#প্রেমনগরে প্রশান্তির ভেলা
#আফসানা_মিমি
| একুশ তম পর্ব |
সুখের পর কষ্ট আসে,
রাতের পর দিন
আনন্দে উল্লাসে ভরা,
সুখ দুঃখের মিল।
প্রিয় নিবাসের চারপাশের আমগাছের সকল কাঁচা আম এখন খাঁচায় খাঁচায়। দশটা খাঁচা ভর্তি আমের সামনে রুপকে বসিয়ে রাখা হয়েছে। রুপ অসহায় দৃষ্টিতে সকলের পানে তাকাচ্ছে। রুপের এই বেহাল দশা করেছে সকলের প্রিয় নাদিফ।
নাদিফের সবচেয়ে অপছন্দনীয় সম্বোধন ‘তুই’ ডাকা। রুপ তো অবুঝ মনে তুই ডেকেছে কিন্তু পরবর্তীতে তুই ডাকার ফলাফল যে এতো ভ’য়া’ন’ক হবে তা রুপ কল্পনাও করেনি।
” ছোট ভাইয়ের যেই রাগ! দেখেছি অনেক রেগে আছে। কখন না যেন রুপকে মাথার উপর তুলে জমিনে আছাড় দিয়ে দেয়। তখন না হয় আমরা আমের আচারের পরিবর্তে রুপের আচার খাবো, কি বলো মা!”
আয়েশা আজাদ দুঃখী মনে রুপের অসহায় মুখশ্রী দেখছিলেন। ফাহিমার কঠিন কথা শুনে আয়েশা আজাদের বর্তমানে ইচ্ছে হচ্ছে ফাহিমার মাথায় আমের খাঁচা বোঝাই করে দাঁড় করিয়ে রাখতে তাহলে যদি ফাহিমার একটু আক্কেল হয়।
” তোমরা এখানে কি করছো? দোষ তো তোমরা করোনি যে এখানে অপরাধীদের মতো দাঁড়িয়ে আছো। দোষ যে করেছে সে আজ এই সকল আম সাবারও করবে সে। এটা তুই বলার শাস্তি।”
নাদিফের কথা শুনে আয়েশা আজাদ করুণ চোখে ছেলের পানে তাকায়। কিন্তু পাষান নাদিফের হৃদয় তো পাষান’ই। রুপের দিকে তাকিয়ে আশ্বস্ত চোখে ইশারা করে আয়েশা আজাদ চলে যান স্বামীকে ডাকবে বলে। যাওয়ার সময় কাবাব মে হাড্ডি হয়ে থাকা ফাহিমাকে সাথে করে নিয়ে যেতে ভুলেন নি।
রাইসা আকাশের সাথে ঘুরতে বের হয়েছে। বর্তমানে দুই একজন কাজের লোক আছে। যাদেরকেও নাদিফ চোখের ইশারায় চলে যেতে বলে।
মাথার উপর বড়ো বড়ো আম গাছ দণ্ডায়মান হয়ে আছে। যেদিকে তাকাবে সেদিকেই আম বাগান। এই জায়গায় আসলামপুর নাম না হয়ে আমপুর হলে ভালো হতো বলে মনে করে রুপ। রুপ বর্তমানে আম বাগানের মধ্যেই বসে আছে। রুপের সামনে নাদিফ চেয়ার পেতে বসে আছে ঠিক দ্বিতীয় দিনের মতো যেদিন রুপ প্রেম নগরে এসেছিলো তার পরের দিন আর কি।
” কি ভাবছেন আমখোর? আম খান! আপনি আম খেতে না পেরে মানুষকে তুই বলেও সম্বোধন করতে ভাবেন না। তো আম খাওয়া শুরু করুন।”
রুপ অসহায় দৃষ্টিতে নাদিফকে দেখছে। নাদিফের গাম্ভীর্যভাব রুপকে আহত করছে। রুপ মিনমিন কন্ঠস্বরে প্রত্যুওর দেয়,
” আমি অনেক খুশি হয়ে গিয়েছিলাম। মনের সকল আনন্দ যেন বের হয়ে আসছিলো। ভুলে আপনাকে তুই বলে ফেলেছি। এবারের মতো ক্ষমা করে দিন।”
নাদিফ যেন এই কথার অপেক্ষায় ছিলো। রুপের ক্ষমা চাওয়া দেখে নাদিফের মুখে বাঁকা হাসির রেখা ফুটে উঠে, যা রুপের নজর এড়ালো না। নাদিফ চেয়ার নিয়ে একদম রুপের কাছাকাছি গিয়ে বসে। এতে রুপ কিছুটা পিছনে ঝুঁকে যায়। নাদিফ রুপের কাছে এসে বলে,
” এত সহজে ক্ষমা পাবে না রুপ! আমার কিছু শর্ত আছে। রাজি হলে ক্ষমা পাবে, নয়তো যা বলবো তা করতে হবে।”
রুপ নাদিফকে বর্তমানে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু এছাড়া আর উপায় নেই। রুপের এখন একটুও ইচ্ছে নেই আম খাওয়ার। নাদিফ যেমন রাগী আর ত্যাড়াবাঁকা স্বভাবের। রুপ যদি নাদিফের শর্তে রাজি না হয় তাহলে দেখা যাবে এই সব আম নাদিফ রুপের পেটে ঢুকিয়ে ই ছাড়বে।
” কঠিন শর্ত দিবেন না। সহজ, সহজ, ভালো, ভালো শর্ত দিবেন।”
রুপের কথায় নাদিফ হাসলো। হাত দ্বারা মাথার চুল পিছনের দিকে টেনে ধরলো। এরপর রুপের দিকে কিছুটি ঝুঁকে বলল,
” আমাকে ভালোবাসো তা স্বীকার করতে হবে। নয়তো আজ আমাকে বিয়ে করতে হবে। অথবা এই সবগুলো আম এখন খেতে হবে।”
রুপ বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে গেলো। নাদিফির তিনটা শর্তের একটা শর্তও পালন করা সম্ভব নয়। রুপ কটমট চোখে নাদিফের পানে তাকায়। নাদিফ দাঁত কেলিয়ে হাসছে। নাদিফের এই হাসি দেখে রুপের গা জ্বলে যাচ্ছে। রুপ মনে মনে দোয়া করছে যেন মিরাকেল কিছু হয়ে যায়। কিন্তু রুপ জানে এটা বাস্তবতা, মিরাকেল হওয়ার সম্ভাবনা নেই। রুপ রাগান্বিত কন্ঠস্বরে নাদিফের উদ্দেশ্যে বলে,
” আপনি জানেন! পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ পুরুষ আপনি? এতো লোভ কেন আপনার? আপনার এক শর্তেও আমি রাজি না।”
নাদিফ এবার হো হো করে হেসে উঠলো। প্রত্যুত্তর করল,
” এই তিন শর্ত ছাড়া আরেকটা শর্ত তোমার জন্য যোগ করে দিলাম। অতি সহজ শর্ত। এখন, এই মুহূর্তে আমাকে নাম ধরে ডাকতে হবে আর ভালোবাসি বলতে হবে।”
রুপের এখন ইচ্ছে করছে দৌঁড়ে কোথাও পালিয়ে যেথে তাহলে নাদিফের কঠিন শর্ত থেকে বেঁচে যাবে। রুপের এই সিদ্ধান্তই আপাতত পালন করবে রুপ। আস্তে আস্তে পিছনে পা বাড়াচ্ছিলো রুপ পালিয়ে যাওয়ার জন্য। নাদিফ রুপের চালাকি বুঝে যায়। ধরে ফেলে রুপের হাত টেনে নিয়ে আসে রুপকে নিজের কাছে।
” একবার ভালোবাসি বললে তোমার কন্ঠনালীতে পোকা ধরবে না। তুমি বুঝতে পারছো না কতটা ছটফট করছি এই শব্দটা শোনার জন্য?”
রুপ নাদিফের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে অপলকে। নাদিফের চোখে রুপেয জন্য আঘাত ভালোবাসা দেখতে পাচ্ছে রুপ। নাদিফের চোখে রুপকে পাবার আকুলতা। রুপকে যেন এক অন্য রাজ্যে নিয়ে চলে যাচ্ছে। রুপের হাত আপনা আপনি নাদিফের গালে চলে গেলো। নাদিফের চোখে চোখ রেখে রুপ বলতে শুরু করল,
” ভালোবাসা কি সবসময় মুখে’ই স্বীকার করতে হয়, বুঝে নেওয়া যায় না! ভালোবাসা কি প্রকাশ্যে দেখাতে হয়, অনুভব করা যায় না? ভালোবাসা তো অন্তরের অভ্যন্তর থেকে আসে, প্রকাশ করতে যে দ্বিধা নেই। কিন্তু কীভাবে বলি আপনাকে ভালোবা,,,,,
রুপ নিশ্চুপ। নাদিফের নিশ্বাস যেন আটকে আসছে রুপের শেষোক্ত কথা শ্রবণ করার জন্য। নাদিফের গালে রাখা রুপের হাত শক্ত করে ধরে হাতের উল্টো পিঠে অধর ছুঁয়ে দিলো নাদিফ। বিচলিত কন্ঠস্বরে বলল,
” থামলে কেন অপরুপ! বলো, সম্পূর্ণ করো তোমার অসম্পূর্ণ কথা। আমার অস্থিরতা যে বেড়ে যাচ্ছে।”
রুপ এবার খুব লজ্জা পাচ্ছে। নাদিফের বাহুবলে রুপ আবদ্ধ। আপ্রাণ চেষ্টা করছে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে।
” ছাড়ুন দয়া করে! কেউ দেখলে সমস্যা হবে।”
” নাদিফ ভাইয়া?”
কোন মেয়ের কন্ঠস্বর শুনে নাদিফ রুপকে ছেড়ে দিলো। রুপ যেন হাঁফ ছেড়ে বেঁচে গেলো। নাদিফ, রুপ পিছনে ফিরে তাকালো। লাল সুতি শাড়ি গায়ে পেঁচিয়ে একজন মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বয়স সতেরো কি আঠারো হবে। মুখে হাসির রেখা। চোখে পানি চিকচিক করছে। যেন এই মুহূর্তে চোখের পানি ঝড়ে যাবে। অদূরে দেখা যাচ্ছে আজাদ সাহেবকে একজন লোকের সাথে কথা বলতে বলতে আসছেন। মেয়েটি এবার নাদিফের কাছে এসে দাঁড়ালো। একদম কাছে। যেন মেয়েটা নাদিফের প্রেমিকা হয়। নাদিফ কিছুটা পিছনে চলে খেলো মনে করতে চেষ্টা করলো কে এই মেয়ে। অবশেষে স্বরণে আসে নাদিফের। চোখ বড় বড় করে তাকায় মেয়েটির পানে নাদিফ। নাদিফের ভাবভঙ্গি পর্যবেক্ষণ করছে রুপ। নাদিফের বিস্ময়কর দৃষ্টি রুপের দৃষ্টিতে এড়ালো না। নাদিফ অবাক হয়ে মেয়েটির উদ্দেশ্যে বলে,
” তুমি মায়া না? হামিদ চাচার ছোট মেয়ে? কতো বড়ো হয়ে গিয়েছো। আমি তো চিনতেই পারিনি।”
” হ্যাঁ বড়ো হয়ে গিয়েছি। মা বলেছে বিয়ের বয়স হয়েছে। শাড়ি পরিধান করা শিখেছি তোমার জন্য। তুমি না শাড়ি পছন্দ করো! দেখো, আজ শাড়ি পরে এসেছি। এবার আমাকে বিয়ে করো।”
রুপ কিছুক্ষণের জন্য ভেবেছিলো। বউ হবার আগেই সতিন এসে হানা দিচ্ছে রুপের জীবনে। নাদিফের কথা শুনে বুঝতে পারলো মেয়েটা চাচাতো বোন হবে। ফোঁস করে নিশ্বাস ত্যাগ করলো রুপ। কিন্তু পরমুহূর্তে মেয়েটির কথা কর্ণধারে আসতেই চোখ জোড়া বড়ো হয়ে যায় রুপের।
নাদিফ ভয়ার্ত চোখে রুপের পানে তাকায়। এই দুই ফুট মেয়ের কথা নাদিফের মস্তিষ্কে প্রবেশ করছে না সঠিকভাবে। না জানে রুপ কি ভেবে নিয়েছে। এমনিতেই মেয়েদের মনে জিলাপির প্যাঁচ থাকে। প্রেম এখনও শুরু হলো না এমনিই প্যাঁচ লাগানোর জন্য এই মেয়ে চলে এসেছে!
রুপ হনহন করে প্রিয় নিবাসে ফিরে গেলো। পড়ে রইলো নাদিফ আর পিচ্ছি মায়া। যার দিকে আপাতত নাদিফ মায়াহীন চোখে তাকিয়ে আছে। এই মেয়েটার দুই কথার জন্য রুপ চলে গিয়েছে রাগ করে। নাদিফের এখন মায়ার দিকে তাকিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে,
” কেন এলি রে মায়া আমার জীবনে,
ঝড় তুফান সব নিয়ে। চলে যা মায়া চলে যা।”
প্রিয় আবাসের দিকে তাকিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে,
” যেয়ো না সাথী,
ওওওওওও
যেয়ো না সাথী
ছেড়ে আমাকে একা পথেএএএএ
যেয়ো না সাথী।”
চলবে………