“প্রেমনেশা”
নন্দিনী নীলা
৭.
আজকে শুক্রবার। ঝিমের কলেজ অফ রাতে চারুর সাথে ঘুমিয়েছে। ময়না বেগম ও সিঁথি সবার সাথেই ঝগড়া করে এজন্য কেউ তেমন ওদের সাথে মিশে না। মা মেয়ে বাড়িতে নেই তাই সবাই আসে। বিশেষ করে ঝিম। সিঁথি আর ও একসাথে পড়লেও সিঁথির সাথে তেমন বনিবনা নেই।
ঝিম আজকে উঠেই গেল না। চারুর সাথেই বসে আছে। ঝিম ঘুম থেকে উঠে বলল,’ আপু আজ তোমার সাথে খাই?’
চারু বলল,’ বাসায় কিন্তু আলু ছাড়া কিছুই নাই। খালি ভর্তা দিয়ে খেতে পারবি তো?’
‘ তুমি পারলে আমি পারব না কেন?’
চারু হেঁসে দিল ওর কথায়। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চারু বলল,’ তুই আমার নিজের বোন হলে খুব ভালো হতো রে ঝিম।’
ঝিম বলল,’ কেন আমি তোমার বোন না বুঝি?’
হেঁসে খেলে দুই বোন রান্না করল। চারু দেখল ফ্রিজ এ কয়েকটা টমেটো আছে। চারু সেটা বের করে ডাল রান্না করল। তারপর দুইবোন পেট পুরে খেল। মাঝে একবার ঝিমের মা এসে ডেকে গেল। ঝিম এখানে খাওয়ার কথা বললে মেয়েকে ধমক দিল।
‘ এই তুই এখানে খাবি কেন? চারু কে আমাদের বাড়ি নিয়ে যেতে পারলি না!’
চারু বলল,’ চাচি সমস্যা নেই থাকুক না।’
‘ ময়না ভাবি কি কিছু রেখে গেছে কি সব খাচ্ছিস ও আবার আসছে ভাগ বসাতে। তোকে আমাদের বাড়ি খেতে বললাম গেলি না তো আর।’
চাচি কে বুঝিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেয় চারু।
ঝিম আর চারু বসে ছিল। সারাদিন ঝিম চারুর সাথেই রইল। দুপুরে আর খেল না বাসা থেকে খেয়ে এলো ঝিম। চারু আর ঝিম বিকেলে বসে নাটক দেখছিল। ঝিম নিজের এ্যান্ডুয়েট ফোনে নাটক দেখাচ্ছে। চারু মনোযোগ দিয়ে দেখেছিল। হঠাৎ ঝিম কি যেন মনে করে ফোন রেখে বলল,’আপু আমি একটু আসছি তুমি দেখতে থাকো।’ চারুর কাছে ফোন রেখে গেছে চারু বসে নাটক দেখছে।
তখনি আবার দরজার খটখটে শব্দে চারু ভাবে হয়ত ঝিম চলে এসেছে ও বসেই আছে। ঝিম কি পাগল হলো? এখনি তো গেল দরজা চাপিয়ে এসেই ধাক্কাধাক্কি করছে কেন?
চারু চেঁচিয়ে উঠল,’ কিরে ঝিম দরজা তো খোলাই আছে ধাক্কাধাক্কি করছিস কেন? আয় দেখ সুন্দর সিন হচ্ছে নায়ক টা নায়িকাকে ভালোবাসি বলছে।’
উৎফুল্ল হয়ে বলল চারু। চারুর কথার বিপরীতে ওপাশ হতে একটা গম্ভীর পুরুষালি কন্ঠস্বর ভেসে এলো।
‘ তাই নাকি?’
চারু ছিটকে উঠল। ফোন রেখে বিস্মিত নয়নে তাকাল সামনে দেখল দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করছে ব্রাউন প্যান্ট পরা এক জোড়া পা। চারু অগত্যা লোকটার মুখের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতেই চমকে উঠল। ধ্রুব দাঁড়িয়ে আছে। চারু লাফ দিয়ে উঠে বসল।
চারু তোতলানো কন্ঠে বলে উঠল,’ আপনি আবার এখানে কি করছেন?’
ধ্রুব এগিয়ে এসে সোফায় বসে পরে থাকা ফোনটা হাতে নিয়ে বলল,’ জোভানের নাটক দেখো চয়েজ খারাপ তোমার।’
বলেই ফোনটা ছুড়ে আরেক সোফায় দিল। চারু ছুঁড়ে মারতে দেখে দৌড়ে গিয়ে ফোনটা যত্ন সহকারে ধরল।
ধ্রুব বলল,’ সস্তা একটা ফোন এটা নিয়ে এতো আতংকিত হওয়ার কি আছে? তোমার জন্য আমার লাখ টাকার ফোন নষ্ট করেছি।’
চারু ফোনটা যত্ন করে হাতে নিয়ে বলল,’ যার যা আছে সেটাই তার কাছে অনেক দামী মূল্যবান।’
‘ তাই নাকি?’ বলতে বলতে ধ্রুবর ঠোঁটে কুটিল হাঁসি ফুটে উঠল। অদ্ভুত ভাবে ফোনটার দিকে তাকিয়ে কিছু ভাবছে যেন।
চারু ঠোঁট কামড়ে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,’আপনি আবার কেন এখানে এসেছেন?’
ধ্রুব নিজের গালের খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে হাত বুলিয়ে বলল,’ মন চাইল চলে এলাম।’
চারু কপাল কুঁচকে বলল,’ মানে?’
ধ্রুব চট করেই দাঁড়িয়ে পড়ল এবং তড়িৎ গতিতে ছো মেরে চারুর হাত থেকে ঝিমের ফোনটা কেড়ে নিল। চারুর বুক ধক করে উঠল। চারু চিৎকার করে উঠল,’ কি করছেন?’
চারুর কথা চারুর মুখেই লেগে আছে ধ্রুব এক টানে ফোনটা কেড়ে নিয়ে দেয়ালে ছুঁড়ে মেরেছে। সঙ্গে সঙ্গে ফোনটা ভেঙে দুই খন্ড হয়ে ফ্লোরে গড়িয়ে পড়তে লাগল। চারু স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে ভাঙা ফোনের দিকে।
দুহাতে মুখ চেপে ধরল চারু। এটা কি সর্বনাশ ঘটে গেল? এটা নিজের ফোন থাকলে তাও নিজেকে বুঝ দেওয়া যেত কিন্তু একজন ওকে বিলিভ করে ওর কাছে নিজের ফোনটা রেখে গেছে সেটা ওর সামনেই তছনছ হয়ে গেল? চারু পাগলের মতো ছুটে গিয়ে ভাঙা টুকরো গুলো জোড়া লাগানোর বৃথা চেষ্টা করতে লাগল। চোখ দিয়ে অধরে শ্রাবণ ধারায় পানি পড়ছে বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যথা করছে। ঝিম কে ও কি উত্তর দিবে? মেয়েটার শখের ফোন। ছয় মাস আগেই অনেক কান্নাকাটি করে ফোনটা কিনেছে। ওরা ও ওদের মতোই মধ্যবিত্ত। এই ফোন নিয়ে কথা কাহিনী সব কিছুই ঝিম ওকে রাত জেগে গল্প করে শুনিয়েছে। মেয়ের শখের ফোনটা ওর জন্য ধ্বংস হয়ে গেল? এই লোকটার জ ল্লা দের মতো এসে শেষ করে দিল। ক্ষ্যাপাটে বাঘিনী রূপ ধারণ করল চারু।
এদিকে ধ্রুবর মনে পৈশাচিক আনন্দ বিরাজ করছে। ওকে যে অপমান করেছে তার একটু হলেও শোধ করতে পেরেছে চারুর চোখের জল দেখে। ও সোফায় পায়ের উপর পা তুলে বসে ছিল। কেন জানি চারুকে পাগলের মতো কাঁদতে দেখে কষ্ট অনুভব হচ্ছিল কিন্তু নিজের মধ্যে খারাপ লাগাটাকে পাত্তা দিচ্ছে না।
ওইদিন মেয়েটা খুব কায়দা করে ওকে বশ করেছিল। কি সুন্দর ওকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করল কান্না করল অসহায় হয়ে ওর প্রতিশোধ স্পৃহা থমকে দিল! দুই রাত ও ঘুমাতে পারেনি মেয়েটা কান্না করে ওকে বশ করতে চায়। মেয়ে মানুষের চোখ জল কি পুরুষ মানুষ সহ্য করতে পারে? দুই রাত ওকে ওই চোখের জল ছটফট করিয়েছে।
আজকে আবার সে চোখের জল। ও চোখের দৃষ্টি সরিয়ে রাগী কন্ঠে বলল,’ সস্তা একটা ফোনের জন্য এতো কান্নাকাটি করার কি আছে? আজব! চোখের জল কি বেশি হয়েছে নাকি? মনে হচ্ছে জীবনে আর ফোন কিনতে পারবে না! তুমি তো মানুষের বাড়ি মেড এর কাজ ভালোই করতে পারো। একটা কাজ জুটিয়ে আবার কিনে নিও কেমন খুকি?’
চারুর দিকে থেকে কোন রেসপন্স পাচ্ছে না তাই আবার বলল,’ তোমরা মেয়েরা খুব চালাক। ছেলেরা মেয়েদের চোখের জল সহ্য করতে পারে না জেনে যখন কিছুতে কাজ হয়না তখন চোখের জল ফেলতে শুরু করে দাও। ওইদিন তোমার অসহায় চোখের পানি দেখিয়ে আমায় থমকে দিয়েছিল আজকেও আমাকে দ্বিধায় ফেলতে চাইছ তাই না? আমি একদম ওই চোখের পানি দেখে গলে যাব না। ধ্রুবর সাথে টক্কর নিয়ে তুমি ভুল করেছো তা তোমায় বুঝাতে হবে।’
চারু ফট করেই উঠে দাঁড়াল। ধ্রুব কিছু বুঝে উঠার আগেই চারু ছুটে এসে ধ্রুবর কলার চেপে ধরল শক্ত করে দুহাতে। ধ্রুব আচমকা আক্রমন এ প্রতিহত করতে পারল না।
শুধু মুখ দিয়ে অস্ফুট স্বরে বলে উঠল,’ হোয়াট দ্যা..!’
চারু আগুন চক্ষু মেলে তাকিয়ে আছে ওর চোখের দিকে। ধ্রুব চারুর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,’ একটু আগেই না ঝরঝর করে চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরছিল? তুমি মেয়ে নাকি গিরগিটি হ্যাঁ? জল থৈ থৈ চোখে, এমন দ্রুত রক্তিম সূর্যের ন্যায় জ্বলে উঠলে কীভাবে?’
চারু দাঁত চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,’ আপনি এটা কেন করলেন? কেন ফোনটা ভেঙে দিলেন?’
‘ এইযে অসহায় হয়ে কাঁদছ বিলিভ মি দেখতে ভীষণ ভালো লাগছে। না ভাঙলে এমন উন্মাদ হয়ে কাঁদতে তুমি?’
চারু কলার আরো শক্ত করে ধরল। এমন ভাবে ধরেছে যে শার্টের একটা বোতাম পর্যন্ত ছিঁড়ে গেল। চারু রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলল,’ আমার উপর রাগ দেখাতে প্রতিশোধ নিতে আপনি আমার জিনিস নষ্ট করতেন আমি কিছুই বলতাম না। আমার মতো একটা মেয়ের কি এ্যান্ডুয়েট ফোনে থাকতে পারে? এতো টুকু কমন সেন্স নাই আপনার? আপনি আমার ক্ষতি করতে গিয়ে আরেকজনের শখ নষ্ট করে দিলেন? আর কি বলছিলেন বারবার সস্তা?
আপনাদের মতো কোটি টাকায় যারা জীবন কাটায় তারা কিভাবে অল্প টাকায় শখ পূরণ করার মর্ম বুঝবে বলেন তো? আমরা গরীব দুই টাকা আয় করতেও আমাদের অনেক পরিশ্রম করতে হয়। এই ফোনটা একজন শখ ছিল অনেক কষ্টে মধ্যবিত্ত পরিবারের লোকেরা এমন সস্তা ফোন কিনেই নিজের আহ্লাদ পূরণ করে। আপনার মতো লাখ টাকার ফোন যে আনন্দ আপনায় দিতে পারেনা এই সস্তা ফোন আমাদের কোটি টাকার থেকেও বেশি খুশি এনে দেয়।’
চারু ধ্রুবর কলার ঝাঁকায় দিতে লাগল। আর নিজের মনের জ্বালা মিটিয়ে নিতে চাইল। কীভাবে কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। কীভাবে ঝিম কে মুখ দেখাবে? চারু চট করেই ধ্রুবর কলার ছেড়ে দিল ধপ করে ফ্লোরে বসে পড়ল। মাথা এলোমেলো লাগছে।
এদিকে ঝিম তখনি দৌড়ে এলো। এসেই চারু আপু বলে চিৎকার করল। দরজা হাট করে খোলা তাই বারান্দায় থেকে দেখল ভেতরে অপরিচিত একজন সুদর্শন পুরুষ বসে আছে। তার সামনে মলিন মুখে চারু বসে আছে। কপাল কুঁচকে ঝিম ভাবছে এই সুন্দর ছেলেটা কে? এটা কি চারু আপুর বয়ফ্রেন্ড হায় কি সুন্দর?
ঝিম ভেতরে এসেই চারুর পাশে বসে পড়ল।
ঝিম চারুর কানে বলল,’ আপু এই সুন্দর ছেলেটা কি তোমার বয়ফ্রেন্ড?’
চারু ঝিমের আওয়াজ পেয়েই চমকে উঠেছে। ঢোক গিলে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ঝিমের কথা সম্পূর্ণ ধ্রুবর কানে গিয়েছে। বিস্মিত চোখে তাকিয়ে আছে ঝিমের দিকে। ওর কানে বাজছে বয়ফ্রেন্ড শব্দটা।
#চলবে…?