প্রিয় সুখ-৪৪
হাফসা আলম
_______________
রাত জুড়ে চলা কালবৈশাখীর তান্ডবলীলা এখনো থামেনি। ঠান্ডা পরিবেশ। মন খারাপের হাজারো গল্পের জন্ম মৃত্যু হসপিটালের কড়িডোর বেয়ে চলে। কেউ নতুন জীবনীশক্তি নিয়ে পৃথিবীর আলোয় নিজের চক্ষু মেলে। কেউ বা সকল মায়া ত্যাগ করে অন্ধকার জগতে পাড়ি জমাতে চোখ বুজে। হসপিটাল শব্দের সাথে আনন্দের সম্পর্ক খুব একটা নেই বললেই চলে। যা একটু আনন্দের রূপ রেখা আছে তাও মানুষের কান্নার জলে প্রবাহিত হয়ে দূরে ছিটকে পরছে। মিতু আপুর প্যাঁচ প্যাঁচ কান্নার বিশ্রী শব্দ শাহিন ভাই কিভাবে সহ্য করছে বুঝতে পারছে না ফাবিহা। এতো এতো দুশ্চিন্তার মাঝেও খুব বিরক্ত সে। নীহারিকার হলুদ শাড়িটি কুঁচকে আছে। হাতে, গলায় মাথার ফুল গুলো নিজেদের সৌন্দর্য্য হারিয়েছে বহু আগে। কালছে দাগ জন্মেছে তাদের শরীরে। সকলে এক নজর এই হলুদ থেকে উঠে আসা মেয়েটিকে দেখছে। সামনে হাঁটতে হাঁটতে চোখ তাদের ঘুরে ফিরে মেয়েটির রক্তিম অবিন্যস্ত মুখশ্রীতে করণার দৃষ্টি ছুঁড়ছে। মিতু আপু কান্না গুন গুন শুনাচ্ছে। নাক টানছে জঘন্য ভাবে। শাহিন ভাইয়ের সাদা পাঞ্জাবিটার গজব বেইজ্জতি। একটি ধমক ভেসে আসল হলুদ সাজের কন্যাটির থেকে,’ মিতু আপু এবার চড় খাবি। এভাবে কাঁদছিস কেন?’
নীহারিকার চোখের লালাভ রেখায় ভয় পেয়ে গেলেন মিতু আপু। শাহিন ভাইয়ের বাহু জড়িয়ে কান্নার বেগ সীমিত করে বললেন,’ তো কি করব বসে থেকে?’
‘ তাই বলে কাঁদবি এভাবে? হসপিটালে বহুত রোগী আছে। সো প্লিজ চুপ কর আপু।’ ফাবিয়া বোনকে শাসন করলো। মিতু আপুর খুব কষ্ট হচ্ছে। বুক ভার হয়ে কান্না বেয়ে পড়ছে গালে। খুব করুন সুরে তিনি বললেন,’ আমি কি করবো? কিছুতেই কান্না থামছে না। বিশ্বাস কর ইচ্ছে করে করছি না।’
ফাবিহার ভ্রু কুঁচকে এসেছে। এক প্রকার তেড়ে তুড়ে এসে বলল,’ তোর আর নীহুর ঢং সহ্য হচ্ছে না। দুইটাই তো জাওয়াদ জাওয়াদ করে মরে যাচ্ছিলি। এখন মরা কান্না জুড়েছিস কেন? সুন্দর পোলাটা হাতছাড়া হবে হবে তাই?’
মিতু আপুর চোখ মুখে অসহায় ভাব ফুটে উঠেছে।
‘ আমি কি ইচ্ছে করে এমন করেছি না কি? আর তাযিন ভাই কি শুধু তোর কাজিন? আমাদের না? আমি তো আর জানতাম না সে এতো ভালোবাসে নীহারিকাকে। যদি জানতাম তাহলে নীহারিকাকে বেঁধে হলেও উনার গলায় ঝুলিয়ে দিতান বিশ্বাস কর ফাবু। বিশ্বাস করেন শাহিন ভাই।’ শাহিন ভাই বিশ্বাস করলেন। বউয়ের সব কথাই তিনি বিশ্বাস করেন। বউয়ের কান্না বন্ধ করতে তাই একটু ন্যাকা সুরে বললেন,’ অবশ্যয়। তুমি কি আর ওতো বুঝো? বাচ্চা একটা মেয়ে। ওর তো কোন দোষ নেই ফাবিহা।’
‘ হ্যা উনি কচি খুকি।’ মুখ বাঁকিয়ে আবার নিজের চেয়ারে বসলো সে। নীহারিকার সর্বক্ষণ রেগে থাকা সেই চোখ দুটি শান্ত নীড়। দৃষ্টি নিবন্ধ আইসিইউর সেই কাঁচে। ভিতরের মানুষটা বুঝি তার খুব কাছের? নীহারিকা দু হাতে মুখ ঢেকে কাঁদছে। যে কান্নার কোন শব্দ নেই। কোন আওয়াজ নেই, নেই বিরক্তি। শুধু উড়ে বেড়াচ্ছে এক বুক আহত হৃদয়ের করুন ব্যথা। পরিবারের সকলের চোখ একবার করে তাকে ঘুরে ঘুরে দেখছে। এতো বিষন্ন, উদাসীন, ক্রন্দনরত নীহারিকা কি কখনো তাদের চোখে পড়েছিলো? আফিয়া বিলকিস নিজের কঠিন, শক্ত হৃদয়ের মেয়েটিকে এভাবে আবেগী শিশুদের মত কাঁদতে দেখে ভয় পেয়ে গেলেন। কাছে ছুঁটে জড়িয়ে ধরে মাথাটা বুকে চেপে বললেন,’ সব ঠিক হয়ে যাবে নিহারিকা। তুই এভাবে কাঁদছিস কেন মা?’
মায়ের ছায়া তলে নীহারিকার কান্না যেন বাধন ছাড়া হয়েছে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে সে কাঁদছে। ছোট খালামনি এগিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। ধমকের সুরে আদর মেখে বললেন,’ তোর যে আমাগো তাযিনরে এতো ভালো লাগে কইবি না। তোর বাপরে কি আমরা ডরাই।’
দুলাভাইয়ের দিকে আড়চোখে একবার তাকালো। তিনি নিস্তব্ধ রজনী যেন। নীহারিকা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল,’ সব আমার জন্য হয়েছে খালামনি। সব আমার জন্য।’
‘ তোর তো কোন দোষ নেই। বাধ্য মেয়েরা সব সময় বাবা মায়ের কথায় জীবনও দিতে পারে। সবাই কি তোগো মিতু আপু!’
নিজের নাম ভৎসনার সুরে শুনেই মিতু আপুর রাগ হলো। রক্তাভ চোখ মুখ নিয়ে উঠে আসতে চাইলো মায়ের সাথে ঝগড়া করার জন্য। সে কি শুনেনি মা বাবার কথা? তার মত কপাল যদি নীহারিকারও হতো? হঠাৎ এমন চিন্তায় মিতু আপু আবার কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছে। এবার শাহিন ভাই বিরক্ত হয়ে তার চোখ মুখ হাত দিয়ে মুছে পরিষ্কার করে দিলেন। চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন,’ তোমারে না কইছি আমারে ছাড়া কারো জন্য কাঁদবা না? এবার চুপ করো। বহুত কাজিন প্রীতি হইছে।’
এই জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন দুটি হৃদয় ভিন্ন ভিন্ন স্থানে অবস্থান করছে। নীহারিকা নিজের বুক চেপে মায়ের কোলে শুয়ে আছে। বিমুগ্ধ কাঁচে ঘেরা রুমে জ্ঞান হারানো মানুষ তখন। নীহারিকা তার মায়ের দিকে অশ্রুতে ভেজা চোখে তাকিয়ে ভাঙ্গা গলায় বলল,’ উনি এমন কিছু করবে আমি ভাবতেই পারিনি মা। আমার এতো কষ্ট হচ্ছে কেন? কত র ক্ত ছিলো! সে এতো পাগল কেন মা? আমি কি খুব স্পেশাল? আমাকে পাওয়ার জন্য কি জীবন দেওয়া খুব বেশি জরুরি?’
নাফিস উদ্দিন উঠে এসে মেয়ের পাশে বসলেন। তার চোখ মুখের থমথমে সেই ভাব একটুও সরলো না। বাবাকে পেয়ে অন্যসময়ের নীহারিকা খুব ভয় পেতো। কিন্তু আজ দু হাতে তার পেট জড়িয়ে ধরে বলল,’ বাবা উনি একটু অদ্ভুৎ, উশৃঙ্খল পোশাক পড়ে। নিজের মর্জির মালিক। কিন্তু দিন শেষে সে তোমার মেয়ের মনের মাঝের শক্ত হৃদয়টি নাড়িয়ে দিয়ে এভাবে শুয়ে আছে কেন? কেন?’
খুব আবেগী শুনালো কথা গুলো? হয় তো। তবুও নীহারিকার চোখের জল থামলো না। সে কাঁদছে। বিমুগ্ধের দেওয়া অভিশাপ নিশ্চয়ই মনের গভীর থেকে দেওয়া। তাই তো এভাবে প্রতিফলিতো হচ্ছে। মেয়েকে কোন ভাষায় সান্ত্বনা দেওয়ার নেই নাফিস উদ্দিনের। তিনি নবীন উদ্দিনের দিকে রোষাগ্নি নজরে তাকালো। চোখের ভাষায় তার ছেলের প্রতি খুব বিরক্তি। যেন জ্ঞান ফিরলেই এক চড়ে আবার অজ্ঞান করে ছাড়বে। সকল প্রেম ছুটিয়ে দিবে বেয়াদপ ছেলেটার। দাঁতের ফাঁক গলে হঠাৎ বের হয়ে আসলো,’ ইতরটার জ্ঞান ফিরুক একবার।’ কান্নায় বিভোর থাকা নীহারিকা শুনলো না সেই কথা।
বিমুগ্ধের চোখের পাতা ভারী। তীব্র ঔষুধের ঘ্রাণ চারপাশে। হসপিটালের সাদটাই বিশ্রী। চোখ খুলে নিজেকে সে বেডের সাথে লেপ্টে থাকা অবস্থায় আবিষ্কার করলো। এতো খারাপ অবস্থায়ও তার মস্তিষ্ক চেতনা ফিরে পেতে সবার আগে যেটা চিন্তা করলো সেটা মুখের শুস্কতা গলিয়ে একটু একটু বের হয়ে আসছে। কর্তব্যে ব্যস্ত নার্স তার মুখের কাছে কান নিয়ে শুনলো সে বলছে,’ কয়টা বাজে?’
নার্স অবাক হয়ে গেলো। এই সময় কেউ সময় জিজ্ঞেস করে? সে ডাক্তারকে ডাকতে যাওয়ার আগে বলল,’ মধ্যদুপুর তিনটা বিশ মিনিট।’
বিমুগ্ধ হঠাৎ খুব উত্তেজিত হয়ে গেলো। সে উঠে বসতে চাইছে। তা পা নাড়াতে পারছে না তীব্র ব্যথায়। অস্ফুটে ভয়াবহ চিৎকারে নার্স পুনরায় ছুঁটে আসলো। বিমুগ্ধ মাথা চেপে ব্যথিত কন্ঠে বলল,’ হসপিটালে কে কে আছে? আমি কখন থেকে হসপিটালে? আমার এখনই যেতে হবে? আরে ধুর আপনি আমাকে আগে জাগিয়ে দিবেন না? সব শেষ হয়ে গেছে নিশ্চয়ই!’
নার্স হতভম্ব গলায় বলল,’ আপনি তো অজ্ঞান ছিলেন। আর আপনাকে কড়া ঔষুধ দেওয়া হয়েছে, স্টিচ করা হয়েছে ক্ষত স্থানে। আমি কিভাবে আপনাকে জাগিয়ে দিবো?’
কিছুই শুনতে চাইলো না বিমুগ্ধ। হাতে রক্তের নল সে টেনে খুলতে চেষ্টা করছে। হাত পৌছাচ্ছে না।
‘ রাগেশ্বরী কোথায়? উনাকে ডেকে দিন। উনি কি বিয়ে করে নিয়েছে? আপনি কথা বলছেন না কেন? বিয়ে করে নিয়েছে কি? আজকে উনার বিয়ে ছিলো? আর আমি এখানে পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছিলাম। সব আপনাদের জন্য হয়েছে। আমি কাউকে ছাড়বো না। সব শেষ করে দিবো।’ এক হাতে সে যন্ত্রপাতি সব ছুড়ে ফেলে দিলো। ভয়ে নার্স দৌড়ে ডাক্তারকে ডাকতে গেছে। ডাক্তারের পাশে জাওয়াদকে দেখে বিমুগ্ধ আরও পাগল হয়ে গেলো যেন। তার ভাঙ্গাচূড়া শরীর টেনে তুলে কলার জড়িয়ে টেনে কাছে নিয়ে আসলো। জাওয়াদ হকচকিত গলায় বলল,’ তাযিন কি করছ? মরতে চাও না কি? তোমার মাথা হাতে পায়ের অবস্থা খুব খারাপ।’
‘ আমাকে নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না। তুই নিশ্চয়ই বিয়ে করিসনি? বল?’
জাওয়াদের মুখের ভাষা জাদু বলে আটকা পড়েছে। তুই! বিমুগ্ধকে সে অনেক বছর ধরে চিনে। কিন্তু এভাবে তাকে কখনো আচরণ করতে দেখেনি সে। তুই বলে তো সে খুব একটা মানুষকে ডাকেও না। অথচ আজ সে কি না তাকে তুই তাকারি করছে? বিমুগ্ধ নিজের হাত তুলতে পারছে না। ব্যথায় করুন আর্তচিৎকার বের হয়ে আসছে তার মুখ থেকে। ক্ষত স্থান গুলো নিশ্চয়ই আরও বেশি আহত হচ্ছে। জাওয়াদ কিছুতেই তাকে শান্ত করতে পারছে না। অনেক ডাক্তার নার্সকে রুমের ভিতরে এভাবে ছুটতে দেখে সকলে চিন্তিত হয়ে উঠেছে। কিছু ঘন্টা পূর্বেই বিমুগ্ধকে কেবিনে শিফট করা হয়েছে। নবীন উদ্দিন নার্সকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন,’ কি হয়েছে?’
নার্সের মাথায় দুশ্চিন্তার ছাপ।
‘ আর বলবেন না আপনাদের পেশেন্ট তো পুরো পাগল হয়ে গেছে। এমন রোগী আমি জীবনে দেখিনি। ডাক্তারকে ধরে মারছে। মনে হয় প্রেমিকার বিয়ে হয়ে গেছে সেই শোকে পাগল হয়ে গেছে বেচারা।’
ছেলে পাগলামী করছে শুনে নবীন উদ্দিন যেন মুহূর্তে শান্তি পেলেন। এমন ভাবে সিটে বসে গেলেন তাকে দেখলে কেউ বলবে না সে ছেলের বাবা। নার্সকে রিকোয়েস্ট করে বললেন,’ আমাকে একটি খবরের কাগজ দিয়ে যাবেন প্লিজ। দেশের অবস্থা দুই দিন ধরে জানতে পারছি না। একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে এটা জঘন্য অপরাধ।’
নার্স হা করে তাকিয়ে আছে। মনে মনে বলছে শুধু ছেলে না এই পরিবারের বেশিরভাগই তো দেখছি পাগল।
নাফিস উদ্দিন দেখলেন তার সম্মানীত বড় ভাই ওয়ানটাইন গ্লাসে করে চা খাচ্ছে আর খবরের কাগজে দেশের এখনকার অবস্থা পড়ছে। ইউনুস সাহেবের উপরে খুব খুশি হয়ে তিনি বললেন,’ ভাবতেই গর্ব হচ্ছে আমেরিকার গরু গুলোও এখন আমাদের কদর বুঝবে। দেখ কত সম্মানটম্মান দেখাচ্ছে।’
ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে শুধু দীর্ঘশ্বাসই ফেললেন তিনি। নবীন উদ্দিন অর্ধেক চা এগিয়ে দিয়ে বলল,’ খাবি? না খেলে এমন নজর দিচ্ছিস কেন? তোর মেয়ের জন্য একটা নিয়ে আয়। আমি টাকা দিচ্ছি। সে চা খেতে খুব পছন্দ করে।’
নাফিস উদ্দিন রেগে বললেন,’ তোর মনে হয় না তুই আর তোর ছেলে মিলে আমাদের জীবনটা জটিল করে দিচ্ছিস?’
নবীন উদ্দিন সুন্দর হাসলেন। কোনো কথাই আপাততো তার গায়ে লাগছে না। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন,’ তোদের অবস্থা এখন বাংলাদেশের মত। তোরা আগেই জটিল অবস্থায় ছিলি। যখন আমরা ঠিক করতে আসছি তোদের জীবন, তখন তোদের মনে হচ্ছে জীবন আরও জটিল হয়ে গেছে। আরে ঘর পরিষ্কার করার জন্য এবং সুন্দর করে সাজানোর জন্য আসবাবপত্র সরাতে হবে, রং করতে হবে এবং একে একে সাজিয়ে তুলতে হবে। পরিশ্রম দিতে হবে। এসব না করে স্তুপের উপরে শুয়ে শুয়ে তোরা বলছিস জটিল করছি। ধর চা খা। তারপর গুছিয়ে দিবো সব।’
নাফিস উদ্দিন আহাম্মকের মত চা হাতে বসে রইলেন। বেশিক্ষণ পারলেন না। ভাইয়ের ছেলে হসপিটাল মাথায় তুলে নিয়েছে। অসুস্থ একটা ছেলে এমন পাগলামী করছে? তার মেয়ের নাম ধরে চিৎকার চেঁচামেচি করছে! তিনি থাকতে না পেরে চা সহ উঠে আসলেন। সকলের ভীর ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করেছেন। পরিবারের কেউ ভয়ে ঢুকছে না। বিমুগ্ধ বিছানার পাশে ছোট স্টিলের টেবিল উপর করে ফেলে দিয়েছে। বালিশ ছুঁড়ে ফেলেছে। র ক্তের ব্যাগ, স্যালাইন ফেলে দিচ্ছে। আর ভয়াবহ চিৎকার করে বলছে,’ আমাকে যেতে দিচ্ছেন না কেন? আমি দেখতে চাই সে কিভাবে বিয়ে করতে পারে? আমি খুন করবো সবাইকে বের হতে না দিলে। জাওয়াদ তোকে রেললাইনে ছুঁড়ে মারবো। চলন্ত রেলে থেতলে তোর চেহারা কেমন হবে তখন? নীহারিকাকে ডাকছেন না কেন আপনারা? এই রাগেশ্বরী…’
সামনের দরজায় তাকিয়ে বিমুগ্ধের হাত থেমে গেলো। সে বুঝতে পারছে খুব ভুল করে ফেলেছে। ছোট বাবার চোখ হঠাৎ করেই বিমুগ্ধের আতঙ্ক মনে হচ্ছে। কোন ভাবে কি সে এই লোকটিকে ভয় পাচ্ছে? আরে না না! নাফিস উদ্দিন ক্রুদ্ধ গলায় বললেন,’ ফাইজলামী বন্ধ করো তাযিন। নাটক কি কম হয়েছে এখন পর্যন্ত? তুমি আবার শুরু করেছ? প্রথমে আমার মেয়ের বিয়েটা নষ্ট করলে। এখন হসপিটালের পরিবেশ। তোমার মত ইতরদের আমি এক চড়ে ঠিক করতে পারি।’
বিয়ে নষ্টের কথা কানে পৌছাতেই বিমুগ্ধের মনে হলো বসন্ত নিজে হেঁটে তার হৃদয়ে এসে উপস্থিত হয়েছে। সে একদম শান্ত হয়ে গেছে। বিছানায় বসে মিষ্টি করে হাসলো। পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো, ভদ্র ছেলেটির মত করে বলল,’ স্যরি ছোট বাবা। আমি ভেবেছি আপনি আমার সাথে গেম খেলবেন। সুযোগের সৎ ব্যবহারে তো আপনি ওস্তাদ।’ বলেই সে সকলের সামনে চোখ মারলো। নাফিস উদ্দিন ভড়কে গেছে। এই ছেলে তো বিখ্যাত বেয়াদপ। এর সাথে মেয়ে বিয়ে দিলে মেয়েটার সাথে ভবিষ্যৎ প্রজন্মও ঝুঁকিতে পারবে। তার উপরে তিনি আবার কথা দিয়ে বসে আছেন। নিজের উপরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ঠান্ডা চা বিমুগ্ধের মুখে ছুড়ে মেরে বের হয়ে যাচ্ছেন। পিছন থেকে বিমুগ্ধের উচ্ছ্বাসিত কন্ঠ শুনতে পেলেন।
‘ ছোট বাবা আপনাকে ধন্যবাদ এই দানের জন্য। প্রতিদান হিসেবে আমি দ্রুত আপনাকে নানা হওয়ার সুযোগ করে দিবো।’
নাফিস উদ্দিন তেড়ে এসে বললেন,’ তোমার এই সুযোগ তোমার কাছে রাখো ইতর ছেলে। আমি তোমাকে মেয়ে দিচ্ছি না।’
‘ নাউজুবিল্লাহ দানের জিনিস ফিরিয়ে নেওয়া যায় না ছোট বাবা। আমি দিচ্ছি না আমার জিনিস।’
‘ আমি বলেছি তোমাকে দেখবো কিন্তু তুমি যা শুরু করেছ কোন সুযোগই দিবো না।’
বিমুগ্ধ পুনরায় উত্তেজিত হয়ে বলল,’ আপনি এটা করতে পারেন না।’
‘ আমি সব পারি।’
‘ আচ্ছা আচ্ছা কোন প্রকার বেয়াদপি করবো না। আমি ভদ্র ছেলে।’
বিমুগ্ধ নিজের ঠোঁটে হাত চেপে বসে গেলো। নাফিস উদ্দিনের কপাল থেকে রাগ ভাব সরে গেছে। কিন্তু সেটা প্রকাশ করলেন না। বিমুগ্ধের প্রচুর ব্লাড লস হয়েছে। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় কেঁটেছে। তার মাঝে এমন এলোমেলো আচরনে অবস্থা খুব একটা ভালো না। বেশিক্ষণ সে থাকতে পারলো না। পুনরায় জ্ঞান হারিয়েছে। নাফিস উদ্দিন ছুটে এসে তাকে ধরতে পারলেন না। বিছানা ঘেসে সে পড়তে পড়তে বলছে,’ আমি জগতের সবচেয়ে ভালো ছেলে হয়ে যাবো আপনার মেয়েকে পেলে। বিশ্বাস করুন আমি সব খারাপ জিনিস জীবন থেকে বাদ দিয়ে দিবো। সবকিছুর বিনিময়ে শুধু এবং শুধু আপনার মেয়েকে চাইছি।’
বাকিটুকু সে বলতে পারলো না। কিছুক্ষণ আগের পাগলামী তার উপরে ভারী হয়ে পড়েছে। লুটিয়ে পড়েছে সে। কপালের এক পাশে তিনটা সেলাই পরেছে। প্রচন্ড তীব্র ভাবে আঘাত মাথায় লাগায় তার অবস্থা খুব একটা ভালো ছিলো না। তার উপরে কিছুক্ষণ পূর্বের কাজে জাওয়াদ প্রচন্ড রেগে গেলো। সে বের হয়ে আসছে কেবিন থেকে। এই ছেলেটা তার জীবন নরক যন্ত্রণায় তলিয়ে দিচ্ছে দিন দিন। জাওয়াদের মনে তীব্র একটি বেদনা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে বার বার। সে সৃষ্টিকর্তার কাছে জিজ্ঞেস করছে,’ কেন আমাকে তাযিনের সাথে পরিচয় করিয়েছেন? করিয়েছেন যখন তখন কেন আমার সবচেয় ভালো লাগা, সবচেয়ে ব্যক্তিগত, সবচেয়ে ভালোবাসার নারীটিকে তার সামনে নিয়ে আসলেন? সবচেয়ে বড় আক্ষেপ আপনি কেন সেই নারীর হৃদয়ে আমার জন্য এক বিন্দু স্থান রাখলেন না?’
আপনাকে প্রশ্ন করে কি আমি খুব পাপ করে ফেলছি?’
‘ ডাক্তার! এই যে ডাঃ জাওয়াদ!’ জাওয়াদ পিছনে ফিরতে চাইলো না। তবুও এই ডাক তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে নিজের সাথে। নীহারিকা নিজেই তার সামনে চলে এসে উদ্বিগ্ন ভাঙ্গা স্বরে জানতে চাইলো,’ বিমুগ্ধ কেমন আছে?’
জাওয়াদ শুধু তাকিয়ে রইলো নীহারিকার সেই ভেজা, লাল হয়ে যাওয়া চোখ মুখের দিকে। প্রশ্নটিকে উপেক্ষা করে সে বলল,’ বিমুগ্ধের ভাগ্য ভয়ংকর লেভেলের ভালো।’
আর্দ্র মিশ্রীত কষ্টের চোখটি জাওয়াদের চোখের দিকে উঠে আসলো। জাওয়াদ তাকিয়ে রইলো নীহারিকার হলুদ শাড়িটির দিকে। সে খুব পছন্দ করে কিনেছিলো। সত্যি হৃদয়ে কারো জোর চলে না। একজন মানুষ আপনার সকল সম্পদ, অর্থ, সকল অনুভূতিকে গায়ে জড়িয়ে নিলেও যদি তার হৃদয় আপনার না হয়! তাহলে আপনি ব্যর্থ। সে কখনো আপনার হবে না।
হৃদয় মানুষকে বাঁধে অদৃশ্য একটি মায়ার সুতোতে। কোন কিছুর বিনিময়ে সেটি জোড়া লাগে না, এবং ছিন্নও হয় না। শুধু হৃদয়ের মায়ায় হৃদয় বন্দি হয়।
নীহারিকা বুঝতে পারছে জাওয়াদের মন খারাপ। তবুও জিজ্ঞেস করলো,’ ভালোই তো ভাগ্য গণনা করতে পারছেন। তা বলুন তো আমার ভাগ্য কেমন?’
‘ সেটা প্রচন্ড প্রচন্ড ভয়ংকর পর্যায়ের, ভয়ংকর রকমের, ভয়ংকর অনুভূতি দিয়ে তৈরি ভাগ্য। সৃষ্টিকর্তা কেন এমন ভাগ্য তোমাকে দিয়েছে আমি জানি না। শুধু অনুভব করছি সে তোমাকে খুব পছন্দ করে নীহারিকা। মারাত্মক পর্যায়ের পছন্দ যাবে বলে।’
_______
পরিবারের সকলে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে বিমুগ্ধের কেবিনে। মিতু আপুর হাউমাউ কান্না দেখে স্বয়ং বিমুগ্ধও বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছে। সে বেশ সময় নিয়ে উনার কান্না দেখে বললেন,’ এতো কাদছেন কেন মিতুয়া? আপনার শ্বশুড়ি এসেছে যান তার যত্ন করুন।’
মিতু আপু আতঙ্কিত হয়ে গেলো। তখনই ফোন বেজে উঠেছে। শাহিন ভাই দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বিমুগ্ধের এই পূর্ব অনুমান শক্তিটি মাঝে মাঝে এতো আতঙ্ক নিয়ে আসে!ফোন ধরে বুঝলেন সত্যি তার মা এসেছে। মিতু আপু বিরক্ত হয়ে বলল,’ অনুমান শক্তি আপনার জঘন্য।’
বিমুগ্ধ হাসছে। সে চাইছে সকলে বের হয়ে যাক একে একে। কিন্তু কেউ যাচ্ছে না। আফিয়া ছেলেটির বেন্ডেজে হাত বুলিয়ে বলল,’ এমন কেউ করে বাবা? যদি বড় কিছু হয়ে যেতো?’
‘ আপনার জামাই নিশ্চয়ই খুশিতে বিশটা ছাগল জবাই দিতো।’ তাচ্ছিল্য কন্ঠস্বর।
‘ ছিঃ বাবা এসব কেউ বলে? সে তোমাকে অপছন্দ করে ঠিক কিন্তু ঘৃণা নয়।’ বিমুগ্ধ আপেল খাচ্ছে পা দুলিয়ে দুলিয়ে। তখনই নীহারিকার আগমন ঘটলো। বিমুগ্ধ বুকে হাত রেখে সকলের সামনেই বলল,’ আপনার আগমন ঝড়ের মত। বুকটা কেঁপে উঠলো বাপরে বাপর।’ সকলে হেসে ফেলল। কিন্তু নীহারিকা হাসলো না। তার চোখ মুখের সকল দুঃখি ভাব সরে গেছে। এখন তীব্র রুষ্টতা হানা দিয়েছে। বিমুগ্ধ ভয় পাওয়ার ভং ধরে বলল,’ আম্মি আমাকে বাঁচাও।’
শামা খালামনি তার সাথে কথা বলছে না। ছেলে কিভাবে পারলো জীবন নিয়ে এভাবে খেলতে? সবার আগে তিনিই রুম ত্যাগ করেছে। এক ঝলক ছেলেকে দেখতে এসেছিলো। আপেল কেটে চলে গেছেন। ফাবিহা আনন্দে আটখানা হয়ে বিমুগ্ধের পাশে আরও একটু চেপে বসে বলল,’ তোমাদের বিয়ে গ্রামে হবে ঠিক আছে তাযিন ভাই?’
বিমুগ্ধ আপেলের উপরের চামড়া খায় না। দাঁত দিয়ে সেটি ফেলে দিতে দিতে বলল,’ বিয়ে! আর আমার! এই জীবনে হচ্ছে না বুঝলেন ফাবিহা। আপনার যেই খালু! জল্লাদ একটা।’
আফিয়া বিলকিস ছোট বোনের সাথে বের হয়ে গেছেন। তারা একটু চিন্তা মুক্ত। বাড়ি ফিরতে হবে। অনেক কাজ আছে। কেউ তেমন কিছু খায়নি। বিমুগ্ধের উস্কোখুস্কো আচরণে সকলে একে একে রুম ছেড়েছে। সকলে বের হয়ে যেতেই বিমুগ্ধ সর্বোশক্তি দিয়ে বিছানায় উঠে বসলো। মৃদূ কাতর চিৎকার রুমে ছড়িয়ে পড়তেই হলুদ শাড়িতে থাকা নীহারিকা ছুটে আসলো। অনুরাগযুক্ত গলায় চিন্তা মিশিয়ে বলল,’ কি করছেন? ব্যথা পাচ্ছেন যখন উঠছেন কেন?’
‘ তুমিও তো কাছে আসছ না রাগেশ্বরী!’ কোমল একটি গলায় ব্যথার কথাগুলো নীহারিকার হৃদয় দুলিয়ে দিলো। কান্নাদের গলায় চেপে ধরে বলল,’ এমন কাজ কেন করেছেন বিমুগ্ধ? আপনার অভিশাপ ফিরিয়ে নিন। আমি আর কাঁদতে চাই না। বিশ্বাস করুন এক ফোঁটাও না।’
গাল বেয়ে নেমে আসা জলের ছলকে পরা বিন্দুকে হাতের আঙ্গুলে স্পর্শ করে নিজের বুকের কাছের জামায় মুছে নিয়ে বিমুগ্ধ বলল,’ কিন্তু তোমার চোখের এই অশ্রু আমার বক্ষে আধিপত্য বিস্তার করছে। ভালো লাগার নাম না জানা একটি গাছের জন্ম দিয়েছে। সেই গাছে তখনই ফুল ফুটে যখন তুমি আমার জন্য কান্নায় জর্জরিত হও। কান্না শুধু কষ্টের হয় না। তোমার কান্না হৃদয়ের উথালপাথাল অনুভূতির জন্য যথেষ্ট রাগেশ্বরী।’
বিমুগ্ধের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো সে। মুখটি দেশের রোদে শ্যামবর্ণ ধারণ করেছে। গরম নরম হাতটি অধিকারের অভাবেই হয় তো তাকে জড়িয়ে বুকের মাঝে বন্দি করতে পারছে না। তবুও সকল পাপ পূর্ণকে কিছু সময়ের ছলনায় উড়িয়ে দিয়ে বিমুগ্ধে নীহারিকার একটি হাত নিজের গালে রাখলো। চোখ দুটিতে বুঝি কি হলো!
পুরুষহৃদয় কাঁপিয়ে কয়েক ফোঁটা নোনাজল গড়িয়ে পড়লো সেই তালুতে। ভালোবাসা পুরুষহৃদয়কেও বদলে দেয়। ঐতিহ্য হারিয়ে তারাও কাঁদে। এই যে বিমুগ্ধ কাঁদছে। পুরুষের কান্না সত্যি বহু পিড়া দায়ক। সচরাচর তো তাদের এই অশ্রু বিন্দু গড়িয়ে পড়ে না। বিমুগ্ধের গাম্ভীর্য্যে ভরপুর স্বরটি বাচ্চাদের মত জানতে চাইলো,’ তুমি আমার তো রাগেশ্বরী?’
ঝড়ের তান্ডবের মত এই বাক্যের সাথে কঠিন হৃদয়টিও এলোমেলো হয়ে গালের জলে হাত চেপে ধরে ঠোঁট দুটির মাঝের কান্না লুকিয়ে বলল,’ এখন পর্যন্ত আমি একমাত্র আপনার। এই পর্যন্ত আমার হৃদয় আপনার। এখন পর্যন্ত আমার সকল আবেগ, জল্পনা, কল্পনা আপনার বিমুগ্ধ।’
__________
কেবিনের বাহিরে বসে বসে ঝিমুচ্ছে নীহারিকা। চলে যেতে বলা হয়েছে তাকে। তবুও কেন যেন সে যাচ্ছে না। রাত তখন অনেক। বাবা অবশ্য উপস্থিত রয়েছে। তাই সেও থাকতে পারছে। যতক্ষণ বাবা থাকবে নীহারিকাও এখানে থাকবে। কেবিন বড় হওয়ায় শামা খালামনি এবং মা বিমুগ্ধের সাথে থাকবে ঠিক করেছে। ছোট খালামনি বাড়িতে গেছে। ফোনটি আবার বেজে উঠলো। নীহারিকা বিরক্তের চরমে। এই মেয়েটি আর ভালো হলো না। জীবনটা অশান্তিতে ঝালাপালা। আসলে এদের কখনো ঠিক করাই যাবে না। পৃথিবীর কিছু অদ্ভুৎ প্রানী তার এই কাজিন গুলো। এদের থেকে নিস্তার সে জীবনেও পাবে না। তাই ফোনটি কানে চেপে একটা রাম ধমক দিতে প্রস্তুত ছিলো সে। কিন্তু অপর পাশের বিখ্যাত কান্নার রোল দেখে থেমে গেলো।
‘ নীহুরে আমারে এমন জল্লাহ খানায় কেনো পাঠালি? এখন আমার কি হবে?’ আমি মতো মনে হয় মরে যাবো রে।’
‘ মিতু আপু তুই এমন বিশ্রী ভাবে কেন কাঁদিস বলতো? কি এমন হয়েছে শুনি?’ নীহারিকা রাগ দমিয়ে জিজ্ঞেস করল। মিতু আপু নাক টেনে বলল,’ প্রথমত তোরা সবাই হসপিটালে। আমার বাসায় একদম ভালো লাগছে না। দ্বিতীয়ত শাহিন ভাইয়ের মা কিছুক্ষন পর পর এসে হাত ধরে বলছে মা গো আমাকে মাফ করে দেও। তুই বল এসব নেওয়া যায়। তাই আমার কান্না পাচ্ছে। কি করবো বল!’
দীর্ঘশ্বাস ফেলে নীহারিকা বলল,’ হসপিটালে আমারা কি আনন্দ করছি? মজা করছি? পার্টি হচ্ছে এখানে?’
‘ বিশ্বাস কর তোরা সবাই যদি জাহান্নামেও থাকছ সেটাও আমার জন্য মজার আনন্দের জায়গা সামান্য হসপিটাল আর কি এমন।’
‘ তুই বড় হবি না তাই না মিতু আপু।’
‘ বড় হতে হলে যদি তোর মত রাগী হতে হয় তাহলে আমি এমনেই ভালো আছি।’ মিতু আপু হাসছে। উনি অনেকটা রোদ বৃষ্টির মত। এই ভালো এই খারাপ টাইপের মানুষ। নীহারিকাও হেসে ফেলল। এই মেয়ে তো জাহান্নামেও তাদের সাথে থাকতে চাইবে। বলদ একটা।
‘ আর শাহিন ভাইয়ের মায়ের কাজটা তো ভালো কাজ। ক্ষমা চাইছে এটা অতিউত্তম বিষয়।’
‘ তুই যখন বলছিস উত্তম তাহলে ঠিক আছে। শুনুন আন্টি এবার হাত ধরতে পারেন। বেশি বেশি করে ধরবেন। ক্ষমা চাওয়া মহৎ গুন।’
নীহারিকা মাথা চাপড়ালো। বলল,’ উনাকে ফোন দে বেয়াদপ।’
‘ আমি আবার কি করলাম? ধরুন নীহু কথা বলবে।’
মিতু আপুর শাশুড়ি আরেক বিলাপ করছে। নীহারিকাকে তিনি খুব ভয় পান। এই মেয়ের চোখের দিকে তাকালে কেমন ভিতরের সব ঠান্ডা হয়ে যায়। তাকেই কি না ধরিয়ে দিলো বউ মা? এমন শয়তান মেয়ে ছেলে জীবনে দেখেননি তিনি।
‘ আন্টি প্লিজ কান্না বন্ধ করুন। মিতু আপু খুব ভালো মনের মানুষ। আপনার সাথে খারাপ আচরণ করেছে?’
‘ না না। সে শুধু কাঁদে। অনেক দুঃখ দিয়েছিতো আবার তোমাদের কাছে যেতে চাইছে।’
‘ আপনি কেন কাঁদছেন?’
‘ জানি না।’ তিনি আসলেই বুঝতে পারছেন না কেন কাঁদছেন। নীহারিকা শব্দ করে হেসে বলল,’ আন্টি কান্না কাটি বাদ দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন। মিতু আপুকে বলুন সকালে আপনার ছেলে তাকে নিয়ে আসবে। আর প্লিজ আন্টি আপুকে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিন। এটা মিতু আপু খুব পছন্দ করে। এটা কেউ করলে উনার সকল রাগ জল হয়ে যায়। উনি আসলে ঘৃণা করতে পারে না কাউকে। খুব সহজ সরল মেয়ে সে। আমার মিতু আপুর মত কোমল হৃদয় সত্যি হয় না। পুরো বাচ্চা একটা।’
মিতু আপুটা সত্যি বাচ্চা। নীহারিকা ফোনটি পাশে রেখে মাথা রাখলো দেয়ালের সাথে। বিমুগ্ধের কেবিনের গ্লাস থেকে স্পষ্ট তাকে দেখা যায়। ডাক্তার ঘুমাতে বলেছে তাকে। অথচ সে তখন থেকে তাকিয়ে তাকিয়ে শুধু এই মেয়েটিকেই দেখছে। মেয়েটিকে যত দেখে নিজেকে কবিদের মত মনে হয়। জনম জনম ধরে এই দেখা শেষ হবে না বিষয়টির মত। তার দেখার মাঝে একটা ফাটল সৃষ্টি করলো জাওয়াদ। সে এসে বসেছে ক্লান্ত নীহারিকার পাশের সিটে। বিশ্রামের অভাবে নেতিয়ে যাওয়া নীহারিকার শান্ত মুখটি দেখছে। মেয়েটির মাঝে সত্যি অন্যরকম একটি বিষয় আছে। যা বিপরীত সকলকে প্রভাবিত করবে। অথচ সে কখনো প্রভাবিত হয় না। তাকে পৃথিবীর কোন বিশেষ জিনিসই নিজের দিকে টানতে পারে না। সবচেয়ে সুন্দর এই নারীর ব্যক্তিত্ব। যে কখনো নিজের প্রতি কারো দূর্বলতা নিয়ে খেলে না। এই জাওয়াদ! কত শত মেয়ে তার জন্য পাগল। অথচ কত কি করেছে সে নীহারিকার জন্য। মেয়েটি কখনো তাকে বিন্দু পরিমান জায়গা করে দেয়নি হৃদয়ে প্রবেশের জন্য। কেন? কারণ জাওয়াদ খুব সুন্দর তাই? কথাটি ভেবে শব্দ করে হেসে ফেলল জাওয়াদ। নীহারিকা চোখ তুলে তাকে দেখে চমকে গেলো। জাওয়াদ দ্রুত ব্যস্ত কন্ঠে বলল,’ স্যরি তোমার ঘুম নষ্ট করার জন্য।’
‘ নষ্ট তো করেই দিয়েছেন। স্যরি দিয়ে কি হবে? কিছু বলবেন? একা একা হাসছেন কেন?’
‘ চিন্তা করছিলাম। আমি যদি খুব একটা সুন্দর না হতাম তুমি কি আমাকে পছন্দ করতে?’
নীহারিকার ঘুম ঘুম ভাব পালিয়েছে। সে নীরব চেয়ে রইলো জাওয়াদের দিকে। তার কাছে কোন জবাব নেই। বিমুগ্ধ এই দৃশ্য বেশি সময় সহ্য করতে পারলো না। হাতের ক্যানোলা টেনে খুলে ফেলল। শরীরে বিন্দু মাত্র ব্যথা অনুভব হয়নি তার। অথচ হাতটা সুইয়ের আঘাতে ঘায়েল। খুড়িয়ে খুড়িয়ে সে বাহিরে চলে এসেছে। যেই জিনিস দিয়ে ভর করে এসেছে সেটি বেশিক্ষণ নাড়াতে পারলো না। তবুও সে হাল ছাড়ার পাত্র নয়। নীহারিকার খুব কাছে এসে সে শুনলো জাওয়াদ বলছে,’ ভালোবাসার লাগাম পাগলা ঘোড়ার মত। দক্ষ এবং পোষ মানাতে পারে এমন ব্যক্তিই তাকে টেনে ধরতে পারে। আমি হয় তো দক্ষ। ভালোবাসা বেশ বুঝি। কিন্তু তুমি সহজে বশ্যতা শিকার করার মত নারী নও। তাই যে তোমাকে লালিত করতে পারবে নিজের মাঝে, তোমার তাকেই বেঁছে নেওয়া উচিৎ। তাহলেই এই ভালোবাসা সুস্থ থাকবে। পৃথিবীতে সুস্থ ভালোবাসার খুব প্রয়োজন। তা না হলে দেবদাসের মতই লাগাম হারিয়ে কেউ একজন পরাজিত হবে।’
বিমুগ্ধ ততক্ষণে দুজনের মাঝের খালি জায়গায় বসে পড়েছে। তাকে এই অবস্থায় উঠে আসতে দেখে জাওয়াদ আশ্চর্য্য হয়ে গেলো। এই ছেলে পুরো পাগল হয়ে গেছে। সে নিজের চোখ দুটিকে একটুও বিশ্বাস করতে পারছে না। কিন্তু বিমুগ্ধের কোপিত দৃষ্টি দেখে সে বুঝলো এই ছেলে মারাত্মক ঝুঁকি পূর্ন প্রেমে আছে। যে কোন সময় এ মরে যাবে পাশের মেয়েটিকে না পেলে! সচকিত কন্ঠে জাওয়াদ বলল,’ তাযিন তুমি সত্যি মানসিক সমস্যায় ভুগছ। তোমার শরীরের সাথে সাথে মানসিক ডাক্তার দেখাতে হবে। আমি আজই কথা বলবো সিনিয়রদের সাথে।’
বিমুগ্ধ সে সব কথায় পাত্তাই দিলো না এমন ভাবে বলল,’ আপনি এখান থেকে যান প্লিজ। আমার সবচেয়ে বড় মানসিক সমস্যা আপনি।’
অপমানে জাওয়াদ মুখ থমথমে। তার খুব রাগ হলো কিছুক্ষণ পূর্বের কথাগুলোর জন্য। শুধু শুধু নিজের ভালোবাসা ত্যাগ করতে এসেছে। এই ছেলে হাড়ে বজ্জাত। কিভাবে নাফিস উদ্দিনের মত লোককে গোল খাইয়ে ছেড়েছে। না অনেক হয়েছে এবার এই ছেলেকে একটা শিক্ষা দিবে সে।
স্বস্তির নিঃশ্বাস বের হয়ে আসলো বিমুগ্ধের। যাক আপদ বিদায় হয়েছে। কেন যেন শুধু ভয় পাচ্ছে সে। মনে হচ্ছে এই বুঝি নীহারিকাকে কেউ কেড়ে নিয়ে যাবে। চোখ বুজে সে নিজের ভিতরের ভয়কে সান্ত্বনা বানী শুনিয়ে বলল,’ সমস্যা নেই ছোট বাবাকে আশা করি লাইনে নিয়ে আসতে পারবো। আপনি এতো ভয় পাবেন না হৃৎপিন্ড মহাশয়।’
রাগের দেবী ভর করেছে নীহারিকার মাথায়। সে বেঞ্চ থেকে সরে যেতে যেতে বলল,’ আপনি কখনো ভালো হবেন না তাই তো?’
বিমুগ্ধ তার আরও একটু চেপে বসলো। নিম্ন কন্ঠে বলল,’ আমি খুব ভালো হয়ে যাবো। শুধু তুমি আমার হয়ে যাও। পবিত্র একটি আত্মার মিলন দেখার অপেক্ষায় আমার হৃদয় কিভাবে কাঁপছে দেখ?’
নীহারিকা দেখলো সত্যি প্রচন্ড জোড়ে জোড়ে বিমুগ্ধের হৃদযন্ত্রটি শব্দ করছে। আর এই শব্দের কারণ একমাত্র নীহারিকার জাওয়াদের সাথে কথা বলা। লোকটা দিন দিন একটু বেশিই উম্মাদ হয়ে যাচ্ছে না? একটু না অনেকটা।
‘ আপনার এসব পাগলামী কিভাবে সুস্থ হবে বলুন? আপনি নিজেই তো ডাক্তার।’
‘ শুধু তুমি আমার হয়ে যাও নিজের জগৎ আমি তোমার জন্য পাল্টে ফেলবো।’
‘ এতো ভালোবাসেন?’ নীহারিকার ঠোঁটের কোনের হাসি চোখের তারা ছুঁয়েছে। বিমুগ্ধ সেই হাসিতে বুক চেপে বলল,’ ওহ আর না। এতো সৌন্দর্য্য আমার মৃত্যুর কারণ হবে। পরে দেখা যাবে পৃথিবী বড় হুমকিতে পড়বে। শত হোক বিমুগ্ধের মত সম্পদ হারিয়ে পৃথিবী বেশি দিন টেকে থাকতে পারবে না।’
নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না নীহারিকা, প্রানবন্ত হাসছে সে। ঠিক কতদিন পরে? কেউ জানে না। দূরের নাফিস উদ্দিন বিস্মৃত চোখে নিজের মেয়েকে এমন প্রান খুলে হাসতে দেখছেন। সত্যি তো তার মেয়েটা যে এতো সুন্দর হাসতে পারে তার জানাই ছিলো না! বিমুগ্ধ নীহারিকার হলুদ শাড়িটি দেখলো। সাথে সাথে আবার বিরক্তি এসে ভর করলো। একজন নার্স তাকেই ঔষুধ দিতে যাচ্ছিলো। রোগীকে বাহিরে বসে থাকতে দেখে তিনি মুখ হা করে তাকিয়ে আছে। বিমুগ্ধ তাকে গম্ভীর গলায় বলল,’ উনার জন্য একটি হসপিটালের মেয়েদের ড্রেস নিয়ে আসুন ফাস্ট।’
নার্সের হা করা মুখটি আরও একটু খুলে গেলো। বিমুগ্ধকে নিজের দিকে ইশারা করে বলল,’ আমি?’
‘ জি মিস সুখতারা।’
‘ আপনি আমার নাম জানেন কিভাবে? আর হসপিটালের পোশাক শুধু রোগীদের জন্য।’
‘ আমি এটাও জানি আপনার প্রেমিক সাব্বির আপনাকে এখন কল করছে। ড্রেস না দিলে আমি কর্তৃপক্ষকে বলবো আপনি রোগীর রুমে বসে রোগীর দেখা শুনা না করে আপনার প্রেমিক সাব্বিরের সাথে প্রেম আলাপে ব্যস্ত থেকেছেন।’
নার্স প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেলো। তিনি তো একবারও তার নিজের নাম বা তার প্রেমিকের নাম নেয়নি। আর সে তো মেসেজে কথা বলেছে। উনি জানলো কিভাবে? তার ভিতু মুখ দেখে নীহারিকা বলল,’ আপনি প্লিজ যান উনি মজা করছে। এমন কিছুই করবে না সে।’
‘ আমি মজা করছি না। তুমি এখনই এই শাড়ি খুলবে এবং ওই ডাস্টবিনে ফেলে দিবে। জাওয়াদের দেওয়া শাড়ি তুমি কেন পড়বে? এটা ভুলেও আর যেন না দেখি।’ খুব সিরিয়াস তার গলা। নীহারিকা বিমুগ্ধের চোখের সেই কঠোরতা দেখে ভয় পেয়ে গেলো। সত্যি সে এতো কঠিন বিমুগ্ধকে কখনো দেখেনি। সে বুঝিয়ে বলল,’ আপনি উত্তেজিত হবেন না আমি চেঞ্জ করে নিবো।’
‘ না এক্ষুনি করবে।’
‘ একটু পরে বাসায় যাবো তখন করে নিবো।’
‘ না এখন মানে এখনই।’
বিমুগ্ধ আবার উত্তেজিত হয়ে গেছে। তার কি যে হয়েছে শুধু ভয়েরা চেপে ধরছে বুক। নীহারিকা তার উত্তেজনা কমাতে কাধে আলতো মাথা রাখলো। বিমুগ্ধ শান্ত হয়ে নিঃশ্বাস নিয়ে বলল,’ তুমি আমার হয়ে থেকো নীহারিকা। সব সময়। মৃত্যুর শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত। বলো থাকবে?’
নীহারিকা একমায়াবী প্রেমজালে ফেসে বলল,’ থাকবো।’
‘ তুমি শুধু আমার জন্য সাজবে?’
‘ শুধু আপনার জন্য।’
‘ তুমি শুধু আমার কিনে দেওয়া শাড়ি পড়বে?’
‘ পড়বো।’
‘ তোমার জন্য হাজারো শাড়ির মেলা বসিয়ে দিবো। রোজ শাড়ি পড়বে কিন্তু?’
‘ আচ্ছা।’
‘ আমার সাথেই শুধু বৃষ্টিতে ভিজবে?’
‘ আচ্ছা।’
‘ তুমি শুধু আমার প্রেমে পড়বে?’
‘ আচ্ছা।’
‘ তোমার হৃদয় শুধু আমার জন্য শব্দ করবে?’
‘ আচ্ছা।’ ক্লান্তিতে নীহারিকা ঘুমের দেশে তলিয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে। বিমুগ্ধ দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে পরের প্রশ্ন গুলো করলো,’ তুমি শুধু আমার জন্য কাঁদবে?’
‘ আচ্ছা।’
‘ তুমি শুধু আমার জন্য অপেক্ষা করবে?’
‘ আচ্ছা।’
‘ তুমি শুধু আমার সাথে পৃথিবী ভ্রমণ করবে?’
‘ আচ্ছা।’
‘ তুমি শুধু আমার সাথেই রাগ দেখাবে?’
‘ আচ্ছা।’
‘ তুমি শুধু আমাকেই ভালোবাসবে?’
‘ আচ্ছা।’
‘ তুমি শুধু আমাকেই বিয়ে করবে?’
‘ আচ্ছা।’ নীহারিকার গভীর ঘুমের নিঃশ্বাস বিমুগ্ধের পোশাক ভেদ করে শরীরের প্রতিটি রোম রোম আন্দোলিত করে তুলছে। বন্ধ চোখ দুটি ঠান্ডা নরম হয়ে আসছে। শরীর অবস হয়ে আসছে। পৃথিবী থেমে গেছে এই অনুভূতিদের ছন্দে। নাফিস উদ্দিনের মনে হলো বিমুগ্ধের সকল অসুস্থতা দূর হয়ে গেছে। মৃত একটি ছেলে হঠাৎ করেই তার মেয়ের ছায়ার আচলে জীবিত হয়েগেছে। তখনই বিমুগ্ধের দুষ্টু কন্ঠ তার কানে আসলো,’ নিশ্চয়ই সব শুনেছেন? ছোট বাবা আমি সব রেকর্ড করে নিয়েছি। বেশি উল্টাপাল্টা করলে আপনাকে এবং আপনার মেয়েকে একটি মুমূর্ষু রোগীর সাথে প্রতারণা করার ফলে জেলে ঢুকিয়ে দিবো। তাই আমার সাথে নো চালাকি ছোট বাবা।’
নাফিস উদ্দিন বিরক্ত হয়ে চলে গেলেন। নার্স বিমুগ্ধের কেবিন থেকে উঁকি দিয়ে দেখলো একটি রোগী যুবক শুয়ে আছে বেঞ্চে। মাথার পিছনের অংশ দেয়ালের বুকে। তার কাধে একটি হলুদ শাড়ির রমনী নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমাচ্ছে। যেন ভয়ংকর এক জীবন মৃত্যুর যুদ্ধ শেষে তারা ক্লান্ত। সবচেয়ে বেশি ক্লান্ত মেয়েটি। ছেলেটি পরম যত্নে সকল ক্লান্তিকে ভাগ করে নিচ্ছে তার শরীর, মন, অন্তরআত্মা থেকে। অথচ সে নিজের প্রতি কত বেখেয়াল। তার ডান হাতটির রক্ত বেয়ে বেয়ে জমা হচ্ছে সাদা ফ্লোরে। সে নির্বিকার চিত্তে ক্লান্ত নারীর ঘুমের সুযোগ করে দিচ্ছে। যেন এই ঘুম পৃথিবীর সব কিছুর ঊর্ধ্বে!
____________
চলবে…