প্রীতিলতা পর্ব-২৭

0
448

#প্রীতিলতা❤️

#লেখিকা:- Nowshin Nishi Chowdhury

# ২৭_তম_পর্ব🍂

অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে আছে চারপাশ। কিছুক্ষণ পরপর ঝিঝিপোকার ডাক এবং সাথে সমুদ্রের কলকল শব্দ মুখরিত করে তুলছে এই জায়গাটিকে। এই মুহূর্তটাকে যদি একটু তৈলচিত্রের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হতো।

তাহলে দেখা যেত এক চমৎকার প্রেমিক পুরুষ তার প্রিয় রমণীকে কোলে করে নিয়ে সমুদ্রের পাড় দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। অসাধারণ হতো কিন্তু চিত্রটি।

সাফওয়ান হেটেই যাচ্ছে। আস্ত একটা মানুষকে যে সে কোলে করে আছে তার জন্য চেহারায় কোন বিরক্তিভাব বা ক্লান্তি নেই তার। এ যেন এক নতুন মানুষকে আবিষ্কার করেছি আমি।

কত কিছুই ভেবেছি কত কিছুই করেছি সেগুলো ভেবে এখন ভারী লজ্জিত হচ্ছি আমি। মানুষটা আমাকে ভালবেসে ছিল কিন্তু নীরবে নিভৃতে। যার অদৃশ্য দেওয়াল আমি ভেদ করতে পারিনি। কি লজ্জা কি লজ্জা আসলেই কি আমি তার ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য ছিলাম।

আমার দৃষ্টির সাফওয়ানে নিবদ্ধ আর সাফওয়ানের দৃষ্টি দূর অজানায়। তার বাম গালের দিকে তাকালাম। কাল নাকি বাবা এখানেই থাপ্পড়টা মেরেছিলেন।

ইশ্ আমার জন্য তাকে মার ও খেতে হয়েছে। ডান হাতটা উঁচু করে তার বা গালে রাখলাম। ধীরে ধীরে ছুঁয়ে দিতে লাগলাম তার খোঁচা খোঁচা দাড়িগুলো। কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠলেন যেন সাফওয়ান।

তার পা জোড়া থেমে গেল। তিনি পূর্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। কিঞ্চিৎ সময় পর আমাকে সহ তার ডান বাহুটা কিছুটা উঁচু করে বেশ সময় নিয়ে আমার কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালেন। আবেশে চোখ বুজে নিলাম আমি। প্রিয় মানুষের স্পর্শ গুলো নিদারুন সুন্দর হয়।

আমাকে কোল থেকে নামিয়ে দিলেন তিনি। পকেট থেকে তার রুমাল বের করে মুহূর্তের মধ্যেই আমার চোখ জোড়া বেঁধে দিলেন। ব্যাপারটিতে আমি খানিকটা হকচকিয়ে গেলাম। এবার পেছন থেকে আমার দুই বাহু ধরে সামনে এগোতে এগোতে বললেন,

— আমাকে বিশ্বাস করো তো প্রীতিলতা? না মানে এখন যদি তোমাকে এই সমুদ্রে ফেলে দেই।

আমি কিটকিট করে হেসে উঠে বললাম,

— তা ফেলে দিন না আপনার হাত জোড়াও কিন্তু আমার হাতের মধ্যে আছে। সো সমুদ্রের পানি আমি একা খাব না সাথে আপনিও খাবেন। এখানে আবার দেখলাম দুজনের নোনা পানি খাওয়ার ওপরে ডিসকাউন্ট আছে।

সাফওয়ান হো হো করে হেসে উঠে বললেন,

— রেলস্টেশনের মত এখানেও তাহলে ডিসকাউন্ট আছে।

বলে এক ঝটকায় চোখের উপর থেকে রুমালটা সরিয়ে দিলেন। একটা বেশ কড়া আলোর ঝলকানি এসে লাগল আমার চোখে। ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম একটা উঁচু ঢিবির মতো জায়গায় খুব সুন্দর করে ডেকোরেশন করা হয়েছে।

যার মাঝখানে একটা গোল টেবিল লাল কাপড়ের মোড়া এবং দুপাশে দুটো চেয়ার রাখা আছে এবং মাথার উপর থেকে নিচ পর্যন্ত স্টিকের সাথে ছোট ছোট লাইট লাগিয়ে সুন্দর করে ডেকোরেশন করা। পুরো জায়গাটাকে আকাশী এবং সাদা বেলুন দিয়ে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে তোলা হয়েছে।

আমার হাত ধরে সেই বেলুনের মধ্য দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে এসে টেবিল ঘেঁষে দাঁড়ালেন সাফওয়ান। আমাকেও মাঝ বরাবর দাঁড় করালেন। টেবিলটার উপরে বড় একটা বক্স রাখা। বক্সের ফ্রিতে ধরে টান দিতে চারিপাশ থেকে বক্সটা খুলে পড়ে গেল।

সাথে সাথে বেরিয়ে আসলো একটি ওশান ব্লু এবং চকলেট ফ্লেভার কম্বিনেশন এর একটি তিন পার্টের কেক। সে কেকের সামনে ক্রস করে দুটো ছোট ইস্টিক লাগানো আছে। যার একটার উপরে লেখা হ্যাপি বার্থডে অন্যরাতে লেখা হ্যাপি ওয়ান মান্থ অ্যানিভার্সারি।

লেখাটা দেখেই চমকে উঠলাম। এক মাস হয়ে গেছে আমাদের বিয়ের। আজকের এই দিনে গত মাসে বিয়ে হয়েছিল আমাদের। আবোল তাবোল চিন্তাভাবনার উদ্ভট কাজের চাপে এই ব্যাপারটা তো আমার মাথা থেকেই বেরিয়ে গিয়েছিল।

আমি সাফয়ানের দিকে তাকাতেই সে আমার বা গালে ছোট্ট একটা চুমু দিয়ে বলল হ্যাপি ওয়ান মান্থ অ্যানিভার্সারি সুইটহার্ট।

আমি হতাশ গলায় তাকে বললাম,

— এটাও মনে ছিল আপনার।

সে বক্সগুলো টেবিলের উপর থেকে সরিয়ে সাইডে রাখতে রাখতে বলল,

— হুম। এই তারিখে একটা গোটা মানুষকে নিজের নামে দলিল করেছিলাম ।তা মনে থাকবে না তারিখ টা। ইনফ্যাক্ট আমি তো চিন্তা করে রেখেছি আগামী এক বছর এভরি মান্থ তোমরা সেলিব্রেশন করব।

অবাক হলাম আমি এগুলো তো আমার পরিকল্পনা ছিল। উনি জানলেন কি করে। সাফওয়ান বক্সগুলো সরিয়ে রেখে সোজা হয়ে আমার দিকে দাঁড়িয়ে বললেন,

— কি অবাক হচ্ছো। প্রিয় মানুষকে শুধু ভালবাসলেই হয় না মনের কথা বুঝতে পারার ক্ষমতা থাকতে হয় , চোখের ভাষা বুঝতে হয়, মনের আবেগ অনুভব করতে হয়। তারপরেই প্রেমিক পুরুষ হওয়া যায়।

সাফোয়ানের কথাগুলো আমার মনের মধ্যে একটি সূক্ষ্ম যন্ত্রনা সুত্রপাত ঘটালো। আমিও ভালোবেসেছি । কিন্তু এতটা অনুভব করে নয়। আমি ভালোবাসার স্বীকৃতি চেয়েছি কিন্তু কিন্তু উনি আমাকে অনুভব চেয়েছেন‌‌।ইশ্ এভাবেও ভালোবাসা যায়।

চোখের কোণে অশ্রু গুলো ভিড় জমালো। তা দেখে সাফওয়ান আমার কাছে আরো কিছুটা এগিয়ে এসে আমার মুখটা আঁজলা করে নিজের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে চোখের পাতা মুছে দিয়ে বললেন,

— তোমার ভালবাসার নিদারুণ ক্ষমতা আছে প্রিয়তমা। আমার মরু মনে তোমার ভালবাসা রহমতের বৃষ্টি হয়ে নেমেছে বলেই আজ আমি আমার অস্তিত্বকে খুঁজে পেয়েছি। রাগ হিংসা এগুলো মনের মধ্যে পুষতে পুষতে এক সময় নিজেই পাথরে পরিণত হয়েছিলাম আমি।

তুমি ঠিক বলেছিলে রাগ হিংসা এগুলো মনের মধ্যে যত বাড়ে আপনজনরা তত বেশি দূরে সরে যায়। সরেই তো গিয়েছিলাম সবার থেকে। নিজের চারিপাশে একটা অদৃশ্য প্রাচীর তৈরি করে নিয়েছিলাম আমি।

কিন্তু সেই দুর্ভেদ্য প্রাচীর তুমি ভেদ করতে সক্ষম হয়েছিলে। তোমাকে যতই দূরে সরাতে চেয়েছি তুমি তত বেশি কাছে এসেছো। তোমাকে যত বেশি ঘৃণা করতে চেয়েছি তুমি তত বেশি ভালোবাসায় মুরিয়ে দিয়েছো আমাকে।

আগে যে তোমার ছায়াও সহ্য করতে পারত না। সে এখন তোয়ায় বুকে করে নিয়ে না ঘুমাতে গেলে ঘুম আসে না। তোমার রান্না ছাড়া এখন অন্য কোন রান্না খেতে পারেনা, ঘরে ঢুকলে তোমার সুবাস না পেলে দম বন্ধ হয়ে যায় তার, জিনিসগুলো তুমি গুছিয়ে না দিলে সবকিছু অগোছালো হয়ে যায়।

তোমার হাসির শব্দ, তোমার করা মজা গুলো, তোমার সম্মোধন টাও প্রতিদিন সকালে তোমার স্নিগ্ধ স্পর্শ গুলো সবকিছু কেমন যেন অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে আমার

ইদানিং কল্পনাতেও আসা যাওয়া বেড়েছে তোমার। আমারও পুরো অস্তিত্বের সাথে মিশে গেছো তুমি। তুমি বিহীন শ্বাস নিতেও এখন আমার কষ্ট হয় প্রিয়তমা।

ভাবলে কি করে প্রিয় , তুমি আমার জীবনের বোঝা হয়ে গেছো। যখন থেকে তোমাকে ভালবাসতে শুরু করেছি তখন থেকেই নিজের মধ্যে তোমাকে হারানোর একটা ভয় সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল আমার। তোমাকে কারো সাথে সহ্য হতো না আমার।

সেদিন খালামনির বাড়িতে সায়েমের সাথে তোমার সাধারণ কথাও আমার চোখে লেগেছিল। রাগ হয়েছিল তোমার উপর তাই সেদিন রাতে তোমার সাথে অমন আচরণ করেছিলাম। পরে সায়েম জানিয়েছিল তোমার আর ওর ব্যাপারে।

তার পরেও ওর পাশে তোমাকে দেখলে কেন জানি আমার সহ্য হতো না। তারপর তুমি যখন তার পরের দিন সকালে তোমার বাড়িতে চলে গিয়েছিলে তখন উপলব্ধি করেছিলাম।

যে আমার মনের অনুভূতিগুলো এবার তোমাকে জানানোর সময় এসে গেছে না হলে সত্যিই অনেক দেরি হয়ে যাবে। তাই সামিরা আর আমার ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ক্লিয়ার করে দিয়েছিলাম তোমার কাছে। যাতে তুমি আমাকে ভুল না বোঝো।

আমি স্বভাবত অনেকটা নিরব স্বভাবের। মনে করেছিলাম তুমি হয়তো বুঝতে পারবে। কিন্তু না তুমি তো উল্টো বুঝে বসে আছো। এবং মনে মনে চক কষেছো কিভাবে আমার থেকে দূরে চলে যাবে।

ভালবাসতে শিখিয়ে এভাবে চলে যাবে তা তো হয় না বেইবি ।তাই মনে মনে আমিও একটা ছক কষে নিলাম। তোমাকে নিয়ে এই বাড়ি থেকে পালাবো। এন্ড সি পালিয়ে এসেছি তোমাকে নিয়ে।

আর জানো তুমি আমার জন্য খুব লাকি। সেদিন দুপুরে তুমি বাপের বাড়ি যাওয়ার পরে রেজাল্ট টা পেয়েছিলাম। যদি সত্যি তুমি ওখানে উপস্থিত থাকতে না আমি কিন্তু উঠে গিয়ে তোমাকেই জড়িয়ে ধরতাম প্রথমে।

বিয়ের পরে কত তালবাহানায় আমার কাছে ঘেষে থাকতে চাইতে তুমি। আর সেদিন তোমাকে যে একটু জড়িয়ে ধরলাম ছিটকে দৌড় দিলে। সত্যি বলতে সেদিন আমার মধ্যকার সমস্ত আনন্দগুলো আমি তোমার সাথে ভাগ করে নিতে চেয়েছিলাম। তোমাতেই বিলীন হতে চেয়েছিলাম।

আমি তার বাহু জোড়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে তার শ্রুতি মধুর কথাগুলো শুনছি। আর নীরবে চোখের জল ফেলছি। সত্যি অপেক্ষার ফল সুমিষ্ট হয়। যে মিষ্টতা এখন আমার সর্বাঙ্গকে পুলকিত করছে। মন জুড়ে আনন্দের জোয়ার বইছে। আর সেই আনন্দের জোয়ারে স্রোত ধারা হয়ে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে।

স্বপন আমার দিকে আরও কিছুটা এগিয়ে এসে চোখের পানি মুছে দিয়ে বললেন,

— আজ মনে হচ্ছে যেন তোমার চোখের পানির বাঁধ ভেঙেছে। অস্রু গড়িয়েই যাচ্ছে গড়িয়ে যাচ্ছে থামার নামই নেই। চলো এসো এবার কেক কাটবে।

কথাগুলো বলে আমার গালের রাখা তার হাত সরিয়ে নিতে গেলে আমি হাত জোড়া চেপে ধরে বললাম,

— আমাকে এতটা ভালবাসলে কবে কুমড়া পটাশ?

সাফওয়ান স্নিগ্ধ হেসে আমার নাকের নাক ঘষে বললেন,

— আমিও তো দিনক্ষণ দেখে তোমাকে ভালবাসিনি সোনা। আমি নিজেও বলতে পারব না সেই নির্দিষ্ট দিনটা কবে এসেছিল। শুধু এটুকু জানি অনুভূতিটা জন্মে গেছে ভেতর থেকে ‌। যাকে প্রতিরোধ করা আমার পক্ষে আর সম্ভব নয়।

আমি শব্দ করে কেঁদে উঠলাম। দুহাত দিয়ে সাফওয়ানকে জড়িয়ে ধরে তার বুকের মাথা রেখে অশ্রু বিসর্জন দিতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর তিনি আমাকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে বললো,

— অনেক কেঁদেছো তুমি।আর না। আমি তোমাকে প্রমিস করছি। এরপরে থেকে আর এক ফোঁটাও অশ্রু তোমার চোখ থেকে গড়াতে দেবো না আমি।

এসো আমার সাথে। আমি অনেক কষ্ট করে তোমার জন্য ডেকোরেশন করেছি। দয়া করে এখন কান্নাকাটি করে এই সুন্দর মুহূর্তটাকে নষ্ট করো না।

কেকটা কাটলাম। একে অপরকে অতি ভালবাসার সাথে খাইয়ে দিলাম। আর এই সুন্দর মুহূর্তটাকে নিজের মুঠো ফোনে ক্যাপচার করে রাখলেন সাফওয়ান।

ভালোবাসা তখনই সুন্দর যখন দুটি মানুষ একে অপরকে শ্রদ্ধাবোধের সাথে আপন করে নেয় দুই দিক থেকেই বরাবর প্রেম থাকে। যেটা আজ আমি অনেক সাধনার পরে পেয়েছি। হ্যাঁ সত্যিই তাকে আমি পেয়েছি। একদম নিজের করে।

_________🌺🌺_________

সন্ধ্যা সাতটা বাজে,

নিজের রুমে বিছানার ওপরে আদর্শোয়া হয়ে বসে চায় চুমুক দিচ্ছেন সাখাওয়াত হোসেন। পাশে তার অতি পছন্দের উপন্যাস শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সমগ্র আধা ভাঁজ করে রাখা আছে।

মাগরিবের নামাজ পড়ে কেবল বসে ছিলেন উপন্যাসের পাতায় ডুব দিতে কিন্তু তৎক্ষণাৎ মিসেস শায়লা হোসেন স্বামীর জন্য চায়ের কাপ নিয়ে রুমে প্রবেশ করলেন। স্বামীর হাতে চায়ের কাপটা ধরিয়ে দিয়ে বিছানার পাশে থাকা জায়গায় বসে স্বামীকে প্রশ্ন করলেন,

— এটা কি হলো সাফওয়ান এর আব্বু। আমাদেরকে সব প্ল্যানই তো ভেস্তে গেল। কী ভেবে রেখেছিলাম আমরা আর কি হয়ে গেল। হাহুতাশ করে বলে উঠলেন তিনি।

মোঃ সাখাওয়াত হোসেন নির্বিঘ্নে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে তৃপ্তির শ্বাস ফেলে বললেন,

— মূল উদ্দেশ্য যেটা ছিল সেটা তো পূরণ হল। এখন কোথায় আর কিভাবে পূরণ হলো সেটা ভেবে লাভ কি। বরং আয়োজন করো তোমার ছেলে আবার বিয়ে করে বউ নিয়ে আসছে।

মহা ধুমধামে আমি এবার বৌভাত এর আয়োজন করব। বিয়েটা যেমনই হয়েছে কিন্তু আমার ছেলের বৌভাতটা জমজমাট হওয়া চাই ।সাব জজ এর বৌয়ের বৌভাতের অনুষ্ঠান বলে কথা।

মিসেস শায়লা হুসাইন চোখ ছোট ছোট করে বললেন,

— তুমি এতটা শিওর হলে কি করে তোমার ছেলে প্রীতিকে আবার বিয়ে করে তারপরে আসবো।

মিস্টার সাখাওয়াত হুসাইন রহস্য করে হেসে বললেন,

— ছেলেটা তো আমার। সব দিক থেকে স্বভাবটাও আমার মত পেয়েছে। আমার ছেলেকে আমার থেকে আর কে বেশি চিনবে। এইজন্যই তো প্রীতিকে এনেছি ওর জীবন সঙ্গিনী করে আমার বিশ্বাস ছিল এই মেয়েই পারবে তোমার ছেলেকে সোজা করতে। এবং পেরেছেও।

মিসেস শায়লা হোসেন হেসে বলে উঠলেন,

— জানো সকালবেলায় যখন ওদের রুমে গিয়ে দেখলাম প্রীতি বিছানায় নেই। আমি তো আঁতকে উঠেছিলাম। পুরো রুমটা তন্ন তন্ন করে খুঁজে কাউকে না পেয়ে আমার তো মাথা কাজ করাই বন্ধ করে দিয়েছিল। সাফওয়ান যে প্রীতি কে নিয়ে এভাবে চলে যাবে এটাতো আমার মাথাতেই আসিনি।

তারপর তুমি যখন বললে সকালবেলায় প্রীতিকে নিয়ে তুমি সাফওয়ানকে বেরিয়ে যেতে দেখেছ বাড়ি থেকে। তার পরেও কেন যেন আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না। পরে সামিরাও একই কথা বলল। আমি এখনো ভাবতে পারছি না সাফওয়ান এমন একটা কাজ করবে।

আমরা তো ভেবে রেখেছিলাম প্রীতিকে প্রথমে অন্য ফ্ল্যাটে গিয়ে রাখবো। কয়দিন পরে সাফওয়ান নিজে গিয়ে প্রীতিকে নিয়ে চলে আসবে। কারণ আমি তো মা আমার ছেলের চোখে আমি প্রীতির জন্য অন্যরকম কিছু দেখেছিলাম সেটা কখনো ভুল হতে পারে না। আমি বুঝতে পেরেছিলাম আমার ছেলে পেতে কে ভালোবেসে ফেলেছে। কিন্তু ও যে এমন পাগলামি করবে এটা আমার ধারণার বাইরে ছিল।

মিস্টার সাখাওয়াত হোসেন পাশের ডেক্সের এর উপরে চায়ের কাপটা রেখে বললেন,

— ফজরের নামাজ মসজিদে পড়ার জন্য যখন ঘর থেকে বাইরে বের হলাম তখন দেখি সামিরা সদর দরজার কাছে দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক নজর বুলাচ্ছে। পরে সদর দরজার দিকে না গিয়ে দোতলার বারান্দায় পিছন সাইডে গিয়ে দেখলাম। তোমার ছেলে বৌমাকে কোলে করে নিয়ে গাড়িতে ঢুকছে আবার দারোয়ান কেউ কিছু টাকা দিয়ে গেছে মুখ বন্ধ রাখার জন্য।

তাইতো ফজরের নামাজটা ঘরেই পড়েছি আজকে। তার সাথে দুই রাকাত শোকরানা নফল নামাজ পড়েছি আল্লাহর উদ্দেশ্যে। আমার পাগল ছেলেকে বুঝদার বানানোর জন্য। নাও তাড়াতাড়ি শুরু করো আমার মন বলছে তোমার ছেলে কাল সকালেই বৌমাকে নিয়ে চলে আসবে। আর আমি দেরি করতে চাই না কালকে বৌভাতের অনুষ্ঠান হবে। সবাইকে প্রায় ইনভাইট করা হয়ে গেছে। আর কিছু বাকি আছে কাগজ-কলম নিয়ে এসো ফোন করে করে জানিয়ে দেই।

এর মধ্যে হাতের ট্রে করে সন্ধ্যার নাস্তা নিয়ে ঘরে ঢুকলো সামিরা। তার পেছন পেছন ঢুকলো পুতুল এবং সাকলাইন ‌। সেন্টার টেবিলটা টেনে এনে মাঝখানে রেখে নাস্তার ট্রেটা টেবিলের উপরে রাখল সামিরা। সাকলাইন আর পুতুল বিছানার ওপরে বসলো, আর স্বামীরা সোফা সেটের উপরে।

সাক লাইনের দিকে তাকিয়ে সাখাওয়াত হোসেন বললেন,

— ক্যাটারিং এর দায়িত্ব কিন্তু তোমার। নাস্তা খেয়ে বেরিয়ে পড়ো এখন। বাজার ঘাট সদাই পাতে সবকিছু বাকি আছে একে একে করতে হবে।

বলে পাকড়াও বাটিটা তুলে এক এক করে খেতে লাগলেন।

সাকলাইন চায়ের চুমুক দিতে দিতে বলল,

— চিন্তা করো না বাবা তুমি শুধু ইনভাইট লিস্ট টা ভালোভাবে চেক করো আর কাদের কাদের ইনভাইট করতে বাকি আছে তাদের ফোন করে জানিয়ে দাও এদিকে আর যা আছে সব কিছু আমি সামলে নেব আর আমি একা তো নয়, আমার সাথে সায়েম আছে। ও একটু হসপিটালে গেছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে বলেছে। এখনো তো সারারাত পড়ে আছে। কাল ওরা আসার আগেই সবকিছু গোছানো হয়ে যাবে। কাল চমৎকার একটা সারপ্রাইজ দেওয়া হবে ওদেরকে।

পুতুল হৈহই করে বলে উঠলো। আম্মু প্রীতিলতা আর ছোট ভাইয়ার কি আবার বিয়ে হবে। শায়লা হোসেন মেয়েকে কোলের দিকে টেনে নিয়ে বললেন,

— বিয়ে তো তোমার ভাইয়ার হয়ে গেছে সোনা। এবার তোমার ভাইয়া আর ভাবির বৌভাতের অনুষ্ঠান হবে।

না ও আমার প্রীতিলতা হয়। আমি সারা জীবন ওকে প্রীতিলতা বলে ডাকবো।

পুতুলের কথা শুনে উপস্থিত সবাই হেসে উঠল। সামিরা বলে উঠলো,

— বাবা কালকে প্রীতিকে পড়ানোর জন্য কিছু ড্রেসও তো কিনতে হবে। তাছাড়া কালকে অনুষ্ঠানের জন্য আমরা মেয়েদের কিন্তু নতুন ড্রেস চাই।

মিস্টার সাখাওয়াত হোসেন মুচকি হেসে সামিরার দিকে তাকিয়ে বললেন,

— আমার বাড়ির সব মেয়েরা কালকে নতুন পোশাক পরবে। তোমরা মেয়েরা সবাই বেরিয়ে পড়ো, শপিংয়ের জন্য আর আমরা এদিকে আমাদের কাজ সেরে আসি। দশটায় ডিনারের টেবিলে সবার সাথে বাকী কথা হবে।ঠিকাছে।

সবাই ঘাড়বাঁকিয়ে সম্মতি জানালো। পুতুল তো বায়না জুড়ে দিয়েছে সে নাকি পছন্দ করে তার প্রীতিলতার জন্য বৌভাতের পোশাক কিনবে। সে তার সেটা তো সে অবশ্যই কিনবে। আফটার অল প্রীতিলতার পুতুল সে।

হঠাৎ ফোনে মেসেজ এর শব্দ আসায় সবাই কিছুটা থেমে গেল। সাখাওয়াত হোসেন ফোনটা তুলে নিয়ে দেখলেন মেসেজে লেখা

Assalamualaikum, baba
finally your plan has succeeded. Coming back very soon… “Preeti”

চলবে…!