প্রিয় সুখ-৪১
হাফসা আলম
___________________
দিন গুলো নীহারিকার যাচ্ছে খুব গোমড়া। বড্ড এলোমেলো। অগোছালো হয়ে উঠছে তার ভিতরের সবকিছু। জীবন খুব বিচিত্র। তার মনে হচ্ছে বিচিত্র এই জীবনে সে সেতু হয়ে ভূমিকা পালন করছে। সামনের বাড়িটির সাথে তাদের বাড়ির লম্বা বিবাদের সেতু। তার উপরে ভড় করেই যেন দুই বাড়ি খুব বিশ্রী ভাবে নিজেদের রাগ ক্ষোভ উড়াচ্ছে। নীহারিকা টিভি খুব কম দেখে। তা না হলে সে নিশ্চিত এমন কিছু সিনেমা পাওয়া যেত যেখানে এভাবেই দুই ভাই নিজেদের দা কোমড়ার সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। একটি দীর্ঘশ্বাস তার বুকের ভিতরে ঘুরছে। কিন্তু ফেলতে পারছে না। বাবা এসে দাড়িয়েছে পাশে। সামনের বাড়িটির নিখুঁত সাজগোছ দেখে তিনি নাক ছিটকে বললেন,’ দ্রুত লোক আসছে।’
নীহারিকা চোখ মুখ কিছুটা বিকৃত করে বলল,’ কেন?’
‘ এই বাড়ির চেয়েও সুন্দর করে সাজাবো সব। তুমি কোন চিন্তাই করবে না। আমি এই বিমুগ্ধ এবং তার নাক উচু বাপকে বুঝিয়ে দিবো আমার মেয়ে কত ভালো পরিবারে যাচ্ছে।’
নীহারিকার বলতে ইচ্ছে করছে বাবা তোমার নাকও খুব উঁচু। কিন্তু সে বলল না। কারণ বাবা কষ্ট পাবে। তবে সে বুঝতে পারছে না কতদিন নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে রাখতে পারবে। এরা যা শুরু করেছে দুই পরিবার! উঠানে ইচ্ছে মত ময়লা ফেলছে দুই ভাই। এ ওর বাড়ির দিকে। সাথে রোজ সকালে নতুন নতুন কাহিনী তো আছেই। দুই পরিবারের কাজের মানুষ এসব পরিষ্কার করতে গিয়ে হুলুস্থূর ঝগড়া লাগিয়ে ফেলছে। নীহারিকা প্রচন্ড রাগান্বিত। আজও সকালে ঝগড়া হয়েছে দুই কাজের মেয়ের মাঝে। এখন আবার বাবা শুরু করেছে! এরা আসলে চাইছে কি? নীহারিকা খুব শান্ত কণ্ঠে বলল,’ বাবা তুমি কেন বাচ্চাদের মত ঝগড়া করছ?’
‘ আমি করছি?’ বলেই তিনি একটু গম্ভীর হয়ে বললেন,’ এই নবীনকে আমার সহ্য হচ্ছে না। আরও অসহ্য কর তার ছেলে। বজ্জাত।’
নীহারিকার রাগ রাগ চোখ মুখ দেখে তিনি দমে গেলেন। ইদানিং বেশ ভয় লাগে তার নিজের মেয়েকে। গলা পরিষ্কার করে তিনি বেশ উচু গলায় বললেন,’ আজ জাওয়াদ আসবে তোমাকে নিয়ে একটু বের হবে বলল।’
‘ কেন?’ বেশ রেগেই বলল নীহারিকা। তার চোখ মুখ কঠিন।
‘ শপিং! হ্যা বিয়ের কেনাকাটা করতে নিয়ে যাবে। কিছুই তো কেনা হচ্ছে না তোমার পছন্দে। তাই সে নিতে আসবে। তুমি তৈরি হয়ে থাকবে কিন্তু।’
বলেই তিনিও কঠিন চোখমুখ করে চলে যাচ্ছেন। নীহারিকার দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসছিলো। ঠিক তখনই কেউ তার মুখের দিকে এক ছটাং পানি ছুড়ে মারলো। হতভম্ব নীহারিকা সামনে তাকিয়ে দেখছে রূবাইদা। জীবনে আরও একটি অশান্তির চাপ্টার। চাইলেও ক্লোজ করা যাচ্ছে না এসব। নীহারিকা মুখের পানি পরিষ্কার করে রাগে জড়জড়িত কণ্ঠে বলল,’ এটা কি ধরনের বেয়াদপী?’
রূবাইদা খুব ভালো মানুষী মুখ করে বলল,’ ভুল করে হয়েছে স্যরি নীহারিকা।’
‘ এধরনের ভুল যেন আর কখনো না হয়।’ বলেই সে চলে যাচ্ছিল। নীহারিকার রাগের মাত্রা সব সময় বেশি। এবং তার আশেপাশের মানুষ হয় এটাকে উপভোগ করে না হয় ভয় পায়। রূবাইদা একটু ভয় পায়। তবুও পূর্বের কি যেন রাগ মাথায় ঘুরে শুধু। সেই রাগের বশীভূত হয়ে সে আরও এক মগ পানি নীহারিকার শরীরে ছুড়েছে। রাগে পাগল হয়ে নীহারিকা এবার তার আচরণের বাহিরে কাজটি করল। সে এক বালতি পানি নিয়ে আসতে বলেছে মিতু আপুকে। মিতু আপুও ভয়ে আছে। রাগ উঠলে নীহারিকা ভয়ংকর হয়ে যায়। কোন ভাবেই এই রাগ নিয়ন্ত্রণে আসে না। রূবাইদা কাজটি করে ছুটে চলে গেছে ঘরে। নীহারিকা হঠাৎ হেসে ফেলল। চিৎকার করে বলল,’ আপনাকে আমি যেখানে পাবো ভিজিয়ে ছাড়ব। আমি মোটেও ভালো মেয়ে নই।’
নিজে নিজে সে হাসছে চেয়ারে বসে। আজকের সকলটাই ফালতু। তার শরীর এখনো ভিজা। রাগ রাগ সেই হাসির দিকে তাকিয়ে আছে বিমুগ্ধ। আজ অনেক দিন পরে সে দেখছে এই নারীকে। রাগেশ্বরীকে। তার ইচ্ছে করছে মেয়েটিকে তুলে নিয়ে যেতে। আচ্ছা বিমুগ্ধের মত ছেলেরা এসব করলে মানুষ নিশ্চয়ই অবাক হবে না! হওয়ার কথাই না। সে এখনো গভীর চোখে তাকিয়ে আছে। নীহারিকা এটা অনুভব করতে পেরে বাসায় চলে গেছে। তীব্র এক অপমান বিমুগ্ধকে ছুঁয়ে দিয়েছে। এই মেয়ে সুযোগ বুঝে তাকে শুধু অপমান করে! এটা কখনো সে মেনে নিবে না। কখনো না। সুযোগ বুঝে ফিরিয়ে দিবে।
________
সময়টা তখন বিকেল। গৌধূলীর রূপ ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে গাছপালার বুকে। শহর স্নিগ্ধ হাওয়ায় ভাসছে। নীহারিকাদের বাসার সামনে খুব সুন্দর একটি মাধবীলতা গাছ আছে। সারা বছর ফুলের মাধুর্যে বাড়িটি অত্যন্ত সুন্দর দেখায়। বিকেলে এক কাপ চায়ের সাথে এই গাছের সৌন্দর্য্য দেখতে দেখতে একটি খোলা বই পড়লে সত্যি জীবনকে অন্যরকম মনে হবে। নীহারিকার তো তাই মনে হয়। নিজেকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে সময় শেষ হয়ে যাবে তবুও ভাবনা শেষ হবে না। সে অতিরূপবতী গাছটির পাশ বেয়ে উঠে আসছে একটি অপরাজিতা, নীলকণ্ঠি গাছ। নীহারিকা মানতে পারছে না এটা। ফুল কখনো অপছন্দের বিষয় নয়। তবুও তবুও তার মাধবীলতার শরীরে অন্য ফুলের বসবাস মেনে নেওয়া নীহারিকার পক্ষে সম্ভব নয়। সে খুব ক্ষিপ্ত এই বিষয়ে। এবং তাকে রাগীয়ে দিতেই হয় তো এই কাজটি করা। সবচেয়ে বড় কথা এটি বিমুগ্ধ করেছে। কিভাবে যেন লোকটি মন পড়তে পারে। সে জানে নীহারিকা কি পছন্দ করে আর কি অপছন্দ করে। সে বুঝে নীহারিকার আত্মিক শান্তি কিভাবে বিনষ্ট করতে হয়। গেটের সামনে দাড়িয়ে নীহারিকা বিষয়টা দেখছে আর তার রাগের পারত বারছে। ইচ্ছে করছে বিমুগ্ধকে ধরে দুই একটা দিতে। সে জানে এটা কখনো সম্ভব নয়। বিমুগ্ধের সাথে কোথাও না কোথাও সে অন্যায় করেছে। জাওয়াদের নীল গাড়ি এসে দাড়িয়েছে। নীহারিকাকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে খুব দ্রুত সে নেমে তার জন্য দরজা খুলে দিয়েছে। মারাত্মক কিছু সুশ্রী পুরুষ আল্লাহ সৃষ্টি করেছে। নারী সৌন্দর্য্য তাদের কাছে ম্লান। জাওয়াদ তেমনই একজন মানুষ। খুব গোছালো। পরিপাটি। এই যে এখনো নায়কদের মত কোর্ট প্যান্ট টাই ঝুলিয়ে এসেছে। দেখে মনে হচ্ছে ইন্টারভিউ দিতে যাচ্ছে। নীহারিকার দিকে ফিরে নার্ভাস হয়ে হাসল সে। খুব গুছিয়ে বলল,’ তোমাকে সুন্দর লাগছে। এসো।’ নীহারিকা নিজের দিকে তাকালো। গম্ভীর কন্ঠে বলল,’ আমাকে? কোথায় আমার তো মনে হচ্ছে না।’
নীহারিকা মুখে মাস্ক পড়েছে। নবীন সাহেব দেখলেই তার দিকে অদ্ভুৎ ভাবে তাকিয়ে থাকে। বড্ড লজ্জা লাগে তখন। জাওয়াদ চেয়ে রইল কিছু সময়। তারপর খুব গোছানো গলায় বলল,’ তুমি সব সময় সুন্দর।’
‘ তাই বিয়ে করতে চাইছেন?’
‘ সেটা না। তোমার ব্যক্তিত্ব সুন্দর। যা আমার সাথে খুব যায়।’
নীহারিকা হেসে ফেলল,’ কিন্তু আপনার সাথে আমাকে যায় না। সুন্দর পুরুষ ভয়ংকর হয়।’
জাওয়াদ অতি আগ্রহের সাথে বলল,’ সব সময় দেখি সৌন্দর্য্য নিয়ে তোমার খুব অবজেকশন। কারণ কি? তুমি তো কখনো প্রেম করনি। ফলে কেউ ধোঁকাও দেয়নি।’
‘ এই যে আপনার সুন্দর চেহারা, ফিট বডি, নিশ্চয়ই জিম করেন?’
‘ অবশ্যয়। শরীর ফিট থাকা অত্যন্ত প্রয়োজন।’
‘ আর এই সুন্দর শরীর অবশ্যয় একজনের চোখে সুন্দর হওয়ার জন্য নয়। একজন সুন্দর মেয়ে বলুন বা ছেলে নিজেকে গুছিয়ে রাখে, সুন্দর প্রমান করতে চায় জগতের কাছে। আর এধরনের মানুষ আমার ব্যক্তিগত ভাবে অপছন্দ। আমি যেমন শুধু আমার মানুষের জন্য সৌন্দর্য্য প্রকাশ করব আমার মানুষও আমার সামনে সবচেয়ে সুন্দর ভাবে আসবে। সে জগতের কাছে অগোছালো, অনফিট হলেও আমার সমস্যা নেই।’
‘ তুমি কি চাইছ আমার পেট ইয়া বড় হয়ে যাক?’ জাওয়াদের ভয় ভয় চোখ দেখে নীহারিকা সত্যি মজা পাচ্ছে। কিন্তু রুক্ষ কণ্ঠ ধরে রেখে বলল,’ আরে না। শুধু আমার মতে এতো ফিটফাট হয়ে চলার পিছনের কারণ বললাম।’
‘ ঘুরে ফিরে তোমার পছন্দ কি ওই পুরুষের মাঝে?’
নীহারিকা চট করে পিছনে ফিরে তাকালো। বিমুগ্ধ আসছে। তার আজকের ভেসভুসা সব সময়ের মত উদ্ভট। একটি ক্রিম কালার শর্টস পড়েছে উপরে আকাশী শার্ট, হাতে তসবীহর মত সব ব্রেসলেট, গলায় ঝুলছে কয়েকটি অ্যাশ রঙ্গের চেইন, কালো দড়ি! দড়ি! হ্যা এই কথাটাই যাচ্ছে বিমুগ্ধের সাথে। তবে সবচেয়ে জঘন্য তার লম্বা করে খুলে রাখা শার্টের বোতাম। পর পর চারটা বোতাম খোলা। লমশ বুক খোলা পড়ে আছে। ভাঁজ গুলো বুঝা যাচ্ছে। রূবাইদা এসে হাত জড়িয়ে ধরলো। বিমুগ্ধ খুব শীতল চোখে একবার তাকাতেই ছেড়ে দিয়ে নীহারিকার দিকে তাকিয়ে বলল,’ কোথায় যাচ্ছো নীহু?’
প্রচন্ড অস্বস্তি, অনিহা, এবং বিরক্তির সাথে নীহারিকা চোখ সরিয়ে জাওয়াদের উত্তরে বলল,’ এদের আমার আরও অপছন্দ।’
জাওয়াদ প্রশান্তি অনুভব করছে। রূবাইদা আবার ভাঙ্গা বাংলায় বলল,’ এই নীহু কোথায় যাচ্ছো বলছ না কেন?’
‘ আমার পছন্দের মানুষ ব্যতিত কেউ নীহু ডাকলে আমি তাকে উত্তর দি না।’
অপমান! খুব লাগে। এই মেয়ে মুখের উপরে মাঝে মাঝে দুম করে কিছু কথা বলে দেয় খুব রাগ উঠে। এখনো উঠছে। কিন্তু বিমুগ্ধের কারণে দেখাতে পারছে না। শত হোক বহু কষ্টে সে নিজের স্বপ্ন পুরুষকে পেতে যাচ্ছে।
বিমুগ্ধ নিভৃতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে খুব সুন্দর একটি হাসি ঠোঁটে একে বলল,’ মিস নীহারিকা যে! কেমন আছেন?’
নীহারিকা যানে না আপনি সম্বোধনে তার কি হলো! শরীরে বিদ্যুতের গতিতে রাগ ছুটতে শুরু করেছে। মিষ্টি সুর টেনে সে বলল,’ ভালো আছি ভাইয়া। আপনি কেমন আছেন?’
ভাইয়া! বিমুগ্ধের সুন্দর হাসির মুখ মুহূর্তে নর্দমার ডুবন্ত মুখের মত কালো হয়ে গেছে। চোয়াল কি একটু কঠিন হয়েছে! আহ মনের প্রশান্তি। নীহারিকা শোধ তুলতে পেরে দারুন খুশি। বিমুগ্ধ তাকে কিছু না বলে জাওয়াদকে বলল,’ কোথায় যাচ্ছেন সার্জেন।’
জাওয়াদ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়েছে এমন ভাবে বলল,’ আমাকে বলছ?’
‘ না আমাদের পরিবারের নতুন সদস্যকে বলছি।’
‘ আসলে শপিং করতে যাচ্ছি।’
‘ ও মাই গড আমরাও তো যাচ্ছি। কি মিল বলুন তো! কোন শপিং মলে যাচ্ছেন শপিং করতে?’ বিমুগ্ধ খুব বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করছে। তার স্বাভাবের একদম বিপরীত। জাওয়াদ অবাক হচ্ছে মুহূর্তে মুহূর্তে।
‘ যমুনায়।’
‘ আরে আমরাও তো সেদিকে যাচ্ছি। চলো রূবাইদা মিষ্টার জাওয়াদের গাড়িতে করেই যাই।’
‘ কেন? তোমার গাড়ির কি হয়েছে?’ জাওয়াদ বিরক্ত হয়ে বলল। বিমুগ্ধ খুব সিরিয়াস ভঙ্গীতে বলল,’ আমি গাড়ি নিয়ে বের হলে আপনার গাড়ির সাথেই দূর্ঘটনা হবে।’
জাওয়াদ একটু ভড়কে গেছে। কারণ বিমুগ্ধের পূর্ব অনুমানের বিষয়টি সে মনে মনে বিশ্বাস করে। বহু বার তাকে এমন এমন কথা বলেছে সে যা সত্যি হয়েছে। তাই নীহারিকাকে বলল,’ তোমার সমস্যা আছে?’
নীহারিকা কিছু বলার আগেই বিমুগ্ধ বলে,’ কোন সমস্যা নেই। নীহারিকা উপকার করতে পছন্দ করে। তাই না?’
চোখ গরম করল নীহারিকা। গাড়িতে চড়ে বসতেই নিজের মুখ ইচ্ছে মত ঘষে লাল করেছে সে। রূবাইদাকে বিরক্ত লাগছে। রাগ লাগছে। অভিমান হচ্ছে। কেন? কেন? নীহারিকা তো এমন নয়। তার তো কাউকে হিংসে হওয়ার কথা নয়। অথচ মন হৃদয়ের মাঝে ছাই চাপা আগুনের তাপ উত্তপ্ত দুপুরের খাঁ খাঁ রৌদ্দুরের চেয়েও যেন একটু বেশি। একেই হয় তো বলে ভালোবাসার অগ্নী কিরণ!
সমস্ত পথ বিমুগ্ধ শুধু নীহারিকাকে দেখেছে। মেয়েটির রাগ সে দূর থেকেও অনুভব করতে পারে। রাগের কারণ কি হতে পারে ভাবতে ভাবতে শপিং মলের পার্কিং এরিয়ায় এসে উপস্থিত সকলে। নীহারিকা আগে আগে নেমেছে ঠিক। কিন্তু রূবাইদাকে অসহ্য লাগায় সে অনেকটা পিছনে হাটছে। নিজের মনের এই নির্যাতন আর নেওয়া যাচ্ছে না। সবার আগে সে পানি পান করেছে। বিমুগ্ধ কি তাকে ঝলসে দেওয়া অনুভূতি অনুভব করাতে চাইছে? তাহলে নীহারিকা বলবে সে জিতে গেছে। রূবাইদা নামক মেয়ে নয় শুধু বিমুগ্ধের আশেপাশের সকল নারীকেই তার ভালো লাগছে না। নীহারিকা নিজের বুক চেপে এক পাশে চুপ করে দাড়িয়ে ছিলো কিছু সময়। একটুও ভালো লাগা কাজ করছে না। বিমুগ্ধ বেশ সময় নিয়ে তাকে দেখছে। কি হয়েছে হঠাৎ! কোন এক ঝরা বৃষ্টির মাঝে বসে প্রেম স্নান দেখার সময় কবে আসবে সে জানে না। কিন্তু বড্ড ইচ্ছে। নীহারিকা বৃষ্টি অপছন্দ করে জানে সে। তবুও সে চায় একটি বৃষ্টির ঢেউ বুকে নিয়ে প্রেম জমিয়ে এই নারীর সাথে ভিজতে। কেন স্বপ্ন গুলো শুধু স্বপ্ন? বিমুগ্ধ হঠাৎ রেগে জিজ্ঞেস করল,’ কেন?’
জাওয়াদ অবাক হয়ে বলল,’ কি কেন?’
নিজেকে ঠিক করে বিমুগ্ধ চলে গেল উপরের দিকে। নীহারিকা এতো সময়ে অনুভব করেছে তার খুব কষ্ট হচ্ছে। অন্যরকম মন অভিমানের কষ্ট।
মেয়ে দেখতে গেলেও এতো খুঁত ধরে না যতটা জাওয়াদ ধরছে। তার এক কথা, বেস্ট জিনিস প্রয়োজন। নীহারিকার মত বেস্ট মানুষ তার জীবনে খুব কম এসেছে। এক কথায় প্রথমও। সে চায় সবচেয়ে সুন্দর সবচেয়ে দামি জিনিস পরিধান করে নীহারিকা তার সাথে তার বাড়িতে আসুক। প্রথমেই সে পছন্দ করতে বসেছে বউভাতের শাড়ি, লেহেঙ্গা। যা প্রায় এক ঘন্টা সময় পার করে ফেলেছে। তার কখনো কালো, কখনো লাল, কখনো হলুদ বা কখনো আকাশী পছন্দ হচ্ছে। একটা সময় সে বিরক্ত হয়ে বলল,’ সব প্যাক করুন।’
নীহারিকার ক্ষিপ্ত চোখমুখ।
‘ মানে কি? এতো সব নিয়ে কি হবে?’
‘ তোমার যখন যা ইচ্ছে হবে পড়বে।’
‘ আমি অপচয় পছন্দ করি না। এই এতো কিছু প্যাক করবেন না।’ ছেলেগুলো থেমে গেল।
জাওয়াদ বলল,’ আমার তো সব পছন্দ হচ্ছে আবার হচ্ছে না।’
‘ আমি দেখছি। আপনি প্লিজ এধরনের অদ্ভুৎ কাজ করা বন্ধ করুন। আপনার টাকা আপনি আপনার মানুষের জন্য উড়ান আমার জন্য নয়।’
‘ তুমি আমার আপন মানুষ নীহারিকা। সবচেয়ে আপন।’
নীহারিকা শুনেও না শুনার মত আছে। লোকটির প্রতি তার কখনো আগ্রহ জাগেনি। হয় তো বিয়ে হয়ে গেলে প্রেম, ভালোবাসা, আগ্রহ জন্মাবে। ‘ সত্যি কি তাই?’ যদি বিয়ের পরে সকল মানুষরের মনে ভালোবাসা জন্মাতো তাহলে কি কখনো বিচ্ছেদ হতো!
মুশকিল আসান বাবার মত বিমুগ্ধের আবির্ভাব। নীহারিকার মাথার উপরে একটি শাড়ি মেলে দিয়ে ভারী, নিম্ন স্বর যুক্ত কন্ঠে বলল,’ আপনাকে স্বপ্নের মত লাগছে নীহারিকা।’
সামনের চিকন আয়নায় নীহারিকা চমকে গিয়ে নিজেকে দেখছে। একটি রোজ পিংক শাড়ি। আঁচলে অসংখ্য মেজেণ্ডা সুতো, পাথরের কাজ। সৌন্দর্য্যের অনিন্দ্য রূপ। বুকের শব্দ নীহারিকা শুনতে পাচ্ছে। ধুকপুক ধুকপুক শব্দের উৎস তার হৃদপিণ্ড নামক বস্তু। বিমুগ্ধ ঠিক তার পাশে দাড়িয়ে। নীহারিকা বিমূঢ় হয়ে ছুঁতেই যাচ্ছিলো ঠিক তখনই রূবাইদা এসে শাড়িটি নিয়ে খুব আগ্রহের সাথে বলল,’ এটা সত্যি সুন্দর। তায আমি এটা পড়তে চাই আমার বউ ভাতে। তোমার আপত্তি আছে?’
নীহারিকা চোখ বন্ধ করে একটি বিষাক্ত নিঃশ্বাস টেনি নিলো। অত্যন্ত জেলাসী নামক বস্তুটি ফিরে আসছে একটু একটু করে। নীহারিকা তা দমনই করতে পারলো না। হঠাৎ তীব্র ক্ষোভ নিয়ে দোকানের কর্মচারীদের বলল,’ এই রং, এই কাজ, এই ডিজাইন ব্যতিত যা পারবেন সব দেখানো শুরু করুন। এটা অসহ্য কর একটি শাড়ি।’
নীহারিকা নিজের শরীরের সমস্ত অংশ থেকে সেটি সরিয়ে দিলো। তারপর যা সামনে পেয়েছে তাই পছন্দ করে নিচ্ছে এমন একটি ভাব নিয়ে সেই শাড়ি গুলোর তারিফ করছে। বিমুগ্ধ অনেক অনেক সময় নিয়ে একান্তে তাকিয়ে রইল নীহারিকার মায়াবি কঠিন মুখের দিকে। তার চৌকশ মস্তিষ্ক, খুব জ্ঞানী বাবা টাইপের হাবভাব এমন কি ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কিছুই এই মুহূর্তে নীহারিকার মনোভাব ধরতে পারলো না। সে বুঝতেই পারলো না নীহারিকা নামক কঠিন হৃদয়ের পাষাণ নারীর মন তার জন্যেই, তার জন্যেই বড্ড অস্থির, বড্ড চঞ্চল, বড্ড হিংসাত্মক। সে উল্টো ভাবলো এটা অপমান। বিগত দিন গুলোতে যা হচ্ছে সব সব অপমান। নীহারিকা চরম ভাবে তাকে অপমান করেছে। তার অনুভূতিকে অপমান করেছে। এর বদলা অবশ্যয় সে নিবে। হয় কাঁদিয়ে না হয় কেঁদে। নীহারিকার চোখের দিকে চেয়ে থেকে বিমুগ্ধ বুঝতে পেরেছে নীহারিকা প্রচুর কাঁদবে। হাউ মাউ করে কাঁদবে। তার বিয়ের দিন তার জন্য শুধু কান্না আর কান্না হবে!
__________
চারপাশ অন্ধকার আচ্ছন্ন। রাতের প্রথম ভাগ ধীরে ধীরে পৃথিবী নিজের কব্জায় বন্ধি করছে। কৃত্রিম আলোতে সমস্ত মল আলোকিত। হলুদ, সোনালী, সাদা পাওয়ার ফুল সব বাতি। নীহারিকা পার্কিং এরিয়ায় অপেক্ষা করছিলো। ঠিক তখনই তাকে এক প্রকার টেনে গাড়িতে বসিয়ে দিয়ে বিমুগ্ধ পাগলা ঘোড়ার মত করে সেই গাড়ি ছুটিয়ে নিয়ে গেলো। একটা মুহূর্ত, একটা সেকেন্ড নীহারিকা ভাবার সময় পেলো না। প্রচন্ড রাগে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে পিছনের সিট থেকেই এক প্রকার সামনে বিমুগ্ধের চুল টেনে বলল,’ আপনার সাহস কি ভাবে হলো আমার সাথে এটা করার?’
বিমুগ্ধ হতভম্ব গলায় বলল,’ রাগেশ্বরী এতো রাগ স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতি কর।’
রাগেশ্বরী! কত সময় পরে সে এই কথাটি শুনেছে? নীহারিকার রাগ একটু একটু কমে যাচ্ছে। লজ্জিত হয়ে সে পিছনে চেপে বসল। বিমুগ্ধ তাকে পিছনের সিটেই বসিয়েছে। তার কি মনে আছে নীহারিকা পিছনে বসতে পছন্দ করে? প্রতিটি মিনিট সেকেন্ড দ্রুত ছুটে চলেছে। নীহারিকা বলল,’ আমরা কোথায় যাচ্ছি?’
বিমুগ্ধ সরল মুখে বলল,’ বিয়ে করতে।’
‘ ফাইজালি করছেন?’
বিমুগ্ধ খুব আত্মপ্রত্যয়ী। তাকে মোটেও মজার মুডে লাগছে না। নীহারিকার ভয় হচ্ছে। কোন ভাবে মাথায় ব ন্দুক তাক করে বিয়ে করবে না কি? ঠিক তখনই বিমুগ্ধ নিজের লাইসেন্স করা রিভ লবারটি বের করে সামনে রাখলো। নীহারিকা চমকেছে, ভড়কেছে। খুব নিভু গলায় সে বলল,’ এটা কিন্তু ভালো হচ্ছে না।’
‘ অথচ বিগত কিছু দিন ধরে আমার সাথে আরও আরও জঘন্য হয়েছে। তুমি কি সেটা বুঝতে পারছ? অনুভব করতে পারছ?’
নীহারিকা চুপ করে আছে। গাড়ি একটি রেলস্টেশনে থেমেছে। নীহারিকা লক্ষ্য করেছে এটি তাদের প্রথম দেখা হওয়ার প্ল্যাটফর্ম। বিমুগ্ধ বলল,’ তোমার সাথে এক কাপ চা খাওয়া যাবে?’
নীহারিকা এই কন্ঠ, এই আকুলতা কখনো ফিরিয়ে দিতে পারবে না। সে খুব ভদ্র মেয়ের মত মেনে পড়ল। বিমুগ্ধ দুই কাপ কাচের পাত্রের চা নিয়ে আসল। টিস্যু দিয়ে খুব ভালো করে গ্লাসের আশেপাশে মুছে দিচ্ছে। নীহারিকা মনোযোগ দিয়ে দেখছে খুব বেপরোয়া, আই ডোন্ট কেয়ার ভাবওলা পুরুষটি তাকে নিয়ে সব সময় সিরিয়াস। নিকষ কালো আধারীর মাঝেও সে অনুভব করছে বিমুগ্ধ তাকেই দেখছে। তার দিকেই তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ ফিরিয়ে রেললাইনের অপেক্ষা দেখছে। অনেক অনেক সময় নিশ্চুপ দাড়িয়ে তারা। চা ঠান্ডা, পরিবেশ ঠান্ডা, শীত শেষের বসন্ত চলছে। প্রকৃতির সব সতেজ হয়ে উঠছে। গাছে গাছে নতুন ফুল টিয়া রঙ্গের পাতার জন্ম হচ্ছে। অথচ বড্ড রুক্ষতার সাথে বিমুগ্ধের ভিতরের সকল প্রেম, ভালোবাসা একটু একটু করে শুকিয়ে দাগ বসিয়ে দিচ্ছে। সেই ব্যথার দাগ যা জনম জনম ভোগাবে তাকে। কয়েকটি সতেজ পাতাই অবশিষ্ট। নীহারিকা কি তাদেরও আজ পায়ে পিষে চলে যাবে?
নীহারিকা দেখলো এক প্রকার দৌড়ে শান্ত, মুহিত, তিশা, মুহিতা, অর্পন এগিয়ে আসছে। নীহারিকা বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে বলল,’ আপনারা এভাবে কোথা থেকে আসছেন?’
‘ জাহান্নাম থেকে। ফেরেস্তা দৌড়ানি দিচ্ছে।’ শান্ত হাপাতে হাপাতে বলল। নীহারিকা যারপরনাই বিরক্ত। সে কিছু বলছে না। অর্পন একবার দেখল তাকে। মেয়েটা এতো বোকা কেন? বিমুগ্ধের মত ছেলেকে এভাবে ছেড়ে দিচ্ছে? আসলেই এটা সত্য কথা যে কারো ড্রিম বয় বা ড্রিম গার্ল কারো কাছে তুচ্ছ। নগন্য। সবার তো সব জায়গায় মূল্য থাকে না। অথচ আমরা সবাই সকলের চোখে নিজের জন্য মূল্য খুঁজে বেড়াই। যা অসম্ভব। মুহিত বলল,’ এই বিমুগ্ধ বস্তাটা গাড়িতে ফেলে এসেছি।’
‘ বস্তা দিয়ে কি হবে?’ অবাক হয়ে বলল নীহারিকা।
‘ তোমাকে ঢুকিয়ে নিয়ে পালাবো। কেন তুমি জানো না?’ মুহিতা বলল। নীহারিকা হেসে ফেলল। তিশা, মুহিতা তাকে জড়িয়ে ধরে বলল,’ তুমি আমাদের ভালো থাকতে দিচ্ছ না নীহারিকা। তোমার এই হাসি আমাদের বন্ধুকে নিঃশেষ করে দিচ্ছে একটু একটু করে। তার মুখের হাসি কেড়ে নিচ্ছে। কেন এমন করছ নীহারিকা? কেন?’
নীহারিকা চুপ করে দাড়িয়ে আছে শুধু। সত্যি কি এই চির সতেজ পুরুষের হাসি সে কেড়ে নিয়েছে?
তিশা বলল,’ পরিবার না মানলে নেই চলো বিয়ে করে নেও। শুনো এমন বহু প্রেমের বিয়ে হয়। একটা সময় পরিবার মেনেও নেয়। এটা কোন বিষয়ই না। পাশেই কাজি অফিস আছে। চলো।’
নীহারিকা আশ্চর্য্য হয়ে বলল,’ অসম্ভব। বাবা মাকে কষ্ট দিয়ে এভাবে বিয়ে করা সম্ভব নয়।’
‘ তাহলে তুমি শিকার করছো তোমাদের মাঝে প্রেমের একটি গুপ্ত বাগান আছে?’ অর্পন খুব ক্যাজুয়ালি বলল কথাটা। নীহারিকার থমথমে মুখ। সম্পর্কের কোন নাম নেই। কখনো প্রেমিক প্রেমিকার মত কিছুই হয়নি। তবুও এটা সত্য! চরম সত্য নীহারিকা এই অদ্ভুৎ মানবের প্রেমে বহু বছর আগেই পড়েছে। তাই তো সে চুপ করে আছে। একদম পানির মত ঠান্ডা তার চোখ। বিমুগ্ধ দাঁতে দাঁত পিষে বলল,’ অর্পন এরা এখানে কি করছে?’
‘ আমি কিছুই বলিনি। তুই ফোন করেছিলি যখন তখন পাশেই ছিলো সব। যেই বললি নীহারিকাকে নিয়ে তুই স্টেশনে যাচ্ছিল সব গুলো পিছনে লেগে আমাকে সহ নিয়ে এসেছে’
কন্ঠ খুব ছোট অর্পনের। বিমুগ্ধ ইদানিং একদম কুল থাকে না। খুব রেগে যায় অল্পতেই। খুব খুব অদ্ভুৎ আচরণ করে সে। এই যে এখন তার চোখ মুখ লাল। সত্যি ভালোবাসা মানুষের ভিতর থেকে সব উল্টেপাল্টে দেয়। বিমুগ্ধ সবাইকে ধমক দিয়ে বলল,’ যা এখান থেকে সব। আমি উনার সাথে আলাদা কথা বলতে চাই। একদম আলাদা।’
অর্পন সবাইকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। শান্ত দুঃখ দুঃখ মুখ করে বলল,’ বুঝি বুঝি, ভালোবাসার মানুষ পেয়ে বন্ধুরা হয়ে গেছে সুজি।’
বিমুগ্ধ সকলের সামনে থেকে নীহারিকাকে এক প্রকার টেনে নিয়ে আসলো একটি খালি বেঞ্চে। মানুষের ভীর চারপাশে। তবুও নীহারিকার কানে যেন শুধু বিমুগ্ধের কণ্ঠ বেজে চলেছে। বিমুগ্ধ নিরবে নিভৃতে নীহারিকার হাতটি নিজের গরম হাতের ভাজে নিয়ে বলল,’ রাগেশ্বরী আমাকে অনুভব করো। শুধু মাত্র আমাকে। এই পৃথিবীতে ভালোবাসাই যেমন সব নয় ঠিক একুই ভাবে পরিবারও সব নয়। সব কিছুর উর্ধ্বে তুমি নিজে। আমি তোমাকে পড়তে পারি। তুমি আমাকেই নিজের জীবনে সেই অংশ হিসেবে চাও যেই অংশের হাত ধরে বৃদ্ধ হওয়া যায়। তুমি কি অনুভব করতে পারছ আমার কথা?’
নীহারিকা কিছুই বলল না। সে চুপ করে অবুঝ, বোকা বোকা, অবলা এক বিমুগ্ধকে দেখছে। সব সময় খুব সুন্দর কথা বলতে পারা ছেলেটা কি ভীষণ এলোমেলো, বেসামাল কথা বলছে! বড্ড করুন তার সুর। বিমুগ্ধকে নীহারিকার একটি বাচ্চা ছেলে মনে হচ্ছে। যার চোখ জ্বলজ্বল করছে দুঃখে, আশায়। নীহারিকা কি তার সকল আশা পুরণ করে দিবে? বিমুগ্ধ পুনোরায় বলল,’ চলো বিয়ে করে নি। বিশ্বাস করো তারপর তোমার হিটলার বাবাকে আমি মানিয়ে নিবো।’
‘ আগে কেন মানিয়ে নেনি?’ নীহারিকার কণ্ঠ কি খুব রুক্ষ শুনালো। বিমুগ্ধ কেন যেন এই বিষয়ে রেগে যায়। নাফিস উদ্দিন তার সাথে যা করেছে তা সে কখনো ভুলবে না। তাই রেগে রেগে বলল,’ তোমার বাবা মোটেও ভালো মানুষ? সে বুঝে? বিরক্তি কর লোক।’
‘ তাহলে তার মেয়েও বিরক্তিকর। তাকে আপনার বিয়ে করতে হবে না।’
‘ নীহারিকা কেন রাগীয়ে দিচ্ছ আমাকে? বিগত কিছুদিন আমি জীবনে সবচেয়ে বেশি পরিমানে রেগেছি। আমার মস্কিষ্ক, আমার মন, আমার শরীর কিছুই আমার বসে নেই। তুমিও না।’
‘ সবাইকে নিজের বসে করতে চাওয়া বন্ধ করুন। অভিনেতা হিসেবে আপনি ভালো। কিন্তু বশিকরন হিসেবে নয়।’
‘ আচ্ছা। চা টা খাও।’ বিমুগ্ধ এবার একটু শান্ত। নীহারিকা চা শরবতের মত গিলে ফেলল।
বিমুগ্ধ হেসে বলল,’ রাতের চা এভাবে খেতে হয়?’
‘ আপনি প্লিজ কথা বলবেন না। আমার খুব খুব রাগ হচ্ছে।’ বিমুগ্ধ জানে নীহারিকা কেন রেগে যাচ্ছে। বিমুগ্ধ চিন্তা করল আসলেই কি সে নাফিস উদ্দিনকে রাজি করাতে পারত সেদিন? সেকি সত্যি চেষ্টা করেনি? কখনো করেনি? না কি করার মত করে করেনি?
নীহারিকা উঠে পড়ল। বিমুগ্ধের দিকে তাকিয়ে কঠিন সেই চেহারা ধারণ করে বলল,’ আপনি রূবাইদা আপুর সাথে ভালো থাকবেন। আমি হয় তো আপনার জন্য নই।’
নীহারিকার হাত পিছন থেকে ধরে বিমুগ্ধ উগ্র বেসামাল, উত্তেজিত হয়ে বলল,’ নীহারিকা তুমি আমার অনুভূতিকে অপমান করেছ। নীহারিকা তুমি আমার অনুভূতির মজা নিয়েছ। তুমি, তুমি আমাকে একটুও বুঝনি, তুমি আমার সবচেয়ে গোপনের, সবচেয়ে খুশির, সবচেয়ে সুন্দর, সবচেয়ে নিষ্পাপ ভালোবাসাকে এভাবে দুঃখ দিলে? তুমি কি বুঝ কাউকে প্রত্যাখ্যান করলে তার কেমন লাগে? তুমি কি সেই কষ্ট কখনো ধারণ করেছ? এই কষ্ট পৃথিবীর সকল কষ্টের মাঝের ভয়াবহ কষ্ট। এই কষ্ট আমার আত্মাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। আমার নিশ্বাস বন্ধ করে দিচ্ছে। তুমি আমার সাথে এতোটা কঠিন হতে পারো না রাগেশ্বরী।’
‘ আমি খুব সহজ বিমুগ্ধ। আপনি জটিল। আমি কখনো আপনাকে পড়তে পারি না। কিন্তু আজকে পারছি। আপনার বড্ড কষ্ট হচ্ছে। এই কষ্ট আপনার শরীরের সাথে সাথে চোখের মাঝেও ফুঁটে উঠেছে জমে থাকা রক্তের আকারে। কিন্তু আমি দুঃখিত। আমার হৃদয় আপনাকে দিতে পারলেও আমি আমাকে দিতে পারবো না। কারণ আমার হৃদয়ের মালিকিন আমি হলেও আমি আমার সেই বাবা মায়ের যারা আমাকে পৃথিবীতে নিয়ে এসেছে। তাদের সাথে প্রতারণা করতে পারবো না। কখনো না।’
নীহারিকা চলে যাচ্ছে বিমুগ্ধ চিৎকার করে বলল,’ তুমি খুব কাঁদবে একটা সময়। ভীষণ ভীষণ কাঁদবে। যেভাবে আমার হৃদয়কে কাঁদিয়েছ তুমি নীহারিকা। শুধু মাত্র তুমি।’ বিমুগ্ধের চোখ সত্যি কাঁদছে। জমে আছে পানি। একটি ধাক্কায় গড়িয়ে পড়বে তা। কিন্তু কোন এক জাদু বলে থেমে গেছে কোটরে। অর্পনের প্রথম খুব খারাপ লাগল। বিমুগ্ধের সকল বন্ধুরা নীহারিকাকে কত বুঝাতে চাইলো নীহারিকা কিছুই শুনলো না। বিমুগ্ধের দিকে পিছন ফিরে অবাক হয়ে শুধু বলল,’ আপনি আমাকে অভিশাপ দিচ্ছেন?’
বিমুগ্ধ করুন হেসে বলল,’ না। নিজেকে নিজে দিচ্ছি। আমাকে আজ বিয়ে না করলে তুমি পৃথিবীতে সবচেয়ে ভয়ংকর কান্নাটা কাঁদবে রাগেশ্বরী।’
‘ তাহলে কান্নাই হয় তো আমার জীবনের শেষ পরিণতি। কারণ বিয়েটা আমি কখনো বাবা মাকে ছাড়া করবো না। কখনো না।’
নীহারিকা চলে যাচ্ছে বিমুগ্ধ রেগে গজড়ে চিৎকার করে ডাকলো,’ নীহারিকা! নীহারিকা! রাগেশ্বরী!’
নীহারিকা একবারও পিছনে ফিরে তাকায়নি। অনেক দূরে হেঁটে চলে এসেছে সে। বুক চাপড়ে ধরে সে মাঝ রাস্তায় দম বন্ধ করে বসে পড়ল। তখন বসন্তের প্রথম বৃষ্টি ঝরঝর করে তার শরীর ভিঁজিয়ে দিলো। রাস্তায় রিক্সা, গাড়ি, সব থমকে গেছে। পরিবেশ ভারী হয়ে আসছে। নীহারিকা সত্যি অন্যরকম কষ্টে কাঁদছে। বুক চেপে ধরছে একটু পর পর। তার সমস্ত শরীর কাঁপছে ভয়ংকর ঝড়ের মত। আকাশের সব কিছু তার হৃদয়ের মতই মেঘলা। করুন। শীতল। বিমুগ্ধের অভিশাপ এতো দ্রুত লেগে গেল? নীহারিকার চিৎকারে আশেপাশের মানুষ জড়ো হয়ে দেখছে তাকে। মেয়েটির কি হয়েছে? সকলের মন পড়তে পারা পুরুষটি তার প্রিয় নারীর মান পড়তে পারেনি বলেই কি সে এভাবে কাঁদছে! তার এভাবে কষ্ট হচ্ছে! এতো এতো কষ্ট হচ্ছে যে সে সকলকে তার সাথে জড়ো করছে? বৃষ্টির পানির সাথে তাল মিলিয়ে ঝরছে বিমুগ্ধের অভিশাপ। নীহারিকার চোখের পানি।
‘ ভালোবাসা তুমি সব সময় স্বার্থপর। নিজের ইচ্ছেতে হাসাও। নিজের ইচ্ছেতে কাঁদাও। বাকি সবাই তোমার আরাধনায় বিভোর। তুমি কি বুঝো কত ভয়াবহ তোমার অস্তিত্ব! যা বিলিন করে দেয় সকলকে। শুধু রয়ে যাও তুমি। হয় কষ্টে না হয় আনন্দে।’
__________________
চলবে…
ভুলত্রুটি আল্লাহর দেওয়া সবচেয়ে সুন্দর গুন ক্ষমার চোখে দেখবেন। নিশ্চুয়ই ক্ষমা একটি মহান গুন। 🍁