#প্রিয়_প্রহর
লেখনীতে: #নুরুন্নাহার_তিথি
#পর্ব-১৯
আরোহী শুভ্রকে বলেছিলো তাড়াতাড়ি আসতে। আয়ানাও ধ্রুবের অপেক্ষা করছে। কিছুক্ষণ পর কলিংবেলের শব্দে দুই বোন একত্রে উঠে যায়। লুকিং মিররে যার প্রিয় মানুষটাকে দেখবে সেই দরজা খুলবে।
কিন্তু একি! শুভ্র ও ধ্রুব একসাথে! লুকিং মিররে এটা দেখে আরোহী ও আয়ানা একে অপরের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে।
দরজা খুলে দুই বোন যখন শুভ্র ও ধ্রুবের সামনে দাঁড়ায় তখন শুভ্র ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়। ধ্রুব সেও কিছুটা অবাক হয় তবে সে শুভ্রর আগেই আয়ানাকে চিনে গেছে। ধ্রুব আয়ানাকে ইশারায় ভেতরে যেতে বলে নিজেও চলে যায়। আরোহী আর কথা না বাড়িয়ে শুভ্রকে নিয়ে ভিতরে যায়।
আরোহী শুভ্রকে রুমে যেয়ে ফ্রেশ হতে বলে।
ধ্রুবকে আয়ানা ও বাকি বান্ধুবীরা মিলে ধরেছে কিভাবে তারা একসাথে এলো!
ধ্রুব বলে,
–আজকে একসাথে ডিউটি পড়েছিলো। আর গন্তব্য যেহেতু একই তাই শুভ্র স্যার আমাকে বলে তার সাথে যেতে। আমি প্রথমে রাজি হইনি কিন্তু উনি জোর করলেন। তাই আর মানা করিনি।
এরপর সবাই আবার আগের মতো আড্ডাতে মেতে উঠে। আয়ানা ধ্রুবকে তার ভাইয়ের রুমে ফ্রেশ হতে বলে।
——-
তানু ইফানকে বারবার জ্বালাচ্ছে আর ইফান বারবার বিরক্তিতে উঠে যেতে চাইছে। সারা তো কথা শুনছে কম আরাশকে দেখছে বেশি। আরাশ চুপ করে বসে আছে মাঝে মাঝে নীড়ের সাথে টুকটাক কথা বলছে। মেঘ সদিয়ার সাথে সাবিলাকে নিয়ে ঝগরা করছে কারন সাদিয়া ওদের দুজনকে কথা বলতে দেখলেই বাগড়া দেয় আর নীড় ওদের তিনজনকে চোখ রাঙিয়ে থামায়। এদের কাজ দেখে ইফান মিটিমিটি হাসছে। আর এদিকে যে কেউ তার হাসিতে অপলক তাকিয়ে আছে সেদিকে নজর নেই আরাশের।
পরেরদিন,,
ইফান ও আরাশ সিফট হয়ে যায়। তারা দুই বন্ধু সারাদিন হসপিটাল টু বাসা এটুকুই।
______
শুভ্র সারাদিন রোগী ও সার্জারি করে এসে রাতে আরোহীর পড়াতে দরকার পরলে টুকটাক হেল্প করে। ফোর্থ ইয়ারের পড়া অনেকটা হার্ড। শুভ্র ও আরোহীর মাঝে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে। আরোহী নিজেই বলেছিল বন্ধুত্ব দিয়ে সম্পর্কের শুরু করতে। একে অপরকে সাপোর্ট করতে। শুভ্র রাজী হয়ে গিয়েছে কারন সেও কোনো না কোনো ভাবে ভুলে থাকতে চায়।
আরোহী প্রায় রাত জেগে পড়ে। শুভ্র তাকে সাহায্য করে টুকটাক। এমনিতেই কেটে যায় কয়েক মাস।
সেপ্টেম্বর মাসের এক রাতে,,
শুভ্রর ইদানিং আরোহীকে বারবার দেখতে ইচ্ছা করে। আজ সে আসার সময় ফুল নিয়ে এসেছে। আয়ানার জন্য ফিলিংস মনের কোনে রাখবে। এক বন্ধ ডায়েরীতে বন্ধি করে। যে ডায়েরী শত ধুলা জমলেও সে খুলবে না। করবে না স্মৃতিচারণ।
” যা তার কখনো হবে না তা নিয়ে পরে থাকলে তো আশপাশের মানুষ অপেক্ষা করবে না। শুভ্র পিছুটান রাখবে না।”
রাত ১ টা বাজে। আরোহীর শরীর কিছুটা খারাপ। টার্ম পরিক্ষার জন্য এতো পড়াশোনা করেছে যে এখন শরীর আর টানছে না। তাও টার্মে দ্বিতীয় হয়েছে। শুভ্র আরোহীর জন্য নিজে কড়া করে কফি বানিয়ে এনেছে। আরোহীর মাথা ব্যাথা করছে অনেক তাই সে শুয়েও শান্তি পাচ্ছে না। মাথার রগ গুলো ধপধপ করছে। কোনোভাবেই শান্তি পাচ্ছে না তাই বেডের বোর্ডে হেলান দিয়ে বসে আছে আর চোখ দিয়ে অশ্রু গড়াচ্ছে।
শুভ্র কফির মগ আরোহীর দিকে বাড়িয়ে দেয়। আরোহী ব্যাথাতুর নয়নে তাকায়। শুভ্র দুই মগ নিয়ে আরোহীর পাশে বসে তারপর আরোহীর মাথা নিজের কাঁধে রাখে। তারপর বলে,
–ব্লাক কফিটা খাও কিছুটা ভালো লাগবে। এতোদিন প্রেশারে ছিলে। তোমার তো ঘুম দরকার কিন্তু ঘুমাতে পারছো না। স্লিপিং পিল বললাম নিতে তাও নিবে না। এখন দেখো পেইন কমে কিনা!
আরোহী শুভ্রর হাত থেকে কফি নিয়ে খাচ্ছে। শুভ্র কফি খাচ্ছে আর আরোহীর মাথায় চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে যাতে আরোহীর একটু ভালো লাগে।
রাত প্রায় দেড়টা বাজে,,
হঠাৎ আরোহীর ফোনে কল আসে। আয়ানা কল করেছে। শুভ্রই আরোহীকে মোবাইলটা দেয়। ফোনের স্ক্রিনে আয়ানার নাম্বার দেখে সে অবাক হয় এতো রাতে কল করার কারনে প্লাস দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
আরোহী সেও অবাক হয়। আরোহী কল রিসিভ করলে আয়ানা কাঁদতে কাঁদতে বলে,
–আরু! আব্বুর অনেক বুকে ব্যাথা হচ্ছে। আমি অ্যানজাইনার ব্যাথা মনে করে এসপিরিন টেবলেট দিয়েছি একটু আগে। তবে মনে হচ্ছে হার্ট অ্যাটাক এটা। ভাইয়ারা মিলে এখন সরোয়ার্দিতে যাচ্ছি। তুই আর শুভ্র ভাই কি আসতে পারবি? আমি আম্মুকে সামলাতে পারছি না। আম্মুর অবস্থাও খারাপ হচ্ছে কান্না করে করে।
আরোহী স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। সে বিশ্বাস করতে পারছে না। আরোহীর হাত থেকে ফোনটা পরে যায়। চোখে মুখে হাত দিয়ে কান্না করছে।
শুভ্র আরোহীর হঠাৎ হাত থেকে ফোন ফেলে কান্না করতে দেখে ব্যতিব্যাস্ত হয়ে পরে। সে আরোহীকে নিজের বুকে আগলে নিয়ে জিজ্ঞাসা করে,
–রুহি! কি হয়েছে? তুমি ঠিক আছো? তুমি কান্না করছো কেনো? মাথা ব্যাথা কি আরো বেড়েছে? আর তারা কল কেনো করেছে?
–আব্বু! আব্বুর!
–কি হয়েছে মামার?
–আব্বুর হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। আমাদের যেতে হবে শুভ্র। চলো প্লিজ। আমার আব্বু! আম্মুর অবস্থাও খারাপ হচ্ছে। আয়ু একা পারবে না।
–আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি শান্ত হও। আমরা এখনি যাবো।তুমি বেশি টেনশন করো না। সরোয়ার্দিতে নিছে মামাকে?
আরোহী মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলে। শুভ্র জলদি করে নিচে নেমে গাড়ি বের করে।
আরোহী যে ভয়ে টেনশনে কখন শুভ্রকে “তুমি” করে বলে ফেলেছে এটা ওরা দুজনের কেউই খেয়াল করেনি।
_____
আরোহীর বাবার মাইনর হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। সময় মতো এসপিরিন দেওয়াতে মেজর অ্যাটাক হয়নি। মিসেস নূরকে ঘুমের ঔষধ দেওয়া হয়েছে। আরোহী ও আয়ানা হসপিটালের করিডোরে বসে আছে। এখন ভোর চারটা বাজে। রাতের অন্ধকার দূর হয়নি এখনো।
ধ্রুব এসে বলে,
–তোমরা দুজন একটু রেস্ট নাও। তোমরা এতো টেনশন নিলে আন্টিকে সামলাতে পারবে না। তোমাদের দুইজনের মুখের অবস্থা খারাপ। এখন কোনো দোকান খোলা পাচ্ছিলাম না। অনেক বলে ক্যাফের মামাকে দিয়ে ক্যাফেটেরিয়া খুলিয়ে কিছু নাস্তা এনেছি। এগুলো খাও। আর ভাইয়াদেরো একটু খাওয়াও।
তখন শুভ্র আসে। সে বলে,
–একটা একস্ট্রা কেবিন ঠিক করেছি। তোমরা রেস্ট নিতে পারো। রুহি, তোমার মাথা ব্যাথা কমেছে? কিছু খেয়ে মেডিসিন নিয়ে ঘুমাও।
শুভ্র একবার আয়ানার দিকে তাকায়। আয়ানা দাঁড়িয়ে থাকা ধ্রুবের পেটে মাথা ঠেকিয়ে রেখেছে। শুভ্র চোখ সরিয়ে নেয়। আয়ানাকে পুরোপুরি মন থেকে ভুলা তার কাছে সময় সাপেক্ষ।
যতো সময় লাগুক সে ভুলবে। আরোহী সাহায্য করছে অনেকটা। এজন্যই তো আরোহীর প্রতি সে উইক হচ্ছে। আস্তে আস্তে সময় গড়িয়ে ভালোওবেসে ফেলবে। একদিন রৌদ্রিতার রাজ হবে শুভ্র আকাশ জুড়ে!
_______
এদিকে সারা সেই শ্যাম বর্ণের ছেলেটা মানে আরাশের সরল মুখশ্রী ভুলতে পারছে না। সারা সেদিন কৌশলে আয়ানার থেকে আরাশের সম্পর্কে জেনে নিয়েছিলো। আর তানু তো ব্রেক টাইম পেলেই সারাকে জোর করে নিয়ে যায় ঢাকা মেডিকেলে। ছুটির পর বা ক্লাসের মাঝে লম্বা গ্যাপ পেলেই হলো। তানুর এই পাগলামিতে ইফান প্রথম প্রথম বিরক্ত হলেও পরে সে তানুর কাজে হেসে ফেলে লুকিয়ে। সারা তো তানুর সাথে যাওয়ার কারনে আরাশের দেখা পেয়ে যায়। আরাশের সাথে সারার কুশল বিনিময় ছাড়া আর কোনো কথা হয় না।
দেখতে দেখতে কেটে যায় ১ বছরের কিছু বেশি সময়,,
প্রকৃতিতে এখন শীতের আগমনী বাত্রা দিচ্ছে। শীত নামানোর জন্য বৃষ্টি হচ্ছে ছন্নছাড়া ভাবে। পৌষ মাস আসতে আর বেশি দেরি নেই।
আরোহীদের ইন্টার্নির সাত মাস হলো। এরই মধ্যে ইশু ও অভ্রর বিয়ে হয়ে গেছে তিন মাস হলো।
শুভ্র এখন প্রাইভেট মেডিকেলে মাঝে মাঝে ক্লাস নেয়। আরোহীদের মেডিকেলেও ক্লাস নেয়। আরোহীর ইন্টার্ন শুরু হবার পর শুভ্র পড়ানোর অফার পায়। তাও আরোহী শুভ্র ক্লাস নিবে শুনলেই সে সেদিন এক ঘন্টা দুই ঘন্টার জন্য ডিউটি করবে না। দরকার পরলে রাতে করবে।
ক্লাসে প্রথমদিন যখন শুভ্র আরোহীকে আর ওদের গ্যাংকে দেখে তখন শুভ্র কপাল কুঁচকে তাকিয়েছিল আরোহীর দিকে আর আরোহী চোখ টিপ মেরে ডোন্ট কেয়ারের মতো বসেছিল। প্রথমদিন আয়ানা করেনি শুভ্রর ক্লাস কারন ধ্রুবের সাথে বিকেলে একটু বেরোবে তাই।
ধ্রুব সরোয়ার্দিতে রেজিস্টার ডাক্তার হিসেবে জয়েন করেছে এক মাস হলো। এখন শুভ্র ও ধ্রুব কলিগ। ধ্রুবও চায় হার্টসার্জন হতে।
আয়ানার ইচ্ছে সে চাইল্ড স্পেশালিষ্ট হবে। আর আরোহী মেডিসিন ও লিভার স্পেশালিষ্ট হতে চায়। কার্ডিওলজিতে ইন্টারেস্ট ছিলো তবে শুভ্র কার্ডিওলজিতে আছে তাই সে অন্য সেক্টরে যায়।
নীড়-সাদিয়া ও মেঘ-সাবিলার বিয়ে পেছানোর কারন মেঘ ও সাবিলা। সাবিলা যেহেতু মেঘের ইউনিভার্সিটির এবং ডিপার্টমেন্টের ছাত্রী তাই মেঘ বলেছে সাবিলার মাস্টার্স শেষ হবার পরেই বিয়ে করবে। আর পুরো ভার্সিটির অনেক মেয়েরা পাগল মেঘ ও নীড়ের জন্য। দুই ভাই হয়েছেও ওদের বাপের মতো ফর্সা ও গুড লুকিং। সাবিলাদের জন্য সাদিয়াও বলেছে বিয়ে পরে করবে। ওদের চারজন একদিনে বিয়ে করবে এটা সাদিয়া ও সাবিলার ইচ্ছে।
সামনের বছর মার্চে ওদের দুই জুটির বিয়ে। হাতে আর চার মাস আছে। সাবিলা মাস্টার্সের কিছু অংশ অন্য ইউনিভার্সিটি থেকে করবে। তাই মার্চে বিয়ে করতে প্রবলেম নেই।
(মাস্টার্স দুই বা ততোধিক ইউনিভার্সিটি থেকে ভাগ করে করা যায়।)
আরোহী এখনো ভেবে পায় না শুভ্রর মন থেকে কি আয়ানার প্রতি ভালোবাসা ফিকে হয়েছে কিনা! তবে জানতে চায়। এটুকু বুঝতে পারে যে শুভ্র আরোহীকে নিজের জীবনের ভাগ দিচ্ছে। কোনো অদৃশ্য বাঁধার কারনে কাছাকাছি আসতে পারছে না। এখন প্রতিদিন কপালে চুমু দিয়ে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। দুজনের একসাথে সময় কাটানো হয়। শুভ্র যেদিন ক্লাস নেয় আরোহী সেদিন করে ক্লাসগুলো। ইতিমধ্যে আরোহীর হসপিটালের সবাই জেনে গেছে শুভ্র ও আরোহী হাসবেন্ড ও ওয়াইফ। যেদিন ক্লাস করে সেদিন আরোহীকে রাত নয়টার পর পর্যন্ত রেগুলার ডিউটি করতে হয়। এমনিতে নয়টার আগে মেয়ে ইন্টার্নদের ডিউটি শেষ হয়। যেসব দিন ক্লাস নেয় সেসব দিনে শুভ্রর হসপিটালে বেশি কাজ থাকে না তাই সে আরোহীর জন্য দাঁড়িয়ে থাকে। আরোহী একাই শুভ্রর ক্লাস করে বাকিদের মধ্য সারা বা তানু করে।
শুভ্র ও আরোহী সেসব দিন স্ট্রিট ফুড খায় রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে। এতো কেয়ার সব আরোহীর ভালো লাগে
তবে কিন্তু থেকে যায়। তারও নিজের স্বামীকে একান্তে পেতে ইচ্ছে করে। এই প্রায় দুই বছর হতে চলল সংসারে এখনো তাদের মধ্য স্বামী-স্ত্রীর মতো শারিরিক সম্পর্ক গড়ে উঠেনি। শুভ্রও চায় কাছে আসতে তবে দুই পক্ষেরই জড়তা থাকে সেসময়।
চলবে ইনশাআল্লাহ,
ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। কার্টেসি ছাড়া দয়া করে কপি করবেন না। রিচেক করা হয়নি।