প্রেমনগরে প্রশান্তির ভেলা পর্ব-২৫

0
624

#প্রেমনগরে প্রশান্তির ভেলা
#আফসানা_মিমি
|পঁচিশ তম পর্ব |

বৈশাখীর শেষ মৌসুম বড়োই আজব। ক্ষণে ঝুমঝুম করে মেঘের আগমন তো ক্ষণে রোদের উত্তাপ। মধ্যাহ্নের সময়ে সূর্য ঠিক মাথার এক হাত উপরে যেন চলে আসে। কড়া রোদের উত্তাপে শরীর থেকে ঘামের সহিত পানি বের হয়ে যায় এই রোদে।
রুপ আজ একটু বেলা করে প্রেম নীড় থেকে বের হয়েছে। এই সময়ে রুপের বাহিরে কোন কাজ নেই। তবে প্রিয় মানুষটিকে চমকে দিবে রুপ এজন্য শত কষ্টের মধ্যেও বের হয়ে এসেছে।
কাঁধে ঝুলিয়ে রাখা ব্যাগখানা আজ ছুঁয়ে দিতেও শান্তি লাগছে রুপের কাছে। আজ রুপ হেঁটে প্রেম নীড়ে ফিরছে। যতটা পথ হেঁটে এসেছে, কতবার যে ব্যাগ ছুঁয়ে দিয়েছে হিসেব নেই।
রুপের মুখশ্রী আজ চিকচিক করছে খুশিতে। অবশেষে যে নাদিফের মনের বাসনা পূর্ণ হবে। রুপ বর্তমানে ব্লক এ তে অবস্থান করছে। প্রেম নীড় ব্লক সি তে। আরো পনেরো মিনিট লাগবে পৌঁছাতে। মধ্যাহ্নের এআ সময়টা স্কুল কলেজের ছাত্রদের ক্লাসের সময়। এই সময়ে কোন স্কুল বা কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের বাহিরে দেখা মানে স্কুল ফাঁকি দিয়ে ঘুরছে।

ব্লক এ-তে এসেই রুপের চোখের সামনে এক জোড়া পরিচিত মুখশ্রী ভাসমান হলো। ফাল্গুনী আর ফয়সাল। ফয়সাল ফাল্গুনীর হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে। ফাল্গুনী অনেক চেষ্টা করে যাচ্ছে হাত ছাড়ানোর।
রুপ কঠিন মুখে ফয়সাল ফাল্গুনীর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আজ রুপ অনেক বকে দিবে ছাত্র-ছাত্রীদের। রুপ ফাল্গুনীর নিকট আসতেই শুনতে পেলো ফয়সালের রাগান্বিত স্বর,

” দেখ ফাল্গুনী, আমি এবার সিরিয়াস। তোকে আর প্রস্তাব মানতেই হবে। নয়তো তোর খবর আছে।”

ফয়সালের কথার প্রত্যুওরে ফাল্গুনী বলছে,

” ছেড়ে দে আমায় ফয়সাল! তুই আমার মন তো দূরের কথা আমার মুখ থেকে কথাও বের করতে পারবি না।”

” এই যে কথা বলছিস! এভাবেই আমি যা শুনতে চাইছি তা বলে ফেল।”

” কখনোই না কু’ত্তা। তুই সব ছেড়ে এখন আমার পিছনে লেগেছিস কেন?”

” কেননা সে তোমাকে ভালোবাসে।”

রুপের কন্ঠস্বর শুনে ফয়সাল ফাল্গুনীর হাতে ছেড়ে দেয়। ফয়সালের দৃষ্টি জমিনে নিবদ্ধ ভুলেও রুপের দিকে তাকাচ্ছে না। ফাল্গুনী ভয়ার্ত চোখে রুপের পানে তাকিয়ে আছে। রুপের কথার প্রত্যুওরে ফাল্গুনী বলল,

” মিথ্যা বলে এই ছেলে। আমাকে কখনও ভালোবাসে নাই। কিছুদিন আগেও আপনার পিছু ঘুরেছে এরপর যেই না নাদিফ ভাইয়ার হাতে উওম মাধ্যম খেয়েছে তারপর লাইনে আসছে।”

” তুমি সত্যি বলছো? এসব কি শুনি ফয়সাল? তোমার মায়ের নাম্বার দাও। এক্ষুনি উনার ছেলের কু কর্মের কথা জানাচ্ছি।”
” আমি বলছি ম্যাডাম। শূন্য, এক, ছয়,,,,,,

ফাল্গুনীর কথা শেষ হতে দিলো না ফয়সাল। ফাল্গুনীর মুখ চেপে ধরলো যেন কোন কথা বলতে না পারে।
রুপ আর ঘাটলো না। স্কুল ফাঁকি দেয়ার জন্য শক্ত কয়েকটা কথা বলবে রুপ এদের,

” এই সময়ে স্কুলে না গিয়ে এখানে কি করছো?”

” ওরা প্রেম করছে স্কুল ফাঁকি দিয়ে। চলো তুমিও একই কাজ করবে ওদের বকা বাদ দিয়ে।”

রুপের রাগ মাটির সাথে মিশে গিয়েছে নাদিফের আগমনে। নাদিফের মুখে দুষ্টু হাসির রেখা। মাত্র ঘুম থেকে উঠে এসেছে হয়তো! মাথার কেশব অগোছালো মুখে ঘুমঘুম ভাব বিদ্যমান। রুপ শুকনো ঢুক গিললো নাদিফের এরুপ দেখে। এক মিনিটের চেয়ে বেশি সময় তাকাতে পারলো না রুপ দৃষ্টি নত করে ফেলল,

” তা বাচ্চারা এখানে কি তোমাদের?”

নাদিফকে দেখা মাত্রই ফয়সাল ভয় পেয়ে যায়। ফাল্গুনী আশার আলো যেন দেখতে পায়। বিনা সংকোচে ফয়সালের নামে নালিশ করে বসে নাদিফের কাছে,

” ভাইয়া এই ফোর টোয়েন্টি এখন আমার পিছু লেগেছে। দুনিয়ার সব মেয়েদের পিছনে ঘুরে পাত্তা না পেয়ে আমাকে মনে পড়েছে। আমি এই বাদরকে ভালোবাসি না। আপনি বলে দিন আমি এক মিনিটের জন্যও ভালোবাসবো না।”

ফাল্গুনীর কথায় রুপের চোখ বড়ো হয়ে গেলো। নাদিফ বাঁকা হেসে রুপের দিকে তাকিয়ে আছে। ফাল্গুনীর উদ্দেশ্যে বলে,

” এটা তো খুবই খারাপ হচ্ছে তোমার সাথে। তা তুমি কি চাও? দূরে সরে যেতে চাও? তাহলে পাত্তা দিও না। বন্ধুত্ব নষ্ট করে দাও।”

ফাল্গুনী নিশ্চুপ হয়ে আছে। নাদিফ ফাল্গুনীর নিস্তব্ধতা দেখে হাসে। ফয়সালের উদ্দেশ্যে বলে,

” কি মিয়া! এবার কি সত্যি সত্যিই? নাকি ক্ষণিকের মোহ?”

ফয়সাল এবার মাথা উঁচু করলো। বুকে সাহস এনে বলল,

” আমি বাঁচতে চাই তাকে নিয়ে, সাত সমুদ্র পাড়ি দিতে চাই তাঁর সাথে। আজীবন ভালোবাসতে চাই, ভালোবাসা শিখাতে চাই এই মেয়েটাকে।”

রুপ হা করে নিজের ছাত্রছাত্রীদের দেখছে। এদের মনে এতো প্রেম কীভাবে আসে কে জানে! রুপের কর্ণধারে ক্ষণিকের জন্য কান্নার আওয়াজ চলে আসে। ফাল্গুনীর দিকে তাকিয়ে দেখে ফাল্গুনী কান্না করছে। রুপ কপালে আঘাত করে উঠে। একদিকে প্রেম নীড়ের সকলের ড্রামা আর অপরদিকে ছাত্রছাত্রীদের প্রেমলীলা। রুপ যেন পাগল হয়ে যাচ্ছে।

” এই মেয়ে কান্না করছো কেন? তুমিও তো ফয়সালকে পছন্দ করো। এখন এতো অজুহাত দেখাচ্ছো কেন? স্কুল ফাঁকি দিয়ে এসব করছো বলে কি কান্না করছো?”

” আমি সেই বাচ্চা কাল থেকে এই বাদরকে পছন্দ করি। কিন্তু এই বজ্জাত এতো দেরি করলো কেন? আমি রাজি হবো না ম্যাডাম।”

ফাল্গুনীর কান্না বন্ধ হয়ে যায় আপনা আপনি। ফয়সাল চোরা চোখে ফাল্গুনীর দিকে তাকাচ্ছে। ফাল্গুনী যে ফয়সালকে পছন্দ করে তা অনেক আগে থেকেই জানতো সে। ফাল্গুনীর নিষেধাজ্ঞা, যত্ন, আদেশ,নিষেধ সবকিছুতে যে কখন ফয়সালের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে তা ফয়সাল জানে না। তবে এখন যে সঠিক সময় হয় নি তা ফয়সাল জানে কিন্তু সুযোগ হাতছাড়া করতে নেই। ক্লাস থেকে দুইজন’ই ছুটি নিয়ে চলে আসে।
ফাল্গুনীকে মা’রতে ফায়সাল অনেক আনন্দ পায়। এজন্য সুন্দরভাবে উওম পরিবেশে মনের কথা ফাল্গুনীকে না বলে এমন চৌরাস্তায মোড়ে ধমকে, হু’ম’কি দিয়ে মপের কথা বলেছে। ফাল্গুনী শোনার পর থেকেই এক প্রকার চিৎকার করে বলে যাচ্ছে যে সে রাজি না। কিন্তু ফয়সাল নাছোড় বান্দার মতো মে’রে ফাল্গুনীকে রাজি করাচ্ছিলো।

” বাসায় যাও তোমরা। তোমাদের ম্যাডামকে ঘু’ষ খাওয়াচ্ছি আমি।”

ফয়সাল ফাল্গুনীকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে সম্মুখে। রুপ নাদিফের আড়াল হতেই ফয়সাল ফাল্গুনীকে একটি দালানের দেয়ালে আটকে নেয়। ফাল্গুনীর মুখে ফুঁ দিয়ে বলে,

” ভালোয় ভালোয় রাজি হয়ে যা। নয়তো রুপ ম্যাডামের কাছে নালিশ করবো যে তুই আমাকে ফাঁসিয়েছিস, তোর প্রেমে পড়তে বাধ্য করেছিস।”

ফাল্গুনীর চোখ বড়ো করে তাকায়। ফয়সালের চোখে অগাধ ভালোবাসা দেখতে পায়। ফাল্গুনী মুচকি হেসে অপর পাশে ফিরে বলে,

” যাহ মিথ্যাবাদী।”

————
প্রেম নীড়ে মানুষজনের দৌঁড়ঝাপ দেখা যাচ্ছে অনবরত। নতুন মুখশ্রী দেখে রুপ নাদিফ উভয়েই চমকে যায়। এক ঘন্টার ভিতরে বাড়ির চেহারাই যেন পাল্টে গিয়েছে। খাবারের টেবিলের উপর নানান প্রজাতির মিষ্টান্নে ভরপুর। রুপ কিছু একটা আন্দাজ করতে পায়। রান্না ঘরে চলে যায় আসল কথা জানতে।

” আমার এই অবস্থায় যদি আব্বা আপনাকে বলি যে টাক হয়ে যান, তাহলে কি তাই করবেন?”

প্রেম নীড়ে খুশির আমেজ। আজাদ সাহেব এবং আয়েশা আজাদ আজ ভীষণ খুশি। দুজনেই অবস্থান করছেন বড়ো ছেলের ঘরে। ফাহিমা বিছানায় শায়িত, চোখে মুখে ক্লান্তি। অনিমেষে তাকিয়ে আছে শ্বশুরের পানে উওরের আশায়। আজাদ সাহেব পুত্রবধূর কথা শুনে কেশে উঠে। আস্তে করে উওর দেয়,

“মারে! এসব বাজে ভাবিস না। তোর জন্যই ক্ষতি হবে। ভালো কিছু ভাব। যেমন: ফুল, ফল, পাখি।”

আজাদ সাহেবের কথায় ফাহিমা উত্তেজিত হয়ে উঠলো। শোয়া থেকে উঠে বলতে শুরু করল,

” আব্বা টাক হয়ে যান। আমার মনের ইচ্ছে পূরণ করে দিন। এই সময়ে আমার এই ইচ্ছে হচ্ছে।”

আয়েশা আজাদ পাশে দাঁড়ানো ছিলো। স্বামীর অসহায়ত্বতা দেখে ফাহিমার উদ্দেশ্যে বলে,

” এমনিতেই ছিলি ভাঙ্গা হাড়ি, তার মধ্যে এখন শুরু ঢোলের বারি। বলি কি! তোর বাচ্চা পেটে তাই বলে যে তুই খাওয়ার পরিবর্তে আমাদের দৌঁড় করাবি তা ডাক্তার বলেনি।”

ফাহিমা শাশুড়ির কথায় একমত না। কিছুক্ষণ আগেই স্বাস্থ্য ক্লিনিক থেকে একজন সেবিকা এসেছিলেন। ফাহিমার বমি, মাথা ঘোরানোর কথা শুনে ঘরে বসেই গর্ভাবস্থার সারন্জম এনে পরীক্ষা করায়। চূড়ান্ত ফলাফল পেয়ে সকলকে জানায় এবং বলে অতি শীঘ্রই হাসপাতালে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে নিয়ে আসতে। ফাহিমাকে বলে যায় যে, এই সময়ে যা খেতে ইচ্ছে করবে তাই খেতে দিতে। যা মনে চাইবে তাই খেতে। কিন্তু বোকা ফাহিমা ভেবে নিয়েছে যে তার মনের সুপ্ত সকল ইচ্ছে এই সুযোগে পূর্ণ করবে। তাই তো শ্বশুরকে বলে টাক হয়ে আসতে। কিন্তু বরাবরের মতোই শাশুড়ি মা এসে ফাহিমাকে ধমকে দেয়। এথে ফাহিমা মিথ্যা কান্না শুরু করে।

ফাহিমার কান্নার মাঝেই রুপ নাদিফের আগমন ঘটে।
ভাবির কান্না দেখে নাদিফ প্রশ্ন করে,

” কি হয়েছে ভাবির? কান্না করছে কেন?”

আয়েশা আজাদের মুখশ্রী খুশিতে চিকচিক করছে। নাদিফের কথার প্রত্যুওরে বলে,

” তুই চাচ্চু হবি, বাবা। আমাদের পরিবারে নতুন অতিথি আসবে।”

রুপ ভীষণ খুশি হয় সু-সংবাদ পেয়ে। নাদিফ ফোন করে বড়ো ভাইকে অফিস থেকে বাসায় আসতে বলে।
নাদিফ এতোটাই খুশি হয় যে উপস্থিত সকলের কথা ভুলে যায়। রুপের উদ্দেশ্যে জোড়ালো কন্ঠস্বরে বলে,

” আমি কবে বাবা হবো অপরুপ?”

চলবে………..