#প্রীতিলতা ❤️
#লেখিকা:- Nowshin Nishi Chowdhury
#২৩_তম_পর্ব🍂
মুহূর্তের মধ্যেই পুরো ড্রয়িং রুমটা নীরবতা এসে গেল কিছুক্ষণ আগে সেই গমগমে ভাবটা এখন আর নেই ড্রয়িং রুমে উপস্থিত সকলের প্রশ্নবোধক দৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দুতে বসে আছি আমি সকলের মনে হয়তো একটাই প্রশ্ন জেগে উঠেছে যে আমি হঠাৎ এমন কিছু কেন বললাম?
কিন্তু না এদের মধ্যে বাবা আগের মতোই শীতল দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে কিন্তু কিছুক্ষণ আগে সেই প্রাণোচ্ছল হাসিটা ঠোঁট থেকে মিলিয়ে গেছে মা-বাবার পাশেই বসে ছিলেন অস্থির কন্ঠে বলে উঠলেন,
—- এসব তুমি কি বলছ প্রীতি তুমি আর ফিরবে না এর মানে কি তুমি এই বাড়ির ছোট বউ এই বাড়িতে ফিরবে না তো কোথায় যাবে তুমি?
মায়ের কথায় তার দিকে এক ঝলক তাকিয়ে মাথা নিচু করে তার উদ্দেশ্যে বলে উঠলাম,
—- আপাতত বাবার বাড়িতে কিছুদিন থাকব তারপর ভালো একটা ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্স এর জন্য চান্স হয়ে গেলে সেখানে চলে যাব। আমি আর কারোর ঘাড়ের বোঝা হয়ে থাকতে চাই না ।
শেষের কথাটার চোখের সামনে দিকে তাকিয়ে বললাম। আর চোখে যেটুকু দেখলাম তাতে বুঝলাম সে আমার দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ।
মা যেন আমার কথা শুনে আরও বেশি অস্থির হয়ে উঠলেন সামনের দিকে এগিয়ে এসে বললেন কিন্তু কে….
বাবা মাকে থামিয়ে দিলেন। আমি এখনো মাথা নিচু করে বাবার সামনে বসে আছি কিছুক্ষণ পর বাবা অতীব স্নেহের কন্ঠে বলে উঠলেন,
— মামনি মাথা উঠাও বাবার দিকে তাকাও।
কন্ঠটা কানে আসতে ভেতরে এতক্ষণে চেপে রাখা কষ্টগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠল ঠোট ভেঙ্গে নিঃশব্দ থেকে দূরে উঠলাম যার ফলশ্রুতি গাল দিয়ে দুই ফোটা নোনা জল গড়িয়ে গেল ।
বাবা এবার নিজের হাত আমার মাথায় ভুলিয়ে দিয়ে বললেন কি হলো তাকাও না আমি এবার আর তার কথা অমান্য করলাম না বাবার দিকে তাকালাম।
আমার ছল ছল চোখ জোড়ার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বাবা আমাকে প্রশ্ন করলে,
— তোমার এই মা-বাবা কী তোমাকে খুব বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছে মা যার জন্য তুমি আমাদেরকে ছেড়ে চলে যেতে চাইছ?
আমি না বোধক মাথা নাড়ালাম। তা দেখে বাবা আবার বললেন,
—- তাহলে কেন তুমি চলে যাবে মা তুমি জানো না পুতুল তোমাকে ছাড়া থাকতে পারে না?
পুতুলের কথা ভাবতে বুকের মধ্যে কেমন যেন করে উঠলো সত্যিই তো আমার এই বাড়িতে এত দিনের একমাত্র সঙ্গী ছিল আমার পুতুল সোনা ।
ওই একমাত্র ব্যক্তি যে আমাকে নিঃস্বার্থভাবে এতদিন ভালোবেসে গেছে ও আমাকে ছেড়ে থাকবে কি করে তার থেকে বড় কথা ওকে ছাড়া আমিও তো থাকতে পারবো না
কিন্তু আমি যে নিরুপায়। ওর সাথে যে আমার রক্তের সম্পর্ক নেই কিন্তু তৎক্ষণাৎ আমার মন বিদ্রোহ করে বলে উঠলো,
তাতে কি হয়েছে রক্তের সম্পর্কের বাইরে এমন অনেক সম্পর্ক আছে যা সকল রক্তের সম্পর্কের উর্ধ্বে হয়ে থাকে। যেমন আমার আর পুতুলের সম্পর্ক।
আমি বাবার দিকে তাকিয়ে বললাম,
পুতুলকে কখনো আমার ননদের চোখে আমি দেখিনি ও আগেও আমার ছোট বোন ছিল এখনো আছে আর ভবিষ্যতেও তাই থাকবে। আমি যেখানে থাকি না কেন প্রতিদিন আমি ওর সাথে দেখা করব।
ওর সাথে দেখা না করে আমি থাকতে পারবো না বাবা এছাড়া ও খুব বুঝদার মেয়ে ওকে বুঝালে ঠিকই বুঝবে। আমি আমার মাস্টার্স কমপ্লিট করতে চাইছি আর মোট কথাই বাড়ি থেকে চলে যেতে চাইছি।
মা যেন আর চুপ করে থাকতে পারলেন না আমার কথা শেষ হতেই মা পাল্টা প্রশ্ন করলেন,
— এই বাড়ি থেকেই কেন চলে যেতে হবে তোমাকে তুমি চাইলে মাস্টার্স কমপ্লিট করে চাকরিও করতে পারো তাতে আমাদের কোন আপত্তি নেই। তাহলে এসব বলার মানে কি তোমার?
আমি মার দিকে তাকিয়ে বললাম,
— আপনি হজ্বে যাওয়ার সময় আমার কাঁধে বড় একটা দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিলেন মা । আপনাদের এবং আপনার ছেলের মধ্যকার সম্পর্ক ঠিক করা। কিন্তু যেখানে তার সাথে আমার মধ্যকার সম্পর্কই ঠিক নাই সেখানে এ দায়িত্ব আমি পালন কীভাবে করব।
কথাগুলো একনাগাড়ি বলে আমি থামলাম। কিছুক্ষণ দম নিয়ে আবার বলতে শুরু করলাম ,
— বাবা এই বাড়িতে যার হাত ধরে ঢুকেছিলাম। বিয়ের এতদিন পরেও তাকে আমি নিজের আপন করে তুলতে পারিনি একই ছাদের নিচে থাকলেও দুজনের মধ্যে যোজন যোজন দূরত্ব রয়েই গেছে আমাদের।
সে ছাড়া এবাড়ির প্রত্যেকটা সদস্য আমার আপন হয়ে উঠেছে। কিন্তু যার বেশি আপন হওয়ার কথা ছিল সেই বরাবরের মতো মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে আমার থেকে।
এতে আমি তার দোষ দেব না। আসলেই তার কোন দোষ নেই।মন এর উপরে কখনো জোরজবরদস্তি চলে না। নিজের মনের বিরুদ্ধে গিয়ে কখনো সুখে থাকা যায় না। মন থেকে না চাইলে কারোর কাছ থেকে জোর করে ভালোবাসা আদায় করা যায় না বাবা। যেটা পাওয়া যায় সেটা হচ্ছে সহানুভূতি।
উনি এই কয়দিনে আমার জন্য অনেক কিছু করেছেন। আমার পরিবারের জন্য করেছেন। আমার পরিবারের চোখে উনি একজন আদর্শ জামাই আমার মা-বাবাকে এতটা সম্মান জন্য আমি সারাজীবন তার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব। আমি জানি আমি না বললেও উনি সারা জীবন এরকম দায়িত্ব পালন করে যাবেন। কিন্তু আমি শুধু ওনার দায়বদ্ধতা হয়ে থাকতে চাই না।
মন চাইনি সে আমাকে ভালোবাসে নি।
তাই বলে জোর করে এই অনিশ্চিত সম্পর্কের দোহাই দিয়ে আমি তাকে আটকে রাখতে পারি না। তার ও স্বাধীনভাবে বাঁচার অধিকার আছে সাথে আমারও ।তাই এই মিথ্যা সম্পর্কটা এখানে সমাপ্তি হোক।
যার কোন ভিত্তি নেই সেই সম্পর্কের বোঝা আমি আর বইতে পারছি না। দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার মানসিকভাবে এই ব্যাপারটা আমাকে খুব পীড়া দিচ্ছে বাবা। আর এই বাড়িতে থাকলে প্রতিনিয়ত আমার এই সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে তাই আমি এখান থেকে চলে যেতে চাইছি।
মা বাবা আপনারা আমাকে মাফ করবেন। আপনাদের কথা আমি রাখতে পারব না। একবার যখন সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছি তখন আমি তার পরিবর্তন করতে চাই না।
মা থম মেরে সোফায় বসে রইলেন। বাবা আমার কথাগুলো শুনে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।
আর সাফওয়ান তিনি তো মনে হয় কথা বলতেই ভুলে গেছেন। এই পুরোটা সময় তিনি একটা কথা বলেননি। আর দিকে না তাকিয়েও যতটা বুঝেছি তিনি পুরোটার সময় আমার দিকে ই স্তব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। হয়তো তিনি ভাবতে পারেননি যে আমি এভাবে চলে যাওয়ার কথা বলব।
কিন্তু কি আর করার এটা তো হওয়ারই ছিল।
চলবে….❣️