প্রেমনেশা পর্ব-০৫

0
2

“প্রেমনেশা”
নন্দিনী নীলা
৫.

সিঁথি এগিয়ে এসে মাকে টেনে ছাড়িয়ে নিল চারুর থেকে। চারু ছাড়া পেতেই খুকখুক করে কেঁশে উঠল।
সিঁথি মাকে টেনে সরিয়ে বলল,’ উফ মা ওকে মেরে ফেলবে নাকি। চারু মরে গেলে আমাদের কাজ গুলো কে করে দিবে ভাবো!’
সিঁথির কথায় ময়না বেগম ধপ করে বসলেন সোফায়।
তারপর রাগী কন্ঠে বললেন,’ ওরে আমার মেরেই ফেলতে ইচ্ছে করছে।’
‘ শান্ত হ‌ও মা। এই চারু যা তুই রান্না ঘরে যা।’
চারু চলে গেল। সিঁথি নিজের মাকে ঠান্ডা করছে।
‘ মা তোমার মাথাটা কি একেবারে খারাপ হয়ে গেছে? ওকে মরে ফেললে এইযে চাকরের মতো খাটিয়ে আয়েশ করছো এটা করবে কীভাবে? আর ওর কিছু হলে তোমাকে পাড়াপড়শিরা ছেড়ে দিবে ভেবেছ? ও আমাদের সব কথা শুনে চলছে ওকে ধমক দিয়ে ভয় দেখিয়ে এভাবে রাখো ও না থাকলে আমাদের ই লস ভাবো তুমি।’
ময়না বেগম শান্ত হলেন। ফোন দিয়ে নিজের বাড়িতে কল দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন কতক্ষন লাগবে আসতে। সিঁথি দরজা খুলে বাইরে এসে দাড়াতেই কপাল কুঁচকে নিল। ওদের বাড়ির সামনে গেইটের বাইরে একটা খুব সুদর্শন যুবক দাঁড়িয়ে আছে। গেইট ধরে ভেতরে উঁকিঝুঁকি মারছে। চমকে উঠল সিঁথি। এতো সুন্দর হ্যান্ডসাম ছেলে ওদের বাড়িতে উঁকিঝুঁকি মারছে ও বিলিভ করতে পারছে না। সিঁথি চোখ কচলে তাকাল সত্যি তো এটা তো ওর ভ্রম না। চারু বারান্দায় থেকে নেমে নিচে এলো। ছেলেটাও কপাল কুঁচকে নিল ওকে দেখে। যেভাবে উঁকিঝুঁকি মারছিল তাতে স্পষ্ট কাউকে খুঁজছে। সিঁথি নিজের চুল কানের পিঠে গুঁজে ভাব নিয়ে এগিয়ে এলো। ওর বিশ্বাস এই ছেলে ওর রূপের প্রেমে পরে এসেছে। কলেজে ভর্তি হয়েছে এবছর কত ছেলে সুন্দরী সিঁথির পেছনে ঘুরেছে সবাই জানে। এই ছেলে ও হয়ত তেমন একজন। ইশ কত ভালোবাসা একদম খুঁজে খুঁজে বাড়ি অব্দি চলে এসেছে এই ছেলে ওকে প্রপোজ করলে ও বিনা বাক্যে রাজি হয়ে যাবে। সিঁথি লাজুক হেঁসে এগিয়ে এসে দাঁড়াল ধ্রুবর সামনে।
ধ্রুব গাড়ি নিয়ে চারুর পিছু এসেছিল। গলির মোড়ে থেকে রিকশা ফেরত যেতে দেখেছে। রিকশা চালক কে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করেছে কোন দিকে গিয়েছে তারপর সেখানেই কার রেখে ধ্রুব রাস্তা ধরে এই টিনের চালে ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কারণ সামনে আরো দুইটা মোড় ও বুঝে পারছে না কোনদিকে যাবে বিরক্ত হয়ে এই বাড়ির গেইট ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। তখনি একটা মেয়েকে বের হতে দেখে দরজা খুলে সন্দেহ বশত মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকে।
চারু ভেবেই তাকিয়ে ছিল কিন্তু অন্য একটা টপস পরা মেয়েকে এগিয়ে আসতে দেখে। মেয়েটাকে চারুর বিষয়ে জিজ্ঞাসা করতে চাইছিল। কিন্তু মেয়েটার হাবভাব দেখে ইচ্ছে সংবরণ করেছে। রাগে মেজাজ সাত আসমানে উঠে আছে চারু প্রতিদিন ওকে ইচ্ছামত অপমান অপদস্থ করে যাচ্ছে আর ও কিনা তার কিছুই করতে পারছে না। রাগে ফরসা মুখটা লাল হয়ে আছে।
সিঁথি এগিয়ে এসে বলল,’ আপনি…’
কথা বলতেও দিল না ধ্রুব গটগট করে যে পথ ধরে এসেছিল সেই পথ ধরেই চলে গেল সিঁথি দৌড়ে এসে ওর পিছু নিল।
বড়ো বড়ো পা ফেলে হাঁটছে ধ্রুব। সিঁথি ওর পিছু এসে ডাকছে ওকে,’ এইযে শুনছেন, কে আপনি? আমাদের বাসার সামনে কি করেছেন? কি হলো কথা বলছেন না কেন! এভাবে চলে এলেন কেন? আরে শুনুন না..’
সিঁথি দৌড়ে এসে ওকে ধরবে ভাবল তখনি দেখল গলি ছেড়ে মেইন সড়কে চলে এসেছে। ধ্রুব ওর চোখের সামনে কারে উঠে চলে গেল। সিঁথি মুখে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
এই ছেলেটার কার আছে ও মাই গড তাহলে তো খুব বড়োলোক বাড়ির ছেলে। আল্লাহ এমন একটা ছেলে আমাকে পছন্দ করেছে আমার জন্য আমাদের বাড়িতে চোরের মতো উঁকিঝুঁকি মেরেছে।
সিঁথি খুশিতে লাফালাফি করতে লাগল। মাকে এখুনি এই নিউজ জানাতে হবে। ইশ মা জানতে পারলে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাবে। তার মেয়ে এবার বড়োলোক বাড়ির ব‌উ হবে।
সিঁথি নাচতে নাচতে বাড়ি ফিরে এলো।

চারু রান্না করছিল এবং লক্ষ্য করছিল সিঁথি আর ময়না বেগম দু’জনে বসে কি জানে ফিসফিসিয়ে বলছে। ময়না বেগম তো আনন্দের আত্মহারা মেয়ের কথায়। দুজনে কি যেনো প্লান করছে। চারু কপাল কুঁচকে ভাবছিল মা একটু আগেই এতো রেগে বোম হয়ে গেছিল ওর জন্য এখনি কি এমন বলল সিঁথি যে খোলস পাল্টে গেল। চারুর রান্না অর্ধেক হতেই ময়না বেগমের ভাই ভাবি, ভাস্তি ভাতিজা সবাই চলে এলো। চারুর কাছে এসে তখন নিজেও রান্নায় হাত লাগাল। চারু সবকিছু ডাইনিং টেবিলে গুছিয়ে রেখে সরে এলো।
চারু সব কিছু রেখে নিজের রুমে চলে এলো। সবাই খাওয়া-দাওয়া করে নেওয়ার পর চারু একাই এসে খেয়ে নিল। ওর রুমে এখন জায়গা নেই। ওর রুমে দখল করেছে সবাই। চারু সিঁথির রুমে গিয়ে বসতেই সিঁথি বলল,’ চারু তুই বাইরে যা আমি এখন ঘুমাব।’
চারু চলে আসবে তখন সিঁথির মামাতো বোন বলল,’ চারু আপু তোমার বড়ো না? তুমি আপু কে নাম ধরে তুই তুকানি আরো কেন?’
সিঁথি বলল,’ এই তুই আমার মামাতো বোন নাকি ওর হ্যাঁ? ওর হয়ে সাফাই গাইছিস যে!’
অবন্তী ঠোঁট বেঁকিয়ে উঠে চারুর পিছু বাইরে চলে এলো। সিঁথি চোখ কটমট করে অবন্তীর দিকে তাকিয়ে র‌ইল।

চারুর পিছু এসে বলল,’ আপু চলো আমরা ঘুরে আসি।’
চারু বলল,’ এখন? কাল যাব নি তোমরা তো আছোই কয়েকদিন তাই না?’
অবন্তী বলল,’ কাল চলে যাব আমরা। ভাইয়া হয়ত থাকবে।’
চারু চমকে উঠল। সে আবার থাকবে কেন? অবন্তীর ভাই আহান ভীষণ খারাপ একটা ছেলে বাবা থাকতে একবার এসে ওর সাথে খারাপ আচরণ করেছিল বাবা ওকে লাঠি দিয়ে মারতে গিয়েছিল। তারপর আর কখনোই ওই ছেলেটা এই বাসায় আসার সাহস করতে পারেনি। বাবা মারা যেতেই আবার চলে এসেছে। এখন আবার যদি ওর সাথে খারাপ কিছু করতে আসে? সেবার তো বাবা ছিল এবার ওকে কে বাঁচাবে?
ভয়ে চারুর হাত পা কাঁপতে লাগল। অবন্তী চারুর হাত ধরে ওকে ঝাঁকিয়ে বলল,’ আপু কি হয়েছে তোমার একাই কাঁপছ কেন?’
চারু নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল,’ ক‌ই কিছু না তো।’
চারু আর অবন্তী বারান্দায় বসে ছিল। আহান এলো সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে। গেইট খুলে ভেতরে আসতে আসতেই কামনা ভরা চোখে তাকাল চারুর দিকে। চারু ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিল। বদমাইশ একটা।
মন চাচ্ছে জুতো খুলে মুখে মারতে‌। কিন্তু ওতো সাহস তো চারুর নেই। চারু দেখল বদমাইশ টা ওর সামনে এসে দাড়িয়েছে। চারুর সারা অঙ্গ রিনরিন করে উঠল ওর বাজে নজরে।
আহান ওদের সামনে এসে বলল,’ আরে চারু যে ক‌ই ছিলা আসার পর থিকা তোমারে খুঁজছি।’
চারু যখন সবার সাথে কথা বলেছিল আহান ছিল না। ও আহানের সামনে যাতে পরতে না হয় তাই আগেই রুমে গিয়ে দরজা আটকে নিয়েছিল। মায়ের ডাকে দরজা খুলে বেরিয়ে খাবার খায়। এখন ওর রুমে রেস্ট করতে যায় অবন্তীর বাবা মা‌। আহান খেয়েই বাইরে চলে গিয়েছিল সিগারেটের প্রতি তীব্র নেশা ওর।
আহান নাকমুখ দিয়ে ধোঁয়া ছড়িয়ে কথা বলছে ওদের সাথে‌। চারু উত্তর দিচ্ছে না দেখে আহান চলে গেল। চারু আহান চলে যেতেই শান্তি অনুভব করল।

সময়টা তখন রাত প্রায় বারোটা চারু বিছানায় শুয়ে আছে। আজকে অবন্তী চারু ও সিঁথি এক রুমে শুয়েছে। সিঁথি গভীর ঘুমে চারুর ফোন তখনি একটা আননোন নাম্বার থেকে কল আসে‌। চারু ধরফরিয়ে উঠে ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে একটা পুরুষ কন্ঠস্বর ভেসে আসে।
চারু কপাল কুঁচকে নেয়। এতো রাতে ওকে ফোন করল কে?
বুক ধকধক করছে সিঁথি উঠে না যায়। কথা বলতেও পারছে না। ওপাশ থেকে লোকটা কর্কশ রুক্ষ স্বরে বলে উঠল,’ তোমার বাড়ির এ্যাড্রেস আমি পেয়ে গেছি মিস চারু। এবার কোথায় পালাবে?’
চারুর হৃদপিন্ড লাফিয়ে উঠল। শ্বাসরুদ্ধ হয়ে এলো এ তো সেই ছেলেটার কন্ঠ। এসব কি বলছে কেন বলছে? সে আমার বাড়ির ঠিকানা কিভাবে পাবে? ঢোক গিলে চারু ফিসফিস করে বলল,’ কি সব বলছেন? আপনি এতো রাতে আমায় কল দিয়েছেন কেন?’
‘ দাদুর কাছে গেলেই তোমার বাসার ঠিকানা ও নাম্বার নেওয়া যাবে মনেই ছিল না জানো? এতো দিন অযথা আমি এতো কষ্ট করেছি। এতো বোকা ধ্রুব কবে হয়ে গেল!’
চারু থমকে গেল। লোকটা কি করতে চাইছে?
‘ আপনি আমার বাড়ির ঠিকানা দিয়ে কি করবেন?’
‘ বিয়ের প্রস্তাব অবশ্যই দিতে আসব না।’
‘ কি সব আবোলতাবোল বকছেন?’ কন্ঠ কাঁপছে চারুর।
‘ শোনো তুমি আমার সাথে পাঙ্গা নিয়ে একদম ঠিক করো নাই। ধ্রুবর সাথে টক্কর নিয়ে খুব ভুল করেছ এবার তুমি হারে হারে টের পাবে মিস চারু।’
‘ আপনি আমার সাথে কেন এমন করছেন?’
‘ তুমি আমার গায়ে হাত তুলে খুব অন্যায় করেছ। ফাস্ট টাইম কেউ আমায় থাপ্পর মেরেছে। তোমার জন্য শুধু মাত্র তোমার জন্য আমি আমার ফ্রেন্ডদের সামনে মুখ দেখাতে পারছি না। দুই দুইবার তুমি আমার গায়ে হাত তুলেছ। এর পর ও ভাবছ আমি তোমায় ছেড়ে দিব? ইম্পসিবল।’
‘ আপনাদের মতো লোকদের এই এক সমস্যা। নিজেদের ভুল আপনাদের চোখে পরে না। আপনি একটা থাপ্পর খেয়ে এতো গায়ে লাগাচ্ছেন।
আমার অনুমতি ছাড়া আমাকে ওভাবে জড়িয়ে ধরলেন আমি তাতে কিছুই করতে পারব না তাই না? আপনাকে একটা থাপ্পর কেন আমার তো তখন মন চাচ্ছিল আপনাকে খুন করে ফেলি।’
ধ্রুব কিছু বলতে যাবে খট করেই ওর মুখের উপর চারু কলটা কেটে দিল। ধ্রুব রাগে নিজের ফোনটা ছুড়ে মারল। এতো বড়ো সাহস ওর কথা না শুনেই মেয়েটা কল কেটে দিল। দিনকে দিন মেয়েটার সাহস দেখে ও স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে। জীবনে যা কেউ করেনি সেসব করছে মেয়েটা।

চারু কল কেটেই ঘুমের ভান করে পরে আছে‌ কারণ সিঁথি উঠে বসেছে। এবং বলছে,’ কে রে এতো রাতে কথা বলছে।’
সিঁথি উঠে কাউকে জাগ্রত না দেখে চমকে উঠল।
‘ হায় কেউ তো জাগনা নেই তাহলে আমি কার ফিসফিস আওয়াজ পেলাম?’
সিঁথি ভয়ে চমকে উঠল। আল্লাহ ভূত নয়ত?
সিঁথি অবন্তী কে জড়িয়ে কম্বল জড়িয়ে নিল।
চারু হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো যেন সিঁথির হাতে ধরা খেলে সর্বনাশ হয়ে যেতো।
ভোরে চারুর আড়মোড় ভেঙে চোখ মেলে তাকাতেই চিৎকার করে উঠল। লাফ দিয়ে উঠে বসল।
ভয়ে ওর হার্টবিট বেড়ে গেছে। কারণ ওর মুখের উপর ঝুঁকে ছিল আহান। আহান ওকে চিৎকার করতে দেখেই দ্রুত দরজা খুলে বেরিয়ে গেছে। চারুর চিৎকার শুনে সিঁথি আর অবন্তী উঠে গেল।
সিঁথি বিরক্তিকর কন্ঠে বলল,’ কি হয়েছে সাতসকালে চিৎকার করে মাথা খাচ্ছিস কেন হ্যাঁ?’
চারু ভয়ে ভীত হয়ে বুকে ফুঁ দিচ্ছে।
সিঁথি ওকে ধমক দিয়ে বলল,’ যা বের হয়ে যা ঘর থেকে। তোর জ্বালায় আমি সারা রাত ঘুমাতে পারি নাই।’
চারু বলল,’ আমি কি করলাম রাতে আবার?’
‘ জানি না তুই যা তো এখন সারারাত তো ঘুমালি এখন যা কাজ কর।’
চারু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাড়াল‌। অবন্তী আবার শুয়ে পড়েছে। চারু দরজার সামনে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে‌। আহান বাসা থেকে বের হতেই চারু বের হলো।
চারু রান্না ঘরে গিয়ে থালা বাসন ধুয়ে নিচ্ছিল। পেছনে কারো গরম নিঃশ্বাস অনুভব করতেই রাগে ফেটে পড়ল। হাতের কাছে থাকা চামুচ দিয়েই পিছনে না ঘুরেই বাড়ি দিয়ে বসল‌। আহান মৃদু আর্তনাদ করে উঠল। কারণ বারিটা একদম নাক বরাবর লেগেছে একটুর জন্য চোখ রক্ষা পেয়েছে। চামুচের বারি খেয়ে রক্ত বেরিয়ে গেছে।
চারু পিছু ঘুরে আগুল তুলে বলল,’ আমার আশেপাশে এমন বাজে উদ্দেশ্য নিয়ে আসলে একদম খুন করে ফেলব তোকে হা রা ম জা দা।’
আহান নাক চেপে ধরে চলে গেল। যাওয়ার আগে বলে গেল,’ তোকে আমি দেখে নেব।’

#চলবে……