#প্রেমনগরে প্রশান্তির ভেলা
#আফসানা_মিমি
|সতেরো তম পর্ব|
আজকের প্রভাতী যেন ভিন্নরুপ নিয়ে এসেছে ধরণীতে রুপের জন্য। রুপ আজ খুবই আনন্দিত। কারণটা রুপের আজানা। সকাল সকাল চলে এসেছে বাগানে পানি দিবে বলে। গাছে পানি দিচ্ছে আর হাসছে আপনমনে রুপ। ইতিমধ্যেই রুপের কর্ণধারে আসে রাইসার গলা ফাটানো চিৎকার। রুপ এবার নিজের কর্ণধারে হাত রেখে খিলখিল করে হেসে দেয়। রুপ জানে রাইসার এমন চিৎকারের কারণ। শেষ রাতে যে রুপ রাইসার ছবি তুলেছিলো সেটা হয়তো রাইসা এতক্ষণে দেখে নিয়েছে। এদিকে পানির পাইপ গিয়ে পড়লো একটা গর্তের মধ্যে। যাই গর্ত কিছুদিন আগে খনন করা হয়েছিলো।
ইতিমধ্যে রাইসা রেগে বোম হয়ে রুপের দিকেই এগিয়ে আসছে। রাইসার হাতে ফোন। প্রেম নীড়ের দরজার সামনে থেকে রাইসা এক প্রকার চিৎকার করে রুপের উদ্দেশ্যে বলে এগিয়ে আসছে,
” তুমি আস্তো একটা দুষ্টের বাক্সো রুপ! এ কেমন ছবি তুললে আমার। এখন যে এই ছবি কয়েকজনের কাছে চলে গিয়েছে।”
রুপ কানে হাত দিয়ে রাইসার কথার প্রত্যুওরে বলে,
” আপাতত আমি রঙিন দুনিয়ায় অবস্থান করছি। তোমার কথা কর্ণধারে আসছে না।”
রাইসার রুপের উওরে রেগে তেড়ে আসে। রুপকে ধরতে না পারলেও পড়ে যায় সেই গর্তের মধ্যে যা এখন কাদায় ভর্তি। রুপ রাইসার অবস্থা দেখে আবারও হেসে দেয়। রাইসার ঘারে, পেটে সুড়সুড়ি দিতে শুরু করে।
আয়েশা আজাদ এবং আজাদ সাহেব গভীর ঘুমে ছিলেন। বাহিরের শোরগোলে উনাদের ঘুম ভেঙে যায়। বাহিরে এসে আজাদ সাহেবের চোখ ছানাবড়া।
চোখের সামনে বাচ্চাদের ন্যায় দুইজন দৌঁড়াচ্ছে বাগান জুড়ে। রুপ সামনের দিকে আর রাইসা তার পেছনে। রাইসার সারা শরীরে কাঁদায় মাখামাখি। রুপের হাসি যেন সরছেই না মুখ থেকে। এদিকে আজাদ সাহেবের মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি আটছে প্রিয়তমা স্ত্রীকে নিয়ে। আড়চোখে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে দুষ্টুমির হাসি দেন তিনি।
আজাদ সাহেবের মনে যেন রং লেগেছে। রুপ, রাইসার দুষ্টুমি দেখে প্রিয়তমা স্ত্রীকে পানি দিয়ে ভিজিয়ে দেন। এতেও যেন আজাদ সাহেব ক্ষান্ত হলেন না। কিছুদিন আগে বাগানে মাটি খনন হয়েছিলো। সেখানে পানি জমে কাঁদা হয়ে আছে। ভাগ্যক্রমে রাইসা সেই গর্তে দৌঁড়ে এসে পড়ে যায়। আজাদ সাহেব হাতির ন্যায় মোটা স্ত্রীকে তো আর সিনেমার নায়কদের মতো কোলে উঠাতে পারবেন না তাই আয়েশা আজাদকে টেনে হিঁচড়ে সেই গর্তে ফেলে দেয়।
এদিকে রুপ আয়েশা আজাদের করুণ অবস্থা দেখে দুঃখের মধ্যেও হেসে ফেলে। রাইসা এসেছিলো রুপকে কাদায় ফেলতে। বুড়ো বুড়ির এই বয়সে বাচ্চামো দেখে হেসে ফেলে। আয়েশা আজাদ যেন এমন কিছুর জন্য একদম প্রস্তুত ছিলেন না। আজাদ সাহেবও হেসে যাচ্ছেন সমান তালে। আয়েশা আজাদ একা কাদায় গড়াগড়ি খাবে তা তো মানা যায় না। আজাদ সাহেবকে ধরে কাদায় ফেলে দেন। এরপর তিনজন মিলে রুপকে কাঁদা লাগাতে দৌঁড়াতে শুরু করেন।
” ওরে আল্লাহ, দিন দুপুরে ভূত আসলো কোথায় থেকে? ভূতরাও বুঝি দৌঁড়াতে পারে?”
ফাহিমা এসেছিলো দারোয়ানকে দিয়ে শলার ঝাড়ু আনাবে বলে। চোখের সামনে তিন কাঁদায় মাখামাখি ভূতদের দেখে ভয় পেয়ে যায়। দালানের পাশে পড়ে থাকা পুরোনো শলার ঝাড়ু দিয়ে এক প্রকার তেড়ে আসে তিন মানুষ নামক ভূতদের দিকে।
” আইদা ঝাড়া, বাইদা ঝাড়া, বিলাই ঘু ছ্যাড়াবেড়া থু থু থু। হুস ভূত ভাগ। দূর হো আমার শ্বশুর বাড়ি থেকে।”
ঝাড়ু দিয়ে একপ্রকার ঝেড়ে-মে’রে তিনজনের অবস্থা বেহাল করে দিচ্ছে ফাহিমা। তিনজন মানুষ আর কেউ না। আজাদ সাহেব, আয়েশা আজাদ এবং রাইসা।
আজাদ সাহেবের লজ্জায় মাথায় হাত। শেষে কি না পুত্রবধূর হাতে ঝাঁটা পে’টা খেতে হলো এই বয়সে? আয়েশা আজাদ বোকা পুত্রবধূর কাণ্ডে ভীষন রেগে।
আয়েশা আজাদ সজোরে ললাটে আঘাত করে। ফাহিমার হাত থেকে ঝাড়ু নিয়ে সজোরে জমিনে নিক্ষেপ করে।
” মাথার বুদ্ধি কি সব রাস্তায় ফেলে এসেছো ফাহিমা?
শাশুড়ি মায়ের কথা শুনে ফাহিমা এদিক সেদিক তাকায়। আয়েশা আজাদের চারপাশে ঘুরঘুর করে কিছুক্ষণ। ফাসিমার ধারণা, আয়েশা আজাদ মানে ফাহিমার শাশুড়ির কোথাও থেকে কথা বলছে, সামনে যে আছে সে ভূত মাত্র। তাই পুরো বাগানের চারপাশে ঘুরঘুর করে ঘুরে আসে ফাহিমা। অবশেষে শাশুড়িকে না পেয়ে আবারো কাদামাখা শাশুড়ি মায়ের বেশে থাকা ভূতের সামনে চলে আসে। ফাহিমা কোমরে হাত রেখে বলে,
“কি বাটপার ভূতরে বাবা! আমার শাশুড়ি মায়ের কন্ঠ নকল করে ফেলে? এসব ভূতকে ঝাড়ু পে’টা করে কীভাবে তাড়াতে হয় তা আমার জানা আছে। দাঁড়া হতচ্ছাড়া ভূত! কোথায় গেল রে ঝাড়ুটা! ভূতকে পি’টি’য়ে আমাদের বাড়ি থেকে ভাগাই!”
আয়েশা আজাদের ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে যায় এই মুহূর্তে। আয়েশা আজাদ ফাহিমার মাথার জোরে আঘাত করে বসে। যার দরুন ফাহিমার মাথায় এবং মুখে কাদা লেগে যায়। আয়েশা আজাদ আফসোসের স্বরে বলে,
” এ কোন বোকা মেয়েকে আমার ছেলের জন্য নিয়ে এসেছি গো আল্লাহ? এই মেয়ের মাথায় বুদ্ধি সুদ্ধি বলতে কি কিছুই নেই! আরে আমার মা, আমি তোমার শাশুড়ি মা। আমি নাবিল, নাদিফের মা, আজাদ সাহেবের স্ত্রী। তোমার সাহস তো কম না! তুমি আমাদের ঝাঁটা পে’টা করো?”
শাশুড়ি মায়ের ভরাট কণ্ঠস্বর শুনে ফাহিমা কেঁদে দিলো,
” ও শাশুড়ি মাগো! তুমি আমার সামনে এমন ভূতের মত সেজে আছো যে! আমি তোমাকে চিনতে পারিনি মা! আমাকে মাফ করে দাও। আল্লাহ মাফ করো, আমি এতক্ষণ আমার শ্বশুর শাশুড়িকে ঝাঁটা পে’টা করেছি? নাবিল শুনলে আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিবে। আমাকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দিবে। ইয়া আল্লাহ আমি আমার এই দুঃখ কোথায় রাখি?”
আয়েশা আজাদ এবং ফাহিমার কাণ্ড দেখে রুপ হাসে কোমড়ে হাত রেখে।
ইতিমধ্যে নাদিফ মেইন গেট দিয়ে প্রেম নীড়ে প্রবেশ করে। নাদিফকে দেখা মাত্রই রুপ নিজের মনের আনন্দ-খুশি ধরে রাখতে পারলো না। কি যেন ভেবে দৌঁড়ে চলে যায় নাদিফের কাছে। নাদিফের হাত ধরে এক প্রকার বাচ্চাদের মত হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে বলতে শুরু করে,
” আপনার আসার অপেক্ষায় ছিলাম। জানেন কি হয়েছে? ফাহিমা ভাবি না! আঙ্কেল আন্টিকে ঝাড়ুপে’টা করেছে ভূত ভেবে। আল্লাহ, আমি তো হাসতে হাসতে শেষ। আঙ্কেল আন্টির অবস্থা কাদায় মাখা-মাখি। চেনাই যাচ্ছে না। দেখুন আমার সাথে আসুন।”
রুপ যেন বাচ্চাদের ন্যায়ে হয়ে গিয়েছে। যেন ছোট কোন বাচ্চা বড়োদের হাতে ধরে টেনে মজার গল্প শুনাচ্ছে। এদিকে নাদিফ রুপের হাস্যজ্জ্বল চেহারার দিকে তাকিয়ে আছে। নাদিফ এর আগে রুপকে এভাবে হাসতে দেখেনি।
রুপ নাদিফকে সকলের সামনে দাঁড় করায়। আজাদ সাহেব এবং আয়েশা আজাদের অবস্থা সত্যি হাস্যকর। তিন জনকে দেখে তাই মনে হচ্ছে কাদায় বাস করা ভূত। নাদিফ নিজের হাসি আটকাতে পারলো না। হো হো করে হেসে দিলো বাবা মায়ের কান্ড দেখে।
নাদিফ জানে তার বাবা-মা একটু রোমান্টিক। যখন যা ইচ্ছে তাই করে বসে। নিজের মনে আনন্দ পাওয়ার জন্য যদি মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয় তাও নিতে প্রস্তুত। নাদিফ নিজের বাবা-মাকে এজন্যেই ভীষণ ভালোবাসে। নাদিফ হাসি সংযত করি কন্ঠস্বর কঠোর করে সকলের উদ্দেশ্যে বলল,
” একি অবস্থা তোমাদের? এই অবস্থায় যদি তোমরা তিনজন প্রেম নীড়ে প্রবেশ করেছো তো, তোমাদের হাড্ডি গুড্ডি ভেঙ্গে ফেলবো বলে দিলাম।”
নাদিফ কণ্ঠস্বর একটু কঠিন করে সকলের উদ্দেশ্যে বলল যেন ভবিষ্যতে কেউ এমন দুষ্টুমি করতে না পারে। নাদিফের কথা শুনে আজাদ সাহেব একদম নিরপরাধের ন্যায় বলে উঠে,
” আমাদের কোন দোষ নেই বাবা। এই রুপ’ই প্রথম কাদা নিয়ে খেলা শুরু করেছে। এই যে রাইসাকে কাদায় ফেলে কতক্ষণ সুরসুরি দিয়েছে। কিন্তু দেখো! নিজে একদম পুরো পরিষ্কার কাদার কোন ছিটেফোঁটাও নেই। ওদের অবস্থা দেখে আমার মন একটু দুষ্টুমি করতে চাইলো তোমার মাকে নিয়ে। আমিও তোমার মাকে নিয়ে একটু দুষ্টুমি করলাম। কিন্তু রুপকে কাদা মাখাতে পারলাম না।”
আজাদ সাহেবের কন্ঠস্বর আফসোসে ভরা।
বাবার কথা শুনে নাদিফ চট করে রুপকে কোলে তুলে নিলো। রুপা নাদিফের এই কাজের জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। রুপ নাদিফের গলা জড়িয়ে ধরে ভয়ে। ওদের দুজনের অবস্থা দেখে সকলে হাততালি দেয়া শুরু করে। এদিকে নাদিফ সকলের উদ্দেশ্যে বলে,
” দুষ্টুমি যেহেতু অপরুপ শুরু করেছে, তাহলে শাস্তি তো তাঁরও পাওয়া উচিত তাই না?”
নাদিফের কথা শুনে সকলে একসাথে হাতে তালি দিয়ে হ্যাঁ বলে উঠে।
রুপ পড়েছে মহা বিপদে। প্রেম নীড়ের সকলকে রুপের শত্রু মনে হচ্ছে। রুপ অসহায় দৃষ্টিতে সকলের পানে তাকালো। রুপের তাকানোতে কারোর মনোভাব বিন্দু পরিমাণ পরিবর্তন হলো না। উল্টো সকলে মিছিমিছি কালা চশমা চোখে লাগিয়ে অন্ধ সেজে অন্য দিকে তাকিয়ে রইলো।
” দয়া করে ঐ কাঁদায় আমাকে ফেলবেন না।”
রুপের করুণ স্বর শুনে নাদিফ ভ্রু যুগল কুঁচকে নেয়। মুখে বাঁকা হাসির রেখা টেনে এনে বলে,
” আমার ভালোবাসা সাদরে গ্রহণ করো। কাঁদায় ফেলবো না, ফুলের বিছানায় ফেলবো।”
রুপ এবার ভীষণ রেগে গেলো। এই লোকটার মুখে কি আর কোন কথা নেই? রুপ রেগে মাথা কাৎ করে নাদিফের শক্ত বাহুতে কামড় দিয়ে বসলো। নাদিফ চোখ বন্ধ করে রুপের আঘাত হজম করে নিলো।
সকলের এক,দুই, তিন গননা করছে। রুপকে হেলিয়ে দুলিয়ে দুইবার ঝাঁকিয়ে কাদায় ফেলে দিলো নাদিফ। সকলের মাঝে হাসির রোল পড়ে যায়। যেন কোন যুদ্ধে বিজয়ী হয়েছে এমন। নাদিফ হেসে সকলের আড়ালে রুপের উদ্দেশ্যে বলল,
” এবার থেকে আর ভালোবাসি বলবো না, সোজা তুলে নিয়ে চলে যাবো।”
রুপও যেন পরাজিত হবে না এই পন করেছে। হাস্যজ্বল নাদিফের হাত ধরে টেনে কাদায় ফেলে দেয়। নাদিফের দিকে তাকিয়ে হেসে বলে,
” আমিও দেখবো কীভাবে আপনি আমায় আপনার ভালোবাসার চাদরে আটকান। আমি এতো সহজে ধরা দিচ্ছি না জনাব!”
চলবে………..