প্রেমজাল পর্ব-১১

0
1126

#প্রেমজাল
পর্ব ১১
জান্নাতুল মাওয়া মাহিমুন

ধরণীর বুক জুড়ে আধার নেমে সন্ধ্যা থেকে রাত হতে চলেছে। দূর আকাশ থেকে এশার আযান শুনা যাচ্ছে। ঘড়ির দিকে তাকাতেই দেখলাম মাত্র রাত ৮ঃ১৫ টা ছুই ছুই। জানালা দিয়ে আসা বহমান ফুরফুরে হাওয়ায় আমার শাড়ির আচল অকপটে উড়ে চলছে। আবহাওয়ার স্নিগ্ধ আবেশে বোঝা যাচ্ছে হয়তো বৃষ্টি আসবে। আমি এবার একটা তপ্ত নিশ্বাস ফেলে আয়নায় শাড়ির কুচি ঠিক করতে উদ্যোগী হলাম। এক জোড়া গম্ভীর চোখ ড্রেসিং টেবলের আয়নার প্রতিফলকে আমাকে যে দেখছে তা না বুঝতে বোধগম্য হলো না। হঠাৎ করে উনার এমন গাম্ভীর্যতার উদ্ভব কেনো ঘটলো কে জানে। সকালে তো ভালোই সবার সাথে খুশ-আলাপ করলো। দুপুরেও তো সব ঠিক-ঠাকই ছিলো। তাহলে উনার এমন গাম্ভীর্য সুলভ আচরণের মানে কি? মাঝে মাঝে মন চায় তো এই ব্যাটাকে আস্ত দাফন করে দেই।

আমি শাড়ি সেট-আপ করতে করতে আকাশ পাতাল ভাবনার মাঝেই আয়ান থমথমে স্বরে প্রশ্ন ছুড়লো,

-“আর কতক্ষণ?”

আমি পিছনের ফিরে এক হাত দিয়ে আরেক হাত মোচড়া-মুচড়ি করতে করতে শুকনো একটা ঢোক গিলাম। এদিক-অদিক চাহনি নিয়ে মিহি গলায় উনাকে উদ্দেশ্য করে বললাম,

-“আজকে ফিরে না গেলে হয় না? মানে যাওয়াটা কি খুব জরুরি?”

আয়ান শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে শান্ত গলায় বললো,

-“বাইরে অপেক্ষা করছি” বলে বেরিয়ে যেতে নিয়েও কিছু একটা ভেবে আবার ফিরে আসলো।

-“ঠিক ৫ মিনিট। ১ মিনিটও যাতে হেল-ফেল না হয়” খানিকটা কড়া গলায় বলে আবার বেরিয়ে গেলো আয়ান। মাঝে মাঝে এই অসহ্যকর লোকের ঘাড়ত্যাড়ামির জন্য নিজের কপাল নিজেরই ফাটাতে মন চায়। জাস্ট রিডিকুলাস পারসন (Just ridiculous person)!

মনের মধ্যে এক রাশ বিরক্তি নিয়ে চোখে হালকা কাজল টানলাম আর একটু ঠোটে লিপজেল দিলাম। পার্সে ফোনটা নিয়ে একবার চারপাশটায় চোখ বুলালাম। হয়তো আর এখানে আসা হবে না। সাহেবের যেই ভাব-সাব। শৈশব-কিশোরী অংশ এই ঘরেই কেটেছে। ভারী শ্বাস নিয়ে বেরিয়ে আসলাম বাইরে।

বাইরে বের হতেই দেখলাম আয়ান বিরক্তিমিশ্রিত ভাব নিয়ে বুকে হাত গুজে দাঁড়িয়ে আছে। কি ব্যাপার? ৫ মিনিট তো পুরা হয়নি। তাহলে এমন থমকা আচরণের কারণ কি? আমি কিছু বুঝার আগেই দাদিমণি অনুনয় বিনয় স্বরে বললো,

-“একট্টু খানি খাওয়ানোর সময়ে তোর কি টেরেন ছুইটা যাইবো, নানাভাই?….(একটু থেমে) দুগা খানি খাইয়া লো”

-“মা এতো করে বলছে, আয়ান। একটু খেয়ে যা। খালি মুখে বাড়ি থেকে বের হতে হয় না বাবা” আয়ানের উদ্দেশ্য আদুরে গলায় বললো ফুপিমণি।

দাদিমণি আর ফুপিমণির মাঝে কথার ফোড়ন কেটে ছোট কাকিমণি কেটে বললো,

-“আচ্ছা। তুমি না খেলেও আহানা খেয়ে নিক…(একটু থেমে) দুপুরে অতিথিদের আপ্যায়নের চাপে তেমন কিছু খেতে পারে নাই”

আয়ান শান্ত গলায় বললো,

-“হুম। দেখলাম তো কীভাবে অতিথি আপ্যায়ন করেছে”

উনার শান্ত গলায় কেমন জানি ঘাপলা আছে। এতো স্মুথ বিহেভার হলেন কীভাবে! পাত্র-পক্ষ যাওয়ার পর থেকে এমন খাপছাড়া আচরণ করছে এবার একটু একটু বুঝতে লাগলাম।

ছোট কাকিমণি হাত ধরে টেনে খাবার টেবিলে আমাকে বসিয়ে দিতেই ফুপিমণি আয়ানের দিকে দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করলো।

আয়ান বাধ্য ছেলের মতো খেতে বসলো। বসতেই দাদিমণি হুমড়ে পরলো নাতিকে সোহাগ করতে। সবচেয়ে ভালো আইটেম গুলো এগিয়ে দিচ্ছে উনার সামনে।

পাশ থেকে রিমি আমাকে ফিসফিস করে বললো,

-“দেখো আহানাপু, আয়ান ভাইয়াকে এমন ভাবে খাওয়ানো হচ্ছে মনে হয় শ্বশুর বাড়ি জামাই আদর দিচ্ছে”

আমি রিমির কথার প্রতিত্তোরে আলতো হাসলাম।

উনার দিকে আড়চোখে এক পলক তাকালাম। উনি তো আরামসে দিব্যি খাচ্ছে। হোক বিয়ে অপ্রত্যাশিত ভাবে সম্পর্কে তো এখন এই বাড়ির নাত-জামাই এই। মনে মনে নিঃশব্দে হেসে আবার খাওয়ায় মনযোগ দিলাম।

বড় কাকিমণি তাচ্ছিল্য স্বরে ছোট কাকিমণিকে উদ্দেশ্য করে বললো,

-“ছোটো, তোর নিজের মেয়ের প্লেট তো খালি প্রায়, দে কিছু। এই মেয়েকে নিয়ে এতো আদিক্ষেতা করে খাওয়ানোর কি আছে বাপু? কয়দিন পরেই আবার উড়ে এসে জুড়ে বসবে” বলে মুখ ব্যঙ্গ করে প্রস্থান করলো। আমি এবারো নিঃশব্দে হাসলাম। এই আর নতুন কি? জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই কমবেশি এমন কটু কথা উঠতে বসতে শুনতে হয়। বড় কাকিমণি আমার আর সুপ্পুর সাথে কি শত্রুতা আল্লাহ মাবুদই জানে। কিন্তু এদিকে ছোট কাকিমণির সাথে অনেক সখ্যতা। এমনকি উনি তো একবার বলেছিলেও যদি রিমি, অরিন বাদে বড় কোনো ছেলে সন্তান থাকতো তাহলে আমার সাথে বিয়ে এখানেই আজীবন রাখতো। নতজানু হওয়ার পর বেশ বুঝলাম আয়ান দিকে তাকিয়ে আছে। আমি চুপচাপ খেয়ে উঠে আসলাম। খাওয়ার পর্ব শেষ করে সবার থেকে বিদায় নিতে নিতে ১০টা বেজে গেলো।

_________________

এতোক্ষণ আকাশটা পরিষ্কার থাকলেও এখন মেঘের ছায়ায় ডুবে যাচ্ছে। গাড়ি পরিমিত সীমা নিয়ে ছুটে চলছে আধ-কাচা রাস্তার লোকবিহীন সবুজের সমারোহের মধ্য দিয়ে। গাড়ির জানালা ভেদ করে বৃষ্টির মিষ্টি সৌরভ আমাকে প্রাণবন্ত করছে। আমি জানালার দিকে মনোনিবেশ হয়ে হাওয়া গুলো অনুভব করতে লাগলাম। পরিবেশের উন্মোদনায় হারিয়ে যেতে ইচ্ছা করছে। আমি খানিকটা আবেগীময় হয়ে বাম হাতটা জানালা পার করে অগ্রসর করলাম। তখনি আমার ওয়ান এন্ড অনলি দি গ্রেট আয়ান চৌধুরী রামধমক দিয়ে হাত ভিতরে নিতে বললো। আমি সাথে হাতটা গুটিয়ে নিলাম। আমি মনের কোণে একরাশ অভিমান নিয়ে উনার দিকে তাকালাম। উনি গাড়ির স্টেয়ারিং সামলাতে ব্যস্ত। এতোই ব্যস্ত যে আমার দিকে এক পলক তাকানো গেলো না? আমি মুখ ফিরিয়ে গাড়ির সিটে গা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে রাখলাম। অনুভব করতে লাগলাম কেও জানালার সাটার অনেক খানি খুলে দিয়েছে। যার ফলস্বরূপ আমার কপালে সন্তপর্ণে পরে থাকা অবিন্যস্ত চুলগুলো দোল খাচ্ছে। আমি নিশ্চুপে অনুভবই শ্রেয় মনে করলাম। উনার হঠাৎ এমন সো কল্ড বিহেভার কেনো উপচে পরছে? চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগলো কিছু সময়ের আগের ঘটনা।
.
.
.
আসরের ওয়াক্তে শেষ পর্যায় পাত্র-পক্ষ বিদায় হয়েছে। সব কিছু গোজ-গাজ করতে করতেই সন্ধ্যা হলো। ড্রয়িং রুমের একপ্রান্তে পরিবারের সদস্যরা বিয়ের আলোচনা করছে। তাদের অদূরে এক প্রান্তে আমরা পরিবারের ছোট সদস্যরা গোল হয়ে মাদুর বিছিয়ে বসেছি। সুপ্পু লাজুক লাজুক চাহনি নিয়ে মুচকি হাসছে। আজ থেকে ঠিক ৩ দিন পর এনগেজমেন্ট। এরপরেই ধুমধাম করে সানাই বাজবে বিয়ের। নিলয় ভাইয়া সুপ্পুকে নিয়ে ফরেন চলে যাবে তাই কিছুটা তাড়াহুড়ো করেই বিয়ে হচ্ছে। একদিক দিয়ে মজা হবে বলে খুশি আরেকদিক দিয়ে চলে যাবে বলে কষ্ট হচ্ছে। রিমি তার ননস্টপ বকাবকানি ইতিমধ্যে শুরু করছে। এজ লাইক বিয়েতে কি করবে, কি পরবে, কই সাজবে, কীভাবে যাবে তার প্লেনিং। আর আমি হাদারামের মতো কথা গিলছি। টুং করে আওয়াজে আমার ধ্যান ভঙ্গ হলে, ফোনে তাকাতেই নোটিফিকেশনে “রিয়ান” নামটি ভাসছে। আমি ইগ্ননোর করে রিমির কথায় মন দিলাম। আবারো টুং করে শব্দ হতেই সুপ্পু সন্দেহ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো। মনে হচ্ছে আমি কি জানি করে ফেলছি। আমি ইগ্ননোরনেস জারি রাখলাম।

সুপ্পু দুষ্টুমি মাখা কণ্ঠে বললো,

-“কীরে, আহানা। প্রেম প্রেম গন্ধ পাচ্ছি। প্রেম-ট্রেম করিস নাকি?”

আমি ডোন্ট কেয়ার ভাব নাক-মুখ ছিটকে নিয়ে বললাম,

-“তুমি তোমার বয়ালির মুরগিকে সামলাও। আমি কি করি দেখতে হবে না, হুহ” বলে একটু ভেংচি কাটলাম।

আমার কথার প্রেক্ষিতে সুপ্পু যখনি কিছু বলতে যাবে তখনি আকস্মিক ভাবে আয়ানের গলার আওয়াজ শুনে পিছনে তাকালাম। উনার এমন কথায় অনেকখানি অবাক হলাম।

#চলবে….

[ভুলগুলো ক্ষমাসুলভ দেখবেন]