#প্রেমনগরে প্রশান্তির ভেলা
#আফসানা_মিমি
| বাইশ তম পর্ব | বোনাস পর্ব
প্রিয় নিবাসে আজ গল্পের আসর জমেছে। পুরুষেরা সোফার ঘরে বসে আড্ডা দিচ্ছে আর উচ্চস্বরে হাসছে। আজাদ সাহেবের আজ কোন পাত্তা নেই। ছোট ভাইকে পেয়ে বউ বাচ্চাদের ভুলে গিয়েছে। আজাদ সাহেবের আপন কেউ নেই। একমাত্র চাচাতো ভাই আছে, হামিদ। হামিদের তিন সন্তান তিনজন’ই মেয়ে। স্ত্রী আছেন। গ্রামে বড়ো হওয়া হামিদের মেয়েদের মধ্যে বড়োজনের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। মেজো জন মায়া, ছোট ছায়া বয়স পাঁচ বছর।
” ভাবি দেখি আগের চেয়ে অনেক রূপবতী হয়ে গিয়েছেন? সেই যে পাঁচ বছর আগে যে এলেন! তখনও একইরকম দেখতে ছিলেন। ভাইজান বুঝি খুব ভালোবাসে! এজন্যই তো দিনে দিনে রূপসী হচ্ছেন।”
সোফার গরে আড্ডা দিচ্ছে পুরুষেরা। মহিলারা আড্ডা থেকে বিরত থাকবে কেন? আয়েশা আজাদ ঘরে আধ শোয়া হয়ে পান চিবুচ্ছেন। পাশে বসে আছেন হামিদের স্ত্রী মিতালি। ফাহিমা মুখ গোমড়া করে শাশুড়ির পা চেপে দিচ্ছে এটাও ফাহিমার শাস্তি।
এদিকে মিতালির কথা শুনে রুপ কেশে উঠলো। হাঁটুর বয়সী মেয়েদের সামনে এসব না বললেই নয়! রুপ অন্য দিকে ফিরে তাকালো। যেন সে কিছু শুনে নি। আয়েশা আজাদও যেন একটু লজ্জা পেলেন। কথা ঘোরানোর জন্য মিতালির উদ্দেশ্যে বললেন,
” আমার কথা বাদ দে মিতালি। তোর চোখে হয়তো ময়লা পড়েছে তাই ভুলভাল দেখছিস। তা তোর মেজ মেয়েটা তো দেখি মাশাআল্লাহ বড়ো হয়ে গিয়েছে সাথে রূপবতী। আমি তো ন্রথম দেখাতে চিনতেই পারিনি।”
আয়েশা আজাদের কথা শুনে মিতালির মুখ আনন্দে চিকচিক করে উঠে যা রুপের নজরে এড়ায় না। মিতালি দূরে বসে থাকা মায়াকে নিজের কাছে ডেকে নিয়ে আসে যে আপাতত নাদিফকে চক্ষু দ্বারা গিলতে ব্যস্ত। মায়াকে আয়েশা আজাদের কাছে এনে দাঁড় করিয়ে মিতালি বলতে শুরু করে,
” আর বলবেন না ভাবি, আমার মেয়েটা রুপে গুনে একদম পাকা। এমন কোন কাজ নেই পারে না। আর সবচেয়ে বড়ো কথা মায়া নাদিফ বলতে পাগল। যখন শুনেছে নাদিফ এসেছে পাগল হয়ে গিয়েছে কি রান্না করবে, কি পরে আসবে তা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।”
আয়েশা আজাদের চোখ কোটর থেকে বের হয়ে আসার উপক্রম। আড়চোখে রুপের দিকে একবার দৃষ্টিপাত করে। রুপ অনুভূতিহীন। বসে বসে সকলের কথা শুনছে। আয়েশা আজাদ মিতালির কথায় মুখে হাসির রেখা এনে বলে,
” আহা! বড়ো ভাইয়ার জন্য কি ভালোবাসা মেয়েটার। আমার দুই ছেলের কতো ভালো ভাগ্য দেখেছো মিতালি! তিন তিনটে বোন পেয়েছে। একদম আপন বোনের মতো।”
আয়েশা আজাদের কথা শুনে মিতালির মুখ একটুখানি হয়ে যায়। মেয়ের দিকে তাকিয়ে দেখে ড্যাব ড্যাব চোখে বড়ো জা এর দিকে তাকিয়ে আছে যেন বড়ো জা অবিশ্বাস্যকর কথা বলেছে। মিতালি মুখে মিথ্যা হাসি এনে প্রত্যুওরে বলে,
” হ্যাঁ নাবিল তো বড়ো ভাই। মায়া তো নাবিলকে বড়ো ভাইয়ের মতোই দেখে। কিন্তু নাদিফ বাবাজি,,,,,
মিতালির কথা শেষ হওয়ার আগেই বোকা ফাহিমা ভালো কথা বলে উঠে,
” আরে মা বুঝছো না! চাচী বলতে চাইছে মায়া শুধু আমার সোয়ামিকে ভাই হিসেবে মানে আর ছোট ভাইয়াকে জামাই হিসেবে। কিন্তু ছোট ভাইয়ার জন্য তো মেয়ে দেখা হয়েছে। এই যে আমাদের সামনে বসে আছে! আমাদের রুপ!”
আয়েশা আজাদ আজ মনে মনে খুব খুশি ফাহিমার কথা শুনে। আয়েশা আজাদ নিয়ত করেছেন এখন থেকে ফাহিমাকে আর বকবেন না, অনেক আদর করবেন। কেননা আয়েশা আজাদের পুত্রবধূর মুখ যতই চলুক না কেন আয়েশা আজাদের না বলা কথা বলে দিয়েছে।
এদিকে ফাহিমার কন্ঠনালী থেকে বের হওয়া স্বর শুনে মিতালির মাথা যেন ঘুরাচ্ছে। ফাহিমার মুখে হাত। মায়া চোখ বড়ো বড়ো করে রুপকে দেখে যাচ্ছে। আর রুপ সে নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে আছে ফাহিমার দিকে তাকিয়ে।
” এই মেয়ে আবার কে, আপা?”
” শুনলে না! আমার হবু বউমা।”
” ওওওও। আমি ভেবেছিলাম আপনার আত্মীয় হবে।”
মিতালি আরো কিছুক্ষণ অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কথা বলে চলে যাওয়ার জন্য উদ্যোগ নিলেন।
” মা তুমি যাও। আমি নাদিফ ভাইয়ার জন্য যে খাবার রান্না করে নিয়ে এসেছি তা নাদিফ ভাইয়াকে খাইয়ে তারপর বাসায় যাবো।”
মিতালি একবার মায়াকে না করতে চাইছিলো কিন্তু পরমুহূর্তে কি যেন ভেবে বলল,
” আচ্ছা তুই বরং থেকে যা। রাতে নাদিফকে বলিস বাসায় পৌছে দিতে। আসি ভাবি।”
মিতালি চলে গেলো। সাথে মায়াও ঘর থেকে বের হয়ে গেলো। আয়েশা আজাদ শোয়া থেকে উঠে ফাহিমার কপালে চুমু এঁকে দিলেন এবং হাস্যজ্বল মুখে বললেন,
” এই প্রথম আমার মেয়েটা সঠিক জায়গায় সঠিক কথা বলেছে। বল মা কি চাই তোর!”
ফাহিমা শাশুড়ির কথা শুনে খুশিতে আধখানা। হাতে থাকা মোবাইল বের করে কিছুক্ষণ আঁকিবুঁকি করে একখানা ছবি বের করে শাশুড়ির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
” আমার এমন কোমড়ের বিছা চাই মা! কিনে দিবে? তোমার ছেলে কিপ্টা তার বাবার মতো, তুমি তো আমার শাশুড়ি মা। অনেক ভালো। বলো না কিনে দিবে কি না!”
” কি বললি তুই! আমার স্বামী কিপটা?”
আয়েশা আজাদ সজোরে ললাটে আঘাত করে বসলেন। আয়েশা আজাদ কিছুক্ষণের জন্য আনন্দে ভুলে গিয়েছিলেন যে এই এলিয়েনটা ফাহিমা অন্য কেউ না। অগত্যা আয়েশা আজাদ রাজি হয়ে গেলেন। প্রেম নীড়ে ফিরে ফাহিমাকে কোমড়ের বিছা কিনে দিবেন।
————–
” এই মেয়ে তুমি কি রান্না করতে জানো?”
রুপ প্রিয় নিবাসের দখিণের বারান্দায় চেয়ার পাতা আছে সেখানে বসে আছে। চারপাশে পাখিদের কিচিরমিচির শোনা যাচ্ছে তা শুনছিলো। তখনই মায়ার আগমন। মায়ার কথায় স্পষ্টত হিংসা বিদ্যমান। রুপ মুচকি হেসে মায়ার কথার প্রত্যুওর দেয়,
” আমি কোন রান্না করতে জানি না। কেন বলো তো!”
মায়ার যেন এবার নিজেকে অনেক গুনী মনে হচ্ছে। কেননা গ্রামে বড়ো হওয়া মায়া কাজে কামে কর্মঠ। এদিকে রুপ এতিমখানায় বড়ো হয়েছে। রান্নার কাজে অকর্মঠ।
” ওমা তুমি রান্না জানো না, কিন্তু বউ হবে কীভাবে? মা বলে, শশুড় বাড়িতে রান্না করে সবার মন জোগাড় করতে হয়। শাশুড়িকে হাত করতে হলে কাজ করতে হবে বেশি বেশি। শ্বশুরের পকেট ফাঁকা করতে হলে খাবারে নুনের স্বাধ বাড়াতে হবে। আর জামাইকে খুশি করাতে হলে,,,,,
” চাচীতো দেখি তোকে ভালো’ই শিক্ষা দিয়েছে মায়া। তা স্বামীকে খুশি করতে হলে কি করতে হয়! আদর করতে হয়! নাকি কোমড় বেঁধে ঝগড়া করতে হয়?”
মায়ার কথা আর শেষ হলো না। নাদিফের আগমনে মায়ার কথা মুখেই আটকে গেলো, বলা হলো না। রুপ রাগান্বিত চোখে নাদিফের পানে তাকিয়ে রইলো। ছোট বাচ্চাদের সামনে লাগামহীন কথা না বললে হতো না! আকাশ রাইসা নাদিফের পিছু আসছিলো। নাদিফের কথা শুনে হাসতে লাগলো।
” নাদিফ ভাইয়া! তুমি এসেছো? তোমার জন্য আমি ইলিশ মাছ রান্না করে এনেছি।”
নাদিফ এসে রুপের পাশে একদম ঘেঁষে দাঁড়ালো। মায়াকে একবার মাথা থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত দেখে নিলো। নাদিফের মুখে বাঁকা হাসি। যেন মায়ার কথা নাদিফের কর্ণধারে পৌঁছেনি,
“শাড়ি পরে এসেছিস? কিন্তু কেন? তোকে দেখতে এসেছে কি? এতো ছোট বয়সে তোকে বিয়ে দিয়ে দিবে চাচা? নাক টিপ দিলে এখনই তো দুধ বের হবে আর এখনই বিয়ে? আমি বাবা যদি পাত্র হতাম তাহলে তোকে এক দেখায় রিজেক্ট করে দিতাম। কেননা তুই অল্প বয়সে বেশি পেকে গিয়েছিস। আমি আবার আমার বাবা-মা এমনকি নিজেকেও বেশি ভালোবাসি। এখন কেউ তো নিছ ইচ্ছে’ই কপালে কোড়াল মারতে পারি না, কি বলো রুপ?”
রুপ মুচকি হাসছে নাদিফের কথায়। এই মায়া, ছলনার ছায়া এসেছিলো রুপকে অপমান করতে কিন্তু বরাবরের মতোই নাদিফ এসে রুপকে বাঁচিয়ে দিলো।
মায়ার চেহারা বর্তমানে দেখার মতো। নাক ফুলিয়ে, ঠোঁট উল্টে কান্না করে দিবে এমন। মায়া এখন নিজের বোকামিতে খুবই বিরক্ত। কেন যে আগ বাড়িয়ে প্রিয় মানুষটির সামনে খারাপ হতে আসলো। মায়া অবুঝের মতো নাদিফের কথার প্রত্যুওর করল,
” আমি তো মজা করছিলাম আপুটার সাথে। আপু চুপচাপ বসে ছিলো তাই গ্রামের রীতি বলছিলাম। আমাকে মা ডাকছে আমি যাই।”
মায়ার আর থাকা হলো না। নাদিফের সামনে ভালোও সাজা হলো না। বড়ো বড়ো পা ফেলে চলে গেলো। এদিকে মায়া চলে যেতেই আকাশ চিল্লিয়ে বলতে শুরু করে,
” ওহে পিচ্ছি, তোমার মা সেই কবে চলে গিয়েছে বাড়িতে, তোমাকে ঝুলিয়ে আমার বন্ধুর ঘারেতে।”
আকাশের কথায় সকলে হেসে উঠে। নাদিফ ভ্রু কুঁচকে আকাশের উদ্দেশ্যে বলে,
” তুই এতো কিছুর খবর রাখিস কীভাবে? নজর ঠিক কর আকাশ? পাশে আমার শালিকা আছে। তোর সব বাঁদরামি বের করে ছাড়বে।”
” শা’লা তুই বন্ধু না শত্রু! তোর সাথে কথা বলা’ই বেকার। চলো তো ফুলটুসি! তোমাকে দিন তারা দেখাই! অনেক সুন্দর দেখতে হয় দিন তারা।”
আকাশ রাইসাকে নিয়ে পিছনের বারান্দার দরজা খুলে চলে যায় বাহিরে।
এদিকে রুপ নাদিফ বর্তমানে একা। রুপ সমানতালে দুই হাত ঘর্ষণ করে যাচ্ছে। নাদিফের কাছে রুপের এই অভ্যাস বেশ লাগে। ভয় পেয়ে যখন রুপ এদিক সেদিক নজর ঘুরায় তখন খুব মায়াবী লাগে। নাদিফ রুপের গায়ে হালকা করে ধাক্কা দেয় নিজের বাহু দিয়ে। মুখে দুষ্টুমির হাসির রেখা টেনে এনে বলে,
” কি গো সুন্দরী! ছোটদের কাছ থেকে সংসার সামলানো শিখছিলে নাকি? বলে রাখি প্রিয়া ঐসব সংসার শিখতে হবে না তোমায়। এই আমাকে দেখো! আমি কিন্তু সবসময়ই ফ্রি তোমার জন্য, তোমাকে সময় দেয়ার জন্য। হয়ে যাও না এবার রাজি, অপরুপা হয়ে যাও রাজি!”
চলবে………