প্রেমনেশা পর্ব-০৮

0
2

“প্রেমনেশা”
নন্দিনী নীলা
৮.

ঝিম ভাঙা ফোন দেখে কাঁদতে কাঁদতে চলে যায়। চারু কোনভাবেই ওকে আটকে রাখতে পারে না।
ধ্রুব আগের জায়গাতেই থম মেরে বসে আছে। ঝিম কে ভাঙা ফোন হাতে বাসা থেকে বেরিয়ে যেতে দেখে বুঝতে বাকি নেই ফোনটা চারুর না।চারু ওকে আটকাতে গেইট পর্যন্ত গেলো।
ঝিম কাঁদতে কাঁদতে বলল,’ আমার ফোনটা তুমি ভেঙে ফেললে আপু? এখন আমি বাসায় কি বলব? কত বকা খেয়ে পেয়েছিলাম ফোনটা আমি। এখন আমাকে কে ফোন দিবে।’
‘ আমাকে ক্ষমা করে দে ঝিম। আমি একটা কাজ জুটিয়ে নেই তোকে আবার একটা ফোন কিনে দিব।’
ঝিম ঝামটা দিয়ে চারুর হাত ছাড়িয়ে নিল নিজের হাত থেকে।
তারপর চিৎকার করে উঠল,’কবে তোমার‌ টাকা হবে আমি সেই আশায় বসে থাকব? তোমাকে আমি নিজের বোনের মতো ভেবেছিলাম। এই ফোনটা আমার কত শখের তুমি সবটাই জানতে। সব জেনে শুনে ইচ্ছে করে এসব করেছ তাই না? নিজের এমন ফোন নেই তাই তুমি আমার শখের ফোনটা শেষ করে দিলে হিংসা করে। আপু তোমার কোনদিন ভালো হবে না। আমি আর কখনোই তোমার কাছে আসব না তুমি খুব খারাপ। সিঁথি একদম ঠিক বলে। তোমাকে খারাপ বলায় আমি ওর সাথে মিশি না আর সেই তুমি…’
ফুঁপিয়ে উঠল ঝিম। চারুর দুনিয়া কাঁপছে। ঝিমের পরিবারের সাথে ওর যে মিষ্টি একটা সম্পর্ক ছিল আজ বোধহয় সেটা শেষ হয়ে গেল। চারুর কষ্টের সাথে যেন আকাশ ও কেঁদে উঠল। গেইটের সামনে দাঁড়ানো অবস্থায় ঝরঝর করে বৃষ্টি নামতে লাগল। ঝিম কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল। চারু ঠাঁই দাঁড়িয়ে ভিজতে লাগল।
ধ্রুব বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে হুট করেই এমন বৃষ্টি শুরু হয়েছে যে বাইরে এক পা ও রাখা যাচ্ছে না। ধ্রুব বিরক্তিকর চোখে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে আছে। বাইরে গেইট ধরে চারু ভিজছে এই ভর সন্ধ্যায় চারুকে ওমন ভিজতে দেখে ধ্রুব ভরকাল।
ধ্রুবর চোখের সামনেই চারু ভিজে চুপচুপে হয়ে গেল। ভেজা শরীরে চারু পিছু ঘুরতেই দেখল ধ্রুব বারান্দায় দাঁড়িয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। মাথায় আগুন চেপে বসল। চারু ভেজা শরীরে ধপাধপ পায়ে ধ্রুবর দিকে এগিয়ে আসতে নিল। পিচ্ছিল উঠানে ঠাস করে চারু পড়ে গেল। ধ্রুব এই রকম একটা অবস্থা দেখে না হেসে পারল না।
চারু পরে গিয়েই কোমরে ভীষণ আঘাত পেয়েছে। কোনভাবেই উঠে দাঁড়াতে পারছে না জায়গাটা এতোটাই পিচ্ছিল হয়ে আছে।চারু চোখ খিচে নিজের ব্যথা নিবারণ করে উঠার চেষ্টা করছে। এদিকে বৃষ্টির ঠান্ডা বরফের মতো পানি ওর গায়ে পড়ছে আর ওর শরীর কেঁপে উঠছে। ধ্রুবর সামনে এমন অবস্থায় পরে রাগ লাগছে নিজের উপর আরো বেশি।‌
একটু পর পর বাজ পড়ছে। বজ্রপাতের শব্দে চারু ভয়ে ভীত হয়ে আছে কিন্তু ধ্রুবর সামনে নিজেকে ভয়ার্ত দেখাতে চাইছে না।
চারু চুপ করে বসে আছে দেখে ধ্রুব গলা উঁচিয়ে বলল,’ কি মিস চারু উঠতে পারছ না? হেল্প লাগবে?’
চারু অগ্নিদগ্ধ চোখে চেয়ে র‌ইল উত্তর দিল না। ধ্রুব নিশ্চুপ পেটে হাত গুজে দাঁড়িয়ে ওকে দেখছে নিষ্পলক চোখে। চারু হাতে ভর দিয়ে উঠার ট্রাই করছে কিন্তু উঠতে পারছে না পায়ে টান লাগছে। বৃষ্টির গতিবেগ বেড়েই চলেছে। চারু এখন মাথা উঁচু করে ধ্রুবর দিকে দেখতেও পারছে না। কিন্তু ওর মন বলছে শয়তান টা ওকেই দেখছে হয়ত, পৈশাচিক আনন্দ উপভোগ করছে ওকে এমন নাকানিচুবানি খেতে দেখে। লজ্জায় চারুর মরে যেতে ইচ্ছা করছে। বারবার কেন তার সামনে ওকে লজ্জা পড়তে হচ্ছে? চারু অনেক কষ্টে উঠে গেল এবং দুই কদম এগুতেই আবার ধপাস করে পড়ে গেল। এমনিতেই ব্যথায় হাঁটতে পারছে না তার উপর পিচ্ছিল জায়গা। চারু এবার পরে আর নিজের ব্যথা আটকাতে পারল না। চারু আর্তনাদ করে উঠল‌।
এদিকে ভিজে ওর গায়ের জামা শরীরে সাথে লেপ্টে গিয়েছে। একটা ছেলের সামনে এমন অবস্থায় পরে লজ্জা রাগে গড়াগড়ি করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। চারু মাথা নিচু করে চোখের জল ফেলছিলো ওর এই জল কারো চোখে ধরা পড়বে না কারণ বৃষ্টির পানির সাথে চোখের পানি মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে। চারু খেয়াল করল ওর সামনে ভেজা উঠানে এসে দাঁড়িয়েছে ধ্রুব।

তারপর ওর দিকে হাত বাড়িয়ে বলল,’ উঠে আসো।’
চারুর চোখমুখ শক্ত হয়ে এলো। ধ্রুবর সাহায্য ও কিছুতেই নিবে না। অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে চারু দাঁতে দাঁত চেপে বলল,’ শাস্তি তো দিয়েছেন।‌এখনো কেন আছেন চলে যান আপনার মুখ আমি দেখতে চাই না।’
ধ্রুব রাগী কন্ঠে বলল,’ উঠতে পারছ না কিন্তু এখনো জেদ কমেনি। শোনো এতো জেদ ভালো না। তুমি আমার শত্রু হবার পর আমি ধ্রুব যে তোমায় হেল্প করতে এসেছি এ তোমার ভাগ্য।’
চারু দাঁত কিড়মিড় করে বলল,’ এমন ভাগ্য আমার দরকার নেই। আপনি চলে যান।’
ধ্রুব রেগে গেল। বৃষ্টিতে ভিজে মেয়েটার হেল্প করতে আসল‌ আর মেয়েটা কিনা ওকে ইগনোর করছে? এতো এটিডিউট মেয়েটা পায় কোথায়? কোন মেয়ে ওকে ইগনোর করতে পারে সেটা ধ্রুব বিলিভ করে না। নিজেকে যথেষ্ট সুদর্শন সুপুরুষ জানে ওকে কোন মেয়ে কখনোই না করেনি। উল্টো সব মেয়েরাই ওর জন্য উন্মাদ। সেখানে এই মেয়েটা প্রথম দিন থেকে ওকে ইগনোর করেছে। এটায় ধ্রুবর রাগ জেদ আরো বেশি প্রখর হয়ে গেল। কোন মেয়ের এমন এটিডিউট ও কখনোই দেখেনি। চারুর এই অবজ্ঞা ওকে আরো জেদি বানিয়ে দিল। ওর বাড়িয়ে দেওয়া হাত মেয়েটা অবজ্ঞা করল এই অপমান ওর রাগ বাড়িয়ে দিল। চারু কে চট করেই ধ্রুব দু’হাতে পাঁজাকোলা করে নিল। চারু শূন্য ভাসতেই বিদ্যুৎ এর শক খেল যেন। মুখের কথা গলায় আটকে ‌র‌ইল চোখ দুটো বিষ্ময় এ রসগোল্লার মতো বড়ো আকার ধারণ করেছে।
ধ্রুব ওকে কোলে তুলে বলল,’ তোমার অতিরিক্ত জেদ, অহংকার তোমার সর্বনাশের কারণ না হয়ে দাঁড়ায় মিস চারু। নিজের জেদ অহংকার অন্তত এই ধ্রুব কে দেখি ও না তাহলে বারবার পস্তাবে।’
বলেই ধ্রুব ওকে নিয়ে রুমে এসে ছুঁড়ে মারল সোফায়।
চারু চিৎকার করে আঙুল তুলে উঠল,’ আপনি কোন সাহসে আমাকে কোলে নিয়েছেন?’
চারু যে ছুটে এসে ওকে আরেকটা থাপ্পর দিবে সেই অবস্থায় ও নাই কারণ ব্যথায় ও নড়তে পারছে না।
ধ্রুব দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে তামাশা চারুর ছটফটানি।
ধ্রুব ঠোঁটের কোনে বিদ্রুপ হাঁসি ও বলল,’ ইশ এখন কিভাবে তুমি এই সাহসের প্রতিদান দিবে চারু? সর্বনাশ আমি যে তোমায় আবার টাচ করে ফেললাম। এবার ও কি থাপ্পর মারার জন্য হাত নিশপিশ করছে?’
চারু ধ্রুবর উপর তো রেগে আছেই তার চেয়ে বেশি রেগে আছে ওকে এই সোফার ভেজা শরীরে রাখার জন্য। কারণ মা যেকোনো সময় চলে আসতে পারে সোফা ভিজে থাকলে ওর উপর দিয়েই অত্যাচার যাবে।
চারু দাঁতে দাঁত চেপে বলল,’ আমাকে এখানে থেকে নামান।’
ধ্রুব বলল,’ ইম্পসিবল। আমি কি পাগল? তোমার কাছে গিয়ে কি আরেকটা চর খাব?’
চারু চোখ বন্ধ করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল,’মারব না এদিকে আসুন।’
‘ নো নেভার।’
চারু নিজেই অনেক কষ্টে নিচে নেমে বসে র‌‌ইল।
ধ্রুব চলে যাবে তাই বলল,’ শোনো মিস চারু তোমার আমাকে খুব অসহ্য লাগে তাই না?’
‘ হ্যাঁ আপনার মুখটা দেখলেও আমার রাগে শরীর কাঁপে।’
‘ তাই তাহলে তো তোমার রাগ এখন শরীর থেকে যাবে না।’
‘ মানে?’ বিস্মিত কন্ঠে বলল চারু।
‘ তুমি একমাত্র মেয়ে যে আমাকে এমন কথা বললে এখন পর্যন্ত কোন মেয়ে আমায় এভাবে বলেনি। উল্টো সবাই আমায় দেখার জন্য বসে থাকে তুমি একমাত্র যে আমায় দেখতে চাও না। আমার মতো একটা হ্যান্ডসাম ছেলেকে কেউ সহ্য করতে পারে না এটা আমি কীভাবে হজম করব বলো তো?’
‘ আপনি হ্যান্ডসাম? হাহাহা নিজের প্রশংসা নিজেই করছেন?’
‘ আমার জন্য কত মেয়েরা লাইন লেগে আছে জানো? তুমি আমায় এভাবে অপমান করে ঠিক করলে না ধ্রুব কে কেউ সহ্য করতে পারে না সেটা ধ্রুব কিছুতেই মানতে পারে না।’
‘ আজব তাইলে কি এখন জোর করে সহ্য করাবেন?’
ধ্রুবর ঠোঁটে রহস্যময়ী হাঁসি,’ প্রয়োজন পড়লে তাও করাতে পারি।’
বলেই ধ্রুব ভেজা শরীরে উঠানে নেমে গেল। চারু বিস্মিত চোখে খোলা দরজার দিকে তাকিয়ে আছে। এই পাগলের পাল্লা থেকে রেহাই পাব কিভাবে?
#চলবে…?