“প্রেমনেশা”
নন্দিনী নীলা
২.
ভাঙা কাঁচের প্লেটের দিকে তাকিয়ে ময়না বেগম বললেন,’ আগে বলবি না। শুধু শুধু আমার এতো সুন্দর প্লেট টা ভাঙা গেল। এমন একটা প্লেট কালকেই কিনে আনবি।’
কপাল কুঁচকে ফেলল চারু,’ আমি টাকা পাব কোথায়? তাছাড়া প্লেট তুমি ভেঙেছ!’
ময়না বেগম ধমক দিয়ে উঠলেন,’ একদম আমার মুখে মুখে তর্ক করবি না। আমি ভেঙেছি মানে কি বলতে চাস তুই? তোর জন্যে ভাঙা গেছে তুই আমার রাগ না উঠালে প্লেট ভাঙা যেত? টাকা কোথায় পাবি আমায় কেন জিজ্ঞেস করছিস? তোর জন্য ভাঙা গেছে তুই কালকেই প্লেট বাড়ি নিয়ে আসবি নয়ত তোর খবর আছে মনে রাখিস।’
বলেই ময়না বেগম চলে গেলেন। চারু রাগে দুঃখে ওখানেই শক্ত হয়ে বসে আছে। নড়তে ও ইচ্ছে করতে না। এতো খিদে পেয়েছে কাল রাত থেকে না খাওয়া। যে বাসায় ও ডিউটি করে সেখানে প্রতিদিন দুপুরের খাবার খাওয়া হয়। রাতেও খাওয়া যাবে কিন্তু ও খায় না। তিনবার খাওয়ার জন্য যদি টাকা কম দেয় সেই ভয়ে চারু খায় না।
গতকাল রাতেই তো কত করে খেতে বলল।
ও খায়নি এখন মনে হচ্ছে খেয়ে আসলেই হয়ত ভালো হতো সারারাত জেগে ছিল সকালে খিদে ও ক্লান্তি নিয়ে ঘুমিয়েছে উঠেই আবার ঝামেলা।
চারু এসব আকাশ পাতাল চিন্তায় বিভোর ছিল তখনি সিঁথি রেডি হয়ে এলো কলেজ যাবে বলে। সিঁথি ভাঙা প্লেটের উপর পা দিয়ে বসেছে। গলা ফাটিয়ে আর্তনাদ করে উঠল সিঁথি। আঁতকে উঠল চারু সিঁথির পা দিয়ে গলগলিয়ে রক্তের পড়ছে। কেমন অন্যমনস্ক হয়ে বেরোচ্ছিল যে এতো বড়ো টাচ পায়ে ঢুকে গেল। ভয়ে চারু কেঁপে উঠল। ময়না বেগম দৌড়ে এলো।
ময়না বেগম চিৎকার করে উঠল,’ হায় আল্লাহ আমার কি সর্বনাশ হলো গো। আমার মেয়েটার কি হলো। ও মুখ পুড়ি তুই ওখানে কি করছিস খাম্বার মতো বসে হ্যাঁ তোর জন্য সব হয়েছে তোর জন্য সিঁথির এই অবস্থা। তুই ইচ্ছে করে করলি তাই না। এসব পরিষ্কার না করে ইচ্ছে করে ফেলে রাখলি যাতে আমার সিঁথির পায়ে লাগে তাই না?’
মায়ের কথায় চমকে উঠল চারু এসব কি বলছে তিনি ও এমনটা কেন চাইবে? সিঁথি কে নিজের জান দিয়ে ভালোবাসে তাকে আঘাত করবে ও ইচ্ছাকৃতভাবে? এও কি সম্ভব!
মায়ের ধমক বকা তোয়াক্কা না করে চারু এগিয়ে এলো সিঁথি কে ধরার জন্য। সিঁথির কাছে এসে দাড়াতেই ঠাস করে গাল বরাবর থাপ্পড় দিয়ে বসল ময়না বেগম।
তারপর ধাক্কা দিয়ে বললেন,’ সর রাক্ষুসী আমার মেয়ে কাছে আসবি না একদম।’
চারুর চোখ টলমল করে উঠল। ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল। সিঁথি কে নিয়ে ময়না বেগম রুমে চলে গিয়েছে। চারু চোখ মুছে কাচ তুলতে লাগল। সিঁথি চেঁচামেচি করে ওকে যা নয় তাই বলে গালিগালাজ করছে। ময়না বেগম মেয়ের জন্য আটখানা হয়ে পড়েছে।
চারু দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দেখছিল ওদের। হঠাৎ ওর ফোনটা কর্কশ শব্দে বেজে উঠল। চারু এগিয়ে এসে দেখল ও যার দেখাশোনা করার কাজ করে তার নাম্বার থেকে কল এসেছে। চমকে উঠল চারু। আজকে তো তার ছেলে মেয়ে রা আসবে এজন্য বন্ধ দিয়েছিল আবার ফোন করছে কেন?
চারু ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে বয়স্ক কন্ঠে এক মহিলা বলে উঠলেন,’ চারু।’
‘ জি,আসসালামু আলাইকুম ম্যাডাম।’
‘ ওয়ালাইকুমুস সালাম। কোথায় তুই তাড়াতাড়ি বাসায় আয়।’
‘ আজ তো বন্ধ দিয়েছিলেন?’ অবাক সুরে জিজ্ঞেস করল চারু।
‘ যাদের জন্য বন্ধ দিলাম তারাই আসে নাই। তুই চলে আয় কেমন?’
চারু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,’ আচ্ছা আমি আসছি।’
চারু এক বয়স্ক মহিলার দেখাশোনার কাজ করে। মাস শেষ মোটা অংকের টাকা পাওয়া যায় এতে। ও কাজ হলো মহিলার উরফে রাশেদা বেগম এর সঙ্গে থাকা গল্প করা, ভাত খাওয়ানো, তাকে সময় দেওয়া আরকি। বিশাল এক বাসায় এটাই থাকেন রাশেদা বেগম। তার দুইটা ছেলে। দুজনেই নিজেদের কাছে ব্যস্ত। কেউ নিজের বুড়ো মায়ের সাথে থাকে না। আলাদা ফ্লাটে থাকে। আর বুড়ো মায়ের জন্য দুইজন লোক রেখে গেছে এক. চারু
দুই. শিখা আন্টি।
শিখা আন্টি একজন নার্স তিনি রাশেদা বেগমের পার্সোনাল নার্স। আর চারু হচ্ছে তার সঙ্গী।
মাস শেষে ত্রিশ হাজার টাকা পাওয়া যায়। ইন্টার পাশ করে চারু কি কাজ করবে? কোন চাকরি পাচ্ছিল না তখন ওদের পাড়ার একজন এই কাজটা ওকে যোগাড় করে দিয়েছে প্রথমে অন্যের বাসায় এমন বুয়ার মতো কাজ করতে খুব লজ্জা লাগত। করতে চাইছিল না কিন্তু জোর করেই এর কাছে পাঠিয়েছিল ময়না বেগম। চারু রাজি হয়েছে আরো বিশেষ করে বাবার অসুস্থতার জন্য। টাকা আসলে বাবার চিকিৎসা হবে সেই জন্য। এখন কাজ করতে করতে রাশেদা বেগম কে ও নিজের দাদীর মতো দেখতে শুরু করেছে। রাশেদা বেগম ওকে স্নেহ করে এজন্য তার সাথে থেকে কাজ করে এখন আর খারাপ লাগে না নিজের মানুষ ভেবেই কাজ করে যায়। বাসার অন্যান্য কাজ করার জন্য একটা লোক আছে সে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজ করে। চারুর বিশেষ কাজ রাশেদা বেগমের একাকিত্ব গুছানো।
এতো দিন ধরে কাজ করছে ওই বাসায় খুব কম আসে তার ছেলে মেয়েরা তাকে দেখতে। এজন্য রাশেদা বেগম খুব কান্নাকাটি করে। সন্তান দের কল করে কত আসার জন্য বলে ওর কাছেও সবসময় তাদের কথাই বলে। কিন্তু তারা বেশি একটা আসে না। আর আসলেও অনেক দিন পর। বুড়ি নিজের নাতি নাতনির জন্য ও কত কান্না করে কখনোই সেভাবে কাউকে আসতে দেখেনি চারু। আর মাঝেমধ্যে আসলে চারু তখন যায় না। কারণ তার বড়ো ছেলের সাথে একবার সাক্ষাৎ হয়েছিল তিনি আসার আগে চারু কে বন্ধ দিয়ে দেয়।
একটানা কাজ করে তাদের আসায় এক দুই দিন বন্ধ পেলেও স্বস্তি পায়।
চারু রেডি হয়ে বেরিয়ে এলো ময়না বেগম কে চিৎকার করে খবর দিল ও কাজে যাচ্ছে।
ময়না বেগম বললেন,’ যা আমায় শান্তি দে। বাড়ি থাকলে তো এক বেলাও তোর জন্য শান্তি পাই না। অপয়া যত দূরে থাকে ততই শান্তি।’
চারু থমকানো মুখে কিছুক্ষণ দরজার দিকে তাকিয়ে থেকে বেরিয়ে এলো বাসা থেকে। সপ্তাহের সাতদিন কাজ থেকেই ভালো হয়েছে। বাসায় থেকে মায়ের এমন হৃদয় বিধানো কথা শুনে মন খারাপ করার থেকে বাসায় বাইরে থাকা ভালো। সেখানে অন্তত এসব কথা শুনতে হয় না।
চারু গাড়িতে উঠে বসল। আজকে খুব ক্লান্ত লাগছে রাত থেকে না খাওয়া হাঁটার শক্তি নেয়। অটোতে করে যেতে দশ টাকা ভাড়া লাগবে ওর ব্যাগে পঞ্চাশ টাকা ছিল ও রেখে দিয়েছিল দরকারে খরচ করতে। রাত করে বাসায় আসে যাওয়ার সময় হেঁটে গেলেও আসার সময় গাড়ি করে আসার ট্রাই করে।
আকাশি রঙের বাসার সামনে এসে অটো থামতেই চারু নেমে পড়ল। ব্যাগে হাত দিল টাকা দেওয়ার জন্য। কিন্তু ভেতরে হাত দিতেই ওর পিল চমকে উঠল। পঞ্চাশ টাকার একটা নোট ছিল ব্যাগে সেটা নাই। ভয়ে চারুর বুক ধক করে উঠল। অটো চালক লোকটা চারুর দিকে বিরক্ত নিয়ে তাকিয়ে আছে। তার তারা আছে কারণ অটোতে আরো দুইজন মেয়ে ও সামনে একজন পুরুষ বসে আছে। যাত্রী নিয়ে লং টাইম দাঁড়িয়ে থেকে তিনি বিরক্ত কন্ঠে বললেন,’ আপা তাড়াতাড়ি ভাড়া দ্যান।’
চারু ঢোক গিলে এদিকে ওদিকে তাকাচ্ছে। ও এখন কিভাবেই লোকটাকে বলবে ওর কাছে ভাড়া নেই ব্যাগের টাকা পাওয়া যাচ্ছে। গলা শুকিয়ে এলো চারুর লজ্জা আতংকে মাথা নিচু করে ব্যাগে হাত চালাচ্ছে। এই কাজ সিঁথি ছাড়া কারো না। সিঁথির স্বভাব এমন ও হাতাহাতি করে ওর ব্যাগ।
চারু ঠোঁট কামড়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। লোকটা বললেন,’ কি হলো আপা ভাড়া দিবেন না? আমার তো আরো যাত্রী আছে এতো সময় নিলে হবে?’
চারু মিনমিন করে বলল,’ আমার ব্যাগ টাকা পাচ্ছিনা!’
টাকা নাই শুনেই লোকটি খেপে উঠলেন।
‘ টাকা নাই মানে? টাকা নাই তো গাড়িতে উঠছেন ক্যান? মিথ্যা কথা বলার জায়গা পান না তাই না। নাই বললেই আমি চলে যাব তাই না? আমি টাকা ছাড়া যাব না তাড়াতাড়ি আমার ভাড়া দ্যান। বাটপার মেয়ে মানুষ গাড়িতে করে এলো এখন বলছে টাকা নাই যত্তসব ন্যাকামি।’
যা নয় তাই বলে অপমান অপদস্থ করতে লাগল চারু কে। লজ্জায় চারুর ইচ্ছে করল মাটির সাথে মিশে যেতে।
চারু মাথা নিচু করে লোকটার বকা খাচ্ছে। তখনি পাশ এসে দাঁড়াল একজন পুরুষ। চারু চোখের জল ফেলছিল তখন।
পাশে থেকে একটা পুরুষ মোটা স্বরে বলে উঠল,’ এখানে কি হয়েছে? আপনি চিৎকার চেঁচামেচি করছেন কেন? কার বাসায় সামনে এমন বেয়াদবি করছেন খেয়াল আছে?’
অপরিচিত পুরুষের কন্ঠস্বর শুনে চমকে উঠল চারু। মাথা নিচু অবস্থা পাশে তাকাতেই দেখতে পেল থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পরে একজন দাঁড়িয়ে আছে। তার ফর্সা পায়ে লাল রঙের জুতো। চারু মাথা তুলে তাকাল পাশের লোকটার দিকে।
ততক্ষণে অটো চালক লোকটা কে বলে দিয়েছে চারু ভাড়া দিতে পারে নাই।
পুরুষ টা নিজের প্যান্টের পকেটে থেকে একশ টাকার একটা নোট দিয়ে বলল,’ এবার যান।’
অটো শো করে চলে গেল। চারু লোকটার দিকে তাকাল তাকাতেই চারশো চল্লিশ ভোল্টেজের শক খেল। সামনে দাঁড়ানো পুরুষ টার ও একই অবস্থা।
ধ্রুব বিস্মিত কন্ঠে বলল,’ তুমিই!’
চারু নিজেও হতবাক এখানে গতকালের সেই বেয়াদব ছেলেটাকে দেখবে কল্পনাও করেনি। ধ্রুব চোখ দুটো বড় বড় করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।
ধ্রুব সকালে জগিং করতে বেরিয়েছিল। গতকাল রাতেই দাদুর কাছে এসেছে বাসার সবাই আজকে আসবে বলেছিল এজন্য ও গতকাল রাতে আর বাসায় ফিরে নাই এখানে এসেছে। চারুর উপর রেগে মেগে অস্থির হয়ে উঠছিল কিন্তু চারু ওদের চোখে ধোঁকা দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। বন্ধুরা ওকে শান্ত করেছে। ধ্রুব দাদুর কাছে খুব একটা আসে না কিন্তু কাল কেন জানি আসতে ইচ্ছে করল। সকালে জগিং করতে বেরিয়েছিল আর বাসায় যায়নি। সামনের কফি হাউজে বসে নিজের এক বন্ধুর সাথে আড্ডা দিয়েছে। এইমাত্র বাসায় এসেছিল। বাসায় ভেতরে যাবে তখন রাস্তায় অটোর সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটা মেয়েকে মাথা নিচু করে দূর থেকে মেয়েটার মুখ স্পষ্টভাবে বুঝা যায় না। কিন্তু দূর থেকে অটো চালক এর চিৎকার শুনা যাচ্ছিল কোন গন্ডগোল হয়েছে বুঝে যায়। কিন্তু ওদের বাসার সামনে কেন হচ্ছে। দাড়োয়ান কে ডেকে বলে,’ এসব কি তোমার সামনে ওরা আমাদের ফ্লাটের সামনে ঝামেলা করছে তুমি ধমক দিয়ে তাড়াচ্ছ না কেন?’
রেগে যায় ধ্রুব। দাড়োয়ান এই অটোকে ওদের ফ্লাটের সামনে এলাও করেছে কেন?
দাড়োয়ান বলেন,’ ওটা তো চারু মা তোমার দাদুর দেখাশোনা করে।’
দাদুর লোক জানার পর ধ্রুবর রাগ কমে ও কৌতূহল নিয়ে এগিয়ে আসে কি হয়েছে জানতে। ভাড়া নিয়ে ঝামেলা লেগেছে জেনে নিজেই ভাড়া মিটিয়ে দেয় যেহেতু নিজেদের লোক। মেয়েটার প্রতি আর কোন কৌতুহল রাখে না চলে যাবে তখনি মেয়েটার মুখ দেখে চমকে উঠে।
ধ্রুবর মুখমণ্ডল লাল হয়ে উঠে। চারু ধ্রুব কে দেখে কি বলবে ভেবে পাচ্ছেনা এই বদ লোকটা এখানে কি করছে? গতকাল রাতেই একটা বাজে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল লোকটা ওর জন্য শুভ না রাত থেকে ওর একটা পর একটা ঝামেলা চলছেই। সকাল হতেই আবার সামনে চলে এসেছে?
‘ আপনি এখানে কি করছেন?’
ধ্রুব চেয়াল শক্ত করে কিছু বলতে যাবে ওর ফোন বেজে উঠেও আঙুল তুলে চারুকে শাসিয়ে সামনে এগিয়ে ফোন রিসিভ করে। চারু এই সুযোগ বাসার ভেতরে চলে যায়। ওই বেয়াদব লোকটার সামনে ও থাকতে চায় না আর কথা বলতে চায়। চারু আরো তাড়াতাড়ি আসে কারণ ও ধ্রুব কে জানাতে চায় না এই বাসায় ও যাবে জানলে হয়ত ঝামেলা করতে চলে আসবে।
#চলবে……?