থইথই করে নাচে। ঠোঁট রাগে লাল হয়ে যায়। নাকের ডগায় সিঁদুর পড়ে যেন। নীহারিকা বিমুগ্ধের দিকে তাকালো। দু’ জনে দু’ জনের দিকে তাকিয়ে। একটি জনমানব সম্পূর্ণ রাস্তায় এমন দৃষ্টিতে হারিয়ে যাওয়াকে কি বলে? বিমুগ্ধ ক্ষীন গলায় বলল,’ রূবাইদাকে দেখলে তোমার জেলাস ফিল হয় না?’
‘ না। কারণ সে আপনাকে সত্যি ভালোবাসে। আমি চাই আপনি ভালো থাকেন।’
‘ কিন্তু জাওয়াদকে দেখলে আমার শরীর জ্ব লে যায়। মনে হয় কেউ বুঝি আ গুন জ্বালিয়ে দিয়েছে গায়ে। হৃৎপিণ্ডে এ সিড পড়ল বুঝি। অঙ্গে অঙ্গে কেউ ব্লে ড বসিয়েছে যেন।তখন আমার কি লার হয়ে যেতে ইচ্ছে করে। এক দুই জন মানুষকে মা রা বড় কোন ব্যাপার না। বিখ্যাত মানুষেরা প্রচুর খু ন করে। আমি কি জাওয়াদকে মে রে ফেলব? সরাসরি বলছি।’
নীহারিকা শান্ত চোখে তাকিয়ে আছে। জ্বরে তার চোখের পাতা জ্বলে যাচ্ছে।
‘ হয় তো সে আমাকে সত্যি ভালোবাসে না।’
‘ বাসে। তার চোখে তোমার জন্য এক সমুদ্র ভালোবাসা আমি দেখেছি। সত্যি দেখেছি।’
‘ তাহলে তো ভালো।’
‘ কিভাবে?’
‘ আমাদের তাকেই বিয়ে করা উচিৎ যে আমাদের খুব ভালোবাসবে।’
বিমুগ্ধ চোখ সরিয়ে নিল। মনে মনে সে শুধু উচ্চ শব্দে চেচাল, নীহারিকা, নীহারিকা, শুধুই নীহারিকা বলে।
‘ আজকে আপনি আমাকে খাওয়াবেন। সব টাকা আপনি দিবেন।’
‘ কোন খুশিতে?’
‘ আজকের খুশিতে। এই দিনটির খুশিতে। এই সুন্দর দুপুরের খুশিতে। দু’ জন মানুষ এক সাথে হাঁটার খুশিতে।’ বিমুগ্ধ উঠল। নীহারিকার সব কথা আজ সে শুনবে। সব। নীহারিকা একটা কাবারের স্টলে গেল। রাস্তার পাশে ভ্যানে বিক্রি করছে গরম গরম কাবাব। সেখান থেকে সে কাবাব তুলে নিল। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে খাচ্ছে। বিমুগ্ধের সাথে তার লক্ষ কোটি কথা। বিমুগ্ধ শুধু দেখছে। এই নীহারিকাকে সে জীবনেও দেখেনি। কে এই নারী? যাকে সে কখনো হারাতে চাইছে না। সে চাইছে নীহারিকা এভাবেই হাসুক। গল্প করতে করতে হোচট খাক। হঠাৎ হঠাৎ অবাক হয়ে বলুক,’ দেখুন ওটা কি? হা হা হা।’ আবার একটু হাঁটুক। মাঝ রাস্তায় পা থামিয়ে দিয়ে চোখ মুখ কুঁচকে তাকিয়ে থাকুক। রাস্তায় যা পাচ্ছে সব কিনুক। ঝালমুড়ি, ফুচকা থেকে শুরু করে কাঁচের চুড়ি কিনুক। থেমে গিয়ে রাস্তায় বসে পড়ুক। তার স্কুল কলেজ ভার্সিটির গল্প বলতে বলতে হাপিয়ে যাক। দু’ হাতে খাবার নিয়ে বলুক,’ আমার ওড়না ঠিক করে দিন তো!’ হায় কি সুন্দর সব। বিমুগ্ধ এমন একটি দিন সারা জীবন চেয়েছে। সব ছেলেদেরই বোধহয় এমন একটি দিন প্রয়োজন। জীবনে ভালো থাকার জন্য হলেও সাপ্তাহে, মাসে, বছরে একটা দিন এমন আসা খুব জরুরী। নীহারিকা ক্লান্ত গলায় বলল,’ চুড়ি গুলো ধরুন তো।’ ডান হাতে চুড়ি বাম হাতে নীহারিকার ব্যাগ। বিমুগ্ধ নিজের দিকে তাকিয়ে নিজেই হাসছে। সে কবে এমন হয়ে গেল? সে তো আমেরিকার মাটিতে হাঁটা বাস্কেটবল নিয়ে ঘুরা ছেলে ছিলো। যার পোষাক থেকে শুরু করে সবই ছিলো আলাদা। তার ব্যক্তিত্ব আলাদা। সে নিজেই আলাদা। সে তো বিমুগ্ধ। মুগ্ধ করার জন্যেই জন্ম। আর সেই মুগ্ধকে যে মুগ্ধ করার ক্ষমতা রাখে তাকেই নীহারিকা বলে। বিমুগ্ধ নীহারিকার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে হাঁটছে ঘন্টার পর ঘন্টা। কখন যেন বিকেল হয়ে গেল। সময় মিনিটে দৌড়ে চলে গেল। বিমুগ্ধের চোখ মুখ পৃথিবীর মতই অন্ধকার হয়ে আসতে লাগল। সৃষ্টিকর্তা কি সময় থামিয়ে দিতে পারলো না? তিনি কেন এতটা কঠর? নীহারিকার ফোন বেজে চলেছে। বিমুগ্ধ হাত শক্ত করল। যতটা শক্ত করলে তার চামড়া ভেদ করে রক্তা ক্ত হয় হাতের তালু। কাঁচের রিমিঝিমি চুড়ি তার হাতে গেঁ থে গেল। নীহারিকা কি লক্ষ্য করল? হৃদয় আরও বি ক্ষত সে কি জানল? আজ অনেক দিন পরে জাওদের কল রিসিভ করল নীহারিকা। বিমুগ্ধ মনে মনে কোটি বার নিষেধ করল। কিন্তু প্রকৃতি তার বিরুদ্ধে। নীহারিকা ফোন রেখে ব্যাগ নিয়ে নিল বিমুগ্ধের হাত থেকে। দায়িত্ব কি কমে যাচ্ছে? কিছু দায়িত্ব তো কখনো ছাড়তে ইচ্ছে করে না। জীবনেও না। তাহলে কেন সে দায়িত্ব কমতে শুরু করেছে? নীহারিকা বিমুগ্ধের হাতটা সাবধানে তুলল। র ক্ত গ ড়িয়ে পড়ছে। একটা একটা করে চুড়ি সরিয়ে দিল। ব্যাগ থেকে বিমুগ্ধেরই দেওয়া রুমাল বের করল। হাতে পানি ঠেলে দিল। রুমাল চাপা দিল। স্বাভাবিক তার আচরণ। যেন বিমুগ্ধের হাত কাঁ টা উচিৎ ছিলো। ভয়াবহ উচিৎ ছিল। নীহারিকা কিছুই বলল না। সোজা হাঁটতে শুরু করল। পিছনে দাড়িয়ে রইল বিমুগ্ধ। সন্ধ্যা নামার মত সে নিশ্চুপ হয়ে পড়ল। তার আকাশ বাতাস জুড়ে কালো মেঘেদের সাথে অন্ধকারের মেলা বসেছে। নীহারিকা হঠাৎ ফিরে আসল। সামনে দাঁড়িয়ে গেল। বিমুগ্ধ সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেল। সে কখনো চায়নি নীহারিকা পিছনে ফিরুক। আসুক। কারণ সে জানে নীহারিকা কেন ফিরেছে। সে কি বলবে সেটাও জানে বিমুগ্ধ। সে শুনতে চায় না। পিছনে ফিরে গেল সে। নীহারিকা ঘুরে সামনে দাঁড়াল। সোডিয়ামের লাইট তার চোখ মুখ উজ্জ্বল করে তুলেছে। নীহারিকা অসম্ভব রকমের স্বর্গীয় হাসি দিয়ে বলল,’ আপনি কি জানেন আপনি খুব অসাধারণ মানুষ? আপনি সত্যি অসাধারণ। সাধরণের মত আচরণ আপনাকে মানায় না। অসাধারণ ব্যক্তিদের জন্ম হয় অসাধারণ কাজের জন্য। ভালো থাকবেন। যে ভালো থাকতে জানে না সে ভালোবাসতে জানে না।’
বিমুগ্ধ কঠিন চোখে তাকিয়ে বলল,’ তুমি কি আমাকে ভালোবাসা শিখাতে চাইছ?’
নীহারিকা উত্তরে হেসে বলল,’ হ্যা শিখাতে চাইছি। অনেক সময় অসম্ভব ভালোবাসতে জানে এমন মানুষকেও ভালোবাসা শিখাতে হয়। কারণ মানুষ ভালোবাসাকে জন্ম দেয় না। ভালোবাসা মানুষত্বকে জন্ম দেয়। ভালোবাসাকে আপনি আমি সাজাতে পারব না। ভালোবাসাই আমাদের সাজিয়ে তুলবে। সেই ভালোবাসা আপনি। যখন আপনি নিজেকে ভালোবাসবেন তখন আপনি গুছিয়ে উঠবেন। সেজে উঠবে আপনার জীবন। এটাই তো ভালোবাসা। আর যে ভালো থাকতে জানে না সে ভালোবাসতেও জানে না। আপনি ভালো থাকবেন।’
‘ তোমার বিয়ের কাজি কি আমি নিয়ে আসব? সাদা পাঞ্জাবি টুপি পড়ে? না কি আমি নিজেই কাজি হবো?’
নীহারিকা হাসতে লাগল। মাতাল করা বাতাসে সেই হাসি নেশা ছড়িয়ে দিল।
‘ না। কারণ আপনি এসব পারবেন না। আপনি শুধু ভালো থাকবেন। আপনি কি মাঝে মাঝে আমার সাথে দেখা করতে আসবেন?’
বিমুগ্ধ ঘুরে গেল। শুধু বিড়বিড় করল,’ রোজ সকালে তোমাকে দেখার ইচ্ছে বহু বছরের। আমি প্রতি সকালে তোমাকে দেখতে চাই।’
নীহারিকা অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। বিমুগ্ধ নিজেকে নিয়েই দাড়িয়ে রইল। নীহারিকা কি পা ষাণ! তার থেকেও চরম কঠিন ব্যক্তিত্বের অধিকারী সে। নীহারিকা শুধুই নীহারিকা। যার সাথে দেখা হওয়াও আকর্ষিক, আশ্চর্যজনক, কাল্পনীক, হঠাৎ, কাকতালিয়। কখনো কি তাদের পরিকল্পনা করে হাঁটা হয়েছে? আচ্ছা নীহারিকার ফোন নাম্বার কেমন হতে পারে? শূন্য দিয়ে শুরু? বিমুগ্ধ হাসল। ভালো থাকার হাসি কি এমনই হয়!
____________________
বানানে ভুল থাকলে ধরিয়ে দিবেন। রি-চেক সম্ভব হয়নি।
——
চলবে…
ভুলত্রুটি আল্লাহর দেওয়া সবচেয়ে সুন্দর গুন ক্ষমার চোখে দেখবেন। নিশ্চুয়ই ক্ষমা একটি মহান গুন।