প্রেমনেশা পর্ব-২২+২৩+২৪

0
1

প্রেমনেশা
নন্দিনী নীলা

২২.

চারু আলগাছে কেবিন থেকে তো বেরিয়েছে ওর কপাল যে এতো ভালো ও ভাবেনি বাইরেও তেমন কেউ নেই। রাত এজন্য হয়তো সবাই চলে গেছে‌। চারু জলদি করে লিফটে উঠে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। নিচতলায় এসে কিছু মানুষের আনাগোনা পেল কিন্তু ওকে তেমন কেউ খেয়াল করছে না এইতো ভালো। চারু হসপিটালে থেকে বেরিয়ে রাস্তায় দাড়াতেই শান্তি অনুভব করছে। মনে মনে ধ্রুব কে ইচ্ছে মতো বকছে খুব তো ওকে বন্দি করতে চাইছিল নিজের মা অসুস্থ আর সে ওকে ধরে রাখে ফাজিল কোথাকার।
চারু দাঁত কিড়মিড় করে ওকে বকছিল। ওর চোখে পড়ার আগে এখানে থেকে পালাতে হবে সমস্যা হয়েছে এক টাকাও নাই হাতে ও এখন যাবে কোথায়। ধ্রুব কোথায় আছে কে জানে চারু কোন দিকে হাঁটবে ভাবছে হঠাৎ একটা রিকশা এসে ওর সামনে থামলো ও মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল ভাবছিল কোথায় যাবে। তখনি রিকশার চাকা ওর সামনে এসে থামতেই চমকে উঠল। রিকশা থেকে কেডস পরা একটা পুরুষ নেমে এলো চারু মাথা তুলে তাকাল আর ওর পিল চমকে উঠল। ধ্রুব ভয়ংকর রেগে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ধ্রুবর হাতে ঔষধ দেখা যাচ্ছে। চারুর মুখ মন্ডল ভয়ার্ত হয়ে এলো। এভাবে ধ্রুব সামনে এসে পড়ল? ওর পালানোর সমস্ত রাস্তা বন্ধ হয়ে গেল। চারু ধ্রুব দিকে ঢোক গিলে তাকিয়ে আছে। এদিকে ধ্রুব আশ্চর্যের চরম সীমায় পৌঁছে গেছে। সাথে অনেক রেগে ও গেছে। ধ্রুব ভাড়া মিটিয়ে চারু সামনে দাঁড়িয়ে রাগী স্বরে জিজ্ঞাসা করল,’ কোথায় যাচ্ছ?’
চারু আমতা আমতা করতে লাগল‌। ধ্রুব ধমকে উঠল,’ উত্তর দিচ্ছ না কেন? কোথায় যাচ্ছ তুমি? এ্যান্সার মি।’
চারুর বুক কেঁপে উঠল ধ্রুবর ধমক খেয়ে চারু এদিকে ওদিকে তাকাতাকি করতে লাগল। অদ্ভুত ও এতো ভয় পাচ্ছে কেন? মনে হচ্ছে খুব বড়ো ভুল করে ফেলেছে কিন্তু অপরাধ তো করেছে এই লোকটা। তবুও কি গলার জোর দেখাচ্ছে। আর ও ভীতুর মতো ভয়ে কাঁপছে। আজব।
রাগে ভেতরে ভেতরে ফুসফুস করছে চারু কিন্তু ভেতরের রাগটা কোনভাবেই চারু সামনে মেলে দিতে পারছে না।
ধ্রুবর চোখে চোখ ও রাখতে পারছে না নিজেকে নিজেই বুঝতে পারছে না।
অসহায় মুখ করে তাকাল চারু ধ্রুবর দিকে তারপর বলল,’ না মানে আসলে..!’
ধ্রুব বলল,’ তুমি কি চলে যাবে বলে বেরিয়েছো?’
চারুর গলা শুকিয়ে আসছে। চারু শুকনো ঠোঁট জোড়া জিভ দিয়ে ভিজিয়ে বলল,’ হ্যাঁ।’
ধ্রুবর মুখটা এমন রাগী গম্ভীর হয়ে উঠল চারু মাথা নিচু করে ফেলল।
‘ মাথায় সমস্যা আছে তোমার? আমার আম্মু অসুস্থ মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে ডক্টর আশা ছেড়ে দিয়েছে এই অবস্থায় ও আমি তোমার পিছনে ছুটাছুটি করি এটাই চাও তুমি?’ কঠিন স্বরে বলল ধ্রুব।
চারু মিনমিনে স্বরে বলল,’ আপনি কেন আমার পেছনে ঘুরবেন? আমি যেখানে খুশি যাই আপনার কী?’
ধ্রুব বলল,’ দেখো চারু তোমার সঙ্গে আমি বাড়তি কথা বলতে পারছি না এই মুহুর্তে। তুমি চলে যাবে তাইতো? কোথায় যাবে এতো রাতে? তোমার কাছে টাকা আছে? নাই। তবুও আমার উপর রাগ দেখিয়ে তুমি চলে যাওয়ার জন্য পাগলামি করছো ওকে ফাইন আমার কাছে থাকার চেয়ে যদি শূন্য হাতে রাস্তায় উদ্দেশ্য হীন ভাবে ঘুরতে তোমার ভালো লাগে তো আমি এখন তোমায় আর আটকাবো না। তুমি চলে যাও। গুড বাই।’
ধ্রুব এতো সহজেই ওকে ছেড়ে দিবে ও কল্পনা ও করেনি। বিস্মিত চোখে চারু ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে আছে। ধ্রুব ওকে রেখে হসপিটালের ভেতরে হাঁটা ধরল। চারু হতবুদ্ধি চোখে তাকিয়ে আছে। ধ্রুব দুই কদম হেঁটে ফিরে তাকাল।
‘ তোমার যদি মনে হয় রাস্তায় ঘোরার থেকে ধ্রুবর কাছে থাকা নিরাপদ আমার কাছে চলে আসতে পারো।’ ধ্রুব আর এক সেকেন্ড বিলম্ব করল না কথাটা বলেই চলে গেল।
চারু হতবিহ্বল হয়ে ওর কথাটা শুনল।

ধ্রুব এতো সহজেই মেনে নিবে আশা করেনি চারু। যেমন রাগী জেদি তার এই আচরণ হতবাক করেছে চারু কে শুধু তাই নয় ধ্রুব এভাবে কথা বলবে তাও ভাবেনি। বিস্মিত মুখে দাঁড়িয়ে আছে চারু এক পা এগুতে ও পারছে না পিছুতে ও পারছে না। ধ্রুব ওকে দু টানায় ফেলে গেল লোকটা খুব চালাক জোর জবরদস্তি করে যখন ওকে আটকাতে পারেনি এখন অন্যভাবে আটকানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু ধ্রুবর বলা প্রত্যেকটা কথায় তো সত্য।
চারু অন্ধকার শুনশান রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে ও উদ্দেশ্যহীন ভাবে কতক্ষন হাঁটবে? হাঁটতে হাঁটতে তো ও হাঁপিয়ে যাবে। গন্তব্য ছাড়া কি কিছু করা যায়‌। নিজেকে এতো অসহায় লাগছিল ধ্রুবর বলা একটা বর্ণ ও তো মিথ্যা নয়। ও ধ্রুবর উপর রাগ করে পালাতে চাইছে ঠিকি কিন্তু ও পালিয়ে যাবেটা কোথায়? চারু মলিন মুখে হসপিটালের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে আগেপিছে কোন দিকেই পা নিতে পারছে না। এতো অসহায় লাগছিল যেন মরে গেলে ওর এই অসহায়ত্ব কমবে। রাত তখন কয়টা ছিল চারু জানে না ওভাবেই দাঁড়িয়ে থেকে চারুর কপালের রৌদ্রের ঝিলিক এলো। চারু কপাল কুঁচকে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।
পা দুটো ব্যথায় ধরে গেছে কিন্তু নড়তে ইচ্ছে করছে না এখানে স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে।
‘ এখনো দাঁড়িয়ে আছো যে?’ ধ্রুবর কথায় চমকে উঠল চারু‌।
মুখ নিচু করে চারু বলল,’ এখানে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া আর যাবার জায়গা খুঁজে পাচ্ছি না।’
ধ্রুব ওর সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,’ জায়গা নেই তাহলে কেবিন থেকে বেরিয়েছিলে কেন?’
চারু আড়চোখে তাকাল ধ্রুবর মুখটায় তারপর নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে র‌ইল। ধ্রুব ওর দিকে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে একটা রিকশা দাঁড় করিয়ে নিজে উঠে বসলো। এবং চারুকে ডেকে বলল,” উঠে আসো।’
চারু কপাল কুঁচকে রিকশায় বসে থাকা ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে আছে।
ধ্রুব আবার বলল,’ কি হলো আসো’
বলেই হাত বাড়িয়ে দিল ওকে ধরে উঠার জন্য।
‘ কোথায় যাব?’ চমকানো স্বরে বলল চারু।
ধ্রুব ওর কথায় পরিহাস করে বলল,’ হসপিটালে থাকবে নাকি সারাজীবন?’
থতমত খেয়ে গেল চারু। ধ্রুবর হাত না ধরেই উঠে বসল জড়োসড়ো হয়ে।
ধ্রুব নিজের হাত গুটিয়ে নিয়ে রিকশা ছাড়তে বলল। চারু কেনার ঘেঁষে বসেছে চাইছে ধ্রুবর সাথে নিজের ছোঁয়া না লাগাতে তা দেখে ধ্রুব ইচ্ছে করেই চারুর দিকে সরে বসল।
চারু কঠিন চোখ ওর ওর দিকে তাকিয়ে বলল,’ এদিকে আসছেন কেন?’
ধ্রুবর ভাবলেশহীন কন্ঠে বলল,’ আমি তো তোমার মতো পাটখড়ি না আমার জায়গা বেশি লাগে। আর তুমি তো একটু খানিতেই বসেছো মাঝে ফাঁকা না থেকে আমি নাহয় একটু আরাম করেই বসলাম।’
চারু মুখটা লাল করে ঘুরিয়ে নিলো। ধ্রুবর ঠোঁটে মিটিমিটি হাঁসি।
চারু চট করেই বলে উঠল,’ আপনার গাড়ি কোথায়?’
ধ্রুব বলল,’ বাবা নিয়ে গেছে।’

ধ্রুব চারু কে নিয়ে রেস্টুরেন্টে এসেছে। চারু ভাবছিলাম কোথায় যাচ্ছে জিজ্ঞেস করবে কিন্তু প্রথমেই যে ভাব নিল বলল না তাই আর মুখ খোলে না।
ধ্রুব চারু কে নিয়ে রেস্টুরেন্টে বসে আছে। চারুর খুব খিদে পেয়েছে। রেস্টুরেন্টে এসে আরো খিদে যেনো বেড়ে গেল। কিন্তু ধ্রুবকে বুঝতে দিচ্ছে না। ধ্রুব ওয়েটার কে ডেকে চারু কে বলল,’ কি খাবে অর্ডার দাও।’
চারু এক পলক ধ্রুব দিকে চেয়ে অর্ডার দিল। ধ্রুব ভেবেছিল চারু অর্ডার দেওয়া নিয়ে ঝামেলা করবে কিন্তু চারুকে বিনা বাক্যে অর্ডার করতে দেখে কিছুটা বিস্মিত হলো। সাথে জোর জবরদস্তি থেকে রেহাই পেয়ে শান্তি পেল। সবসময় কার জোরাজুরি করতে ভালো লাগে?
দুজনেই রাতে অভুক্ত ছিল তাই পেট পুরে খেল। চারু কথায় কথায় জিজ্ঞেস করল,’ আপনার মায়ের কি অবস্থা এখন?’
ধ্রুব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,’ অবস্থা বেশি ভালো না। সকালে নতুন ডক্টর আসবে সে দেখে জানাবে কন্ডিশন।’
খাওয়া-দাওয়া শেষে চারু ধ্রুবর পিছু পিছু বাইরে এসে দাঁড়াল।
ধ্রুব পাঁচ মিনিট নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে কিছুই একটা ভেবে চারু কে নিয়ে অটোতে উঠে বসলো।
চারু ধ্রুব কে হসপিটালে রেখে আরেকদিকে ওকে নিয়ে যেতে দেখে বলল,’ কোথায় যাচ্ছেন?’
ধ্রুব বলল,’ তোমাকে বিক্রি করে দিতে।’
‘ মজা করবেন না। আপনি এদিকে আসলেন কেন?’
‘ তো কোথায় নিয়ে যাব তোমায়?’ কপাল কুঁচকে বলল ধ্রুব।
চারু থতমত খেয়ে গেল তারপর বলল,’ আপনিই তো আমাকে জোর করে নিজের সাথে নিয়ে এসেছেন আমি কিন্তু আসতে চায়নি। তাই কোথায় নিয়ে যাবেন বললে তো হবে না! আপনার জন্য আমার শেষ সম্বল টুকু ও আমি নিজের সাথে করে নিয়ে আসতে পারিনি। সব দোষ আপনার তাই আমার একটা ব্যবস্থা আপনাকেই করে দিতে হবে। আমি রাগের মাথায় বোকামি করতে যাচ্ছিলাম। আপনাকে এতো সহজে ছেড়ে দিলে তো হবে না। আমার এই অবস্থার জন্য আপনি দায়ী আপনার জন্য আমাকে ঘর ছাড়া হতে হয়েছে এখন ঘরের ব্যবস্থা আপনাকেই করে দিতে হবে।’
এক নিঃশ্বাসে এ কথাগুলো বলে থামল চারু।
চারুর কথা শুনে হাততালি দিয়ে উঠল ধ্রুব। চারু মুখটা বিমূঢ় করে ওর হাত তালি দেওয়া দেখছে।
‘ আমি কি ভাষণ দিয়েছি আপনি হাততালি দিচ্ছে কেন?’ রেগে গেল চারু।
ধ্রুব বলল,’ একটা পারফেক্ট কথা বলেছো। তোমার সিদ্ধান্ত কে আমি পছন্দ করেছি তাই হাততালি দিচ্ছি। শোনো একদম আমাকে ছেড়ে দিবে না। আমি তোমায় ঘর ছাড়া করেছি না এবার তুমি আমার বাসায় উঠে বসো।’
‘মানে কি সব বলছেন?’
ধ্রুব বলল,’ হুম ঠিকই তো আছে।’
চারু বোকা চোখে তাকিয়ে আছে এই ছেলে কি ওর সাথে মজা নিচ্ছে।‌
ধ্রুব চারু কে নিয়ে দাদির ফ্লাটে এলো। চারু গাড়িতে থেকে নেমে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
ধ্রুব বলল,’ স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছো কেন তাড়াতাড়ি আসো।’
চারু আসছে না দেখে ধ্রুব ওকে জোর করেই টেনে বাসার ভেতরে নিয়ে গেল। তারপর চারু কে বাসায় ভেতরে রেখে বলল,’ আমি এখন হসপিটালে যাচ্ছি তুমি থাকো। বিকেলে তোমার জন্য সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে। বাই।’
চলেই ধ্রুবর চলে গেল। এইদিকে বিকেলে কি সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে ভেবে কপাল কুঁচকে নিলো চারু।
#চলবে….

প্রেমনেশা
নন্দিনী নীলা

২৩.

সময় বেলা বারোটা। দুপুরের রান্না চারু করছে।
সকালে চারু কে বাসায় দেখে শিখা আন্টি তো বলেই বসলেন,’ আরে চারু যে তুমি হঠাৎ হঠাৎ কোথায় উধাও হয়ে যাও বলোতো। আমিই আর উধাও হতে পারলাম না। ছোটো স্যার বলল তোমার নাকি বিয়ে তুমি আর কাজে আসবে না আবার চলে এলে যে? শুনেছিলাম তো খুব বড়ো ঘরের ব‌উ হয়ে যাচ্ছ তাহলে আবার কাজে আসলে কেন?’
জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শিখা আন্টি। চারু কোন উত্তর দিতে পারছিল না কি বলবে ও সেটাই ভাবছিল কিন্তু কোন কথা সাজাতে পারছিল না।
শিখা আন্টি আবার বললেন,’ তুমি না এলে আমার খুব অসুবিধা হয় চারু। একা একা এই বাসায় এক দন্ড ভালো লাগে না। এসেছো ভালোই হয়েছে। ওই বুড়িকে কি একা একা সামলানো যায় বলো?’
চারু চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে দেখে শিখা আন্টি ওকে খোঁচা দিয়ে বললেন,’ কি ব্যাপার কথা বলছো না কেন? বিয়ে কি হয়ে গেছে তোমার দেখে তো বিয়ের আমোদ পাচ্ছি না। তোমরা তো মুসলিম তোমাদের বিয়ে হলেও বুঝার উপায় নেই। আমাদের দেখো বিয়ে হলে আর লুকানোর উপায় নেই মাথায় সিঁদুর কপালে টিপ পড়তে হয়।’
চারু বলল,’ আন্টি আমি বিয়ে করিনি।’
শিখা আন্টি ভাবলেন বিয়েটা হয়তো কোন কারণে ভেঙে গেছে এজন্য চারুর মন খারাপ তিনি মুখটা মলিন করলেন।‌
চারুর থুতনি ধরে বললেন,’ আহারে এজন্য বুঝি এতো মন মরা হয়ে দাঁড়িয়ে আছো? বুঝি আমি বড়ো ঘরের ছেলে তোমায় বিয়ে করতে রাজি হয়নি তাই তো? মন খারাপ করো না। তুমি তো দেখতে খুব সুন্দরী খুবই ভালো পাত্র পাবে মন খারাপ করো না। তাইতো বলি মেয়ে এখানে কেন।’
আহারে করতে লাগলেন শিখা আন্টি। তিনি ভাবছেন এইটুকু মেয়ে কত কষ্ট করে। বিয়ে হয়ে গেলে এই কষ্টের জীবন থেকে মুক্তি পেতো কত আশায় না করেছিল কিন্তু সবটাই ভেঙে গেছে। মনটাই ভেঙে গেছে মেয়েটার। শিখা আন্টি চারু কে দুহাতে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন,’ কষ্ট পেয়ো না।’
চারু আগে কখনোই ভাবেনি শিখা আন্টি ওকে এতো ভালোবাসে। আজকে তার বিহেভিয়ার এ স্তব্ধ।

শিখা আন্টি ওকে সোজা করতেই চারু বলল,’ আমি বাসা থেকে পালিয়ে এসেছি আন্টি।’
শিখা আন্টি এতোক্ষণ যে কষ্টের কথা ভাবছিল এই কথায় সবটাই ভেঙে গেল। তার মুখটা বিস্মিত হয়ে উঠল।
বিস্ময় এ শিখা আন্টি ডান হাতে মুখটা চেপে ধরে বললেন,’ এমা কি বলছো? তুমি বিয়ে না করে পালিয়ে এসেছো?’
চারু নির্লিপ্ত কন্ঠে বলল,’ হ্যাঁ আন্টি আমি পালিয়ে এসেছি।’
শিখা আন্টি মুখটা হাঁ করে চারুর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে অবিশ্বাস্য চোখে তিনি বিশ্বাস করতে পারছে না চারুর মতে ভোলাভালা মেয়ে এই কাজ করত পারে।
তার মুখটা দেখে চারু ঢোক গিলল। কারণ শিখা আন্টি যে খুব বড়ো শক খেয়েছে তার মুখের এক্সপ্রেশন দেখেই বুঝা যাচ্ছে।
চারু কে শিখা আন্টি জিজ্ঞেস করলেন,’ তোমার যে বয়ফ্রেন্ড আছে‌ আগে বলো নি তো? আমি তো ভেবেছিলাম তুমি সিঙ্গেল।’
চারু বলল,’ আমার বয়ফ্রেন্ড নাই আন্টি।’
‘ বলো কি তাহলে তুমি বিয়ে না করে পালালে কেন?’ আশ্চর্যান্বিত কন্ঠে বললেন শিখা আন্টি।
চারু মাথা নিচু করে ফেলল,’ আন্টি যার সাথে আমার বিয়ে ঠিক করেছিল মা সে আগে থেকেই বিবাহিত আমাকে তার দ্বিতীয় ব‌উ করে পাঠাতে চেয়েছিল। আমি এসব মানতে পারিনি। তাই পালিয়ে এসেছি।’
‘ বলছ কি? কি সর্বনাশ! নিজের মা তো না সৎ মায়ের থেকে আর কি বা আশা‌ করা যায়‌। তুমি খুব ভালো কাজ করেছো। কিন্তু একা কোথায় উঠেছো তুমি?’
চিন্তিত স্বরে বললেন শিখা আন্টি।
চারু বলল,’ কোথাও উঠিনি আন্টি।’
‘ তাহলে থাকছো কোথায়?’
‘ গতকাল হাসপাতালে ছিলাম।’ মুখ নিচু করে বলল চারু।
‘ হসপিটালে কেন তুমি কি অসুস্থ?’ জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
চারু বলল,’ না আন্টি ধ্রুবর মা অসুস্থ।’
‘ ধ্রুবর মা বলতে ছোট স্যার এর মা?’ বিস্মিত কন্ঠে বললেন তিনি।
‘ জি।’
‘ সেখানে তুমি কী করছিলে?’
‘ ধ্রুব নিয়ে গিয়েছিল।’
‘ ওয়েট ওয়েট আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। তুমি একটু আমায় খুলে বলবে চারু? ধ্রুব স্যার তোমায় কেন নিয়ে গিয়েছিল আর স্যার তোমায় পেলো কোথায়? তুমি বাসা থেকে পালিয়ে তাকে কীভাবে পেলে?’
চারু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,’ অনেক লম্বা কাহিনী আন্টি আমি আপনাকে পরে বলব।’
‘ আমি এখনি শুনতে চাচ্ছি। নয়তো আমার কোন কাজেই মন বসবে না।’
চারু ইতস্তবোধ করছে বলতে যা সব ঘটেছে এসব জেনে শিখা আন্টির কি অবস্থা হয় কে জানে!

চারু আস্তেধীরে মুখ নিচু করে সব খোলে বলল সব শুনে শিখা আন্টি চোখ কপালে তুলে ফেলল।
চারুর কথা শুনে বললেন,’ তাইতো বলি দুজনের ভাব সাব দেখে মনে হয় পূর্বপরিচিত।’
‘ পরিচিত না বেয়াদবি করেছিল আমার সাথে। আমি কল্পনা ও করিনি এই বাসার সাথে উনার যোগসূত্র রয়েছে।’
চারু দেখল শিখা আন্টি তদ্ধা খাওয়া মুখে সোফায় বসে পড়ল। চারু শিখা আন্টির দিকে চেয়ে বলল,’ আন্টি,’
নো রেসপন্স চারু একটা নিঃশ্বাস ফেলে ভেতরে চলে যায়।
চারু রান্না বান্না শেষ করে দাঁড়িয়ে আছে। শিখা আন্টি একটু পর পর এসে ওকে জিজ্ঞাসা করছে,’ আমি আন্দাজ করতে পারছি তোমার জন্য কি সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে। বলব?’
‘ হুম বলুন শুনি।’ কপাল কুঁচকে বলল চারু।
শিখা আন্টি বললেন,’ দেখো তোমার কথা শুনে আমি যতটুকু বুঝলাম ধ্রুব তোমায় লাইক করে হয়তোওওও। শিউর বলতে পারছিনা কারণ আমি তোমায় বেশি আশা দিয়ে কষ্ট দিতে চাইনা। কারণ শিউর দিলে তুমি আশা করবে বেশি পরে না পেলে কষ্ট ও পাবে। এজন্য কম আশা রাখো হয়ে গেলে তো। গেলোই।’
চারুর মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল,’ এসব আপনি কি বলছেন আন্টি?’
‘ কেন ভুল বললাম নাকি?’
চারু রাগী স্বরে বলল,’ অবশ্যই।’
মুখটা কালো করে শিখা আন্টি চলে গেল। কারণ চারু উনাকে‌ কড়া গলায় শাসন করে এখানে থেকে পালাতে বাধ্য করেছে।

চারু কল্পনাতে ও কখনো ধ্রুব ওর মতো মেয়েকে পছন্দ করতে পারে ভাবেনি। শিখা আন্টি কি সব আবোল তাবোল বলছে। চারু রান্না বান্না শেষ করে বসে ছিল সোফায়। চারুর দিকে রাশেদা বেগম আজকে কেমন করে যেন তাকিয়ে ছিল। রাশেদা বেগমের দৃষ্টি দেখে চারু থতমত খায়। রাশেদা বেগম খাবার খেয়ে চলে যাওয়ার সময় চারু ডেকে উঠল ওর সাথে নাকি‌ কথা আছে। চারু চমকে উঠল। মাথা তুলে‌ তাকাল তার দিকে আসা নিয়ে যা সব শুরু করেছে ও তাই হয়ত বকবে। চারু রাশেদা বেগমের রুমের সামনে এসে দরজায় টোকা দিয়ে বলল,’ আসবো?’
রাশেদা বেগম হাত উঁচিয়ে আসার ইশারা করে মুখে বলেন,’ আয়।’
চারু মাথা নিচু করে ভেতরে এসে দাঁড়ায়। রাশেদা বেগম ওকে বলে,’ এতো দূরে দাড়ালি কেন কাছে আয়।’
চারু রাশেদা বেগমের কথায় ঢোক গিলল। চারু কাছে এসে দাড়াতেই তিনি খপ করে ওর হাতটা ধরে নিলেন। চারু ভয় পেয়ে তাকাল তার দিকে,’ কি হয়েছে দাদী?’
রাশেদা বেগম ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে‌। হাতটা শক্ত করে ধরে বললেন,’ সত্যি ক‌ইরা কয়ডা কথা ক তো আমারে!’
চারু কপাল কুঁচকে বলল,’ কি কথা দাদী? কোন সমস্যা!’
চারু রাশেদা বেগমের উত্তেজনা লক্ষ্য করছে অবাক চোখে। এভাবে উত্তেজিত হতে কখনোই দেখেনি তাকে। আচ্ছা ছেলের ব‌উ এর চিন্তায় এই অবস্থা নাকি?
চারু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,’ আপনি কি ধ্রুব স্যার এর মায়ের জন্য দুশ্চিন্তা করছেন?’
রাশেদা বেগম প্রশ্নতুক কন্ঠে বললেন,’ কেন আমার বৌমার কি হয়েছে?’
তার প্রশ্ন করা দেখে বোকা বনে গেল চারু এবং নিশ্চিত হলো তাকে তার অসুস্থতার খবর জানানো হয়নি। চারু নিশ্চিত হলো উনার যা শরীরের অবস্থা উনাকে না জানানো টাই বেটার হয়েছে।
চারু নিশ্চিন্তে হাসলো।
এবং বলল,’ না কি হবে এমনি বললাম।’
রাশেদা বেগম বললেন,’ দাদুভাইয়ের লগে তোর কি গভীর কোন সম্পর্ক হয়েছে। তোরা কি একেরপর কে ভালোবাসিস?’
চারুর চোখ কপালে উঠে গেল এসব উনি কি সব বলছেন? কেন বলছেন? চোখ ভরা বিস্ময় নিয়ে চারু জিজ্ঞেস করল,’ এসব কি বলছেন দাদী?’
রাশেদা বেগম বললেন,’ আমি কিন্তু ওইদিন রাইতে তোদের একলগে দেখছি‌।’
‘ এমা ছি ছি কি সব ভাবছেন দাদী। আপনি কি দেখেছেন কবে দেখেছেন বলুন তো?’
চারু ভুলেই গিয়েছিল ধ্রুব ওকে বন্দি করে রাখার কথাটা এবং ওকে অচেতন অবস্থায় কোলে করে বেরিয়েছিল যখন এই বুড়ির চোখে পড়ে যায়। এদিকে রাশেদা বেগম ওদের মধ্যে কোন সম্পর্ক আছে নাকি জিজ্ঞেস করছে কিন্তু চারু কিছু বুঝতে পারছে না। হঠাৎ করে দাদী কেন এসব জিজ্ঞেস করছে ও বুঝতে পারছে না।
চারু বলল,’ দাদী আপনি ভুল ভাবছেন এমন কিছুই আমাদের মধ্যে নেই।’
‘ মিছা কথা ক‌ইস না আমারে।’
চারু অধৈর্য হয়ে বলল,’ আপনার নাতির মতো রাজপুত্র আমার মতো একটা মেয়েকে পছন্দ করবে? ভালোবাসবে? কিসব ভাবছেন! তিনি তার জন্য কোন এক রাজকন্যার সন্ধান করে নিবে দেইখেন।’ তাচ্ছিল্য করে বলল চারু। তারপর আরো কিছু কথা বলে চলে এলো।
শিখা আন্টি ওকে বললেন,’ কি বলল এতো জরুরি তলব করে?’
চারু উত্তর দিল না হতবুদ্ধি হয়ে সোফায় বসে আছে। দাদী এসব কেন জিজ্ঞেস করলো। কোনদিন রাতে কি দেখেছে? আচ্ছা ধ্রুব ওকে যেদিন বন্দি করেছিল ও তো অজ্ঞান ছিল জাগ্রত হয়ে ও নিজেকে ধ্রুবর বিছানায় শুয়ে থিকা অবস্থায় পায়। আচ্ছা ধ্রুব সেদিন ওর সাথে কিছু করার চেষ্টা করেনি তো? ঢোক গিলল চারু ওর গলা শুকিয়ে এলো। এসব কি হচ্ছে?
ভয়ে ওর হাত পা কাঁপছে।
অজানা ভয়ে ভীত হলো ওর হৃদয়।
#চলবে

#প্রেমনেশা
নন্দিনী নীলা
২৪.

চারু স্তম্ভিত হয়ে বসে আছে। চারু বসে আছে এই মুহূর্তে ফ্লোরে। একটু আগেই ও এই বাসায় এসেছে। আগে কখনোই এই বাসায় আসেনি। ধ্রুবর বাবা মা যে বাসায় থাকতেন সেই বাসায় চারু এসেছে। সবার সাথেই এসেছে। মাঝে একটা রাত পার হয়ে গেছে। একটা রাতে অনেক কিছুই ঘটেছে। চারুর চোখে এখনো জল চিকচিক করছে‌। রাশেদা বেগম হঠাৎ এভাবে মৃত্যুবরণ করবেন কেউই আশা করেননি। যে মানুষটা দুপুরেই ওর সাথে কত কথা বলল ধ্রুব সাথে ওর কোন সম্পর্ক আছে নাকি এসব নিয়ে কত ভাবে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে প্রশ্ন করল। তিনি যে বারবার তার সন্দেহ সত্যি হোক চাইছিল চারু তার কথার ধরণ এ ধরতে পারছিল। চারু এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না মানুষটা আর পৃথিবীতে নেই। শরীর টা এখনো থরথরিয়ে কাঁপছে চারুর। এই বাসায় এসে তার ছেলে দের দেখছে তেমন কেউই তার মৃত্যু তে তেমন কষ্ট পেয়েছে বলে মনে হয়না। যা একটু কষ্ট পেয়েছে সেটা ধ্রুবর মধ্যে দেখা গিয়েছে। বিকেলে একটা সারপ্রাইজ দেওয়ার কথা ছিল চারু কে সেই নিয়ে সারাটা দিন চারু ভয়ে আতঙ্কে থরথরিয়ে কেঁপেছে লোকটার মন যা খারাপ তার দেওয়া সারপ্রাইজ যে ভালো হবে না ভেবেই নিয়েছিল চারু। তাই আল্লাহর কাছে কত ভাবে চাইছিল এটা যেন কোনভাবে আটকে যায়। আটকে গেল ধ্রুব আসলো দাদীর মৃত্যুর খবর পেয়ে। বাচ্চাদের মতো কাঁদছিল। অথচ রাশেদা বেগমের মেয়ে ও তেমন কাঁদেনি। একটু মনখারাপ করে ছিল এই যা। সবার পাষাণ রূপ চারু দেখল আর অবাক হলো। তাদের মা এই পৃথিবী থেকে চিরকালের জন্য বিদায় নিয়েছে অথচ তাদের মধ্যে যেন তেমন দুঃখ দেখা গেল না। উল্টো আপদ বিদায় হয়েছে এমন ভাব করলো।
এই বাসায় এসেই দেখতে পেল। রাশেদা বেগম যে বাসায় থাকতো ওর বাসায় টা বড়ো সড়ো কিন্তু এই বাসাটা আরো বড়ো আরো কাজের লোক দিয়ে ভরপুর অথচ সবাই তাকে কেমন উটকো ঝামেলা ভেবে আলাদা বাসায় রেখেছিল। শুনেছিলাম এই বাসাটা নাকি ধ্রুব দাদা থেকে গিয়েছে তাই তিনি স্বামীর বাড়ি ছেড়ে যায়নি। এদিকে ধ্রুবর বাবা নিজের পছন্দ মতো বাসা করে উঠে গিয়েছে মাকে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল কিন্তু সে যাবে না জেদ ধরেছি। রাশেদা বেগম নাকি বলেছিল,’ আমি যতদিন বেঁচে আছি এইখানে থাক না তোরা আমি মরে গেলে নিজেদের প্রসাদে গিয়ে থাকিস।’
কিন্তু কেউ তার কথায় রাজি হয়নি। তাকে একা থেকেই সবাই নিজেদের জায়গায় উঠে গিয়েছিল।
একা থেকেই তিনি আরো অসুস্থ হয়ে পড়েন। চারু ভাবছে,’ কি পাষাণ নির্দয় এই বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষ। একজন বয়স্ক অসুস্থ মানুষকে একা করে রেখেছিল। তার কথা শুনে সবাই তার সাথে ওই বাসায় থাকলে কি এমন ক্ষতি হতো। মানুষ মরার আগেই ও কারো মুখটা দেখে যেতে পারলো না।’
এতো খারাপ লাগছিল চারুর রাশেদা বেগম এর কষ্টের কথা ভেবে। ও নিজেকে সবচেয়ে দুঃখী মানুষ ভেবেছিল ওর থেকেও তো বেশি দুঃখ যন্ত্রণা ভোগ করেছে দাদী। তার সব ছিল। কিন্তু শেষ বয়সে এসে তার পাশে কেউ ছিল না। একা নিঃসঙ্গ হয়ে তিনি ওই বাসায় থেকেছে। কত কষ্ট‌ই না তার হয়েছে। আহারে এতো কষ্ট করে ছেলে মেয়েদের বড়ো করেছে তারাই শেষ বয়সে এসে বুড়ো মাকে ফেলে দিয়েছে। চারুর চোখ বেয়ে টপটপ করে পানির ধারা নামছে। চারু যদি জানতো মানুষটা আজকেই শেষ হয়ে যাবে হয়তো তার কাছে বসে থাকতো। ওইসব প্রশ্ন করায় চারু তার উপর বিরক্ত হয়ে উঠে চলে গিয়েছিল। তারপর আর যায়নি। দুপুরের খাবার পর সে ঘুমায় তাই ওই সময় আর শিখা আন্টি ও তার কাছে যায় নি। দুজনেই নিচে বসে ছিল। শিখা আন্টি গিয়েই পরে জানতে পারছেন তিনি মারা গিয়েছে তারপর ওকে খবর দিয়ে সে ফোন নিয়ে জানিয়েছে ধ্রুবর বাবাকে।
মানুষের জীবন কত অনিশ্চিত। আমার দুনিয়ার মায়ায় পরে ভুলেই যায় আমাদের মরতে হবে।
চারু কাঁদছিল হঠাৎ কারো আওয়াজ এর কানে আসে।

চারু মাথা তুলে চোখ ভর্তি অশ্রু নিয়ে। সামনে তাকিয়ে দেখে ধ্রুব দাঁড়িয়ে আছে ও তাকাতেই বলে,’ এক গ্লাস পানি দাও।’
চারু মুখটা গম্ভীর করে চোখ হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুছে বলে,’ পারব না।’
ধ্রুব কপাল কুঁচকে বলে,’ সমস্যা কি?’
চারু রাগী গলায় বলল,’ আমি আপনার চাকর না যে আপনি যা বলবেন তাই করব। আমি দাদির দেখাশোনা করতাম তাই তার সব কথা শুনতাম সেই আর নেই তাই নিজে আর কারো আদেশ শুনব না। আপনিও আমাকে চাকরের মতো ট্রিট করবেন না।’
ধ্রুব বলল,’ এক গ্লাস পানি দিলে তুমি ছোটো হয়ে যাবে?’
চারু ফ্লোর থেকে উঠে দাঁড়াল। তারপর বলল,’ ছোটো হবো না কিন্তু আপনি আমাকে ছোটো ভেবেই এভাবেই চাইলেন।’
ধ্রুব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উল্টো ঘুরে হাঁটা দিল। চারু নিজেকে শান্ত করে গ্লাসে পানি নিয়ে ধ্রুব কে ডেকে উঠল,’ দাঁড়ান।’
ধ্রুব দাঁড়াল। চারু গ্লাস নিয়ে সামনে গিয়ে দাঁড়াল
তারপর বলল,’ পানি না খেয়েই চলে যাচ্ছেন কেন?’
‘ আমি পানি খেতে চাইলে তুমি ছোটো হবে জানলে কখনোই চাইতাম না‌।’
চারু একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বলল,’ সরি এভাবে বলা উচিত হয়নি। আমি আসলে আপনাদের বাসায় সবার বিহেভিয়ার এ স্তব্ধ।‌মাথা গরম হয়ে আছে। সবাই এতো পাষাণ।’
ধ্রুব পানি খেয়ে বলল,’ থ্যাংকিউ।’
বলেই ধ্রুব চলে গেল। চারু ফাঁকা গ্লাস হাতে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ ওর সামনে এসে দাঁড়াল ধ্রুবর চাচাতো বোন পিনাক। পিনাক কপাল কুঁচকে দাঁড়িয়ে আছে ওর সামনে। চারু তাকে দেখে মাথা নিচু করে ঘুরে কিচেনে চলে গেল গ্লাস রাখতে‌।
পিনাক ওর পিছু পিছু এসে বলল,’ এই তুই ধ্রুবর সাথে কি কথা বলেছিলি?’
মেজাজ খারাপ হয়ে চারুর। এই বাসার ছেলেমেয়ে গুলো এতো বেয়াদব গতকাল এই বাসায় না আসলেই জানতেই পারতো না চারু। ধ্রুব কে সবচেয়ে বেশি বেয়াদব ভেবেছিল চারু কিন্তু এরা তো তার থেকেই বেশি। কাজের লোক কি মানুষ না? এরা ওদের মানুষ বলেই গন্য করে না। এই মেয়ে চারুর থেকেও বয়সে ছোটো হবে। কিন্তু চারু কে তুইতোকানি করছে কাল থেকে। প্রথম দেখায় কেউ কাউকে এভাবে তুই তোকানি করতে পারে এই বাসায় না আসলে জানা হতো না। এই বাসায় কাজ করে একটা মহিলা। গতকাল তাকে দেখেছে বড়ো ছোটো সবাই তার সাথে এতো বাজে আচরণ করেছে। সকাল হতেই চলে এসেছে এসেই ব্রেকফাস্ট তৈরি করছে। চারু দেখেছে সবাই তার সাথে একটু আধটু ভুল চুক বলেই যা হয় তাই বলে গালিগালাজ করে। অথচ চারু জানত ধনী শিক্ষিত মানুষ জন মুখ খারাপ করে না। কিন্তু এরা নাকি শিক্ষিত সম্মানীয় মানুষ তাদের মুখের যা অবস্থা বাইরের মানুষ জানলে থুথু ফেলবে। চারু কখন এই বাসা থেকে বের হতে পারবে সেই সুযোগ খুঁজছে।
চারু গম্ভীর মুখে বলল,’ আপু আমি আপনার বড়োই হবো তাই দয়া করে তুমি বা আপনি করে কথা বলবেন। এভাবে তুই শব্দ টা আমার ভালো লাগছে না।’

পিনাক মেয়েটা ছ্যাত করে জ্বলে উঠল।
‘ কি বললি তুই? আমি তোর মতো ফকিন্নী কে আপনি করে কথা বলব?’
চারু বলল,’ জি আপু। একটু অন্তত সম্মান দেন। হয়তো আমি আপনাদের মতো বড়ো লোক না কিন্তু আমিও মানুষ।’
পিনাক বিদ্রুপ করে বলল,’ ফকিন্নীর বাচ্ছা তোর সম্মান লাগবে?’
‘ ভদ্র ভাবে কথা বলুন।’ রেগে গেল চারু।
চারুর রাগ দেখে পিনাক চিৎকার করে উঠল,’এতো বড়ো সাহস বাড়ির একটা সামান্য চাকরানি হয়ে তুই আমায় ভদ্রতা শেখাচ্ছিস?’
পিনাক চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তুলে নিলো। চারু রাগে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটার অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ আর সহ্য হচ্ছে না ও তবুও নিজেকে সামলে দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে আছে। এক দৃষ্টিতে চারু ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে আছে। বাসার সবাই পিনাকের চিৎকার চেঁচামেচিতে রুমে এক দন্ড ও থাকতে পারেনি দৌড়ে এসেছে সবাই। সবার সামনে পিনাক চিৎকার করে নিজের আব্বু কে বলে উঠল,’ আব্বু এই ফকিন্নীর বাচ্ছা আমাকে অভদ্র বলেছে। আমাকে বলেছে ওকে সম্মান দিয়ে কথা বলতে। ও আমায় যা নয় তাই বলে অপমান করেছে।’
পিনাকের বাবা বলে উঠলেন,’ কি এই ছোটো লোকের বাচ্ছার এতো স্পর্ধা ও আমার মেয়েকে অপমান করে?’
রাগে তিনি লাল হয়ে উঠলেন। বাসায় একটা হুইস্থল পড়ে গেল। সবাই পিনাকের কথায় যা খুশি তাই বলে সমানে চারু কে অপমান অপদস্থ করতে উঠেপড়ে লাগল। চারু মাথা নিচু সবার কথা শুনছে সবার মাঝে একজন কেও ও নিজের পাশে পাচ্ছে না। দিশেহারা লাগছে সবার দিকে এক পলক তাকাতেই দেখতে পেল সবাই ওর দিকে একটা কথাই বারবার ছুড়ে মারছে ছোটো লোক ফকিন্নী কথাগুলো ওর কানে গিয়ে লাগছে। চারু ছলছল চোখ সবার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠল,’ চুপ করুন সবাই। দয়া করে চুপ করুন।’
সবার চিল্লাচিল্লিতে চারুর মাথা ভনভন করে ঘুরছে নিজেকে ভীনদেশী লাগছে এই বাসা থেকে ছুটে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য চারু সদর দরজার দিকে দৌড় দিতে চাইল তখনি এক জোড়া হাত ওকে আঁকড়ে ধরল সবার সামনে। চারু সহ বাসার সবার চোখ জোড়া বিষ্ময় এ চরকগাছ হয়ে গেল।
#চলবে…?