প্রেমনেশা পর্ব-১৪+১৫

0
1

“প্রেমনেশা”
নন্দিনী নীলা
১৪.

চারু বিছানায় শুয়ে এক দৃষ্টিতে সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে আছে। ধ্রুবর অত্যাচার দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। এখন চারু তার সাথে মুখ লাগায় না বিনা বাক্যে তার হুকুম জারি শুনে চলে তবুও তার বাড়াবাড়ি কমছে না। চারুর চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে লাগল। ওভাবেই চারু ঘুমিয়ে পড়ল। সকালে উঠে চারু দ্রুত রেডি হয়ে বেরিয়ে ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা ভাত বের করেই গপাগপ খেয়ে বেরিয়ে এলো। হাঁটছে আর পায়ের চটির দিকে তাকিয়ে আছে। আগুন গরম কফি পড়েছিল পায়ের অবস্থা শেষ। জায়গাটা কালো হয়ে উঠেছে। চটির ঘষায় ব্যথা ও লাগছে।
গতকালের কথা চট করেই মনে পড়ে গেল। চারুর পায়ে ধ্রুব আগুল চেপে ধরতেই ও ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠে। তারপর চারু কিছু বলার আগেই ধ্রুব উঠে চলে যায় চারু ওভাবেই দাঁড়িয়ে চোখের পানি ফেলতে লাগে।
ব্যথায় জায়গায় আরও ব্যথা দিয়ে লোকটা কতটা নিষ্ঠুর বারবার প্রমাণ করতে চাইছে ওর কাছে। ধ্রুব চলে যাওয়ার পর চারুর ওভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে। হঠাৎ পায়ে ঠান্ডা কিছু লাগতেই চমকে উঠে চারু দেখে ধ্রুব ফ্লোরে বসে ওর পায়ে মলম লাগিয়ে দিচ্ছে।
ধ্রুবর কাজে চারুর চোখ চড়কগাছ হয়ে যায়।
‘ কি করছেন?’ পা সরিয়ে নিতে চায় চারু ধ্রুব ওর পা টেনে ধরে ধমক দেয়।
‘ নড়াচড়া করলে থাপ্পর খাবে কিন্তু.. আমাকে আমার কাজ করতে দাও।’ ধ্রুবর কথায় হতবুদ্ধি হয়ে তাকিয়ে থাকে চারু।
ধ্রুব মলম লাগিয়ে দিয়ে মলম ওর হাতের মুঠোয় দিয়ে বলে,’ এটা বাসায় নিয়ে যাবে। আর একটু পর পর পায়ে লাগাবে। তাহলে ব্যথা চলে যাবে দাগ‌ ও হবে না।’
চারু বিস্মিত নয়নে ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে থাকে। ধ্রুবর কথা সব ওর মাথায় উপর দিয়ে যেতে থাকে।
‘ আপনি আমার ব্যথা নিয়ে ভাবছেন?’ চারুর ঠোঁটে এক রাশ বিষ্ময় এসে লুটোপুটি খেতে লাগল। ও ঢোক গিলে প্রশ্ন করল।
ধ্রুব বলল,’ নো আমি তোমার ব্যথা নিয়ে ভাবতে যাব কেন? পাগল নাকি?’
‘ সেটাই তো ভাবছি আপনি আমার ব্যথা নিয়ে ভাবছেন কেন? এই মলম টাই বা আমাকে কেন দিলেন?’
‘ হা হা হা তোমাকে নিয়ে ভাবছি না। এতো কেয়ার করার কারণ একটাই, পায়ের ব্যথার অজুহাতে তুমি কাজে ফাঁকি দিতে যাতে না পারো। তোমাদের তো কাজ একটাই সুযোগ পেলেই গায়ে বাতাস লাগাতে শুরু করে দাও।’ ধ্রুবর কথায় রাগে চারুর চোখ মুখ লাল হয়ে উঠে।
ও কখনোই নিজের কাজে অবহেলা ফাঁকি দেওয়ার কথা চিন্তা ও করেনি। ধ্রুব আজ ওকে এমন কথা বলল রাগে হাতের মুঠোয় থাকা মলম ধ্রুবর দিকে ছুঁড়ে মারল। মলম গিয়ে ধ্রুবর বুকে লাগল। চোখ জ্বলে উঠল ধ্রুবর।
চারু নিচু হয়ে নিজের ওরনার কোনা দিয়ে নিজের পায়ের লাগানো মলম মুছে নিল।
তারপর বলল,’ প্রয়োজন নেই এসব জিনিসের। আপনার কোন সিনপ্যাতি আমি চাই না। পোড়া হাত পা নিয়ে কাজ করার অনেক অভিজ্ঞতা আমার আছে।’
বলেই চারু ধ্রুবর সামনে থেকে চলে যায় চোখ মুছতে মুছতে।

চারু ভাবতে ভাবতে চলে এলো। আজকে ধ্রুব বাসায়‌ই আছে। সোফায় বসে আছে পায়ের উপর পা তুলে এই সময়ে তো জগিং এ যায় আজকে যায়নি গেটাপ দেখেই বুঝা যাচ্ছে। চারু মাথা নিচু করে চলে যাচ্ছিল ভেতরের দিকে। আড়চোখে তবুও দৃষ্টি চলে গেল ধ্রুবর দিকে। ধ্রুব গম্ভীর মুখে ওর পায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। চারু তাকাল নিজের পায়ের দিকে। তারপর হনহনিয়ে চলে এলো। ধ্রুব ওমন রেগে বোম হয়ে আমার পায়ের দিকে তাকিয়ে ছিল কেন?
কপাল কুঁচকে ভাবছে চারু।
ধ্রুব গম্ভীর মুখে সেখানেই বসে আছে। চারু ভেতরে থেকে উঁকি মেরে ওর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করল। যে পরিমাণ রেগে আছে আজকে ওর কপালে কি আছে কে জানে!
চারু ধ্রুবর গালের দিকে তাকিয়ে আছে কেমন চোখ শক্ত করে আছে নিশ্চিত কিছু ভাবছে। কি আর ভাববে ওকে কিভাবে কষ্ট দেওয়া যায় সেটাই তো তার একমাত্র ভাবনার বিষয়।
চারু ব্রেকফাস্ট তৈরি করতে শুরু করে দিল। উপরে থেকে শিখা আন্টি এলো খাওয়ার আগে ঔষধ গুলো তাকে খাইয়ে এসেছে। এবার তিনিও চারু সাথে কাজে লেগে পড়ল। রান্না শেষ করে চারু কে পাঠাল রাশেদা বেগম কে নিচে নিয়ে আসতে চারু চলে গেল‌।
চারু দেখল ধ্রুব নিজের জায়গা পরিবর্তন করেছে। সে নিজের রুমে আছে‌ রাশেদা বেগম এর রুম থেকে আসার সময় ধ্রুব কে নিজের রুমে দেখেছে।
চারু রাশেদা বেগম কে ডাইনিং এ বসিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। শিখা আন্টি খাবার ডাইনিং এ এনে সাজিয়ে ফেলেছে ততক্ষণে।
রাশেদা বেগম চারুর দিকে তাকিয়ে বললেন,’ ধ্রুব দাদুভাই কে ডেকে আন।’
চারু মুখটা অসহায় করে ফেলল। তাকাল শিখা আন্টির দিকে তাকে যাওয়ার ইশারা করছে। শিখা আন্টি মুখ ঘুরিয়ে নিল। সেদিন যে ধমক খেয়েছিল তারপর আর ধ্রুবর আশেপাশে যায় না শিখা আন্টি।
চারু শিখা আন্টিকে নড়তে না থেকে মুখটা ফ্যাকাসে করে ফেলল।
শিখা আন্টির মনের অবস্থা চট করেই পড়ে নিল আর মুখটা গম্ভীর করে নিল।
চারু ধ্রুবর রুমের সামনে থম মেরে দাঁড়িয়ে আছে। ধ্রুব বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে কার সাথে যেনো ফোনে কথা বলছে। চারু দরজার সামনে থেকে দুইবার ডেকেছে কিন্তু ধ্রুবর কানে হয়ত কোন কথায় যায়নি। সে এমন ভাবে ফোনে কথা বলছে যেন ফোনের ভেতরেই ঢুকে গেছে। বিরক্তিকর চোখে ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে আছে চারু। কতক্ষন এখানে এভাবে দাড়িয়ে থাকবে?
চারু দরজায় টোকা দিয়ে বলল,’ স্যার শুনছেন? দয়া করে ফোনের কথা রেখে নিচে খেতে আসুন।’
ধ্রুব কে সাড়া দিতে না দেখে চারু দরজায় জোরে জোরে থাপ্পর দিতে লাগল। ধ্রুব ফোন রেখে লাফিয়ে উঠল। এমন ভাবে শব্দ হয়েছে ও ভেবেছে ভূমিকম্প হচ্ছে হয়ত।
চারু কে দরজার সমুক্ষে চোখমুখে লাল করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল।
‘ হেই এসব কি করছো?’
চারু ধ্রুবর কথাকে অবজ্ঞায় ফেলে বলল,’ নিচে খেতে আসুন। আপনার দাদি না খেয়ে আপনার জন্য বসে আছে।’
জোরে কথাটা বলে চারু বিড়বিড় করে বলল, এমন অকৃতজ্ঞ ছেলে জীবনে দেখি নাই অসুস্থ মানুষ না খেয়ে আছে আর তিনি ফোনে মজা মাস্তি করছে।
চারু বিড়বিড় করে কথা বললেও ধ্রুবর কানে সম্পুর্ন কথা চলে গেল।
ধ্রুব এগিয়ে এলো তড়িৎ গতিতে আর চারু কে একহাত টেনে ধরে শক্ত করে চেপে ধরল দরজায় হেলান দিয়ে।
চারু আচমকা টানে খেয়ে থমকে গিয়েছে সাথে পিঠে জোরে বাড়িও খেয়ে দরজায়। দানবের মতো চেপে ধরেছে ধ্রুব। ধ্রুব চোখ চোখ মিলাতে গিয়ে চারু চমকে উঠল।
ঢোক গিলে ফেলল চট করেই ওর কথাটা যে শুনে ফেলেছে বুঝতে বাকি নেই চারুর।
চারুর হাত এতো জোরে খামচে ধরেছে যে চারুর চোখে জল এসে গিয়েছে।
ধ্রুব দাঁতে দাঁত চেপে বলল,’ কি বললে তুমি?’
চারু মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
ধ্রুব ওকে কথা বলতে না দেখে আরো রেগে বোম হয়ে গেল।
‘ তাকাও আমার দিকে।’
চারু তাকাচ্ছে না। ধ্রুবর হাতে আচমকাই এক ফোঁটা জল গড়িয়ে এসে পড়ল কপাল কুঁচকে এলো ধ্রুবর। চারু হাত ছাড়াতে মুচড়ামুচড়ি করছে তখন। ধ্রুব নিচু হয়ে ওর মুখের দিকে উঁকি মারতেই হাতের বাঁধন ছেড়ে দিয়ে সরে দাঁড়াল।
চারু ছাড়া পেয়ে আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা করল না ছুটে সিঁড়ির কাছে চলে এলো দৌড়ে।
ধ্রুবর কি হলো ও নিজেও জানে না। চারুর চোখে জল দেখে কেন ওর কষ্ট হচ্ছিল ও জানে না। চারুর উপর রাগ দেখাতে না পেরে নিজের উপর প্রচন্ড বিরক্ত হলো। রাগে ধ্রুব দেয়ালে ঘুসি মারল জোরে।

শিখা আন্টির বাসা থেকে কল আসায় তিনি দুইটার সময় চলে গেল‌। চারু একাই বাসায় আছে। ব্রেকফাস্ট করে সেই যে ধ্রুব বাসা থেকে বেরিয়েছে আর আসেনি। রাশেদা বেগম নাতি ছাড়া দুপুরে ও খাবে না বলে জেদ ধরেছে।
চারু তার আদ্যিখেতায় আরো রেগে যাচ্ছে কিন্তু নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে রেখেছে দাঁতে দাঁত চেপে।
চারু রাশেদা বেগম কে জোর করিয়েই দুপুরে খাওয়ালো তারপর ঔষধ খাইয়ে ঘুমাতে বলল। তিনি রুমে শুয়ে পরার পর চারু নিজে খেতে বসে। তখনি কলিংবেল বেজে উঠে চারু কিচেনে বসে খাচ্ছিল। আধ খাওয়া প্লেট রেখে চারু বেসিন এ হাত ধুয়ে বেরিয়ে আসে। দরজা খুলতেই চোখ মুখ কুঁচকে আসে চারুর‌। তিনটা ছেলে ও দুইটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কাউকেই তেমন চিনতে পারছে না। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে চারু দরজার মুখে।
তখনি পিছু থেকে ধ্রুব কে আসতে দেখা যায়। ধ্রুব নিজের ফ্রেন্ড দের দাঁড় করিয়ে গাড়ি পার্কিং করতে গিয়েছিল।
ধ্রুব এগিয়ে এসে চারু কে দরজার মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ধমকে উঠে,’ দরজা আটকে দাঁড়িয়ে আছো কেন? আমার ফ্রেন্ডদের ঢুকতে দাও সরো সামনে থেকে।’
চারু চমকে উঠে দরজা থেকে সরে দাঁড়ায়। ধ্রুব নিজের ফ্রেন্ড নিয়ে ভেতরে গিয়ে ড্রয়িংরুমের সোফা আটকে বসে।
চারু দরজা লক করে ফিরে তাকায়। ড্রয়িংরুম পেরিয়ে চারু কিচেনের দিকে যাচ্ছিল তখনি ওর কানে আসে একটা মেয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বিদ্রুপ করে হেঁসে বলছে,’ ধ্রুব এটা সেই অহংকারী মেয়েটা না যাকে তুমি ডেয়ার নিয়ে জড়িয়ে ধরে ছিলি।’
ধ্রুব কিছু বলার আগেই পাশ থেকে একটা ছেলে বলে উঠে,’ আরে এ তো সেই মেয়েটাই। ধ্রুব কে কি চরটাই না মেরেছিল। বেচারা প্রথম বার কোন মেয়ের হাতে ওমন থাপ্পর খেয়েছিল।’
ধ্রুবর চোখমুখ শক্ত হয়ে গেল। চোখ লাল টুকটুকে হয়ে উঠেছে। শুধুমাত্র চারুর জন্য ওকে নিজের ফ্রেন্ডদের সামনে বেইজ্জতি হয়ে হয়েছিল। ধ্রুব কঠিন চোখে তাকাল চারুর দিকে তারপর বলল,’ যাও আমার ফ্রেন্ডদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করো কুইক।’
চারু ওদের কথায় থেমে গিয়েছিল‌। ধ্রুবর কথায় পা চালিয়ে চলে এলো।

#চলবে…

“প্রেমনেশা”
নন্দিনী নীলা
১৫.

চারু অবেলায় আবার রান্না বসালো। ধ্রুবর বলা প্রত্যেকটা পদ আবার রান্না করতে হলো। খুবই বিরক্ত লাগছিল হঠাৎ করেই নিজের ফ্রেন্ড বাসায় এনে ওকে হেনস্থা করায়‌। একটু ভুল ত্রুটি হলেই সবাই মিলে ওকে অপমান অপদস্থ করতে লাগবে তাই খুব সাবধানের রান্না করছিল। ফল কেটে দিয়েছিল। চারু অর্ধেক রান্না রেখে বেরিয়ে দেখল কেউ নেই কিন্তু কমলার খোসা প্লেটে‌। উপরে থেকে কথার আওয়াজ আসছে চারু একপলক ঘাড় উঁচিয়ে উপরে চেয়ে প্লেট নিয়ে কিচেনে চলে এলো। রান্না শেষ করে ক্লান্ত হয়ে বেরিয়ে এলো। ধ্রুব ওকে বলে গিয়েছে রান্না শেষ হলে যেন ডেকে দেয়।
চারু সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে এলো। ধ্রুবর রুমের সামনে দাঁড়িয়ে দেখল সবাই কি নিয়ে যেন হাসাহাসি করছে।
চারু মাথা নিচু করে ডাকল ধ্রবকে স্যার বলে।
ধ্রুব তাকাতেই বলল,’ রান্না শেষ আপনারা খেতে আসুন।’
বলেই চারু চলে যাচ্ছিল ভেতরে থেকে একটা মেয়ে ডেকে উঠল।
‘ এই শোন,
চারু চমকে উঠে দাঁড়াল। এভাবে তুই ডাক শুনে ও বিস্মিত হয়েছে।
পাশ থেকে আরেকটা মেয়ে বলে উঠল,’ তুই তোকানি করছিস কেন?’
মেয়েটা দেমাগি কন্ঠে বলল,’ একটা চাকরানি কে তুই বলব না তো কি আপনি বলে সম্মান দেব? দেখ আমি এমন ছোটো লোক চাকর দের তুই বলেই শান্তি পাই। এদের বেশি আশকাড়া দিলে মাথায় চড়ে বসে।’
চারু চুপ করে মেয়েটার কথা হজম করল। চোখে অজান্তেই পানি চলে আসছিল ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে আজ ওকে চাকরানি হয়ে মানুষের লাথি খেতে হচ্ছে।
চারু মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল কিন্তু মেয়েটা তেমন কিছুই বলল না তাই চলে এলো। চারু ডাইনিং টেবিলে খাবার সাজিয়ে রেখে দাঁড়িয়ে ছিল সবার আসার জন্য।
ধ্রুব সবার আগে এসে বসল। চারু ধ্রব কে দেখেই চলে যাচ্ছিল ধ্রব ওকে ডেকে বলল,’ দাঁড়াও সবাইকে খাবার বেড়ে দিবে কে?’
চারু দাঁড়িয়ে র‌ইল বাকিরা এসে চেয়ার টেনে বসতেই চারু সবাইকে খাবার বেড়ে দিতে লাগল। সেই অহংকারী মেয়েটার চোখেমুখে বিদ্রুপের হাসি ফুটে উঠছিল সবটাই চারু দেখতে পেল। মেয়েটার নাম শাম্মী। পাশের মেয়ের নাম ধরে ডাকায় জানতে পারল চারু। চারু গোস্ত দিচ্ছিল প্লেটে তখন শাম্মী ইচ্ছাকৃতভাবে ওকে ধাক্কা দিয়ে বসে। চারু ধাক্কা খেয়ে গোস্তের ঝোল শাম্মীর গায়ে ফেলে দেয়। আর সেকেন্ডের মধ্যে ডাইনিং টেবিলে ঘূর্ণিঝড় চলে আসে। চারু নিজেও থমকে গিয়েছে ঘটনাটায়। দ্রুত নিজের সুতি ওড়না দিয়ে নিচে হয়ে ঝোল মুছতে লাগে আর মুখে অনবরত সরি বলতে লাগে।
‘ সরি ম্যাডাম আমি ইচ্ছে করে ফেলি নাই। আপনি হঠাৎ করেই…’
চারু কথা শেষ করতে পারল না। বজ্র কন্ঠে চিৎকার করে উঠল শাম্মী। ওর চিৎকার এ চারু ভয়ে ভীত হয়ে গেল। শাম্মী চারু কে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে লাফিয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে। চারু কিছু বলতে যাবে শাম্মী রেগে আগুন হয়ে হাত উঁচু করে থাপ্পড় মারতে উদ্যত হয়। চারু ভয়ে আঁতকে উঠে কিন্তু যেটা ও করেই নি শাম্মী ইচ্ছাকৃতভাবে ওকে ধাক্কা দিয়ে এমন বাজে পরিস্থিতি তৈরি করেছে সেটার দায়ভার ও কিছুতেই নিবে না। চারু চট করেই শাম্মীর থাপ্পর মারতে আসা হাত ধরে নেয়।
আর বলে উঠে,’ ম্যাডাম আমি কিছুই করিনি। আপনি আমাকে ধাক্কা দিয়েছেন। এখানে আমার তো কোন দোষ নেই।’

চারুর কথায় চোখ জ্বলে উঠে শাম্মীর। ও ইচ্ছা করেই ধাক্কা দিয়েছে ঠিক কিন্তু সেটা ও সবার সামনে স্বীকার করবে ইম্পসিবল ও তো এসব করেছে সবার সামনে চারু কে ইচ্ছেমত অপমান করতে। নিজের দোষ সম্পূর্ণ অস্বীকার করে শাম্মী চেঁচিয়ে উঠল,’ তোর এতো বড়ো সাহস নিজে ভুল করে আমাকে বলছিস আমি করেছি? তোর কি মনে হয় আমি ইচ্ছে করেই নিজের গায়ে ঝোল ফেলেছি?’
‘ হ্যাঁ আপনি নিজেই ফেলেছেন।’
শাম্মী কাঁদো কাঁদো মুখ করে তাকাল ধ্রুবর দিকে তারপর বলল,’ ধ্রুব দেখছিস তোর বাসায় সামান্য একটা মেড আমাকে কিভাবে অপমান করছে। ও আমার উপর ইচ্ছে করে ঝোল ফেলেছে ধ্রুব ওকে তখন আমি কথা শুনিয়ে ছিলাম না তাই জন্য। এখন আবার বলছে আমি নাকি নিজে এসব করেছি কত বড়ো লায়ার এই মেয়ে।’
ধ্রুব হতবুদ্ধি হয়ে তাকিয়ে ছিল দু’জনের দিকে আচমকা এমন ঘটনায় ও সহ টেবিলের সবাই হতবাক হয়ে গেছে।
রাহুল বলল,’ দুই পয়সার একটা মেড হয়ে আমাদের ফ্রেন্ড কে অপমান করছে একে তো..’
রাহুল উঠে এসে চারু কে কিছু বলবে ধ্রুব ওকে টেনে ধরে বলে,” তুই বস আমি দেখছি ওর ব্যাপার। শাম্মী তুই ওয়াশরুম থেকে ক্লিন হয়ে আয় যা।’
শাম্মী আবার ন্যাকামি কন্ঠে বলে উঠল,’ ধ্রুব ওকে ছাড়বি না কিন্তু ও আমার এই অবস্থা করেছে। ওকে এর জন্য কঠিন শাস্তি দিবি।’
‘ অবশ্যই শাস্তি তো ও পাবেই। আমার ফ্রেন্ডের সাথে লাগতে গিয়ে কতবড় ভুল করেছে একটু পরেই টের পাবে।’
শাম্মী শয়তানি হাসি দিয়ে‌ চলে গেল।
চারু ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে বলল,’ আপনি আমার কথাটা শুনুন আমি কিছুই করিনি।’
ধ্রুব চারুর হাত শক্ত করে চেপে ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগে পেছনে নিজের ফ্রেন্ডদের বলে,’ তোরা খা আমি আসছি।’
চারুকে টেনেহিঁচড়ে কোথায় জানি নিয়ে যেতে লাগে। ধ্রুব কাজে বিস্ময় এ হতবিহ্বল হয়ে যায় চারু। চারু নিজের হাত ছাড়ানোর জন্য মুচড়ামুচড়ি করতে লাগে আর মুখে বলতে লাগে,’ কি হয়েছে? আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? কি হলো হাত ছাড়ুন প্লিজ।’
ধ্রুব ওর কোন কথার উত্তর দিচ্ছে না ওকে টেনেহিঁচড়ে স্টোর রুমে নিয়ে গেল তারপর ধ্রুব চারু কে ধাক্কা দিয়ে ময়লা আবর্জনা যুক্ত রুমটায় ফেলে দিল। চারু ভেতরে গিয়েই ফ্লোরে আঁচড়ে পড়ল।

মাথা তুলে‌ চারপাশে চেয়ে বুঝতে পারল ফেলনা সব আসবাবপত্র কাগজপাতি এই রুমে জায়গা নিয়েছে। ফ্লোরে পড়েই চারু নিজের হাতের তালুতে ময়লার স্তূপ টের পেল।
‘ তোর বাড়াবাড়ির শাস্তি একটাই এই রুমে আজ তোর বাসস্থান হবে।’
‘ কি সব বলছেন? আপনার মাথাটা কি একেবারে খারাপ হয়ে গেছে? এই রুমে কোন মানুষ থাকতে পারবে? দেখুন পাগলামি বাদ দিন আমাকে বের হতে দিন।’ বিস্মিত কন্ঠে বলেই চারু লাফ দিয়ে ফ্লোরে থেকে উঠে দাঁড়াল।
ধ্রুব বলল,’ তোমাকে আমি মানুষ মনেই করি না। তুমি এলিয়েন তুমি এখানে অনায়াসে থাকতে পারবে।’
‘ দেখুন ফাজলামি করবেন না। আমাকে বের হতে দিন।’
বলেই চারু বের হতেই ধস্তাধস্তি শুরু করে দিল। ধ্রুবর শক্তির সাথে পেরে‌ উঠল না। ধ্রুব বলল,’ আজকে তোমাকে এখানেই থাকতে হবে এটাই ফাইনাল।’
বলেই চারুর মুখের উপর দড়াম করে দরজা আটকে দিল। দরজা আটকে দিতেই রুমটা অন্ধকারে ঢেকে গেল। চারু হতভম্ব হয়ে সেখানেই পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে র‌ইল। ও বিলিভ করতে পারছে না একটা সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ ওকে এমন জায়গায় বন্দি করে গেল। ও কি স্বপ্ন দেখছে? এটা স্বপ্ন হবে হয়ত। তখনি মশার কামড়ে লাফিয়ে উঠল চারু আর ওর সমস্ত স্বপ্ন ভেঙে গেল এ তো স্বপ্ন না। এতো ভয়ংকর বাস্তব।
চারু অবস্থা অন্ধকারে হেঁটে রুমের লাইট জ্বালিয়ে নিল। যেখানেই পা রাখছে যেখানে থেকেই ময়লা উড়ে ওর নাকেমুখে লাগছে হাঁচি আসছে। চারু ওড়না দিয়ে নাক মুখ ঢেকে দাঁড়িয়ে আছে। কত সময় এই শাস্তি চলছে আল্লাহ মালুম।
চারু দরজা একটু পর পর ধাক্কা দিচ্ছে কিন্তু কোন সাড়া শব্দ নেই। মনে হচ্ছে ও আলাদা একটা রাজ্যে ঢুকে এসেছে এখানে ও ছাড়া আর কেউ নেই।

শাম্মী এসে দেখল ধ্রুব নাই টেবিলে ও চেয়ার টেনে বসে বলল,’ ধ্রুব ক‌ই?’
রাহুল বলল,’ ভেতরে গেল।’
‘ কেন?’
‘ জানি না‌।’
শাম্মী বসে ভেতরে উঁকিঝুঁকি মারছিল তখনই ধ্রুব এগিয়ে এসে জয়েন করলো ওদের সাথে। ধ্রুব কে দেখেই শাম্মী বলল,’ ক‌ই গিয়েছিলি? ওই মেয়েটা ক‌ই গেল?’
চারু কে এদিক ওদিক খোঁজে বলল শাম্মী।
ধ্রুব বলল,’ তোর সাথে মিসবিহেভ করার শাস্তি ভোগ করছে এখন সে। তুই খা।’
শাম্মী অবাক কন্ঠে বলল,’ কি করছিস তুই?’
‘ চুপচাপ খা তো।’
ধ্রুব কথা এড়িয়ে গিয়ে বলল। এদিকে শাম্মী জানার জন্য হাঁসফাঁস করতে লেগে গেল। ধ্রুব তবুও বলল না খালি কুটিল হাঁসি দিতে লাগল।
চারু বলল কে আজকে উচিত শিক্ষা দিতে পারবে ভেবেই মনে শান্তি অনুভব করছে। অনেক জ্বালিয়েছে আজকে তার জন্য আফসোস করবে। ধ্রুব খাচ্ছিল আর এসব নিয়েই ভাবছিল।
খাওয়া-দাওয়া শেষ করে ওরা রেস্ট করে নিল। রাহুল বলল,’ যাই বলিস মেয়েটার হাতের রান্না কিন্তু ফাটাফাটি।’
শাম্মী ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল,’ হয়েছে ওই মেয়ের গুনগান আমার সামনে গাইবি না‌।’
সবাই থেমে গেল‌। ধ্রুব কে নিয়ে সবাই সন্ধ্যার দিকে বেরিয়ে এলো। এখন ওরা ক্লাবে যাবে সবাই এজন্য। ধ্রুব যেতে চাইছিল না কিন্তু সবাই ওকে জোর করেই নিয়ে গেল। ধ্রুব ক্লাবে গিয়ে চারুর কথা একজন বেমালুম ভুলে গেল।
#চলবে…….?