প্রেমনেশা পর্ব-১৮+১৯

0
1

“প্রেমনেশা”
নন্দিনী নীলা
১৮.

চারু পালিয়ে যাওয়াটা সহজ মনে করেছিল কিন্তু এটা যে এতো কঠিন কাজ ও বুঝতে পারেনি। রাত পোহালেই বিয়ে একথা মনে পড়লেই চারুর দুনিয়ার অন্ধকার হয়ে আসে। চারু রাত বারোটায় সময় বিছানায় বসে আছে‌ চিন্তিত মুখে। কাল এই বাসায় থাকলে ও কোন ভাবেই বিয়ে আটকাতে পারবে না। আর আজ পালিয়ে গেলে এই বাড়িতে আর কোনদিন প্রবেশ করতে পারবে না। আজকে এই বাড়িতে ওর শেষ দিন হবে। এই ঘটনায় পর মা আর ওকে বাসায় ঢুকতে দিবে না এমনকি ওর সাথে কোন প্রকার সম্পর্ক ও রাখবে না। এমনিতেই ওকে সহ্য করতে পারে না এসব করলে ওর মুখ ও দেখবে না। চোখটা ছল ছল করে উঠল চারুর।
চারুকে তারা আপন নাই ভাবতে পারে কিন্তু ময়না বেগমের কাছেই ছোটো থেকে বড়ো হয়েছে তাকে নিজের আপন মায়ের মতোই ভালোবাসে। সিঁথি কে খুব ভালোবাসে কিন্তু ওরা ওকে কখনোই ভালোবাসেনি আপন করতে পারেনি‌ আফসোস।
চারু চোখ হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুছে নিল তারপর উঠে দাঁড়াল। বাসা থেকে পালাতেই হবে। মায়ার টান আর ভয়ের কারণে কোনদিন এই সাহস করে উঠতে পারেনি। কিন্তু আজকে ধৈর্য্য বাঁধ ভেঙে গিয়েছে। আর মায়ের কথায় নিজের সর্বনাশ করতে পারব না আমি।

চারু নিজের ছোটো জামাকাপড়ের ব্যাগ বের করে নিজের পোশাক ঢুকিয়ে নিল। বাবার একটা ছবি ছিল দেয়ালে টাঙানো চারু সেটা ব্যাগে ঢুকিয়ে নিল। তারপর ওরনা দিয়েই মুখ ঢেকে হিজাবের মতো বেঁধে নিল। এখন অপেক্ষা করতেছে কীভাবে বাসা থেকে বের হ‌ওয়া যায়। চারু আস্তেধীরে দরজার লক খুলে বাইরে উঁকি মারল সম্পূর্ণ অন্ধকার এই মুহূর্তে কেউ জেগে নেই চারুর হাঁটু কাঁপছে ভয়ে। বারংবার গলা শুকিয়ে আসছে। বাসা থেকে পালানোর মতো কঠিন কাজ করতে ওর মতো ভীতু মেয়ে লেগেছে অবাক হচ্ছে নিজেই। কিন্তু ধৈর্য্য যখন সীমা অতিক্রম করে ফেলে তখন এমন সাহস আপনাআপনি নিজের মধ্যে চলে আসে। চারু কাঁপা হাতে ব্যাগ তুলে দরজা খুলে বেরিয়ে এলো।

অনেক সাবধানে মেইন দরজা খুলে চারু বারান্দায় পা রাখল। ভয়ে চারুর নাক মুখ ঘামছে। বুক ধরপর করছে। চারু বারান্দায় থেকে উঠানে পা রেখে গেইট পেরিয়ে রাস্তায় যাবার জন্য পা বাড়াবে তখনি ওর কপাল কুঁচকে আসে। ভয়ে চারুর হাত থেকে ব্যাগ নিচে পরে যায়। চারু নিজেও লাফ দিয়ে মাটিতে বসে পড়েছে। কারণ বাইরে গেইটের সামনে একটা ছায়া দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। যা দেখে চারু ভয়ে কাঁপছে। এতো রাতে ওদের বাড়ির সামনে কে দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকার এর কারণে লোকটার মুখ দেখা যাচ্ছে না। এমনিতেই নিজের বাড়ি থেকে চোরের মতো পালানোর চেষ্টা করছে তখন এই ভাবে কারো সামনে পড়ে যাওয়ায় চারুর তো মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার দশা। তার উপর একি আদো মানুষ? এই এতো রাত এটা অন্য কিছু নয়তো‌। চারু মাটিতে মাথা নিচু করে বসে থরথরিয়ে কাঁপছে। ভয়ে ওর হার্টবিট বেড়ে গিয়েছে। কি এক বিপদে ফেঁসে গেল। ও এখন পালাবে কিভাবে? পালাতে না পারলে ওর সাথে সর্বনাশ ঘটে যাবে। চারু মাথা একটু তুলে আবার দেখার চেষ্টা করে দেখল ছায়ার মতো লোকটা ওদের গেইটের উপর দিয়ে আসার চেষ্টা করছে। চারু এবার বুঝে গেল এটা ভূত প্রেতাত্মা নয় কারণ ভূত হলে বাসায় ঢুকতে এতো কষ্ট করতে হতো না। আচ্ছা এটা চোর নয়তো? ওদের বাসায় হয়তো চুরি করতে এসেছে কারণ কাল‌ ওর বিয়ে প্রায় মহল্লার সবাই জানে। বড়োলোক ঘরের ছেলে এটাও জানে আজকে অনেক শপিং করে এসেছে এসব দেখে হয়তো চোর এসেছে নিজের আখের গোছাতে। চারু নিশ্চিত হয়ে গেল এটা চোর। চোর বুঝতেই রেগে গেল চোর কে কোনভাবেই সফল হতে দিবে না ও থাকতে। এই চোর তাড়িয়েই ও পালাবে পরিকল্পনা করে নিল। চারু বসেই একটু একটু করে নিজেদের লাঠি রাখা আছে যেখানে সেদিকে যেতে লাগল।
বাইরে ওদের মাটির চুলা আছে এজন্য মা কিছু প্রয়োজনীয় জিনিষ রাখে চুলায় আগুন দিতে। চারু সেখানে থেকে একটা লাঠি নিয়ে উঠে দাঁড়াল। এদিকে অগত্যা লোকটা গেইট টপকে ভেতরে এসেই বারান্দায় উঠে যেতে লাগল। চারু খুব সাবধানে পেছনে থেকে বেরিয়ে লোকটার পিঠ বরাবর লাঠির আঘাত করে বলল,’ চোরের বাচ্চা চোর। তোর এতো সাহস তুই আমার বাড়িতে চুরি করতে আসছিস? আজকে তোর একদিন কি আমার যতদিন লাগে।’
সামনের লোকটা আচমকা আঘাতে হতভম্ব হয়ে গিয়েছে। মুখে বিরক্তিকর কন্ঠে বলেন উঠেছে,’ হোয়াট দ্যা..’
চারু আরেকটা লাঠির আঘাত করে বসল তৎক্ষণাৎ। এবার সামনে লোকটা আর্তনাদ করে বলল,’ আরে আমি চোর না।’
একটু জোরেই বলল ধ্রুব। চারুর হাত থেমে গেল কারণ কন্ঠটা ও চিনে ফেলেছে। ধ্রুব পিছু ঘুরে বলল,’ তুমি এই মধ্যরাত কি চোর বলে আমায় পেটাতে বসে ছিলে জেগে?’
চারু লাঠি নিচে নামিয়ে রেখে বলল,’ আজব আমি কীভাবে জানব? আপনি এতো বড়ো ঘরের সন্তান হয়েও আমাদের মতো গরীব বাড়িতে চুরি করতে আসবেন?’
চারুর কথায় ক্ষেপে উঠল ধ্রুব,’ কি বলছো তুমি আমি তোমার বাড়িতে চুরি করতে এসেছি?’
‘ অবশ্যই। এই টাইমে চুরি ছাড়া আর কোন কাজেই বা আপনি আসবেন? ছি ছি ছি মানসম্মান আর কিছুই রাখলেন না শেষে কিনা আপনাকে চুরি করতে এসে এভাবে হাতে নাতে ধরা খেতে হলো! কয় টাকার জিনিস ই বা ছিল আমার বাড়ি? এই কয়টা জিনিসের লোভ সামলাতে পারলেন না? যেই দেখলেন আমার বড়ো বাড়িতে বিয়ে হচ্ছে একগাদা শপিং করেছি ছেলে আমায় হাজার টাকা দিয়েছে। রাত গভীর হতেই চলে এলেন। আমার নিজের ই খুব লজ্জা লাগছে আপনার এই পরিস্থিতি দেখে।’
ধ্রুব আচমকাই চারুর কোমর জড়িয়ে ধরল। চারুর মুখে বিদ্রুপ হাঁসি ছিল সঙ্গে সঙ্গে তা থেকে চোখেমুখে আতংক এসে ভীড় করল কিন্তু দুজনের কেউ ই দুজনের মুখভঙ্গি আম্যাবসার এই রাতে তা খেয়াল করতে পারল না।
চারু মুচড়ামুচড়ি করতে করতে বলল,’ কি করছেন অসভ্য ছাড়ুন আমায়।’
ধ্রুব ছাড়ার বদলে আরো শক্ত করে নিজের সাথে চেপে ধরে নিল। চারু ছটফট করছে ছাড়া পাওয়ার জন্য। ধ্রুব অন্ধকারেই চারুর কানের কাছে মুখটা নিয়ে ফিসফিস করে বলল,’ ঠিকি বলেছ আমি চুরি করতেই এসেছি।’
চারু বিস্মিত কন্ঠে বলল,’ খুব দামী মূল্যবান জিনিস তো এই ছোটো বাসায় নেই আমার জানামতে। আপনার এই বাসায় কি প্রয়োজন পড়ল?’
ধ্রুব চারুর কোমর থেকে এক হাত তুলে ওর ঘাড়ের নিয়ে চেপে ধরল চারু চমকে উঠল। ধ্রুব গিঁট দেওয়া ওরনা খুলে নিতেই চারুর মুখ ঢাকা কাপড় খুলে গেল। চারু চমকে উঠল।
‘ এই বাসাটা ছোটো হলেও চারু আমার একটা দামী মহামূল্যবান সম্পদ এইবাসায় আছে। সেটা নিতেই এমন চোরের মতো লোহার শিকল টপকে ভেতরে এসেছি। তুমি একটা জিনিস দেখে হাসবে আমি কিন্তু ওই লোহা টপকাতে গিয়ে প্যান্ট ছিঁড়ে ফেলেছি।’
‘ ছিহ..’ চারু মুখটা বিকৃতি করে ফেলল।
ধ্রুব ওর কথা শুনে হো হো করে হেঁসে উঠল। চারু ওর বুকে ধাক্কা মেরে নিজের থেকে সরাতে চাইছে কিন্তু ধ্রুব ওকে ছাড়ছে না জোর করেই বুকের সাথে চেপে রেখে বলল,’ চারু আমার দামী জিনিস টা কি জানবে না?’
চারু বলল,’ না আমি কিছুই জানতে চাই না ছাড়ুন আমায়।’
ধ্রুব বলল,’ ওইদিনের বিহেভিয়ার জন্য আমি সরি।’
‘ কোনদিনের জন্য?’ কপাল কুঁচকে বলল চারু।
ধ্রুব কিছু বলতে নিবে ভেতরে থেকে ময়না বেগমের চিৎকার ভেসে এলো,’ কে রে বাইরে কে কথা বলে..?’
চারুর ঢোক গিলে উঠল। এবার ও কি পালাতে ব্যর্থ হবে এই শ য় তা ন টার জন্য ও এবার ও পালাতে পারবে না। রাগে চারু ধ্রুবকে ছাড়িয়ে বলল,’ ছাড়ুন আমায়।’
ধ্রুব ভেতরের আওয়াজ পেয়ে বাঁধন আলগা করে দিয়েছিল চারু নিজেকে ছাড়িয়ে ব্যাগ উঠানে ফেলেই দৌড় দিল গেইটের দিকে। আজকে ময়না বেগম দরজায় তালা দিয়ে রেখেছে ও তাই চাবি আগেই নিজের কাছে রেখেছিল তাড়াতাড়ি চাবি দিয়ে তালা খুলে বাইরে দৌড় লাগায়।
ধ্রুব হতবুদ্ধি চোখে চারুর দৌড়ানো দেখে। ওর পায়ের কাছে চারুর ফেলে যাওয়া ব্যাগ পড়ে আছে। ধ্রুবর কানে দরজার খোলার শব্দ হচ্ছে।
#চলবে….

প্রেমনেশা
নন্দিনী নীলা

১৯.

চারু দৌড়ে কোথায় যাবে কোনদিকে যাবে বুঝতে পারছে না। ভয়ে ওর শরীর ঘামছে। মোড়ের মাথায় চারু দেখল ধ্রুবর গাড়ি পার্কিং করা। চারু ঢোক গিলে গাড়ি ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ভয়ে ওর হার্টবিট ফার্স্ট হয়ে গিয়েছে। চারু দেখল দূরে থেকে ময়না বেগমের আওয়াজ ভেসে আসছে। তিনি টচ লাইট জ্বালিয়ে এদিকে আসছে। ভয়ে চারু কাঁপছে। পাশেই হেঁটে আসছে ধ্রুব। ধ্রুব নিশ্চিত ওর কথা বলে দিয়েছে। চারু কোন দিকে যাবে এখন? কারের পাশে লুকিয়ে ভয়ার্ত চোখে ময়না বেগম রেগে এগিয়ে আসতে দেখা যাচ্ছে। হঠাৎ মাঝরাস্তায় ময়না বেগম নিজের পা জোড়া থামিয়ে দিল। চারু নিঃশ্বাস আটকে তাকিয়ে ছিল এই ঘটনায় চমকে উঠল।
দূরে থেকে ধ্রুব আর ময়না বেগমের কোন কথাই স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে না কিন্তু দুজনে কিছু বলাবলি করছে দেখা যাচ্ছে। ময়না বেগম হঠাৎ পিছনে ঘুরে হাঁটা ধরল। চারু বিস্মিত চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
ফিরে যাওয়ার কারণ কি? ধ্রুব নিজেও তার পিছনে গেল।
দুজনেই দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল। চারু উঠে দাঁড়িয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। গাড়িতে হেলান দিয়ে শান্তি অনুভব করছিল। ভয়ে এতোক্ষণ ওর আত্মার পানি শুকিয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ নিজের হাত খালি বুঝতেই চমকে উঠল।
‘ একি ও তো নিজের প্রয়োজনীয় ব্যাগটাই ফেলে এসেছে এখন কি হবে?’
চারুর সব রাগ গিয়ে পড়ল ধ্রুবর উপর লোকটার জন্য এই আকাম হয়েছে। লোকটা যদি ওভাবে বাসায় না ঢুকতো ও কিছুই গন্ডগোল করতো না‌। মা ও জানতেই পারত না সকালের আগে ও পালানোর চেষ্টা করেছে। লোকটা সব সময়ই ওর কাজে ঝামেলা সৃষ্টি করে লোকটার কি আর কোন কাজ নেই সব সময় ওর শান্তিতে বেগড়া দিয়ে শান্তি পায়।
চারু এখন কি করবে একটা টাকাও তো সাথে নেই। ও এখন কোথায় যাবে? পায়ে হেঁটে বা কতদূর পালাবে? রাগে দুঃখে এখন চারুর কান্না পাচ্ছে। টপটপ করে ওর চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরছিল তখন‌। কোনভাবেই নিজের কান্না থামাতে পারছিল না। এতো রাগ দুঃখ হচ্ছিল ও কাউকে বুঝাতে পারবে না। আর ওর কষ্ট বুঝার জন্য কেউ নেই ও।
নিজেকে এতো বেশি অসহায় লাগছিল।

এদিকে ময়না বেগম কে ধ্রুব বলছে,’ আন্টি এখন এই ভাবে ঘুরে আপনি চারু কে কীভাবে পাবেন? সকাল হতে দিন আর তখনো না পেলে পুলিশের কাছে যাবেন। এখন বাসায় গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন।’
ধ্রুব এসব বলে ময়না বেগম কে শান্ত করতে চাইছিল কিন্তু তিনি শান্ত হবেন না এতো সহজে।
তিনি বললেন,’ না আমি এই অবস্থায় ঘুমাব কীভাবে তুমি বলো। কত বড়ো সেয়ানা ভাবো পালিয়ে গেল? এতো সাহস তো ওর হতে পারে না। এই সাহস ওকে কে জোগাচ্ছে আমি সব বুঝে গেছি।’
ধ্রুব কপাল কুঁচকে বলল,’ কি বুঝতে পেরেছেন আন্টি?’
‘ এই বুদ্ধি ওর নাগরের হবে। এতো দূর। ওকে একবার হাতের নাগালে পাই মজা বুঝাবো।’
ময়না বেগম গেইট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই ধ্রুব কপাল চুলকাতে লাগল। কারণ খানিক দূরে সরিয়ে লুকিয়ে রেখেছে চারুর ব্যাগ‌। তার নজরে না পরলেই হয়।
‘ আপনি এতো রাতে খোঁজে কোথায় বা পাবেন চারু কে। সকাল হবার অপেক্ষায় থাকতেই হবে।’ ঢোক গিলে বলল ধ্রুব।
ময়না বেগম ভেতরে চলে যাচ্ছিল তখনি বলল,’ আচ্ছা তুমি এতো রাতে এদিকে কোথায় এসেছিলে?’
ধ্রুব থতমত খেয়ে গেল মিথ্যা গল্প সাজিয়ে বলল,’আসলে ওই পাশেই আমার এক ফ্রেন্ড থাকে ওর সাথেই ছিলাম থাকার কথা ছিল কিন্তু বাসা থেকে চাপ দেওয়ায় চলে যাচ্ছিলাম।’
ময়না বেগম ওহ আচ্ছা বলে চলেই যাচ্ছিল তা দেখে ধ্রুব হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো এমন করে একটা নিঃশ্বাস নিল। ধ্রুব এগিয়ে গিয়ে চারুর ফেলে যাওয়া ব্যাগ বের করতেই ময়না বেগম দৌড়ে এসে বললেন,’ আরে আরে এটা কি?’
ফেরত আসা ময়না বেগমের দিকে তাকালো ধ্রুব চমকানো চোখে। আমতা আমতা করতে লাগল ধ্রুব‌। ময়না বেগম টেনে ব্যাগ নিয়ে চেইন খুলতেই চিৎকার করে উঠল।
‘ আরে এটা তো চারুর ফেলে যাওয়া ব্যাগ। তার মানে ও পালাতে পারবে না। ওকে ফিরে আসতেই হবে। ওর ব্যাগ এখন আমার হাতে কব্জা। বলেই শয়তানি হাসি দিতে লাগল ময়না বেগম। আর পাশেই ধ্রুব বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে র‌ইল। ময়না বেগম অবাক হয়ে তাকাল ধ্রুবর দিকে তারপর বললেন,’ তুমি এটা কিভাবে পেলে?’
ধ্রুব বলল,’ আসলে আন্টি আমি লাইট জ্বালিয়ে দেখছিলাম হঠাৎ ওটা চোখে পড়ে গেল।’
ময়না বেগম চারুর ব্যাগ নিয়ে ভেতরে চলে গেল। ধ্রুবর মুখটা কালো করে বেরিয়ে এলো। ও ভেবেছিল ব্যাগটা নিজের সাথে করে নিয়ে যাবে কিন্তু ময়না বেগম এতো চালাক ও ভাবতেই পারেনি।

সিঁথি চিৎকার চেঁচামেচিতে উঠে বসে ছিল‌। তাকে ভয়ঙ্কর ভাবে রুমে ঢুকতে দেখে বলল,’ কি হয়েছে আম্মু এতো হ‌ইচ‌ই কেন?’
‘ বাসাটা কেউ উঠিয়ে নিয়ে গেলেও তো তোর আক্কেল হবে না। বাইরে আমি চিন্তায় দৌড়াদৌড়ি করলাম আর তুই মরার মতো বিছানায় পরে র‌ইল। কি রে তুই।’
মাকে এতো চুটপাট করতে দেখে সিঁথি চমকে উঠল।
‘ কি হয়েছে আম্মু? তুমি এই এতো রাতে রেগে গেলে কেন? আর তোমার হাতে ওটা কি কার ব্যাগ? ব্যাগ নিয়ে কোথা থেকে এলে?’
ময়না বেগম মেয়ের মাথায় গাট্টা বললেন,’ আমার পেট থেকে বেরিয়েছে একটা বেকুব।’
মায়ের বিরক্ত দেখে চিন্তায় পড়ে গেল সিঁথি হঠাৎ মায়ের হলো কি? ও নখ কাটতে কাটতে ভাবছে।
ময়না বেগম নিজের থেকেই বললেন,’ চারু পালিয়েছে।’
মায়ের কথায় ঝটকা লাগল সিঁথির।
‘ কিহ?’
মৃদু চিৎকার করে উঠল সিঁথি।
‘ হুম আরো মরার মতো ঘুমা কতো বললাম ওর সাথে ঘুমা। শুনলি না তো..’
‘ আমি বিলিভ করতে পারছি না আম্মু। আমি কি স্বপ্ন দেখছি? তুমি কি সত্যি বলছো? চারুর মতো ভীতু মেয়ে ও পালিয়ে গেছে এটাও বিশ্বাসযোগ্য?’
সিঁথি যেন আকাশ থেকে পড়ল। চারু কখনোই পালানোর সাহস করতে পারে ওরা কল্পনা ও করেনি।

চারু উদ্দেশ্য হীন ভাবে হাঁটছিল। ভয়ের চুটে ও জুতো ও ফেলে এসেছে। এখন পাকা সড়ক দিয়ে হাঁটতে খারাপ লাগছে। রাতে এই শুনশান রাস্তায় হাঁটতে ও ভয় লাগছে। কোথায় যাবে এখন সেই নিয়েই চিন্তিত। নিজের নানা বাড়ির কথা স্মরণ হলো‌। বাবার দ্বিতীয় বিয়ের পর তারা বাবার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। চারু কে নিজের সাথে নিতে চেয়েছিল চারু যায়নি এজন্য তারা আর ওর খোঁজ নেয়নি। চোখ জোড়া ছলছল করে উঠল চারুর। হঠাৎ নিজের পেছনে গাড়ির হর্ন শুনে লাফিয়ে উঠল চারু। পিছনে ঘুরে তাকাতেই কপাল কুঁচকে নিল ও তো সাইডেই আছে তাহলে এমন হর্ন বাজিয়ে ওকে জ্বালাতে আসছে কেন?
চারু অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল তখনি গাড়ির লাইট অফ হয়ে যায় আর গাড়ি থেকে ধ্রুব নেমে দাঁড়াল। ধ্রুব কে দেখেই চারুর মাথায় রক্ত উঠে গেল‌। দপ করে চোখ জোড়ার জ্বলে উঠল তীব্র রাগে। আক্রোশ কোন ভাবেই নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারলনা‌‌। কটমট করে তাকিয়ে রইল ধ্রুবর দিকে।
ধ্রুব ওকে কারের কাছে লুকিয়ে থাকতে দেখে অনেক কষ্টে ময়না বেগম কে ফেরত নিয়েছিল‌।ফিরে এসে চারু কে না পেয়ে ভড়কে গিয়েছিল তড়িঘড়ি করে গাড়ি চালু করে ওকে খুঁজতে শুরু করে‌।
চারু কে পেয়ে স্বস্তি পেল যেন।
‘ আরে তুমি পাগল নাকি? একা একা চলে এসেছ কেন?’
চারু ভ্রু জোড়া কুঁচকে নিল। ধ্রুব এমন ভাবে প্রশ্ন করল যেন দুজনের একসাথে যাওয়ার কথা ছিল ও ধ্রুব কে ফেলে এসেছে।
চারু দাঁতে দাঁত চেপে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,’ আপনি কি বলতে চাইছেন?’
‘ কি বলতে চাইছি বুঝতে পারছো না? এতো রাতে তুমি একা এদিকে এসেছ কেন? জানো কারের কাছে এসে তোমায় না পেয়ে কতটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।’ কড়া গলায় বলল ধ্রুব।
চারু ধ্রুবর কথায় আহাম্মক হয়ে গেল যেন. ধ্রুবর কথা সব ওর মাথায় উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে।
ধ্রুব বলল,’ কি হলো কথা বলছো না কেন? তোমার মাথায় কি বুদ্ধিশুদ্ধি বলতেই কিছুই নাই। বাসা থেকে পালাবে ঠিক আছে কিন্তু নিজের সাথে আনা ব্যাগ কেউ ওভাবে ফেলে আসে? আর নিজের পায়ের দিকে তাকাও জুতো জোড়া পর্যন্ত রাস্তায় ফেলে এসেছো। তোমার কি উত্তেজিত হয়ে গেলে মাথার তার ঠিলা হয়ে যায় নাকি? জুতো নিয়ে কি দৌড়াতে পারো না।’
চারু ধ্রুবর কথা ও শাসন দেখে হতবুদ্ধি হয়ে গেছে। কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে যেন কিন্তু তবুও বিস্মিত গলায় বলল,’ আপনার জন্য সব হয়েছে‌। আপনি না আসলে আমি এমন ভুল করতাম না। আপনি সব নষ্টের মূল আপনি এসেই তো আমার সব এলোমেলো করে দিয়েছেন।’
ধ্রুব বিদ্রুপ করে বলল,’ আমি ছিলাম বলেই তুমি পালাতে পেরেছো। নয়তো তোমার মতো ভীতু মেয়ে পালাতে পারত না। ঘুরে আবার তুমি রুমে চলে যেতে আমি নিশ্চিত। আমাকে দেখলেই তুমি একটু সাহসী হয়ে উঠো এমনিতেই তো সবার সামনে ভেজা বিড়াল হয়ে বসে থাকো। আমার সামনে আসলেই মুখে কথার কৈ ফুটে। হাত মুখ দুই ই তুমি আমার সামনে আসলেই চালাতে পারো নিজের বাড়ির মানুষের সামনে তো দুটো কথা অব্দি ঠিকমতো বলতে পারো না। তুমি একটা ভীতুর ডিম।’
চারু নাক লাল করে আঙুল তুলে বলল,’ দেখুন আপনি কিন্তু..’
ধ্রুব ওকে হাত দিয়ে থামিয়ে দিয়ে বলল,’ এখন কিছু দেখতে পারছি না চারপাশ অন্ধকার। সো তর্ক না করে জুতো পরে নাও।’
বলেই ধ্রুব চারুর রাস্তায় ফেলে আসা জুতো জোড়া কার থেকে বের করে ওর কাছে এগিয়ে এসে ওর পায়ের কাছে রাখল নিচু হয়ে অতঃপর বলল,’ তাড়াতাড়ি জুতো পরে আমার গাড়িতে আসো।’
চারু স্তম্ভিত হয়ে জুতো পরে নিল ও ধ্রুবর বিহেভিয়ার দেখে হতবিহ্বল হয়ে গিয়েছে। ধ্রুব কে যেন চিনতেই পারছে না।
চারু গাড়িতে উঠছে না দেখে ধ্রুব বলল,’ কি হলো আসো তাড়াতাড়ি।’
‘ আমি আপনার সাথে যাব কেন?’ থমথমে কন্ঠে বলল চারু।
ধ্রুব বলল,’ আমার সাথে যাবে না তো কার সাথে যাবে? এতো রাতে আমি ছাড়া আর কে তোমাকে হেল্প করার জন্য বসে আছে? তোমার ভাগ্য ভালো আমার মতো একটা হ্যান্ডসাম ছেলের সাহায্য পাচ্ছ। নিজেকে নিয়ে তোমার গর্ব বোধ করা উচিত তা নয় তর্ক করছো? ইটস নট ফেয়ার চারু।’
#চলবে….