“প্রেমনেশা”
নন্দিনী নীলা
৪.
চারু বাসায় এসে বলেছে ওর কাজ আর নেই। এই কথা শুনে ময়না বেগম চোখ কপালে তুলে ফেলল। চারু বাসায় এসে এসব জানিয়েছে, ওর মন বলছে এই জব ওর আর থাকবে না। ধ্রুব যে শয়তান সে কখনোই ওর ওই বাসায় কাজ করে জানার পর শান্ত হয়ে বসে থাকবে না। তাই আগেই বাসায় জানিয়ে দিল চারু। ভয়ে ভয়েই কথাটা বলেছে কারণ জব গেলে ওর জন্য এই বাসায় থাকা দায় হয়ে পড়বে ও একা কোথায় যাবে? ছোটো থেকেই ময়না বেগমের ছায়া তলে বড়ো হয়েছে যতই মারুক কাটুক তাকেই আপন ভাবে। এই বাড়ি তার বাড়ি কিভাবে সে এখানে থেকে যাবে? বললেই কি সব ছেড়েছুড়ে চলে যাওয়া যায়?
বাবার মৃত্যুর পর চারুকে অনেকে বলেছিল চলে যেতে নিজে ইনকাম করে ও যেন এই অত্যাচার সহ্য না করে চলে যায় পারেনি যেতে। একা খুব ভয় পায় চারু একা কীভাবে কোথাও যাবে ও?
চারুর কথায় ময়না বেগম কি বলবে ভেবে উঠতে পারছে না পাগলের মতো এগিয়ে এসে বললেন,’সত্যি করে বল কি করেছিস? হঠাৎ তোকে তারা বের করে দিল কেন? কি আকাম করেছিস মু খ পু ড়ি এখনি বলবি।’
চারু ঢোক গিলে বলল,’ আমি কিছু করিনি মা। তারা নিজেকে থেকেই না করে দিয়েছে।’
ময়না বেগম চারু গাল টিপে ধরলেন,’ একদম মিথ্যা কথা বলবি না। তোকে আমি চিনি না ভেবেছিস? নিশ্চয়ই তুই কোন অঘটন ঘটিয়েছিস এমনি এমনি তো আর কাজ থেকে বের করে নাই।’
চারু গাল থেকে মায়ের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগল।
ময়না বেগম দাঁত কিড়মিড় করে চিৎকার করে বললেন,’ সত্যি কথা বল।’
চারু কি বলবে ভেবে পাচ্ছেনা। ময়না বেগম চিৎকার চেঁচামেচি করে বাড়ি মাথায় নিল। এমন ভাব করছে যেন সব শেষ হয়ে গেছে। তার চিৎকারে সিঁথি এগিয়ে এলো। আর দাঁড়িয়ে তামাশা দেখতে লাগল। চারু রুমে যেতে পারছে না দাঁড়িয়ে ও থাকতে পারছে না।
ময়না বেগম ওর দিকে তাকিয়ে বললেন,’ এখনি ওই বাসায় যাবি হাতে পায়ে ধরে হলেও কাজ ফিরিয়ে আনবি।’
চারু ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে দেখে তিনি হুংকার দিয়ে উঠলেন,’ কি হলো তালগাছের মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? যা বলছি কর!’
চারু নড়ছে না দেখে তিনি এগিয়ে এসে ওর চুলের মুঠি টেনে ধরে বললেন,’ এখন নড়ছিস না কেন? তুই আকাম করিস নাই তাহলে তোর চোখমুখে এতো ভয় কেন?’
চারু দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথা সহ্য করছিল। ময়না বেগম ওকে ছেড়ে মাথা ঠান্ডা করে বসল। কিভাবে নিজের রাগ দেখাবে ভাবছে হয়ত। চারু ময়না বেগম কে শান্ত হয়ে বসতে দেখে রুমের দিকে পা বাড়াল। ওকে ভেতরে যেতে দেখেই ধমক দিয়ে উঠল ময়না বেগম।
‘ অ প য়া একদম ঘরের দিকে পা বাড়াবি না। নয়লে তোর পা আমি ভেঙে দিব।’
‘ মা আমি অন্য একটা কাজের ব্যবস্থা করব দেখো।’ ভয় ভয় কন্ঠে বলল চারু।
‘ তোর জন্য তো সবাই কাজ নিয়ে বসে আছে তাই না। তুই যাবি আর কাজ দিয়ে দিবে। কি কাজ করবি তুই হ্যাঁ।’
‘ যেকোনো কাজ আমি পারব দেখো। তুমি আমাকে কয়েকদিন সময় দাও।’
চারুর কথায় ময়না বেগম গলে গেল না। তিনি কড়া কন্ঠে বললেন,’ যদি না পাস মনে রাখিস তখন থেকে তোর জন্য এই বাড়ির দরজা বন্ধ হয়ে যাবে।’
চারু মাথা উপর নিচ করে আচ্ছা বলল। চারু রুমে এসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। মাকে তো ম্যানেজ করে নিলাম এবার কাজ পাব কোথায়? চারু নিজের ফোন চেক করছে শুধু ওভাবে চলে এলো কেউ ওকে কল দেয় নাকি। কেউ ওকে কল দিল না দিন পেরিয়ে রাত নেমে এলো। এই নিরবতা ওকে বুঝিয়ে দিল ঐ বাড়িতে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। মাকে আগেই জানিয়ে ভালো হয়েছে।
পরদিন থেকে চারুর জীবনে নেমে এলো আরো অত্যাচার। এতো দিন বাইরে কাজ করেছে তাও শান্তিতে ছিল। রাশেদা বেগম ছিল খুব নরম মানুষ ওকে খুব স্নেহ করত। খুব মিস করে মানুষটিকে।
কিন্তু এখন বাসার সব কাজ ওর কাঁধে ফেলে বসে থাকে ময়না বেগম।
সকালে উঠেই তিনি বললেন,’ বাড়িতেই যখন থাকবি বসে থাকবি কেন? বাড়ির কাজ করতে করতে ক্লান্ত এখন একটু রেস্ট নেয়। নতুন কাজ না পাওয়া পর্যন্ত বাড়ির সব কাজ তোর করতে হবে চারু।’
বাসায় তেমন কাজ নেই রান্না করা, ঘর গুছানো এসবই এটা চট করেই করে নিতে পারে চারু। কিন্তু ও কাজ শুরু করার পর থেকে কাজ যেন এক দিনেই লাফ দিগুন বেড়ে গেছে। প্রতিদিন ঘর মুছতে হয় এখন, প্রতিদিন মা মেয়ের জামা ধুতে হয় আগে এমনটা হতো না। প্রতিদিন এতো পরিশ্রম করে দূর্বল হয়ে গেল চারু। রাতে ঘুমাতে পারে না হাতের ব্যথায় এবং কোমর ব্যথায়। জ্বর জ্বর ও হয়ত হয়। মাঝে একদিন রান্না পুড়িয়ে ফেলল চারু।
সেজন্য গরম খুন্তির ছ্যাঁকা পর্যন্ত খেতে হলো। অধৈর্য্য হয়ে উঠল চারু এই নরক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে ছটফট করতে লাগল।
এক সপ্তাহ পরের কথা,
চারুর হাতে বাজারের ব্যাগ দিয়ে দুই হাজার টাকার দুইটা নোট দিল ময়না বেগম, বাজার থেকে বড়ো মাছ, মুরগি ও সবজি আনার জন্য। কারণ আজকে তার বাবার বাড়ির মেহমান আসবে।
চারু এখন পর্যন্ত বাজারে যায় নি তাই প্রথম বার বাজারে যেতে খুব ভয় লাগছিল।
ময়না বেগম টাকা হাতে দিয়ে বলেছে,’ এক টাকাও যদি এদিক ওদিক হয় খবর আছে কিন্তু।’
চারু টাকা ও ব্যাগ হাতে বাজারে এলো।
প্রথমবার বাজারে এসেছে কিভাবে দর দাম করতে হয় কিছুই জানে না বুঝে না। প্রথমেই চারু এলো মাছ কিনতে পুরুষ মানুষের গিজগিজ লেগে আছে মহিলা যে নাই তা নয় আছে কিন্তু অল্প পুরুষ বেশি। মাছের আঁশটে গন্ধে চারুর বমি পেয়ে গেল। মাছ যেভাবে লাফালাফি করছে কাছে গিয়ে চারু দাম ও জিজ্ঞেস করতে পারছে না। ভয়ে দূরে দাঁড়িয়ে আছে আতঙ্কিত চোখে। চারু ওরনা দিয়ে নাক সেপে রুই মাছের সামনে গিয়ে দাঁড়াল অনেক কষ্টে একটা রুই মাছ কিনে বেরিয়ে এলো। মাছের বাজার থেকে বেরিয়ে শান্তি অনুভব করল চারু। সবজির বাজার থেকে লিস্ট করা সবজি ও মুরগি নিতে গিয়ে টাকা কম হয়ে গেল। চারু দুই কেজি মুরগি নিয়ে হাঁটতে লাগল। মুরগি তিন কেজি নিতে বলেছিল কিন্তু মাছের দামটা বেশি হওয়ায় টাকা কম পড়েছে। ভাড়া রেখে নিয়েছে কারণ এতো কিছু নিয়ে চারু হাঁটতে পারবে না। মাছ কাটতে দিয়েছিল সবকিছু নিয়ে চারু মাছ নিতে এলো। সব ঠিকঠাক করে চারু বাজার থেকে বের হতেই চমকে উঠল।
রাস্তায় ব্লাক কারে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে ধ্রুব। চোখে সানগ্লাস। চারু ঢোক গিলল ধ্রুব কে দেখে। বাজারে ঢুকে এমনিতেই গরমে অতিষ্ঠ হয়ে গেছে। এখন সময়টা তেমন গরম না কিন্তু বাজারে মানুষের গিজগিজ গরমে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে চারু। চারু দুই হাতে দুইটা ভারী ব্যাগ নিয়ে ভয়ার্ত চোখে ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে আছে। ধ্রুব ওকে এখনো দেখেনি লোকটা ওকে দেখার আগে পালাতে হবে। দ্বিতীয় চর মারা সময় দেখেছে লোকটা ওর উপর কী পরিমান রেগে আছে। আজকে না জানি ওকে পেয়ে কি করে!
ভয়ে শঙ্কিত চোখে তাড়াতাড়ি রিকশা ঠিক করতে লাগল। চারু বিশ টাকার ভাড়া ত্রিশ টাকা শুনেও গাড়িতে ব্যাগ তুলে দিল। নিজেও উঠার জন্য পা উঁচু করছিল। তখনি ওর রক্ত হিম হয়ে উঠে। কারণ ওর বাহু টেনে ওকে নিজের দিকে ফিরিয়ে নিয়েছে ধ্রুব। লোকটার মুখে ওকে খুন করার মতো রাগ চেপেছে। শুকনো ঢোক গিলল চারু। লোকটা যতটা রেগে আছে ততটা রাগ নিয়ে কাউকে খুন করতেও হাত কাঁপবে না।
চারু নিজের ভয় লুকিয়ে চটপটে কন্ঠে বলল,’আপনি তো ভীষণ অভদ্র। ভদ্রতা শিখেন নাই? একটা মেয়েকে যখন খুশি তখন স্পর্শ করে বসেন। এমন হুটহাট বাজে কাজ করা থেকে নিজেকে সামলান প্লিজ।’
‘ মেড হয়ে কাজটা করতে পারছ না তাই এখন কি বাজার করার কাজে লেগে গেলে নাকি? সো স্যাড! তোমার এখনো মুখ চলছে? আর কি বললে ভদ্রতা শিখেছি কিনা? শিখিনি একটু শিখিয়ে দিবেন ম্যাডাম?’
চারু ঝামটা দিয়ে হাত ছাড়িয়ে বলল,’ প্রথম দিনেই বুঝেছি আপনি কেমন ধারা ছেলে। আপনার ভাগ্য ভালো আমি এখনো আপনার নামে মামলা করিনি। আপনি একটা মেয়েকে যেভাবে হেনস্থা করছেন আপনার…’
ধ্রুব দাঁতে দাঁত চেপে বলল,’ তুমি আমার গায়ে হাত তুলে ঠিক কাজ করোনি। তোমার শাস্তি প্রাপ্য।’
‘ চর মেরেছি বলে খুব গায়ে লাগছে তাই না? আমাকে জড়িয়ে ধরেছেন আমার কেমন লাগতে পারে ভাবেন?’
ধ্রুব কিছু বলতে যাবে পিছনে থেকে ওর বাবা ওকে ডেকে উঠে,’ ধ্রুব ওখানে কি করছো?’
ধ্রুব পিছনে ফিরতেই চারু দ্রুত গাড়িতে উঠে বসে। আর বলে,’ মামা তাড়াতাড়ি চলেন প্লিজ।’
ধ্রুব ‘উফফ শিট’ বলে উঠে চলন্ত রিকশার দিকে তাকিয়ে। আবার মেয়েটা পালিয়ে গেল।
চারু রিকশায় বসে শান্তি পেল উফ কোথাও গিয়ে শান্তি নেই যেখানেই যাচ্ছে সেখানে লোকটা চলে আসে। সেদিন রাতে ওই ব্রিজে দাঁড়ানো একদম উচিত হয়নি। তার পর থেকে একটার পর একটা ঝামেলা লেগেই আছে ওর সাথে।
চারু বাসার সামনে এসে ভাড়া মিটিয়ে ভেতরে চলে গেল। বাজার থেকে বের হওয়ার তুলনায় এখন ব্যাগ পাতলা লাগছে।
ময়না বেগম সব নিয়ে বসেছে একটা একটা করে দাম মিলিয়ে নিচ্ছে।
চারু এক কেজি মুরগি কম আনায় ওকে বললেন,’ কম কেন? তোকে মাছ এতো বড়ো আনতে কে বলেছে?’
‘ মা এর থেকে ছোটো ছিল সেটা বেশি ছোটো আর দাম বেশি চাচ্ছিল। তাই আরকি..’
‘ ত্রিশ টাকা কম কেন?’
‘ আমি ভাড়া দিয়ে এসেছি।’
‘ এই টুকু রাস্তা আবার গাড়িতে উঠতে হয়? শরীরের তেল হয়েছে নাকি হ্যাঁ তুই হাঁটতে পারিস না?’ ভয়াবহ রেগে বলল।
সবজি দেখাতে গিয়ে চারুর চোখ কপালে।
‘ সবজি খালি আলু কেন? এতো জিনিস লিস্ট করে দিলাম। টাকা ও নাই সবজিও সব আনিস নাই টাকা কই?’
চারু অন্যমনস্ক হয়ে ভাবতে লাগল ব্যাগটা কোথায় গেল? দুইটা ব্যাগ ই তো গাড়িতে রেখেছিল ঠিকমতো। তাহলে সবজির ব্যাগে থাকা সবজি কি হলো।
চারু দৌড়ে বাইরে এলো পাগলের মতো রাস্তা দিয়ে হাঁটতে লাগল কোথাও পরেও নাই সবজি। ভয়ে ওর শরীরে ঘাম ছেড়ে দিল। ধ্রুব কে দেখে খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল তাই ভুলে কোথাও ঝাঁকুনিতে পরে যায় নি তো? ও সাবধান এ ব্যাগ ধরে রাখতে পারেনি।
চারু গেইটের সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছে ভয়ে।
কোন ভাবেই বাসায় ঢুকতে পারছে না। পা টেনে দরজা খুলে রুমে ঢুকতেই ময়না বেগম বললেন,’কি হলো?’
চারু মাথা নিচু করে কাঁপতে লাগল।
‘ কথা বলছিস না কেন? টাকা কি করেছিস?’
‘ আমি তো সব কিছুই এনেছিলাম কিন্তু মনে হচ্ছে কোথাও পরে গেছে।’
চারুর গলা টিপে ধরলেন ময়না বেগম,’ মিথ্যা কথা বলার জায়গা পাস না তাই না? টাকা হাতে পেয়েই নিজের প্রয়োজনে খরচ করে এখন আমায় বানোয়াট কাহিনী বলছিস? আমাকে কি তোর অবুঝ মনে হয় তুই যা বলবি আমি তা বিশ্বাস করব? সত্যি করে বল কি করে টাকা ভেঙেছিস?’
#চলবে…..