“প্রেমনেশা”
নন্দিনী নীলা
৩.
চারু বাসায় ঢুকে দেখল শিখা আন্টি রেগে আগুন হয়ে বসে আছে। চারু ব্যাগ রেখে তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,’ আন্টি কি হয়েছে? আপনি এতো রেগে আছেন কেন?’
শিখা আন্টি বললেন,’ রাগবো না বলো? বুড়ির নাতি আসছে তাই বুড়ি এই দশটা অব্দি না খেয়ে বসে আছে। এসব কেমন পাগলামি তুমিই বলো চারু তার ঔষধ আছে না খেয়ে থাকলে খাবে কীভাবে?’
চারু কিছুই বুঝতে পারছে না নাতি এসেছে এটা তো আনন্দের খবর তাহলে রাশেদা বেগম না খেয়ে আছে কেন?
চারু কপাল কুঁচকে বলল,’ নাতি এসেছে এর সাথে না খেয়ে থাকার কি কারণ আন্টি? আমি বুঝতে পারছি না।’
‘ আর বলো না চারু। বুড়ির নাতি নাকি কাল রাতে আসছে। আজকে সবার আসার কথা ছিল কেউ আসবে না। তাদের কোন এক প্রোগ্রাম আছে এজন্য বলেছে ফোন দিয়ে। এদিকে বুড়ির নাতি আসছে সে সাতসকালে উঠে জগিং করতে গিয়েছিল আমি এসেও তাকে বাসায় দেখিনি। এসে রান্না করলাম খাবার নিয়ে গেলাম তার এক কথা আমার নাতি ছাড়া আমি এক দানা মুখে দিব না। ওরে ডাকো আগে ওর সাথে খাব।
এখন আমি তারে কোথায় পাব? তার নাম্বারে কয়েকবার কল দিলাম সে ধরল না। এই মাত্র ও দিয়েছি সে বলল আসতেছে এখনো আসল না এদিকে ঔষধ এর টাইম হয়ে গেছে কখন? এই বুড়ি গুলোর ও না জেদি তোর নাতির তোর চিন্তা নাই তুই কেন তার জন্য আলগা পিরিতি দেখাইয়া না খেয়ে বসে থাকবি? ঔষধ অনিয়ম করলে যদি সমস্যা হয় তাহলে এর দায়ভার তো আমাদের উপর পড়বে আমরা কি কিছু করেছি তখন তার ছেলের কড়া কথা আমাদের হজম করতে হবে। টাকা থাকলে যে মানুষ কত কিছু করে শুধু টাকার জন্যে এই বাসায় আমি পড়ে আছি ওই বিছানা সজ্জিত বুড়িয়ে দেখভাল করতে নয়ত আমি কবেই এই সব ছেড়ে চলে যেতাম..’
আরো কিছু বলতে ছিল চারু কপাল কুঁচকে তার কথা শুনছে। কে তার নাতি? বাইরে তো কাউকে ও আসতে দেখল না। হঠাৎ শিখা ভয়ে লাফিয়ে সোফায় থেকে উঠে দাঁড়াল। কপাল মুছে কথা থামিয়ে নিল। কারো পায়ের শব্দ এসেছে কানে চারু ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতে ওর শ্বাসরুদ্ধ হয়ে এলো। ভয়ে চারুর হাঁটু কাঁপতে লাগল। কারণ ধ্রুব বাসায় ঢুকেছে। বাসায় ঢুকেই ওর দিকে তাকাল। ও আর শিখা আন্টি সোফার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। ধ্রুব এগিয়ে এলো ওদের দিকে। এদিকে শিখা আন্টি ওর কানে কানে বললেন,’ এই মনে হয় বুড়ির নাতি।’
ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে চারু এই ছিল ওর কপালে? এই বেয়াদব ছেলেটাকে কিনা এই বাড়ির লোক হতে হলো?
বিস্মিত চোখে তাকিয়ে ছিল চারু এদিকে ধ্রুব এগিয়ে এসে চারুর মুখোমুখি দাঁড়াল। শিখা আন্টি হেঁসে বলল,’ স্যার আপনি কোথায় ছিলেন? আপনার দাদি তো না খেয়ে সেই কখন থেকে আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। প্লিজ চলুন তার ঔষধ খেতে হবে।’
ধ্রুব তাকে বলল,’ আপনি খাবার রেডি করুন আমি আসছি।’
শিখা আন্টি চলে গেলেন। চারু কাঁপা পায়ে শিখা আন্টির পিছু নিতে চাইল। ধ্রুব ওর বাম হাতটা খপ করে টেনে ধরল। চারুর হৃদপিন্ড লাফিয়ে উঠল। ধ্রুব শয়তানি হাসি দিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।
চারু হাত মুচড়ামুচড়ি করে ফিরে বলল,’ কি হচ্ছে কি হাত ছাড়ুন প্লিজ।’
ধ্রুব হাত ছাড়ল না আরো শক্ত করে ধরে বলল,’ কাল রাতে আমার চোখে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলে এখন কীভাবে পালাবে?’
চারু হাত ছাড়ানোর জন্য ছটফট করছে।
‘আমার গায়ে হাত তুলেছ! আমি তোমায় এতো সহজেই ছেড়ে দেব ভেবেছ? জীবনে প্রথম আমার গায়ে কেউ হাত তুলেছে! তাও এমন একজন যে আমার লেভেলে পরে না। তোমার মতো সামান্য একটা মেড আমায় থাপ্পর মেরেছে।’
ধ্রুব রাগে লাল হয়ে উঠল। চারু হাত ছাড়াতে না পেরে রেগে বলল,’ আমার হাত ছাড়ুন।’
ধ্রুব গতকালের মতোই ওকে আবার গর্জে উঠতে দেখে বলল,’ এখনো তুমি চোখে চোখ রেখে উঁচু গলায় কথা বলতে পারছ? এতো সাহস তোমার? হাত ছাড়ব না কি করবে?’
চারু নিজের রাগ কে সংযত করতে পারল না দ্বিতীয় বার ফের ধ্রুবর গালে থাপ্পর দিয়ে বসল। ধ্রুব বিস্ময় এ পাথর হয়ে গেল। রাগে ওর চোখের মনি রক্তিম হয়ে উঠল। ফরসা গাল সঙ্গে সঙ্গে লাল হয়ে উঠেছে। ধ্রুব থাপ্পর খেয়ে আগুন চোখে তাকাল চারুর দিকে। চারু রাগের মাথায় থাপ্পর তো দিয়েছে এখন ভয়ে ওর অন্তর কাঁপছে। হাত থরথরিয়ে কাঁপছে। ভয়ে ওর মাথা ঘুরে উঠল। ধ্রুবর মুখমণ্ডল দেখে ওর গলা শুকিয়ে এলো।
ধ্রুব চিৎকার করে কথা বলতে গিয়েও চট করেই থেমে গেল কারণ রাশেদা বেগম কে ধরে নিয়ে আসছে শিখা আন্টি। ধ্রুব দাদুকে দেখে নিজের রাগ গিলে নিল। চারু এই সুযোগে ঝামটা মেরে হাত ছাড়িয়ে নিল। এবং দ্রুত রাশেদা বেগমের পিছনে গেল।
ধ্রুব রাগে গজগজ করে এগিয়ে এসে বসল চেয়ারে। চারু ঢোক গিলে দাঁড়িয়ে আছে চুপটি করে।
রাশেদা বেগম আর ধ্রুব সকালের নাশতা শেষ করে নিল। ধ্রুব শুধু দাঁতে দাঁত চেপে তাকাচ্ছিল চারুর দিকে। চারু কিচেনে এসে দাঁড়িয়ে ছিল ওর ভয়ে। কারণ চোখ দিয়েই ভস্মীভূত করে দিবে এমন করে তাকাচ্ছিল ধ্রুব।
দাদুর সাথে ধ্রুব সোফায় বসে আছে। রাশেদা বেগম নাতি কে বললেন,’ তোর বাপ তো আমাকে কল দিয়েছিলো। তোকে এখনি পাঠিয়ে দিতে বলেছে। তুই নাকি ফোন ধরিস নাই বলল।’
‘ আব্বুর সাথে কথা হয়েছে আমার।’
‘ কখন যাবি?’
ধ্রুব উত্তর না দিয়ে চোখ টেরা চারুকে খুঁজছে। একবার নয় দুইবার ওকে মেয়েটা মেরেছে। সামান্য একটা মেড তার এতো অহংকার? রাগে নিজের মাথার চুল নিজেই টেনে ধরল।
রাশেদা বেগম নাতির দিকে ভালো করে তাকিয়ে বললেন,’ দেখি তোর গালে কি হয়েছে?’
বলেই তিনি ধ্রুবর গাল টেনে স্পর্শ করল। ধ্রুব চোখমুখ শক্ত করে বসে আছে। এই মেয়ের কথা ও ভুলে যেতে চেয়েছিল কিন্তু আজকের থাপ্পর খেয়ে ও আর ভুলতে চায় না। একে উচিত শিক্ষা না দিয়ে ও শান্ত হবে না। ওর গায়ে হাত তোলার জন্য ওকে ভয়ঙ্কর শাস্তি ভোগ করতে হবে।
ধ্রুবর ফোন নিয়ে এগিয়ে এলো শিখা উপরে ঔষধ আনতে গিয়েছিল হাতে করে ধ্রুবর ফোন নিয়ে এসেছে। সেটায় অনবরত রিংটোন বেজে যাচ্ছে।
শিখা এসে ধ্রুবর হাতে ফোন দিয়ে বললেন,’ অনেকক্ষণ ধরে বাজছিল তাই নিয়ে এলাম স্যার।’
ধ্রুব ফোনে কানে ধরে দেখল আব্বুর কল। তিনি ওকে দ্রুত প্রোগামে গিয়ে উপস্থিত হতে বলছে। ধ্রুবর এখন কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না। কোন প্রোগ্রাম এ যেতে ইচ্ছে করছে না। চারু কে থাপ্পর এর জবাব দেওয়া না পর্যন্ত ওর বুকের জ্বালা কমবে না। ধ্রুব উত্তর না দিয়েই কল কেটে দিল।
ধ্রুব রুমে গিয়ে আগুন হয়ে বসে আছে। কীভাবে নিজের রাগ কন্ট্রোল করবে? একটা সুযোগ খুঁজছে শুধু।
এদিকে চারু পারে না এখনি এই বাসা থেকে ছুটে বেরিয়ে যেতে। যে ভয়াবহ রেগে গিয়েছে লোকটা এমনিতেই শয়তান তারপর উপর ওর হাতে দুই দুইটা থাপ্পর খেয়েছে আল্লাহ জানেন ওকে কি করবে! চারু কিচেনে শুধু পায়চারি করছে। এই বাসায় আর এক মিনিট ও ওর জন্য থাকা রিস্কি। ও আজকে চলে যাক এখানে থাকলে ওকে আবার তার সামনে পড়তে হবে ও সেটা চায় না।
চারু দেখল ড্রয়িংরুম ফাঁকা এইতো সুযোগ চারু পা টিপে বেরিয়ে এলো ব্যাগ হাতে নিয়ে ঝটপট বাসা থেকে বেরিয়ে এলো। এতো আগেই ওকে বাসার বাইরে যেতে দেখে দাড়োয়ান জিজ্ঞেস করল কি হয়েছে ও বলল ছুটি নিয়েছে।
মিথ্যা বলেই চারু হাঁটতে লাগল। ভয় উত্তেজনায় ও চলে তো এলো এখন টেনশন হচ্ছে। ধ্রুব যদি ওকে কাজ থেকে বাতিল করে কি হবে? যে খবিশ লোকটা সে ওর কোন এক আকাম করে দিবে জানে। চারু হাঁটতে লাগল। টেনশনে নখ কাটতে লাগল। হঠাৎ ওর কানে বেজে উঠল ময়না বেগমের কথা। বুক ধকধক করতে লাগল। কাজ গেলে তো মাকে বাসায় ও রাখবে না। ও এখন কি করবে? লোকটা যে বেয়াদব তার জন্য এই কাজ ওর থাকবে না ও জানে তার উপর কম সাহস তো দেখায় নি। আর দেখাবে না তো কি করবে? অজানা অপরিচিত একটা মেয়েকে জড়িয়ে ধরে নেশা করে মাতাল হয়ে। তারপর কেমন বাজে কথা বলেছিল আজকে চরটা কেন দিল?
এর তো কারণ আছে ওভাবে হাত ধরল কেন? হুটহাট স্পর্শ করা এক নম্বরের বেয়াদব।
হঠাৎ অটো চালক এর কথা মাথায় এলো কন্ঠ নামিয়ে নিল চারু। রাগের মাঝেও কৃতজ্ঞতা ফুটে উঠল। সে বাজে সিসুয়েশনে পড়েছিল তখন ধ্রুব ভাড়া না দিলে কি হতো?
একটা উপকার করেছ ঠিক আছে এর জন্য কৃতজ্ঞ চারু। কিন্তু তাই বলে তার খারাপ গুনটা তো ধুয়ে মুছে যাবে না। কাজটা কিভাবে করবে ও মাথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে এভাবে বাসায় ও যেতে পারছে না।আবার কাজেও যেতে পারছে না। এমন এক অবস্থানে আছে ও এগিয়ে যাচ্ছে যেতে পারছে না পিছিয়ে ও যেতে পারছে না।
চারু এই রাস্তায় হাত পা ছড়িয়ে বসে কাঁদতে ইচ্ছে করছে কেন এমনটা হয় এর সাথে? মস্তিষ্ক ফাঁকা ফাঁকা লাগছে চারুর।
চারু চায়ের দোকানে বসল। এখানে কলা পাউরুটি পাওয়া যায়। হাতে এক টাকাও অবশিষ্ট নাই এদিকে খিদের জ্বালায় অস্থির হয়ে উঠছে চারু। বারবার কলা ও রুটির দিকে চোখ যাচ্ছে। দোকানে একটা আধবয়স্ক লোক ছিল তিনি ওকে জিজ্ঞাসা করলেন,’ চা দেব?’
চারু ছিটকে উঠে বলল,’ চাচা আমি চা খাব না খুব খিদে পেয়েছে একটা কলা ও রুটি দিবেন?’
লোকটা হেঁসে বললেন,’ দেব না কেন? এসব তো তোমাদের জন্য রেখেছি নাও।’
ঢোক গিলে চারু বলল,’ চাচা আমার কাছে টাকা নেই।’
লোকটা থমকানো মুখে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বললেন,’ টাকা না থাকলে কীভাবে দেব? আমি তো এসব বিক্রি করে খাই।’
চারু বলল,’ আপনার কোন কাজ থাকলে দিন করে দেই। বিনিময়ে একটা কলা দিবেন। গতকাল রাত থেকে আমি না খাওয়া এখন আর শরীর চলছে না। খুব খারাপ লাগছে আমার।’
এতো অসহায় লাগছিল চারুর ভিক্ষারির মতো ওকে কখনো এভাবে মানুষের কাছে চেয়ে খাবার খেতে হবে কল্পনা ও করেনি। ওর চোখ দিয়ে টপটপ করে নোনা জল পড়তে লাগল। লোকটা একটা কলাও রুটি এগিয়ে দিল চারুকে চারু চোখ মুছে খেয়ে বলল,’ চাচা কি করতে হবে বলুন আমি করে দিচ্ছি।’
লোকটা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,’ কিছুই করতে হবে না মা। আমার দোকানে তেমন কোন কাজ নেই।’
‘ তাহলে আপনি আমাকে খেতে দিলেন কেন?’ বিস্মিত কন্ঠে বলল চারু। খেয়েও তো বিপদে পড়ল।
‘ একবেলা খাওয়ানোর জন্য কারণ লাগে না মা। তুমি আমার কাছে এসেছ তোমার রিজিক আমার কাছেই ছিল’
চারু অসহায় মুখে তাকিয়ে আছে। টাকা দিয়ে দিবে সে উপায় ও নাই। ও অসহায় কন্ঠে বলল,’আপনি খুব ভালো মানুষ চাচা।’
#চলবে…?