প্রেমনগরে প্রশান্তির ভেলা পর্ব-১৯

0
659

#প্রেমনগরে প্রশান্তির ভেলা
#আফসানা_মিমি
|ঊনিশ তম পর্ব |

গাড়ি চাকা যেন আজ থামার নাম মাত্র নেই, অনবরত চলছেই। রাস্তার দুই ধারে কৃষকেরা আমন ধান মাঠে উঠিয়েছে মাত্র। কয়েকদিনের মধ্যেই ধান গাছ থেকে ধান আলাদা করা হবে। ধানের ঘ্রাণে প্রাণ জুড়িয়ে যায় যেন। গ্রামের পরিবেশের সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করে এ সময়ে। আম, কাঁঠালের এই সময়ে গাছে ঝুঁকে আছে আম।

আজাদ সাহেব মনের সুখে গান গাইছেন,

“ধন ধান্য পুষ্পে ভরা, আমাদের এই বসুন্ধরা
তাহার মাঝে আছে দেশ এক সকল দেশের সেরা
ও সে স্বপ্ন দিয়ে তৈরী সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা।
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি,
সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি,
সে যে আমার জন্মভূমি, সে যে আমার জন্মভূমি।”

আজাদ সাহেবের পরিবারের সকল সদস্য রওনা হয়েছেন আসলামপুরের উদ্দেশ্যে। আর কিছু পথ বাকি আজাদ সাহেবের বাবা-দাদার বাড়ি। গ্রামের মেঠো পথ দেখা যাচ্ছে ইটের রাস্তা থেকে। আনন্দ করার জন্য ছোট বাস নিয়েছেন। যেখানে আরামে যে যেখানে ইচ্ছে বাসে চড়ে বসে যেতে পারবে। বাসের সামনের সিটে বসেছেন আজাদ সাহেব এবং আয়েশা আজাদ। খোলা জানালায় বাতাস প্রবেশ করছে। গ্রামের গাছ-গাছালি যেন সবাইকে পাতা নাড়িয়ে মিষ্টি বাতাস ছড়াচ্ছে, স্বাগত জানাচ্ছে। আয়েশা আজাদ লাজুক হেসে স্বামীর গা ঘেঁষে বসে গান শুনছেন।

ফাহিমা পুরো রাস্তায় স্বামী নাবিলের কাঁধে পড়ে ঘুমোচ্ছে। এটা ফাহিমার অভ্যাস। এতে অবশ্য নাবিলের কোন সমস্যা হচ্ছে না বরঞ্চ সপ্তাহের শেষে স্ত্রীকে পাশে পেয়ে আনন্দ লাগছে। এই অগোছালো ফাহিমাকে অনেকটাই গুছিয়ে নিয়েছে নাবিল। ফাহিমা সকলের সামনে যেমন হোক না কেন নাবিলের ক্ষেত্রে খুবই রাশভারী। একমাত্র নাবিলের সামনে যেন বড়ো সেজে যায়। স্বামীর সকল কিছুর দিকে সুন্দরভাবে খেয়াল রাখে।

আজাদ সাহেবের পরিবারের বাহিরে একজন সদস্য আছে বাসে। আর সে হচ্ছে নাদিফের বন্ধু আকাশ। আকাশ বর্তমানে উঁকি ঝুঁকি মারছে রাইসার দিকে। রাইসার সাথে এই দুইদিনে আকাশের ভীষণ সখ্যতা গড়ে উঠেছে। অনলাইনে দুজনের আলাপ আলোচনা ভালোই চলে এখন। গতকাল সকালে আকাশের ফোনে রাইসার ফোন থেকে কিউট একটা ছবি আসে যেখানে রাইসা ব্যাঙের ন্যায় উপুড় হয়ে শুয়ে ঘুমুচ্ছে। ছবিখানা দেখে আকাশ হাসতে হাসতে অজ্ঞান। প্রায় পাঁচ মিনিট ছবিখানা সেভাবেই ছিলো এরপর মুছে ফেলে রাইসা কিন্তু ততক্ষণে যা হবার তা হয়ে গিয়েছে। আকাশ ছবিখানা নিজের ফোনে সংরক্ষিত করে রেখেছে রাইসাকে ক্ষেপাবে বলে। রাইসাকে যখন ছবির বিষয়ে ক্ষেপানো হয় তখন থেকেই রাইসার আকাশের সহিত কথা বলা বন্ধ। আকাশ নিজ ইচ্ছায় নাদিফের সাথে এসেছে রাইসার মান ভাঙবে বলে।

” এই লাল পরী, কি করছো একা বসে?”

চোখ বন্ধ অবস্থায় কাঁচা আমের ঘ্রাণ নিচ্ছিলো রুপ। সকালে অভ্যাস মোতাবেক ছাদে হেঁটে এসে নিজের ঘরে বিছানার উপর দুই সেট কাপড় দেখতে পায় রুপ, যেগুলোর একটার উপর রুপের নাম লিখা ছিলো আরেকটার উপর রাইসার। রুপ প্রথমে ভেবেছিলো এই কাজ আজাদ সাহেব বা আয়েশা আজাদের। কাপড় দুটো ফেরত দিতে গিয়েও দেয়নি বয়স্ক মানুষ কষ্ট পাবে বলে।
মাথায় ঘোমটি টেনে বাসের ঠিক পিছনের সিটে বসেছে রুপ। রাইসা রুপের সামনের সিটে কানে ইয়ারফোন গুঁজে গান শুনছে। কারোর কথার আওয়াজে রুপ চোখ খুলে তাকায়। প্রকৃতির সতেজ বাতাস সাড়া মুখে স্পর্শ করতে চোখের চশমা খুলে ব্যাগে রেখে দিয়েছিলো রুপ। চশমা চোখে পড়তেই পাশে বসা মানুষটা রুপের হাত আটকে নেয়।

” চশমা পরতে হবে না। এভাবেই থাকো। চশমাবিহীন তোমাকে মায়াবী লাগে অনেক।”

” এই কাপড়টা আপনি দিয়েছেন তাই না?”

” অপরুপকে কল্পনায় সাজাতে ভালো লাগে। রাতে অপরুপকে লাল পরী সাজাতে ইচ্ছে করছিলত খুব। কিন্তু কল্পনায় সাজাতে পারছিলাম না। তাই আর কি। ছোট শালিকা হিসেবে রাইসাও পেয়ে গেলো।”

রুপ হেসে ফেললো নাদিফের কথায়। রুপের অবাক লাগে একটা কথা ভেবে, এই রাগী মানুষটা রুপকে অপমান করতে পিছপা হতো না কখনও। এখন সে রুপের পাগল।
রুপের পাশে নাদিফ বসা। নাদিফ অনেক আগেই রুপের কাছাকাছি বসতে চেয়েছিলো। কিন্তু হারামি বন্ধু আকাশের জন্য পারেনি। আকাশ বাসে উঠে নদিফের হাতে ল্যাপটপ ধরিয়ে কাজে লাগিয়ে দেয়, কি কাজ তা অজানা’ই থাক। পাঁচ মিনিট হয়েছে কাজ শেষ করেছে নাদিফ। নিজেকে কিছুটা গুছিয়ে পুরো বাসে নজর বুলায় নাদিফ। কাঙ্খিত মানুষকে একদম পিছনের সিটে বসতে থাকতে দেখে খুশি হয়। নাদিফ রুপের পাশে এসে বসে কিছুক্ষণ রুপকে দেখে নেয়। মলিন মুখশ্রী, ফ্যাকাসে ঠোঁট, কোন সাজসজ্জা নেই। নাদিফের আগমনের আভাস রুপ পায়নি। মন ভরে রুপকে দেখে নাদিফ রুপের উদ্দেশ্যে বলে।

রুপ চশমাবিহীন চোখে নাদিফকে দেখতে পাচ্ছে না। তবুও কেন যেন নাদিফের কথা মানতে ইচ্ছে করছে রুপের। বাসের জানালার দিকে তাকিয়ে লম্বা নিশ্বাস নিলো রুপ। আনমনে বলে উঠলো,

” কাঁচা আমের সুগন্ধিতে মন উতলা হয়ে যাচ্ছে। বাসের ছাদে বসে সকলে হৈ-হুল্লোর করে আম খেলে আনন্দ হবে অনেক।”

” তোমার কি এই ইচ্ছে’ই অপরুপ?”

রুপ নাদিফের কথায় কি বলবে বুঝতে পারছে না। কন্ঠনালী দিয়ে আপনা আপনি চলে এসেছে কথাগুলো।
এদিকে নাদিফ রুপের ইচ্ছাকে অপূর্ণ রাখতে চায় না। তাই রুপের পাশ থেকে উঠে চলতি বাসের জানালার পাশে এসে দাঁড়ায়। হাতের মুঠোয় পরপর দুটি ডাল আম সহ ভেঙে ফেলে। নাদিফের কান্ড দেখে আকাশও দাঁড়িয়ে যায়। জানালা দিয়ে গাছের নিচে ঝুলে থাকা আমগুলো ছিড়ে নেয়। চলন্ত বাসে আম পাড়ার মজা’ই আলাদা। বাসের ড্রাইভার আয়না দিয়ে নাদিফ, আকাশের কার্য দেখে নেয়। রাস্তার পাশে যেই আম গাছে আম আছে সেই জায়গায় গাড়ি দাঁড় করায়।

” সাব্বাস বেটা, এই না হলে আমার ছেলে! আমিও জোয়ান বয়সে এমন করতাম তোর মাকে খুশি করার জন্য। এখন তোমার এমন বিচ্ছুপনা দেখে মনে হচ্ছে সেই জোয়ান বয়সে চলে গিয়েছি। কি গো ললিতা! হবে কি আবার আগের মতো! তুমি বসে কাঁচা রসযুক্ত আম খাবে আর আমি তা দেখে জিভ ভিজাবো?”

আজিদ সাহেবের কথায় সকলে হেসে উঠেন। আয়েশা আজাদ লজ্জায় মুখ ঢাকেন। রুপ মুখে হাত দিয়ে তাকিয়ে আছে নাদিফের দিকে। নাদিফের কান্ড দেখে রুপ মনে মনে খুবই আনন্দিত। ছোটবেলা থেকেই কষ্টে বড়ো হওয়া রুপ হঠাৎ আনন্দে ভরপুর পরিবারে চলে এসেছে। যেখানে শুধু আনন্দ আর আনন্দ। একসাথে মিলেমিশে থাকা আর অসীম ভালোবাসা রয়েছে। রুপের এখন বড্ড লোভ পাচ্ছে সারাজীবন এই পরিবারের সাথে থেকে যেতে।

” ওমা কত আম ভাইয়া! এগুলো কি এখানে খাবো নাকি বাসায় গিয়ে খাবো? আমারতো এখনি সব সাভার করতে ইচ্ছে করছে। জানেন ভাইয়া রুপ আর আমার কাঁচা আম খুবই পছন্দের। আমরা যখন এতিম খানায় ছিলাম, বৃষ্টি বাদলের দিন তো আম গাছের নিচে চলে যেতাম আম কুড়াতে। এরপর সেই আম লবন মরিচ দিয়ে মেখে খেতাম। আহা কি স্বাদ!”

” এখন আর চুরি করে খেতে হবে না পিচ্ছি বাবু? তোমার জন্য আম জীবন বাজি রেখে আম পেরে এনেছি।”

আকাশের কথায় রাইম মুখ ভেংচি কাঁ’টে। কোন কথা না বলে অন্যদিকে তাকায়। এদিকে আকাশ পিচ্ছির অভিমান দেখে ব্যথিত হয়। আকাশ মনপ্রাণ দিয়ে পিচ্ছির রাগ ভাঙাবে বলে পন করে নেয়।

রাইসার কথা শুনে নাদিফ চোরা চোখে রুপের দিকে তাকায়। রুপের নজর জমিনে নিবদ্ধ। দুইহাত ঘসে যাচ্ছে অনবরত। রুপের অবস্থা দেখে নাদিফ রুপের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। রুপের হাত ধরে টেনে নিয়ে আসে নিজের কাছে।

” যত ইচ্ছে আম খাও। এখানে তোমাকে বাঁধা দেওয়ার মত কেউ নেই। তোমার জন্য সবকিছু।”
————–
গাড়ি থেমেছে অনেক আগেই। কাঙ্খিত জায়গায় চলে এসেছে সবাই। এবার দু’কদম এগোলেই হবে।
বিশাল বড়ো আম বাগানের ঠিক মধ্যিখানে নাদিফের দাদার বাড়ি।
আজাদ সাহেব, আয়েশা আজাদ হিতে হাত ধরে চলে গিয়েছেন বাড়ির আম বাগানের দিকে। সেখানে একটা কূপ আছে। কথিত আছে, সেই কূপে নাকি হাজার বছর আগে এক জোড়া প্রেমিক যুগলের বিয়ে হয়। আজাদ সাহেবের মানা! এই কূপের কাছে বসে আয়েশা আজাদকে নিয়ে ভাবতেন সবসময় তাই আয়েশা আজাদকে পেয়েছেন তিনি। প্রতিবার এখানে আসলে কূপের কাছে যেতে ভুলেন না।

নাদিফের দাদার বাড়ির নাম ‘ প্রিয় নিবাস’ এই বাড়িটা সকলের অনেক পছন্দের ছিলো। বর্তমানে কেউ থাকে না। নাদিপের দাদা দাদী মারা যাবার পর যে যার কাজে ব্যস্ত হয়ে যায় আর পাড়ি জমায় শহরে।

” আরে নাদু বাবাজি যে! কখন আইলেন? এতোদিন পর এই আদুভাইয়ের কথা মনে পড়ছে? একখান ফোন দিয়া আইলেও তো সব ফিটফাট করে রাখতাম।”

আদুভাই এবং উনার স্ত্রী শেফালী নাদিফের দাদার বাড়ির দেখাশোনা করেন।

” বলে আসলে তোমার মুখের এই হাসি দেখতাম কীভাবে?”

রুপ, রাইসা চারপাশ দেখছে। রাইসা ফোন বের করে গাছ-পালার ছবি তুলছে। এই সুযোগে আকাশ রাইসার পিছু চলে গেলো অভিমান আঙাতে।
প্রিয় নিবাসের সদর দরজা খুলে দেয়া হয়েছে। নাবিল ফাহিমাকে ধরে ভিতরে নিয়ে গিয়েছে। সদর দরজার সামনে রুপ, নাদিফ দাঁড়ানো। শেফালী বেগম কথায় থেকে এসে চিৎকার দিয়ে উঠলো,

” হায় রে নাদু, বিয়ে করে ফেলেছো আমাদের না জানিয়ে! মাশাআল্লাহ, বউ তো খুব সুন্দরী! তোমাদের মানিয়েছে খুব।”

শেফালী বেগমের কথায় রুপ কাশতে শুরু করলো। এদিকে নাদিফ খুব খুশি ইচ্ছে করছে শেফালী বেগমকে ধরে নাচতে।

” এখনও বউ হয়নি ভাবি। খুব শীঘ্রই হয়ে যাবে। সুসময়ের অপেক্ষায় আছি।”

রুপ এসে নাদিফের পিঠে এক কিল বসিয়ে দেয়। রেগে তেড়ে এসে নাদিফের গলা টিপে ধরে,

” বিয়ে তো আপনাকে করবোই না। ঐ রাস্তার কালা মানিককে বিয়ে করবো। আপনার ঠোঁট কাঁ’টা স্বভাবের জন্য কবে যেন আপনাকে মে’রে’ই ফেলি।”

শেফালী,নাদিফ হতভম্ব। রুপের মতো লাজুক,চুপচাপ স্বভাবের মেয়ে কি কান্ড করে বসলো! একদম নাদিফের গলা চেপে ধরলো! মুহূর্তেই কথাটি সকলের মাঝে ছড়িয়ে গেলো। শেফালী বেগম যে চিৎকার করে সবাইকে ডেকে যাচ্ছেন। রুপ নাদিফকে ছেড়ে জিহ্বায় কামড় কাঁ’টে। নাদিফের থেকে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ায়। নাদিফ রুপের অবস্থা দেখে মাথা চুলকে মুচকি হেসে বলে,

” পাগলি রাজি, এখনই ডাকবো কাজি।”

চলবে…………