“প্রেমনেশা”
নন্দিনী নীলা
১২.
চারু ঘুমিয়ে পড়েছে। ময়না বেগম ক্রোধে চারুর রুমের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল সিঁথি মায়ের হাত ধরে টেনে বলল,’ কই যাও।’
‘ একশ টাকা দিয়েছি। কোন জিনিস আনে নাই আসছে কাহিনী নিয়ে। ওর কাহিনী আমি বের করবো এখন।’ কর্কশ কন্ঠে বলে উঠলেন ময়না বেগম।
সিঁথি বিরক্তিকর কন্ঠে বলল,’ মা এসব বাদ দাও তো এখন। আমার খুব খিদে পেয়েছে। নিজের রাগটা এবার কমাও। তোমার জন্য হ্যান্ডসাম এর কাছে আমার মান ইজ্জত গেল। নিজের মেয়ের কথা ভাবো। চারু সত্যি অনেক অসুস্থ ওকে আগে সুস্থ হতে দাও। এখন ওকে থাকতে দাও ওর মতো।’
ময়না বেগম মেয়ের কথায় আর চারুর উপর রাগ ঝাড়তে পারলেন না। সিঁথি ধ্রুবর নামটা অব্দি জানতে পারল না। আবার কোথায় পাব তাকে কে জানে..
মায়ের চারুর প্রতি নিষ্ঠুরতা দেখে ফেলল ইশ মানানোর আগেই চলে গেল। মুখটা ভোঁতা করে সিঁথি বসে আছে রুমে।
দুইদিন পরের কথা,
চারুর জ্বর কমেছে। দুইদিন ময়না বেগম ওকে কিছুই বলেনি। বিছানায় শুয়েই কাটিয়েছে দুইটা দিন। চারুর কাছে নাপা ছিল সেটাই খেয়েছে। জ্বর কম লাগতেই চারু বাইরে যাবার জন্য তৈরি হয়ে নিল। গতকাল রাতেই রাশেদা বেগমের নাম্বার থেকে কল এসেছিল তিনি আজকে ওকে যেতে বলেছে। হঠাৎই এতো দিন পর তার কল পেয়ে চারু চমকে উঠেছিল। রাশেদা বেগম ওর খোঁজখবর নিলেন। এতো দিন না যাওয়া নিয়ে কিছুই বলল না। চারু ঢোক গিলে কথা বলছিল।
সকাল সকাল চারু কে রেডি হয়ে বের হতে দেখে ময়না বেগমের কপাল কুঁচকে এলো।
ময়না জিজ্ঞেস করলেন,’ রেডি হয়ে কই যাস?’
চারু বলল,’ মা গতকাল রাশেদা ম্যাডাম কল দিয়েছিল আজকে যেতে বলেছে।’
ময়না বেগমের কপালে ভাঁজ পড়লেন,’ ওইদিন না বললি তোকে তাড়িয়ে দিয়েছে আজকে আবার ডাকল কেন?’
‘ আমি জানি না মা গিয়ে দেখি?’
ময়না বেগম সুযোগ পেয়ে বসল।
‘ যাবি যা এতো দিন তো আজাইরা বসে খাইলি। আবার যেহেতু ডেকে পাঠিয়েছে এবার সব ঠিকঠাক করে আসবি।’
চারু কিছু ভালোমন্দ বলল না বেরিয়ে এলো। ওর মাথায় কিছুই আসছে না এতো দিন পর কেন ওকে ডেকে পাঠাল? সেদিনের পর ওকে আর ফোন করেন নি রাশেদা বেগম এর মূলে রয়েছে ধ্রুব ওর বুঝতে বাকি নেই। আশা তো ছেড়েই দিয়েছিল আবার কেন?
চারু ভোরেই এসে পৌঁছাল। দাড়োয়ান কে দেখল চলে যাচ্ছে। সারারাত জেগে একজন পাহারা দেয় সকাল হলেই তিনি চলে যায় আরেকজন আসে। চারু গুটিসুটি পায়ে গেইট পেরিয়ে এলো।
সদর দরজার সামনে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কলিংবেল দেওয়ার আগেই সদর দরজা খুলে গেল চারু ভড়কাল।
বিস্মিত নয়নে তাকাল সামনে। ধ্রুব দাঁড়িয়ে আছে বাইরে জগিং করতে যাওয়ার বেশে। চারু মুখ ফিরিয়ে নিল। এমন ভাবে দরজা খুলে গিয়েছে চারু ভেবেছিল ওর উপস্থিতি অজান্তেই টের পেয়ে হয়ত খুলে দিয়েছে কেউ। কিন্তু ধ্রুব কে দেখে ভাবনার মধ্যে ভাটা পড়ল। চারু মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে ধ্রুব দরজা আটকে দাঁড়িয়ে আছে। চারু ওকে বের হতে দেওয়ার জন্য সরে দাঁড়াল।
ধ্রুব গতকাল দাদুর কাছে এসেছে এসেই বলেছে চারু কে আবার কাজে আনতে ফোন করে। রাশেদা বেগম ধ্রুবর কথায় অবাক হয় কারণ কয়দিন আগেই ধ্রুব আরেকটা মেয়েকে এনে বলেছে চারুর বদলে একে রাখতে। রাশেদা বেগম ধ্রুবর কথায় চমকে গিয়েছিলেন। চারু কে তিনি ভীষণ স্নেহ করেন মেয়েটা খুব নরম ও শান্তশিষ্ট। চারুর অসহায়ত্বের কথা সবটাই জানেন তিনি চারুর এলাকার যে মহিলা ওকে নিয়ে এসেছিল সেই সবটা বলেছে। চারু কে হঠাৎ কাজ থেকে বের করে দেওয়ার কথা বলায় খুব রাগ করেছিল।
কিন্তু নিজের নাতির কথার উপর কিছু বলতেও পারেনি। খুব জেদি সে। নাতির জেদের কাছে হার মেনেছিল। অসহায় মেয়েটাকে হারিয়ে খুব কষ্ট পেতেন।
ধ্রুব নিজের দাদুর রাগ অভিমান সবটাই বুঝতো কিন্তু চারুর প্রতি প্রতিশোধ স্পৃহা ওকে জেদি করে তুলেছিল। কিন্তু চারুর প্রতি ওর মায়ের নিষ্ঠুরতা ওকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। চলে আসতে গিয়েও কেন জানি ফিরে গিয়েছিল। আর গিয়েও ওমন নির্মমতার সাক্ষী হবে কল্পনা ও করেনি ধ্রুব। অসুস্থ নিস্তেজ চারু কে যখন ময়না বেগম নিষ্ঠুর ভাবে ফ্লোরে আছড়ে ফেলল ধ্রুবর হৃদপিন্ড লাফিয়ে উঠেছিল। কোন মায়ের আচরণ এমন হতে পারে ময়না বেগম কে না দেখলে ধ্রুব বিলিভ করতে পারত না।
সিঁথির মুখে যখন শুনল চারু সৎ বোন তখন ধ্রুবর কাছে সবটাই স্বচ্ছ জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেছে। এইজন্যেই এতোটা কঠিন হতে পেয়েছে ময়না বেগম। অজ্ঞান অবস্থায় মেয়েকে বাসায় ফিরতে দেখেও তার মধ্যে উত্তেজনা লক্ষ্য করেনি ধ্রুব। এই অবহেলার একটাই কারণ চারু তার নিজের সন্তান নয়।
চারু প্রতি অত্যাচার নির্যাতনের কথা সবটাই রাশেদা বেগমের কাছে জানতে পারে। ধ্রুব গতকাল রাতেই দাদু কে চেপে ধরেছিল সব জানতে। চারু কে চোখের সামনে ওমন অত্যাচারিত হতে দেখে চারু ব্যাপারে না জেনে শান্তি পাচ্ছিল না। সবটা স্পষ্ট ভাবে জানার জন্য বুকের ভেতর ধুকপুক করছিল।
ধ্রুব আজকে চারু কে ভালো ভাবে লক্ষ্য করল। চারুর ঠোঁটের নিচে কাটা দাগটা কালচে হয়ে আছে। মুখে অন্যান্য মেয়েদের মতো প্রসাধনী ব্যবহার করে না। গায়ের রং ফর্সা হলেও যত্নের অভাবে ফরসা রং টা ভাটা পড়েছে। দুই দিন আগেও চারুকে যতটা সতেজ লাবণ্যময় দেখাচ্ছিল আজকে দুদিনের অসুস্থতায় চোখের নিচে কালো দাগ পড়ে গেছে যেন। চিকন পাতলা ঠোঁটজোড়ায় অযত্নে রক্ষ্যতা এসে ভীড় করেছে। ছোটো গোলগাল মুখটা দেখলেই বুঝা যায় চারুর অসুস্থতা।
চারু খুব বেশি লম্বা না ধ্রুব যেহেতু লম্বা তাই ওর সামনে ছোটো বাচ্চা লাগে দেখতে। চারুর পরনে সুতি সেলোয়ার কামিজ চুল গুলো বিনি করে পিঠে ফেলে রেখেছে। ধ্রুব চারু কে মাথা থেকে পা পর্যন্ত আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করছিল। পায়ে দিকে তাকিয়ে ধ্রুব বেশি চমকালো চারুর মুখের তুলনায় পা বেশি ফরসা লাগছিল।
এইদিকে চারু ধ্রুব কে নিজের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখে বিরক্ত হচ্ছিল মুখ দিয়ে অনেক কড়া কথা শুনিয়ে দিতে ইচ্ছে করছিল কিন্তু মুখে কুলুপ এঁটে আছে। ধ্রুবর সাথে কথা বলে তর্কাতর্কি করতে চায় না। নিজের মাথাটাকে শান্ত করে দাঁড়িয়ে আছে। ধ্রুবর সাথে ভালোমন্দ কোন কথাই আর বলতে চায় না এই লোকটা আঠার মতো পিছু লেগে যায় এর থেকে যতটা সম্ভব নিজেকে সরিয়ে রাখতে হবে এর জন্য একমাত্র পথ নিজের মুখটা বন্ধ রাখা। চারু ফ্লোরের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে নিচ্ছিল।
কিন্তু কত সময় দাঁড়িয়ে থাকবে?
চারু মুখ তুলে নিচু স্বরে বলল,’ স্যার আমি কি ভেতরে আসতে পারি?’
চারুর মুখে এতো সুন্দর কথা শুনে ধ্রুব কিংকিতৃব্যবিমূঢ় হয়ে গেল। বিশেষ করে ওকে স্যার বলে সম্বোধন করায় আরো বেশি বিস্মিত হলো।
ধ্রুব কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে চারুর দিকে। চারু মুখে হালকা হাসি এনে বলল,’ স্যার আমাকে কি শাস্তি স্বরূপ এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে?’
ধ্রুব হতবিহ্বল হয়ে সরে দাড়াতেই চারু মুচকি হেঁসে বলল,’ ধন্যবাদ স্যার।’
ধ্রুব বিস্ময় এ হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল চারুর যাওয়ার দিকে।
চারু সবসময় ওর সাথে যেভাবে তর্ক গলায় কথা বলেছে আজ তার মুখে এমন নম্র ভদ্র গলায় কথা শুনে ধ্রুব পুরাই বোকা বনে গেল।
ধ্রুব বাইরে জগিং করতে না গিয়ে চারুর পিছু নিল।
‘ এই দাঁড়াও।’
চারু মাথা নিচু করে দাঁড়াল।
‘ জি স্যার বলেন..’
ধ্রুব থতমত খেয়ে বলল,’ হোয়াটস হ্যাপেন্ড?’
চারু মাথা নিচু করেই বলল,’ কি হবে স্যার?’
‘ তুমি এতো ভদ্র হয়ে গেলে কীভাবে?’ ধ্রুবর চোখেমুখে উপচে পড়ছে বিস্ময়। বিস্ময় এ ধ্রুবর মুখটা হা হয়ে গেছে।
‘ মালিকের সামনে চাকরানি ভদ্রতা বজায় না রাখলে কি চাকরি থাকবে স্যার?’
চারুর কথায় ধ্রুব চোখ মুখ কঠিন করে ফেলল। চারু রাশেদা বেগমের কাছে চলে গেল। এতো ভোরে চলে এসেছে যে এখনো শিখা আন্টি আসেনি। চারু রাশেদা বেগমের কাছে গিয়ে কথা বলল মাথা নিচু করে।
রাশেদা বেগম বললেন,’ কিরে রাগ করেছিস নাকি?’
‘ না না ম্যাডাম আপনার উপর রাগ করব কেন?’
‘ তাইলে বুড়িটাকে দেখতে আসিস না কেন?’
‘চারু কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। এখন এমন অবস্থায় ফেঁসে গেছে চারু ও বলতে পারছে না আপনারাই তো আসার রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। কীভাবে বলবে? ও কী তাদের কিছু বলার সুযোগ দিয়েছিল সেই তো নিজেই দোষী হয়ে গেল ভাবনা টাকে সত্যি ভেবে আসা বন্ধ করে দিয়েছিল।
চারু নিশ্চুপ আছে বলে রাশেদা বেগম আর কিছু বললেন না এই নিয়ে।
চারু দেখতে পেল ওর মতোই একটা মেয়ে এলো। কথায় কথায় জানতে পারলো এই মেয়েটা ওর কাজ করে এখন। চারুর মুখটা কালো হয়ে গেল তাহলে ওকে আবার কেন ডেকে আনল?
শিখা আন্টি ও আসলেন তার সাথে ওর দুইদিন কথা হয়েছিল। সাখা সিঁদুর পরা শিখা আন্টি এসেই ওকে দেখে জড়িয়ে ধরল। চারু দেখল শ্যামলা করে মেয়েটি কেমন জানি করে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। ওর জায়গা ওকে আনা হয়েছে জানে মেয়েটি তাই ওকে দেখে মেয়েটি শঙ্কিত বোধ করছে ভাবছে ওকে চলে যেতে হবে। চারু ভেবেছিল ওকে যেতে হবে কিন্তু ধ্রুব এসে ওই মেয়েটাকে বেতন দিয়ে বিদায় দিল। চারু ভাবতেই পারেনি ওকে আবার কাজে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। ময়না বেগম যেভাবে ওকে বলেছিল সব ঠিক করতে ও ভয়ে ছিল কীভাবে কী করবে?
আজকে রাস্তায় প্রতিজ্ঞা করে এসেছে ধ্রুবর থেকে যত সম্ভব দূরত্ব করবে।
শিখা আন্টি চলে গেল রাশেদা বেগমের কাছে। চারু তাকিয়ে ছিল মেয়েটির দিকে ছলছল চোখে মেয়েটি ওর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে চলে গেল।
চারু মেয়েটির যাওয়ার দিকে অসহায় মুখ চেয়েছিল।
ধ্রুবর কথায় সম্বিত পেল চারু।
‘ যাও আমার জন্য কফি নিয়ে আসো কুইক।’
চমকে উঠল চারু আড়চোখে ধ্রুবর দিকে চেয়ে কিচেনে চলে গেল। ধ্রুবর অর্ডার শুনতে হবে ভেবেই রাগ লাগছিল এই অসভ্য লোকটার সামনে মাথা নিচু করে কাজ করতে হবে ভাবতেই রাগ গা শিরশিরানি করে ওর। কিন্তু ও অসহায় বাসায় থেকে সর্বক্ষণ মায়ের অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করার থেকে এখানে থেকে এই লোকটার অর্ডার শোনা ভালো। এজন্য ও ধ্রুবর সাথে আর ঝগড়া করবে না ভেবেছে যতক্ষণ এই বাসায় থাকে ধ্রুব কে স্যারের মতোই ট্রিট করবে।
চারু একটা নিঃশ্বাস ফেলে কিচেনে এসে কফি করতে লাগল। আরেক চুলায় স্যুপ তৈরী হচ্ছিল রাশেদা বেগমের স্যুপ একটু আগেই বসিয়েছে চারু। শিখা আন্টি এসে দাড়াতেই চারু কফির মগ তার হাতে দিয়ে বলল,’ আন্টি স্যার কে মগ টা দিয়ে আসো।’
শিখা আন্টি নিয়ে চলে গেল। চারু স্যুপ নেড়েচেড়ে নিচ্ছিল।
চারু দেখল বাইরে থেকে দারুণ একটা ধমক ভেসে আসছে। চমকে উঠল চারু। এগিয়ে এসে উঁকি মারতেই দেখল শিখা আন্টি মুখটা গম্ভীর করে কফির মগ নিয়ে ফিরে আসছে। আঁতকে উঠল চারু ওর কফি কী বাজে হয়েছে? ওর জন্য কি আন্টি কে ধমক খেতে হলো খুব অপরাধ বোধ হতে লাগল চারুর ও তো ইচ্ছে করে খারাপ করেনি।
শিখা আন্টি কাছে আসতেই চারু বলল,’ আন্টি কি হয়েছে? কফি কি স্যারের পছন্দ হয়নি? সত্যি আন্টি আমি ইচ্ছে করে খারাপ করিনি কীভাবে হয়ে গেল!’
চারু কথায় শিখা আন্টি গম্ভীর মুখে বললেন,’ কফি কেমন হয়েছে জানি না। এছাড়া স্যার কফি মুখে দিয়ে দেখেই নি ভালো খারাপের পার্থক্য বুঝবে কিভাবে?’
‘ মানে?’ কপাল কুঁচকে নিল চারু।
‘ স্যার তোমার বদলে আমাকে কফি নিয়ে যাওয়ায় রেগে গিয়েছে। সে নাকি তোমায় দিয়েছে বানাতে আমি কেন নিয়ে গিয়েছি বলে রাগ দেখালো।’
শিখা আন্টির কথায় লজ্জা নাক কাটা গেল চারুর। শ য় তা ন টা ওকে দিয়ে সব কাজ করাতে চায়। ওকে কাজ করিয়ে যে মজা পায় তা তো অন্য কাউকে দিয়ে পাবে না এক নম্বরের খ বিশ।
চারু দাঁত কিড়মিড় করে কফির মগ টা নিজের হাতে নিয়ে এগিয়ে এলো। ওকে দেখেই ধ্রুব ঠোঁট বেঁকিয়ে হাসলো। চারুর গাঁ পিত্তি জ্বলে উঠল সেই হাসিতে। কিন্তু নিজের মুখে তা প্রকাশ করতে পারল না। চারু কাছে এসে কফি এগিয়ে দিবে অমনি ধ্রুব চট করেই উঠে দাঁড়াল এবং উঠে নিজের রুমের দিকে হাঁটা ধরল চারু স্তম্ভিত হয়ে ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। এটা কি হলো এভাবে চলে গেল কেন?
চারু ওকে পিছন থেকে ডেকে উঠল,’ স্যার আপনার কফি..!
ধ্রুব গম্ভীর মুখে বলে উঠল,’ নিয়ে আসো।’
চারু বিড়বিড় করল, শ য় তা ন একটা।
চারু রাগী চোখে ধ্রুবর পিছু হাঁটতে লাগল।
#চলবে…?
“প্রেমনেশা”
নন্দিনী নীলা
১৩.
চারু দশ মিনিট ধরে দাঁড়িয়ে আছে। রাগে দাঁত কিড়মিড় করছে কিন্তু রাগ গিলে ওকে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। ও এখন দাঁড়িয়ে আছে ধ্রুবর বেডরুমের দরজার মুখে। ধ্রুব ওকে নিজে পিছু আসতে বলে এই দরজার সামনে আটকে দিয়েছে।
ওকে দরজা পর্যন্ত এনে বলে,’ ওখানে দাঁড়িয়ে থাকো আমি ফ্রেশ হয়ে এসে কফি নেব।’
বলেই খা টা শ টা ওয়াশরুমে চলে গেছে।
চারু বাইরে দাঁড়িয়েও পানির শব্দ পাচ্ছে কতক্ষন এখানে স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে আল্লাহ মালুম।
চারু কফির মগ নিয়ে ভাবছে, আগেই যেহেতু এসব করবে এতো আগে কেন ওকে এখানে এনে দাঁড় করিয়ে রাখল? যত্তসব ওকে হয়রানি করার ইচ্ছা।
চারু বিরক্তিকর চোখে তাকিয়ে আছে বেডরুমের দিকে মোটামুটি পরিষ্কার পরিচ্ছন্নই লাগছে রুমটা। সে কি এখন এখানেই থাকছে? কই আগে তো কখনোই তাকে আসতে দেখতাম না। অনেক দিন হলো চারু এই বাসায় কাজ করছে কখনোই ধ্রুব কে দেখেনি। এখানে এসে থাকা তো দূরে থাক। এখন এখানেই থাকছে দেখা যাচ্ছে। রুমটা দেখেই বুঝা যাচ্ছে এখানেই তার থাকা হচ্ছে। কপালে ভাঁজ পড়ল চারুর হঠাৎ ধ্রুব এখানে থাকা শুরু করল কেন?
ভাবতে ভাবতেই চোখ মুখ কঠিন করে ফেলল।
ও তো ভুলেই গিয়েছিল ধ্রুবর ওর প্রতি রাগ প্রতিশোধ স্পৃহা। লোকটা ওকে জ্বালাতে এখানে পড়ে আছে। কবে এখানে থেকে যাবে আর কবে ও শান্তি পাবে?
ঠান্ডা পানির ঝাপটায় চারু কল্পনা জগত থেকে বেরিয়ে এলো। হতচকিয়ে সামনে তাকাতেই অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। অ স ভ্য লোকটা কেবলি হয়ত গোসল করে বেরিয়েছে। বেরিয়ে এসেই ওকে বিরক্ত করতে নিজের ভেজা চুল নাচিয়ে ওর চোখে মুখে পানি দিচ্ছে।
নাক লাল করে চারু দাঁতে দাঁত চেপে বলল,’ এসব কি হচ্ছে? দূরে যান আমার থেকে ফা ল তু অ স ভ্য।’
ধ্রুব ফোস কে জ্বলে উঠল চারুর কথায়।
‘ এই কি বললে তুমি?’ আঙুল তুলে চেয়াল শক্ত করে বলল ধ্রুব।
‘ কেন কানে কালা নাকি আপনি? একবারে কথা শুনতে বুঝতে পারেন না বুঝি?’ বিদ্রুপ করে বলল চারু।
‘ অসভ্য বললে কাকে তুমি হ্যাঁ? কি অসভ্যতামি করেছি তোমার সাথে?’ রাগে গজগজ করে উঠল ধ্রুব।
ধ্রুবর রাগ দেখে চারু আঁতকে উঠল। তবুও বলল,’ আপনি এমন খালি গায়ে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন কেন? আবার চুলের পানি দিচ্ছেন এসব কি?’
ধ্রুব চারুর হাত মুচড়ে ধরে বলল,’ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কোন কল্পনায় মুশগুল ছিলে?’
থতমত খেল চারু।
ধ্রুব হাত শক্ত করে ধরে আছে চারু বলল,’ হাত ছাড়ুন।’
‘ কেন ছাড়ব? আমি তো অ স ভ্য। অ স ভ্য লোকরা কাউকে ছাড়ে না।’
‘সরি প্লিজ ছাড়ুন ম্যাডাম বা শিখা আন্টি দেখলে কি ভাববে!’ ভয়ে কাঁপছে চারু।
ধ্রুবর সাথে তর্ক ঝগড়াঝাঁটি করে আর বিপদ বাড়াবে না ভেবেছিল তাও হলো না লোকটা এমন ব দ মা ইশ যে যতই শান্তি বজায় রাখতে চাই না কেন? শান্তি তার সামনে সবার আগেই পালিয়ে যায়। চারু ভয়ে কাঁপছে সাথে হাতের মগটাও কাঁপছে এটা পড়ে ভেঙে গেলে কি হবে? এদিকে নগ্ন গায়ে ধ্রুব দাঁড়িয়ে আছে ওর সামনে। হাত ধরে রেখেছে ঠান্ডা হাতে অস্থির লাগছে চারুর।
হাত থেকে মগটা পড়বে পড়বে অবস্থা সেই মুহূর্তে ধ্রুব ওকে ছেড়ে দিল এবং মগটা নিজের হাতে নিয়ে এক চুমুক দিয়ে বলল,’ ওয়াক ছিহ এটা তো শরবত হয়ে গেছে যাও গরম কফি নিয়ে আসো।’
ধ্রুবর কথায় চারু মুখ ফসকে বলে উঠল,’ নিজের দোষে ঠান্ডা করেছেন এবার নিজে করে খান এতো হুকুম জারি না করে।’
বলেই চারু ঠোঁট কামড়ে ধরল ভয়ে। যতই ভাবি লোকটার কোন কাজে কথা বলব না বিনা বাক্যে কাজ করে যাব ততই ও অধৈর্য্য হয়ে যায় কথা বলে উঠে। চারু দেখল ধ্রুব তার টকটকে চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে চোখ দিয়েই আগুনের ফুলকি বের করবে।
চারু তাড়াতাড়ি বলে উঠল,’ সরি আমি এখনি করে আনছি স্যার।’
বলেই চারু মাথা নিচু করে চলে গেল।
ধ্রুব বোকা হয়ে ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। এইমাত্র বলা ওর কথাটা শুনে উত্তর দেবার জন্য তৈরি হচ্ছিল ধ্রুব তখনি চারু ওর রাগ কে ঠান্ডা করে দিল সরি বলে। চারু কে গিরগিটির মতো পাল্টাতে দেখে ধ্রুব নিজেও কনফিউজড হয়ে গেল কোনটা ওর মনের কথা কোনটা বাইরের কথা।
ধ্রুব আলমারি থেকে টিশার্ট বের করে পরে মাথার চুল হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে শুকিয়ে নিল। চারু আর আসছে না দেখে রেগে উঠল কিন্তু তখনি ধ্রুবর কানে একটা জোরে চিৎকার ভেসে এলো চারুর কন্ঠ থেকে এসেছে আর্তনাদ টা। কপাল কুঁচকে নিল ধ্রুব কফি আনতে পাঠিয়েছি ওই মেয়ে কফি না এনে এমন চিৎকার করে উঠল কেন?
ধ্রুব বেডরুম থেকে বেরিয়ে দেখল চারু সিঁড়িতে বসে আছে ওর পায়ের নিচে ভাঙা কফির মগ পড়ে আছে। ফরসা ডান পা লাল টুকটুকে হয়ে আছে। কি হয়েছে কিছুই বুঝতে পারছে না কিন্তু পা দেখে আন্দাজ করতে পারল কি হয়েছে। চারু পায়ে হয়ত গরম কফি ফেলে দিয়েছে যার ধরুণ পায়ের এই অবস্থা।
চারু কফি করে উপরে আসছিল হঠাৎ মাথায় চক্কর দিয়ে উঠে কোমর ব্যথায় ও বৃষ্টিতে ভেজার ফলে জ্বরে ভালোই ভুগান্তিতে পড়েছিল। বিছানা থেকে উঠেই এই বাসায় চলে এসেছে সকালের খাবার ও খায়নি। অসুস্থতা ও দূর্বলতায় চারুর পেশার লো হয়ে চোখমুখ অন্ধকার হয়ে গেছিল হঠাৎ তখন ও সিঁড়িতে ছিল হাত থেকে মগ কাত হয়ে পায়ে পড়ে যায়। আগুন গরম কফি পরেই জ্বলে উঠে পা আর আর্তনাদ করে উঠে চারু। তারপর হাত থেকে মগ পড়ে যায় আর ওভাবেই সিঁড়িতে বসে পড়ে চারু।
চোখের সামনে সব পরিষ্কার হতেই চারু আঁতকে উঠে ভাঙা মগ দেখে। পোড়া পা নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়ল চারু ভাঙা মগ তুলতে। চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি পড়তে লাগল।
ধ্রুব এসে দাঁড়াল ওর পিছনে। চারু ধ্রুব কে দেখে আরো ভয়ে মিইয়ে গেল। যাদের বাসায় কাজ করে তাদের জিনিস নষ্ট করার জন্য ওকে এখন কি শাস্তি পেতে হতে আল্লাহ মালুম।
ধ্রুব এমনিতেই সবসময় সুযোগ খুঁজে কিভাবে ওকে শাস্তি দেওয়া যায়। তার কাজ টা আরো সহজ করে দিল ও।
চারু ভয়ে আতঙ্কে থরথরিয়ে কাঁপছে। ধ্রুব চারু কাছে এসে দাঁড়িয়েছে হতবুদ্ধি চোখে। চারু ভয়ে কাঁপা কন্ঠে বলে উঠল ওকে দেখেই,’ আমাকে ক্ষমা করে দিবেন স্যার আমি ইচ্ছে করে মগ ভাঙিনি। হাত ফসকে পড়ে গিয়েছে।’
ধ্রুব কপাল কুঁচকে তাকাল চারুর দিকে চারুর চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। লজ্জায় লাল হয়ে উঠছে ওর মুখ মন্ডল। চারু চোখ মুছে পোড়া পা নিয়েই উঠে দাঁড়াল এবং উঠে নিচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা ভাঙা মগ তুলতে লাগল। ভয় উত্তেজনায় কাজ করতে গিয়ে চারু আঙুল কেটে ফেলল এবং হাত কেটে গলগলিয়ে রক্ত বের হতে লাগল।
চারু দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথা গিলে ভাঙা মগের টুকরো তুলে উঠে দাঁড়াল। ধ্রুব গম্ভীর গলায় চারু কে ডেকে উঠল। চারু তাড়াতাড়ি কিচেনের দিকে চলে যাচ্ছিল ধ্রুবর ডাকে ওর বুক ধক করে উঠল। ঢোক গিলে দাঁড়িয়ে পড়ল।
‘ তোমার পায়ে কি হয়েছে?’
চারু মিনমিনে গলায় বলল,’ কই কিছু হয়নি তো। আমি এখনি কফি করে আনছি। ভাঙা মগের জন্য আপনি আমার বেতন থেকে টাকা কেটে নিয়েন।’
বলেই চারু কিচেনে চলে গেল। কিচেনে এসেই ফ্রিজ থেকে বরফ বের করে পোড়া পায়ে ঘষতে লাগল। পা জ্বরে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। চারুর ব্যথায় কুঁকড়ে যাচ্ছে।
চারু নিজের সামনে এসে ধ্রুব কে দাঁড়াতে দেখেই আতংকে কেঁপে উঠল।
‘ মিথ্যা বললে কেন?’ গমগম সুরে বলল ধ্রুব। ধ্রুবর কথায় চারু ফেঁসে গেল।
দ্রুত বরফ রেখে উঠে দাঁড়াল। ফরসা পা মিনিটের মধ্যে লাল টকটকে হয়ে উঠেছে। পা ফেলে দাঁড়িয়ে থাকা যাচ্ছে না।
চারু চোখ ভর্তি অশ্রু নিয়ে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে ছিল ধ্রুবর দিকে। ধ্রুব ফট করেই ফ্লোরে হাঁটু ভাঁজ করে বসে পড়ল। চারু চমকে উঠল।
বিস্মিত নয়নে তাকাল নিচের দিকে।
ধ্রুব আঙুল নিয়ে স্পর্শ করল পোড়া জায়গা চারু ব্যথায় আঙু্ল দিয়ে খামচে ধরার চেষ্টা করল ফ্লোর।
ধ্রুব কে হঠাৎ নিজের পায়ের কাছে বসে পরতে দেখে চারু স্তব্ধ। কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। কি বলবে বুঝতে পারছে না।
ধ্রুব চারুর পা দেখে কঠিন সুরে বলল,’ কিছু হয়নি তাহলে পা এতো লাল কেন?’
চারু মুখ স্তব্ধ করে করে দাঁড়িয়ে আছে।
ধ্রুবর চোখমুখ কঠিন হয়ে এলো ওকে মিথ্যা বলায়। চারু ধ্রুবর চোখের দিকে তাকাতেই চমকে উঠল। ধ্রুবকে ভয়াবহ রাগী দেখা যাচ্ছে ওর পা পুড়েছে এতে সে এতো রাগ করছে কেন? চারু ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে বোকা চোখে। তখনি পায়ের ব্যথায় চিৎকার করে উঠল চারু। ধ্রুব ওর পোড়া জায়গা চেপে ধরেছে। ব্যথা জায়গায় এমন আক্রমণ এ চারু হতবুদ্ধি হয়ে গেল। আরো ব্যথায় অসহ্য যন্ত্রণায় চারু আর্তনাদ না করে পারল না।
#চলবে…